খাতাটি পাওয়ার পরেও শশাঙ্ককে সেটি পড়ার লোভ সংবরণ করতে হয়েছিল কয়েকদিন, কারণ প্রদোষের রচনা নির্বাচনের কাজ তখনও শেষ হয়নি। বারোদিনের দিন কাজ শেষ হবার পর খাতাটি আদ্যোপান্ত পড়ে নিয়ে শশাঙ্ক প্রফেসর বাগচিকে তাঁর অনুরোধ অনুযায়ী খবর দিল।
আপনি এবারে আসতে পারেন স্যার। আমার কাজ খতম।
সাকসেসফুল?
আসুন। এসে দেখুন!
আই উইল বি দেয়ার ইন অ্যান আওয়ার।
টেলিফোন রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিভা চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। রোজই এই সাড়ে চারটের সময় নিভা তাকে চা এনে দিয়েছে, এবং রোজই এই মুহূর্তটিতে শশাঙ্ক একটা হৃৎস্পন্দন অনুভব করেছে। নিভা থান পরে না। তার পরনের সরু কালো পাড়ের মিলের শাড়ি তার অজ্ঞাতসারেই যেন তার রূপকে একটি স্নিগ্ধ আভিজাত্য দান করেছে।
কাজ শেষ?
হ্যাঁ।
কত পরিশ্রম করলেন আপনি!
সব সার্থক। আশ্চর্য সব লেখা আবিষ্কার করেছি।
কেন জানি শশাঙ্ক ঠিক এই মুহূর্তে নীল খাতাটির কথা আলাদা করে বলতে পারল না নিভাকে। কিন্তু সত্য গোপন করা তো আর মিথ্যাভাষণ নয়–আর সত্য উদঘাটনের সময় তো পড়েই আছে সামনে। বাগচি এলে তখন তো কথা হবেই।
নিভাকে দেখে একটি প্রশ্নই কেবল শশাঙ্কর মনে জাগে। সে কি বিয়ে করে সুখী হয়েছিল? এ কদিনে এতবার দেখেও শশাঙ্ক এ-প্রশ্নের উত্তর পায়নি। কিন্তু প্রদোষকে বিবাহ করে সে সুখী হয়নি, এমন সন্দেহ তার মনে উদয় হবে কেন? জিনিয়াসের স্ত্রীর জীবনে শূন্যতা থাকতে বাধ্য, এমন একটা প্রচলিত বিশ্বাসই কি এই সন্দেহের উৎস?
বাগচি এলেন প্রায় ছটা।
কীরকম বুঝেছ হে?
রিমার্কেবল। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও অনেক বেশি। রচনার সংখ্যাও বেশি, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যও যা আন্দাজ করেছিলাম তার চেয়ে বেশি।
আমি একটা মেমোরিয়াল ভলমের কথা ভাবছি। সেটা হল ইমিডিয়েট কাজ। তোমার সাহায্য চাই–বলাই বাহুল্য।
শশাঙ্কর প্যান্টের ডান পকেটে সেই নীল খাতা। মানুষের আয়ুবৃদ্ধির সম্ভাবনা সম্পর্কে যুগান্তকারী গবেষণা।
পশ্চিমের আধুনিকতম গবেষণা ও প্রাচ্যের সুপ্রাচীন আয়ুর্বেদিক জ্ঞানের সংমিশ্রণে লব্ধ এলিক্সির অফ লাইফ, অথবা আয়ুবৃদ্ধিকর ড্রাগ প্রস্তুত প্রণালীর বর্ণনা। প্রদোষের মতে এই ড্রাগ ইঞ্জেকশনের ফলে মানুষ বাঁচবে অন্তত দেড়শো বছর। ব্যক্তিবিশেষের মেটাবলিজম অনুযায়ী আয়ুর তারতম্য হবে অবশ্যই–তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দুশো-আড়াইশো বছর বাঁচাও অসম্ভব নয়। এই ড্রাগের অবশ্যম্ভাবী সাফল্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছে প্রদোষ।
শশাঙ্কর ডান হাতটা অন্যমনস্ক ভাবেই তার প্যান্টের ডান পকেটে প্রবেশ করল।
বাগচি এতক্ষণ প্রদোষের লেখাগুলি নেড়েচেড়ে দেখছিলেন।
১৯৭০ পর্যন্ত ওর কাজের ও চিন্তাধারার বেশ একটা ধারাবাহিক ছবি পাওয়া যাচ্ছে হে।
হ্যাঁ স্যার।
কিন্তু এই কি সব? আর কোনও খাতা নেই?
শশাঙ্কর হঠাৎ গরম লাগছে। সে হাতের কাছে পাখার রেগুলেটারটা তিন থেকে পাঁচের ঘরে ঠেলে দিল।
বাগচি আবার বললেন, তুমি সব জায়গায় খুঁজে দেখেছ?
নিভা আবার ঘরে এসেছে। এবার প্রফেসর বাগচির জন্য চা ও মিষ্টি।
শশাঙ্ক একটা গলা খাকরানি দিয়ে বলল, দেখেছি স্যার।
কিছু পাওনি? হয়তো আলগা ফুলস্ক্যাপ কাগজে কিছু থাকতে পারে। ওর মাথাটা যে পরিমাণে পরিষ্কার ছিল, কাজের পদ্ধতিটা তো সবসময়ে ঠিক সেরকম…
শশাঙ্ক ডান হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে পকেটের খাতাটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।
আর কিছুই পাইনি স্যার।
পরিষ্কার গলায় অস্বীকারোক্তিটা ঘুপচি ঘরে অস্বাভাবিক রকম গম্ভীর শোনালো।
হুঁ বলে বাগচি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। বাগচি কি তাকে সন্দেহ করছেন? কিন্তু এসন্দেহ যে দূর করতে হবে। শশাঙ্ক তার গলার স্বর আরও দৃঢ় করল।
এ ঘরে আর কোথাও কিছু নেই।
বাগচি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অবিশ্যি এই তেতাল্লিশ বছরের জীবনে প্রদোষ যা করে গেছে তার কোনও তুলনা নেই, কিন্তু তাও… বাগচি নিভার দিকে চাইলেন। বউমা কিছু হেল্প করতে পারো?
নিভা তার শান্ত আয়ত চোখ দুটি বাগচির দিকে তুলল।
বাগচি প্রশ্নটিকে আরেকটু বিশদভাবে ব্যক্ত করলেন, প্রদোষ তার জীবনের শেষ দুটো বছর কী নিয়ে ভেবেছে তার কোনও লিখিত ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। তোমায় সে মুখে কখনও কিছু বলেছে কি? বুঝতেই তো পারছ–তার চিন্তার সামান্য কণাটুকুরও আজ মূল্য অনেক।
নিভা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ধীর সংযত কণ্ঠে বলল, তাঁর কাজ সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি আমাকে।
বাগচি এবার বললেন, তাকে ইদানীং কিছু লিখতেও দেখোনি?
এ প্রশ্নের উত্তর শশাঙ্কই দিল।
আমি তো বলছি স্যার। কোনও জায়গা বাদ রাখিনি। তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
শশাঙ্ক মন স্থির করে ফেলেছে। প্রদোষের শেষ রচনাটি আর প্রদোষের থাকবে না। এটা হবে তার নিজেরই লেখা, নিজেরই গবেষণা, নিজেরই জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার ফল। দ্বন্দ্ব তো কেবল নিজের মনের সঙ্গে, বিবেকের সঙ্গে–আর তো কেউ জানবেও না, বুঝবেও না। আজ থেকে ছমাস হ্যাঁ, অন্তত ছমাস সে কাউকে কিছু জানাবে না। ছমাস সময়টার প্রয়োজন আছে। কারণ মিথ্যাটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। এই কটা মাস তাকে আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে পড়াশুনা করতে হবে। বাগচির মতো লোকের মনে যাতে কোনও সন্দেহ না স্থান পায়। মাঝে মাঝে তাকে বাগচির সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দেবে যে, আয়ুবৃদ্ধির প্রশ্নটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে, সে নিয়ে সে পড়াশুনা করছে, রিসার্চ করছে। তারপর সময় হলে সে খাতাটা বাগচিকে দেখাবে।