শশাঙ্ক এবার লক্ষ করল যে, টেবিলের যত কাছে সে এগিয়ে আসছে, পাপড়ির আন্দোলন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরেকটি আশ্চর্য জিনিস শশাঙ্ক লক্ষ করল–এবারে উত্তাপের পরিবর্তে একটি পরম স্নিগ্ধ শীতলতা জেলি থেকে নিঃসৃত হয়ে তার দেহমনের সমস্ত অবসাদ দূর করে দিচ্ছে। শশাঙ্কর অজ্ঞাতসারেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল–কী অদ্ভুত। কী সুন্দর!
এবারে ফুলের একটি বিশেষ পাপড়িকে যেন লম্বিত হতে লক্ষ করল শশাঙ্ক। ফুলের সমস্ত জ্যোতিটুকু যেন সেই লম্বমান পাপড়ির অগ্রভাগে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে।
পাপড়িটি ক্রমশ একটি সাপের আকার ধারণ করল–তার উজ্জ্বল নীলাভ ফণাটি যেন কোনও অদৃশ্য সাপুড়ের বাঁশির সঙ্গে তাল রেখে দুলছে।
শশাঙ্ক অনুভব করল যে, ক্রমবর্ধমান শৈত্যে তার স্নায়ু সব অসাড় হয়ে আসছে।
জেলিসর্পের ফণার অগ্রভাগের অত্যুজ্জ্বল নীল জ্যোতি তার দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করছে।
শশাঙ্ক এখন শক্তিহীন, অনড়। জেলিসর্পের ফণা তার গলদেশ লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে এখন শশাঙ্কর কারণ ফণা তার গলদেশে বেষ্টন করে চাপ দিতে শুরু করেছে। ব্যান্ডেজবদ্ধ ডানহাতটা তুলে শশাঙ্ক ফাঁসমুক্ত হবার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করল। কিন্তু এ নাগপাশে সহ অজগরের শক্তি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই শশাঙ্কর নিষ্প্রাণ দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
ফণা তখন শশাঙ্ককে মুক্তি দিয়ে টেবিলের বিপরীত দিক লক্ষ্য করে এগিয়ে গেল। ফণার অগ্রভাগ থেকে এখন পাঁচটি নীলাভ আঙুল উদগত হয়েছে। সেই অঙ্গুলিবিশিষ্ট জেলিহস্ত শশাঙ্কর পেনসিলটি টেবিলের উপর থেকে অনায়াসে তুলে নিয়ে শশাঙ্করই কালো খাতার খোলা পাতার দিকে অগ্রসর হল।
.
মালি দুঃখীরাম যখন বেলঘরিয়া থানা থেকে ইনস্পেক্টর বসাককে তার মনিবের মৃতদেহ দেখতে নিয়ে এল তখন প্রায় রাত বারোটা। বসাক অবশ্য জেলিজাতীয় কোনও পদার্থর চিহ্ন দেখতে পাননি। শশাঙ্কর মৃতদেহ ছাড়া যে জিনিসটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেটি হল শশাঙ্কর নোটবুকের পাতায় শশাঙ্করই হস্তাক্ষরে একটি স্বীকারোক্তি–
আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী আমারই বিবেক।
শারদীয়া আশ্চর্য: ১৩৭২ (১৯৬৫)
সবুজ মানুষ
আমি যার কথা লিখতে যাচ্ছি তার সঙ্গে সবুজ মানুষের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, তা আমার সঠিক জানা নেই।
সে নিজে পৃথিবীরই মানুষ, এবং আমারই একজন বিশিষ্ট বন্ধু–স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক–প্রফেসর নারায়ণ ভাণ্ডারকার।
ভাণ্ডারকারের সঙ্গে আমার পরিচয় দশ বছরের–এবং এই দশ বছরে আমি বুঝেছি যে, তার মতো শান্ত অথচ সজীব, অমায়িক অথচ বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ খুব কমই আছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন জীবিত, ভাণ্ডারকার তখন শান্তিনিকেতনে ছাত্র ছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন তাকে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষত, বিশ্বমৈত্রীর যে বাণী রবীন্দ্রনাথ প্রচার করেছিলেন, সেবাণী ভাণ্ডারকার তার জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছিল। সে বলত, যতদিন না জাতিবিদ্বেষের বিষ মানুষের মন থেকে দুর হচ্ছে ততদিন শান্তি আসবে না। আমার অধ্যাপক জীবনে সবটুকু আমি আমার ছাত্রদের মনে বিশ্বমৈত্রীর বীজ বপন করে কাটিয়ে দিতে চাই।
সুইডেনে উপসালা শহরে সম্প্রতি যে দার্শনিক সম্মেলন হয়ে গেল, ভাণ্ডারকার তাতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। কাল বিকেলে উপসালা থেকে ফিরে এসে সে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
এখানে আমার নিজের পরিচয়টা একটু দিয়ে রাখি।
আমি যে জগৎটাকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জানি এবং ভালবাসি, সেটাকে সবুজ বলা বোধহয় খুব ভুল হবে না। আমার জগৎ হল গাছপালার জগৎ। অর্থাৎ আমি একজন বটানিস্ট। আমার দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটে গ্রিনহাউসের ভিতর। দুষ্প্রাপ্য ক্যাকটাস ও অর্কিডের যে সংগ্রহ আমার গ্রিনহাউসে আছে, ভারতবর্ষে তেমন আর কারুর কাছে আছে কিনা সন্দেহ।
ভাণ্ডারকার যখন এল, তখন আমি আমার গ্রিনহাউসেই আমার প্রিয় লোহার চেয়ারটিতে বসে টবে রাখা একটি এপিফাইলাম ক্যাকটাসের বিচিত্র গোলাপি ফুলের শোভা উপভোগ করছিলাম।
বিকেলের রোদ কাঁচের ছাউনি ভেদ করে এসে গাছের পাতার উপর পড়েছে, আর তার ফলে সমস্ত গ্রিনহাউসের ভিতরটা স্নিগ্ধ সবুজ আভায় ছেয়ে গেছে। ভাণ্ডারকারকে দেখলাম সেই আলোতে। তাকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, তোমাকে সবুজ রঙটা ভারী ভাল মানিয়েছে।
সে যেন একটু চমকে উঠেই বলল, সবুজ রঙ? কোথায় সবুজ?
আমি হেসে বললাম, তোমার সর্বাঙ্গে। তবে ওটা ক্ষণস্থায়ী। সুর্যের আলো যতক্ষণ আছে ততক্ষণ। কিন্তু ওটা তোমাকে মানায় ভাল। তোমার মনটা যে কত তাজা সে তো আমি জানি! রবীন্দ্রনাথ বোধহয় তোমাকে লক্ষ্যকরেই তাঁর সবুজের অভিযান লিখেছিলেন।
ভাণ্ডারকারকে দেখে মনে হচ্ছিল, বিদেশ সফরের ফলে তার যেন কতগুলি সূক্ষ্ম পরিবর্তন হয়েছে। তার চাহনিটা যেন আগের চেয়ে বেশি তীক্ষ্ণ, অঙ্গচালনা আগের চেয়ে বেশি চঞ্চল।
ভাণ্ডারকার অন্য চেয়ারটায় বসে পড়ল। বললাম, তোমার খবর বলো। বাইরে কেমন কাটল?
ভাণ্ডারকার কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে গলার স্বর নামিয়ে নিয়ে বলল, অবনীশ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীর সন্ধান পেয়েছি উপসালাতে।
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, কার কথা বলছ বলল তো।
সে বলল, নাম বললে চিনবে না। তার নাম বিশেষ কেউ জানে না–ও দেশেও না। তবে অদূর ভবিষ্যতে জানবে। কিন্তু নামের আগে যেটার সঙ্গে পরিচয় হওয়া দরকার, সেটা হল তার চিন্তাধারা। আমার নিজের চিন্তাধারা সে সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছে।