সুর্যের আলোর অভাবেও জেলিটি থেকে আপনা হতেই একটা আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। মাথার উপরে এখনও নীলাভ চাঁদোয়া।
এতে কি তবে ফসফরাস আছে? কিন্তু সে জাতীয় কোনও পদার্থ তো উপাদানে ছিল না।
শশাঙ্ক এবার সাহস করে পাত্রটি হাতে তুলে নিল। জেলির ওজন মন্দ নয়। দেখে তো মনে হয়নি। জেলির বদলে পারা থাকলেও এর চেয়ে বেশি ওজন হত না। শশাঙ্ক এবার ধীরে ধীরে পাত্রটিকে কাত করতে লাগল। পাত্রের পাশ টেবিলের উপর পড়ে একটি কম্পমান গোলকের আকার ধারণ করল।
আধারমুক্ত হবার ফলে জেলির ঔজ্জ্বল্য যেন আরও বেড়ে গেল। ধীরে ধীরে গোলকের অস্থিরতা দূর হল। এখন সেটি, একটি নিটোল নিষ্কলঙ্ক ময়রকণ্ঠিবর্ণযুক্ত স্বত:সূর্ত আলোক-পিণ্ড।…
.
সাড়ে আটটায় শশাঙ্ক তার বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ফিরে এল। ব্যান্ডেজবদ্ধ ডান হাতের তেলোয় এখনও। সে মৃদু যন্ত্রণা অনুভব করছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। তার সমস্ত সত্তা এখন নবাবিষ্কৃত অপরূপ বর্ণচ্ছটা-সম্পৃক্ত জেলির ভাবনায় আচ্ছন্ন। আয়ুবৃদ্ধির প্রশ্নটা এখন তার কাছে বড় নয়। যে পদার্থটি এখন তার গবেষণাগারে বন্দি অবস্থায় রয়েছে, পার্থিব জগতে তার রূপের তুলনা বিরল। গুণও যদি কিছু থাকে সেটার, মানুষের প্রয়োজনে যদি আসে সেটা, তবে সেটা হবে ফাউ।
এগারোটার কিছু পরে অমিতাভ এল। তার চাহনির অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা শশাঙ্কর দৃষ্টি এড়াল না। শশাঙ্কর খাটে ধপ করে বসে খোলা খবরের কাগজের উপর একটা চাপড় মেরে অমিতাভ বলল, আই ওয়াজ রাইট।
শশাঙ্ক উৎকণ্ঠা দমন করে চেয়ারে বসে সিগারেটের টিনটা অমিতাভর দিকে এগিয়ে দিল।
অমিতাভ বলল, ওসব রাখ। এই দ্যাখ।
পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে অমিতাভ শশাঙ্কর দিকে এগিয়ে দিল।
আজ নিভার ওখানে গেসলাম। এই অসমাপ্ত চিঠিটা প্রদোষের শোয়ার ঘরের টেবিলের দেরাজে পাওয়া গেছে। আই ওয়াজ রাইট!
চিঠিটা ইংরেজিতে লেখা। তর্জমা করলে এই দাঁড়ায়—
প্রিয় অমিতাভ,
এত অল্প সময়ের মধ্যেই আরেকখানা চিঠি পেয়ে নিশ্চয়ই খুব অবাক লাগবে তোমার। কিন্তু না লিখে পারলাম না। গত চিঠিতেই আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে গবেষণার কথা উল্লেখ করেছিলাম, মনে আছে বোধহয়। তাতে একটা নতুন ড্রাগ আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা লিখেছিলাম। এবারে তার ফরমুলাটা তোমাকে জানিয়ে দিতে চাই, কারণ আমি নিজে একাজ শেষ করে উঠতে পারব কিনা জানি না। কদিন থেকেই আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে, আমার নিজের আয়ু বোধহয়
চিঠিটা একবার শেষ করে দ্বিতীয়বার পড়ার সময় শশাঙ্ক শুনল অমিতাভ বলছে, এখন কথা হচ্ছে–হোয়ার ইজ দ্যাট ফরমুলা? অ্যান্ড হোয়্যার ইজ দ্যাট নোটবুক?
শশাঙ্ক চিঠিটা ফিরিয়ে দিল।
কী করে জানব বল! আর এমনও তো হতে পারে প্রদোষ শেষকালে সে খাতা ডেস্ট্রয় করে ফেলেছে। হয়তো মনে হয়েছে সে ভুল পথে চলেছে–তার গবেষণার কোনও মূল্য নেই। তা ছাড়া শশাঙ্কর মাথায় হঠাৎ একটা পৈশাচিক বুদ্ধি খেলে গেল–তা ছাড়া আমিও যে ও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি সেটা তো আমি প্রদোষকে বলেছিলাম। হয়তো সে কারণেই
তুইও ভাবছিস মানে? অমিতাভর দৃষ্টিতে যুগপৎ বিস্ময় ও অবিশ্বাস।
মানে যা বুঝছ তাই। আমি সেকথা প্রদোষকে বলেছিলাম। প্রদোষ জানত। তুই তো চিনতিস প্রদোষকে। সেন্টিমেন্টাল। বন্ধুর যাতে ক্ষতি না হয় তার জন্য নিজে স্যাক্রিফাইস করতে দ্বিধা করত না–তাই নয় কি?
অমিতাভ কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে শশাঙ্কর দিকে চেয়ে বলল, তুইও লঞ্জিভিটি নিয়ে রিসার্চ করছিস? তোর নোক্স আছে?
আছে বইকী! তুই কি ভাবছিস আমি বসে কেবল পৈতৃক সম্পত্তি ভোগ করছি–আর আমার ভাগ্যে লবডঙ্কা?
না না, তা কেন! অমিতাভ যেন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত, অনুতপ্ত। তোর যে বুদ্ধি নেই একথা তো কোনওদিন বলিনি, ভাবিওনি। তোর যেটার চিরকালই অভাব ছিল সেটা হচ্ছে একাগ্রতা, অ্যাপ্লিকেশন। তা ছাড়া তোর চিন্তায় কোনওদিন ডিসিপ্লিন ছিল না। কিন্তু চিন্তাশক্তিটাই যে নেই এসব কথা কি কখনও বলেছি?
শশাঙ্ক একটা সহজ হাসি হেসে বলল, যাই হোক, ধরে নে যে, শশাঙ্ক আর সে শশাঙ্ক নেই।
অমিতাভ খাট থেকে উঠে পায়চারি শুরু করেছে। তার অস্থিরতা যে ষোলো আনা বিশ্বাসের অভাবেই, তা শশাঙ্ক জানে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কী? কী করতে পারে অমিতাভ। সন্দেহ যতই হোক না কেন, জিনিসটার সম্ভাব্যতা সে উড়িয়ে দিতে পারে না কখনওই। আর তাকে মিথ্যাবাদীই বা প্রমাণ করবে সে কীভাবে?
তুই প্রদোষের বাড়িতে গিয়ে কাজ শুরু করার আগে আর কেউ ওর কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছিল?
ঠিক তা জানি না।
অমিতাভ থেমেছে। জানলা থেকে মুখ ফেরাতে শশাঙ্ক লক্ষ করল তার কপালে স্বেদবিন্দু। অমিতাভ কণ্ঠস্বর দৃঢ় করে বলল, কিছু মনে করিস না–কিন্তু তোর কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না।
শশাঙ্ক বিবেক বস্তুটিকে আগেই বর্জন করেছে। সুতরাং এমন সংকটময় মুহূর্তেও সে বিচলিত হল। উপযুক্ত কাঠিন্য ও শ্লেষমিশ্রিত কণ্ঠে সে বলল, তা হলে তুই বলতে চাস আমি মিথ্যেবাদী?
অমিতাভ হঠাৎ যেন ভেঙে পড়ল। খাট থেকে সিগারেটের টিনটা তুলে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সরি ভাই। ভেরি সরি। মাথাটা গণ্ডগোল হয়ে গেল। কাজের কাজ বলতে তো কিছুই করিসনি। অ্যাদ্দিন, তাই ছাত্র হিসেবে যে তুই ভালই ছিলি সে কথাটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যাগে–আমি উঠি।