কার খাতা? প্রদোষের খাতা? অবশ্যই না। প্রদোষের খাতার প্রতিটি অক্ষর সে অন্য খাতায় কপি করে নেবে। সে খাতার প্রথম পাতায় সে লিখবে–Some Notes on Longevity by S. S. Bose. তারপর তার প্রথম কাজ হবে প্রদোষের ফরমুলা অনুযায়ী আয়ুবৃদ্ধির ড্রাগটি প্রস্তুত করা। একটা বাদে কোনও উপাদানই দুষ্প্রাপ্য নয়। যেটি দুষ্প্রাপ্য সেটিও অর্থ আর ব্যক্তিগত প্রভাবের বিনিময়ে লভ্য।
আজ তারিখ ৩রা অগস্ট ১৯৭২। আজ শশাঙ্ক তার ড্রাগ প্রস্তুতের কাজ শুরু করবে। কিন্তু তার আগে প্রদোষের খাতাটি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা দরকার। অন্য কাজ সমস্ত করা হয়ে গেছে। একটি বড় সাইজের কালো খাতায় শশাঙ্ক প্রদোষের লেখা কপি করে নিয়েছে। বাগচির মনে যাতে কোনও সন্দেহের উদ্রেক না হয় তার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। এই ছমাসে একাধিকবার শশাঙ্ক তাঁর সঙ্গে বসে আয়ুবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছে। বাগচি প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, পরে আনন্দিত হয়েছেন ও তাকে উৎসাহ দিয়েছেন, বুঝেছি, প্রদোষের ব্যক্তিত্বই এতদিন তোমার নিজের ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ হতে দেয়নি। বন্ধুবিচ্ছেদে উপকার হয়েছে তোমার। এটা অস্বাভাবিক নয়। মানুষের মন বড় বিচিত্র জিনিস।…করে যাও তোমার কাজ। সাহায্যের প্রয়োজন হলে চাইতে দ্বিধা কোরো না। ফরমুলাটির কথা বাগচিকে বলেনি সে। অনেক ভেবেই সে স্থির করেছে যে, একেবারে ড্রাগটি প্রস্তুত করে তবে সে সবকিছু প্রকাশ করবে।
এত করেও আজ প্রদোষের খাতাটি নষ্ট করার পূর্ব মুহূর্তে সে কেন দ্বিধা বোধ করছে?
শশাঙ্ক বুঝল যে, বিবেক বলে যে বস্তুটি মানুষের অন্তরের একটি নিভৃত কক্ষে বাস করে, সেই বিবেকই এই সংশয়ের কারণ। কিন্তু আজকের দিনে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে গেলে সত্যিই কি ওই বস্তুটির কোনও প্রয়োজন আছে? গত কয়েক দশকের পৃথিবীর ইতিহাসে কতগুলি প্রধান ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কি এই সত্যটাই প্রমাণ হয় না যে, বিংশ শতাব্দীতে বিবেক জিনিসটার কোনও মূল্য নেই? হিটলারকে আজ যারা নিন্দা করে, সাময়িক হলেও হিটলারের মতো প্রতিপত্তি তাদের কজনের ভাগ্যে জুটেছে? হিরোশিমার উপর আণবিক বোমা বর্ষণ করেও আমেরিকার সম্মানে কোনও হানি হয়েছে কি? আসলে আজকের দিনে বিজ্ঞানের প্রসারই যখন মানুষের মন থেকে পরলোক পরজন্ম ইত্যাদির চিন্তা মুছে ফেলে দিয়েছে, তখন বিবেক জিনিসটার সত্যিই আর কোনও প্রয়োজন নেই।
শশাঙ্ক মনে জোর পেল।
পকেট থেকে দেশলাই বার করে প্রদোষের খাতার মলাটের একটি কোণে অগ্নিসংযোগ করে খাতাটা হাত থেকে মেঝেতে ফেলে দিল।
হাতের ঘড়িতে হিসাব করে শশাঙ্ক দেখলে খাতাটি পুড়তে সময় লাগল সাড়ে তিন মিনিটের কিছু বেশি।
.
ড্রাগ-প্রস্তুত পর্বের বিস্তারিত বিবরণ এ কাহিনীতে কেন নিষ্প্রয়োজন, সেটা যথাস্থানে প্রকাশ্য। আপাতত অন্য একটি ঘটনাকে প্রাধান্য দিতে হয়।
৩রা অগস্ট সকাল সাড়ে নটায় প্রদোষ শশাঙ্কর খাতাটি পুড়িয়ে ফেলে। দ্বিপ্রহরিক আহার সেরে সে তার বালিগঞ্জের সর্দার শশাঙ্ক রোডের ফ্ল্যাট থেকে যাবে বেলঘরিয়া। সেখানে তার এক মামার একটি প্রায়-পরিত্যক্ত বাগানবাড়ির একটি ঘরে, গত ছমাসের মধ্যে সে একটি ল্যাবরেটরি তৈরি করেছে। ড্রাগটি প্রস্তুত হবে এই ল্যাবরেটরিতেই–তবে দিনের বেলা নয়–মধ্যরাত্রে।
খেতে বসার মুখটিতে শশাঙ্ক একটি টেলিফোন পেল।
কে, শশাঙ্ক?…চিনতে পারছিস?
সে কী? কবে এলি?
অমিতাভ বিলেত থেকে ফিরে এসেছে–অপ্রত্যাশিত ভাবে।
কাল সকালে।
কী ব্যাপার?
বোনের বিয়ে। ভাবতে পারিস? যাবার সময় দেখে গেছি ফ্রক পরছে!
শশাঙ্ক হাসে। কেমন আছিস?
আমি তো ভালই। তুই কেমন?
সো-সো?…কিন্তু খবর জানিস তো?
প্রদোষের ব্যাপার তো? টেরিবল! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি।Whom the Gods love… জানা আছে তো?
খুব জানি। যে কারণে আমার বিশ্বাস আমাদের কপালে অনেক দুঃখভোগ আছে।
আশ্চর্য! মৃত্যুর মাসখানেক আগেও ওর একটা চিঠি পেয়েছি। আগে কোনওদিন লেখেনি। ওই প্রথম, আর ওই শেষ।
শশাঙ্কর গলাটা ধরে গেল।
তোকে চিঠি…তুই…?
কী হল?
না না। মানে–তোকে চিঠি লিখেছিল?
আর বলিস না। তখন কাজে বেরোচ্ছি–ভীষণ তাড়া। চিঠিটা এল, একবার কোনওরকমে চোখ বুলিয়ে হাতে একটা পেপারব্যাক ছিল, তার মধ্যে রেখে দিলুম, আর সেটা কোথায় যে হাত থেকে স্লিপ করে পড়ল। বোধহয় টিউবেই।
সে কী রে?
এত আফসোস হল! বেশ বড় চিঠি, জানিস! আর ফুঁ অফ ইন্টারেস্টিং থিংস। কী জানি কী একটা নিয়ে রিসার্চ করছিল। সামথিং টু ডু উইথ…উইথ…
শশাঙ্কর গলায় শ্লেষ্ম। একবার কেশে নিয়ে সে বলল, লন্ডনের হাওয়ায় তোর স্মৃতিশক্তিটা অ্যাফেক্টেড হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে?
ও ইয়েস ইয়েস! মনে পড়েছে। লঞ্জিভিটি, লঞ্জিভিটি! আসল ব্যাপারটা কী জানিস? আমার নিজের আবার আয়ুবৃদ্ধির ব্যাপারে খুব বেশি ইন্টারেস্ট নেই। ঠাকুরদাকে দেখেছি তো–আশি বছর বয়স অবধি কী জ্বালান জ্বালিয়েছেন। আরও পঞ্চাশটা বছর যদি ও জ্বালানি সইতে হত–উঃ।
সমস্ত ব্যাপারটা হালকা করার উদ্দেশ্যে শশাঙ্ক একটা হাসির চেষ্টা দিতে গিয়ে ব্যর্থ হল। তারপর সে বলল, এমন একটা ব্যাপার নিয়ে সে ভাবছিল, আর তার একটা নোট পর্যন্ত নেই!
নোট নেই? কিন্তু ও যে–তুই ঠিক বলছিস তো?