শশাঙ্ক মন্ত্রমুগ্ধের মতো টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। নীল আলো এত তীব্র হয় কী করে? শশাঙ্কর চোখে জল আসছে। আনন্দাশ্রু? হবেও বা!
টেবিল থেকে যখন তিন হাত দূরে, তখন শশাঙ্ক দেখল জেলিপিণ্ডের মধ্যে মৃদুস্পন্দন আরম্ভ হয়েছে। তবে স্পন্দনটা জেলির সর্বাঙ্গে নয়–কেবল মাথার উপরের একটি অংশে। সেই স্পন্দমান অংশটি থেকেই যেন একটা উত্তাপ নির্গত হচ্ছে। শশাঙ্ক সে উত্তাপ তার দেহে অনুভব করল। বড় সর্বনেশে এ-উত্তাপ, কারণ এতে বিকর্ষণ নেই। শীতের দিনে আর্তের হাত যেমন আগুনের দিকে এগিয়ে যায়, এই ভর গ্রীষ্মের গুমোট অপরাহে শশাঙ্ক ঠিক সেইভাবেই তার দেহের উত্তমা জেলির দিকে এগিয়ে দিল।
তারপর যেটা ঘটল সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত–এবং সেটা হৃদয়ঙ্গম করার আগেই তীব্র যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় শশাঙ্ক দেখল সে মেঝেতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।
জেলির স্পন্দমান অংশটি থেকে একটি ফুলিঙ্গ সদৃশ জেলির কণা তীরবেগে ধাবিত হয়ে তার ডান গালে একটি গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এই আক্রমণ সত্ত্বেও শশাঙ্ক জেলির প্রতি কোনও বিরূপ ভাব অনুভব করল না। সে জানে, সে পড়েছে, শুনেছে যে, নতুন কোনও আবিষ্কারের পথে বৈজ্ঞানিককে অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি সহ্য করতে হয়, অতিক্রম করতে হয়। আপাতত তার কাজ হওয়া উচিত জেলির জাত ও ধর্ম নির্ণয় করা। তা হলেই এর অপ্রত্যাশিত কার্যকলাপ বৈজ্ঞানিক নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়বে।
শশাঙ্ক তার প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বার করে গালের ক্ষতের উপর চাপা দিয়ে রক্তের স্রোত অবরোধ করে মেঝে থেকে উঠে পড়ল।
তারপর টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটি স্বচ্ছ কাঁচের আবরণ জেলিপিণ্ডের উপর ফেলে সেটিকে আচ্ছাদিত করল। সাবধানের মার নেই।
গালের ক্ষতে মলম লাগিয়ে স্টিকিং প্লাস্টার চাপা দেওয়ার সময় শশাঙ্ক একটি গাড়ির আওয়াজ পেল। তারই বাড়ির গেটের ভিতর দিয়ে গাড়িটা ঢুকছে।
অমিতাভর ফিয়াট।
এস্তপদে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে ল্যাবরেটরির দরজা তালা দিয়ে বন্ধ করে শশাঙ্ক বিপরীত দিকের বৈঠকখানার দরজাটি খুলে দিয়ে ঘরে ঢুকে বাতিটা জ্বালিয়ে দিল। সিঁড়িতে অমিতাভর বিলাতি জুতোর শব্দ।
শশাঙ্ক সিঁড়ির মুখটাতে গিয়ে বন্ধুকে স্বাগত জানাল। এই ব্যস্ততার মধ্যে এতদূর আসার কারণ একটাই হতে পারে। অমিতাভর মুখের ভাবও শশাঙ্কের অনুমানের সত্যতাই প্রমাণ করে।
বৈঠকখানায় গিয়ে সোফায় বসার পর অমিতাভ মুখ খুলল। তার কণ্ঠস্বরে ইস্পাতসুলভ কাঠিন্য।
তুই মিথ্যা কথা বলেছিস।
শশাঙ্ক স্থির, নির্বাক।
প্রদোষ স্যাক্রিফাইস করতে পারে কিন্তু করবার আগে তার ফাইন্ডিংস্ সে তোকে দিয়ে যেত নিশ্চয়ই। তার মনে সংকীর্ণতা ছিল না বলেই সে এটা করত–এবং তার সাহায্যের জন্যই।
তুই কী বলতে চাস?
প্রদোষের খাতা কোথায়?
বলেছি তো, সে নষ্ট করে ফেলেছে।
অমিতাভর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে তীব্র বিদ্বেষ জ্বলে উঠল।
তোর লজ্জা করে না? যে লোকটা মরে গেছে তার জিনিস…শুধু জিনিস নয়–তার এতবড় একটা কাজ–তার শেষ কাজ–সেটা তুই বেমালুম–
অমিতাভর কথা শেষ হল না। যোড়শ শতাব্দীর একটি ইতালীয় চিনামাটির ফুলদানি তার মস্তকের উপর সজোরে প্রক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে সে একটি সামান্য আঁ শব্দ করে সোফার উপর কাত হয়ে পড়ল। শশাঙ্ক উঠে এসে তার নাড়ি অনুভব করার সময় লক্ষ করল অমিতাভর ব্রহ্মতাল থেকে একটি তরল ধারা নির্গত হয়ে মেঝের গালিচায় চুঁইয়ে পড়ে তাতে একটি রক্তিম স্ফীতিমান নকশা আরোপ করছে।
সংকটকালে তার বুদ্ধির স্থির তীক্ষ্ণতায় শশাঙ্ক নিজেই বিস্মিত অনুভব করল।
তিন ঘণ্টার মধ্যেই শশাঙ্ক তার প্রাক্তন বন্ধুর মৃতদেহ বন্ধুরই ফিয়াট গাড়িতে নিয়ে গিয়ে কলকাতার উপকণ্ঠে একটি নির্জন স্থানে গাড়িসমেত রেখে বেলঘরিয়ায় ফিরে এল। গাড়ি জখম করতে গিয়ে সে নিজেও কিঞ্চিৎ জখম হয়েছে কিন্তু সেটা যাকে বলে মাইনর ইনজুরি। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে দেড় মাইল পথ হেঁটে সিক্ত অবস্থায় বাস ধরে তাকে ফিরতে হয়েছে। বৃষ্টিতে পথঘাটের জনশূন্যতা তাকে অবশ্য সাহায্য করেছে। মালিকে ছুটি দিয়েছিল আগেই। সে ফিরবে রাত দশটার পর। বাঁ হাতেও শশাঙ্ককে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হয়েছে–দস্তানার অভাব পূরণ করার জন্য। ছাত্রাবস্থায় গোয়েন্দা কাহিনী পড়ার অভ্যাস আজ তার কাজে লেগেছে।
বেলঘরিয়ার বাড়িতে ফিরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় শশাঙ্ক ঘড়ির দিকে দেখল–আটটা বেজে তেরো মিনিট।
বাঁ হাতে ব্যান্ডেজবদ্ধ অবস্থাতেই শশাঙ্ক চাবি দিয়ে ল্যাবরেটরির দরজা খুলল।
সারাদিন বন্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধের বদলে তার থেকে এল মাদকতাপূর্ণ এক অনির্বচনীয় সৌরভ। সত্তর বছরের পুরনো ঘর যেন সহস্র ফুলের সুবাসে মশগুল হয়ে আছে।
শশাঙ্ক প্রায় নেশায় বিভোর হয়ে ঘরে প্রবেশ করল। টেবিলের দিকে চাইতে এক অভাবনীয় দৃশ্য তার চেতনাকে বিহ্বল করে দিল।
কাচের আবরণটি টেবিলের একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, আর জেলির আকারে এক আশ্চর্য পরিবর্তন। সেটা এখন আর গোলাকৃতি নয়। গোলকের দেহ থেকে অজস্র নীলাভ পাপড়ি নির্গত হয়েছে, এবং প্রতিটি পাপড়ি যেন মৃদু সমীরণে হিল্লোলিত হচ্ছে।
গন্ধ যে এই সহস্রদল ময়ূরকণ্ঠি জেলিপুষ্প থেকেই নিঃসৃত হচ্ছে, শশাঙ্কর সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না। দুরু দুরু বক্ষে ধীর পদক্ষেপে সে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। এমনই এই সৌরভের মহিমা যে, শশাঙ্কর মন থেকে আজই সন্ধ্যার কালিমালিপ্ত ঘটনাটি সম্পূর্ণ মুছে গেছে।