ওর ব্যাগটা কোথায় গেল? ভেবে অংশু হঠাৎ সোজা হয়ে বসে। তারপর ভাবে, যেখানেই থাক তাতে কী আর যায়-আসে? ভেবে ফের গা ছেড়ে দিল সে।
ব্র্যাণ্ডিতে প্রথম চুমুক দিয়ে তার খুব ভালো লাগল না। এর আগে এক-আধবার সে সামান্য খেয়েছে। কোনোবারই ভালো লাগেনি বলে অভ্যাস করেনি। আজ ভালো না লাগা সত্ত্বেও সে ধীরে ধীরে, জোর করে পুরোটা খেয়ে নিতে পারল। বেশি নয় অবশ্য। এক পেগ হবে।
মাথাটা একটু কেমন লাগছে কি?
অংশু চোখ বুজে বসে থাকে অনেকক্ষণ।
খাবেন না স্যার! লাঞ্চ রেডি।
অংশু একটু চমকে ওঠে। সামান্য সেই চমকে শরীরটা নড়তেই কোমর থেকে ব্যথাটা হিড়িক দিয়ে উঠে আসে মেরুদন্ড বেয়ে। স্পাইনাল কর্ডে যদি লেগে থাকে তবে ভয় রয়ে গেল। হাড়ের দিকেও একটা ব্যথা মাথাচাড়া দিচ্ছে। যদি স্পণ্ডিলাইটিসের মতো কলার নিতে হয়?
আজ স্যার দিদিমণি এলেন না?
ডাইনিং হল-এর দিকে যেতে যেতে অংশু বলল, না।
আপনি কি স্যার অসুস্থ?
অংশু একটা শ্বাস ফেলে বলল, একটু চোট হয়েছে। তেমন কিছু নয়।
গাড়িও আনেননি আজ স্যার।
সার্ভিসিং-এ গেছে।
এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে অংশুর রাগ হচ্ছিল না। কারণ, এসব সৌজন্যমূলক প্রশ্ন খুবই প্রাসঙ্গিক। বিশু তো আর জেরা করছে না। জবাব দেওয়াই উচিত। চেপে গেলে সন্দেহের বীজ বপন করা হবে।
অংশু প্রকৃত মুশকিলে পড়ল খেতে বসে। চমৎকার সরু চালের সাদা গরম ভাত, কাঞ্চনবর্ণ মুরগির কারি, ধোঁয়া-ওঠা ডাল, মুচমুচে আলু ভাজা, মাছের ফ্রাই, চাটনি দেখে আজ তার বারবার ওয়াক আসছিল। এতক্ষণে রাণুকে কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে কি? নাকি ঠাণ্ডা ঘরে ফেলে রেখেছে। ওর সৎকারেরই বা কী হবে? কে এসে নেবে ডেডবডি? ওর স্বামী? কিন্তু ওই বডির কিছু দায়িত্ব তো অংশুরও আছে। অংশু তো কম ভোগ করেনি ওই শরীর, যতদিন জ্যান্ত ছিল।
অংশু বিস্তর নাড়াঘাটা করে সব ফেলে ছড়িয়ে উঠে পড়ল।
খেলেন না স্যার?
আজ পারছি না। একটা পান আনো তো বিশু। জর্দা দিয়ে।
এসব খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির অ্যারেঞ্জমেন্টের জন্য প্রতি রবিবার অংশুকে পঞ্চাশটা করে টাকা দিতে হয়। আজ আবার এক পেগ মদের দাম আছে। খরচটা আপাতত বেঁচে যাচ্ছে অংশুর। সামনের রবিবার সে অবশ্যই আসছে না।
বারান্দায় যেতে গিয়েই হলঘরের টেলিফোনটা নজরে পড়ল তার। একটু থমকাল সে। তাদের কলকাতার বাড়িতেও টেলিফোন আছে। কথা বলবে কি, একটু ইতস্তত করে অংশু। তারপর হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, বলবে। বলাই উচিত। ফিরলে সকলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুর্ঘটনার কথা বলতে তার ভীষণ অস্বস্তি হবে। মুখ না দেখেই বলে দেওয়া ভালো। বলতে যখন হবেই।
কিছুক্ষণের চেষ্টায় সে বাড়ির লাইন পেল। ধরল তার বোন রীতা।
শোন, আজ একটা বিচ্ছিরি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
অ্যাক্সিডেন্ট–বলে রীতা একটা আর্তনাদ করে উঠল ওধারে।
শোন, ডোন্ট বি নার্ভাস। আমার কিছু হয়নি।
কিছু হয়নি?
আমার কিছু হয়নি, তবে গাড়িটা গেছে। আর…
আর কী?
আমার সঙ্গে আমার একজন কলিগ ছিল। তার অবস্থা ভীষণ খারাপ।
বাঁচবে না?
বোধ হয় না।
সে কী?
চেঁচাস না। ঠাণ্ডা হয়ে শোন। আমি ব্যাণ্ডেল থেকে কথা বলছি।
ব্যাণ্ডেল থেকে? ব্যাণ্ডেল থেকে কেন? তুমি তো প্ল্যান্টে গিয়েছিলে।
হ্যাঁ। প্ল্যান্টেই ভদ্রমহিলা ধরলেন আমাকে। ব্যাণ্ডেলে ওঁর কে একজন আত্মীয় থাকেন গুরুতর অসুস্থ। আমাকে একটু পৌঁছে দিতে বললেন।
ভদ্রমহিলা! কে গো?
আমাদের পাবলিসিটি অফিসার। রাণু সরকার।
তুমি ব্যাণ্ডেল গেলে পৌঁছে দিতে?
কী আর করব। ট্রেনের নাকি আজ কী সব গন্ডগোল ছিল হাওড়ায়, তাই।
ট্রেনের গন্ডগোল। তাহলে কী হবে। মা আর বউদি যে বড়দার সঙ্গে তারকেশ্বর গেল।
তারকেশ্বর। ও গড! অংশু হাল ছেড়ে দিল প্রায়।
কী বলছ?
অংশু মনে মনে নিজেকে বলল, ইডিয়ট, এর চেয়ে ঢের বেশি চক্করে পড়েও দুনিয়ায় চালাক লোকেরা বেরিয়ে আসে। তুমি কি গাড়ল? চালাও, চালিয়ে যাও।
অংশু একটু ধীর স্বরে বলল, ট্রেনের গন্ডগোল ছিল কিনা তা তো আমার জানার কথা নয়। ভদ্রমহিলা বলছিলেন, তাই ধরে নিয়েছি আছে।
ব্যাণ্ডেলে কোথায় আছ তুমি এখন? কোথা থেকে কথা বলছ?
অংশু এত মিথ্যে কথা একসঙ্গে জীবনে বলেনি। একটু ঢোঁক গিলে বলল, হাসপাতালের কাছ থেকে।
ভদ্রমহিলার কীরকম লেগেছে?
মাথাটা থেঁতলে গেছে।
উঃ মাগো!
একটু চুপ করে থেকে রীতা বলল, কী হয়েছিল মেজদা?
লরি। একটা লরি এসে মেরেছিল বাঁদিকে।
বাঁচার কোনো চান্স নেই?
না।
গাড়িটা?
গেছে। একদম গেছে।
তুমি তাহলে কী করে ফিরবে?
দেখছি। ফেরার জন্য চিন্তা নেই। পারব।
শোনো মেজদা, ছোড়দা একটু আড্ডা মারতে বেরিয়েছে সকালে। ও ফিরলে তোমাকে গিয়ে তুলে আনবে। ও ওর গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে। নইলে আমিই চলে যেতাম–
না, তার দরকার নেই।
বাবাকে বলব তো?
বলিস। তবে আগে বলিস যে আমার কিছু হয়নি।
সত্যিই হয়নি তো?
হলে কি আর ফোন করতে পারতাম?
তুমি কখন ফিরবে?
রাণুর একটা ভালোমন্দ খবর পেলেই। ছাড়ছি। ভাবিস না।
তুমি কিন্তু তাড়াতাড়ি এসো।
অংশু ফোন রেখে দিল। শোয়ার ঘরে এসে সে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। শরীরের ভার আর বহন করা যাচ্ছে না।
বিছানাটা নরম ফোম রবারের। ভারি নরম। এই বিছানাতেই সে আর রাণু–। কিন্তু রাণুর স্মৃতি তাকে একটুও তাড়া করছে না। তবে এতক্ষণে দুর্ঘটনার পুরো ভয়াবহতা সে একা ঘরে স্মরণ করতে পারল। ওইরকম ভাবে চুরমার হয়ে যাওয়া একটা গাড়ির ভিতরে থেকেও কী করে সে বেঁচে গেল সেটা এখনও ভেবে পাচ্ছে না সে। বাঁচলেও এমন আস্ত অবস্থায় তো কিছুতেই নয় তবু আশ্চর্য কিছু ব্যথা-বেদনা নিয়ে সে বেঁচেই আছে। ভাবতেই শিউরে উঠল সে। তার শরীর থেকে রক্তপাতও হয়েছে সামান্য। মাত্র চার জায়গায় ছড়ে বা। চিরে গেছে, জামাকাপড় অবশ্য ছিঁড়েছে কিন্তু তা ব্যবহারের অযোগ্য নয়। এত বড়ো একটা অ্যাক্সিডেন্ট যাতে রাণু তৎক্ষণাৎ মারা গেল, ফিয়াটটা হয়ে গেল খন্ড খন্ড, তাতে পড়েও সে এমন ফুলবাবুটির মতো অক্ষত, অনাহত রয়ে গেল কেন?