আমিই তো ওর লেখাপত্তর সব ঘেঁটেঘুঁটে গুছিয়ে দিলুম।
কিছু পাসনি? অন লঞ্জিভিটি?
নাথিং। তুই বোধহয় গণ্ডগোল করছিস।
কিন্তু…ভেরি স্ট্রেঞ্জ! তা হলে কি লঞ্জিভিটি নয়? সামথিং এক্স? হবেও বা!…যাই হোক, এগারোই সন্ধ্যা সাতটা।
কী?
ডলির বিয়ে–বললাম না। আসা চাই। অবিশ্যি, তোর বাড়ি একবার যাবই। কাল তো রোববার। সকালের দিকে আছিস?
আছি। ইয়ে–তোর বাগচির সঙ্গে দেখা হয়েছে?
পাগল! ফোনও করিনি। সময় কোথায়? শুধু নিভাকে একটা ফোন করে সমবেদনা জানিয়েছি।
ওকে প্রদোষের চিঠির কথা–?
না। হারিয়ে ফেলেছি শুনলে কষ্ট পাবে। চলি ভাই। বাই বাই!
রিসিভারটা নামিয়ে রেখে শশাঙ্ক কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে চেয়ারে বসে রইল।
তা হলে কি তাকে সত্যটা প্রকাশ করে দিতে হবে? কিন্তু গত ছমাসের এত পরিশ্রম, এত অর্থব্যয়, রাত্রিজাগরণ, অর্থ ও খ্যাতির এত রঙিন স্বপ্ন সব কি ব্যর্থ হবে? এই স্বপ্নসৌধ যদি তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়, তা হলে সে বাকি জীবনটা কী নিয়ে থাকবে! এখন তো তার আর অন্য কোনও কাজে মন নেই। সত্যি বলতে কি, আয়ুবৃদ্ধি সম্পর্কে পড়াশুনার ফলে তার ও বিষয়ে রীতিমতো জ্ঞান ও অনুসন্ধিৎসার সঞ্চার হয়েছে।
নাঃ, এ কাজ তাকে করতেই হবে। যেভাবে প্ল্যান করেছিল সেভাবেই। অমিতাভর মনে যেটুকু সন্দেহ আছে, দূর করতে হবে। আর ও তো এসেছে বোনের বিয়ের ব্যাপারে। মাসখানেকের বেশি থাকবে না নিশ্চয়ই। তারপর ও চলে গেলে ড্রাগের খবরটা প্রকাশ করলেই হবে।
বিকেলে বেলঘরিয়া যাবার মুখে মণীশ এল–তার হাতে একখানা চিঠি।
এটা মা দিলেন।
শশাঙ্ক হালকা সবুজ রঙ-এর খামটা খুলে চিঠিটা পড়ল।
মাননীয়েষু,
সেই যে কাজ করে দিয়ে গেলেন, তারপর তো কই আর এলেন না। আমার একান্ত ইচ্ছে আপনি একদিন এসে আমাদের এখানে খান। কোনদিন সুবিধে হবে সেটা হয় মনুকে, না হয় আমাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। আশা করি ভাল আছেন।
ইতি
বিনীতা
নিভা সরকার।
চিঠিটা পড়া শেষ হলে শশাঙ্ক সেটাকে ভাঁজ করে মণীশের পিঠে ছোট্ট একটা চাপড় মেরে বলল, মাকে বোলো–যেদিন আসব তার দুদিন আগে টেলিফোন করে জানিয়ে দেব, কেমন?
মণীশ চলে গেলে পর শশাঙ্ক নিভার চিঠিটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিল।
.
ড্রাগ-প্রস্তুত পর্বের বিবরণ এই কারণে নিষ্প্রয়োজন যে, প্রদোষের নির্দেশ অনুযায়ী উপাদান মিশিয়ে যে পদার্থটি তৈরি হল, প্রদোষের আনুমানিক বর্ণনার সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। রাত বারোটার সময় কাজ শুরু করে ভোর পাঁচটায় শশাঙ্কর কাঁচের পাত্রটিতে যে বস্তুটি আবির্ভূত হল তেমন বস্তু শশাঙ্ক এর আগে কখনও দেখেনি। প্রদোষ তার খাতায় লিখেছিল তরল পদার্থের কথা। যেটি পাওয়া গেল সেটি হল ভিস্কা–অর্থাৎ চিটচিটে থথকে।
পদার্থটির প্রথম অবস্থা অবিশ্যি তরলই ছিল, কিন্তু পাঁচ মিনিটের জন্য ঘরের বার হয়ে ফিরে এসে শশাঙ্ক দেখল সেটি জমতে শুরু করেছে।
যে অবস্থায় এসে জমা থামল, সেটা দেখে কেবল একটি জিনিসের কথাই মনে হয়–জেলি। রঙ যদি লাল হত, তবে সেটাকে পেয়ারার জেলি বলে ভুল করা অস্বাভাবিক হত না। কিন্তু এখন সে ভুলের প্রশ্নই ওঠে না। জেলি জাতীয় কোনও পদার্থের যে এমন রঙ হতে পারে তা শশাঙ্ক ভাবতেও পারেনি। বৈদ্যুতিক আলোতে রঙ-এর বাহার ঠিক ধরা পড়েনি৷ ভোরবেলা পূর্বদিকের খোলা জানলাটা দিয়ে সূর্যের রশ্মি এসে জেলির গায়ে পড়াতে সমস্ত ঘর যেন আলোয় আলো হয়ে উঠল।
শশাঙ্ক উপরের দিকে চেয়ে দেখলে জেলি থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে সিলিং-এর উপর ছড়িয়ে পড়ে নয়নাভিরাম নীলাভ চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু শুধুই কি নীল?
শশাঙ্ক লক্ষ করল দৃষ্টিকোণের সামান্যতম পরিবর্তনেই জেলির রঙ বদলাচ্ছে। নীলই প্রধান। কিন্তু সবুজ ও লালের আভাসও পাওয়া যায়। এ রঙকে ময়ূরকণ্ঠি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
বিস্ময়ের মধ্যেও শশাঙ্কর হাসি পেল। ময়ূরকণ্ঠি জেলি! প্রদোষ এ কীসের ফরমুলা দিয়ে গেল? এ কি ড্রাগ, না অন্য কিছু? জীব রসায়নের ইতিহাসেই কি এর স্থান, না প্রাতরাশের মেনুতে?
যাই হোক না কেন–এমন চমকপ্রদ বর্ণচ্ছটা শশাঙ্কর অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। নাই বা থাকুক এর কোনও আয়ুবৃদ্ধির শক্তি, এর অনির্বচনীয় সৌন্দর্যই ধৈর্য ও শ্রম সার্থক করছে।
শশাঙ্ক তন্ময় হয়ে পাত্রটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে লক্ষ করল জেলির মধ্যে যেন একটা মৃদু স্পন্দনের ভাব।
মুহূর্তকাল বিস্ময়ের পর শশাঙ্ক এই স্পন্দনের একটা কারণ অনুমান করল। জেলি এতই সেনসিটিভ যে, ভোরের সূর্যালোকের মৃদু উত্তাপই এতে উত্তেজনা সঞ্চার করতে সক্ষম। অর্থাৎ, জেলি গরমে ফুটছে।
শশাঙ্ক পূর্বদিকের জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে টেবিলের কাছে ফিরে এসে পাত্রটির গায়ে হাত দিয়েই তার অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করল।
তারপর অতি সন্তর্পণে পাত্রের মুখের কাছে হাতের তেলোটা আনামাত্র বিদ্যুদ্বেগে হাতটা সরিয়ে নিয়ে লক্ষ দিয়ে শশাঙ্ককে তিন হাত পিছিয়ে যেতে হল।
হাতের তেলোতে অসহ্য যন্ত্রণা।
শশাঙ্ক চেয়ে দেখল–ফোস্কা।
সৌভাগ্যক্রমে ফাস্ট এডের বাক্সটি আনতে ভোলেনি শশাঙ্ক। বার্নল দিয়ে নিজের হাতে নিজেই ব্যান্ডেজ করে আরেকবার টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে শশাঙ্ক দেখল, জেলি এখন নিষ্পন্দ, পাত্রও ঠাণ্ডা। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষণীয়।