শশাঙ্ক হেসে ব্যাপারটাকে হালকা করে দিল।
তোর ঝামেলা মিটুক। একদিন তোকে বেলঘরিয়া নিয়ে যাব।
তোর সেই মামাবাড়ি?
মামা আর থাকেন না। এখন একটা ল্যাবরেটরি করেছি ওখানে। কাজ করছি।
এক্সলেন্ট!…এই দ্যাখ–তোকে নেমন্তন্ন চিঠিটাই দেওয়া হয়নি!
অমিতাভকে সিঁড়ির মুখটাতে পৌঁছে দিয়ে ঘরের দিকে ফিরে আসার পথে শশাঙ্কর মনে হল–একবার নিভার বাড়ি যাওয়া দরকার। প্রথম চিঠিটার কথা না জানলেও, অসমাপ্ত চিঠিটার বিষয় নিভাই প্রথম জেনেছে। চিঠির বিষয়বস্তু কী অমিতাভ জানে। নিভার মনেও যদি কোনও সন্দেহের বীজ প্রবেশ করে থাকে, তবে সেটাকে অঙ্কুরিত হতে দেওয়া চলে না।
নিভা সবে স্নান খাওয়া শেষ করে দ্বিপ্রহরিক বিশ্রামের আয়োজন করছে, এমন সময় শশাঙ্ক গিয়ে উপস্থিত।
নিভার রুচির প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় প্রদোষের বৈঠকখানায়। এখানে সর্বত্র সচেতন শিল্পীর ছাপ–আপনভোলা বৈজ্ঞানিকের নয়। টেবিলের উপর স্বহস্তে এমব্রয়ডারি করা ঢাকনি, দরজা-জানলায়। সুদৃশ্য পরদা, সোফার কুশনে নাগা লোকশিল্পের বাহার। ফুলদানিতে রজনীগন্ধাগুচ্ছের স্নিগ্ধ শুভ্রতা যেন নিভার নিরাভরণ সৌন্দর্যেরই প্রতিধ্বনি।
বসুন।…এভাবে খবর না দিয়ে তো আসার কথা ছিল না।
শশাঙ্ক নিভার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারে না। আজানুলম্বিত এলোচুলে আজ সে বুঝি প্রথম দেখল নিভাকে।
আপনি বলাটা আর ছাড়তেই পারলে না। শান্তভাবে কোলের উপর হাতদুটি জড়ো করে বসে আছে নিভা। শশাঙ্কর কথায় তার ঠোঁটের কোণে একটা ম্লান হাসির আভাস ফুটে উঠল।
শশাঙ্কর বক্তব্য তার মনে পরিষ্কার ভাবে দানা বেঁধেছে। কোনও জড়তাই আজ আর সে অনুভব করবে না।
একটা কথা তোমাকে জানানো দরকার, নিভা।
বলুন।
বললে তুমি দুঃখ পাবে জানি। কিন্তু না বললে আমার নিজের বিবেক-যন্ত্রণা। দুঃখটা হয়তো তুমি সয়ে উঠতে পারবে–মৃত্যুশোকই যখন এভাবে বহন করছ–কিন্তু আমার বিবেকের দংশন বড় সাংঘাতিক। আর না-বলে পারছি না।
বলুন না!
অমিতাভর কাছে প্রদোষের শেষ চিঠির কথা জানলাম। তাতে আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে গবেষণার উল্লেখ আছে।
জানি। অমিতাভবাবু বলেছেন।
তার খাতাটা কেন পাওয়া যায়নি তার কারণ আমি জানি। নিভার দৃষ্টিতে কৌতূহল।
কী কারণ?
আমিও ওই একই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করছিলুম। সে কথা আমি প্রদোষকে বলি–ওর…ইয়ের…মাস দু-এক আগে। আমার বিশ্বাস সে নিজের গবেষণা বিসর্জন দিয়ে আমার পথ খোলসা করে দিয়েছে।
নিভা এখনও শশাঙ্কর দিকে চেয়ে আছে। কী বলতে চায় তার চাহনি? শশাঙ্কর মনে হল এমনভাবে একদৃষ্টে নিভা কোনওদিন তার দিকে চায়নি। ভাগ্যবান প্রদোষ! আজ সে নেই–কিন্তু বিশ বৎসর সে নিভার সান্নিধ্যলাভ করেছে।
শশাঙ্ক বলল, তার অন্তঃকরণ যে কত মহৎ ছিল, এ থেকেই তা বোঝা যায়।
এবার নিভা কথা বলল।
আগে বলেননি কেন?
ভেবেছিলাম প্রদোষের গবেষণা আর আমার গবেষণা একত্র করে একটা কিছু করব–কিন্তু যখন। বুঝলাম যে, সে নিজে তার গবেষণার কোনও চিহ্ন রাখতে চায়নি–
আশা করি আপনার কাজ সফল হবে।
প্রদোষের গবেষণার ইঙ্গিত পেলে হয়তো আরও সহজে হত। তবে এ-বিশ্বাস আছে যে, এতদিনে হয়তো সত্যিই একটা কাজ, একটা প্রতিষ্ঠা হবে। বিফলতাই তো জীবনের মূল সূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যা চেয়েছি তার কোনওটাই পাইনি–কোনওদিনই।
নিভা তার দৃষ্টি নত করল। কয়েক মুহূর্তের গভীর স্তব্ধতা ভঙ্গ করে এবার শশাঙ্ক গাঢ়স্বরে বলল, আমি কেবল জানতে চাই–আমার প্রতি তোমার বিশ্বাস আছে কি না।
নিভার উত্তর যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল।
সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
এর পরের কথাটির জন্য শশাঙ্ক নিজেই যেন প্রস্তুত ছিল না।
নিভা–তোমার মনে আমার প্রতি এতটুকুও প্রসন্নভাব…আকর্ষণ…কি স্থান পেতে পারে?
ক্ষণিকের জন্য নিভার দৃষ্টি শশাঙ্কর দিকে নিবদ্ধ। তারপর সে দৃষ্টি নত করে আবার সেই শান্ত গলায় বলল, ও প্রশ্ন আজ থাক। এখন থাক।
শশাঙ্ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল। নিভার যেন ব্যস্ত ভাব।
শরবত–?
শশাঙ্কর ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ হাসি।
আজ থাক। এখন থাক।
আপনার হাতে…? নিভার চোখ ব্যান্ডেজের দিকে।
চায়ের জল। ফুটন্ত। চাকরটা ছুটিতে। আমি আবার ব্যাচেলার–জানোই তো…
.
নিভার লেক প্লেসের বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে বেলঘরিয়া পৌঁছতে শশাঙ্কর লাগল পঞ্চাশ মিনিট। সারা পথ সে তার জেলির মনোমুগ্ধকর রূপটি মনে করতে চেষ্টা করেছে; কিন্তু সকালে অল্প সময়ের মধ্যেই তার এত বিচিত্র পরিবর্তন সে দেখেছে যে, পদার্থটির কোনও একটি বিশেষ আকৃতি বা বর্ণ তার পক্ষে মনে করা সম্ভব হল না। কেবল এইটুকুই সে বুঝল যে, অস্পষ্টতা সত্ত্বেও ময়ূরকণ্ঠি জেলি তাকে আকর্ষণ করেছে এক অমোঘ সম্মোহনী শক্তির মতো।
হাতের তেলোটায় সামান্য জ্বালা এখনও রয়েছে। বাঁ হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে চাবিটা বার করে শশাঙ্ক ল্যাবরেটরির দরজা খুলল। বাইরে মেঘের ঘনঘটা, ঘরের জানলা সব বন্ধ। শশাঙ্ক জানে ঘরের সুইচবোর্ড ঠিক ডানদিকেই।
দরজা খুলে অভ্যাসমতো সুইচের দিকে হাত বাড়াতেই শশাঙ্ক বুঝল আলোর কোনও প্রয়োজন হবে না।
জেলি-প্রসূত ময়ূরকণ্ঠি আলোই তার ঘরটিকে আলোকিত করে রেখেছে।
টেবিলের উপর সকালের সেই গোলাকার পিণ্ড অবস্থাতেই জেলি এখনও অবস্থান করছে, কেবল তার আভা সকালের চেয়ে অন্তত চারগুণ বেশি।