আমি এবার একটু হালকাভাবেই বললাম, সে কী হে! তোমার চিন্তাধারা পালটানোর প্রয়োজন আছে বলে তো আমার মনে হয়নি কখনও।
ভাণ্ডারকার আমার ঠাট্টায় কর্ণপাত করল না। একটা হাতের উপর আর একটা হাত মুঠো করে রেখে। আমার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ে, তার অস্বাভাবিক রকম পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে সে বলল, অবনীশ–মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, সৌহার্দ্যে আর আমি বিশ্বাস করি না। দুর্বলের সঙ্গে সবলের, ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের, মূর্থের সঙ্গে মনীষীর সৌহার্দ্য হবে কী করে? আমরা মানবিকতা বলে একটা জিনিসে বিশ্বাস করি, যেটার আসলে কোনও ভিত্তিই নেই। ইকুয়েটর-এর মানুষের সঙ্গে মেরুর দেশের মানুষের মিল, হবে। কোত্থেকে! মঙ্গোলয়েড আর এরিয়ান-এ যা মিল, বা নর্ডিক ও পলিনেশিয়ান-এ যা মিল, বাঘে আর গোরুতেও ঠিক ততখানি মিল। হেরেডিটি, এনভাইরনমেন্ট ও অদৃষ্ট–এই তিনে মিলে মানুষে মানুষে যে প্রভেদের সৃষ্টি করে–সেখানে মৈত্রীর বুলি কোন কাজটা করতে পারে? কালো মানুষ নির্যাতিত হবে কেন? তাদের চেহারা দেখোনি, ফিজিওগনোমি লক্ষ করোনি? মানুষের চেয়ে বানরের সঙ্গেই যে তাদের মিলটা বেশি, সেটা লক্ষ করোনি?
ভাণ্ডারকার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে এমন দৃষ্টি এর আগে কখনও দেখিনি।
আমার কণ্ঠস্বর যথাসাধ্য সংযত করে বললাম, ভাণ্ডারকার, তুমি নেশা করেছ কিনা জানি না। কিন্তু তোমার কথার তীব্র প্রতিবাদ না করে আমি পারছি না। এতগুলো ছাত্রের ভবিষ্যৎ হাতে নিয়েও যার এমন। মতিভ্রম হতে পারে, তাকে আমি বন্ধু বলে মানতে রাজি নই। আমার এখনও একটা ক্ষীণ আশা আছে যে, এটা তোমার একটা রসিকতা; যদিও তাই বা হবে কেন জানি না, কারণ আজ তো পয়লা এপ্রিল নয়।
ভাণ্ডারকার এক পা পিছিয়ে গিয়ে বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, অবনীশ, তোমাদের মতো লোকের সারা জীবনটাই হল পয়লা এপ্রিল, কারণ তোমরা বোকা বনেই আছ। আমিও তোমাদের দলেই ছিলাম এতদিন, কিন্তু এখন আর নেই। আমার চোখ খুলে গেছে। আমার ছাত্ররা যাতে আমার পথে চলতে পারে, এখন থেকে সেটাই হবে আমার লক্ষ্য। আমি ওদের বুঝিয়ে দেব যে, আজকের দিনেও যে কথাটা সত্যি সেটা হল সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা–সারভাইভ্যাল অফ দি ফিটেস্ট। যারা সবল, তারা যদি তাদের শক্তি প্রয়োগ করে দুর্বলদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে, তবেই জগতের মঙ্গল।
যে শক্তির কথা আমি বলছি সেটা অল্পদিনের মধ্যেই পৃথিবীর লোকে অনুভব করবে–তুমিও করবে। বিশ্ব-মৈত্রীর ধোঁয়াটে অবাস্তব বুলিতে যারা বিশ্বাস করে, তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে, অবনীশ। কিন্তু আমরা
আছি, আমরা থাকব। আর আমাদের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, এবং বাড়বে। আমরাই হব পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি। আমি চললুম। গুড বাই।
কথা শেষ করে উলটোদিকে ঘুরে দৃপ্ত পদক্ষেপে গ্রিনহাউসের দরজার দিকে এগিয়ে যাবার সময়, একটা সাধারণ ফণীমনসার গায়ে ভাণ্ডারকারের বাঁ হাতটা ঘষে গেল।
একটা অস্ফুট আজাদ করে ভাণ্ডারকার তার কোটের পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে হাতের ওপর চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করলাম রুমালে রক্তের ছোপ লেগেছে। ভাণ্ডারকারও দেখল সে রক্ত, তারপর তার বিস্ফারিত দৃষ্টি আমার দিকে মুহূর্তের জন্য নিক্ষেপ করে সে ঝড়ের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে রক্তের কথা আমি কোনওদিনও ভুলব না, কারণ তার রঙ ছিল সবুজ।
ভাণ্ডারকার চলে যাবার পর আমি যে কতক্ষণ গ্রিনহাউসে বসে ছিলাম জানি না। কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আজ সকালে আমার প্রিয় সবুজ ঘরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেছি, তারপর আমার আর বেঁচে থাকার কোনও সার্থকতা আছে বলে মনে হয় না।
গিয়ে দেখি, আমার গাছপালার একটিও আর বেঁচে নেই। শুধু তাই নয়, প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সবুজ রঙটিও যেন কে শুষে নিয়েছে। যা রয়েছে, সেটা পাংশুটে–ভস্মের রঙ।…
আকাশবাণীর সাহিত্যবাসর অনুষ্ঠানে প্রচারিত।
১৬.২.৬৬, রাত্রি ৮টা।