শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩৭৭
ময়ূরকণ্ঠি জেলি
শশাঙ্ক টেবিলের উপর থেকে খাতাটা তুলে নিল।
নীল মলাটের ছোট সাইজের সাধারণ নোটবুক! দাম বোধহয় আজকের দিনে আনা আষ্টেক। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে শশাঙ্ক এরকম নোটবুক ব্যবহার করেছে, তখন দাম ছিল দুআনা। মনে আছে তখন হঠাৎ ডায়রি লেখার শখ হয়েছিল। কিন্তু সাধারণ ডায়রির পাতায় কুলিয়ে উঠত না, কারণ শশাঙ্ক কেবল দৈনন্দিন কার্যকলাপের বর্ণনাই লিখত না। সে সম্পর্কে দার্শনিক মন্তব্য, আপন চিন্তাভাবনার বিশ্লেষণ, এমনকী মাঝে মাঝে রাত্রে দেখা স্বপ্নের বিবরণ পর্যন্ত লিখে অস্তিত্বের ব্যাপারটাকে একটা সাহিত্যিক মর্যাদা ও স্থায়িত্ব দেওয়ার প্রবৃত্তি তখন শশাঙ্কর মনে জেগেছিল।
কিন্তু অভ্যাসটা এক বছরের বেশি টেকেনি। একাগ্রতা জিনিসটা শশাঙ্ককে চিরকালই এড়িয়ে গেছে–যে কারণে মেধাবী ছাত্র হয়েও পরীক্ষায় চমকপ্রদ ফললাভের সৌভাগ্য থেকে সে চিরকালই বঞ্চিত হয়েছে। যাকে বলে গুড সেকেন্ড ক্লাস শশাঙ্কর স্থান আজীবন সেই পঙক্তিতেই রয়ে গেছে। তার ডায়রিটিও শশাঙ্ক হারিয়ে ফেলেছে কবে কীভাবে তা মনে নেই।
এ খাতাটা অবিশ্যি দিনপঞ্জি নয়। শশাঙ্ক প্রথম পাতাটার দিকে চাইল। সরু কলমে কালো কালিতে yang Pet C. 971–Some Notes on Longevity-P. Sarkar, 14 July, 1970.
প্রদোষের খাতা। প্রদোষের জিনিয়াসের সর্বশেষ নিদর্শন। খাতার অর্ধেক পাতায় কালির আঁচড় পড়েনি। আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে তার শেষ কথা প্রদোষ বলে যেতে পারেনি। ১৯৭১ সনের ১৭ই ডিসেম্বর বিয়াল্লিশ বছর তিন মাস বয়সে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে প্রদোষের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বায়োকেমিস্ট হিসেবে প্রদোষ তার জীবনের শেষ দুটি বছর কোন বিশেষ গবেষণায় লিপ্ত ছিল, সে সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক মহলে অনেক জল্পনা কল্পনা হয়েছিল, কিন্তু তার কোনও সঠিক সন্ধান পাওয়া যায়নি।
আজ সে সন্ধান জানে কেবল একটিমাত্র ব্যক্তি–শশাঙ্কশেখর বোস।
আপনি বাবার বন্ধু ছিলেন, তাই মা-র ইচ্ছে আপনি বাবার কাগজপত্রগুলো দেখে, সেগুলোকে গুছিয়ে-টুছিয়ে যদি একটা…মানে…
প্রদোষের চৌদ্দ বছরের ছেলে মণীশ ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝাতে না পারলেও, শশাঙ্কর বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি। প্রদোষের কাগজপত্রের অবিন্যস্ত সম্ভারে শৃঙ্খলা আনয়ন, তার অপ্রকাশিত রচনাবলীর একটি তালিকা প্রস্তুত করায় শশাঙ্কর কোনও আগ্রহের অভাব ছিল না। প্রদোষের জীবদ্দশায়, কলেজে সহপাঠের সময় থেকেই শশাঙ্ক প্রদোষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েও তাকে ঈর্ষা না করে পারেনি। প্রথমে ঈর্ষা করেছে তার মেধাকে, পরে তার খ্যাতি ও লেখনীশক্তিকে।
ঈর্ষার আরেকটি কারণ–নিভা মিত্রকে প্রদোষের পত্নীরূপে লাভ। অধ্যাপক ভাস্কর মিত্রের কন্যা নিভার সঙ্গে দুই বন্ধুরই একসঙ্গে আলাপ হয় অধ্যাপকের বাড়িতেই। অপেক্ষাকৃত সুপুরুষ হয়েও একদিনের আলাপেই শশাঙ্ক প্রদোষের কাছে হার মানতে বাধ্য হয় কারণ নিভার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ক্ষণিকের আলাপেই মানুষের বাইরের আবরণ ভেদ করে অন্তরের রূপটি ধরে ফেলার।
তিন মাস কোর্টশিপের পর নিভর সঙ্গে প্রদোষের বিবাহ হয়। প্রদোষ বলেছিল, খ্রিস্টান বিয়ে হলে তোকে বেস্টম্যান করতুম।শশাঙ্ক নিজে আর বিয়ে করেনি। না করার কারণ তার নিজের কাছে স্পষ্ট–নিভাকে সে ভুলতে পারেনি। এমন অন্য কোনও মেয়েও তার চোখে পড়েনি যে, স্মৃতি তার মন থেকে মুছে ফেলতে পারে।
কিন্তু আজ যখন প্রদোষ মৃত, তখন তো আর ঈর্ষার প্রশ্ন ওঠে না। তাই মণীশের অনুরোধ শশাঙ্ক ঠেলতে পারেনি। প্রদোষের বাড়ির তিনতলার পূর্ব দিকের স্বল্পায়তন ঘরটিতে বারোদিন অহোরাত্র পরিশ্রম করে শশাঙ্ক তার পরলোকগত বন্ধুর লেখা প্রবন্ধগুলি রচনাকাল অনুযায়ী ধারাবাহিক ভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল।
নীল নোটবইটি চোখে পড়ে অষ্টম কিংবা নবম দিনে। একটি বুক শেলফের সবচেয়ে উপরের তাকে মেচনিকফের একটা বইয়ের পিছনে খাতাটি আত্মগোপন করে ছিল। মনে পড়ে, খাতাটি পেয়ে এবং তার বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত পেয়ে উত্তেজনায় শশাঙ্কর শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়েছিল। আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে প্রদোষের এ-গবেষণার কথা কেউ জানে না–এমনকী প্রোফেসর বাগচিও না। প্রদোষকে নিয়ে বাগচির সঙ্গে শশাঙ্কর আলোচনা হয় প্রদোষের মৃত্যুর কয়েকদিন আগেই। বাগচি তখন বলেন, কিছুদিন থেকেই প্রদোষ যেন কী একটা ভাবছে। এটা তার অন্যমনস্কতা থেকেই বুঝেছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। তোমায় কিছু বলেছে কি?…
বাগচি তাঁর তেইশ বছরের অধ্যাপক জীবনে প্রদোষের মতো ছাত্র পাননি। প্রদোষ যে অনেক আগেই অনেক বিষয়েই তার শিক্ষককে অতিক্রম করে গিয়েছে, সেটা বাগচি নিজেও স্বীকার করতেন। বাগচির গভীর বিশ্বাস ছিল যে, বায়োকেমিস্ট্রির জগতে প্রদোষ কোনও একটা যুগান্তকারী অবদান রেখে যাবে। তাই তার ভাবনাচিন্তা গবেষণা ইত্যাদি সম্পর্কে বাগচির কৌতূহল ছিল অপরিসীম। কিন্তু বাগচি এই খাতাটি সম্পর্কে জানতেন না।
বাগচি ছাড়া আর যে দুজনের জানার সম্ভাবনা ছিল, সে হল শশাঙ্ক নিজে এবং প্রদোষ ও শশাঙ্কর বন্ধু অমিতাভ। অমিতাভ আজ পাঁচ বছর হল লন্ডনের ফ্রীডম্যান ল্যাবরেটরিজ-এর কাজ নিয়ে দেশছাড়া। তাই খাতার ব্যাপারটা তার কাছেও অজ্ঞাত বলে অনুমান করা যেতে পারে।