আর্যশেখর আরেকবার বাপের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
বাবা, আমাদের বংশলতিকা নেই?
বংশলতিকা? কেন?
আছে?
থাকলেও তা উইয়ে খেয়েছে। কেন, তুই কি জাতিস্মর-টাতিস্মর হলি বলে মনে হচ্ছে?
না, ভাবছিলাম, আমার পূর্বপুরুষদের মধ্যে কেউ প্রতিভাবান ছিলেন কিনা। তোমার আর ঠাকুরদাদার কথা তো জানি। তার আগে?
সাতপুরুষের মধ্যে কেউ ছিলেন না, এ গ্যারান্টি দিতে পারি। তার আগের কথা জানি না।
ঘরে ফিরে এসে আর্যশেখর চিন্তা শুরু করলেন। বাপের দিকে সাতপুরুষের মধ্যে কেউ নেই। মাতৃকুলেও তথৈবচবরং সেখানে সম্ভাবনা আরও কম। গুণের দিক দিয়ে নীহারিকা দেবী অত্যন্ত সাধারণ শ্রেণীর মহিলা। তিনি এখনও তাঁকে খোকা বলে সম্বোধন করেন বলে আর্যশেখর পারতপক্ষে তাঁর কাছে। ঘেঁষেন না।
হেরিডিটির প্রভাব অনিশ্চিত। পরিবেশ? এনভায়রনমেন্ট? তেত্রিশ নম্বর পটুয়াটোলা লেন কি সেদিক দিয়ে খুব প্রশস্ত বলা চলে? বোধহয় না। তা হলে?
কিন্তু শুধুমাত্র হিসেব দিয়েই কি সত্যিকার কিছু প্রমাণ হয়? বাবার বাবা তার বাবা করে বংশলতিকা জিনিসটাকে তো টেনে একেবারে সৃষ্টির আদিতে নিয়ে যাওয়া যায়। জিনের প্রভাব কি তখন থেকেই প্রবাহিত হয়ে আসছে না? কে জানে আজ থেকে বিশ হাজার বছর আগে আর্যশেখরের পূর্বপুরুষ কে বা কেমন ছিলেন! এমনও তো হতে পারে তিনি আলতামিরার গুহায় দেয়ালে বাইসনের ছবি এঁকেছিলেন। এইসব আদিম গুহা চিত্রকরদের জিনিয়াসের পর্যায়ে ফেলা যায় না? অথবা হরপ্পা মহেনজোদরোর মতো শহরের পরিকল্পনা করেছিলেন যাঁরা তাঁদের? অথবা বেদ উপনিষদের রচয়িতাদের? এঁদের মধ্যে কেউ যদি আর্যশেখরের পূর্বপুরুষ হয়ে থাকেন তা হলে আর চিন্তার কোনও কারণ থাকে না। কিন্তু তবু তাঁর মনটা খচখচ করতে লাগল। সৌম্যশেখরের মতো কল্পনা-বিমুখ বৈষয়িক-চিন্তাসর্বস্ব স্থূল ব্যক্তি যে তাঁর জন্মদাতা হতে পারেন, এর কোনও বৈজ্ঞানিক সমর্থন তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
ভাবতে ভাবতে সহসা একটি সম্ভাবনা এসে তাঁর মনে দুরমুশের মতো আঘাত করল।
তিনি যদি জারজ সন্তান হয়ে থাকেন? যদি সৌম্যশেখরের ঔরসে তাঁর জন্ম না হয়ে থাকে?
কথাটা মনে হতেই আর্যশেখর বুঝলেন, এ প্রশ্নের উত্তর একমাত্র তাঁর বাবাই দিতে পারেন এবং সে উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। সত্যান্বেষণের খাতিরে পুত্র পিতাকে প্রশ্ন করবে, এটা আর্যশেখরের কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হল।
নশো চব্বিশ পৃষ্ঠার সুবৃহৎ ল ডাইজেস্টে নিমগ্ন সৌম্যশেখর পুত্রের প্রশ্ন প্রথমবার অনুধাবন করতে পারলেন না।
যমজ সন্তান? কার কথা বলছিস?
যমজ নয়, জারজ। আমি জানতে চাই আমি জারজ সন্তান কিনা।
একথায় সৌম্যশেখরের ওষ্ঠদ্বয় বিভক্ত হল। তারপর তাতে কম্পনের আভাস দেখা দিল। তারপর সে কম্পন তাঁর সমস্ত দেহে সঞ্চারিত হল। তারপর তাঁর কম্পমান ডান হাত কাছে আর কিছু না পেয়ে একটি ভারী কাঁচের পেপারওয়েট তুলে আর্যশেখরের দিকে নিক্ষেপ করল। আর্যশেখর আনাদ করে রক্তাক্ত মস্তকে ভূলুণ্ঠিত হলেন।
আরোগ্যলাভের পর বোঝা গেল আর্যশেখরের অলৌকিক গাণিতিক প্রতিভাটি নষ্ট হয়েছে। কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল।
.
আর্যশেখরের যখন উনিশ বছর বয়স, তখন একদিন সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে একটি শিরীষ গাছের নীচে উপবিষ্ট অবস্থায় বৃক্ষস্থিত কোনও পক্ষীর বিষ্ঠা তাঁর বাম স্কন্ধে এসে পড়ায় তিনি সহসা মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে সচেতন হলেন। যথারীতি তিনি এ বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেন। তাঁর ধারণা ছিল নিউটনের আপেলের ঘটনাটা বুঝি কিংবদন্তি। প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের নিজের লেখায় সে ঘটনার উল্লেখ দেখে তাঁর ধারণার পরিবন হল। তাইকো ব্রাহি গ্যালিলিও থেকে শুরু করে কোপারনিকাস, কেপলর, লাইবনিৎস-এর রাস্তা দিয়ে ক্রমে আর্যশেখর আইনস্টাইনে পৌঁছে গেলেন। আর্যশেখরের বিদ্যায় আইনস্টাইন জীর্ণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু পাঠ্য-অপাঠ্য বোধ্যদুর্বোধ্য সবরকম পুস্তকই আদ্যোপান্ত পাঠ করার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল আর্যশেখরের। অবিশ্যি বর্তমান ক্ষেত্রে তাঁর পড়ার আগ্রহের একটা কারণ ছিল এই যে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে শেষ কথা বলা হয়ে গেছে কিনা। আইনস্টাইন পড়ে এইটুকু তিনি বুঝলেন যে মাধ্যাকর্ষণ কী তা জানা গেলেও মাধ্যাকর্ষণ কেন, তা এখনও জানা যায়নি। তিনি স্থির করলেন, এই কের অম্বেষণই হবে আপাতত তাঁর জীবনের প্রধান লক্ষ্য।
।সেইদিনই আর্যশেখর স্থির করলেন যে, তিনি যাবতীয় তুচ্ছ ঘটনার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। অনেক আবিষ্কারের পশ্চাতেই যে নিউটনের আপেলের মতো একটি করে তুচ্ছ ঘটনা রয়েছে, এটা তাঁর জানা ছিল।
দুঃখের বিষয়, প্রায় তিন মাস ধরে সহস্রাধিক তুচ্ছ ঘটনা লক্ষ করেও তিনি তাদের মধ্যে এমন কিছু দেখতে পেলেন না, যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক আগেই হয়ে যায়নি। অগত্যা আর্যশেখরকে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে হল। উপলব্ধির আদিতে ধ্যান–এই বিশ্বাসে তিনি তাঁর বাড়ির তিনতলার ছাতে চিলেকোঠায় গিয়ে ধ্যানস্থ হতে মনস্থ করলেন।
প্রথম দিনই–সেদিন ছিল রবিবার, ছাতে উঠে চিলেকোঠার তক্তপোশে বসে চক্ষু মুদ্রিত করার অব্যবহিত পূর্বে জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির ছাতে একটি তুচ্ছ ঘটনা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রতিবেশী ফণীন্দ্রনাথ বসাকের সপ্তদশ বর্ষীয়া কন্যা ডলি বাহু উত্তোলন করে ধৌতবস্ত্র রজ্জুতে আলম্বিত করছে। এই দৃশ্যে মুহূর্তের মধ্যে আর্যশেখরের মন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কিত এক আশ্চর্য নতুন জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।