Site icon BnBoi.Com

শিবরাম রচনা সমগ্র – শিবরাম চক্রবর্তী

শিবরাম রচনা সমগ্র - শিবরাম চক্রবর্তী

অঙ্ক সাহিত্যের যোগফল

আমার পাশের বাড়ির রাজীবরা খাসা লোক! ও, ওর দাদা, বাবা, ওরা সব্বাই। কিন্তু লোক ভালো হলে কি হবে, মনের ভাব ওরা ঠিক মতন প্রকাশ করতে পারে না। সেটা আমাদের ভাষার গোলমালে, কি ওদের মাথার গোলমালে, তা এখনো আমি ঠাওর করে উঠতে পারিনি। কিন্তু যখনই না আমি তাদের কিছু জিগগেস করছি, তার জবাব যা পেয়েছি তা থেকে দেখেছি মাথামুণ্ডু কোনো মানেই খুঁজে পাওয়া যায় না।

কেন, এই আজই তো! বেরুবার মুখেই রাজীবের দাদার সাথে দেখা। জিগগেস করলুম–কেমন আছো হে?

এই কেটে যাচ্ছে একরকম!

কেটেযাচ্ছে? শুনলে পিলে চমকায়! কিন্তু তখন ভারী তাড়া, ফুরসত নেই দাঁড়াবার। নইলে কী কাটছে, কেন কাটছে, কোথায় কাটছে, কিভাবে কাটছে, কবের থেকে কাটছে এসবের খবর নেবার চেষ্টা করতুম।

বাজারের পথে রাজীবের বাবাকে পাই–এই যে! কেমন আছেন মুখুয্যেমসাই?

আজ্ঞে যেমন রেখেছেন!

এত কি একটা জবাব হলো নাকি? এ থেকে ভদ্রলোকের দেহমনের বর্তমান অবস্থায় কতখানি আমি টের পাই? কে রেখেছেন, আর কেনই বা রেখেছেন–তারই বা কি কোন হদিশ পাওয়া যায়? তোমারই বলো।

ঝি সঙ্গে নিয়ে বাজারে চলেছেন, তখন আর তাকে জেরা করে জানা গেল না; অগত্যা ঝি–কেই প্রশ্ন করি–তুই কেমন গো বুড়ী?

এই আপনাদের ছিচরণের আশীর্বাদে। আপ্যায়িত হয়ে বুড়ী যেন গলে পড়ে।

ছিচরণকে আমি চিনি না, তার আশীর্বাদের এত বহর কেন, বাতিকই বা কিসের, তাও আমার জানা নেই, কিন্তু সঠিক উত্তর না পাওয়ার জন্যে–ও আর ছিচরণ দুজনের ওপরেই নিদারুণ চটে গেলাম।

এক বন্ধুর সঙ্গে মোলাকাত হঠাৎ। অনেকদিন পরে দেখা, কুশল প্রশ্ন করি–মহেন্দ্র যে! ভালো আছো তো?

এই একরকম।

এও কি একটা কথার মত কথা হল? ভাল থাকার আবার একরকম, দুরকম নানারকম আছে নাকি? বন্ধু বলে কিছু আর বলি না, মনে মনে ভারী বিরক্তি বোধ করি।

বিকেলে যখন আমি বাসামুখো, সেই সময় রাজীবও–খাসা ছেলে রাজীব! সেও দেখছি ফিরছে ইস্কুল থেকে!–এই যে রাজীবচন্দন! চলছে কি রকম?

চমৎকার!

না, এবার ক্ষেপেই যেতে হোলো। যখনই ওকে কোনো কথা–তা ওর স্বাস্থ্য, কি খেলাধুলা, কি পড়াশোনা যা কিছুর সম্পর্কেই জিগগেস করেছি, তখনই ওর ওই এক জবাব চমৎকার! এ ছাড়া যেন আর অন্য কথা ওর ভাঁড়ারে নেই আলাদা কোনো বুলি ও জানে না।

বাড়ি ফিরে ভারী খারাপ লাগে। এ কী? সবারই কি মাথা খারাপ নাকি? আবাল বৃদ্ধ বনিতা–সক্কলের? এবং একসঙ্গেই? আশ্চর্য।

দুনিয়া-সুদ্ধ সবারই ঘিলুর গোলমাল, না আমাদের ভাষায় ভেতরেই গলদ–তাই নিয়ে মাথা ঘামাই। এরকম হেঁয়ালীপনার খেয়ালী জবাবে কবিরাই খালি খুশি হতে পারেন, আমার যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মন কিন্তু ভীষন বিচলিত হয়। মাথা ঘামাতে হয় আমায়।

আচ্ছা, আমাদের ভাষাকে অঙ্কের নিয়মে বেঁধে দিলে কেমন হয়? বিশেষ করে বিশেষণ আর ক্রিয়াপদের? অঙ্কের নির্দেশের মধ্যে তো ভুল হবার কিছু নেই। ফিগারস ডু নট লাই–অঙ্কেরা মিথ্যবাদী হয় না,–মিথ্যা কথা বলতে জানে না–এই বলে একটা বয়েতে আছে না ইংরাজীতে সংখ্যার মধ্যে বাঁধা পড়লে শংকার কিছু থাকে না; আর, ভাসা-ভাসা ভাবটা কেটে যায় ভাষার। অঙ্কের নিরিখটাই সব চেয়ে ঠিক বলে মনে হয়।

১০০-কেই পুরো সংখ্যা ধরা যাক তাহলে। আমাদের দেহের, মনের, বিদ্যার, বুদ্ধির, রূপের, গুণের–এক কথায় সবকিছুর সম্পূর্ণতাজ্ঞাপক সংখ্যা হোলো গিয়ে ১০০; এবং ওই সংখ্যার অনুপাতের দ্বারাই অবস্থাভেদের তারতম্য বুঝতে হবে আমাদের। এর পর আর বোধগম্য হবার বাধা কি রইল?

উদাহরণ : নিয়মকানুন মেনে এর পর রাজীবের বাবাকে গিয়ে যদি আমি জিগগেস করি… কেমন আছেন মশাই? ভাল তো? এবং সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় সংখ্যা হয় ১০০-তাহলে ভেবেচিন্তে, অনেক হিসেব করে তাকে উত্তর দিতে হবেঃ–এই ভাল আছি এখন! পরশু পেটের অসুখে ১০ দাঁড়িয়েছিল, কাল দাঁতের ব্যাথায় ৭-এ ছিলাম, আজ যখন দাঁত তোলাই তো কাত, প্রায় নাই বললেই হয়। এই যাই আর কি! তারপর অনেকক্ষণ zero বার পর সামলে উঠলাম, সেই থেকেই ১ টু দুর্বল বোধ করছি নিজেকে-এখনই এই ৫৩!

অর্থাৎ যেদিন-যখন-যেমন তার শরীর-গতিক!

আমার বিস্ময়-প্রকাশে বরং আরো একটু তিনি যোগ করতে পারেনঃ–হ্যাঁ, বাহান্নই ছিলাম মশাই। কিন্তু আপনার সহানুভূতি প্রকাশের পর এখন একটু ভাল বোধ করছি আরো। তা, ওই যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন!

সব সময়েই মানুষ কিছু একরকম থাকে না–সুতরাং সব সময়েই উত্তর একরকম হবে কেন? এমনি সব ব্যাপারেই। ভাব-প্রকাশের দিকে ভাষায় যে অসুবিধা আছে সংখ্যার যোগে তা দূর হবেই–যেমন করে কুয়াশা দূর হয়ে যায় সূর্যোদয়ের ধাক্কায়। সাহিত্যে আর অঙ্কের যোগাযোগে সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি তো হবেই নির্ঘাৎ-অঙ্কের সম্বন্ধে ও আমাদের আতঙ্ক কমে যাবে ঢের। সেইটাই । উপরন্ত। অর্থাৎ লাভের উপরি। ফাউয়ের ওপর পাউকো।

নাঃ, এ বিষয়ে রাজীবের বাবার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হওয়ার দরকার এখুনিই–এই দণ্ডেই। এবং রাজীবের সঙ্গেও।

তখুনি বেরিয়ে পড়ি ৬২ বেগে।

ওদের বাড়ি বরাবর গেছি, দেখি, শ্রীমান রাজীবলোচন সদর রাস্তায় দাঁড়িয়েই ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন ৯৮ মনোযোগে।–খুব যে ঘুড়ি ওড়াচ্ছ দেখছি?

চমৎকার! আমার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোকের সেই এক কথা!

কিন্তু বাড়ির ছাদে ওড়ালেই ভাল ছিল নাকি? তোমাদের বাড়ির ছাদে তো বারান্দা নেই। ঘুড়ির উত্থান আর তোমার পতন দুটোই একসঙ্গে হতে পারত। তাহলে খুব সুবিধের হত না?

চমৎকার।

তোমার বাবা কি করছেন এখন?

চমৎ–

বলতে বলতেই সে পিছু হটতে শুরু করে, ঘুড়ির তাল সামলাবার তালেই। চোখকে আকাশে রেখে, পুরোপুরি ১০০ই, ওর মনও ঘুড়ির সঙ্গে একই সূত্রে লটকানো, ওর স্কুল রাজীব অংশই কেবল পিছু হটে আসে পৃথিবীতে–আসে চকিতের মধ্যে আর ৯২ বেগে–এত তাড়াতাড়ি কে আমি জক্ষেপ করবার অবকাশ পাই না।

১ মুহূর্তে সে আমার ১০০ কাছাকাছি এসে পড়ে। ১০০ মানে, ঘনিষ্ঠতার চরম যাকে বলা যায়। আমি ঝাঁকিয়ে উঠি সেই ধাক্কায়।

কানা নাকি মশাই? আমার দিকে না তাকিয়েই ওর জিজ্ঞাসা।

তুমি ৮৭ নাবালক! কি আর বলব তোমায়–

দেখতে পান না চোখে? আকাশে চোখ রেখেই ওর চোখা প্রশ্নটা।

উহঁ। বরং ৭৫চক্ষুম্মান। ১০০-ই ছিলাম, কিন্তু তোমার লাটাইয়ের চোট লেগে চশমার একটা পাল্লা ভেঙে গিয়ে বা চোখে এখন অর্ধেক দেখছি। বলে আমার আরো অনুযোগঃ–একটা পাল্লা মানে চশমাটার ৫০ পাল্লাই বলা যায়। তোমার পাল্লায় পড়ে এই দশা হল আমার।

অ্যাঁ এবার সে ফিরে তাকায় তিরানব্বই বিস্মিত হয়ে–কি বললেন?

আমার ধারণা ছিল তুমি ৪২ বুদ্ধিমান, কিন্তু দেখছি তা নয়। বয়সে ১৩ হলে কি হবে, এই। তেরতেই তিন তেরং ঊনচল্লিশ পেকে গেছ তুমি।

৭২ হতভম্ব হয়ে যায় সে।–কি সব আবোল-তাবোল বকছেন মশাই পাগলের মতো?

এখন আপনি দেখছি তুমি ঊননব্বই ইচর-পাকা।

আর আপনি পাঁচশো উজবুক জোর গলাতেই সে জাহির করে।

আমি ৯৭ অগ্নিশর্মা হই, ৫ আঙুলে ওর পঞ্চাশ কান পাকড়ে ধরি–বললেই হলো,৫০০? সাংখ্যদর্শন বোঝা অত সহজ না! ১০০-এর ওপরে সংখ্যাই নেই!

বলে ওর ৪৩ কান পাকড়ে ৭৫ জোরে ৮৫ আরামে বলতে শুরু করে দিই। ভাবতে থাকি মোট কান-সংখ্যার বাকি ৫ কে রেহাই দেব, না, এই সঙ্গেই বাগিয়ে ধরব? কিংবা আমার মুক্ত ৫০ হাতে ওর ২২ গালে ৮২ জোরালো এক চড় কষিয়ে দেব এক্ষুণি?

ইত্যাকার বিবেচনা করছি এমন সময়ে ও তীব্র চিৎকার শুরু করে দেয়। ওর বাবা ছুটে আসেন টেলিগ্রামের মত। ওর দাদাও আসে পাশের বাড়ির তাসের আড্ডা ফেলে। পাড়াপড়শীরাও। সকালের দেখা হওয়া সেই বন্ধুটিও এই মাহেন্দ্রক্ষণে এসে জোটেন কোত্থেকে।

২৬ কান্নার আওয়াজে ৬৩ গলার অস্পষ্টা মিলিয়ে তারস্বরে আওড়াতে থাকে রাজীব–আমি ঘুড়ি ওরাচ্ছি, কোথাও কিছু নেই, কোনো বলা কওয়া না, এই লোকটা হঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে ধরে ধরে মারছে কেবল আমায়! আর অঙ্ক কষে কষে কী সব গালাগাল দিচ্ছে–

আমার বন্ধু মহেন্দ্র এসে মাঝখানে পড়েন–আহা হ্যাঁ! করছেন কি! করছেন কি? দেখছেন না ভদ্রলোকের হিস্টিরিয়া হয়েছে!

অ্যাঁ? হিস্টিরিয়া?

দেখছেন না, চোখ লাল আর গা কাঁপছে ওর! এই সব তো হিস্টিরিয়ার লক্ষণ!

চোখ লাল আমার ৯৪ রাগে, কাঁপছিও সেই কারণেই! হিস্টিরিয়া না কচু! তবু ওদের ৭২ বোকামি আমাকে ৯২ অবাক করে দেয়।

আমার বন্ধু অকস্মাৎ ডাক্তার হয়ে ওঠেন–জল, কেবল জলই হচ্ছে এ রোগের ওষুধ। মাথায় রক্ত উঠলেই মৃত্যু! রক্ষে নেই তাহলে আর!

হিস্টিরিয়ার নামে ওদের বীররস অচিরে অপত্য স্নেহে পরিণত হয়, যে যার বাড়িতে ছুটে যায়, এক এক বালতি জল নিয়ে বেরিয়ে আসে ছুটতে ছুটতে।

আমার মাথায় ঢালতে আরম্ভ করে–সবাই মিলে।

বাধা দেবার আগেই বালতি খালি হয়েছে। কাপড় জামা ভিজে আমার একশী–মানে ১০০ই। একি আপদ বলো দেখি। ভারী বিচ্ছিরি!

আমি পালাবার চেষ্টা করি। কয়েকজন মিলে চেপে ধরে আমায়। আরো–আরো-আরো বালতি খালি হতে থাকে! হাঙ্গামা আর বলে কাকে!

একে পৌষের ৯৫ শীত, তার ওপরে ৫২ কনকনে ঠাণ্ডা জল, তার ওপরে আবার, এই দুর্য্যোগেই, সাইসাই করে বইতে পারে শুরুর করেছে উত্তুরে হাওয়া–৭৭ শীতল। কাহাকত আর সওয়া যায়? ১ ঝটকায় হাত পা ছড়িয়ে নিই, বলি–তোমাদের এই ৪৯ পাগলামি বরদাস্ত করা সম্ভব  নয় আমার পক্ষে।

এই বলে ১ দৌড়ে যেই না আমি ৬৫ দিতে যাচ্ছি, ওরা ৭৭ ক্ষিপ্রতায় আমাকে পাকড়ে ফেলে, ফলে আমারই চাদর দিয়ে বাঁধে আমাকে ল্যাম্পপোষ্টের সঙ্গে। ৮৮ কষ্ট বোধ হতে থাকে আমার। কষ্টের চূড়ান্ত যাকে বলে।

এমনি সময়ে এক হোসপাইপওয়ালা রাস্তায় জল দিতে আসে। রাজীব তা হাত থেকে পাইপ হাতিয়ে আমাকেই লক্ষ্য করে! তার যাবতীয় রাগ জলাঞ্জলি দিয়ে কর্ণমোদন বেদনা ভুলে আমার পীড়নের সাধু প্রতিশোধ নিতে চায়। শিশু ভোলানাথ এক নম্বর।

এই-এই-এই! ওকি হচ্ছে চেঁচিয়ে উঠেছি আমি।

৬০ এর বাছা, শুনবে কেন সে? উনুখর জলের তোড় ছেড়ে দেয় সে আমার মুখের ওপর, ৫৬ পুলকে। অর্থাৎ পুলকের সেই ডিগ্রীতে, যেখানে সে নিজে ছাপিয়ে উঠেছে এবং ছাপাতে চাইছে অপরকেও।

এতক্ষণে ঠিক হয়েছে! বন্ধুবর উৎসাহে ৬৯ হয়ে ওঠেন–এইবার ঠাণ্ডা হবে।

জলের গোঁত্তা এসে ধাক্কা মারে নামে চোখে মুখে মাথায় গায়– কোথায় না!

কতক্ষণ আর এই বরফি জলের টাল সামলানো সম্ভব ১ জনের পক্ষে? ক্রমশই আমি কাহিল মেরে আসি। একেবারে ঠাণ্ডা হতে, অর্থাৎ (৫) পঞ্চত্ব পেতে বেশি দেরি নাই বুঝতে পেরে আর বিলম্ব হয় না আমার।

এর পরের ইতিহাস অতি সংক্ষিপ্তই। জলযোগের পর অ্যাম্বুলেন্সযোগে আমাকে পাঠায়ে দেয় হাসপাতালে। সেখানে এখন আমি।

হিস্টিরিয়ার কবল থেকে বেঁচেছি। এখন ভুগছি খালি নিউমোনিয়ায়। অমন ৫৫ জল চিকিৎসার পরিণাম তো একটা আছেই!

অঙ্ক আর সাহিত্যের যোগাযোগে যে আবিষ্কারটা আমি করেছিলাম সেটা আর চালু করা গেল না এ-বাজারে। আঙ্কিক সাহিত্যিকের ৯৯ দশায় অর্থাৎ অন্তিম অবস্থায় তার সাহিত্য-অঙ্কের যবনিকা পতন হল।

সাহিত্যে প্লাস অঙ্ক, তার সঙ্গে যদি সামান্য একটা ছেলেকে যোগ দেওয়া যায় তার ফল দাঁড়ায় প্রাণবিয়োগ। অর্থাৎ একেবারে শূন্য। ক্ষুদ্র, বৃহৎ, ১-ই কি আর ১০০ই কি, সব ব্যাপারেই ছেলেদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া নিরাপদ। চাইল্ড ইজ দি ফাদার অফ ম্যান, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন; এই কথাগুলোর মানে আমি বুঝতে পারলাম এতদিনে আমার হাড়ে হাড়ে। এর যথার্থ দামও এতদিনে আত্মসাৎ করতে পারলাম। অর্থাৎ, ছেলেরা হচ্ছে মানুষের বাবা! আর, বাবার সঙ্গে লাগতে গেলে কাবার হতে কতক্ষণ?

আবিষ্কারকের ক্রমপরিণতি খুব সুবিধের হল না, সেজন্য দুঃখ নেই। কোন দেশে কোন কালেই হয় না, ইতিহাস পড়ে জানা আছে। যাই হোক, এই সুযোগে সেই ভদ্রলোক, সেই মহেন্দ্রবাবু, মাহেন্দ্রক্ষণে যিনি অযাচিত এসে বন্ধুকৃত্য করেছিলেন তাকে ধন্যবাদ দিয়ে রাখি। হিস্টিরিয়ার টাল সামলেছি, নিউমোনিয়ার ধাক্কা সামলাব কিনা কে জানে! আগে থেকে দিয়ে রাখাই ভাল।

৬৭ জলকষ্টের কথা আর মনে নেই, এখন ৭৬ মন্বন্তর আমার সম্মুখে, সাবু বালিই খালি পথ্য আমার এখন।

 অশ্বত্থামা হতঃ ইতি

পাশের বাড়ি বেরিবেরি হওয়ার পর থেকেই মন খারাপ যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক যে ছিল, তা নয়, সম্পর্ক হবার আশঙ্কাও ছিল না, কিন্তু বেরিবেরির সঙ্গে সম্পর্ক হতে কতক্ষণ? যে বেপরোয়ো ব্যরাম কোনদেশ থেকে এসে এতদূর পর্যন্ত এগুতে পেরেছে, তার পক্ষে আর একটু কষ্ট স্বীকার করা এমন কি কঠিন!

কদিন থেকে শরীরটাও খারাপ বোধ করতে লাগলাম। মনের মধ্যে স্বগতোক্তি শুরু হয়ে গেল–ভাল করছ না হে, অশ্বিনী! সময় থাকতে ডাক্তার-টাক্তার দেখাও।

মনের পরামর্শ মানতে হোলো। ডাক্তারের কাছেই গেলাম। বিখ্যাত গজেন ডাক্তারের কাছে। আমাদের পাড়ায় ডাক্তার এবং টাক্তার বলতে একমাত্র তাঁকেই বোঝায়।

তিনি নানারকমের পরীক্ষা করলেন, পালসের বীট গুণলেন, ব্লাডপেসার নিলেন, স্টেথিসকোপ বসালেন, অবশেষে নিছক আঙুলের সাহায্যে বুকের নানাস্থান বাজাতে শুরু করে দিলেন। বাজনা শেষ হলে বললেন–আর কিছু না, আপনার হার্ট ডায়ালেট করেছে।

বলেন কি গজেনবাবু?–আমার পিলে পর্যন্ত চমকে যায়।

তিনি দারুন গম্ভীর হয়ে গেলেন–কখনো বেরিবেরি হয়েছিল কি?

হুঁ হয়েছিল। পাশের বাড়িতে। ভয়ে ভয়ে বলতে হোলো। ডাক্তারের কাছে ব্যারাম লুকিয়ে লাভ নেই!

ঠিকই ধরেছি। বেরিবেরির আফটার–এফক্ট-ই এই।

তা হলে কি হবে? আমি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লাম–তা হলে কি আমি আর বাঁচবো না?

একটু শক্ত বটে। সঙ্গীন কেস। এরকম অবস্থায় যে-কোন মুহূর্তে হার্টফেল করা সম্ভব।

অ্যাঁ! বলেন কি গজেনবাবু! না, আপনার কোনো কথা শুনব না। আমাকে বাঁচাতেই হবে আপনাকে।–করুণ কণ্ঠে বলি–তা যে করেই পারেন আমি না বেঁচে থাকলে আমাকে দেখবে কে? আমাকে দেখবার আর কেউ থাকবে না যে। কেউ আমার নেই।

পাঁচটাকা ভিজিট দিয়ে ফেললাম।–আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখা যাক–গজেন ডাক্তার বললেন–একটা ভিজিটালিসের মিক্সচার দিচ্ছি, আপনাকে। নিয়মিত খাবেন, সারলে ওতেই সারবে।

আমি আর পাঁচটাকা ওঁর হাতে গুঁজে দিলাম–তবে তাই কয়েক বোতল বানিয়ে দিন আমায়, আমি হরদম খাবো।

না, হরদম নয়। দিনে তিনবার। আর, কোথাও চেঞ্জে যান। চলে যান–পশ্চিম টশ্চিম। গেলে ভালো হয়। সেখানে গিয়ে আর কিছু নয়, একদম কমপ্লিট রেস্ট।

প্রাণের জন্য মরীয়া হতে বেশী দেরী লাগে না মানুষের। বললাম–আচ্ছা, তাই যাচ্ছি না হয়। ডালটনগঞ্জে আমার বাড়ি, সেখানেই যাবো।

কমপ্লিট রেস্ট, বুঝেছেন তো? হাঁটা-চলা, কি ঘোরাফেরা, কি দৌড়ঝাঁপ, কি কোনো পরিশ্রমের কাজ একদম না! করেছেন কি মরেছেন–যাকে বলে হার্টফেল–দেখতে শুনতে দেবে না–সঙ্গে সঙ্গে খমত। বুঝেছেন তো অশ্বিনীবাবু?

অশ্বিনীবাবু হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, ডাক্তার দেখাবার আগে বুঝেছেন এবং পরে বুঝেছেন–যেদিনই পাশের বাড়িতে বেরিবেরির সূত্রপাত হয়েছে, সেদিনই তিনি জেনেছেন তার জীবন সংশয়। তবু গজনবাবুকে আশ্বান্ত করি–নিশ্চয়! পরিশ্রম না করার জন্যই পরিশ্রম, তাই করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এখন থেকে অলস হবার জন্যই আমার নিরলস চেষ্টা থাকবে। এই বলে আমি, ওরফে অশ্বিনীবাবু, বিদায় নিলাম।

মামারা থাকেন ডালটনগঞ্জে। সেখানে তাঁদের ক্ষেত-খামার। মোটা বেতনের সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমিটমি কিনে চাষবাস নিয়ে পড়েছেন। বেকার-সমস্যা সমাধানের মতলব ছোটবেলা থেকেই মামাদের মনে ছিল, কিন্তু চাকরির জন্য তা করতে পারছিলেন না। চাকরি করলে আর মানুষ বেকার থাকে, কি করে? সমস্যাই নেই তো সমাধান করবেন কিসের? অনেকদিন মনোকষ্টে থেকে অবশেষে তারা চাকরিই ছাড়লেন।

তারপরেই এই চাষাবাস। কলকাতার বাজারে তাদের তরকারি চালান আসে। সরকারী-গর্বে অনেককে গর্বিত দেখেছি, কিন্তু তরকারির গর্ব কেবল আমার মামাদের! একচেটে ব্যবসা, অনেকদিন থেকেই শোনা ছিল, দেখার বাসনাও ছিল; এবার এই রোগের অপূর্ব্ব সুযোগ ডালটনগঞ্জে গেলাম, মামার বাড়ির যাওয়া হোলো, চেঞ্জেও যাওয়া হোলো এবং চাই কি, তাঁদের সাম্রাজ্য চোখেও দেখতে পারি, চোখেও দেখতে পারি হয়তো বা।

মামারা আমাকে দেখে খুশী হয়ে ওঠেন।বেশ বেশ, এসেছে যখন, তখন থাকো কিছুদিন। বড়মামা বলেন।

থাকবই তো পায়ের ধুলো নিতে নিতে বলি–চেঞ্জের জন্যই তো এলাম।

মেজমামা বলেন–এসেছ ভালই করেছ, এতদিনে পটলের একটা ব্যবস্থা হোলো।

ছোটমামা সায় দেন–হ্যাঁ, একটা দুর্ভাবনাই ছিল যাক, তা ভালোই হয়েছে।

তিন মামাই যুগপৎ ঘাড় নাড়তে থাকেন।

বুঝলাম, মামাতো ভাইদের কারো গুরুভার আমায় বহন করতে হবে। হয়তো তাদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। তা বেশ তো, ছেলেপড়ানো এমন কিছু শক্ত কাজ নয় যে, হার্টফেল হয়ে যাবে। গুরুতর পরিশ্রম কিছু না করলেই হোলো; টিউশনির যেগুলো শ্রমসাধ্য অংশ–পড়া নেওয়া, ভুল করলে শোধরাবার চেষ্টা করা, কিছুতেই ভুল শোধরালে শেষে পাখাপেটা করা এবং মাস ফুরোলে প্রাণপণে বেতন বাগানন, এখন থেকেই এগুলো বাদ দিতে সর্তক থাকলাম। হা, সাবধানেই থাকবো, রীতিমতই, যাতে কান মোলর কষ্ট স্বীকারটুকুও না করতে হয়, বরঞ্চ প্রশ্রয়ই দেব পটলকে–যদি পড়াশুনায় ফাঁকি দিতে থাকে, কিংবা কাঠফাটা রোদ–জেগে উঠলেই ওর যদি ডাণ্ডাগুলিখেলার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, ভেগে পড়তে চায়, আমার উৎসাহই থাকবে ওর তরফে। ভ্রাতৃপ্রীতি আমার যতই থাক, প্রাণের চেয়ে পটল কিছু আমার আপনার নয়, তা মামাতো পটলই কি, আর মাসতুতো পটলই কি!

মামাতো ভাইদের সঙ্গে মোলাকাত হতে দেরী হোলো না। তিনটে ডানপিটে বাচ্চা-মাথা পিছু একটি করে গুণে দেখালাম।–এর মধ্যে কোনটি পটল, বাজিয়ে দেখতে হয়। আলাপ শুরু করা গেল–তোমার নাম কি খোকা?

রা, ঠনাঠন।

অ্যাঁ। সে আবার কি? পরিচয়ের সূত্রপাতেই পিলে চমকে যায় আমার। দ্বিতীয় জনের। অযাচিত জবাব আসে–হামার নাম ভটরিদাস হো!

আমার তো দম আটকাবার যোগাড়! বাঙ্গালীর ছেলের এ সব আবার কি নাম! এমন বিধঘুঁটে এরকম বদ নাম কেন বাঙ্গারীর?

বড়মামা পরিষ্কার করে দেন–যে দেশে থাকতে হবে, সেই দেশের দস্তর মানতে হবে না? তা নইলে বড় হয়ে এরা এখানকার দশজনের সাথে মিলে মিশে খাবে কিসে, মানিয়ে চলবেই বা কি করে?

মেজমামা বলেন–এ সব বাবা, ডালটনী নাম। সে দেশের যা দস্তুর!

ছোটমামা বলেন–এখানকার সবাই বাঙালীকে বড় ভয় করে। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি যুদ্ধ করতে আসিনি তো! তাই এদের পক্ষে ভয়ঙ্কর বাঙ্গালী নাম সব বাদ দিয়ে এদেশী সাদাসিদে নাম রাখা।

তৃতীয়টিকে প্রশ্ন করতে আমার ভয় করে–তুমিই তবে পটল?

ছেলেটির দিক থেকে একটা ঝটকা আসে–আঃ! হামার নাম গিধৌড় বা!

হার্টফেলের একটা ভয়ানক ধাক্কা ভয়ানকভাবে কেটে যায়। পকেট থেকে বের করে চটকরে এক, দাগ ভিজিটালিস খেয়ে নিই–পটল তবে কার নাম?

তিনজনেই ঘাড় নাড়ে–জানহি না তো!

তুমহারা নাম কেয়া জী? জিগ্যেস করে ওদের একজন।

আমার নাম? আমার নাম? আমতা আমতা করে বলি–আমার নাম শিব্রাম ঠনাটন!

যস্মিন দেশে যদাচারঃ। ডালটনগঞ্জের ডালভাঙ্গা কায়দায় আমার নামটার একটা হিন্দি সংস্করণ বার করতে হয়।

ভটরিদাস এগিয়ে এসে আমার হাতের শিশিটা হস্তগত করে–সিরপ হ্যায় কেয়া?

তিনটি বোতল ওদের তিনজনের হাতে দিই মেজমামা একটি লেবেলের উপর দৃক পাত করে বলেন–সিরপ নেহি! ভিজটলিস্ হ্যায়। খাও মৎ-তাৰু উপর রাখ দেও।

ভটরিদাস রাম ঠনঠনকে বুঝিয়ে দেয়–সমঝা কুছ? ইসসে হি ডিজ লনঠন বনতি। এহি দুবাই সে।

বড়মামা বলেন–শিবু সেই কাল বিকেলে গাড়িতে উঠেছে, ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়? কিছু খেয়েদেয়ে নাও আগে।

এ্যাম্বক ওঝার ডাক পড়ল। ছোটমামা আমার বিস্মিত দৃষ্টির জবাব দেন–তোমার দাদামশায়ের সঙ্গে মামীরা সব তীর্থে গেছেন কিনা, তাই দিনকত-র জন্য এই মহারাজ!কে কাজ চালানোর মত রাখা হয়েছে।

তেইশটা চাপাটি আর কুছ তরকারি নিয়ে মহারাজের আবির্ভাব হয়। তিনটি পাচাটি বা চপেটাঘাত সহ্য করতেই প্রাণ যায় যায়, তারপর কিছুতেই আর টানতে পারি না। মামারা হাসতে থাকেন। অগত্যা লজ্জায় পড়ে আর আড়াইটা কোনো রকমে গলাধঃকরণ করি। টানে টুনে পাঠাইল গলায় তলায়, ঠেলে ঠুলে।

মামা ভয়ানক হাসেন–তোমার যে দেখি পাখির খোরাক হে!

আমি বলি–খেতে পারতাম। কিন্তু পরিশ্রম করা আমার ডাক্তারের নিষেধ কিনা।

আঁচিয়ে এসে লক্ষ্য করি, আমার ভুক্তাবশেষ সেই সাড়ে সাতটা চাপাটি ফ্রম রাম ঠনঠন টু গিধৌর চক্ষের পলকে নিঃশেষ করে এনেছে। এই দৃশ্য দেখাও কম শ্রমসাধ্য নয়, তৎক্ষণাৎ চার দাগ ভিজিটালিস খেতে হয়।

বড়মামা বলেন–চলো একটু বেড়িয়ে আসা যাক। নতুন দেশে এসেছ জায়গাটা দেখবে না? বলে আমাকে টেনে নিয়ে চলতে থাকেন।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরুতে হয়। ডাক্তারের মতে বিশ্রাম দরকার–একেবারে কমপ্লিট রেসট। কিন্তু মামারা রেসট কাকে বলে জানেন না, আলস্য ওঁদের দুচক্ষের বিষ। নিজেরা অলস তো থাকবেনই না, অন্য কাউকে থাকতেও দেবেন না।

সারা ডালটনগঞ্জটা ঘুরলাম, অনেক দ্রষ্টব্য জায়গা দেখা গেল, যা দেখবার কোনো প্রয়োজনই আমার ছিল না কোনদিন। পুরো সাড়ে তিন ঘণ্টায় পাক্কা এগারো মাইল ঘোরা হোলো। প্রতি পদক্ষেপেই মনে হয়, এই বুঝি হার্টফেল করল। কিন্তু কোন রকমে আত্মসংবরণ করে ফেলি। কি করে যে করি, আমি নিজেই বুঝতে পারি না।

বাড়ি ফিরে এবার বিয়াল্লিশটা চাপাটির সম্মুখীন হতে হয়। পাখির খোরাক বলে আমাকেই সব থেকে কম দেওয়া হয়েছে। পরে খাব জানিয়ে এক ফাঁকে ওগুলো ছাদে ফেলে দিয়ে আসি, একটু পরে গিয়ে দেখি,তার চিহ্নমাত্রও নেই। পাখির খোরাক তাহলে সত্যিই!

খাবার পর শোবার আয়োজন করছি বড়মামা বলেন–আমাদের ক্ষেতখামার দেখবে চলো।

ছোটমামা বলেন–দিবানিদ্রা খারাপ। ভার খারাপ! ওতে শরীর ভেঙে পড়ে।

আমি বলি–আজ আর না, কাল দেখব।

তবে চল, দেহাতে দিয়ে আখের রস খাওয়া যাক, আখের খেত দেখেছ কখনও?

আখের রসের লালসা ছিল, জিজ্ঞাসা করলুম–খুব বেশি দূরে নয় তো?

আরে, দূর কীসের? কাছেই তো–দু-কদম মোটে।

কদবে কদম হয় জানি নে, পাক্কা চোদ্দ মাইল হাঁটা হোলো, চোখে ফুল দেখছি! তবু শুনি–এই কাছেই। এসে পড়লাম বলে।

প্রাণের আশা ছেড়েই দিয়েছি, মামার পাল্লায় পড়লে প্রাণ প্রায়ই থাকে না-রামায়ণ-মহাভারতে তার প্রমাণ আছে।

আরো দু-মাইল পরে দেহাত। আখের রস খেয়ে দেহ কাত করলাম। আমার অবস্থা দেখে মামাদের করুণা হোলো বোধ হয়, দেহাতি রাস্তা ধরে এক্কা যাচ্ছিল একটা, সেটাকে ভাড়া করে ফেললেন।

এক্কায় কখনও চড়িনি; কিন্তু চাপবার পর মনে হলো, এর চেয়ে হেঁটে ফেরাই ছিল ভালো। এক্কার এমনি দাপট যে, মুহূর্তের আমি আকাশে উদ্ধৃত হতে লাগলাম এ যাত্রার এতক্ষণে টিকে থাকলেও এ-ধাক্কার এবার গেলাম নির্ঘাত, সজ্ঞানে এক্কা-প্রাপ্তি অর দেরি নেই–টের পেলাম বেশ।

বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল–এক্কায় যতক্ষণ এসেছি, তার দুই তৃতীয়াংশ সময় আকাশে আকাশেই ছিলাম, একথা বলতে পারি; কিন্তু সেই আকাশের ধাক্কাতেই সাসা গায়ে দারুণ ব্যাথা! হাড়পাজরা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে ঝরঝরে হয়ে গেয়ে বোধ হতে লাগল। তেত্রিশটা চাপাটির মধ্যে সওয়া তিনখানা আত্মসাৎ করে শুয়ে পড়লাম। কোথায় রামলীলা হচ্ছিল, মামারা দেখতে গেলেন। আমায় সঙ্গে যেতে সাধলেন, বার বার অভয় দিলেন যে এক কদমের বেশি হবে না, আমি কিন্তু ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম। ডালটনী ভাষায় এক কদম মানে যে একুশ মাইল, তা আমি ভাল রকমই বুঝেছি।

আলাদা বিছানা ছিলনা, একটিমাত্র বড় বিছানা পাতা,তাতেই ছেলেদের সঙ্গে শুতে হোলো। খানিকক্ষণেই বুঝতে পারলাম যে হ্যাঁ, সৌরজগতেই বাস করছি বটে– আমার আশেপাশে তিনটি ছেলে যেন তিন টি গ্রহ! তাদের কক্ষ পরিবর্তনের কামাই নেই। এই যেখানে একজনের মাথা দেখি, একটু পরেই দেখি, সেখানে তার পা; কানিক বাদে মাথা বা পার কোনটাই দেখতে পাই না। তার পরেই অকস্মাৎ তার কোনো একটার সঙ্গে আমার দারুণ সংঘর্ষ লাগে। চটকা ভেঙে যায়, আহত স্থানের শুশ্রূষা করতে থাকি কিন্তু ওদের–কারুর নিদ্রার বিন্দুমাত্রও ব্যত্যয় ঘটে না। ঘুমের ঘোরে যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরছে ওরা–আমিও যদি ওদের সঙ্গে ঘুরতে পারতাম, তাহোলে বেধ হয় তাল বজায় থাকত, ঠোকাঠুকি বাধার সম্ভাবনাও কমতো কিছুটা। কিন্তু মুশকিল এই ঘুরতে গেলে আমার ঘুমনো হয় না, আর ঘুমিয়ে পড়লে ঘোরার কথা একদম ভুলে যাই।

ছেলেগুলোর দেখছি পা দিয়েও বক্সিং করার বেশ অভ্যেস আছে এবং সব সময়ে নট-টু-হিট বিলো-দি-বেল্ট-এর নিয়ম মেনে চলে বলেও মনে হয় না। নাক এবং দাঁত খুব সতর্কভাবে রক্ষা করছি–ওদের ধাক্কায় কখন যে দেহচ্যুত হয়, কেবলি এই ভয়। ঘুমানোর দফা তো রফা!

ভাবছি, আর চৌকিদারিতে কাজ নেই, মাটির নেমে সটান জমিদার হয়ে পড়ি। প্রাণ হাতে নিয়ে এমন করে ঘুমনো যায় না। পোয় না আমার। এদিকে দুটো তত বাজে। নিচে নেমে শোবার উদ্যোগে আছি, এমন সময়ে নেপথ্যে মামাদের শোরগোল শোনা গেল রামলীলা দেখে আড়াইটা বাজিয়ে ফিরছেন এখন। অগত্যা মাটি থেকে পুনরায় প্রমোশন নিতে হেলো বিছানায়।

মামারা আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন, অর্থাৎ তাদের ধারণা যে, জাগালেন। তারপর ঝাড়া দু ঘণ্টা রামলীলার গল্প চলল। হনুমানের লম্পঝম্প তিন মামাকেই ভারী খুশি করেছে সে সমস্তই আমাকে শুনতে হোলো। ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে আসছিল কেবল হুঁ হাঁ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক মামা প্রশ্ন করে বসলেন–হনুমানের বাবা কে জানো তো শিব্রাম?

ঘুমের ঝোঁকে ইতিহাসটা ঠিক মনে আসছিল না। হনুমান পুরাল হলে মামাদের নাম করে দিতাম, সিঙ্গুলার অবস্থায় কার নাম করি? সঙ্কোচের সহিত বললাম–জাম্বুমান নয়তো?

বড়মামা বললেন–পাগল!

মেজমামা বললেন–যা আমরা নিঃশ্বাস টানছি, তাই।

ও! এতক্ষণে বুঝেছি!–হঠাৎ আমার বুদ্ধি খুলে যায়, বলে ফেলি চট করে–ও! যতো সব রোগের জীবাণু!

বড়মামা আবার বলেন–পাগলা!

উহুঁহুঁ!–মেজমামাও আমায় দমিয়ে দেন, বলেন–না ও সব নয়। জীবাণুটিবাণু না।

জীবাণুটিবাণুও না? তা হোলে কি তবে? আমার তো ধরণা এই সব প্রাণীরাই আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে যাতায়াত করে।–আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি।

ছোটমামা বলেন–পবনদেব।

সাক্ষাৎ পবনদেবকে নিঃশ্বাসে টানছি এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়েছি, কিংবা হয়তো ঘুমাইনি। বড়মামা আমাকে টেনে তুললেন–ওঠো, ওঠো; চারটে বেজে গেছে, ভোর হয়ে এল। মুখ হাত ধুয়ে নাও, চলো বেরিয়ে পড়ি। আমরা সকলেই প্রাতঃভ্রমণ করি রোজ। তুমিও বেড়াবে আমাদের সঙ্গে।

মেজমামা বললেন–বিশেষ করে চেঞ্জে এসেছে যখন! হাওয়া বদলাতেই এসেছো তো?

ছোটমামাও সায় দেয়–ডালটনগঞ্জের হাওয়াই হোলো আসল! হাওয়া খেতে এসে হাওয়াই যদি না খেলে, তবে আর খেলে কি?

চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে মামাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। সাড়ে সাত মাইল হাঁটবার পর বড়মামা দুধারে যতদুর যাক, বাহু বিস্তার করলেন–এই সব-সবই আমাদের জমি।

যতদুর চোখ যায়, জমি! কেবল জমিই চোখে পড়ে। মেজমামা বলেন–এবার যা আলু ফলেছিল তা যদি দেখতে! পটলও খুব হবে এবার।

ছোটমামা ঘাড় নাড়েন–আমার সব নিজেরাই করি তো! জন-মজুরের সাহায্য নিই না। স্বাবলম্বনের মত আর কী আছে? গতবারে আমরা তিন ভায়ে তুলে কুলিয়ে উঠতে পরলাম না, প্রায় আড়াই কী লক্ষ পটল এঁচোড়েই পেকে গেল। বিলকুল বরবাদ। পাকা পটল তো চালান যায় না, কে কিনবে?

বড়মামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন–তবুও তো প্রত্যেকে দশলাখ করে তুলেছিলাম।

মেজমামা আশ্বাস দেন–যাক, এবার আর নষ্ট যাবার ভয় নেই, ভাগনেটা এসে পড়েছে, বাড়তির ভাগটা ওই তুলতে পারবে।

ছোটমামা বলেন–কিন্তু এবার পটল ফলেছেও দেড়া।

তা ও পারবে। জোয়ান ছেলে– উঠে পড়ে লাগলে ও আমাদের ডবল তুলতে পারে। পারবে? বড়মামা আমার পিঠ চাপড়ান।

পৃষ্ঠপোষকতার ধাক্কা সামলে ক্ষীণস্বরে বলি–পটলের সিজনটা কবে?

আর কি, দিন সাতেক পরেই পটল তোলার পালা শুরু হবে। ছোটমামার কাছে ভরসা পাই।

চোদ্দ মাইল হেঁটে টলতে টলতে বাড়ি ফিরি। ফিরেই ভিজিটালিসের অন্বেষণে গিয়ে দেখি, তিন বোতলই ফাঁক। গিধৌড়কে জিজ্ঞাসা করি–ক্যা হুয়া।

গিধৌয় জবাব দেয়–উ দোনো খা ডালা।

ভটরি দাস প্রতিবাদে করে–নেহি জি, উ ভি খায়া! আপকো ভিজটালিস উভি খাইস।

কেবল খাইস নয়, আমাকেও খেয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি এই দারুণ পরিশ্রমের পর এখন কি করে হার্টফেলের হাত থেকে বাঁচি। আত্মরক্ষা করি আপনার?

গজেন ডাক্তারকে চিঠি লিখতে বসলাম কাল এসে অবধি আদ্যোপান্ত সব হতিহাস সবিশেষ অবশেষে জানাই–

ভিজিটালিস নেই, ভালই হয়েছে, আমার আর বাঁচাবার সাধও নেই। বাঁচতে গেলে আমায় পটল তুলতে হবে। এক-আধটা নয়, সাড়ে তিনলাখ পটল তার বেশিও হতে পারে। তুলতে হবে আমাকে। পত্রপাঠ এমন একটা ওষুধ চট করে, পাঠাবেন, যাতে এই পটল-তোলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাই এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার হার্টফেল করে। এ পর্যন্ত যা দারুণ খাটুনি গেছে, তাতেও যখন এই ডায়ালেটেড হার্ট আমার ফেল করেনি, তখন ওর ভরসা আমি ছেড়েই দিয়েছি। ওর ওপর নির্ভর করে বসে থাকা যায় না। সাড়ে তিনলক্ষ পটল তোলা আমার সাধ্য নয়, তার চেয়ে আমি একবার একটিমাত্র পটল তুলতে চাই-পটলের জিন আসার ঢের আগেই। যখন মরবারও আশা নেই, বাঁচাবারও ভরসা নাস্তি–তখন এ জীবন রেখে লাভ? ইতি মরণাপন্ন (কিংবা জীবনাপন্ন) বিনীত–ইত্যাদি।

এক সপ্তাহ গেল, দুসপ্তাহ কেটে গেল, তবু ডাক্তারের কোনো জবাব নেই, ওষুধ পাঠাবার নাম নেই। কাল সকাল থেকে পটল-পর্ব শুরু হবে ভেবে এখন থেকেই আমার স্বকম্প আরম্ভ হয়েছে। এঁটে রেখেছি মামারা রাত্রে রামলীলা দেখতে গেলেই সেই সুযোগে কলকাতার গাড়িতে সটকান দেব।

কলকাতায় ফিরেই গজেন ডাক্তারের কাছে ছুটি। গিয়ে দেখি কম্পাউন্ডার দুজন গালে হাত দিয়ে বসে আছে, রোগীপত্তর কিছু নেই। জিজ্ঞাসা করলাম–গজেনবাবু আসেননি আজ? কোথায় তিনি?

দু-তিনবার প্রশ্নের পর অঙ্গুলি নির্দেশ জবাব পাই।

ও! এই বাড়ির তেতলায় গেছেন! রোগী দেখতে বুঝি?

উত্তর আসে–না, রোগী দেখতে নয়, আরো উপরে।

আলো উপরে? আরে উপরে রকম? বাড়ির ছাদে নাকি? আমি অবাক হয়ে যাই।–ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন বুঝি?

আজ্ঞে না, তারও উপরে।

ছাদের ও উপরে? তবে কি এরোপ্লেনের সাহায্যে তিনি আকাশেই উড়ছেন এখন? ডাক্তার মানুষের এ আবার কি ব্যারাম! বিস্ময়ের আতিশয্যে প্রায় ব্যাকুল হয়ে উঠি; এমন সময়ে হোট কম্পাউন্ডারটি গুরুগম্ভীরভাবে, অথচ সংক্ষেপে জানান–তিনি মারা গেছেন।

মারা গেছেন! সেকি রকম!!!–দশদিনের মধ্যে তৃতীয়বার আমার পিলে চমকায়। হার্টফেল ফেল হয়।

বুড়ো কম্পাউন্ডারটি বলেন–কি আর বলবো মশায়! এক চিঠি–এক সর্বনাশে চিঠি–ডালটনগঞ্জ থেকে–অশ্বিনীর না ভরণীর কার এলো যেন–তাই পড়তে পড়তে ডাক্তারবাবুর চোখ উল্টে গেল। বার তিনেক শুধু বললে–কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ!!…তার পরে আর কিছুই বললেন না, তার হার্টফেল হোলো।

নিজের পাড়ায় যতটা অপরিচিত থাকা যায়! এই জন্যেই গজেন ডাক্তারের কাছে আমি অশ্বিনীরূপ ধারণ করেছিলাম। আজ সেই ছদ্মনামের মুখোস আর খুললাম না, নিজের কোনো পরিচয় না দিয়েই বাড়ি ফিরলাম। একবার ভাবলাম, বলি যে, সেই সঙ্কট মুহূর্তে ডাক্তারবাবুকে এক ডোজ ভিজিটালিস দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখন আর বলে কি লাভ!

আমার বাঘ শিকার

মুখের দ্বারা বাঘ মারা কঠিন নয়। অনেকে বড় বড় কেঁদো বাঘকে কাঁদো কাঁদো মুখে আধমরা করে ঐ দ্বারপথে এনে ফেলেন। কিন্তু মুখের দ্বারা ছাড়াও বাঘ মারা যায়। আমিই মেরেছি।

মহারাজ বললেন, বাঘ-শিকারে যাচ্ছি। যাবে আমাদের সঙ্গে?

না বলতে পারলাম না। এতদিন ধরে তাঁর অতিথি হয়ে নানাবিধ চর্বচোষ্য খেয়ে অবশেষে বাঘের খাদ্য হবার সময়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলে না। কেমন যেন চক্ষুলজ্জায় বাধে।

হয়তো বাগে পেয়ে বাঘই আমায় শিকার করে বসবে। তবু মহারাজ!র আমন্ত্রণ কি করে অস্বীকার করি? বুক কেঁপে উঠলেও হাসি হাসি মুখ করে বললাম, চলুন যাওয়া যাক। ক্ষতি কি?

মহারাজ!র রাজ্য জঙ্গলের জন্যে এবং জঙ্গল বাঘের জন্যে বিখ্যাত। এর পরে তিনি কোথাকার মহারাজ, তা বোধ হয় না বললেও চলে। বলতে অবশ্য কোন বাধা ছিল না, আমার পক্ষে তো নয়ই, কেন না রাজামহারাজ!র সঙ্গেও আমার দহরম-মহরম আছে–সেটা বেফাঁস হয়ে গেলে আমার বাজারদর হয়ত একটু বাড়তোই। কিন্তু মুশকিল এই, টের পেলে মহারাজ হয়তো আমার বিরুদ্ধে মানহানির দাবি আনতে পারেন–এবং টের পাওয়া হয়তো অসম্ভব ছিল ন। মহারাজ না পড়ন, মহারাজকুমারেরা যে আমার লেখা পড়েন না, এমন কথা হলফ করে বলা কঠিন। তাছাড়া আমি যে পাড়ায় থাকি, যে গুড়াপাড়ায়, কোন মহারাজ!র সঙ্গে আমার খাতির আছে ধরা পড়লে তারা সবাই মিলে আমাকে একঘরে করে দেবে। অতএব সব দিক ভেবে স্থান, কাল, পাত্র চেপে যাওয়াই ভাল।

এবার আসল গল্পে আসা যাক।

শিকার যাত্রা তত বেরোল। হাতির উপরে হাওদা চড়ানো, তার উপরে বন্দুক হাতে শিকারীরা ডজনখানেক চড়াও হাতি চার পায়ে মশ মশ করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে। সব আগের হাতিতে চলেছেন রাজ্যের সেনাপতি। তারপর পাত্র-মিত্র-মন্ত্রীদের হাতি; মাঝখানে প্রকাণ্ড এক দাতালো হাতিতে মশগুল হয়ে স্বয়ং মহারাজ!; তার পরের হাতিটাতেই একমাত্র আমি এবং আমার পরেও ডানহাতি, বাঁহাতি আরো গোটা কয়েক হাতি; তাতে অপাত্ৰ অমিত্ররা! হাতিতে হাতিতে যাকে বলে ধূল পরিমাণ! এত ধূলো উড়ল যে দৃষ্টি অন্ধ, পথঘাট অন্ধকার–তার পরিমাণ করা যায় না।

জঙ্গল ভেঙ্গে চলেছি। বাধা রাস্তা পেরিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ–এখন আর মশ মশ নয়, মড় মড় করে চলেছি। এই ‘মর্মর-ধ্বনি কেন জাগিল রে।’ ভেবে না পেয়ে হতচকিত শেয়াল, খরগোশ, কাঠবেড়ালির দল এধারে ওধারে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিয়েছে, শাখায় শাখায় পাখিদের কিচির-মিচির আর কারো পরোয়া না করে চলেছি। হাতিরা কারো খাতির করে না।

চলেছি তো কতক্ষণ ধরে। কিন্তু কোন বাঘের ধড় দূরে থাক, একটা ল্যাজও চোখে পড়ে না। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর কিসের শোরগোল শোনা গেল। কোত্থেকে একদল বুনো জংলী লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। তারা বনের মধ্যে ঢুকে কি করছিল কে জানে! মহারাজ! হয়তো বাঘের বিরুদ্ধে তাদের গুপ্তচর লাগিয়ে থাকবেন। তারা বাঘের খবর নিয়ে এসেছে মনে হতেই আমার গায়ে ঘাম দেখা দিল।

কিন্তু তারা বাঘের কোন উচ্চবাচ্য করে হাত-তী-হাত-তী বলে চেঁচাতে লাগল।

হাত-তী তো কি? হাতি যে তা তো দেখতেই পাচ্ছ–হাতি কি কখনো দেখনি না কি? ও নিয়ে অমন হৈ চৈ করবার কি আছে? হাতির কানের কাছে ওই চেঁচামিচি আর চোখের সামনে ওরকম লম্ফঝম্ফ আমার ভাল লাগে না। হাতিরা বন্য ব্যবহারে চটে গিয়ে ক্ষেপে যায় যদি? হাতি বলে কি মানুষ নয়? হাতিরও তো মানমর্যাদা আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে!

মহারাজকে কথাটা আমি বললাম। তিনি জানালেন যে, আমাদের হাতির বিষয়ে উল্লেখ করছেন, একপাল বুনো হাতি একদিকেই তাড়া করে আসছে, সেই কথাই ওরা তারস্বরে জানাচ্ছে। এবং কথাটা খুব ভয়ের কথা। তারা এসে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। হাতি এবং হাওদা সমেত সবাইকে আমাদের দলে পিষে মাড়িয়ে একেবারে ময়দা বানিয়ে দেবে।

তৎক্ষণাৎ হাতিদের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হল। কথায় বলে হস্তিযূথ, কিন্তু তাদের ঘোরানো ফেরানোর এত বেজুত যে বলা যায় না। যাই হোক কোন রকমে তো হাতির পাল ঘুরল, তারপরে এলো পালাবার পালা।

আমার পাশ দিয়ে হাতি চালিয়ে যাবার সময় মহারাজ! বলে গেলেন, খবরদার! হাতি থেকে একচুল যেন নড় না। যত বড় বিপদই আসুক, হাতির পিঠে লেপটে থাকবে। দরকার হলে দাঁতে কামড়ে, বুঝেছ?

বুঝতে বিলম্ব হয় না। দূরাগত বুনোদে বজ্রনাদী বৃংহণধ্বনি শোনা যাচ্ছিল-সেই ধ্বনি হন হন করতে এগিয়ে আসছে। আরো-আরো কাছে, আরো আরো কাছিয়ে। ডালে ডালে বাঁদররা কিচমিচিয়ে উঠেছে। আমার সারা দেহ কাটা দিয়ে উঠতে লাগল। ঘেমে নেয়ে গেলাম।

এদিক আমাদের দলের আর আর হাতিরা বেশ এগিয়ে গেছে। আমার হাতিটা কিন্তু চলতে পারে না। পদে পদে তার যেন কিসের বাধা! মহারাজের হাতি এত দূর এগিয়ে গেছে যে, তার লেজ পর্যন্ত দেখা যায় না। আর সব হাতিরাও যেন ছুটতে লেগেছে। কিন্তু আমার হাতিটার হল কি। সে যেন নিজের বিপুল বপুকে টেনে নিয়ে কোনরকমে চলেছে।

আমাদের দলের অগ্রণী হাতিরা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর এধারে বুনো হাতির পাল পেল্লায় ডাক ছাড়তে এগিয়ে আসছে ক্রমশই তার আওয়াজ জোরাল হতে থাকে। আমার মাহুতটাও হয়েছে বাচছা। কিন্তু বাচ্ছা হলেও সেই তখন আমাদের একমাত্র ভরসা।

জিজ্ঞাসা করলাম–কি হে। তোমার হাতি চলছে না কেন? জোরসে চালাও। দেখছ কি?

জোরে আর কি চালাব হুজুর? তিনি পায়ে হাতি আর কত জোরে চলবে বলুন? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে বললে।

তিন পা। তিন পা কেন? হাতিদের তো চার পা থাকে বলেই জানি। অবশ্য, এখন পিঠে বসে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু চার পা দেখেই উঠেছিলাম বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য, ভাল করে ঠিক খেয়াল করিনি।

এর একটা পা কাঠের যে। পেছনের পাটা। খানায় পড়ে পা ভেঙে গেছল। রাজাসাহেব হাতিটাকে মারতে রাজি হলেন না, সাহেব ডাক্তার এসে পা কেটে বাদ দিয়ে কাঠের পা জুড়ে দিয়ে গেল। এমন রঙ বার্নিশ যে ধরবার কিছু জো নেই। ইট্রাপ দিয়ে বাঁধা কি না।

শুনে মুগ্ধ হলাম। ডাক্তার সাহেব কেবল হাতির পা-ই নয়, আমার গলাও সেইসঙ্গে কেটে রেখে গেছেন। আবার মহারাজেরও এমন মহিমা, কেবল বেছে বেছে খোঁড়া হাতিই নয়, দুগ্ধপোষ্য একটা খুদে মাহুতের হাতে অসহায় আমায় সমর্পণ করে সরে পড়লেন।

কাঠের হাতি নিয়ে বাচ্চা ছেলে তুমি কি করে চালাবে?–আমি অবাক হয়ে যাই।

বার্লি আমার নাম–সে সগর্বে জানাল–আর আমি হাতি চালাতে জানব না?

বার্লি? ভারি অদ্ভুত নাম তো।–আমার বিস্ময় লাগে।

আমি সাবুর ভাই। সাবু আমেরিকায় গেছে ছবি তুলতে।

তোমার বার্লিনে যাওয়া উচিত ছিল।–না বলে আমি পারলাম না।–গেলে ভাল করতে।

শোনা মাত্রই নিজের ভুল শোধরাতেই কি না কে জানে, তৎক্ষণাৎ সে হাতির ঘাড় থেকে নেমে পড়ল। নেমেই বার্লিনের উদ্দেশ্যেই কি না কে বলবে দে ছুট। দেখতে দেখতে আর তার দেখা নেই। জঙ্গলের আড়ালে হাওয়া।

আমি আর আমার হাতি, কেবল এই দুটি প্রাণী পেছনে পড়ে রইলাম। আর পেছন থেকে তেড়ে আসছে পাগলা হাতির পাল। তেপায়া হাতির পিঠে নিরুপায় এক হস্তিমুখ।

কিন্তু ভাববার সময় ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাজ পড়ার মতো আওয়াজ চার ধার থেকে আমাদের ছেয়ে ফেলল। গাছপালার মড়মড়ানির সঙ্গে চোখ ধাঁধানো ধুলোর ঝড়। তার ঝাঁপটায় আমাদের দম আটকে গেল একেবারে।

মহারাজ!র উপদেশ মতো আমি এক চুল নড়িনি, হাতির পিঠে লেপটে সেটে রইলাম। হাতির পাল যেমন প্রলয় নাচন নাচতে নাচতে এসেছিল তেমনি হাঁক-ডাক ছাড়তে ছাড়তে নিজের ধান্দায় চলে গেল।

তারা উধাও হলে আমি হাতির পিঠ থেকে নামলাম। নামলাম না বলে খসে পড়লাম। বলাই ঠিক। হাতে পায়ে যা খিল ধরেছিল। নীচে নেমে একটু হাত-পা খেলিয়ে নিচ্ছি, ও-মা, আমার কয়েক গজ দূরে এক কি দৃশ্য! লম্বা চওড়া বেঁটে খাটো গোটা পাঁচেক বাঘ একেবারে কাত হয়ে শুয়ে! কর্তা গিন্নী, কাচ্চা-বাচ্চা সমেত পুরো একটি ব্যাঘ্র-পরিবার হাতির তাড়নায় হয়তো বা তাদের পদচারণায়, কে জানে, হতচৈতনয় হয়ে পড়ে আছে।

কাছাকাছি কোনও জলাশয় থাকলে কাপড় ভিজিয়ে এনে ওদের চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে পারলে হয়তো বা জ্ঞান ফেরানো যায়। কিন্তু এই বিভুয়ে কোথায় জলের আজ্ঞা, আমার জানা নেই। তাছাড়া, বাঘের চৈতনয়সম্পাদক করা আমার অবশ্য কর্তব্যের অন্তর্গত কি না, সে বিষয়েও আমার একটু সংশয় ছিল।

আমি করলাম কি, প্রবীণ বনস্পতিদের ঘাড় বেয়ে যেসব ঝুরি নেমেছিল তারই গোটাকতক টেনে ছিঁড়ে এনে বাঘগুলোকে একে একে সব পিছমোড়া করে বাঁধলাম। হাত মুখ বেঁধে-ছেনে সবাইকে পুটলি বানিয়ে ফেলা হল–তখনো ব্যাটারা অজ্ঞান।

হাতিটা এতক্ষণ নিস্পৃহভাবে আমার কার্য্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। এবার উৎসাহ পেয়ে এগিয়ে এসে তার লম্বা শুঁড় দিয়ে এক একটাকে তুলে ধরে নিজের পিঠের উপর চালান দিতে লাগল। সবাই উঠে গেলে পর সব শেষে ওর ল্যাজ ধরে আমিও উঠলাম। তখনো বাঘগুলো অচেতন। সেই অবস্থাতেই হাওদার সঙ্গে শক্ত করে আর এক প্রস্থ ওদের বেঁধে ফেলা হল।

পাঁচ-পাঁচটা আস্ত বাঘ–একটাও মরা নয়, সবাই জলজ্যান্ত। নাকে হাত দিয়ে দেখলাম নিঃশ্বাস পড়েছে বেশ। এতগুলো জ্যান্ত বাঘ একাধারে দেখলে কার না আনন্দ হয়? একদিনের এক চোটে এক সঙ্গে এতগুলো শিকার নিজের ল্যাজে বেঁধে নিয়ে ফেরা–এ কি কম কথা?

গজেন্দ্রগমনে তারপর তো আমার রাজধানীতে ফিরলাম। বাচ্ছা মাহুত বার্লি ব্যগ্র হয়ে আমাদের প্রতীক্ষা করছিল। এখন অতগুলো বাঘ আর বাঘান্তক আমাকে দেখে বারংবার সে নিজের চোখ মুছতে লাগল। এরকম দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।

খবর পেয়ে মহারাজ! ছুটে এলেন। বাঘদের হাওদা থেকে নামানো হলো। ততক্ষণে তাদের জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু হাত পা বাঁধা–বন্দী নেহাৎ! নইলে, পারলে পরে, তারাও বার্লির মতো একবার চোখ কচলে ভাল করে দেখবার চেষ্টা করতো।

এতগুলো বাঘকে আমি একা স্বহস্তে শিকার করেছি, এটা বিশ্বাস করা বাঘদের পক্ষেও যেমন কঠিন, মহারাজ!র পক্ষেও তেমনি কঠোর! কিন্তু চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে দেখলে অবিশ্বাস করবার কিছু ছিল না।

কেবল বার্লি একবার ঘাড় নাড়বার চেষ্টা করেছিল–এতগুলো বাঘকে আপনি একলা হাতিয়ার নেই, কুছ নেই–বৃহৎ তাজ্জব কি বাত…!

আরে হাতিয়ার নেই, তো কি, হাত তো ছিল? বাধা দিয়ে বলতে হলো আমায়! আর, তোমার হাতির পা-ই তো ছিল হে! তাই কি কম হাতিয়ার? বাঘগুলোকে সামনে পাবামাত্রই, বন্দুক নেই টক নেই করি কি, হাতির কাঠের পা-খানাই খুলে নিলাম। খুলে নিয়ে দু-হাতে তাই দিয়েই এলোপাথাড়ি বসাতে লাগলাম। ঘা কতক দিতেই সব ঠাণ্ডা! হাতির পদাঘাত–সে কি কম নাকি? অবশ্য তোমাদের হাতিকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। বলবামাত্র পেছনের পা দান করতে সে পেছ পা হয়নি। আমিও আবার কাজ সেরে তেমনি করেই তার ইস্ট্রাপ লাগিয়ে দিয়েছি। ভাগ্যিস, তুমি হাতিটার কেঠো পায়ের কথা বলেছিলে আমায়।

অম্লান বদনে এত কথা হাতির দিকে চোখ তুলে তাকাতে আমার লজ্জা করছিল। হাতিরা ভারি সত্যবাদী হয়ে থাকে। এবং নিরামিষাশী তো বটেই তাদের মতো সাধুপুরুষ দেখা যায় না প্রায়। ওর পদচ্যুতি ঘটিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি এই মিথ্যা কথায় কেবল বিরক্তি নয়, ও যেন রীতিমত অপমান বোধ রকছিল। এমন বিষ-নজরে তাকাচ্ছিল আমার দিকে যে-কি বলব! বলা বাহুল্য, তারপর আমি আর ওর ত্রিসীমানায় যাইনি।

হাতিরা সহজে ভোলে না।

 আমার ব্যাঘ্রপ্রাপ্তি

একবার আমাকে বাঘে পেয়েছিলো। বাগে পেয়েছিলো একেবারে—

আমার আত্মকাহিনী আরম্ভ হয়।

এতক্ষণে আমাদের চার-ইয়ারি আড্ডায় আর সকলের শিকার-কাহিনী চলছিলো। জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে যে যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছিলেন। আমার পালা এলো অবশেষে।

অবিশ্য সবার আগে শুরু করেছিলেন এক ভালুক-মার। তার গল্পটা সত্যই ভারী রোমাঞ্চকর। ভালুকটা তার বাঁ হাতখানা গালে পুরে চিবোচ্ছিল কিন্তু তিনি তাতে একটুও না বিচলিত হয়ে এক ছুরির ঘায়ে ভালুকটাকে সাবাড় করলেন। ডান হাত দিয়ে–তাকে হাতিয়ে।

আমি আড় চোখে তার বাঁ হাতের দিকে তাকালাম। সেটা যে কখনো কোন ভালুক মন দিয়ে মুখস্থ করেছিল তার কোন চিহ্ন সেখানে নেই।

না থাক, আমার মনের বিস্ময় দমন করে আমি জিজ্ঞেস করি; ভালুক কি আপনার কানে কানে কিছু বলেছিলো।

না। ভালুক আবার কি বলবে? তিনি অবাক হন।

ওরা বলে কিনা, ওই ভালুকরা। আমি বলিঃ কানাকানি করা ওদের বদভ্যাস। পড়েননি কথামালায়?

মশাই এ আপনার কথামালার ভালুক নয়। আপনার ঈশপ কিংবা গাঁজার শপ পাননি। তাঁর মুখে-চোখে বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। আস্ত ভালুক একেবারে জলজ্যান্ত।

ভালুক শিকারীর পর শুরু। এক কর্মবীর। তাঁর কচ্ছপ ধরার কাহিনী করলেন তাঁরটাও জলজ্যান্ত। জল থেকেই তিনি তুলেছিলেন কচ্ছপটাকে।

কচ্ছপটা জলের তলায় ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। হেদো-গোলদীঘির কোথাও হবে। আর উনি ড্রাইভ খাচ্ছিলেন–যেমন খায় লোকে। খেতে খেতে একবার হলো কি ওঁর মাথাটা গিয়ে কচ্ছপের পিঠে ঠক করে ঠুকে গেল। সেই ঠোক্কর না খেয়ে তিনি রেগেমেগে কচ্ছপটাকে টেনে তুললেন জলের থেকে।

ইয়া প্রকাণ্ড এক বিশমণী কাছিম। বিশ্বাস করুন। তিনি বললেন। একটুও গাঁজা নয়, নির্জলা সত্যি। জলের তলা থেকে আমার নিজের হাতে টেনে তোলা।

অবিশ্বাস করবার কি আছে? আমি বলি? তবে নির্জলা সত্যি–এমন কথা বলবেন না।

কেন বলব না কেন? তিনি ফোঁস করে উঠলেন।–কেন শুনি?

আজ্ঞে, নির্জলা কি করে হয়? জল তো লেগেই ছিলো কচ্ছপটার গায়ে। আমি সবিনয়ে জানাই।–গা কিংবা খোল–যাই বলুন, সেই কচ্ছপের। আমি আরো খোলসা করি।

তারপর আরম্ভ করলেন এক মৎস্য অবতার–তার মাছ ধারার গল্প। মাছ ধরাটা শিকারের পর্যায়ে পড়ে না তা সত্যি, কিন্তু আমাদের আড্ডাটা পাঁচ জনের। আর, তিনিও তার একজন। তিনিই বা কেন বাদ যাবেন। কিন্তু মাছ বলে তার কাহিনী কিছু ছোটখাট নয়। একসা পেল্লায় সব মাছ তিনি ধরেছে, সামান্য ছিপে আর নাম মাত্র পুকুরে–যা নাকি ধর্তব্যের বাইরে। তার কাছে তিমি মাছ কোথায় লাগে।

তুমি যে-তিমিরে তুমি সে-তিমিরি। আমি বলি। আপন মনেই বলি–আপনাকেই।

মাছরা: যতই তার চার খেতে লাগল তার শোনাবার চাড় বাড়লে লাগল ততই তার কি, তিনি তো মাঝ ধরতে লাগলেন, আর ধরে খেতে লাগলেন আকচার। কেবল তার মাছের কাঁটাগুলো আমাদের গলায় খচখচ করতে লাগলো।

তার ফিস ফিসিনি ফিনিশ হলে, আমরা বাঁচলাম।

কিন্তু হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই শুরু হলো এক গণ্ডার বাজের। মারি তো গণ্ডার কথায় বলে থাকে। তিনি এক গণ্ডার দিয়ে শুরু গণ্ডারটাকেই নয়, আমাদেরও মারলেন। তাকে বাদ দিয়ে আমরাও এক গণ্ডার কম ছিলাম না।

এক গণ্ডারের টেক্কায়–একটি ফুঙ্কালে আমাদের চার জনকেই যেন তিনি উড়িয়ে দিলেন। চার জনার পর আমার শিকারের পালা–এলো।

নাচার হয়ে আরম্ভ করতে হলো আমায়।

হ্যাঁ, শিকারের দুর্ঘটনা জীবনেও যে না ঘটছে তা নয়, আমাকেও একবার বাধ্য হয়ে.. আমার শিকারোক্তি শুরু করি।

মাছ, না মাছি? মৎস্য-কুশলী প্রশ্ন করেন।

আমি অস্বীকার করি মাছ? না, মাছ না। মাছিও নয়। মশা, মাছি, ছারপোকা কেউ কখনো ধরতে পারে? ওরা নিজগুণে ধরা না দিলে?

তবে কি? কোন আর্সোলা-টার্সেলাই হবে বোধ হয়?

আরশোলা? বাবা, আরশোলার কেই তার কাছে ঘ্যাঁষে? বলতেই আমি ভয়ে কাঁপি।-–না আরশোলার ত্রিসীমানায় আমি নেই, মশাই। তারা ফরফর করলেই আমি সফরে বেরিয়ে পড়ি। দিল্লী কি আগ্রা অদুরে যাই নে, যেতেও পারি নে, তবে হ্যাঁ, বালিগঞ্জ কি বেহালায় চলে যাই। তাদের বাড়াবাড়ি থামলে, ঠাণ্ডা হলে, বাড়ি ফিরি তারপর।

তা হলে আপনি কি শিকার করেছিলেন, শুনি? হাসতে থাকে সবাই।

এমন কিছু না, একটা বাঘ। আমি জানাই : তাও সত্যি বলতে আমি তাকে বাগাতে যাই নি, চাইও নি। বাঘটাই আমাকে মানে বাধ্য হয়েই আমাকে, মানে কিনা, আমার দিকে একটুও ব্যগ্রতা না থাকলেও শুধু কেবল ও তরফরে ব্যম্রতার জন্যেই আমাকে ওর খপ্পরে পড়তে হয়েছিলো। এমন অবস্থায় পড়তে হলো আমায়, সে তখন আর তাকে স্বীকার না করে উপায় নেই….

আরম্ভ করি আমার বাঘাড়ম্বর।

…তখন আমি এক খবর-কাগজের আপিসে কাজ করতাম। নিজস্ব সংবাদদাতার কাজ। কাজ এমন কিছু শক্ত ছিল না। সংবাদের বেশীর ভাগই গাঁজায় দম দিয়ে মনশ্চক্ষে দেখে লেখা এই যেমন, অমুক শহরে মাছবৃষ্টি হয়েছে, অমুক গ্রামে এক ক্ষুরওয়ালা চার পেয়ে মানুষে জন্মেছে (স্বাভবতঃই নাহিত নয়, কোন গহিন পাহাড়ে এক অতিকায় মানুষ গেল, মনে হয় মহাভারতের আমলের কেউ হবে, হিড়িম্বা–ঘটোৎকচ-বংশীয়। কিংবা একটা পাঠার পাঁচটা ঠ্যাং বেরিয়েছে অথবা গোরুর পেটে মানুষের বাচ্চা-মানুষের মধ্যে সে-সব গোরু দেখা যায় তার প্রতিশোধ স্পৃহাতেই হয়ত বা দেখা দিয়েছে কোথাও! এই ধরনের যত মুখরোচক খবর। ‘আমাদের স্টাফ রিপোর্টারেরা প্রদত্ত সংবাদ’ বাংলা কাগজে যা সব বেরোয় সেই ধারর আর কি! আজগুবি খবরের অবাক জলপান!…

আসল কথায় আসুন না! তাড়া লাগালো ভালুক-মার।

আসছি তো। সেই সময়ে গৌহাটির এক পত্রদাতা বাঘের উৎপাতের কথা লিখেছিলেন সম্পদককে। তাই না পড়ে তিনি আমায় ডাকলেন, বললেন, যাও তো হে, গৌহাটি গিয়ে বাঘের বিষয়ে পুঙ্খলনুপুঙ্খ সব জেনে এসো তো। নতুন কিছু খবর দিতে পারলে এখন কাগজের কাটতি হবে খুব।

গেলাম আমি–কাগজ পেনসিল আর প্রাণ হাতে করে। চাকরি করি, না গিয়ে উপায় কি?

সেখানে গিয়ে বাঘের কীর্তিকলাপ যা কানে এলো তা অদ্ভুত; বাঘটার জ্বালায় কেউ নাকি গোরু-বাছুর নিয়ে ঘর করতে পারছে না। শহরতলীতেই তার হামলা বেশি, তবে ঝামেলা কোথাও কম নয়। মাঝে মাঝে গ্রাম এলাকাতেও সে টহল দিতে আসে। হাওয়া খেতেই আসে বলাই বাহুল্য। কিন্তু হাওয়া ছাড়া অন্যান্য খাবারেও তার তেমন অরুচি নেই দেখা যায়। এবার এসে এক মনোহারি দোকানের সব কিছু সে ফাঁক করে গেছে। সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রীম, লুডো খেলার সরঞ্জাম–কিছু বাকি রাখে নি। এমন কি, তার শখের হারমোনিয়ামটাও নিয়ে গেছে।

আরেকবার বাঘটা একটা গ্রামোফোনের দোকান ফাঁক করলো। রেডিয়োসেট, লাউডস্পীকার, গানের রেকর্ড যা ছিলো, এমন কি পিনগুলি পর্যন্ত সব হজম, সে সবের আর কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না।

আমি যেদিন পৌঁছালাম সেদিন সে এক খাবারের দোকান সাবাড় করেছিল। সন্দেশ-রসগোল্লার ছিটেফোঁটাও রাখে নি, সব কাবার! এমন কি, অবশেষে সন্দেশওয়ালার পর্যন্ত ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তক্ষুনি বাঘটার আশ্চর্য খাদ্যরুচির খবরটা তারযোগে কলকাতায় কাগজে পাচার করে দিলাম।

আর, এই খবরটা রটনার পরেই দুর্ঘটানটা ঘটলো। চিড়িয়াখানার কর্তা লিখলেন আমাকে আমি বা গৌহাটির কেউ যদি অদ্ভুত বাঘটাকে হাতে হাতে ধরতে পারি–একটুও হতাহত না করে– আর আস্ত বাঘটাকে পাকড়াও করে প্যাক করে পাঠাতে পারি তা হলে তারা প্রচুর মূল্য আর পুরস্কার দিয়ে নিতে প্রস্তুত আছেন।

আর হ্যাঁ, পুরক্ষারের অঙ্কটা সত্যিই লোভজনক–বাঘটা যতই আতঙ্কজনক হোক না! যদিও হাতহত না করে এবং না হয়ে খালি হাতাহাতি করেই বাঘটাকে হাতেনো যাবে কি না সেই সমস্যা।

খবরটা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। গৌহাটি বড় বড় বাঘ শিকারী উঠে পড়ে লাগলেন বাঘটাকে পাকড়াতে।

এখানে বাঘাবার কায়দাটা একটু বলা যাক। বাঘরা সাধারণত জঙ্গলে থাকে, জানেন, নিশ্চয়? কোন কিছু বাগাতে হলেই তারা লোকালয়ে আসে। শিকারীরা করে কি, আগে গিয়ে জঙ্গলে মাচা বেঁধে রাখে। আর সেই মাচার কাছাকাছি একটা একটা গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তের ওপর জাল পেতে রাখা হয়। জালের ওপরে জ্বালা! আবার শুকনো লতাপাতা, খড়কুটো বিছিয়ে আরো জালিয়াতি করা হয় তার ওপর, যাতে বাঘটা ঐ পথে ভ্রমণ করতে এলে পথ ভ্রমে ঐ ছলনার মধ্যে পা দেয়–ফাঁদের মধ্যে পড়ে, নিজেকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও দ্বিধা না করে।

অবশ্যি, বাঘ নিজগুণে ধরা না পড়লে, নিজের দোষে ঐ প্যাঁচে পা না দিলে অক্ষত তাকে ধরা একটু মুশকিলই বইকি! তখন সেই জঙ্গল ঘেরাও করে দলকে দল দারুণ হৈ চৈ বাধায়। জঙ্গলের চারধার থেকে হট্টগোল করে, তারা বাঘটাকে তাড়া দেয়, তাড়িয়ে তাকে সেই অধঃপতনের মুখে ঠেলে নিয়ে আসে। সেই সময়ে মাচায় বসা শিকারী বাঘটাকে গুলি করে মারে। নিতান্তই যদি বাঘটা নিজেই গর্তে পড়ে, হাত-পা ভেঙে না মারা পড়ে তা হলেই অবশ্যি।

তবে বাঘ এক এক সময়ে গোল করে বসে তাও ঠিক। ভুলে গর্তের মধ্যে না পড়ে ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ে–শিকারীর ঘাড়ের ওপর। তখন আর গুলি করে মারার সময় থাকে না, বন্দুক দিয়েই মারতে হয়। বন্দুক, গুলি, কিল, চড়, ঘুষি–যা পাওয়া যায় হাতের কাছে তখন। তবে কিনা, কাছিয়ে এসে বাঘ এ সব মারামারির তোয়াক্কাই করে না। বিরক্ত হয়ে বন্দুকধারীকেই মেরে বসে এক থাবড়াতেই সাবাড়ে দেয়। কিন্তু পারতপক্ষে বাঘকে সেরকমের সুযোগ দেওয়া হয় না–দূরে থাকতেই তার বদ-মতলব গুলিয়ে দেওয়া হয়।

এই হলো বাঘাবার সাবেক কায়দা। বাঘ মারো বা ধরো যাই করো–তার সেকেলে সার্বজনীন উৎসব হলো এই। গৌহাটির শিকারীরা সবাই এই ভাবেই বাঘটাকে বাগাবার তোড়জোড়ে লাগলেন।

আমি সেখানে একা। আমার লোকবল, অর্থবল, কিছুই নেই। সদলবলে তোড়জোড় করতে হলে টাকার জোর চাই। টাকার তোড়া নেই আমার। তবে হ্যাঁ, আমার মাথার জোড়াও ছিল না। বুদ্ধি-বলে বাঘটাকে বাগানো যায় কিনা আমি ভাবলাম।

চলে গেলাম এক ওষুধওয়ালার দোকানে–বললাম–দিন তো মশাই, আমায় কিছু ঘুমের ওষুধ।

কার জন্যে?

ধরুন, আমার জন্যেই। যাতে অন্ততঃ চব্বিশ ঘন্টা অকাতরে ঘুমানো যায় এমন ওষুধ চাই আমার।

বাঘের জন্যে চাই চেটা আর আমি বেফাঁস করতে চাইলাম না। কি জানি, যদি লোক-জানাজানি হয়ে সমস্ত প্ল্যানটাই আমার ভেস্তে যায়। তারপর গুজব যদি একবার রটে যায় হয়তো সেটা বাঘের কানেও উঠতে পারে, বাঘটা টের পেয়ে হুসিয়ার হয়ে যায় যদি?

তা ছাড়া, আমাকে কাজ সারতে হবে সবার আগে, সবচেয়ে চটপট, আর সকলের অজান্তে। দেরি করলে পাছে আর কেউ শিকার করে ফেলে বা বাঘটা কোন কারণে কিংবা মনের দুঃখে নিজেই আত্মহত্যা করে বসে তা হলে দাওটা ফসকে যাবে সেই ভয়টাও ছিল।

ওষুধ হাতে পেয়ে তারপর আমি শুধালাম–একজন মানুষকে বেমালুম হজম করতে একটা বাঘের কতক্ষণ লাগে বলতে পারেন?

ঘন্টা খানেক। হ্যাঁ, ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।

আর বিশ জন মানুষ?

বিশ জন? তা দশ-বিশটা মানুষ হজম করতে অন্তত ঘন্টা তিনেক লাগা উচিত–অবশ্যি, যদি তার পেটে আঁটে তবেই। জানালেন ডাক্তারবাবু। তবে কিনা, এত খেলে হয়তো তার একটু বদ হজম হতে পারে। চোয়া ঢেকুর উঠতে পারে এক-আধটা।

তাহলে বিশ ইনটু তিন, ইনটু আট–মনে মনে আমি হিসেব করি–হলো চারশ আশি। একটা বাঘের হজম শক্তি ইজ ইকোয়াল টু চারশ আশিটা মানুষ। তার মানে চারশ আশি জনার হজম-শক্তি। আর হজমশক্তি ইজ ইকোয়াল টু ঘুমোবার ক্ষমতা।

মনে মনে অনেক কষাকষি করে, আমি বলি–আমাকে এই রকম চারশ আশিটা পুরিয়া দিন তো। এই নিন শষুধের টাকা। পুরিয়ার বদলে আপনি একটা বড় প্যাকেটও পুরে দিতে পারেন।

ডাক্তারবাবু ওষুধটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এর সবটা খেতে চান খান, আমার আপত্তি নেই। তবে আপনাকে বলে দেওয়া উচিত যে এ খেলে যে প্রগাঢ় ঘুম আপনার হবে তা ভাঙবার ওষুধ আমাদের দাবাই খানায় নেই। আপনার কোনো উইল-টুইল করবার থাকলে করে খাবার আগেই তা সেরে রাখবেন এই অনুরোধ।

ওষুধ নিয়ে চলে গেলাম আমি মাংসের দোকানে। সেখানে একটা আস্ত পাঠা কিনে তার পেটের মধ্যে ঘুমের ওষুধের সবটা দিলাম সেঁধিয়ে,–তার পরে পাঁঠাটিকে নিয়ে জঙ্গল আর শহরতলীর সঙ্গমস্থলে গেলাম। নদীর ধারে জল খাবার জায়গায় রেখে দিয়ে এলাম পাঁঠাটাকে। জল খেতে এসে জলখাবার পেলে বাঘটা কি আবার না খাবে?

ভোর না হতেই সঙ্গমস্থলে গেছি– বাঘাটার জলযোগের জায়গায়। গিয়ে দেখি অপূর্ব্ব দৃশ্য। ছাগলটার খালি হাড় কখানাই পড়ে আছে, আর তার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছেন আমাদের বাঘা মলে। গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।

ঈস, কি ঘুম। রাস্তায় কোনো পাহারাওয়ালা কি পরীক্ষার্থী কোনো ছাত্রকেও এমন ঘুম ঘুমুতে দেখি নি!

বাঘটার আমি গায়ে হাত দিলাম, ল্যাজ ধরে টানলাম একবার। একেবারে নিঃসাড়। খাবার নখগুলো, গুণলাম, কোনো সাড়া নেই। তার গোঁফ চুমরে দিলাম, পিঠে হাত বুলোলাম-পেটে খোঁচা মারলাম–তবুও উচ্চবাচ্য নেই কোনো!

অবশেষে সাহাস করে তার গলা টিপলাম। আদর করলাম একটু। কিন্তু তার গালে আমার টিপসই দিতেও বাঘটা নড়লো না একটুও।

আরো একটু আদর দেখাবো কিনা ভাবছি। আদরের আরো একটু এগুবো মনে করছি, এমন সময়ে বাঘটা একটা হাই তুললো।

তার পরে চোখ খুললো আস্তে আস্তে।

হাই তুলতেই আমি একটা হাই জাম্প দিয়েছিলাম পাঁচ হাত পিছনে। চোখ খুলতেই আমি ভোঁ দৌড়। অনেক দূর গিয়ে দেখি উঠে আলস্যি ছাড়ছে– আড়মোড়া ভাঙছে; গা-হাত-পা খেলিয়ে নিচ্ছে একটু। ডন-বৈঠক হয়েতো সেটা, ওই রকমের কিছু একটা হতে পারে। কী যে-তা শুধু ব্যায়ামবীরেরাই বলতে পারেন।

তারপর ডন-বৈঠক ভেঁজে বাঘটা চারধারে তাকালো। তখন আমি বহুৎ দূরে গিয়ে পড়েছি, কিন্তু গেলে কি হবে, বাঘটা আমরা তাক পেলো ঠিক। আর আমিও তাকিয়ে দেখলাম তার চাউনি। অত দূর থেকেও দেখতে পেলাম। আকাশের বিদ্যুঝলক যেমন দেখা যায়। অনেক দূর থেকেও সেই দৃষ্টি–সে কটাক্ষ ভুলবার নয়।

বাঘটা গুঁড়ি এগুতে লাগলে আমার দিকে। আমারো দৌড় বেড়ে গেল আরো–আরোও।

গুড়ি গুঁড়ির থেকে ক্রমে তুড়ি লাফ বাঘটার।

আর আমি? প্রতি মুহূর্তের তখন হাতুড়ির ঘা টের পাচ্ছি আমার বুকে।

বাঘটাও আসছে–আমিও ছুটছি বাঁচবার আশায়। ছুটছি প্রাণপণ… বলতে বলতে আমি থামলাম দম নিতেই থামলাম একটু।

তারপর? তারপর? তারপর?…. আড্ডার চারজনার হসপ্রশ্ন। বাঘের সম্মুখে পড়ে বিকল অবস্থায় আমি যাই যাই, কিন্তু তাদের মার্জনা নেই। তারা দম দিতে ছাড়ছেন না।

ছুটতে ছুটতে আমি এসে পড়েছি এক খাদের সামনে। অতল গভীর খাদ। তার মধ্যে পড়লে আর রক্ষে নেই সাততলার ছাদ থেকে পড়লে যা হয় তাই একদম ছাতু। পিছনে বাঘ, সামনে খাদ–কোথায় পালাই? কোনদিকে যাই?

দারুণ সমস্যা। এধারে খাদ, ওধারে বাঘ–ওধারে আমি খাদ্য আর এধারে আমি বরবাদ!

কি করি? কী করি? কী যে করি?

ভাবতে ভাবতে বাঘটা আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়লো।

অ্যাঁ?

হ্যাঁ। বলে আমি হাঁফ ছাড়লাম। এতখানি ছুটোছুটির পর কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।

তারপর? তারপর কী হলো?

কি আবার হবে? যা হবার তাই হলো। আমি বললাম : এ রকম অবস্থায় যা হয়ে থাকে। আমার গপপো শেষ হলো সেইখানেই।

কি করলো বাঘটা? তবু তারা নাছোড়বান্দা।

বাঘটা? আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম : কী আর করবে? বাঘটা আমায় গিলে ফেললো গল্প করে।

আমার ভালুক শিকার

তোমরা আমাকে গল্প-লেখক বলেই জানো। কিন্তু আমি যে একজন ভাল শিকারী এ খবর নিশ্চয়ই তোমাদের জানা নেই। আমি নিজেই এ কথা জানতাম না, শিকার করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।

আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, কোথায় নাকি দশ-বারো বছরের ছেলেরা, দশ-বারো হাত বাঘ শিকার করে ফেলেছে। আজকের ৭ই জুলাইয়ের খবরের কাগজেই তোমরা দেখবে একটা সাত বছরের ছেলে ন ফিট বাঘ সাবাড় করে দিয়েছে। বাঘটার উপদ্রবে গ্রামসুদ্ধ লোক ভীত, সস্ত্রস্ত। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। ভগ্যিস সেখানকার তালুকদারের একটা ছেলে ছেলে ছিল এবং আরো সৌভাগ্যের কথা যে বয়স ছিল মোটে বছর সাত, তাই গ্রামবীসাদের বাঘের কবল থেকে এত সহজে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হলো।

তোমরা হয়ত বলবে যে, ছেলেটার ওজনের চেয়ে বন্দুকের ওজনই যে ভারী। তা হতে পরে, তবু এ কথা আমি অবিশ্বাস করি না, বিশেষ করে যখন খবরের কাগজে ছাপার অক্ষরে নিজের চোখে দেখেছি। আমার ভালুক শিকারের খবরটাও কাগজে দেখেছিলাম তারপর থেকেই তা ঘটনাটায় আমার দারুণ বিশ্বাস হয়ে গেছে। প্রথমে আমি ধারণা করতেই পারিনি যে আমিই ভালুকটাকে মেরেছি, এবং ভালুকটারও মনে যেন সেই সন্দেহ বরাবর ছিল মনে হয়, মরার আগে পর্যন্ত। কিন্তু যখন খবরের কাগজে আমার শিকার কাহিনী নিজে পড়লাম, তখন নিজের কৃতিত্ব সম্বন্ধে অমূলক ধারণা আমার দূর হলো। ভালুকটার সন্দেহ বোধকরি শেষ অবধি থেকেই গেছল, কেন না খবরের কাগজটা চোখে দেখার পর্যন্ত তার সুযোগ হয়নি–কিন্তু না হোক, সে নিজেই দূর হয়ে গেছে।

সেই রোমাঞ্চকর ঘটনাটা এবার তোমাদের বলিঃ আমার মাসতুতো বড়দা সুন্দরবনের দিকে জমি-টমি নিয়ে চাষ-বাস শুরু করেছেন। সেদিন তাঁর চিঠি গেলাম–এবার গ্রীষ্মটা এ ধারেই কাটিয়ে যাও না, নতুন জীবনের আস্বাদ পাবে অভিজ্ঞতাও বেড়ে যাবে অনেক।

সঙ্গে করে কিছুই আনতে হবে না, কয়েক জোড়া কাপড় এনো!

আমি লিখলাম–যেতে লিখেছ যাব না–হয়। কিন্তু কাপড় নিয়ে যেতে হবে কেন বুঝতে পারলাম না। আমার সুটকেসে তো দুখানার বেশি ধরবে না, এবং বাড়তি বোঝা বইতে আমি নারাজ! আর তা ছাড়া এই সেদিনই তো তুমি কলকাতা থেকে বার জোড়া কাপড় নিয়ে গেছ! এত কাপড় সেখানে কি করো? বৌদি নিশ্চয়ই ধুতি পরা ধরেননি। তোমার কাপড়েই আমার চলে যাবে–আমি তো একলা মানুষ বাপু!

দাদা সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন–আর কিছু না, বাঘের জন্যে।

আমার সবিস্মিত পালটা জবাব গেল–সে কি! বাঘে ছাগল গরুই চুরি করে শুনেছি, আজকাল কাপড়-চোপড়ও সরাচ্ছে নাকি? কাপড়-চোপড়ের ব্যবহার যখন শিখেছে, তখন তারা রীতিমত সভ্য হয়েছে বলতে হবে!

দাদা উত্তর দিলেন–চিঠিতে অত বকতে পারি না। আমার এখানে এসে তোমার কাপড়ের অভাব হবে না, এ কথা নিশ্চয়ই–কিন্তু যে কাপড় তোমাকে আনতে বলেছি, তার দরকার পথেই। চিড়িয়াখানার বাঘই দেখেছ, আসল বাঘ তো কোনদিন দেখনি, আসল বাঘের হুঙ্কারও শোননি। চিড়িয়াখানার ওগুলোকে বেড়াল বলতে পার। সুন্দরবন দিয়ে স্টিমারে আসতে দুপাশের জঙ্গলে বাঘের হুঙ্কার শোনা যায়, শোনামাত্রই কাপড় বদলানোর প্রয়োজন অনুভব করবে। প্রায় সকলেই সেটা করে থাকে। যত ঘন ঘন ডাকবে, (ডাকাটা অব্যশ্য তাদের খেয়ালের ওপর নির্ভর করে) তত ঘন ঘনই কাপড়ের প্রয়োজন। তবে তুমি যদি খাকি প্যান্ট পরে আস, তাহলে দরকার হবে না।

অতঃপর চব্বিশ জোড়া কাপড় কিনে নিয়ে আমি সুন্দরবন গমন করলাম।

আমার মাসতুতো দাদাও একজন বড় শিকারী। এ তথ্যটা আগে জানতাম না; এবার গিয়ে জানলাম। শুধু হাতেই অনেক দুদ্ধর্ষ বাঘকে তিনি পটকে ফেলেছেন। বন্দুক নিয়েও শিকারের অভ্যাস তার আছে, কিন্তু সে রকম সুযোগে তিনি বন্দুককে লাঠির মত ব্যবহার করতেই ভালবাসেন। তাঁর মতে কেঁদো বাঘকে কাঁদাতে হলে বন্দুকের কুঁদোই প্রশস্ত-গুলি করা কোন কাজের কথাই নয়। কিছু দিন আগে এক বাগের সঙ্গে তাঁর বড় হাতাহাতি হয়ে গেছল, তাঁর নিজের মুখেই আমার শোনা। বাঘটার অত্যাচার বেজায় বেড়ে গেছল, সমস্ত গ্রামটার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাত ব্যাটা, এমন কি তাদের স্বপ্নের মধ্যে এসে হানা দিত পর্যন্ত!

দাদার নিজের ভাষাতেই বলিঃ তারপর তো ভাই বেরোলাম বন্দুক নিয়ে। কি করি, সমস্ত গ্রামের অনুরোধ। ফেলা তো যায় না–একাই গেলাম। সঙ্গে লোকজন নিয়ে শিকারে যাওয়া আমি পছন্দ করি না। একবার অনেক লোক সঙ্গে নিয়ে গিয়ে যা বিপদে পড়েছিলাম, কি বলব! বাঘ করল তাড়া তারা এসে পড়ল আমার ঘাড়ে; মানুষের তাড়ায় প্রাণে মারা যাই আর কি! গেলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি সামনে বাঘ, বন্দুক ছুঁড়তে গিয়ে জানলাম টোটা আনা হয়নি। আর সে বন্দুকটা এমন ভারী যে, তাকে লাঠির মতও খেলানো যায় না। কী করি, বন্দুক ফেলে দিয়ে শুধু হাতেই বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। জোর ধস্তাধস্তি, কখনো বাঘ ওপরে আমি নীচে, কখনো আমি নীচে বাঘ ওপরে–বাঘটাকে প্রায় কাবু করে এনেছি এমন সময়ে–

আমি রুদ্ধ-নিশ্বাসে অপেক্ষা করছি, বৌদি বাধা দিয়ে বললেন–এমন সময়ে তোমার দাদা গেলেন তক্তাপোষ থেকে পড়ে। জলের ছাঁট দিয়ে, হাওয়া করে, অনেক কষ্টে ওঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনি। মাথাটা গেল কেটে, তিন দিন জলপটি দিতে হয়েছিল।

এর পর দাদা বারো দিন আর বৌদির সঙ্গে বাক্যলাপ করলেন না এবং মাছের মুড়ো সব আমার পাতেই পড়তে লাগল।

দাদা একদিন চুপিচুপি আমায় বললেন–তোমার বৌদির কীর্তি জানো না তো! খুকিকে নিয়ে পাশের জঙ্গলে জাম কুড়োত গিয়ে, পড়েছিলেন এক ভালুকের পাল্লায়। খুকিতে পালিয়ে এল, উনি ভয়ে জবুথুবু হয়ে, একটা উইয়ের টিপির উপর বসে পড়ে এমন চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন যে, ভালুকটা ওঁর ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল।

আমি বললাম–ওঁর ভাষা না বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেছল, এমনও তো হতে পারে?

দাদা বিরক্তি প্রকাশ করলেন—হ্যাঁ! ভারি ত ভাষা! প্রত্যেক চিঠিতে দুশো করে বানান ভুল!

বৌদির পক্ষ সমর্থন করতে আমাকে, অন্ততঃ মাছের মুড়োর কৃতজ্ঞতাসূত্রের, বলতে হলো–ভালুকরা শুনেছি সাইলেন্ট ওয়ার্কার, বক্তৃতা ওরা বড় পছন্দ করে না। কাজেই বৌদি ভালুক তাড়াবার ব্রহ্মস্ত্রই প্রয়োগ করেছিলেন, বুঝলে দাদা?

দাদা কোন জবাব দিলেন না, আপন মনে গজরাতে লাগলেন। বৌদির তরফে আমার ওকালতি শুনে তিনি মুষড়ে পড়লেন, কি ক্ষেপে গেলেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সেদিন বিকেলেই তাঁর মনোভাব টের পাওয়া গলে। দাদা আমাকে হুকুম করলেন পাশের জঙ্গল থেকে এক ঝুড়ি জাম কুড়িয়ে আনতে–সেই জঙ্গল, যেখানে বৌদির সঙ্গে ভালুকের প্রথম দর্শন হয়েছিল।

দাদার গরহজম হয়েছিল, তাই জাম খাওয়া দরকার, কিন্তু আমি দাদার ডিপ্লোম্যাসি বুঝতে পারলাম। আমাকে ভালুকের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আমাকে সুদ্ধ বিনা আয়াসে হজম করবার মতলব। বুঝলাম বৌদির পক্ষে যাওয়া আমার ভাল হয়নি। আমতা-আমতা করছি দেখে দাদা বললেন–আমার বন্দুকটা না হয় নিয়ে যা, কিন্তু দেখিস, ভুলে ফেলে আসিস না যেন।

ওঃ, কি কূটচক্রী আমার মাসতুতো বড়দা! ভালুকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করা বরং আমার পক্ষে সম্ভব হতে পারে, কিন্তু বন্দুক ছোঁড়া–? একলা থাকলে হয়ত দৌড়ে পালিয়ে আসতে পারব, কিন্তু ঐ ভারী বন্দুকের হ্যাঁন্ডিক্যাপ নিয়ে দৌড়তে হলে সেই রেসে ভালুকই যে প্রথম হবে, এ বিষয়ে আমার যেমন সন্দেহ ছিল না, দেখলাম দাদাও তেমনি স্থির–নিশ্চয়।

দাদা জামের ঝুড়ি আর বন্দুকটা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললেন–চট করে যা, দেরি করিসনি। তোর ভয় কচ্ছে নাকি?

অগত্যা আমায় বেরুতে হলো। বেশ দেখতে পেলুম, আমার মাসতুতো বড়দা আড়ালে একটু মুচকি হেসে নিলেন। মাছের-মুড়োর বিরহ তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। নাঃ, এই বিদেশে বিভুয়ে মাসতুতো ভাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে ভাল করিনি। খতিয়ে দেখলাম, ওই চব্বিশ জোড়া কাপড়ই বড়দার নেট লাভ।

বেরিয়ে পড়লাম। এক হাতে ঝুড়ি, আরেক বন্দুক। নিশ্চয়ই আমাকে খুব বীরের মত দেখাচ্ছিল। যদিও একটু বিশ্রী রকমের ভারী, তবু বন্দুকে আমায় বেশ মানায়। ক্রমশ মনে সাহস এলো–আসুক না। ব্যাটা ভালুক, তাকে দেখিয়ে দিচ্ছি এবং বড়দাকেও! মাসতুতো ভাই কেবল চোরে-চোরেই হয় না, শিকারীতে-শিকারীতেও হতে পারে! উনিই একজন বড় শিকারী, আর আমি বুঝি কিছু না?

বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলাম। আসুক না ব্যাটা ভালুক এইবার! ঝুড়িটা হাতে নেওয়ায় যতটা মনুষ্যত্বের মর্যাদা লাঘব হয়েছিল, বন্দুকে তার ঢের বেশি পুষিয়ে গেছে। আমাকে দেখাচ্ছে ঠিক বীরের মত। অথচ দুঃখের বিষয়, এই জঙ্গল পথে একজনও দেখবার লোক নেই। এ সময়ে একটা ভালুককে দর্শকের মধ্যে পেলেও আমি পুলকিত হতাম।

বন্দুক কখনো যে ছুঁড়িনি তা নয়। আমার এক বন্ধুর একটা ভাল বন্ধুক ছিল, হরিণ-শিকারের উচ্চাভিলাষ বশে তিনি ওটা কিনেছিলেন। বহুদিনের চেষ্টায় ও পরিশ্রমে তিনি গাছ-শিকার করতে পারতেন। তিনি বলতেন–গাছ শিকারের অনেক সুবিধে, প্রথমত–গাছেরা হরিণের মত অত দৌড়ায় না, এমন কি ছুটে পালাবার বদভ্যাসই নেই ওদের, দ্বিতীয়ত–ইত্যাদি, সে বিস্তর কথা। তা, তিনি সত্যিই গাছ শিকার করতে পারতেন–অনন্ত বাতাস একটু জোর না বইলে, উপযুক্ত আবহাওয়ায় এবং গাছটাও হাতের কাছে হলে, তিনি অনায়াসে লক্ষ্য ভেদ করতে পারতেন–প্রায় প্রত্যেক বারই।

আমি তার সঙ্গে গাছ-শিকার করেছি, তবে যে-কোন গাছ আমি পারতাম না। আকারে-প্রকারে কিছু বড় হলেই আমার পক্ষে সুবিধে হতো, খুঁড়ির দিকটাতেই আমার স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। বৃক্ষ শিকারে যখন এতদিন হাত পাকিয়েছি, তখন ভালুক-শিকারে যে একেবারে বেহাত হব না, এ ভরসা আমার ছিল।

জঙ্গলে গিয়ে দেখি পাকা পাকা জামে গাছ ভর্তি! জাম দেখে জাম্ববানের কথা আমি ভুলেই গেলাম। এমন বড় বড় পাকা পাকা খাসা জাম! জিভ লালায়িত হয়ে উঠল। বন্দুকটা একটা গাছ ঠেসিয়ে, দুহাত ঝুড়ি ভরতে লাগলাম। কতক্ষণ কেটেছে জানি না, একটা খস খস শব্দে আমার চমক ভাঙল। চেয়ে দেখি-ভালুক!

ভালুকটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমি যা করছি সেও তাতেই ব্যাপৃত! একহাত দিয়ে জামের একটা নীচু ডালকে সে বাগিয়ে ধরেছে, অন্য হাতে নির্বিচারে মুখে পুরছে– কাঁচা ডাঁসা সমস্ত। আমি বিস্মিত হলাম বললে বেশি বলা হয় না! বোধ হয়, আমি ঈষৎ ভীতই হয়েছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, ভালুক দর্শনের বাঞ্ছা একটু আগেই করেছি বটে, কিন্তু দেখা না পেলেই যেন আমি বেশি আশ্বস্ত হতাম। ঠিক সেই মারাত্মক মুহূর্তেই আমাদের চারি চক্ষুর মিলন!

আমাকে দেখেই ভালুকটা জাম খাওয়া স্থগিত রাখল এবং বেশ একটু পুলকিত-বিস্ময়ের সঙ্গে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আমি মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। গাছে উঠতে পারলে বাঘের হাত থেকে নিস্তার আছে, কিন্তু ভালুকের হাতে কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ভালুকরা গাছে উঠতেও ওস্তাদ।

অগত্য শ্রেষ্ঠ উপায়–পালিয়ে বাঁচা। বন্দুক ফেলে যেতে যেতে দাদার নিষেধ; বন্দুকটা বগল দাবাই করে চোচা দৌড় দেবার মতলব করছি, দেখলাম সেও আস্তে আস্তে আমার দিকে এগুচ্ছে। আমি দৌড়লেই যে সে আমার পিছু নিতে দ্বিধা বোধ করবে না, আমি তা বেশ বুঝতে পারলাম। ভালুকজাতির ব্যবহার আমার মোটেই ভাল লাগল না।

আমিও দৌড়চ্ছি, ভালুকও দৌড়চ্ছে। বন্দুকের বোঝা নিয়ে ভালুক দৌড়ে আমি সুবিধে করতে পারব না বুঝতে পারলাম। যদি এখনও বন্দুকটা না ফেলে দিই, তাহলে নিজেকেই এখানে ফেলে যেতে হবে। অগত্যা অনেক বিবেচনা করে বন্দুককেই বিসর্জন দিলাম।

কিছুদূর দৌড়ে ভালুকের পদশব্দ না পেয়ে ফিরে তাকালাম। দেখলাম সে আমার বন্দুকটা নিয়ে পড়েছে। ওটাকে নতুন রকমের কোন খাদ্য মনে করেছে কিনা ওই জানে। আমিও স্তব্ধ হয়ে ওর কার্য্যকলাপ নিরীক্ষণ করছিলাম।

ভালকুটা বেশ বুদ্ধিমান। অল্পক্ষণেই সে বুঝতে পারল ওটা খাদ্য নয়, হাতে নিয়ে দৌড়াবার জিনিস। এবার বন্দুকটা হস্তগত করে সে আমাকে তাড়া করল। বিপদের ওপর বিপদ-এবার আমার বিপক্ষে ভালুক এবং বন্দুক। ভালুকটা কি রকম শিকারী আমার জানা ছিল না। বন্দুক ওর হাত অন্তর আমার চেয়ে খারাপ নয় বলেই আমার আন্দাজ।

যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। কয়েক লাফ না যেতেই পেছনে বন্দুকের আওয়াজ। আমি চোখ কান বুজে সটান শুয়ে পড়লাম—যাতে গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়–যুদ্ধের তাই রীতি কিনা! তারপর আবার দুড়ুম! অবার সেই বন্দুক গর্জ্জন। আমি দুরু দুরু বক্ষে শুয়ে দুর্গনাম করতে লাগলাম। ভালুক-শিকার করতে এসে ভালুকের হাতে না শিকৃত হয়ে যাই।

আমি চোখ বুজেও যেন স্পষ্ট দেখছিলাম, ভালুকটা আস্তেআস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার গুলিতে আমি হতাহত–অন্তত একটা কিছু যে হয়েছি,সে বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। গুলির আঘাতে না যাই, ভালুকের আঘাতে এবার গেলাম। মৃত্যুর পূর্ব্বক্ষণে জীবনের সমস্ত ঘটনা বায়স্কোপের ফিলমের মত মনশ্চক্ষের ওপর দিয়ে চলে যায় বলে একটা গুজব শোনা ছিল। সত্যিই তাই–একেবারে হুবহু। ছোটবেলার পাঠশালা পালানো, আম্রশিকার থেকে শুরু করে আজকের ভালুক শিকার পর্যন্ত প্রায় চারশো পাতার একটা মোটা সচিত্র জীবন-স্মৃতি আমার মনে মনে ভাবা, লেখা, ছাপাপো, প্রফ কারেক্ট করা– এমন কি তার পাঁচ হাজার কপি বিক্রি অবধি শেষ হয়ে গেল।

জীবন-স্মৃতি রচনার পর আত্মীয়-স্বজনের কথা আমার স্মরণে এল। পরিবার আমার খুব সামান্য–একমাত্র মা এবং একমাত্র ভাই সুতরাং সে দুশ্চিন্তার সমাধা করা ও খুব কঠিন হলো না। এক সেকেন্ডে–দু সেকেন্ড-তিন-চার-পাঁচ সেকেন্ড-এর মধ্যে এত কান্ড হয়ে গেল, কিন্তু ভালুক ব্যাটা এখনো এসে পৌঁছল না তো। কি হলো তার? এতটা দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কি?

ঘাড়টা ফিরিয়ে দেখি, ওমা, সেও যে সটান চিৎপাত। সাহস পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম–এ ভালুকটা তো ভারি অনুকরণ প্রিয় দেখছি! কিন্তু নড়ে না চড়ে না যে। কাছে গিয়ে দেখলাম, নিজের বন্দুকের গুলিতে নিজেই মারা গেছে বেচারা। বুঝলাম অত্যন্ত মনক্ষোভেই এই অন্যায়টা সে করেছে। প্রথম দিন বৌদির ব্যবহারে সে লজ্জা পেয়েছিল, আজ আমার কাপুরুষতার পরিচয়ে সে এতটা মর্মাহত হয়েছে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া তার উপায় ছিল না।

বন্দুক হাতে সগর্বে বাড়ি ফিরলাম। আমার জাম-হীনতা লক্ষ্য করে দাদার অসন্তোষ প্রকাশের পূর্বেই ঘোষণা করে দিলাম–বৌদির প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ভালুকটাকে আজ নিপাত করে এসেছি। কেবল দুটো শট–ব্যস খতম।

দাদা, বৌদি এমন কি খুকি পর্যন্ত দেখতে ছুটল। আমিও চললাম–এবার আর বন্দুকটাকে সঙ্গে নিলাম না–পাঁচজনে যাত্রা নিষেধ, পাঁজিতে লেখে। দাদা বহু পরিশ্রমে ও বৌদির সাহায্যে, ভালুকের ল্যাজটাকে দেহচ্যুত করে, এই বৃহৎ শিকারের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ সযত্নে আহরণ করে নিয়ে এলেন। এই সহযোগিতার ফলে দাদা ও বৌদির আবার ভাব হয়ে গেল। আপনি আত্মদান করে ভালুকটা দাদা ও বৌদির মধ্যে মিলনগ্রন্থি রচনা করে গেল–তার এই অসাধারণ মহত্ত্বে সে নতুন মহিমা নিয়ে আমার কাছে প্রতিভাত হলো। আমার রচনায় তাকে অমর করে রাখলাম, অন্তত আমার চেয়ে সে বেশিদিন টিকবে আশা করি।

বাড়ি ফিরেই দাদা বললেন–অমৃতবাজার পত্রিকায় খবরটা পাঠিয়ে দিই কি বসিল?–A big wild bear was heroically killed by my young brother aged-aged-কত রে?

আমার age তুমি তা জানোই!–আমি উত্তর দিলাম।

উঁহু, কমিয়ে লিখতে হবে কিনা। নইলে বাহাদুরি কিসের! দশ বারো বছর কমিয়ে দিই, কি বলিস?

কিন্তু দশ-বারো বছর কমিয়েও আমার বয়স দশ-বারো বছরের কাছাকাছি আনা গেল না–(সাতে দাঁড় করানো তো দুঃসাধ্য ব্যাপার।) তখন বাধ্য হয়ে Young এই বিশেষণের ওপর নির্ভর করে আমার বয়সাল্পতাটা লোকের অনুমানের ওপর ছেড়ে দেওয়া গেল।

সেদিন আমার পাতে দু-দুটো মুড়ো পড়ল, খুকি মাকে বলে রেখেছে তার কাকামণিকে দিতে। আমি আপত্তি করলাম না, ভালুকের আত্মবিসর্জনে যখন করিনি, খুকির মুড়ো–বিসর্জনেই বা করব কেন? সবচেয়ে আশ্চর্য এই আমার ঝোলের বাটির অস্বাভাবিক উচ্চতা দেখেও দাদা আজ ভ্রূক্ষেপ করলেন না!

আমার সম্পাদক শিকার

হাম কিংবা টাইফয়েড়, সর্পাঘাত কিংবা মোটরচাপা, জলে ডোবা কিংবা গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, এগজামিনে ফেল করা, কিংবা কাঁকড়া-বিছে কামড়ানো–জন্মাবার পর এক কোনো না কোনটা কারু-না-কারু বরাতে কখনো কখনো একবার ঘটেই। অবশ্য যে মোটর চাপা পড়ে তার সপার্ঘাত হওয়া খুব শক্ত ব্যাপার, সেরকম আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই হয়, এবং যার সর্পাঘাত হয় তাকে আর গাছ থেকে পড়তে হয় না। যে ব্যক্তি জলে ডুবে যায় মোটরচাপা পড়ার সুযোগ তার যৎসামান্যই এবং উঁচু দেখে গাছ থেকে ভাল করে পড়তে পারলে তার আর জলে ডোবার ভয় থাকে না। তবে কাঁকড়া-বিছের কামড়ের পরেও এগজামিনে ফেল করা সম্ভব, এবং অনেকক্ষেত্রে হামের ধাক্কা সামলাবার পরেও টাইফয়েড হতে দেখা গেছে। হামেশাই দেখা যায়।

কিন্তু বলছিই, এসব কাজ কারু না কারু অদৃষ্টে ঘটে কখনো বা কদাচ। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা প্রায় সবারই জীবনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে অনিবার্যরূপে প্রকট হয়, তার ব্যকিক্রম খুব বড় একটা দেখা যায় না। আমি গোঁফ ওঠার কথা বলছিলেন–তার চেয়ে শক্ত ব্যারাম–গোঁফ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লেখক হবার প্রেরণা মানুষকে পেয়ে বসে।

আমরাও তাই হয়েছিল। প্রথম গল্প লেখার সূত্রপাতেই আমার ধারণা হয়ে গেল আমি দোলগোবিন্দবাবুর মতো লিখছে পেরেছি। দোলগোবিন্দকে আমি রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মনে করতাম–কেননা একই কাগজে দুজনের নাম একই টাইপে ছাপার অক্ষরে দেখেছিলাম আমি। এমন কি অনেক সময়ে দোলগোবিন্দকে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় লেখক আমার বিবেচনা হয়েছে– তার লেখা কেমন জলের মতো বোঝা যায়, অথচ বোঝার মতন মাথায় চাপে না! কেন যে তিনি নোবেল। প্রাইজের জন্য চেষ্টা করেন না, সেই গোঁফ ওঠার প্রাক্কালে অনেকবার আমি আন্দোলন করেছি–অবশ্যি মনে মনে। একন বুঝতে পারছি পণ্ডিচেরী, কিংবা পাশাপাশি, রাঁচীতে তার পরামর্শ দেবার কেউ ছিল না বলেই। আরও দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের লেখা এখনও চোখে পড়ে থাকে কিন্তু কোনো কাগজ কোনো কাগজ-পত্রেই দোলগোবিন্দ বাবুর আর দেখা পাই না।

যাই হোক, গল্পটা লিখেই বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিকপত্রে, দোলগোবিন্দ বা বরীন্দ্রনাথের রচনার ঠিক পাশেই সেটা প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। নিশ্চিন্তে বসে আছি যে নিশ্চয়ই ছাপা হবে এবং ছাপার অক্ষরে লেখাটা দেখে কেবল আমি কেন, রবীন্দ্রনাথ, এমন কি স্বয়ং দোলগোবিন্দ পর্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠবেন–ও হরি! পর পর তিন মাস হবার পরে একদিন দেখি বুকপোস্টের ছদ্মবেশে লেখাটা আমার কাছেই আবার ফিরে এসেছে। ভারী মর্মাহত হলাম। বলাই বাহুল্য! শোচনীয়তা আরও বেশি এইজন্য যে তিন মাসে তিনখানা কাগজ কিনেছিলাম–খতিয়ে দেখলাম সেই দেড়টা টাকাই ব্যাটাদের লাভ!

তারপর, এক একে আর যে-কটা নামজাদা মাসিক ছিল সবাইকে যাচাই করা হল–কিন্তু ফল একই। আট আনার পেট-মোটাদের ছেড়ে ছ-আনার কাগজদের ধরলাম–অবশেষে চার আনা দামের নব্যপন্থীদেরও বাজিয়ে দেখা গেল। নাঃ, সব শেয়ালের একই রা! হ্যাঁ, গল্পটা ভালই, তবে ছাপতে তারা অক্ষম! আরে বাপ, এত অক্ষমতা যে কেন তাতো আমি বুঝতে পারি নে, যখন এত লেখাই অনায়াসে ছাপতে পারছ তোমরা! মাসিক থেকে পাক্ষিক–পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিক নামলাম; অগত্যা লেখাটার দারুণ অমর্যাদা ঘটছে জেনেও দৈনিক সংবাদপত্রেই প্রকাশের জন্য পাঠালাম। কিন্তু সেখান থেকেও ফেরত এল। দৈনিকে নাকি অত বড় সংবাদ ধরবার জায়গাই নেই। আশ্চর্য! এত আজেবাজে বিজ্ঞাপন যা কেউ পড়ে না তার জন্য জায়গা আছে, আমার বেলাই যত স্থানাভাব? বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে ছাপলেই তো হয়। কিন্তু অদ্ভুত এঁদের একগুয়েমি–সব সংবাদপত্র থেকেই বারম্বার সেই একই দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।

তখন বিরক্ত হয়ে, শহর ছেড়ে মফঃস্বলের দিকে লক্ষ্য দিতে হল । অর্থাৎ লেখাটা দিগ্বিদিকে পাঠাতে শুরু করলাম। মেদিনীপুর-মন্থন, চুঁচুড়া-চন্দ্রিকা, বাঁকুড়া–হরকরা, ফরিদপুর- সমাচার, গৌহাটি-গবাক্ষ, মালদহের গৌড়বান্ধব–কারুকেই বাদ রাখলাম না। কিন্তু শহরে পেট-মোটাদের কাছ থেকে যে দুর্ব্যবহার পাওয়া গেছে, পাড়াগেঁয়ে ছিটে ফোঁটাদের কাছে তার রকমফের হল না। আমার বিরুদ্ধে দেশব্যাগী এক দারুণ ষড়যন্ত্র আমার সন্দেহ হতে লাগল।

এইভাবে সেই প্রথম ও পুরোবর্তী লেখার ওপরে ট্রাই এন্ড ট্রাই এগেন পলিসির কার্য্যকারিতা পরীক্ষা করতেই বাংলা মুলুকের তাবৎ কাগজ আর সাড়ে তিন বছর গড়িয়ে গেল বাকি রইল কেবল একখানি কাগজ কৃষি সম্বন্ধীয় সাপ্তাহিক। চাষাড়ে কাগজ বলেই কি ওর দিকে এতাবৎ আমি মনোযোগ দিইনি, তারা কি আমার এই সাহিত্য রচনার মূল্য বুঝবে? ফেরত তো দেবেই, হয়তো সঙ্গে সঙ্গে বলে পাঠাবে, মশাই আপনার আষাড়ে গল্প আমাদের কাগজে অচল; তার চেয়ে ফুলকপির চাষ সম্বন্ধে যদি আপনার কোনো বক্তব্য থাকে তা লিখে পাঠালে বরং আমরা বেয়ে চেয়ে দেখতে পারি।

এই ভয়েই এতদিন ওধারে তাকাইনি কিন্তু এখন আর আমার ভয় কি? (ডুবন্ত লোক কি কুটো ধরতে ভয় করে?) কিন্তু না; ওদের কাছে আর ডাকে পাঠানো নয়, অনেক ডাকখরচা গেছে অ্যাদ্দিন, এবার লেখা সমভিব্যাহারে আমি নিজেই যাব।

দেখুন আপনি–আপনিই সম্পাদক, না? আমি–আমি একটা একটা লেখা এনেছিলাম আমি–? উক্ত সম্পাদকের সামনে হাজির হয়ে হাঁক পাড়লাম।

গভীর ভদ্রলোক চশমার ফাঁকে কটাক্ষ করলেন–কই দেখি!

একটা গল্প। একেবারে নতুন ধরনের–আপনি পড়লেই বুঝতে পারবেন। লেখাটা বাড়ির দিলাম আনকোরা প্লটে আনকোরা স্টাইলে একেবারে–

ভদ্রলোক গল্পে মনোযোগ দিয়েছেন দেখ আমি দেখে আমি বাক্যযোগ স্থগিত রাখলাম। একটু পড়তেই সম্পাদকের কপাল কুঞ্চিত হল, তারপর ঠোঁট বেঁকে গেল, নাক সিটকাল, দাড়িতে হাত পড়ল,যতই তিনি এগুতে লাগলেন, ততই তা চোখ-মুখের চেহারা বদলাতে লাগল, অবশেষে পড়া শেষ করে যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন তখন বদলাতে লাগল, অবশেষে পড়া শেষ করে যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন তখন মনে হল তিনি যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। হতেই হবে। কিরকম লেখা একখান!

হ্যাঁ, পড়ে দেখলাম-নিতান্ত মন্দ হয়নি। তবে এটা যে একটা গল্প তা জানা গেল আপনি গল্পের নামের পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে কথাটা লিখে দিয়েছেন বলে –নতুবা বোঝার আর কোনো উপায় ছিল না।

তা বটে। আপনারা সম্পাদকরা যদি ছাপেন তবেই নতুন লেখক আমরা উৎসাহ পাই। বলতে বলতে আমি গলে গেলাম, এ গল্পটা আপনার ভাল লেগেছে তাহলে?

লেগেছে এক রকম। তা এটা কি–

হ্যাঁ অনায়াসে! আপনার কাগজের জন্যেই তো এনেছি।

আমার কাগজের জন্য? ভদ্রলোক বসেই ছিলেন কিন্তু মনে হল যেন আরো একটু বসে গেলেন, তা আপনি কি এর আগে আর কখনও লিখেছেন?

ঈষৎ গর্বের সঙ্গেই আমি জবাব দিলাম–নাঃ, এই আমার প্রথম চেষ্টা।

প্রথম চেষ্টা? বটে? ভদ্রলোক ঢোঁক গিললেন, আপনার ঘড়িতে কটা এখন?

ঘড়িটা পকেট থেকে বার করে অপ্রস্তুত হলাম, মনে পড়ল কদিন থেকেই এটা বন্ধ যাচ্ছে, অথচ ঘড়ির দোকানে দেওয়ার অবকাশ ঘটেনি। সত্য কথা বলতে কি, সম্পাদকের কাছে ঘড়ি না হোক অন্ততঃ ঘড়ি চিহ্নমাত্র না নিয়ে যাওয়াটা বে-স্টাইলি হবে ভেবেই আজ পর্যন্ত ওটা সারাতে দিইনি। এখান থেকে বেরিয়েই বরাবর ঘড়ির দোকানে যাব এই মতলব ছিল।

ঘড়িটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম–নাঃ বন্ধ হয়ে গেছে দেখছি। কদিন থেকেই মাঝে মাঝে বন্ধ যাচ্ছে।

তাই নাকি? দেখি তো একবার? তিনি হাত বাড়ালেন।

ঘড়ি মেরামতও জানেন নাকি আপনি? আমি সমভরে উচ্চারণ করলাম।

জানি বলেই তো মনে হয়। কই দেখি, চালানো যায় কিনা।

আমি আগ্রহভরে ঘড়িটা ওঁর হাতে দিলাম–যদি নিখরচায় লেখা আর ঘড়ি একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া যায়, মন্দ কি!

ভদ্রলোক পকেট থেকে পেনসিল-কাটা ছুরি বার করলেন; তার একটা চাড় দিতেই পেছেনের ~ ডালার সবটা সটান উঠে এল। আমি চমকে উঠতেই তিনি সান্ত্বনা দিলেন, ভয় কি? জুড়ে দেব আবার।

সেই ভোতা ছুরি এবং সময়ে সময়ে একটা চোখা কলমের সাহায্যে তিনি একটার পর একটা ঘড়ির সমস্ত অল্প-প্রত্যঙ্গ খুলে ফেলতে লাগলেন। মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটাও বাদ গেল না। খুঁটিনাটি যত যন্ত্রপাতি টেবিলের উপর পাকার হলো তিনি এক একটাকে চশমার কাছে এনে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সূক্ষ্ম তারের ঘোরানো কি একটা জালের মতো বোধহয় হেয়ার স্প্রিংই হবে দুহাতে ধরে সেটাকে লম্বা করার চেষ্টা করলেন। দেখতে দেখতে সেটা দুখান হয়ে গেল, মৃদু হাস্য করে আমার দিকে তাকালেন; তার মানে, ভয় কি, আবার জুড়ে দেব।

ভয় ছিল না কিন্তু ভরসাও যেন ক্রমশ কমে আসছিল! যেটা জুয়েলের মধ্যে সবচেয়ে স্থূলকায় সেটাকে এবার তিনি দাঁতের মধ্যে চাপলেন, দাঁত বসে কিনা দেখবার জন্যই হয়ত বা। কিন্তু দন্তস্ফুট করতে না পেরে সেটাকে ছেড়ে মাথার দিকের দম দেবার গোলাকার চাবিটাকে মুখের মধ্যে পুরলেন তারপর। একটু পরেই কটাস করে উঠল; ওটার মেরামৎ সমাধি হয়েছে বুঝতে পারলাম।

তারপর সমস্ত টুকরো-টাকরা এক করে ঘড়ির অন্তঃপুরে রেখে তলাকার ডালাটা চেপে বন্ধ করতে গেলেন; কিন্তু ডালা তাতে বসবে কেন? সে উঁচু হয়ে রইল। ওপরের ডালাটা আগেই ভেঙেছিল, এবার সেটাকে হাতে নিয়ে আমাকে বললেন, আঠার পাত্রটা আগিয়ে দিন তো দেখি। এটাকে।

অত্যন্ত নিরুৎসাহে গাম–পটটা বাড়ির দিলাম। তিনি আঠার সহায়তায় যথেষ্ট সগ্রাম করলেন কিন্তু তাঁর যৎপরোনাস্তি চেষ্টা সমস্ত ব্যর্থ হলো। আঠায় কখনও ও জিনিস আঁটানো যায়? তখন সবগুলোয় মুঠোর করে নিয়ে আমার দিকে প্রসারিত করলেন এই নিন আপনার ঘড়ি।

আমি অবাক হয়ে এতক্ষণ দেখছিলাম, বললাম–এ কি হল মশাই?

তিনি শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন–কেন, মেরামৎ করে দিয়েছি তো।

বাবার কাছ থেকে বাগানো দামী ঘড়িটার এই দফারফা দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল–এই বুঝি মেরামৎ করা? আপনি ঘড়ির যদি কিছু জানেন। না তবে হাত দিতে গেলেন কেন?

কেন, কি ক্ষতি হয়েছে? একথা বলে তিনি অনায়াসে হাসতে পারলেন–তাছাড়া, আমারও এই প্রথম চেষ্টা।

আমি অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম, তারপ বললাম, ওঃ। আমার প্রথম লেখা বলেই এটা অপনার পছন্দ হয়নি? তা-ই বললেই পারতেন ঘড়ি ভেঙে একথ বলা কেন? আমার চোখ ফেটে জল বেরুবার মতো হলো, কিন্তু অবাঞ্ছিত অঞ কোনমতে সম্বরণ করে, এমনকি অনেকটা আপ্যায়িতের মতো হেসেই অবশেষে বললাম কাল না হয় আর একটা নতুন গল্প লিখে আনব, সেটা আপনার পছন্দ হবে। চেষ্টা করলেই আমি লিখতে পারি।

বেশ আসবেন। এ বিষয়ে সম্পাদকের বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল, কিন্তু ঐ সঙ্গে আর একটা নতুন ঘড়িও আনবেন মনে করে। আমাদের দুজনেরই শিক্ষা হবে তাতে। আপনারও লেখার হাত পাকবে, আমিও ঘড়ি সম্বন্ধে পরিপক্কতা লাভ করব।

পরের দিন মরীয়া হয়েই গেলাম এবং ঘড়িয়া না হয়েই। এবার আর গল্প না, তিনটে ছোট ছোট কবিতা–সিম, বেগুন, বরবটির উপরে।

আমাকে দেখেই সম্পাদক অভ্যর্থনা করলেন–এই যে এসেছেন, বেশ। ঘড়ি আছে তো সঙ্গে?

আমি বললাম না–দেখুন এবারে একেবারে অন্য ধরনের লিখেছি। লেখাগুলো সময়গাপযোগী, এমন কি সব সময়ের উপযোগী। এবং যদি অনুমতি করেন তাহলে অনুগ্রহ–

আরও খানিকটা মুখস্থ করে আনা ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক আমার আবৃত্তিতে বাধা দিলেন–ধৈর্য, উৎসাহ, তিতিক্ষা এসব আপনার আছে দেখছি। পারবেন আপনি। কিন্তু আমাদের মুশকিল কি জানেন, বড় লেখকেরই বড় লেখা কেবল আমরা ছাপতে পারি। প্রবন্ধের শেষে বা তলায় দিকে দেওয়া চলে এমন ছোট-খাট খুচরা-খাচরা যদি আপনার কিছু থাকে তাহলে বরং–। এই ধরুন, চার লাইনের কবিতা কিংবা কৌতুক–কণা–

আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিলাম–হ্যাঁ, কবিতা। কবিতাই এনেছি এবার। পড়ে দেখুন আপনি, রবীন্দ্রনাথের পরে ওমন কবিতা কেউ লিখেছে কিনা সন্দেহ।

তিনি কবিতা তিন পিস হাতে নিলেন এবং পড়তে শুরু করে দিলেন—

সিম।

সিমের মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
ধামার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।

সঙ্গে সঙ্গে তার সপ্রশংস অভিব্যক্তি দেখা গেল–বাঃ, বেশ হয়েছে। আপনি বুঝি সিমের ভক্ত? সিম খেয়ে থাকেন খুব? অত্যন্ত ভাল জিনিস, যথেষ্ট ভিটামিন।

সিম আমি খাইনে। বরং অখাদ্যই মনে করি। তবে এই কবিতাটা লিখতে হিমসিম খেয়েছি।

হ্যাঁ এগুলো চলবে। খাসা কবিতা লেখেন আপনি; বরবটির সঙ্গে চটপটির মিলটা মন্দ না। তুলনাটাও ভাল–তা, এক কাজ করলে তো হয়।–অকস্মাৎ তিনি যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হলেন।দেখুন, ভিটামিনের কাগজ বটে কিন্তু ভিটামিন আমরা খুব কমই খাই। কলা বাদ দিয়ে কলার খোসা কিংবা শাঁস বাদ দিয়ে আলুর পোসার সারাংশ প্রায়ই খাওয়া হয়ে ওঠে না–এইজন্যে মাস কয়েক থেকে বেরিবেরিতে ভুগতে হচ্ছে; তা আপনি যদি–তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।

হ্যাঁ, পারব। খুব পারব। ঝুড়ি ঝুড়ি কলার খোসা আপনাকে যোগাড় করে দেব। কিন্তু শুধু খোসা তো কিনতে পাওয়া যায় না, কলার দামটা আপনিই দেবেন। তার সমর্থনের অপেক্ষায় একটু থামলাম, কলাগুলো আমিই না হয় খুব কষ্টে-সৃষ্টে-যদিও অনুপকারী, তবু বেরিবেরি না হওয়া পর্যন্ত খেতে তো কোন বাধা নেই?

না সে কথা নয়। আমি বলছি কি, আমি তিন মাসের ছুটি নিয়ে ঘাটশিলায় হাওয়া বদলাতে যেতাম, আপনি যদি সেই সময়ে আমার কাগজটা চালাতেন।

আমি? এবার আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন।

তা, লিখতে না জানলেও কাগজ চালানো যায়। লেখক হওয়ার চেয়ে সম্পাদক হওয়া সোজা। আপনার সঙ্গে আমার এই চুক্তি থাকবেঃ আপনাকে নামজাদা লেখকদের তালিকা দিয়ে যার, তাঁদের লেখা আপনি চোখ বুজে চালিয়ে দেবেন কেবল কপি মিলিয়ে প্রুফ দেখে দিলেই হল। সেই সব লেখার শেষ পাতায় তলায় যা এক-আধুট জায়গা পড়ে থাকবে সেখানে আপনার এই ধরনের ছোট ছোট কবিতা আপনি ছাপতে পারবেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। এই রকম কৃষি কবিতা–ওলকপি, গোলআলু, শকরকন্দ–যার সম্বন্ধে খুশি লিখতে পারেন।

বলা বাহুল্য, আমাকে রাজি করতে ভদ্রলোককে মোটেই বেগ পেতে হল না, সহজেই আমি সম্মত হলাম। এ যেন আমার হাতে স্বর্গ পাওয়া গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! সম্পাদক শিকার করতে এসে সম্পাদকতা স্বীকার– তোমাদের মধ্যে খুব কম অজাতশ লেখকেরই এরকম সৌভাগ্য হয়েছে বলে আমার মনে হয়।

সম্পাদনা-কাজের গোড়াতেই এক জোড়া চশমা কিনে ফেললাম; ফাউন্টেন পেন তো ছিলই। অতঃপর সমস্ত জিনিসটাই পরিপাটিরকম নিখুঁত হলো। কলম বাগিয়ে -কৃষিতত্ত্বের- সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলাম। যদিও সম্পাদকীয় লেখার জন্য ঘুণাক্ষরেও কোন অনুরোধ ছিল না সম্পাদকের, কিন্তু ওটা বাদ দিলে সম্পাদকতা করার কোন মানেই হয় না, আমার মতো। এতএব লিখলাম।

আমাদের দেশে ভদ্রলোকের মধ্যে কৃষি সম্বন্ধে দারুণ অজ্ঞতা দেখা যায়। এমন কি, অনেকের এরকম ধারণা আছে যে এই সব তক্তা আমরা দেখি, দরজা, জানালা কড়ি, বরগা, পেনসিল তক্তপোষে যেসব কাঠ সাধারণতঃ দেখতে পাওয়া যায় সে সমস্ত ধান গাছের। এটা অতীব শোচনীয়। তারা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে ওগুলো ধান তো নয়ই, বরঞ্চ পাট বলা যেতে পারে। অবশ্য পাট গাছ ছাড়াও কাঠ জন্মায়; আম, জাম, কাঁঠাল, কদবেল ইত্যাদি বৃক্ষেরাও তক্তাদান করে থাকে। কিন্তু নৌকার পাটাতনে যে কাঠ ব্যবহৃত হয় তা কেবলমাত্র পাটের।…

ইত্যাদি—এইভাবে একটানা প্রায় আড়াই পাতা কৃষি তত্ত্ব। কাগজ বেরুতে না বেরুতে আমার সম্পাদকতার ফল প্রত্যক্ষ করা গেল। মোটে পাঁচশ করে আমাদের ছাপা হত, কিন্তু পাঁচশ কাগজ বাজারে পড়তেই পেল না। সকাল থেকে প্রেস চালিয়ে, সাতগুণ গেছেও অনেক হকারকে শেষে ক্ষুণ্ণমনে আর শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিতে হল।

সন্ধ্যায় পরে যখন আপিস থেকে বেরুলাম, দেখলাম একদল লোক আর বালক সামনের রাস্তায় জড়ো হয়েছে; আমাকে দেখেই তারা তৎক্ষণাৎ ফাঁকা হয়ে আমার পথ করে দিল। দুএকজনকে যেন বলতেও শুনলাম–ইনি, ইনিই। স্বভাবতঃই খুব খুশি হয়ে গেলাম। না হব কেন?

পরদিনও আপিসের সামনে সেই রকম লোকের ভীড়; দল পাকিয়ে দুচারজন করে এখানে ওখানে ছড়িয়ে, রাস্তার এধারে ওধারে, দূরে সুদূরে (কিন্তু অনতি নিকটে) প্রায় সমস্ত জায়গাটা জুড়েই ব্যক্তিবর্গ। সবাই বেশ আগ্রহের সঙ্গে আমাকে লক্ষ্য করছে। তাদের কৌতূহলের পাত্র আমি বুঝতে পারলাম বেশ; এবং পেরে আত্মপ্রসাদ হতে লাগল।

আমি কাছাকাছি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা বিচলিত হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল, আমি দ্বিধাবোধ করার আগেই মন্ডলীর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আমার পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছিল। একজন বলে উঠল ওর চোখের দিকে তাকাও, কি রকম চোখ দেখেছ! আমিই যে ওদের লক্ষ্য এটা যেন লক্ষ্য করছি না এই রকম ভাব দেখাচ্ছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, মনে মনে বেশ পুলক সঞ্চার হচ্ছিল আমার। ভাবলাম, এ সম্বন্ধে লম্বা-চওড়া বর্ণনা দিয়ে আজই বড়দাকে একখানা চিঠি ছেড়ে দেব।

দরজা ঠেলে আপিস-ঘরে ঢুকতেই দেখলাম দুজন গ্রাম্যগোছের লোক আমার চেয়ার এবং টেবিল ভাগাভাগি করে বসে আছে–বসার কায়দা দেখলে মনে হয় লাঙ্গল ঠেলাই ওদের পেশা। আমাকে দেখেই তারা তটস্থ হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য যেন তাদের লজ্জায় ম্রিয়মাণ বলে আমার বোধ হলো কিন্তু পরমুহূর্তেই তাদের আর দেখতে পেলাম না–ওধারের জানলা টপকে ততক্ষণে তারা সটকেছে। অপিস-ঘরে যাতায়াতের অমন দরজা থাকতেও তা না ব্যবহার করে অপ্রশস্ত জানলাই বা তারা কেন পছন্দ করল, এই অদ্ভুত কান্ডের মাথামুন্ড নির্ণয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। এমন সময়ে একজন ভোঢ় ভদ্রলোক সযত্নলাললিত ছড়ি হস্তে আমার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। তাঁর দাড়ির চাকচিক্যা দৃষ্টি আকর্ষ করার মতো। চেয়ারে ছড়ির ঠেসান দিয়ে দাড়িকে হস্তগত করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি নতুন সম্পাদক?

আমি জানালাম, তাঁর অনুমান যথার্থ।

আপনি কি এর আগে কোন কৃষি কাগজের সম্পাদনা করেছেন?

আজ্ঞে না, আমি বললাম, এই আমার প্রথম চেষ্টা।

তাই সম্ভব। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, হাতে-কলমে কৃষি-কাজের কোন অভিজ্ঞতা আছে। আপনার?

একদম না। স্বীকার করলাম আমি।

আমারও তাই মনে হয়েছে। ভদ্রলোক পকেট থেকে ভাজ করা এই সপ্তাহের একখানা কৃষি তত্ত্ব বার করলেন–এই সম্পাদকীয় আপনার লেখা নয় কি?

আমি ঘাড় নাড়লাম–এটাও আপনি ঠিক ধরেছেন।

আমার আন্দাজ ঠিক। বলে তিনি পড়তে শুরু করলেন?

মূলো জিনিসটা পড়বার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কখনই টেনে ছেঁড়া উচিত নয়, ওকে মূলোর ক্ষতি হয়। তার চেয়ে বরং একটা ছেলেকে গাছের ওপরে পাঠিয়ে দিয়ে ডালপালা নাড়তে দিলে ভাল হয়। খুব কসে নাড়া দরকার। ঝাঁকি পেলেই টপাটপ মূলোবৃষ্টি হবে, তখন কুড়িয়ে নিয়ো ঝাঁকা ভরো।…..

এর মানে কি আমি জানতে চাই। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে যেন উন্মার আভাস ছিল।

কেন? এর মানে তো স্পষ্ট। বৃদ্ধ ব্যক্তির বোধশক্তি-হীনতা দেখে আমি হতবাক হলাম, আপনি কি জানেন, কত হাজার হাজার, কত লাখ লাখ মূলো অর্ধপক্ক অবস্থায় টেনে ছিঁড়ে নষ্ট করা হয় আমাদের দেশে? মূলো নষ্ট হলে কার যায় আসে? কেবল যে মূলোরাই তাতে অপকার করা হয় তা নয়, আমাদের আমাদেরও ক্ষতি তাতে। দেশেরই তাতে সর্বনাশ, তার হিসেব রাখেন? তার চেয়ে যদি মূলোকে গাছেই পাকতে দেওয়া হত এবং তারপরে একটা ছেলেকে গাছের ওপরে

নিকুচি করেছে গাছের! মূলো গাছেই জন্মায় না।

কি! গাছে জন্মায় না। অসম্ভব–এ এখনও হতে পারে? মানুষ ছাড়া সবকিছুই গাছে জন্মায়, এমন কি বাঁদর পর্যন্ত।

ভদ্রলোকের মুখবিকৃতি দেখে বুঝলাম বিরক্তির তিনি চরম সীমায়। রেগে কৃষি-তত্ত্বখানা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফুঁ দিয়ে, ঘরময় উড়িয়ে দিলেন। তারপরে নিজের ছড়িতে হস্তক্ষেপ করলেন। আমি শঙ্কিত হলাম–লোকটা মারবে নাকি? কিন্তু না আমাকে ছাড়া টেবিল, চেয়ার দেরাজ, আলমারি, ঘরের সবকিছু ছড়িপেটা করে, অনেক কিছু ভেঙেচুরে, অনেকটা শান্ত হয়ে, অবশেষে, সশব্দে ঘরের দরজায় ধাক্কা মেরে তিনি সবেগে বেরিয়ে গেলেন। লোকটা কোনো ইস্কুলের মাস্টার নয় তো?

আমি অবাক হলাম, ভদ্রলোক ভারী চটে চলে গেলেন তা তো স্পষ্টই, কিন্তু কেন যে কি সম্বন্ধে তার এত অসন্তোষ তা কিছু বুঝতে পারলাম না।

এই দুর্ঘটনার একটু পরেই আগামী সপ্তাহের সম্পাদকীয় লেখবার জন্য সুবিধে মতো আঁকিয়ে বসছি এমন সময়ে দরজা ফাঁক করে কে যেন উঁকি মারল। যারা জানলা-পথে পালিয়েছিল সেই ‘চষ্য’-রাজাদের একজন নাকি? কিন্তু না, নিরীক্ষণ করে দেখলাম বিশী বেহারার জনৈক বদখৎ লোক। লোকটা ঘরে ঢুকেই যেন কাঠের পুতুল হয়ে গেল, ঠোঁটে আঙুল চেপে, ঘাড় বেঁকিয়ে কুঁজো হয়ে কি যেন শোনবার চেষ্টা করল। কোথাও শব্দমাত্র ছিল না। তথাপি সে শুনতে লাগল। তবু কোনো শব্দ নেই। তারপরে অতি সন্তপর্ণে দরজা ভেজিয়ে পা টিপে টিপে আমার কাছাকাছি এগিয়ে এসে সুতীব্র ঔৎসুক্যে আমাকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ একেবারে নিষ্পলক, তারপরেই কোটের বোতাম খুলে হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে একখণ্ড কৃষি-তত্ত্ব বার করল।

এই যে, তুমি! তুমিই লিখেছ তো? পড়-পড়–এইখানটা তাড়াতাড়ি। ভারী কষ্ট হচ্ছে আমার।

আমি পড়তে শুরু করলামঃ

মুলোর বেলা যেরকম আলুর বেলা সেরকম করা চলবে না। গাছ ঝাঁকি দিয়ে পাড়লে আলুরা চোট খায়, এই কারণেই আলু পচে আর তাতে পোকা ধরে। আলুকে গাছে বাড়তে দিতে হবে যতদূর খুশি সে বাড়ুক। এরকম সুযোগ দিলে এক-একটা আলুকে তরমুজের মতো বড় হতে দেখা গেছে। অবশ্য বিলাতেই; এদেশে আমরা আলু খেতেই শিখেছি, আলুর যত্ন নিতে শিখিনি। আলু যথেষ্ট বেড়ে উঠলে এক-একটা করে আলাদা আলাদা ফজলি আমের মতন তাকে ঠুসি পাড়া করতে হবে।

তবে পেঁয়াজ অমরা আঁকশি দিয়ে পাড়তে পারি, তাতে বিশেষ কোন ক্ষতি হবে না। অনেকের ধারণা পেঁয়াজ গাছেল ফল, বাস্তবিক কিন্ত তা নয়। বরং ওকে ফুল বলা যেতে পারে–ওর কোনো গন্ধ নেই, যা আছে কেবল দুর্গন্ধ। ওর খোসা ছাড়ানো মানেই ওর কোরক ছাড়ানো। এনতার কোরক ওর। পেঁয়াজেরই অপর নাম শতদল।

অতি প্রাচীনকালেও এদেশে ফুলকপি ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়, তবে তাকে আহার্যের মধ্যে তখন গণ্য করা হত না। শাস্ত্রে বলেছে অলাবুভক্ষণ নিষেধ, সেটা ফুলকপি সম্বন্ধেই। আর্যেরা কপি খেতেন না, ওটা আনর্য হাতিদের খাদ্য ছিল। গজভুক্ত কপিখ এই প্রবাদে তার প্রমাণ করেছে

বাতাবিলেবুর গাছে কমলালেবু ফলানোর সহজ উপায় হচ্ছে এই–

ব্যস, ব্যস–এতেই, হবে। আমার উৎসাহী পাঠক উত্তেজিত হয়ে আমার পিঠ চাপড়াবার জন্য হাত বাড়াল। আমি জানি আমার মাথা ঠিকই আছে, কেননা তুমি যা পড়লে আমিও ঠিক তাই পড়েছি, ওই কথাগুলোই। অন্তত আজ সকালে, তোমার কাগজ পড়ার আগে পর্যন্ত ওই ধারণাই আমার ছিল। যদিও আমার আত্মীয়স্বজন আমাকে সব সময়ে নজরে নজরে রাখে তবু এই ধারণা আমার প্রবল ছিল যে মাথা আমার ঠিকই আছে–

তার সংশয় দূর করার জন্য আমি সায় দিলাম–নিশ্চয়ঃ নিশ্চয়! বরং অনেকের চেয়ে বেশি ঠিক একথাই আমি বলব। এইমাত্র একজন বুড়ো লোক কিন্তু যাক সে কথা।

লোকটাও সায় দিল–হ্যাঁ, যাক। তবে আজ সকালে তোমার কাগজ পড়ে সে ধারণা আমার টলেছে। এখন আমি বিশ্বাস করি যে সত্যি সত্যিই আমার মাথা খারাপ। এই বিশ্বাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এক দারুণ চিৎকার ছেড়েছি নিশ্চয়ই তুমি এখানে বসে তা শুনতে পেয়েছে?

আমি ঘাড় নাড়লাম, কিন্তু আমার অস্বীকারোক্তিতে সে আমল দিল না–নিশ্চয় পেয়েছ। দু মাইল দূর থেকে তা শোনা যাবে। সেই চিৎকার ছেড়েই এই লাঠি নিয়ে আমি বেরিয়েছি, কাউকে খুন না করা পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছে না। তুমি বুঝতেই পারছ আমার মাথার যা অবস্থা তাতে একদিন কাউকে খুন আমায় করতেই হবে–তবে আজই তা শুরু করা যাক না কেন?

কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না, একটা অজানা আশঙ্কায় বুক দূর দূর করতে লাগল।

বেরুবার আগে আর একবার তোমার প্যারাগুলো পড়লাম, সত্যিই আমি পাগল কিনা নিশ্চিত হবার জন্যে। তার পরক্ষণেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছি। রাস্তায় যাকে পেয়েছি তাকেই ধরে ঠেঙিয়েছি। অনেকে খোঁড়া হয়েছে, অনেকের মাথা ভেঙেছে; সবসুদ্ধ কতজন হতাহত বলতে পারব না। তবে একজনকে জানি, সে গাছের উপর উঠে বসে আছে। গোলাদীঘির ধারে। আমি ইচ্ছা করলেই তাকে পেড়ে আনতে পারব। এই পথ দিয়ে যেতে মনে হল তোমার সঙ্গে একবার মোলাকাৎ করে যাই–

হৃৎকম্পের কারণ এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম–কিন্তু বোঝার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎকম্প একেবারেই বন্ধ হবার যোগাড় হল যেন!

কিন্তু তোমায় আমি সত্যি বলছি, যে লোকটা গাছে চেপে আছে তার কপাল ভাল। এতক্ষণ তবু বেঁচে রয়েছে বেচারা। ওকে খুন করে আসাই উচিত ছিল আমার। যাক, ফেরার পথে ওর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হবে। এখন আসি তাহলে–নমস্কার!

লোকটা চলে গেলে ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়ল। কিন্তু এতগুলো লোক যে আমার লেখার জন্যই খুন-জখম হয়েছে হাত-পা হারিয়েছে এবং একজন গোলদীঘির ধারে এখনও গাছে চেপে বসে আছে এই সব ভেবে মন ভারী খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই এই সব দুশ্চিন্তা দূরীভূত হলো, কেননা—’কৃষি-তত্ত্বের’ আটপৌরে সম্পাদক অপ্রত্যাশিতরূপে প্রবেশ করলেন।

সম্পাদকের মুখ গম্ভীর, বিষণ্ণ, বিলম্বিত। চেঞ্জ গিয়ে অবিলম্বে ফিরে আসার জন্যেই বোধ হয়। আমার দুজনে চুপচাপ। অনেকক্ষণ পরে একটি মাত্র কথা তিনি বললেন–তুমি আমার কাগজের সর্বনাশ করেছ।

আমি বললাম, কেন, কাটতি তো অনেক বেড়েছে।

হ্যাঁ, কাগজ বহুত কেটেছ, আমি জানি। কিন্তু আমার মাথাও কাটা গেছে সেই সঙ্গে। তারপরে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কীর্তিকলাপ তাঁর দৃষ্টিগোচর হল, চারিদিকে ভাঙাচোরা দেখে তিনি নিজেও যেন ভেঙে পড়লেন–সত্যি বড় দুঃখের বিষয়। ‘কৃষি-তত্ত্বের’ সুনামের যে হানি হলো, যে বদনাম হলো তা বোধহয় আর ঘুচবে না। অবিশ্যি কাগজের এত বেশি বিক্রী এর আগে কোনোদিন হয়নি বা এমন নামডাকও চারদারে ছড়িয়ে পড়েনি–কিন্তু পাগলামির জন্য বিখ্যাত হয়ে কি লাভ? একবার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখ দেখি চারধারে কি রকম ভীড় কি সোরগোল! তারা সব দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে দেখবার জন্যে। তাদের ধারণা তুমি বদ্ধ পাগল। তাদের দোষ কি? যে তোমার সম্পাদকীয় পড়বে তারই ওই ধারণা বদ্ধমূল হবে। তুমি যে চাষবাসের বিন্দুবিসর্গও জানো তা তো মনে হয় না। কপি আর কফিখ যে এক জিনিস একথা কে তোমাকে বলল? গোল আলুর সম্বন্ধে তুমি যে গবেষণা করেছ, মূলো চাষের যে আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছ সে সম্বন্ধে তোমার কোনই অভিজ্ঞতা নেই। তুমি লিখেছ শামুক অতি উৎকৃষ্ট সার, কিন্তু তাদের ধরা অতি শক্ত। মোটেই তা নয়, শামুক মোটেই সারবান নয়, এবং তাদের দ্রুতগতির কথা এই প্রথম জানা গেল। কচ্ছপেরা সঙ্গীতপ্রিয়, রাগ-রাগিণীর সম্মুখে তারা মৌনী হয়ে থাকে, সেটা তাদের মৌনসম্মতির লক্ষণ, তোমার এ মন্তব্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কচ্ছপদের সুরবোধের কোনই পরিচয় এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনিই ওরা চুপচাপ থাকে, মৌনী হয়ে থাকাই ওদের স্বভাব-সঙ্গীতের কোন ধারই ধারে না তারা। কচ্ছপদের দ্বারা জমি চষানো অসম্ভব একেবারেই অসম্ভব। আপত্তি না করলেও জমি তারা চষবে না–তারা তো বলদ নয়! তুমি যে লিখেছ, ঘোড়ামুগ ঘোড়ার খাদ্য আর কলার বীচি থেকে কলাই হয়, তার ধাক্কা সামলাতে আমার কাগজ উঠে না গেলে বাঁচি! গাছের ডাল আর ছোলার ডালের মধ্যে যে প্রভেদ আছে দেড় পাতা খরচ করে তা বোঝাবার তোমার কোনই দরকার ছিল না। কেবল তুমি ছাড়া আর সবাই জানে। যাক, যা হবার হয়েছে, এখন তুমি বিদায় নাও। তোমাকে আর সম্পাদকতা করতে হবে না। আমার আর বায়ু পরিবর্তনের কাজ নেই– ঘাটশিলায় গিয়েই আমাকে দৌড়ে আসতে হয়েছে তোমার পাঠানো কাগজের কপি পেয়ে অবধি আমার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। পরের সপ্তাহে আবার তুমি কি গবেষণা করে বসবে সেই ভয়েই আমার বুক কেঁপেছে। বিড়ম্বনা আর কাকে বলে! যখনই তোমার ঘোষণার কথা ভেবেছি জাম জামরুল আর গোলাপ জাম কি করে একই গাছে ফলানো যায়, পরের সংখ্যাতেই তুমি তার উপায় বলে দেবে, তখন থেকেই নাওয়া-খাওয়া আমার মাথায় উঠেছে- বেরিবেরিতে প্রাণ যায় সেও ভাল–তখনই আমি কলকাতার টিকিট কিনে গাড়িতে চেপেছি।

এতখানি বক্তৃতার পর ভদ্রলোক এক দারুণ দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। ওরই কাগজের কাটতি আর খ্যাতি বাড়িয়ে দিলাম, আরও বেড়ে গেল কত অথচ উনিই আমাকে গাল-মন্দ করলেন! ভদ্রলোকের নেমকহারামি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে আমাকে গাল-মন্দ করছেন! ভদ্রলোকের নেমকহারামি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। অতএব, শেষবিদায় নেওয়ার আগে অমিই বা ক্ষান্ত হইয়া কেন? আমার বক্তব্য আমিও বলে যাব। এত খাতির কিসের?

বেশ আমার কথাটাও শুনুন তবে। আপনার কোন কাণ্ডজ্ঞানেই নেই, আপনি একটি আস্ত বাঁধাকপি। এরকম অনুদার মন্তব্য যা এতক্ষণ আমাকে শুনব বলে কোনদিন আমি কল্পনাও করিনি। কাগজের সম্পাদক হতে হলে কোনো কিছু জানতে হয় তাও আমি এই প্রথম জানলাম। এতদিন তো দেখে আসছি যারা বই লিখতে পারে না তারই ফুটবল খেলা দেখতে যায়। আপনি নিতান্তই শালগম, তাই একথা বুঝতে আপনার বেগ পেতে হচ্ছে। যদি নেহাৎ ভুনিকুমাণ্ড না হতেন তাহলে অবশ্য বুঝতেন যে কৃষি-তত্ত্বের কি উন্নতি আর আপনার কতখানি উপকার আমি করেছি! আমার গায়ে জোর থাকলে আপনার মত গাজরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যেতাম! কি আর বলব আপনাকে, পালং শাক, পানিফল, তালশীল, যা খুশি বলা যায়। আপনাকে পাতিলেবু বললে পাতিলেবুর অপমান করা হয়–

দম নেবার জন্য আমাকে থামতে হল। গায়ের ঝাল মিটিয়ে গালাগালের শোধ তুললাম, কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে নির্বাক। আবার আরম্ভ করলাম আমি–

হ্যাঁ, একথা সত্যি, সম্পাদক হবার জন্য জন্মভূমি যারা সৃষ্টি করে আমি তাদেরই একজন, আমি হচ্ছি লেখক। উঁইফোড় কাগজের সম্পাদক হয় কারা? আপনার মতো লোক নিতান্তই যারা টম্যাটো। সাধারণত যারা কবিতা লিখতে পারে না, আট-আনা সংকরণের নভেলও যাদের আসে না, পিলে চমকানো থিয়েটারী নাটক লিখতেও অক্ষম, প্রথম শ্রেণীর মাসিক পত্রেও অপারগ তারাই অবশেষে হাত-চুলকানো থেকে আত্মরক্ষার জন্য আপনার মতো কাগজ বের করে বসে। আমি আমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করেছেন তাতে আর মুহূর্তও এখানে থাকতে আমার রুচি নেই! এই দণ্ডেই সম্পাদক-গিরিতে আমি ইস্তফা দিচ্ছি! চাষাড়ে কাগজের সম্পাদকের কাছে ভদ্রতা আশা করাই বাতুলতা! ঘড়ির দুর্দশা দেখেই আমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। যাব তো আমি নিশ্চয়, কিন্তু জানবেন, আমার কর্তব্য আমি করে গেছি, যা গেছি, যা চুক্তি ছিল তা অক্ষরে পালন করেছি আমি। বলেছিলাম আপনার কাগজ সর্বশ্রেণীর পাঠ্য করে তুলব–তা আমি করেছিও। বলেছিলাম আপনার কাগজের কুড়ি হাজার গ্রাহক করে দেব–যদি আর দু-সপ্তাহ সময় পেতাম তাও আমি করতে পারতাম। এখন-এখনই আপনার পাঠক কারা? কোন চাষের কাগজের বরাতে যা কোনদিন জোটেনি সেইসব লোক আপনার কাগজের পাঠক–যত উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, মোক্তার, হাইকোর্টের জজ, কলেজের প্রফেসার, যত সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। একজনও চাষা নেই ওর ভেতর-যত চাষা গ্রাহক ছিল তারা সব চিঠি লিখে কাগজ ছেড়ে দিয়েছে-ঐ দেখুন টেবিলের ওপর চিঠির গাদা! কিন্তু আপনি এমনই চাল-কুমড়ো যে পাঁচশ মুখ্যু চাষার জন্যে বিশ হাজার উচ্চশিক্ষিত গ্রাহক হারালেন! এতে আপনারই ক্ষতি হলো, আমার কি আর! আমি চললাম।

ঋণং কৃত্বা

কারো ধার ধারি না, এমন কথা আর যেই বলুক আমি কখনই বলতে পারি না। আমার ধারণা, এক কাবুলিওয়ালা ছাড়া এ জগতে এ-কথা কেউই বলতে পারে না। অমৃতের পথ ক্ষুরস্য ধারা নিশ্চিতা; অকালে মৃত না হতে বলে ধার করতেই হবে।

ধার হলেও কথা ছিল বরং, কিন্তু তাও নয়। বাড়ি ভাড়া বাকি। তাও বেশি না পাঁচশো টাকা মাত্তর! কিন্তু তার জন্যেই বাড়িওয়ালা করাল মূর্তিটি ধরে দেখা দিলেন একদিন আপনাকে অনেক সময় দিয়েছি কোন অজুহাত শুনছি না আর

ভেবে দেখুন একবার। আমি তাকে বলতে যাই : এই সামান্য পাঁচশো টাকার জন্যে আপনি এমন করছেন! অথছ এক যুগ পরে একদিন–আমি মারা যাবার পরেই অবিশ্যি–আপনার এই বাড়ির দিকে লোকে আঙুল দেখিয়ে বলবে, একদা এখানে বিখ্যাত লেখক শ্রীঅমুকচন্দ্র বাস করতেন।

বাস করতেন! বাস করে আমার মাথা কিনতেন জবাবে তার দিক থেকে যেমন ঝাঁপটা এলো–শুনুন মশাই, আপনাকে সাফ কথা কথা বলি যদি আজ রাত্রি বারোটার ভেতর আমার টাকা না পাই তাহলে এক যুগ পরে নয়, কালকেই লোকে এই কথা বলবে।

বাড়িওয়ালা তো বলে গেলন, চলেও গেলেন। কিন্তু এক বেলার মধ্যে এতো টাকা আমি পাই কোথায়? পাছে ধার দিতে হয় ভয়ে সহজে কেউ আমার মতো লেখকের ধার ঘেঁষে না। লেখক মাত্রই ধারাল, আমি আবার তার ওপর এক কাঠিজানে সবাই।

হর্ষবর্ধনের কাছে যাবো? তাদের কাছে এই ক-টা টাকা কিছুই নয়। কীর্তি-কাহিনী লিখে অনেক টাকা তাদের পিটেছি, এখন তাদের পিঠেই যদি চাপি গিয়ে? তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় যদি এই দায় থেকে উদ্ধার পাই।

গিয়ে কথাটা পাড়তেই হর্ষবর্ধন বলে উঠলেন–নিশ্চয় নিশ্চয়! আপনাকে দেবো না তো কাকে দেববা!

চমকে গেলাম আমি। কথাটা যেন কেমনতরো শোনাল।

আপনি এমন কিছু আমাদের বন্ধু নন? তিনি বলতে থাকেন।

বন্ধুত্বের কথাই যদি বলেন- আমি বাধা দিয়ে বলতে যাই।

হ্যাঁ, বন্ধুত্বের কথাই বলছি। আপনি তো আমাদের বন্ধু নন। বন্ধুকেই টাকা ধার দিতে নেই, মানা আছে। কেননা, তাতে টাকাও যায় বন্ধুও যায়। তিনি জানান তবে হ্যাঁ, এমন যদি সে বন্ধু হয় সে বিদেয় হলে বাঁচি তার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাকে ঐ ধার দেওয়া। তাহলেই চিরকালের মতন নিস্তার!

আহা! আমি যদি ওঁর সেই দ্বিতীয় বন্ধু হতাম মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

কিন্তু আপনি তো বন্ধু নন, লেখক মানুষ। লেখকরা তো কখনো কারো বন্ধু হয় না।

লেখকদেরও বোধহয় কেউ বন্ধু হয় না। সখেদে বলি।

বিলকুল নির্ঝঞ্ঝাট! এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে, বলুন? তিনি বলেন, আপনি যখন আমাদের আত্মীয় বন্ধু কেউ নন, নিতান্তই একজন লেখক তখন আপনাকে টাকা দিতে আর বাধা কি? কতো টাকা দিতে হবে বলুন?

বেশি নয় শ-পাঁচেক। আর একেবারে দিয়ে দিতেও আমি বলছি না। আমি বলি :–আজ তো বুধবার, শনিবার দিনই টাকাটী আমি আপনাকে ফিরিয়ে দেবো।

কথা দিলাম। এছাড়া আজ বাড়িওয়ালার হাত থেকে ত্রাণ পাবার আর কি উপায়, কিন্তু কথা তো দিলাম। না ভেবেই দিয়েছিলাম কথাটা–শনিবারের সকাল হতেই ওটা ভাবনার কথা হয়ে দাঁড়াল।

ভাবতে ভাবতে চলেছি, এমন সময় গোবর্ধনের সঙ্গে মোলাকাত অকুলপাথারে, চৌরাস্তার মোড়ে।

গোবর্ধন ভায়া একটা কথা রাখবে? রাখো তো বলি।

কি কথা বলুন?

যদি কথা দাও যে, তোমার দাদাকে বলবে না তাহলেই বলি।

দাদাকে কেন বলতে যাবো, দাদাকে কি আমি সব কথা বলি?

অন্য কিছু কথা নয়, কথাটা হচ্ছে এই, আমাকে শপাঁচেক টাকা ধার দিতে পারো দিন কয়েকের জন্যে? আজ তো শনিবার? এই বুধবার সন্ধ্যের মধ্যেই টাকাটা আমি তোমাকে ফিরিয়ে দেবো।

এই কথা? এই বলে আর দ্বিরুক্তি না করে শ্রীমান গোবরা তার পকেট থেকে পাঁচখানা একশো টাকার নোট বার করে দিল।

টাকাটা নিয়ে আমি সটান শ্রীহর্ষবর্ধনের কাছে।

দেখুন আমার কথা রেখেছি কিনা। দরিদ্র লেখক হতে পারি, কথা নিয়ে খেলা করতে পারি কিন্তু কথার খেলাপ কখনো করি না।

হর্ষবর্ধন নীরবে টাকাটা নিলেন।

আপনি তো ভেবেছিলেন যে টাকাটা বুঝি আপনার মারাই গেল, আমি আর এ-জন্মেও এ-মুখো হবো না। ভাবছিলেন যে–

না না। আমি সে-সব কথা একেবারেও ভাবিনি। টাকার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

তিনি বললেন, বিশ্বাস করুন, টাকাটা আপনাকে দিয়ে আমি কিছুই ভাবিনি কিন্তু ফেরত পেয়ে এখন বেশ ভাবিত হচ্ছি।

ভাবছেন এই যে, এই পাঁচশো টাকা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের ক্রেডিট খাঁটিয়ে এর পরে আমি ফের হাজার টাকা ধার নেবো। তারপর সেটা ফেরত দিয়ে আবার দু-হাজার চাইবো। আর এমনি করে ধারটা দশ-হাজারে দাঁড় করিয়ে তারপরে আর এ-ধারই মাড়াবো না? এই তো ভাবছেন আপনি? এই ভেবেই তো ভাবিত হয়েছেন, তাই না?

আমি তার মনোবিকলন করি। তার সঙ্গে বোধহয় আমার নিজেরও।

তিনি বিকল হয়ে বলেন–না না, সে-সব কথা আমি আদৌ ভাবিনি। ভাবছি যে এত তাড়াতাড়ি আপনি টাকাটা ফিরিয়ে দিলেন! আর এতো তাড়াতাড়ি আপনার প্রয়োজন কি করে মিটতে পারে? বেশ, ফের আবার দরকার পড়লে চাইতে যেন কোন কুণ্ঠা করবেন না।

বলাই বাহুল্য! মনে মনে আমি ঘাড় নাড়লাম। লেখকরা বৈকুণ্ঠের লোক, কোন কিছুতেই তাদের কুণ্ঠা হয় না।

বুধবার দিনই দরকারটা পড়ল আবার। হর্ষবর্ধনের কাছ থেকে টাকটা নিয়ে গোবর্ধনকে গিয়ে দিতে হলো।

কেমন গোবর্ধন ভায়া! দেখলে তো কথা রেখেছি কিনা। এই নাও তোমার টাকা প্রচুর ধন্যবাদের সহিত প্রত্যর্পিত।

বুধবার আবার গোবরায় কাছে যেতে হলো। পাড়তে হলো কথা–

গোবর্ধন ভায়া বুধবারে টাকাটা ফেরত দেবো বলেছিলাম বুধবারেই দিয়েছি, দিই–নি কি? একদিনের জন্যেও কি আমার কথার কোন নড়চড় হয়েছে?

এমন কথা কেন বলছেন? গোবর্ধন আমার ভণিতা ঠিক করতে পারে না।

টাকটার আমার দরকার পড়েছে আবার। ওই পাঁচশো টাকাই–সেই জন্যেই তোমার কাছে এলাম ভাই। এই বধুবারই তোমায় আবার ফিরিয়ে দেবো টাকাটা। নির্ঘাত।

এইভাবে হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন শনিবার আর বুধবারের দু-ধারের টানা পোড়েনে আমার ধারিওয়াল কম্বল বুনে চলেছি এমন সময়ে পথে একদিন দু-জনের সঙ্গে দেখা।

দুই ভাই পাশাপাশি আসছিল। আমাকে দেখে দাঁড়াল। দু-জনের চোখেই কেমন যেন একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি।

হয়তো দৃষ্টিটা কুশল জিজ্ঞাসার হতে পারে, কোথায় যাচ্ছি, কেমন আছি–এই ধরনের সাধারণ কোন কৌতূহলই হয়তো বা, কিন্তু আমার তো পাপ মনে, মনে হলো দু-জনের চোখেই যেন এক তাগাদা!

হর্ষবর্ধনবাবু, ভাই গোবর্ধন, একটা আমি বলবো, কিছু মনে করো না–বলে আমি শুরু করি: ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধনবাবুকে পাঁচশো টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি প্রত্যেক শনিবার পাঁচশো টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি বুধবার, আর গোবর্ধন, তুমি শনিবার মনে থাকবে তো?

ব্যাপার কি! হর্ষবর্ধন তো হতভম্ব: কিছুই বুঝতে পারছি না।

ব্যাপার এই যে, ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।

একটি বেতার ঘটিত দুর্ঘটনা

অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার মত বরাত বুঝি আর হয় না। মোটর চাপাপড়া গেল অথচ অ্যামবুলেন্স আসার জন্য তর সইতে হলো না–যাতে চাপা পড়লাম তাতেই চেপে হাসপাতালে চলে গেলাম। এর চেয়ে মজা কি আছে?

ভাগ্যের যোগযোগ বুঝি একেই বলে। অবিশ্যি, ক্কচিৎ এরূপ ঘটে থাকে-সকলের বরাত তো আর সমান হয় না। অবিশ্যি এর চেয়েও–অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার চেয়েও, আরো বড়ো সৌভাগ্য জীবনে আছে। তা হচ্ছে রেডিয়োয় গল্প পড়তে পাওয়া।

দুর্ভাগ্যের মত সৌভাগ্যরাও কখনো একলা আসে না। রেডিয়োর গল্প আর অ্যামবুলেন্স চাপ–এই দুটো পড়াই একযোগে আমার জীবনে এসেছিল। সেই কাহিনীই বলছি।

কোন পূণ্যবলে রেডিয়োয় গল্পপাঠের ভাগ্যলাভ হয় আমি জানিনে, পারতপক্ষে তেমন কোনো পুণ্য আমি করিনি। অন্তত আমার সজ্ঞানে তো নয়, হঠাৎ রেডিও অফিসের এক আমন্ত্রণ পেয়ে চমকাতে হলো। আমন্ত্রণ এবং চুক্তিপত্র একসঙ্গে গাঁথা দক্ষিণা পর্যন্ত বাঁধা–শুধু আমার সই করে স্বীকার করে নেওয়ার অপেক্ষা কেবল। এমন কি রেডিয়োর কর্তারা আমার পঠীতব্য গল্পের নামটা পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছেন। সর্বমন্ততাম! এই নাম দিয়ে, এই শিরোনামার সঙ্গে খাপ খাইয়ে গল্পটা আমায় লিখতে হবে।

তা, আমার মত একজন লিখিয়ের পক্ষে এ আর এমন শক্ত কি? আগে গল্প লিখে পরে নাম বসাই, এ না হয়, আগেই নাম ফেঁদে তারপরে গল্পটা লিখলাম। ছেলে আগে না ছেলের নাম আগে, ঘোড়া আগে না ঘোড়ার লাগাম আগে, কারো কাছে সেটা সমস্যারূপে দেখা দিলেও একজন লেখকের কাছে সেটা কোনো প্রশ্নই নয়। লাগামটাই যদি আগে পাওয়া গেল, তার সঙ্গে ধরে বেঁধে একটা ঘোড়াকে বাগিয়ে আনতে আর কতক্ষণ?

প্রথমেই মনে হলো, সব আগে সৌভাগ্যের কথাটা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাইকে জানিয়ে ঈর্ষান্বিত করাটা দরকার। বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বন্ধু বান্ধব, চেনা আধচেনা, চিনি-চিনি সন্দেহজনক যাকেই পথে পেলাম, পাকড়ে দাঁড় করিয়ে এটা-সেটা একথা সেকথার পর এই রোমাঞ্চকর কথাটা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করলাম না। অবশেষে পই পই করে বলে দিলাম–শুনো কিন্তু! এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার–সাড়ে পাঁচটায়–শুনে বলবে আমায় কেমন হলো!

শুনব বইকি! তুমি গল্প বলবে আমরা শুনবো না, তাও কি হয়? রেডিও কেনা তবে আর কেন? তবে কিনা, রেডিয়োটা কদিন থেকে আমাদের বিকল হয়ে রয়েছে–কে বিগড়ে দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। গিন্নির সন্দেহ অবশ্যি আমাকেই-যাক, এর মধ্যে ওটা সারিয়ে ফেলব ’খন! তুমি গল্প পড়ছ, সেটা শুনতে হবে তো। একজনের আপ্যায়িত করা জবাব পেলাম।

আরো কজন তো আমরা কথা বিশ্বাস করতে পারেন নাঃ বলো কি? আরে, শেষটায় তুমিও! তোমাকেও ওরা গল্প পড়তে দিলে? দিনকে দিন কি হচ্ছে কোম্পানীর! আর কিছু বোধহয় পাচ্ছে না ওরা নইলে শেষে তোমাকেও–ছিঃ ছিঃ ছিঃ! অধঃপাতের আর বাকি কি রইলো হে? নাঃ, এইবার দেখবে অল ইন্ডিয়া রেডিও উঠে যাবে, আর বিলম্ব নেই!

বন্ধুবরের মন্তব্য শুনে বেশ দমে গেলাম, তথাপি আমতা আমতা করে বললাম–রেড়িয়োর আর দোষ কি দাদা? খোদার দান। খোদা যখন দ্যান ছাপ্পর ছুঁড়ে দিয়ে থাকেন, জানো তো? এটাও তেমনি আকাশ ছুঁড়ে পাওয়া–হঠাৎ এই আকাশবাণীলাভ।

আচ্ছা শুনবখন। তুমি যখন এত করে বলছ। অ্যাসপিরিন, স্মেলিং সলট–এসব হাতের কাছে রেখেই শুনতে হবে। তোমার গল্প পড়লে তো সত্যি বলছি, কিছু মনে কোরো না আমার মাথা ধরে যায়–শুনলে কি ফল হবে কে জানে! মুখ বিকৃত করে বন্ধুটি জানিয়ে গেলেন।

তবু আমি নাছোড়বান্দা। পথেঘাটে যাদের পাওয়া গেল না তাদের বাড়ি ধাওয়া করে সুখবরটা দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য উক্ত শুক্রবারে সেই মুহূর্তে সকলেই শশব্যস্ত! কারো ছেলের বিয়ে, কারো মেয়ের পাকা দেখা, কারো আবার কিসের যেন এনগেজমেন্ট, কাউকে খুব জরুরি দরকারে কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে! এমনি কত কি কাণ্ডে সেই দয়াখো দেখি। আমি গল্প বলব কেউ শুনবে না। আমার জানাশোনারা শুনতে পাবে না এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? আমার গল্প পড়ার দিনটিতেই যে সবার এত গোলমাল আর জরুরি কাজ এসে জুটবে তা কে জানত।

আর তা ছাড়া, রেডিয়োর সময়টাতেই তারা কেন যে এত ভেজাল জোটায় আমি তো ভেবে পাই না। পূর্ব্বজন্মের তপস্যার পুণ্যফলে রেডিয়োকে যদি ঘরে আনতে পেরেছিস–তাই নিয়েই দিনরাত মশগুল থাক–তা না। অন্তত প্রোগ্রামের ঘণ্টায় যে কখনো কক্ষচ্যুত হতে নেই একথাও কি তোদের বলে দিতে হবে? আর সব তালে ঠিক আছিস কেবল রেডিয়োর ব্যাপারেই তোরা আনরেডি–সব তোদের উল্টোপাল্টা!

সত্যি, আমার ভারী রাগ হতে লাগল। অবিশ্যি, ওদের কেউই আমাকে আশ্বাস দিতে কসুর করল না যে যত ঝামেলাই থাক যেমন করে হোক, আমার গল্পটার সময়ে অন্তত ওরা কান খাড়া রাখবে–যত কাজই থাক না, এটাও তো একটা কাজের মধ্যে। বন্ধুর প্রতি কর্তব্য তো। এমন কি কলকাতার বর্হিগামী সেই বান্ধবটিও ভরসা দিয়ে গেলেন যে ট্রেন ফেল করার আগের মিনিট পর্যন্ত কোনো চুল-ছাঁটা সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে যতটা পারা যায় আমার গল্পটা শুনে তবেই তিনি রওনা দেবেন।

সবাইকে ফলাও করে জানিয়ে ফিরে এসে গল্পটা ফলাতে লাগা গেল! সর্বমত্যন্তম-এর সঙ্গে যুতমত, মজবুতমতো একটা কাহিনীকে জুড়ে দেয়াই এখন কাজ।

কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল কাজটা মোটেই সহজ নয়। গল্প তো কতই লিখেছি, কিন্তু এ ধরনের গল্প কখনো লিখিনি। ছোট্ট একটুখানি বীজ থেকে বড় বড় মহীরূহ গজিয়ে ওঠে। লোকে বলে থাকে, আমি নিজের চোখে কখনো দেখিনি বটে, তবে লোকের কথায় অবিশ্বাস করতে চাইনে। তবুও, একথা আমি বলব যে গাছের বেলা তা হয়ত সত্যি হলেও, একটুখানি বীজের থেকে একটা গল্পকে টেনে বার করে আনা দারুণ দুঃসাধ্য ব্যাপার!

বলব কি ভাই, যতই প্লট ফাদি আর যত গল্পই বাঁধি, আর যত রকম করেই ছকতে যাই, কিছুতেই ওই সর্বমত্যন্তম-এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। একটা গল্প লিখতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে একশটা গল্প এসে গেল, মনের গল্পের একশা, আর মনের মত তার প্রত্যেকটাই কিন্তু নামের মত একটাও না।

ভাবতে ভাবতে সাত রাত্রি ঘুম নেই; এমন কি, দিনেও দু চোখে ঘুম আসে না। চোখের কোণে কালি পড়ে গেল আর মাথার চুল সাদা হতে শুরু করল। অর্ধেক চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম–আর কামড়ে কামড়ে ফাউন্টেনের আধখানা পেটে চলে গেল। কত গল্পই এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এল আর গেল কিন্তু কোনটাই এই নামের সঙ্গে খাটল না। •

তখন আমি নিজেই খাটলাম–আমাকেই খাঁটিয়ে নিতে হলো শেষটায়।

শুয়ে শুয়ে আমার খাতার শুভ্র অঙ্কে–আমার অনাগত গল্পে আষ্টেপৃষ্ঠে–ললাটে কত কি যে আঁকলাম! কাকের সঙ্গে বক জুড়ে দিয়ে, বাঘের সাথে কুমীরের কোলাকুলি বাধিয়ে, হনুমানের সঙ্গে জাম্বুবানকে জর্জরিত করে, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার!

সব জড়িয়ে এক ইলাহী কাণ্ড! কি যে ওই সব ছবি, তার কিছু বুঝবার যো নেই, অথচ বুঝতে গেলে অনেক কিছুই বোঝা যায়। গুহা মানুষেরা একদা যে সব ছবি আঁকতো, এবং মানুষের মনের গুহায়, মনশ্চক্ষুর অগোচরে এখনো যে সব ছবি অনুক্ষণ অঙ্কিত হচ্ছে, সেই সব অন্তরের অন্তরালের ব্যাপার! মানুষ পাগল হয়ে গেলে যে সব ছবি আঁকে অথবা আঁকবার পরেই পাগল হয়ে যায়। সর্বমত্যন্তম—ড্যাশ–উইদিন ইনভার্টেড কমার শিরোনামার ঠিক নিচে থেকে সরু করে, গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় আমার নাম স্বাক্ষরের ওপর অবধি কেবল ওইসব ছবি–ওই পাগলকরা ছবি সব! পাতার দুধারে মার্জিনেও তার বাদ নেই–মার্জনা নেই কোনোখানে।

তোমরা হাসছো? তা হাসতে পারো! কিন্তু ছবিগুলো মোটেই হাসবার নয়– দেখলেই টের পেতে। ওই সব ছবির গর্ভে যে নিদারুণ আর্ট নিহিত রইলো আমার আশা, সমদারের সাহায্যে (রাচির বাইরেও তারা থাকবেন নিশ্চয়!) একদিন তার তত্ত্ব উদঘাটিত হবে হবেই চিরদিন কিছু তা ছলনা করে, নিগূঢ় হয়ে থাকবে না। আমার গল্পের জন্য, এমন কি, আমার কোনো লেখার জন্য কখনো কোনো প্রশংসা না পেলেও, ওই সব ছবির খ্যাতি আমার আছেই– ওদের জন্য একদিন না একদিন বাহবা আমি পাবই। ওরাই। ওরাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে–আজকে না হলে আগামীকালে মানুষের দুঃস্বপ্নের মধ্যে অন্ততঃ–এ বিশ্বাস আমার অটল।

অবশেষে সর্বমত্যন্তম-এর পরে ড্যাশের জায়গায় শুধু গর্হিতম কথাটি বসিয়ে রচনা মেষ করে, আমার গল্পের সেই চিত্ররূপ নিয়ে নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রেডিয়ো স্টেশনের দিকে দৌড়ালাম।

ভেবে দেখলে সমস্ত ব্যাপারটাই গর্হিত ছাড়া কি? আগাগোড়া ভাল করে ভেবে দেখা যায় যদি, আমার পক্ষে রেডিয়োর গল্প পড়তে পাওয়া, এবং যে দক্ষিণায় গল্প বেচে থাকি, সেই গল্প পড়তে গিয়ে তার তিনগুণ দাক্ষিণ্যলাভের সুযোগ পাওয়া দস্তুরমত গহিত বলেই মনে হতে থাকে! এবং যে গল্প আমি চিত্রাকারে, মিকি মাউসের সৃষ্টি কর্তাকে লজ্জা দিয়ে, পৃষ্ঠায় পর পৃষ্ঠা ধরে কেঁদেছি তার দিকে তাকালে–না, না এর সমস্তটাই অত্যন্তম–অতিশয় অত্যন্তম–এবং কেবল অত্যন্তম–এবং কেবল অত্যন্তম নয়, অত্যন্তম গর্হিতম!

তারপর? তারপর সেই গল্প নিয়ে হন্যে হয়ে যাবার মুখে আমার দু-নম্বর বরাত এসে দেখা দিল। অ্যামবুলেন্সে চাপা পড়লাম।

হাসপাতালে গিয়েও, হাত পা ব্যয় না করে, নিজে বাজে খরচ না হয়ে, অটুট অবস্থায় বেরিয়ে আসাটা তিন নম্বর বরাত বলতে হয়। কিন্তু সশরীরে সর্বাঙ্গীণরূপে লোকালয়ে ফিরে এসে ভাগ্যের ত্র্যহস্পর্শেয়র কথাটা যে ঘটা করে যাকে তাকে বলবো, বলে একটু আরাম পাবো তার যো কি! যার দেখা পাই, যাকেই বলতে যাই কথাটা, আমারি সুত্রপাতের আগের সে মুক্তকন্ট হয়ে ওঠে।

চমৎকার! খাসা! কী গল্পই না পড়লে সেদিন! যেমন লেখায় তেমনি পড়ায়-লেখাপড়ায় যে তুমি এমন ওস্তাদ তার পরিচয় তো ইস্কুলে কোনোদিন দাওনি হে! সব্যসাচি যদি কাউকে বলতে হয় তো সে তোমায়! আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছ, মাইরি!

আমি কম অবাক হইনি। প্রতিবাদ করতে যাব, কিন্তু হাঁ করবার আগেই আরেকজন হাঁ হাঁ করে এসে পড়েছে :

তোমার গল্প অনেক পড়েছি! ঠিক পড়িনি বটে, তবে শুনতে হয়েছে। বাড়ির ছেলেমেয়েরাই গাড়ে পড়ে শুনিয়ে দিয়েছে। শোনাতে তারা ছাড়ে না–তা সে শোনাও পড়াই মতই! কিন্তু যা পড়া সেদিন তুমি পড়লে তার কাছে সে সব কিছু লাগে না। আমার ছেলেমেয়েদের পড়াও না। হ্যাঁ, সে পড়া বটে একখান! আহা, এখনো এই কানে–এইখানে লেগে রয়েছে হে!

তাঁর মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন আরেকজন! গল্প শুনে তো হেসে আর বাঁচিনে ভায়! আশ্চর্য গল্পই পড়লে বটে! বাড়ি সুদ্ধ সবাই আমার দুধের ছেলেটা পর্যন্ত উত্তর্ণ হয়েছিল, কখন তুমি গল্প পড়বে! আর যখন তুমি আরম্ভ করলে সেই শুকুরবার না কোনবারে–বিকেরের দিকেই না?–আমরা তো শুনবামাত্র ধরতে পেরেছি–এমন টক-মিষ্ট-ঝাল-ঝাল-নোনতা গলা আর কার হবে? আমার কোলের মেয়েটা পর্যন্ত ধরতে পেরেছে যে আমাদের রামদার গলা!

রামদা-টা গলা থেকে তুলতে না তুলতেই অপর এক ব্যক্তির কাছে শুনতে হলো : বাহাদুর, বাহাদুর! তুমি বাহাদুর! রেডিয়োর গল্প পড়ার চানস পাওয়া সহজ নয়, কোন ফিকিরে কি করে জোগাড় করলে তুমিই জানো! তারপরে সেই গল্প মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রগরানো–সে কি চাটটিখানি? আমার তো ভাবতেই পা কাঁপে, মাথা ঘুরতে থাকে! কি করে পারলে বলো তো? আর পারে বলে পারা–অমন নিখুঁত ভাবে পারা–যা একমাত্র কেবল হাঁসেরাই পারে। আবার বলি, তুমি বাহাদুর!! তারাই আমায় তাক লাগিয়ে দিল। রেডিয়োর স্বর্গে যাবার পথে উপসর্গে আটকে অ্যাম্বুলেন্স চেপে আধুনিক পাতালে যাওয়ার অমন গালভরা খবরটা ফাঁস করার আর ফাঁক পেলাম না।

একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা

বিশ্বেশ্বরবাবু সবেমাত্র সকালের কাগজ খুলে বিশ্বের ব্যাপারে মনযোগ দেবার চেষ্টা পাচ্ছেন, এমন সময়ে বিশ্বেশ্বর–গৃহিণী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। ওগো সর্বনাশ হয়েছে–!

বিশ্বজগৎ থেকে তার বিনীত দৃষ্টিকে অপসারিত করেন বিশ্বেশ্বরবাবু। চোখ তুলে তাকান গৃহিণীর দিকে।

ওগো আমার কি সর্বনাশ হলো গো। আমি কি করবো গো!

বিশ্বেশ্বরবাবুকে বিচলিত হতে হয়। কি–হয়েছে কি?

চুরি গেছে। আমার সমস্ত গয়না। একখানাও রাখেনি গো–

বিশ্বেশ্বরবাবুর বিশ্বাস হয় না প্রথমে। ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করেন তিনি। অবশেষে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন–ও! গয়না চুরি! তাই বলো! আমি ভেবেছি না জানি কি! বিশ্বেশ্বরবাবু যোগ করেন। তার য়্যানাটমিতে ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না।

আমার অত গয়না! একখানাও রাখেনি গো!

একখানাও রাখেনি নাকি? বিশ্বেশ্বরবাবু বাঁকা ঠোঁটে ঈষৎ হাসির আভাস যেন উঁকি মারে।– তা হলে ভাবনার কথা তো।

বিশ্বেশ্বরবাবুর ভাবভঙ্গি গৃহিণীকে অবাক করে, কিন্তু অবাক হয়ে থাকলে শোক প্রকাশের এমন সুযোগ হারাতে হয়। এহেন মাহেন্দ্র যোগ জীবনে কটা আসে?

ভাবনার কথা কি গো! আমার যে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কে আমাদের এমন সর্বনাশ করে গেল গো–তারস্বর ছাড়তে উদ্যত হন তিনি।

যাক, যেতে দাও। যা গেছে তার জন্য আর দুঃখ করে কি হবে?–হাসি মুখেই বলেন বিশ্বেশ্বরবাবু–গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য্য।

এহেন বিপর্যয়ের মধ্যেও হাসতে পারছেন বিশ্বেশ্বরবাবু? সর্বস্তান্ত হয়ে দুঃখের ধাক্কায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? না, গিন্নীকে সান্ত্বনা দিতেই তার এই হাসিখুশির ভান? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না, না পেরে আরো তিনি বিগড়ে যান–তুমি বলছ কি গো! হায় হায় আমার কি সর্বনাশ হল গো! বাজখাই গলা বার করেন গৃহিণী।

আরে থামো থামো, করছ কি। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু সত্যিই বিচলিত হন–চেপে যাও, পাড়াব লোক জানতে পারবে যে!

বয়েই গেল আমার!–গিন্নী খাপ্পা হয়ে ওঠেন–আমার এত টাকার গয়না গেল আর পাড়ার লোক জানতে পারবে না। কোনদিন গা সাজিয়ে পরতে পেলুম না, দেখাতেও পেলুম না হিংসুটেদের। জানুক না মুখপোড়ারা–মুখপুড়িরা।

উঁহুহু, তুমি বুঝছ না গিন্নী! বিশ্বেশ্বরবাবু মুখখানা প্যাচার মতো করে আনেন–চুরির খবর পেলে পুলিস এসে পড়বে যে!

পুলিস? পুলিসের কথায় গিন্নীর ভয় হয়।

আর পুলিস এলই বাড়িঘর সব খানাতল্লাসী হবে! আষাঢ়ের ঘন মেঘে বিশ্বেশ্বরবাবুর হাঁড়িপানা-মুখে ভারী হয়ে আসে। সে এক হাঙ্গামা।

এবার ভড়কে যান গিনী।–কেন, চুরি গেলেই পুলিস খবর দেয় এই তো জানি। চোরেই তো পুলিসের কিনারা করে। পরমুহূর্তেই ভুল শুধরে নেন–উঁহু! পুলিসেই তো চুরির কিনারা করে, চোরকেও পাকড়ায়!

সে হাতেনাতে ধরতে পারলেই পাকড়ায়–বিশ্বেশ্বর গোঁফে মোচড় দেয়, তা না হলে আর পাকড়াতে হয় না।

হ্যাঁ হয় না;–গিন্নী মাতা নাড়েন, তুমি বললেই আর কি?

তা তেমন পীড়াপীড়ি করলে নিয়ে যায় পাকড়ে। একটাকে নিয়ে গেলেই হলো! এখানে চোরকে হাতে না পেয়ে আমাকেই ধরে কিনা কে জানে!

তোমাকে কেন ধরতে যাবে? গিন্নীর বিস্ময় হয়।

সব পারে ওরা। হাঁস আর পুলিস, ওদের পারতে কতক্ষণ? বিশ্বেশ্বরবাবু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন, তবে তফাত এই, হাঁস পাড়ে হাঁসের ডিম। আর ওরা পাড়ে ঘোড়ার ডিম। ঘোড়ার ডিমের আবার মাললেটও হয় না, একেবারে অখাদ্য। তাঁর মুখ বিকৃত হয়।

তোমাকে কক্ষনো ধরবে না।–গিন্নী সজোরে বলেন।

না ধরবে না আবার। আমাকেই তো ধরবে। বিশ্বেশ্বরবাবুর দৃঢ় বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয় । আর ধরলেই আমি স্বীকার করে ফেলব। তা বলে রাখছি কিন্তু। করাবেই ওরা আমাকে স্বীকার। স্বীকার করানোই হলো কাজ, তাহলেই ওদের চুরির কিনারা হয়ে গেল কিনা।

চুরি না করেও তুমি স্বীকার করবে চুরি করেছ?

করবই তো! পড়ে পড়ে মার খেতে যাব নাকি? সকলেই স্বীকার করে। করাটাই দস্তুর। আর নাও যদি মারে, হাজত বলে এমন একটা বিশ্রী জায়গায় আটকে রাখে শুনেছি সেখানে ভারী আরশোলা, আর নেংটি ইঁদর। আরশোলা আমার দুচক্ষের বিষ, আর নেংটি ইঁদুর? বাবাঃ, সে বাঘের চেয়েও ভয়ানক! অমন অবস্থায় পড়লে সকলকেই স্বীকার করতে হয়।

যদি তেমন তেমন দেখ না হয় স্বীকার করেই ফেল। তাহলেই ছেড়ে দেবে তো?

হ্যাঁ, দেবে। একেবারে জেলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে।

তবে কাজ নেই তোমার স্বীকার করে।–গিন্নী এবার শান্ত হন, গয়না আমি চাই না।

হ্যাঁ, সেই কথাই বল! আমি বেঁচে থাকতে তোমার ভাবনা কি? আবার গয়না গড়িয়ে দেব না হয়।

হ্যাঁ, দিয়েছ! সেবার বালিগঞ্জের জমিটা বিক্রী করেই তো হলো!

এবার না হয় টালিগঞ্জের বাড়িটাই বেচে ফেলব।

এতক্ষণে গিন্নীর মুখে হাসি দেখা দেয়–জমিটা বেচে পাঁচ হাজার টাকার গয়না হয়েছিল। পুরানো বাড়ির আর কত দাম হবে?

যতই কম হোক, বিশ হাজারের কম তো না। আমি ব্যঙ্কে টাকা জমানোর চেয়ে গয়না গড়িয়ে রাখতেই বেশি ভালবাসি। তুমি তো জানো! মাটিতে পুঁতে রাখার চেয়েও ভাল।–একটু দম নেন–হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জলে ফেলে দেওয়ার চেয়েও।

কিন্তু এত টাকার গয়না! পুলিসে খবর না দাও, নিজে থেকেও একটু খোঁজ করলে হতো না! হয়তো পাওয়া যেত একটু চেষ্টা করলে।

হ্যাঁ, ও আবার পাওয়া যায়। তা আর ফেরে না। ও আমি অনেকবার দেখেছি। কেবল খোঁজাখুঁজিই সার হবে! বিশ্বেশরবাবু বুড়ো আঙুল নাড়েন।

তবু–গিন্নীর তথাপি খুঁত-থুতুনি যায় না।

খুঁজব কি, কে নিতে পারে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না। বিশ্বেশ্বরবাবু কপাল কোচকান, কার যে এই কাজ?

কার আবার! কার্তিকের! তা বুঝতেও তোমার এত দেরি হচ্ছে। যে চাকর টেরি কাটে, সে চোর হয়ে যায় না।

কার্তিক? এতদিন থেকে আছে, অমন বিশ্বাসী? সে চুরি করবে তা কি হয় কখন?

সে করবে না তো কি আমি করেছি? গিন্নী এবার ক্ষেপে যান।

তুমি?–বিশ্বেশরবাবু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকান–তোমার নিজের জিনিস নিজে চুরি করবে? আমার বিশ্বাস হয় না।–

তাহলে কি তুমি করেছ?

আমি? অসম্ভব। বিশ্বেশ্বরবাবু প্রবলভাবে ঘাড় নাড়েন।

তুমি করোনি, আমিও করিনি, কার্তিকও করেনি–তাহলে কে করতে গেল? বাড়িতে তো এই তিনটি প্রাণী! গৃহিণী অন্তরের বিরক্তি প্রকাশ করেই ফেলেন।

তাই তো ভাবনায় বিষয়। বিশ্বেশ্বরবাবু মাথা ঘামাবার প্রয়াস পান,এইখানেই গুরুতর রহস্য! গোয়েন্দার মতো গোলমেলে হয়ে ওঠে তার মুখ।

তোমার রহস্য নিয়ে তুমি থাকো, আমি চললুম। গয়না গেছে বলে পেট তো মানবে না, চলে যেতে যেতে বলে যান গিন্নী, তুমি টালিগঞ্জের বাড়িটার বিহিত কর এদিকে, তাছাড়া আর কি হবে তোমাকে দিয়ে! গয়নার কি গতি করতে পারি, আমি নিজেই দেখছি।

কার্তিককে কিছু বোল না যেন। প্রমান নেই, বৃথা সন্দেহ করলে বেচারা আঘাত পাবে মনে।–কর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

কি করতে হয় না হয় সে আমি বুঝব।

আর পাড়ায় কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। বিশ্বেশ্বরবাবু ঈষৎ ব্যস্তই হন–চুরি যাওয়া একটা কেলেঙ্কারীই তো?

অত টাকার গয়না, একদিন গা সাজিয়ে পরতেও পেলুম না। তোমার জন্যেই তো। কেবলই বলেছ, গয়না কি পরবার জন্যে। ও-সব বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! এখন হল তো, সব নিয়ে গেল চোরে? গিন্নীর কেবল কাঁদতে বাকী থাকে।

সে তো তোমার ভালই জন্যেই বলেছি। পাড়ার লোকের চোখ টাটাবে। তোমার হিংসে করবে–সেটা কি ভাল?

বেশ, তবে এবার ওদের কান টাটাক। আমি গলা ফাটিয়ে ডাক ছেড়ে বলব যে, আমায় অ্যাতো টাকার গয়না ছিল। বলবই তো!

উঁহুহু। তাহলেই পুলিসে জানবে। চুরির কিনারা হবে, ভারী হাঙ্গামা। ও নিয়ে উচ্চবাচ্যও কোরো না। আমি আজ বিকেলেই বরং টালিগঞ্জে যাচ্ছি।

গিন্নী চলে গেলে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়েন বিশ্বেশ্বরবাবু। নিজের গৃহের সমস্যা থেকে একেবারে স্পেনের গৃহ সমস্যায়। বিশ্ব ব্যাপারে ওতঃপ্রোত হয়ে কতক্ষণ কাটে বলা যায় না, হটাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়া ওঁকে সচকিত করে। নিচে নেমে যেতেই পাড়ার সবাই ওঁকে হেঁকে ধরে।

কোথায় গেল সেই বদমাইশটা? তাকেই জিজ্ঞাসা করে সবাই।

কে গেল কোথায়? বিশ্বেশ্ববাবু বিচলিতই হন।

সেই গুণধর আপনার চাকর? কার্তিক? চুরি করে পালিয়েছে বুঝি?

পালিয়েছে? কই তা জানি না! কার চুরি করল আবার?

আপনাকেই তো পথে বসিয়ে গেছে আর অপনিই জানেন না? আশ্চর্য!

আমাকে? পথে বসিয়ে? বিশ্বেশ্বরবাবু আরো আশ্চর্য হন, আমি তো এতক্ষণ ওপরেই বসেছিলাম।

দেখুন বিশ্বেশ্বরবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাবেন না। আপনার ও চারটি কম নয়। আমরা তখন থেকেই জানি। যে চাকর টেরি কাটে, সে চোর ছাড়া আর কি হবে? আমরা সবাই জানতে পেরেছি, আপনার গিন্নীর থেকে আমাদের গিন্নী, আমাদের গিন্নীদের থেকে আমরা।

হ্যাঁ, কিছুই জানতে বাকি নেই। জনতার ভেতর থেকে একজন বেশি উৎসাহ দেখায় এখন কোথায় গেল সেই হতভাগা! পিটিয়ে লাশ করব তাকে। সেই জন্যই আমরা এসেছি।

দেখুন, সমস্তই যখন জেনেছেন তখন আর লুকোতে চাই না।–বিশ্বেশ্বরবাবু বলেন–কিন্তু একটা কথা। মেরে কি লাভ হবে? মারলে অন্য অনেক কিছু বেরুতে পারে, কিন্তু গয়না কি বেরুবে?

আলবৎ বেরুবে।–তাদের মধ্যে দারুণ মতের ঐক্য দেখা যায়, বার করে তবে ছাড়বো। বেরুতেই হবে।

বিশ্বেশ্বরবাবু দেখেন, এরা সব বাল্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত এ যাবকাল বাবার কাছে, মাস্টারের কাছে, স্কুলে আর পাঠশালায়, খেলার মাঠে আর সিনেমা দেখতে গিয়ে সার্জেন্টের আর গুণ্ডার হাতে যেসব ঠেঙান, ঠোক্কর আর তো খেয়ে এসেছে আজ সুদে আসলে নিতান্তই ধরা পড়ে যাওয়া কার্তিককেই তার সমস্ত শোধ দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। বেওয়ারিশ মাথায় চাদা করে চাটাবার এমন অধোদয়যোগে সহজে এরা হাতছাড়া করবে না। তবু তিনি একবার শেষ চেষ্টা করেন একটা কথা ভাবার আছে। শাস্ত্রে বলে ক্ষমা হি পরমো ধর্মঃ। মার্জনা করে দেওয়াই কি ভাল নয় ওকে?

আপনার চুরি গেছে আপনি ক্ষমা করতে পারেন। আপনার চাকর আপনি তো মার্জনা করবেনই। কিন্তু আমরা পাড়ার পাঁচজন তা করতে পারি না।

কি মুশকিল, কি মুশকিল! তাহলে এক কাজ করুণ আপনারা। অর্ধেক লোক যান হাওড়ায়, অর্ধের শেয়ালদায়। এই দুটো পথের একট পথেই সে উধা হয়েছে এতক্ষণ।

পাড়ার লোকেরা হতাশ হয়ে চলে যায়। পলায়মান চোরের পশ্চাদ্ধাবনের উৎসাহ প্রায় কারোরই হয় না। বিশেশ্বরবাবুর আবার কাগজের মধ্যে ফিরে আসেন। এমনই সময়ে টেরি সমন্বিত কার্তিকের আবির্ভাব।

কি রে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? বিশ্বেশ্বরবাবু খবরের কাগজ থেকে চোখ তোলেন। সকাল থেকে তো দেখতে পাইছি। ওঁর কণ্ঠে সহানুভূতির সুর।

আত্মীয়র বাড়ি গেছলাম–আমতা আমতা করে কার্তিক। কিন্তু একটু পরেই ফোঁস করে ওঠে–গেছলাম এক স্যাকরার দোকানে।

বিশ্বেশ্বরবাবু যেন ঘাবড়ে যান–আহা, কোথায় গেছলি আমি জানতে চেয়েছি কি! যাবি বই কি, একটু বেড়াতে টেড়াতে না গেলে হয়। বয়স হয়েছে আর পেরে উঠি না তাই, নইলে আমিও এককালে প্রাতঃভ্রমণ করতাম! রেগুলারলি।

গিন্নীমা আমার নামে যা–নয়–তাই বদনাম দিয়েছেন। পাড়ায় কান পাতা যাচ্ছে না–চাপা রাগে ফেটে পড়তে চায় কার্তিক।

বাধা দেন বিশ্বশ্বরবাবু–ওর কথা আবার ধরে নাকি! মাথার ঠিক নেই ওর। তুই কিছু মনে করিসনে বাপু।

আমি কিনা–আমি কিনা–কার্তিক ফুলে ফুলে ওঠে। অকথ্য উচ্চারণ ওর মুখ দিয়ে বেরুতে চায় না।

আহা কে বলছে! বিশ্বেশ্বরবাবু সান্ত্বনা দেন, আমি কি বলেছি সে কথা? বলিনি তো? তা হলেই হল।

পাড়ার পাঁচজনের নাকি আমায় পুলিশে দেবে। দিক না–দিয়েই দেখুক না মজাটা

হ্যাঁ, পুলিশে দেবে! দিলেই হল!–বিশ্বেশ্বরবাবু সাহস দেন–হ্যাঁ, দিলেই হল পুলিশে। কেন মিছে ভয় খাস বলতো। ওরা পুলিশে দেবার কে? আমি আছি কি জন্যে?

ভয় যার খাবার সেই খাবে। আমি কেন ভয় খেতে যাবো? কোনো দোষে দুষী নই আ আমারই যত বদনাম। আসুক না একবার পুলিশ। আমি নিজেই না হয় যাচ্ছি থানায়।

বিশ্বেশ্বরবাবু বেজায় দমে যান এবার–আরে, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কোথায় পুলিশ, কে কাকে দিচ্ছে তার ঠিক নেই, হাওয়ার সঙ্গে লড়াই। একটু থেকে ট্যাক থেকে একটা টাকা বের করেন–বদনাম দিয়েছে তার হয়েছে কি! গায়ে কি লেগে রয়েছে? এই নে, বকশিস নে–কিছু খা গিয়ে।

ঝনাৎ হতেই তৎক্ষণাৎ তুলে নেয় কার্তিক। একটু ঠাণ্ডা হয় এতক্ষণে।

কিন্তু একটা কথা বলি বাপু। যদি কিছু নিয়েই থাকিস, এখান থেকে সরিয়ে ফেল। একখানাও রাখিস নি যেন এখানে। পাড়ার লোক যখন খবর দেয়, পুলিশ যদি এসেই পড়ে, খানাতল্লাসী হতে কতক্ষণ? সদুপদেশ দিতে যান বিশ্বেশ্বরবাবু!

কী নিয়েছি, নিয়েছি কি? কার্তিক ক্ষেপে ওঠে।

আমি কি বলেছি কিছু নিয়েছিস? কিছু নিসনি। তবু যদি কিছু নিয়ে থাকিস বলে তোর সন্দেহ হয়।…আচ্ছা, এক কাজ কর না কেন কার্তিক? আমি তোকে গাড়ি ভাড়া এবং আরো কিছু টাকা দিচ্ছি, এখান থেকে পালিয়ে যা না কেন?

কেন পালাবো? আমি কি চুরি করেছি? তবে পালাব কেন? কার্তিক দপদপ করে জ্বলতে থাকে।

আহা, আমি কি পালাতে বলেছি? বলছি, দিনকতক কোথাও বেড়াতে যা না? এই হাওয়া খেতে, কি চেঞ্জে কোথাও শিলঙ কি দার্জিলিং, পুরী কিম্বা ওয়ালটোয়ারে? লোকে কি যায় না? চুরি না করলে কি যেতে নেই? দেশেও তো যাসনি অনেকদিন! আমি বলি কি–

কিন্তু তাঁর বলাবলির মধ্যে বাধা পড়ে। বিশ্বেশ্বরবাবু বাড়ি আছেন? বলতে বলতে কতকগুলি ভারী পায়ের শব্দ ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে, সটান তাঁর ঘরের মধ্যে এসে থামে। জনকতক পাহারাওলা নিয়ে স্বয়ং দারোগাবাবুকে দেখা যায়।

আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ। আপনি নাকি বাড়িতে চোর পুষেছেন?

বিশ্বেশ্বরবাবু আকাশ থেকে পড়েন, এসব মিথ্যে কথা কে লাগাচ্ছে বলুন তো? কার খেয়েদেয়ে কাজ নেই? ঘর-বাড়ি কি চোর পুষবার জন্যে হয়েছে? কেউ শুনেছে কখনো এমন কথা?

আপনার কি গয়নার বাকস চুরি যায়নি আজ? দারোগা জিজ্ঞাসা করেন।

বিশ্বেশ্বরবাবু ভারি মুশড়ে যান। চুপ করে থাকেন। কি আর বলবেন তিনি?

চুরির খবর থানায় রিপোর্ট করেন নি কেন তবে?- দারোগাবাবু হুমকি দেন।

গিন্নী বলছিলেন বটে চুরি গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। কার্তিকের দিকে ফেরেন এবার–এই, তুই এখানে কি করছিস? দাঁড়িয়ে কেন? বাড়ির ভেতরে যা। কাজ কর্ম নেই?

এই বুঝি আপনার সেই চাকর? কিরে ব্যাটা, তুই কিছু জানিস চুরির?

জানি বইকি হুজুর, সবই জানি। চুরি গেছে তাও জানি কি চুরি গেছে তাও জানি–কার্তিক বলতে থাকে।

বিশ্বেশ্বরবাবু বাধা দেন–দারোগাবাবু, অ্যাকে ছেলেমানুষ তার ওপর ওর মাথা খারাপ। চারক হয়ে টেড়ি কাটে, দেখছেন না? কি বলতে কি বলে ফেলবে, ওর কথায় কান দেবেন না। বহুদিন থেকে আছে, ভারী বিশ্বাসী, ওর ওপর সন্দেহ হয় না আমার।

বহুদিনের বিশ্বস্ততা একদিনেই উবে যায, লোভ এমনই জিনিস মশাই!–দারোগাবাবু, বলেন, আকচারই দেখছি এরকম। কার্তিকের প্রতি জেরা চলে–এ চুরি-কার কাজ বলে তোর মনে হয়?

আর কারো কাজ নয় হুজুর, আমারি কাজ।

কেন করতে গেলি এ কাজ?

ঐ তো আপনিই বলে দিয়েছেন হুজুর। লোভের বশে! কার্তিক প্রকাশ করে, তা শিক্ষাও আমার হয়েছে তেমনি। সবই বলব আমি, কিছুই লুকবো না হুজুরের কাছে।

যা যাঃ! আর তোকে সব বলতে হবে না! বিশ্বেশ্বরবাবু দুজনের মাঝে পড়েন, ভারি বক্তা হয়েছেন আমার! অমন করলে খালাস করাই শক্ত হবে তোকে। দারোগাবাবু, ওর কথায় কান দেবেন না আপনি।

দারোগাবাবু বিশ্বেশ্বরের কথায় কান দেন না–কোথায় সে সব গয়না? কার্তিককেই জিজ্ঞাসা করেন।

কোথায় আবার? আমারই বিছানার তলায়! বিরক্তির সঙ্গে বিস্তারিত করে কার্তিক।

ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে নাড়াচাড়া শুরু করতেই কার্তিকের লাখটাকার স্বপ্ন বেরিয়ে পড়ে। নেকলেস, ব্রেসলেট, টায়রা, হার, বালা, তাগা, চুড়ি, অনন্ত–সব কিছুরই অন্ত মেলে। দড়ি দিয়ে বাধা হয় কার্তিককে। সে কিন্তু বেপরোয়া। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু নিজেই ওকালতি শুরু করেন ওর তরফে–-দেখুন দারোগাবাবু! নেহাত ছেলেমানুষ, লোভের বশে একটা অন্যায় করেই ফেলেছে। ছেলেবেলা থেকে আছে, প্রায় ছেলের মতই, আমার কোন রাগ হয় না ওর ওপর। এই ওর প্রথম অপরাধ, প্রথম যৌবনে এবারটা ওকে রেহাই দিন আপনি। সুযোগ পেলে শুধরে যাবে, সকলেই অমন শুধরে যায়। যে অভিজ্ঞতা আজ ওর লাভ হলো তাই ওর পক্ষে যথেষ্ট। অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ বড় হয় জীবনে। এই থেকে ও কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, কলকাতার মেয়রও হতে পারে একদিন–হবে না যে তা কে বলবে? আর যদি নিতান্তই রেহাই না দেবেন, তবে দিন ওকে গুরুতর শাস্তি। আমি তাই চাই আপনার কাছে। চুরির চেয়েও গুরুতর। ও কি চোর? ও চোরের অধম। ও একটা গুণ্ডা! দেখছেন না কি রকম টেরি? ওকে আপনাদের গুণ্ডায়্যাক্টে একসটার্ন করে দিন–ঘাড় ধরে বার করে দিন এ দেশ থেকে। যাবজ্জীবন নির্বাসন। আমি ওকে এক বছরের বেতন আর গাড়িভাড়া আগাম গুণে দিচ্ছি, ও এক্ষুণি কেটে পড়ক, ছাপরা কি আরা জিলায়–যেখানে খুশি চলে যাক। গয়না তো সব পাওয়া গেছে, কেবল সাধু হবার, নতুন করে জীবন আরম্ভ করবার একটা সুযোগ দিন ওকে আপনি।

বিশ্বেশ্বরবাবুর বক্তৃতায় দারোগার মন টলে! কেবল বক্তৃতাই নয়, সেইসঙ্গে বক্তার দুই নয়নের দর বিগলিত ধারায় দারোগাবাবু বিমুগ্ধ, ব্যথিত, ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি শিকার ফেলে চিত্তবিকার নিয়ে চলে যান।

পুলিশের কবল থেকে অব্যাহতি পেয়েও একটুও কাহিল হয় না কার্তিক। তার সঙ্গে যেন ভয়ানক অদ্ৰতা করা হয়েছে, ভয়ানক রকম ঠকানো হয়েছে তাকে, এহেন ধারণার বশে একটা জিঘাংসার ভাব তার প্রত্যেকটি আচরণ- বিচরণ থেকে প্রকাশ পেতে থাকে।

অবশেষে চিরবিদায়ের আগের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। কর্তা অনেক আদর আপ্যায়নে, অযথা বাক্য বিস্তারে, অযাচিত বখশিসের প্রাচুর্য দিয়ে ওর যাবজ্জীবন নির্বাসনের দুঃখ ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু ও কি ভোলে? ওর ব্যথা কি ভোলবার? ওই জানে!

তোমার আদরেই তো সর্বনাশ হয়েছে ওর! মানুষ এমন নেমকহারাম হয়! গিন্নী নিজের অসন্তোষ চাপতে পারেন না–যথেষ্ট মাথা খেয়েছে, আর কেন? বরং, দড়ি-কলসী কিনে ডুবে মরতে বলল ওকে!

নিতে যাবার আগে শেষবারের মতন উসকে ওঠে কার্তিক। দড়ির ভাবনা নেই, কর্তার পুজোয় দেওয়া ছেঁড়া সিল্কের জামাটা পাকিয়েই দড়ি বানিয়ে নেব, কিন্তু কলসী আর হলো কোথায়? বড় দেখেই কলসী গড়াতেই চেয়েছিলাম মাঠাকরুণ, কিন্তু গড়তে আর দিলেন কই? হ্যাঁ, বেশ ভাল একটা পেতলের কলসী হত– বলে একটু থেকে সে উপসংহার করে আপনার গয়নাগুলি গালিয়েই!

কল্কেকাশির অবাক কাণ্ড

আপনার একটু অবিমৃষ্যকারিতা হয়েছে, বললাম অমি হর্ষবর্ধনকে : মানে ঐভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। ঐ লোকটা আসলে এক ডিটেকভিট। আপনার টাকাকড়ির খোঁজ খবর নিতেই এসেছিলো।

তাতে ওর লাভ? ওকে কি আমার টাকাকড়ির ভাগ দিতে হবে নাকি?

গভর্নমেন্ট থেকে ওকে লাগিয়ে থাকবে হয়তো। ইনকমট্যাকস-এর তরফ থেকেও হতে পারে! মুনাফাবাজদের পাকড়াবার চেষ্টা হচ্ছে না আজকাল? আপনি আবার ফলাও করে নিজের মুনাফার কথা জাহির করলেন ওর কাছে, এক কথায়, Moon offer করলেন, চাঁদ তুলে দিলেন ওর হাতে।

কিন্তু আপনি এটাকে দাদার অবিমিশকারিতা বলছেন কেন বলুন তো? তস্য ভ্রাতা গোবর্ধন বসে ছিল পাশেই, খট করে বলে বসলো।

ও-কথা তো বলিনি! বলেছি অবিমৃষ্যকারিতা। আমি ওকে শুধরে দিতে চাই।

একই কথা। কিন্তু ওর মানেটা কি, তাই আমি জানতে চাইছি।

মানেটা যে কি, তা আমিও ঠিক জানিনে ভাই! অভিধানে আছে। তবে মনে হচ্ছে তোমার কথাটাতেও ওর মানে পাওয়া যায়। কি মেশাতে গিয়ে কি মেশানো-এ কথার সঙ্গে সে-কথা মিশিয়ে গুলিয়ে গিয়ে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলা আর কি!

গোয়েন্দা যে লোকটা তা আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করলেন হর্ষবর্ধন।

চিনি যে ওকে। কল্কেকাশি ওঁর নাম, নামজাদা গোয়েন্দা উনি। অনেকদিন আগে ওঁল সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল আমার কোন এক সূত্রে। উনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি।

ডিটেকটিভ কল্কেকাশি? গোবরা জিজ্ঞেস করে। হুঁকোকাশি তো জানি, মনোরঞ্জন ভট্টচার্যের ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছিলাম! ডিটেকটিভ হুঁকোকাশি।

তস্য ভ্রাতা হবেন হয়তো বা! জানিনে ঠিক। হুঁকোকাশির ভাই কল্কেকাশি হওয়া বিচিত্র নয়। আমি জানাই।

আমাদের কাছে ওঁকে কন্ধে পেতে হবে না। বললেন হর্ষবর্ধন।

আমাদের ল্যাজে পা দিতে এলে ওঁর কাশী-প্রীপ্তি ঘটিয়ে দেবো আমরা! এখানে আর কল্কে পেতে হবে না।

গোবর্ধন সায় দেয় দাদার কথায়।

হয়েছিল কি, ডিটেকটিভ কল্কেকাশি নিরীহ ভদ্রলোকের মতই এসেছিলেন হর্ষবর্ধনের কাছে এমনি আলাপ করতে। কথায় কথায় তিনি বললেন–আপনাদের ব্যবসায় আর এমন কি লাভ হয় মশাই! সামান্য কাঠের কারবার তো আপনার।

হর্ষবর্ধনের পেটের খবর টেনে বের করার জন্যেই যে কথাটা পাড়া ওঁর, পাড়তেই আমি তা টের পাই।

সামান্য! কথাটায় ওঁর অহমিকায় লাগল। গর্বে তিনি ফেটে পড়লেন তক্ষুনি, বড়াই করে বললেন–বলেন কি মশাই! আমাদের কারবারে পারসেন্ট মুনাফা, আঁচ করতে পারেন তার? চার টাকার কাঠের থেকে আমরা চারশো টাকা লাভ করি তা জানেন? হিসেব করে বলুন তো কত পারসেন্ট লাভ দাঁড়ায় তাহলে?

শুনে তো আমি থ হয়ে যাই, মানসাঙ্ক করেও ওর পারসেন্টেজের কোনো থই পাইনে।

কিরকম, কিরকম? নির্দোষ কৌতূহল দেখা যায় কষ্কেকাশির। হর্ষবর্ধনের হাঁড়ির খবর জানার মতলব তাঁর, আমি বুঝতে পারি বেশ।

কিন্তু আমি ওঁকে সামলাবার আগেই উনি নিজের হাঁড়ি নিজেই হাটে ভেঙে বসেছেন!

কি রকম শুনবেন? শুনুন তাহলে। ছোটনাগপুরের জঙ্গল আমরা ইজারা নিই। জঙ্গলকে জঙ্গল। ওইসব জঙ্গল বরাবর চলে গেছে মধ্যপ্রদেশের সেই দণ্ডকারণ্য অব্দি। অফুরন্ত জঙ্গল সীমা পরিসীমা নেই। এনতার গাছ। সেই সব গাছ কেটে তার ডালপালা হেঁটে কলকাতায় আমদানি করি আমরা। এখানে আমাদের কারখানায় সেইসব ইলাহি কাঠ করাত দিয়ে চিরে তক্তা বানানো হয়–সেই তক্তা আমরা বেচি। বেচি লাভ হয় আমাদের।

কেমনধারা লাভ? কল্কেকাশির ঔৎসুক্য।

তার কি ইয়ত্তা আছে নাকি? জঙ্গলকে জঙ্গল ইজারা নিই, বলো না? নীলাম ডেকে ইজারা নেয়া হয়। গাছ প্রতি আমাদের পরতা পড়ে চার টাকা মতন, সেই চার টাকার গাছের তক্তা বেচে পাই

অন্তত চার শো টাকা। তারপর… বলে তিনি একটু থামেন, দম নিতেই বোধ করি।

তারপর? কল্কেকাশি উসকে দেন ওঁকে নতুন উদ্যম দেবার জন্যেই বোধ হয়।

দম পেয়ে তিনি শুরু করেন আবার–তারপর ঐ সব তক্তার থেকে যদি আমরা আলনা, আলমারি, দেরাজ, ডেসক, টেবিল, চেয়ার, খাট, পালঙ্ক ইত্যাদি নানান আসবাব পত্তর বানিয়ে বেচি, তাহলে গোড়াকার সেই চার টাকার মুনাফাই হয়ে দাঁড়াবে চার হাজার টাকা। বুঝলেন এবার?

না না, এর মধ্যে শ্রমের প্রশ্নও রয়েছে যে! লেবারটাও ধরতে হবে। এই সব বানাতে কারিগরদের মজুরি দিতে হয় না? তাদের চারজও তো চারগুণ এখন। মুনাফার সবটাই আপনার সেবায় নয় মশাই! দেবার দিকটাও রয়েছে আবার। ওঁর কথায় বিপক্ষে বলে ওঁর পক্ষ সমর্থনের প্রয়াস আমার।

তা আছে। মেনে নেন হর্ষবর্ধন ও তা আছে বইকি। সেটাও ধর্তব্য ঐ সঙ্গে। তবে তা ধরেও..।

বিস্তর মুনাফা হয়, তাই না? কল্কেকাশি ওঁকে দম দেন আবার।

তা তো হয়ই। না হয়ে কি আর যায় মশাই? যাবার যো কী!

অ্যাতো টাকা আপনি রাখেন কোথায়! আনাড়ির মতই জিজ্ঞাসা কষ্কেকাশির। একটু যেন বিস্ময়ের সুরেই।

টাকা কি আবার রাখা যায় নাকি? রাখতে পারে কখনো কেউ? আপনার থেকেই তো উড়ে যায় টাকা। টাকার যা দস্তুর।

কেমন করে যায় কে জানে! গোবরার সায় দেওয়া। আসতে না আসতে চলে যায়।

কি করেন অ্যাতো টাকা দিয়ে? তবুও শুধান উনি-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওঁর সেই এক কথাই।

বিলিয়ে দিই। কি আবার করবো? হর্ষবর্ধনের সরল জবাব–টাকা নিয়ে কি করে মানুষ?

বিলিয়ে দেন! অবাক হন কল্কেকাশি। তার বিশ্বাস হয় না বলাই বাহুল্য।

বিল মেটাতেই চলে যায় টাকা। বেতনের বিল, বোনাসের বিল। বলেন হর্ষবর্ধন ও আমার কারখানার মজুর-করিগরকে মাইনে দিতেই কী কম টাকাটা যায় মশাই? বেতন মিটিয়ে, বোনাস দিয়ে কী আর থাকে বলুন।

কতো আর দেন বোনাস! বড়জোর তিনমাসের?

তাতে দিই-ই সব কোম্পানিই তা দেয়। তবে তারা দেয় বছরে তিনমাসের, আর আমি দিই প্রতি মাসে।

তার মানে?

মানে, মাস মাস তিন মাসের বেতন বাড়তি দিয়ে যাই। না দিলে চলবে কেন ওদের? জিনিসপত্রের দাম কি তিনগুণ করে বেড়ে যায়নি বলুন।

বলেন কি মশাই অ্যাঁ? এবার কল্কেকাশি সত্যিসত্যিই হতবাক হন।

বলে, দাদার ঐ বোনাস পেয়ে পেয়ে আমাদের কারিগররা বোনাই পেয়ে গেল সবাই। গোবর্ধন জানায়।

বোনাই পেয়ে গেলো? সে আবার কি? কল্কেকাশি কথাটার কোনো মানে খুঁজে পান বা–বোনাস থেকে বোনাই!

পাবে না? ব্যাসিলাস-এর বেলা যেমন ব্যাসিলাই। ইংরিজি কি জানিনে নাকি একদম? বোনাস এর বহুবচনে কী হয়? জিনিয়াসের পুরালে যেমন জিনিয়াই, তেমনি বোনাস-এর পুরালে বোনাই-ই তো হবে। হবে?

গোবর্ধন আমার দিকে তাকায়।

ব্যাকরণ মতে তাই হওয়াই তো উচিত। বলি আমি।

বোনাস-এর ওপর বোনাস পেতে ওদের আইবুড়ো বোনদের বিয়ে হয়ে গেলো সব। আপনিই বর-রা এসে জুটে গেলো যতো না! বিনাপণেই বলতে কি! বউয়ের হাত দিয়ে সেই বোনাস-এর ভাগ বসাতেই বোনাইরা জুটে গেলো সব আপনার থেকেই।

এই কথা! কথাটা পরিষ্কার হওয়ায় কল্কেকাশি হাঁফ ছাড়লেন? তাহলেও বাড়ি টাকার অনেকখানিই মজুদ থেকে যায় সে সব টাকা রাখেন? ব্যাঙ্কে না বাড়তি?…তিল তিল করে জমলেও তো তাতাল হয়ে ওঠে একদিন আপনাদের সেই বিপুল ঐশ্বর্য…।

অরণ্যেই ওঁদের ঐশ্বর্য! কথাটা আমি ঘুরিয়ে দিতে চাই : ঐশ্বর্য কি আর ওঁদের বাড়িতে আছে? না,বাড়িতে থাকে? জমিয়ে রাখবার দরকারটাই বা কী? গোটা অরণ্যভূমিই তো ঐশ্বর্য ওঁদের। বনস্পতিরূপে জমানো। কাটা গাছই টাকার গাছ। বলে উদাহরণ দিয়ে কথাটা আরো পরিষ্কার করি–যেমন মড়া মড়া জপতে জপতেই রাম হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি কাটা উলটোলেই টাকা হয়ে যায় মশাই! মানে, কাটা গাছই উলটে টাকা দেয় কিনা! টাকার গাছ তখন।

বুঝেছি। বলে ঘাড় নেড়ে কল্কেকাশি চাড় দেখান-আবার আপনাদের বাড়ি সেই গৌহাটি না কোথায় যেন বললেন না? আসাম থেকেই তো আসা আপনাদের এখানে–তাই নয়? তা আসামের বেশির ভাগই তো অরুণ্য। তাই নয় কি? তাহলে বোধহয় সেই অরণ্যের কাছাকাছি কোথাও…মানে, আপনাদের বাড়ির কাছেই হয়তো কোনো গভীর জঙ্গলেই জমানো আছে, তাই না।

কল্কেকাশির কথায় হর্যবর্ধনের কোনো সাড়া পাওয়া যায় না আর। তিনি শুধু বলেন–হুম। বলেই কেমনধারা গুম হয়ে যান। কল্কেকাশির উদ্যম সত্বেও তার গম্ভীর্যের বাঁধ ভেঙে কথার স্রোত আর গড়াতে পারে না।

আচ্ছা, নমস্কার, আজ আমি আসি তাহলে। বলে উঠে পড়ে আপনার নাম শুনেছিলাম, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব আনন্দ হলো। নমস্কার।

লোকটার কথাবার্তা কেমনধারা যেন। কল্কেকাশি গেলে পর মুখ খুললেন হর্ষবর্ধন–আমাদের টাকাকড়ির খোঁজ খবর পেতে চায় লোকটা!

হ্যাঁ দাদা, কেমন যেন রহস্যময়। গোবরা বলে।

তখন আমি ভদ্রলোকের রহস্য ফাঁস করে দিই। জানাই যে, ঐ কল্কেকাশি কোনো কেউকেটা লোক নন, ধুরন্ধর এক গোয়েন্দা। সরকার এখন কালোবাজার এর টাকার সন্ধানে আছে কি না, কোথায় কে কতো কালো টাকা, কালো সেনা জমিয়ে রেখেছে….।

কালো সোনা তো আফিঙকেই বলে মশাই! সোনার দাম এখন আফিঙের সমান। দাদার টীকা আমার কথার ওপর। আমার কি আফিঙের চাষ নাকি?

আবার কেষ্টঠাকুরকেও কালোসোনা বলে থাকে কেউ কেউ! তস্য ভ্রাতার টিপপনি দাদার ওপরে। কালোমানিকও বলে আবার।

এখনকার দিনে কালো টাকা তো কেউ আর বার করে না বাজারে, সোনার বার বানিয়ে লুকিয়ে কোনো খানে মজুদ করে রাখে, বুঝেছেন? আমি বিশদ ব্যাখ্য করি তখন আপনারা কালো বাজারে, মানে, কাঠের কালো বাজার করে প্রচুর টাকা জমিয়েছেন, সরকার বাহাদুরের সন্দেহ। তাই তার আঁচ পাবার জন্যেই এই গোয়েন্দা প্রভুটিকে লাগিয়েছেন আপনার পেছনে।

তাহলে তো বেশ গনগনে আঁচ মশাই মানুষটার। গোবর্ধন বলে, না আঁচলে তো বিশ্বাস নেই…বাচন নেই আমাদের।

সর্বনাশ করেছেন দাদা। হর্ষবর্ধনের প্রায় কাঁদার উপক্রম, আপনি ওই লোকটাকে আসামের অরণ্য দেখিয়ে দিয়েছেন আবার।

এমন সময় টেবিলের ফোন ক্রিং ক্রিং করে উঠলো ওঁর। ফোন ধরলেন হর্ষবর্ধন হ্যালো। কে?…কে একজন ডাকছেন আপনাকে। রিসিভারটা উনি এগিয়ে দিলেন আমায়।

আমাকে? আমাকে কে ডাকতে যাবে এখানে? অবাক হয়ে আমি কর্ণপাত করলাম হ্যালো, আমি শিব্রাম….আপনি কে?

আমি কল্কেরাশি। কাছাকাছি এক ডাক্তারখানা থেকে ফোন করছি আপনাকে। ওখানে বসে থাকতে দেখেই আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। আপনি বোধহয় চিনতে পারেননি আমার…শুনুন, অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে। অনেকদিন পরে দেখা পেলুম আপনার। আজ রাত্রের ট্রেনে গৌহাটি যাচ্ছি, আসুন না আমার সঙ্গে। প্রকৃতির লীলাভূমি আসাম, আপনি লেখক মানুষ বেশ ভালো লাগবে আপনার। দু-পাঁচ দিন অরণ্যবিহার করে আসবেন এখন। চেঞ্জের কাজও হবে। কেমন, আসছেন তো?

অরণ্যবিহার? আমার সাড়া দিই :–আজ্ঞে না। আমাদের বাড়ি ঘাটশিলায়, তার চারধারেই জঙ্গল পাহাড়। প্রায়ই সেখানে যাই আমি সঠিক বললে, বিহারের বেশির ভাগই অরণ্য। খোদ বিহার-অরণ্যে বাস করি। আমাকে আবার গৌহাটি গিয়ে অরণ্য-বিহার করতে হবে কেন? অরণ্য দেখে দেখে অরুচি ধরে গেছে আমার। আর সত্যি বলতে, এক আধটু লিখিটিখি বটে, তবে কোনো প্রকৃতিরসিক আমি আদপেই নই।

ফোন রেখে দিয়ে হর্ষবর্ধনকে বললাম–ঐ ভদ্রলোক, মনে কল্কেকাশিই ফোন করেছিলেন এখন। আর রাত্রের ট্রেনেই উনি গৌহাটি যাচ্ছেন কিনা…

অ্যাঁ? গৌহাটি যাচ্ছেন। কী বললেন? অ্যাঁ? আতঙ্কিত হন হর্ষবর্ধন, সেরেছে তাহলে। এবার আমাদের সর্বনাশ রে গোবরা।

সর্বনাশ কিসের। বাঁচিয়ে দিয়েছি তো আপনাকে। এখানে আপনাদের বাড়িতে তল্লাশী করলে বিস্তর সোনা দানা পেয়ে যেতো, এখান থেকে কায়দা করে হটিয়ে দিলাম কেমন। এখন মরুক না গিয়ে আসামের জঙ্গলে। অরণ্যে অরণ্যে রোদন করে বেড়াক।

এখানে আমাদের বাড়ি তল্লাশী করে কিছুই পেতো না সে। বড়ো জোর লাখ খানেক কি দেড়েক আমাদের দৈনন্দিন দরকার মিটিয়ে মাস খরচার জন্য লাগে যেটা। আমরা কি এখানে জমাই নাকি মশাই? চোর-ডাকাতের ভয় নেইকো? সেদিনের কারখানার সেই চুরিটা হয়ে যাবার পর থেকে আমরা সাবধান হয়েছি। আমাদের কারবারের লাভের টাকা আর বাড়তি যা কিছু, সব আমরা সোনার বাট বানিয়ে গৌহাটি নিয়ে যাই-বাড়ির কাছাকাছি একটা জঙ্গলে গিয়ে এক চেনা গাছের তলায় পুঁতে রেখে আসি।

চেনা গাছ। অবাক লাগে আমার গাছ কি আবার কখনো চেনা যায় নাকি? একটা গাছের থেকে আরেকটাকে, এক গোরর থেকে অন্য গোরু, এক চীনেম্যানের থেকে আরেক চীনেম্যান কি আলাদা করে চিনতে পারে কেউ? গাছ যদি হারিয়ে যায়?

ঐ একটা বস্তু যা কখনো হারায় না, টাকাকড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় না কদাচ। হাত-পা নেই তো, একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়…

এই জন্যেই তো শুদ্ধভাষায় ওদের পাদপ বলেছে, তাই না দাদা? গোবরার সঠিক ভাষ্য বনে আগুন লাগলে দপ করে জ্বলে ওঠে বটে কিন্তু সেখান থেকে মোটেই পালাতে পারে না।

আমি তো মশাই চিনতে পারিনে, শাখা-প্রশাখা ডাল-পালা নিয়ে সব গাছই তো আমার চোখে এক চেহারা মনে হয়। ফুল ধরলে কি ফল ফললে তখন যা একটু টের পাই তাদের জ্ঞাতগোত্রের কোনটা আম, কোনটা জাম-কিন্তু কোন গাছটা যে কে, কোনজনা, তা আমি চিনে রাখতে পারিনে।

আমরা পারি। একবার যাকে যে গাছটাকে দেখি তাকে আর এ জীবনে ভুলিনে….

যাক গে সে কথা…এখন আপনাদের গোয়েন্দা যদি আমাদের বাড়ি গিয়ে কাছাকাছি জঙ্গলের যতো গাছের গোড়ায় না খোঁড়াখুড়ি লাগিয়ে দেয় তাহলেই তো হয়েছে।

গোড়ার গলদ বেরিয়ে পড়বে আমাদের। গোবরা বলে।

একটা না একটার তলায় পেয়ে যাবে আমাদের ঐশ্বর্যের হদিস। অরণ্যেই আমাদের ঐশ্বর্য, যতই গালভরা হোক, কথাটা বলে আপনি ভাল করেননি। এভাবে হদিসটা দেওয়া ঠিক হয়নি আপনার।

তার চেয়ে আপনি কষে আমাদের গাল দিতে পারতেন বরং। কিছু আসতো যেতো না। গালে চড় মারতেও পারতেন। গাল বাড়িয়ে দেয় গোবরাকিন্তু আমাদের ভাঁড়ারের নাগাল দেওয়াটা উচিত হয়নি।

কী করা যায় এখন। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েন হর্ষবর্ধন। বসে তো ছিলেনই, মনে হয়, আরো যেন তিনি একটু বসে গেলেন।

চলো দাদা, আমরা গৌহাটি চলে যাই। গোবরা একটা পথ বাতলায়, ওই ট্রেনেই চলে যাই আজ। গোয়েন্দার উপর গোয়েন্দাগিরি করা যাক বরং। ডিটেকটিভ বই তো নেহাত কম পড়িনি ওদের হাড়-হদ্দ জানি সব। কিছুই আমার অজানা নয়।

ওর পড়াশোনার পরিধি কদুর জানার আমার কৌতূহল হয়। সে অকাতরে বলে–কম বই পড়েছি নাকি? লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে আনিয়ে পড়তে কিছু আর বাকি রাখিনি। সেই সেকেলে দারোগার দপ্তর থেকে শুরু করে পাঁচকড়ি দে-আহা সেই মায়াবী মনোরমা বিষম বৈসূচন…কোনোটাই বাদ নেই আমার। আর সেই নীলবসনা সুন্দরী।

দাদার সমর্থন আসে–আহা, মরি মরি।

থেকে আরম্ভ করে সেদিনের নীহার গুপ্ত, গৌরাঙ্গ বোস অব্দি সব আমার পড়া। ব্লেক সিরিজ, মোহন সিরিজ বিলকুল। জয়কুমার থেকে ব্যোমকেশ পর্যন্ত কারো কীর্তিকলাপ আমার অজানা নয়। এতো পড়ে পড়ে আমি নিজেই এখন আস্ত একটা ডিটকিটিভ, তা জানেন?

বলো কি হে?

সেবারকার আমাদের কারখানার চুরিটা ধরলো কে শুনি? কেন গোয়েন্দা? এই-এই শর্মা তো। তেজপাতার টোপ ফেলে তৈজসপত্রের লোভ দেখিয়ে আমিই তো ধরলাম চোরটাকে। দাদার বেবাক টাকা উদ্ধার করে দিলাম। তাই না দাদা?

তোর ওই সব বই টই এক-আধটু আমিও যে পড়িনি তা নয়। ওর আনা বই-টই অবসরমতন আমিও ঘেঁটে দেখেছি বইকি। তবে পড়ে-উড়ে যা টের পেয়েছি তার মোদ্দা কথাটা হচ্ছে এই যে গোয়েন্দাদের মৃত্যু নেই। তারা আপনার ঐ আত্মার মতই অজর অমর অবিনশ্বর অকাট্য অবিধ্য…

অকাট্য? অবিধ্য?

হ্যাঁ, তরোয়াল কেটে ফেলা যায় না, গুলি দিয়ে বিদ্ধ করা যায় না মেরে ফেলা তো অসম্ভব। কানের পাশ দিয়ে চলে যাবে যতো গুলিগোলা। এই পরিচ্ছেদে দেখলেন আপনি সে হতভাগা খতম হলো, আবার পরের পরিচ্ছদই দেখুন ফের বেঁচে উঠেছে আবার। অকাট্য অবিধ্য অখাদ্য।

তাহলে চলো দাদা। আমরাও ওকে টের পেতে না দিয়ে ওই ট্রেনেই চলে যাই আজকে। গুলি করেও গুলিয়ে দেওয়া যাক ওকে আসল জায়গার থেকে ভুলিয়ে অন্য জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসবো দেখো তুমি।

এতক্ষণে দাদা যেন একটু আশ্বস্ত হলেন মনে হলো। হাসিমুখে বললেন–যাব তো, কিন্তু যাচ্ছি যে, ও যেন তা টের না পায়!…

গৌহাটি স্টেশনে নামতেই তাঁর নজরে পড়ে গেলেন কল্কেকাশির। কষ্কেকাশি তাদের দেখতে পেয়েছে সেটা তারা লক্ষ্য করলেন বটে, কিন্তু তারা যে লক্ষীভূত হয়েছেন সেটা তাকে টের পেতে দিলেন না একেবারেই। নজরই দিলেন না একদম তার দিকে। আপন মনে হেলে দুলে বাইরে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলেন তাঁরা।

কল্কেকাশিও অলক্ষে পিছু পিছু আরেকটা ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলেন তারপর। ছুটলেন তাঁদের পিছনে পিছনে।

হর্ষবর্ধনের গাড়ি কিন্তু কোন জঙ্গলের ত্রিসীমানায় গেল না, তাঁদের বাড়ির চৌহদ্দির ধারে তো নয়ই। অনেক দূর এগিয়ে ছোটখাটো পাহাড়ের তলায় গিয়ে খাড়া হল গাড়িটা।

ভাইকে নিয়ে নামলেন হর্ষবর্ধন। ভাড়া মিটিয়ে মোটা বখশিস দিয়ে ছেড়ে দিলেন ট্যাক্সিটা। কল্কেকাশিও নেমে পড়ে পাহাড়ের পথ ধরে দূর থেকে অনুসরণ করতে লাগলেন ওঁদের।

আড়চোখে পিছনে তাকিয়ে দাদা বললেন ভাইকে ছায়ার মতন আসছে লোকটা। খবরদার ফিরে তাকাস নে যেন।

পাগল হয়েছে দাদা? তাকাই আর তাক পেয়ে যাক? দাদার মতন গোবরারও যেন আজ নয়া চেহারাঃ দু-ভায়ে এখেনেই ওকে আজ নিকেশ করে যাব। কাক চিল কেউ টের পাবে না, সাক্ষী সাবুদ থাকবে না কেউ। শকুনি গৃধিনীতে খেয়ে শেষ করে দেবে কালকে।

কাজটা খুবই খারাপ ভাই, সত্যি বলছি। দাদার অনুযোগ; কিন্তু কি করা যায় বল? ও বেঁচে থাকতে আমাদের বাঁচান নেই, আর আমাদের বেঁচে থাকাটাই যখন বেশি দরকার, অন্তত আমাদের কাছে…তখন ওকে নিয়ে কি করা যায় আর? তবে ওকে আদৌ মারা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এখনো পর্যন্ত কোনো বইয়ে একটা গোয়েন্দাও মরেনি কখনো।

কিন্তু বাবার যেমন বাবা আছে তেমনি গোয়েন্দার উপরে গোয়েন্দা থাকে… জানায় গোবরা আর তিনি হচ্ছেন খোদ এই গোবর্ধন। খোদার ওপর খোদকারি হবে আজ আমার। ব্লেক আর স্মিথের মতই গোবরা দাদাকে নিজের সাকরেদ বানাতে চাইলেও হর্ষবর্ধন অন্যরূপে প্রকট হন, গোঁফ মুচড়ে বলেন–তুই যদি গোবর্ধন, তাহলে আমি সাক্ষাৎ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং গোবর্ধনকে ধারণ করে রয়েছি।

বলে ভাইয়ের হাত ধরে বলেন–আয়, আমরা এই উচ টিবিটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াই। একটুখানি গা ঢাকা দিই। লোকটা এখানে এসে আমাদের দেখতে না পেয়ে কী করে দেখা যাক…

কষ্কেকাশি বরাবর চলে এসে কাউকে না দেখে সোজা পাহাড়ের খাড়া দিকটার কিনারায় গিয়ে পৌঁছান। দেখেন যে তার ওধারে আর পথ নেই, অতল খাদ, তার খাদ্যরা বিলকুল গায়েব। তাকিয়ে দেখেন চার দিকে দুই ভাই কারোরই কোন পাত্তা নেই গেলো কোথায় তারা?

এমন সময় যেন মাটি খুঁড়েই তারা দেখা দিলে হঠাৎ। কল্কেকাশি সাড়া পেলেন পেছন থেকে হাত তুলে দাঁড়ান।

ফিরে তাকিয়ে দেখেন দুই মূর্তিমান দাঁড়িয়ে যুগপৎ শ্রীহর্ষ এবং শ্রীমান গোবর-বধর্ন ভ্রাতৃদ্বয়। দুজনের হাতেই দোনলা পিস্তল।

এবারে আপনি আমাদের কবজায়, কল্কেকাশিবাবু। হাতের মুঠোয় পেয়েছি আপনাকে। আর আপনার ছাড়ান নেই, বিস্তুর জ্বালিয়েছেন কিন্তু আর আপনি আমাদের জ্বালাতে পারবেন না। দেখছেন তো আমাদের হাতে এটা কী। হর্ষবর্ধন হস্তগত বস্তুটি প্রদর্শন করেন–সব জ্বালাযন্ত্রণা খতম হবে এবার আমাদের, আপনারও।

একটু ভুল করছেন হর্ষবর্ধনবাবু। জানেন নাকি, আমাদের গোয়েন্দাদের কখনো মৃত্যু হয় না? আমরা অদাহয় অভেদ্য অমর।

জানি বইকি, পড়েওছি বইয়ে। আপনারা অসাধ্য, অকাট্য, অখাদ্য ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু তাই বলে আপনারা কিছু অপত্য নন। দু-পা আগ বাড়িয়ে তাকিয়ে দেখুন একবার আপনার সামনে অতল খাদ মুহূর্ত বাদেই ওই খাদে পড়ে ছাতু হতে হবে আপনাকে। পালাবার কোনো পথ নেই। ওই পতন অপ্রতিরোধ্য কিছুতেই আপনি তা রোধ করতে পারবেন না। সব হতে পারেন কিন্তু আপনি তো অপত্য, মানে, অপতনীয় নন।

আপনাকে প্রজাপুঞ্জের মতন অপত্যনির্বিশেষে আমরা পালন করবো। গোবর্ধন জানায়, বেশির ভাগ বাবাই যেমন ছেলের অধঃপতনের মূল, মানুষ করার ছলনায় তাকে অপমৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় ঠিক তেমনি ধারাই প্রায় আপনাকে পুঞ্জীভূত করে রাখবো পাহাড়ের তলায়। হাড়মাস সব এক জায়গায়।

পায়ে পায়ে এগিয়ে যান এইবার। হর্ষবর্ধনের হুকুম, খাদের ঠিক কিনারায় গিয়ে খাড়া হন। নিজে ঝাঁপিয়ে পড়বার সাহস আপনার হবে না আমি জানি। আপনাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো আমরা। এখোন এগোন….নইলেই এই দুড়ম!

অগত্যা কষ্কেকাশি কয়েক পা এগিয়ে কিনারাতেই গিয়ে দাঁড়ান। হাতঘড়িটা কেবল দেখে নেন একবার।

ঘড়ি দেখে আর কী হবে সার! অন্তিম মুহূর্ত আসন্ন আপনার। দাদা বলেন–গোবরা, চারধারে একবার ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ তো, পুলিস- টুলিস কারু টিকি দেখা যাচ্ছে নাকি কোথাও?

উঁচু পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে গোবরা নজর চালায় চারধারে, না দাদা, কেউ কোথাও নেই। পুলিস দূরে থাক, চার মাইলের মধ্যে জনমনিষ্যির চিহ্ন না। একটা পোকা মাকড়ও নজরে পড়ছে না আমার।

খাদটা কতো নিচু হবে রে? দাদা শুধায়, ধারে গিয়ে দেখে আয় তো।

তা, পাঁচশো ফুট তো বটেই। আঁচ পায় গোবরা।

কোথাও কোনো ঝোঁপ-ঝাড়, গাছের শাখা-প্রশাখা, লতা-গুল্ম কিছু বেরিয়ে-টেরিয়ে নেই তো! পতন বোধ রোধ হতে পারে এমন কিছু কোথাও কোন ফ্যাকড়ায় লোকটা আটকে যেতে পারে শেষটায়–এমনতরো কোনো ইতর বিশেষ আছে কিনা ভালো করে দ্যাখ।

বিলকুল ন্যাড়া এই খাড়াইটা। আটকারার মতন কোথাও কিছু নেইকো।

বেশ। আমি রিভলভার তাক করে আছি। তুই লোকটার পকেট-টকেট তল্লাশী করে দ্যাখ এইবার। কোনো প্যরাসুট কি বেলুন-ফেলুন লুকিয়ে রাখেনি তো কোথাও?

এক পকেটে একট রিভলভার আছে দাদা!

বার করে নে এক্ষুনি, আর অন্য পকেটটায়? একখানা রুমাল।

নিয়ে নে ওটাও। কে জানে, ওটাকেই হয়তো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্যারাসুটের মতো বানিয়ে নিয়ে দুর্গা বলে ঝুলে পড়বে শেষটায় কিছুই বলা যায় না। ওদের অসাধ্য কিছু নেই।

গোবর্ধন হাসে–রুমালকে আর প্যারাসুট বানাতে হয় না। তুমি হাসালে দাদা! বলে রুমালটাও সে হাতিয়ে নেয়।

এখন কোনো ভূমিকম্পটম্প হবে না তো রে? সে রকম কোনো সম্ভাবনা নেই, কী বলিস?

একদম না। এ ধারটায় অনেকদিন ও-সব হয়নি আমি শুনেছি।

তাহলে তুই এবার রিভলভার বাগিয়ে দাঁড়া, আমি লোকটাকে ছুটে গিয়ে জোরসে এক ধাক্কা লাগাই।

ওই কমমোটি কোরো না দাদা! দোহাই! তাহলে ও তোমায় জড়িয়ে নিয়ে পড়বে, আর পড়তে পড়তেই, কায়দা করে আকাশে উলটে গিয়ে তোমাকে তলায় ফেলে তোমার ওপরে গিয়ে পড়বে তারপর। তোমার দেহখানি দেখহ তো! ওই নরম গদির ওপরে পড়লে ওর কিছুই হবে না। লাগবে

একটুও। তুমিই ছাতু হয়ে যাবে দাদা মাঝ থেকে। গৌহাটি এসে আমাকে এমন ভাবে দাদৃহারা কোরো না তুমি রক্ষে করো দাদা!

ঠিক বলেছিস! আমার চেয়ে বেশি পড়াশুনা তোর তো। আমি আর ক-খানা গোয়েন্দাকাহিনী পড়েছি বল! পড়বার সয়ম কই আমার। ভাইয়ের বুদ্ধির তারিফ করেন হর্ষবর্ধন–দাঁড়া, তাহলে একটা গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে আসি। তাই দিয়ে দূর থেকে গোত্তা মেরে ফেলে দিই লোকটাকে কী বলিস?

তারপর হর্ষবর্ধনের গোঁত্তা খেয়ে কল্কেকাশি পাহাড়ের মাথা থেকে বেপাত্তা! কল্কেকাশির কল্কেপ্রাপ্তি ঘটে গেলো দাদা! তোমার কৃপায়।

একটা পাপ কমলো পৃথিবীর। একটা বদমাইশকে দুনিয়া থেকে দূর করে দিলাম। আরামের হাঁফ ছাড়লেন হর্ষবর্ধন।

একেবারে গোটুহেল করে দিয়েছে লোকটাকে। এতক্ষণ নরকের পথ ধরেছে সটান। গোবর্ধন বলেঃ খাদের তলায় দেখবো নাকি তাকিয়ে একবার? কিরকম ছরকুটে পড়েছে দেখবো দাদা?

দরকার নেই। পাহাড়ের থেকে পড়ে পায়ের হাড় পর্যন্ত হয়ে গেছে। বিলকুল ছাতু! সে-চোহারা কি আছে নাকি আর? তাকিয়ে দেখবার কিছু নেই। দাদা বলেন, এবার আস্তে আস্তে ফিরে চলি আমরা। ইস্টিশনের দিকে এগুনো যাক। বড়ো রাস্তার থেকে একটা বাস ধরলেই হবে।

পাহাড়তলীর পথ ধরে এগিয়ে চলেন দু-ভাই।

যেতে যেতে হঠাৎ পেছন থেকে সাড়া পান যেন কার–হাত তুলে দাঁড়ান। দুজনেই।

পিছন ফিরে দেখেন স্বয়ং সাক্ষাৎ কঙ্কোকাশি। হাতে পিস্তল নিয়ে খাড়া।

আপনারা টের পাননি প্যান্টের পকেটে আরেকটা পিস্তল ছিল আমার। কৈফিয়তের মতই বলতে যান কল্কেকাশি।

তা তো ছিলো। কিন্তু আপনি ছিলেন কোথায়? হতভম্ব হর্ষবর্ধনের মুখ থেকে বেরোয়।

আকাশে। আবার কোথায়! হেলির নাম শুনেছেন কখনো? বাতলাম কল্কেকাশিঃ তার দৌলতেই বেঁচে গেলাম এ-যাত্রা।

হেলিই আপনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, বলছেন আপনি? মানে, জাহান্নামের পথ থেকেই ফিরে আসছেন সটান?

না। অদুর যেতে হয়নি অবশ্যি। হেলি–মানে হেলির ধূমকেতুর নাম শোনেননি নাকি কখনো? নিরানব্বই বছর অন্তর অন্তর একবার করে পৃথিবীর পাশ কাটিয়ে যায় সেটা। সেই সময়টায় তার বিকর্ষণে কয়েক মুহূর্তের জন্যেই, মাধ্যকর্ষণ শক্তি লোপ পায় পৃথিবীর। তাই অমি তখন ঘড়ি দেখছিলাম বার বার–হেলির ধূমকেতু কখন যায় এ ধার দিয়ে। আজ তার ফিরে আসার নিরানব্বইতম বছর তো! আর ঠিক সেই সময়েই ফেলেছিলেন আপনার আমায়। আমাকে আর মাটিতে পড়তে হয়নি আছড়ে। আকাশের গায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ঠায়। আর আপনারা পেছন ফিরতেই, পাখির মতন বাতাস কেটে সাতরে এসে উঠেছি ওই পাহাড়ে। তারপর থেকেই এই পিছু নিয়েছি. আপনাদের। রিভলভার দুটো লক্ষ্মী ছেলে মতন ফেলে দিন তো এইবার। ব্যস, এখন হাত তুলে চলুন দুজনে গুটিগুটি। সোজা থানার দিকেই সটাং!

নিরানব্বই বছর অন্তর হেলির ধূমকেতু পাশ দিয়ে যায় পৃথিবীর? জানতাম না তো! কখনো শুনিওনি এমন আজগুবি কথা।

অবাক লাগে হর্ষবর্ধনের।

এখন তো জানলেন! পাক্কা নিরানব্বই বছর বাদ ধূমকেতুর আসার ধুমধাড়াক্কার মুখেই আপনার ধাক্কাটা এলো কিনা, তাই দুই ধাকায় কাটাকাটি হয়ে কেটে গেলো। বুঝলেন এখন?

এর নামই নিরানব্বইয়ের ধাক্কা, বুঝলে দাদা? বললো গোবরা।

কাষ্ঠকাশির চিকিৎসা

বড়দির আদুরে থোকাকে একটি কথা বলার কারু জে নেই। বলেছ কি খোকা তো বাড়ি মাথায় করেছেই, বড়দি আবার পাড়া মাথায় করেন। প্রতিবেশীদের প্রতি বেশি রাগ আমার নেই–তাই যতদূর সম্ভব বিবেচনা করে বড়দি আর খোকাকে না ঘাঁটিয়েই আমি চলি।

কালই মিউনিসিপ্যাল মার্কেট থেকে পছন্দ করে কিনে এনেছি, আজ সকালেই দেখি খোকা সেই দামী পাইনের ছড়িটা হস্তগত করে অম্লানবদনে চর্বণ করছে। খোকার এইভাবে ছড়িটি আত্মসাৎ করার প্রয়াস আমার একেবারেই ভাল লাগল না, ইচ্ছা হল ওকে বুঝিয়ে দিই ছড়ির আস্বাদ নয়, পিঠে। কিন্তু ভয়ানকভাবে আত্মসংবরণ করে ফেললাম।

ভয়ে ভয়ে বড়দির দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম–দেখছ, খোকা কি করছে?

সঙ্গে সঙ্গে বড়দির খান্ডমার্কা জবাব–কে তোমার পাকা ধানে মই দিচ্ছে? ও তো ছড়ি টিবচ্চে।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, তা চিবুক ক্ষতি নেই কিন্তু যত রকমের কাঠ অছে, তার মধ্যে পাইন কাঠ খাদ্য হিসেবে সব চেয়ে কম পুষ্টিকর, তা জানো কি? তাছাড়া এখন চারধারে যে রকম হুপিংকাফ হচ্ছে–

বড়দি ঝামটা দিয়ে উঠলেন–যাও যাও, তোমাকে আর বাকা বুঝাতে হবে না। সেদিন আমি একটা ওষুধের বিজ্ঞাপনে পড়লাম পাইন গাছের হাওয়া যক্ষ্মকাশি পর্যন্ত সারে–যার হাওয়ায় যক্ষ্মা সেরে যায়, তাতেই কি না হুপিং কাশি হবে? পাগল!

আমার মনে বৈরাগের উদয় হল, বললাম–বেশ আমার কথার চেয়ে বিজ্ঞাপনেই যখন তোমার বেশি বিশ্বাস তখন আজই আমি এক ডজন ছড়ির অর্ডার দিচ্ছি, তুমি রোজ একটা করে থোকাকে খাওয়াও। আহার ওষুধ দুই হবে। বলে বিনা ছড়ি হাতেই বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির থেকে।

জীবনটা বিড়ম্বনা বোধ হতে লাগল। সারা দিন আর বাড়ি ফিরলাম না। ওয়াই, এম, সি. এ-তে সকালের লাঞ্চ সারলাম, তারপর সোজা কলেজে গেলাম, সেখান থেকে এক বন্ধু বাড়ি বিকেলের জলযোগ পর্ব সেরে চলে গেলাম খেলার মাঠে। মোহনবাগান ম্যাচ জেতায় যে ফুর্তিটা হল, ক্লাবে গিয়ে ঘন্টা দু ব্রিজ খেলায় হেরে গিয়ে সেটা নষ্ট করলাম। সেখান থেকে গেলাম সিনেমার সাড়ে নটার শোয়ে।

রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে সদর দরজা খোলাই পেলাম। হাঁকডাক করতে হল না, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। জ্যাঠামশাই ভারি বদরাগী মানুষ, তাঁর ঘুমের ব্যাঘাত হলে আর রক্ষা নেই। পা টিপে টিপে নিজের ঘরের অভিমুখে যাচ্ছি বড়দি কোথায় ওৎ পেতে ছিলেন জানি না, অকস্মাৎ এসে আক্রমণ করলেন।

শিবুরে, খোকা বুঝি আর বাঁচে না।

বড়দির অতর্কিত আক্রম, তার পরেই এই দারুণ সুঃসংবাদ–আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লাম।-কেন, কেন, কি হয়েছে? ছড়িটা গিয়ে ফেলেছে না কি?

বিপদের মুহূর্তে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসের কথাই আগে মনে পড়ে। ছড়িটার দুর্ঘটনা আশঙ্কা করলাম।

না না, ছড়ির কিছু হয়নি।

স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে বড়দির দিকে দৃষ্টিপাত করলাম যাক, ছড়ির কোন অঙ্গহানি হয়নি তো। বাঁচা গেছে।

না, ছড়ির কিছু হয়নি, তবে সন্ধ্যে থেকে খোকা ভারি কাশছে– ভয়ানক কাশছে। হুপিংকাফ হয়েছে ওর–নিশ্চয়ই হুপিংকাফ। কি হবে ভাই?

এতক্ষণে মুরব্বি চাল দেবার সুযোগ এসেছে আমার। গভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বললাম, তখনই তো বলেছিলাম সকালে। তা তুমি গ্রাহ্যই করলে না। তখন পাইনের হাওয়ায় কত কি উপকারিতার কথা আমায় শুনিয়ে দিলে। এখন ঠেলা সামলাও।

লক্ষ্মি দাদাটি, তোমাকে একবার ডাক্তার বাড়ি যেতে হবে এখুনি।

এত রাত্রে? অসম্ভব, ডাক্তার কি আর জেগে বসে আছে এখন? তার চেয়ে এক কাজ কর না বড়দি?

ব্যগ্রভাবে বড়দি প্রশ্ন করলেন, কি, কি?

পাইনের হাওয়ায় যক্ষ্মা সারে, আর হুপিং সারবে না? ছড়িটা দিয়ে থোকা কষে হাওয়া কর না কেন?

বড়দি রোষ কষায়িত নেত্রে আমার দিকে দৃকপাত করলেন–না তোমাকে যেতেই হবে ডাক্তারের কাছে। নইলে জ্যাঠামশাইকে জাগিয়ে দেব। এই ডাক ছাড়লাম–ছাড়ি?

না না, রক্ষে কর–দোহাই। যাচ্ছি ডাক্তারের কাছে।

খোকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলাম। হ্যাঁ, হুপিংকাফ, নিশ্চয়ই তাই, ছড়ি খেলে হুপিংকাফ হবে, জানা কথা। কি কাশিটাই না কাশছে, নিজের নাক ডাকার আওয়াজে শুনতে পাচ্ছে না তাই, নইলে এই কাশির ধ্বনি কানে গেলে জ্যাঠামশাই নিশ্চয় ক্ষেপে উঠতেন। কিম্বা উঠে ক্ষেপতেন।

গেলাম ডাক্তারের কাছে–ভাগ্যক্রমে দেখাও হল। কাল সকালে তিনি খোকাকে দেখতে আসবেন। এখন এক বোতল পেটেন্ট হুপিংকাফ-কিওর দিলেন, ব্যবস্থাও বাতলে দিলেন। বড়দিকে বললাম, এই ওষুধটা এক চামচ তিন ঘন্টা বাদ বাদ খাওয়াতে হবে।

তিন ঘন্টা বাদ বাদ? ওতে কি হবে? অসুখটা কতখানি বেড়েছে দেখছ না? ঘন্টায় ঘন্টায় খাওয়ালে যদি বাঁচে থোকা।

বেশ, তাই খাওয়াও। আমি এখন ঘুমুতে চললাম।

ঘন্টাখানেক চোখ বুজেছি কি না সন্দেহ, বড়দির ধাক্কায় জেগে উঠলাম।

আঃ, কি ঘুমুচ্ছিস মোষের মতো? এদিকে খোকার যে নাড়ি ছাড়ে।

ধড়মড়িয়ে উঠলাম–তাই নাকি? যতটুকু নাড়ি জ্ঞান তাই ফলিয়েই বুঝলাম নাড়ি বেশ টন টন করছে। বড়দিকে সে কথা জানাতেই তিনি আগুন হয়ে উঠলেন, জ্যাঠামশায়ের ভয়ে চাঁচাতে পারলেন না এই যা রক্ষা। জিজ্ঞাসা করলাম, ওষুধ খাইয়েছে?

হ্যাঁ দু চামচ।

এক ঘণ্টায় দু চামচ? বেশ করেছ।

শিবু, খোকার বুকে সেই পুলটিসটা দিলে কেমন হয়? অন্টি ফুজিস্টিন– যেটা জ্যাঠামশায়ের নিউমোনিয়ার সময় দেওয়া হয়েছিল–এখনো তো এক কৌটো রয়ে গেছে। দেব সেটা?

আমি বললাম, ডাক্তার তো পুলটিস দিতে বলেনি।

বড়দি বললেন, ডাক্তার তো জানে। সেটা দিয়ে কিন্তু জ্যাঠামশায়ের খুব উপকার হয়েছিল, আমি নিজে দেখেছি। তুই স্টোভ জ্বাল, আমি ফ্লানেল যোগাড় করি।

আমি ইতস্তত করছি দেখে বড়দি অনুচ্চ-চিল্কারের একটা নমুনার দ্বারা জানিয়ে দিলেন, স্টোভ না ধরালেই তিনি অকৃত্রিম আর্তনাদে জ্যাঠামশায়ের নিদ্রাভঙ্গ ঘটাবেন। আমি ভারি সমস্যার মধ্যে পড়লাম–যদি বা খোকা বাঁচতে, বড়দির চিকিৎসার ঠেলায় সকাল পর্যন্ত–মানে ডাক্তার আসা পর্যন্ত–টেকে কিনা সন্দেহ। অথচ বড়দির চিকিৎসায় সহায়তা না করলে আরেক বিপদ। ওদিকে খোকার মৃত্যু, এদিকে আমার অপঘাত-আমি স্টোভ ধরাতেই স্বীকৃত হলাম।

পুলটিসের হাত থেকে থোকার পরিত্রাণের একটা ফন্দি মাথায় এল। স্টোভ ধরাতে গিয়ে বলে উঠলাম–এই যে, ধরচে না তো। যা ময়লা জমেছে বানারে। পোকারটা দাও তো বড়দি?

ঘেউৎকারে গলা ফাটিয়ে, নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে শিকার এখন। শিকের রেলিং ডিঙিয়ে, কি তার কায়দার দরজা খুলে-ভেজিয়ে ভেতরে ঢোকার কৌশল তো ওর জানা নেই। বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিতান্তই জিহ্বা-আস্ফালন এবং ল্যাজ-নাড়া ছাড়া আর উপায় কি।

পার্কের ওধার একটা গ্যাসের বাতি খারাপ হয়ে দপদপ করছিল। প্রায় নিভবার মুখেই আর কি। বাতির অবস্থা দেখে দাদুর অবস্থা ওর মনে পড়ে। তার জীবন প্রদীপও হয়তো ওই বাতির মতোই–ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে টুসি।

সর্বনাশ। পোকার–সে যে জ্যাঠামশায়ের ঘরে।

আমি তা জানতাম। তাহলে কি হবে? যাও তুমি নিয়ে এসগে। নইলে তো স্টোভ ধরবে না।

বাবা। জ্যাঠামশায়ের ঘরে আমি যাব না, তার চেয়ে আমি চ্যাচাব।

না না, তোমায় চাচাতে হবে না। আমিই যাচ্ছি।

ওই সঙ্গে তাক থেকে থার্মোমিটারও এনে, জ্বর দেখতে হবে।

খোকার গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, বেশ গরম। পোকার আনি আর না আনি, থার্মোমিটার দেখা দরকার। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে জ্যাঠামশায়ের কক্ষে ঢুকলাম, দরজা খোলাই ছিল। অন্ধকার ঘরের মধ্যে জীবন্ত একমাত্র নাসিকা কাজে ব্যাঘাত না ঘটিয়েই যদি থার্মোমিটার বাগিয়ে আনতে পারি, তাহলেই আজ রাত্রের ফাড়া কাটল।

কাছাকাছি এক বেড়াল শুয়েছিল, অন্ধকারে তো দেখা যায় না, পড়বি তা পড় তার ঘাড়েই দিয়েছি এক পা। সঙ্গে সঙ্গে হতভাগা চেঁচিয়ে উঠেছে মাও।

শুনেছি বেড়ালের দৃষ্টি অন্ধকারেই ভাল খেলে, ওরই আগে থেকে আমাকে দেখা উচিত ছিল। আমার পথ থেকে অনায়াসেই সরে যেতে পারতো। নিজে দোষ করে নিজেই আবার তার প্রতিবাদ–আমার এমন রাগ হল বেড়ালটার উপর, দিলেম ওকে কষে এক শুট, মহামেডান স্পোর্টিং এর সামাদের মতন।

আমার শুটটা গিয়ে লাগল চেয়ারে, সেখানেই সে সেটা দাঁড়িয়েছিল জানতাম না। পাজি বেড়ালটা এবার ঠিক নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। শুটের প্রতিক্রিয়া থেকে কোনো রকমে আমি টাল সামলে নিলাম কিন্তু চেয়ারটা চিৎপাত হল।

এই সব গোলমালে নাসিকা গর্জ্জন গেল থেমে, কিন্তু আমার হৃৎকম্প আরম্ভ হল সেইসঙ্গে। ভাবলাম, নাঃ, হামাগুড়ি দিয়ে চার-পেয়ের মতো চলি, তাতে ধাক্কাধুকি লাগবার ভয় কম, সাবধানেও চলা যাবে, জ্যাঠামশায়ের নিদ্রা এবং নাসিকা গর্জনের হানি না ঘটিয়ে নিঃশব্দে থার্মোমিটারটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব। একটু পরেই আবার নাক ডাকতে লাগল–আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে হামাগুড়ি প্র্যাকটিস শুরু করলাম।

প্রথমেই একটা বস্তুর সংঘর্ষে দারুণভাবে মাথা ঠুকে গেল হাত দিয়ে অনুভব করলাম ওটা চেয়ার। সব জিনিসেরই দুটো দিক আছে– সুবিধার দিক এবং অসুবিধার দিক; অন্ধকার হামাগুড়ি অভিযানে পা সামলানো যায় বটে, কিন্তু মাথা বাঁচানো দায়। যাক, গোল টেবিলটা এতক্ষণে পেয়েছি, এবার হয়েছে, ঘরের মধ্যিখানে পৌঁছে গেছি–এখানে থেকে সোজা উত্তরে গেলেই সেই তাক যেখানে থার্মোমিটার আছে। না তাকালেও পাবো।

অনেকটা তো গুঁড়ি দেওয়া হল– কিন্তু তাক কই? ভাল করে তাক করতে গিয়ে টেবিলটাকে পুনরাবিষ্কার করলাম–এবার মাথা দিয়ে-এবং রীতিমতন ভড়কে গেলাম। একি, এখনো আমি ঘরের মধ্যিখানেই ঘুরছি? আহত মাথায় হাত বুলোত বুলোতে ভাবতে লাগলাম কি করা যায়?

নতুন উদ্যমে আবার যাত্রা শুরু করলাম। এই তো টেবিল–এই একটা চেয়ার, এটা? এটা জ্যাঠামশায়ের পিকদানি–ছিঃ। যাকগে, হাতে সাবান দিলেই হবে–এই তো দেয়াল, এই আরেকখানা চেয়ারঃ এই গেল গিয়ে সোফা-–এ কি? ঘরে তো একটা সোফা ছিল বলেই জানতাম, নাঃ, এবার হতভম্ব হতে হল আমাকে। যে ঘরে দিনে দশবার আসছি যাচ্ছি, তাতে এত লুকোনো সম্পত্তি ছিল জানতাম না তো। আরেকটু এগিয়ে দেখতে হল–আরো কি অজ্ঞাত ঐশ্বর্য উদ্ধার হয়। এই যে দেখছি আরেকখানা চেয়ার ঘরে আজ এত চেয়ারের আমদানি হল কোত্থেকে। এই যে ফের আরেকটা পিকদানি–ছিঃছি, এ-হাতটাতেও সাবান লাগাতে হল আবার। ছ্যাঃ।

নাঃ, এবার এগুতে সত্যিই ভয় করছিল। ঘরে আজ যে করম পিকদানির আমদানি তাতে আর বেশি পরিভ্রমণ নিরাপদ নয়। দরজাটা কোন দিকে? এবার বেরুতে পারলে বাঁচি আর থার্মোমিটারে কাজ নেই বাবা। উঠতে গিয়ে মাথায় লেগে গেল–এ কোনখানে এলাম? টেবিলের তলায় নাকি? টেবিলটা তো ছোট এবং গোল বলেই জানতাম–এ যে, যেখানে যত ঘুরে ফিরেই উঠতে যাই মাথায় লাগে। ঘরের ছাদ নোটিস না দিয়ে হঠাৎ এত নীচে নেমে আসবে বলে তো মনে হয় না। তবে আমার দণ্ডায়মান হবার বাধা এই দীর্ঘ-প্রস্থ বস্তুটি কি? এটাকে নিয়ে ঠেলে উঠব, যাই থাক কপালে।

যেই চেষ্টা করা, অমনি সহসা জ্যাঠামশায়ের নাসিকাধ্বনি স্থগিত হল। ক্ষণপরেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন–চোর চোর। ডাকাত। খুনে! ভূমিকম্প! ভূমিকম্প! খুন করলো।

ও বাবা। আমি জ্যাঠামশায়ের তক্তপোশের তলায়–কী সর্বনাশ। তাঁকে শুদ্ধ নিয়ে উঠবার চেষ্টায় ছিলাম। এখন তাঁকে অভয় দেওয়া দরকার। বোঝান দরকার চোর নয়, ডাকাত নয়, ভূমিকম্প নয়–অন্য কিছু নগণ্য কিছু। মিহি সুরে ডাকলাম–মিঁয়াও।

জ্যাঠামশাই যে খুব ভরসা পেয়েছেন এমন বোধ হল না। এবার গলা ফুলিয়ে ডাকতে হল–ম্যাঁ–ও।

বড়দি হ্যারিকেন হাতে ঢুকলেন। জ্যাঠামশাই ভীতিবিহ্বল কণ্ঠে বললেন, দেখতে সুশী, আমার তক্তপোশের তলায় কি?

বড়দি আমাকে পর্যবেক্ষণ করে আশ্বাস দিলেন, ও কিছু না, জয়ঠামশাই, একটা ইঁদুর, আপনি ঘুমান!

জ্যাঠামশাই সন্দিগ্ধস্বরে বললেন, ইঁদুর আমার চৌকি ঠেলে তুলবে? ইঁদুরের এত জোর–একি হতে পারে?

বড়দি বললেন, ধাড়ি ইঁদুর যে।

ধাড়ি ইঁদুর! একটু আগে বেড়ালের ডাক শুনলাম যেন। বেড়াল ইঁদুর এক সঙ্গে ওরা যে খাদ্য খাদক বলেই আমার জানা ছিল। যাকগে আলোটা নিয়ে যা আমার সামনে থেকে–ঘুম পাচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে আবার জ্যাঠামশায়ের নাসিকা বাদ্য বেজে উঠল। বড়দির আড়াল দিয়ে আমিও বিপদ-সঙ্কুল কক্ষ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করলাম।

বাইরে এসে হাঁফ ছেড়ে দেখি ভোর হতে আর বাকি নেই–সুদূর আকাশে মুক্তাভা দেখা দিয়েছে। রাত দুটো থেকে এই ভোর পাঁচটা, ওই ঘরে আমি কেবল ঘুরেছি– পায়ে মিটার বাঁধা ছিল না, নইলে জানা যেত কত মাইল মোট ঘুরলাম? তিন ঘন্টায় তিরিশ মাইল তো বটেই।

বড়দি করুণ কণ্ঠে বললেন, তুমি তো থার্মোমিটার আনতে বছর কাটিয়ে দিলে, এদিকে দেখ এসে, খোকা কেমন করছে।

দেখেই বুঝলাম আর না দেখলেও চলে খোকার শেষ-মুহূর্ত সন্নিকট! যে সময়ে আমি এনডিওরেস হামাগুড়ির রেকর্ড সৃষ্টি করছিলাম, আমার ভাগ্নের অদৃষ্টে সেই সময়ে অন্যবিধ এনজিওরেনস পরীক্ষা চলছিল। দেখলাম, বড়দি নিজেই কোনো রকমে স্টোভ ধরিয়ে নিয়েছেন, ইতিমধ্যে। দু-দু বার খোকার বুকে পুলটিস দেওয়া হয়ে গেছে। ওষুধের দিকে তাকিয়ে দেখি গোটা বোতলটা ফাঁক। ওষুধের কি হল জিজ্ঞাসা করতেই বড়দি জানালেন, দশ মিনিট অন্তর এক চামচ করে খাওয়ানো হয়েছে, তবু তো কই কোন উপকার দেখা যাচ্ছে না। আমি বললাম, উপকার দেখা যেত যদি থোকার বদলে তুমি খেতে। হাত টিপে দেখলাম, কিন্তু খোকার নাড়ি পেলাম না। খোকার আর অপরাধ কি, যে এক বোতল হুপিংকাফ একিওর ওকে উদরস্থ করতে হয়েছে, তাতে কি আর ওর নাড়ি-ভুড়ি হজম হতে বাকি আছে? তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ফোন করলাম–আমাদের খোকা মারা যাচ্ছে ।

পায়জামা পরনেই ডাক্তার ছুটে এলেন, পরীক্ষা করে বললেন, না, মারা যাচ্ছে না। তাছাড়া এর হুপিং কাফই হয়নি। দেখি বলে খোকার গলার কাছে সুড়সুড়ি দিতেই খোকা বেদম কাশতে শুরু করল এবং কাশির ধমকে বেরিয়ে এল সুক্ষ্মতম কি একটা জিনিস। হাতে নিয়ে ভাল করে দেখে ডাক্তার বললেন, এ তো পাইন কাঠের টুকরো দেখছি! খোকা বোধ হয় পাইন কাঠের কিছু চিবুচ্ছিল–তার ভগ্নাংশ ভেঙে গলায় গিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।

ক্ষুদ্ধ কণ্ঠে বড়দি বললেন, হুপিংকাশি নয়, তাহলে এটা কি কাশি? বড়দির ক্ষোভের কারণ ছিল, সমস্ত রাত ধরে এক সঙ্গে হুপিংকাফ, নিউমোনিয়া ও সর্দিগর্মির চিকিৎসার পর সেই প্রাণান্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হয়েছে জানলে বার না দুঃখ হয়?

আমি উত্তর দিলাম, এক রকমের কাষ্ঠ-হাসি আছে জানো তো বড়দি? এটা হচ্ছে তারই ভায়রা ভাই কাষ্ঠ-কাশি।

গোখলে, গান্ধিজী ও গোবিন্দবাবু

মহাত্মা বলে সর্বসাধারণে পরিচিত ও পুজিত হবার ঢের আগে থেকেই গান্ধীজি যে যর্থাথ অর্থে মহান আত্মা, তার পরিচয় এই গল্পে তোমরা পাবে। যিনি এই গল্পের জন্য নায়ক, এক গৌণ চরিত্র, তার নিজের মুখ থেকে এ কাহিনীটি শোনা আমার।

গোবিন্দবাবু সেই সময়ে কলকাতার একজন সাধারণ আপিসের কেরানী। তার আসল নাম অবশ্য গোপন রাখলাম। এখন তিনি বড় পদে প্রতিষ্ঠিত যে তার নাম করলে অনেকেই তাকে চিনতে পারবেন।

বহুদিন আগেকার কথা। গোখলে সেই সময়ে ভারতবর্ষের নেতা। সেই গোখলের কলকাতাবাসের সময়ে তাকে পছন্দসই বাসা খুঁজে দিয়েছিলেন, এই সূত্রে গোখলের সঙ্গে আমাদের গোবিন্দবাবুর ঘনিষ্ঠতা গজায়।

ঘনিষ্ঠতা দিনদিনই দারুণতর হয়ে উঠছিল। কেন না, গোখলের দেশ থেকে যখনই তার আত্মীয়-গোষ্ঠীর কেউ আসে, গোখলে তাঁকে কলকাতা দেখবার ভার গোবিন্দবাবুর ওপর দেন। গোবিন্দবাবুকে গোখলের অনুরোধ রাখতে হয়। অত বড় দেশমান্য ব্যক্তির ভাড়াটে বাড়ি যোগাড় করে দেবার সুযোগ লাভ করে তিনি নিজেকে ধন্য জ্ঞান করেছিলেন, এখন তার দেশোয়ালিদের কলকাতা দেখিয়ে আপনাকে কৃতার্থ বোধ করেন।

তাঁর ফরমাস খাটতে পেলে গোবিন্দবাবু যে আপ্যায়িত হন এটা বোধ করি গোখলে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই গোবিন্দুবাবুকে বাধিত করবার সামান্য সুযোগও তিনি অবহেলা করতেন না। যখনই পোরবন, কি পুণা, কি ভুসাওয়াল থেকে কোন অতিথি আসত, গোখলে বলতেন, গোবন্দবাবু ইনকো কলকাত্তা তো কুছ দেখলা দিজিয়ে!

গোবিন্দবাবু অত্যন্ত উৎসাহের সহিত ঘাড় নাড়তেন। কিন্তু সেই অদৃষ্ট পূর্ব্ব অপরিচিত অভ্যাগতকে কলকাতায় দৃশ্য ও দ্রষ্টব্য দেখিয়ে বেড়াতে সেই উৎসাহের কতখানি পরে বজায় থাকত তা বলা কঠিন।

সেই সময়ে গান্ধীজি আফ্রিকা থেকে সবে স্বদেশে ফিরেছেন, তাঁর কীর্তি- কাহিনী সমস্ত শিক্ষিত ভারতবাসীর মনে শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের সঞ্চার করেছে। যদিও আপামর সাধারণের কাছে তার নাম তখন পৌঁছেনি, তবু তাঁর অদ্ভুত চরিত্র, জীবনযাত্রা ও কর্ম-প্রণালীর কথা ক্রমশ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। ভারতবর্ষে ফিরেই গান্ধীজি গুজরাট থেকে কলকাতায় এলেন গোখলের সঙ্গে দেখা করতে।

সেই তাঁর প্রথম কলকাতায় আসা। কাজেই গোখলের স্বভাবতই ইচ্ছা হল গান্ধীজিকে কলকাতাটা দেখানোর। এ কাজের ভার আর কার ওপর তিনি দেবেন? এই কাজের উপযুক্ত আর কে আছে ওই গোবিন্দবাবু ছাড়া? এতএব গোবিন্দবাবুকে ডেকে অনুরোধ করতে তার বিলম্ব হল না।

মোহনদাসকো কলকাত্তা তো দেখলা দিজিয়ে!–শুনে গোবিন্দবাবু কিন্তু নিজেকে এবার অনুগৃহীত মনে করতে পারলেন না। গান্ধীজির পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। যদিও গোবিন্দবাবুর কানে গান্ধীজির খ্যাতি পৌঁছেছিল, তবু কেবল মোহনদাস থেকে তিনি বুঝতে পারলেন না যে তিনি সেই বিখ্যাত ব্যক্তিটিরই গাইড হবার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তাছাড়া গোখলের কথায় তিনিই সকালে গিয়ে লোকটাকে স্টেশন থেকে এনেছেন–থার্ড ক্লাসের যাত্রী, পরণে মোটা কাপড়)–তাও আবার আধময়লা, পায়ে জুতো নেই, মলিন অপরিচ্ছন্ন চেহারা–এ সব দেখে লোকটার ওপর তার শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়নি। সেই লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে সারা কলকাতা ঘুরতে হবে ভেবে গোবিন্দবাবুর উৎসাহ উপে যাবার যোগাড়!

কিন্তু কি করবেন? গোখলের অনুরোধ। আগের দিনই তিনি গোখলের দূর সম্পর্কীয় এক আত্মীয়কে কলকাতা দর্শন করিয়েছেন। সে লোকটি গুজরাটের কোন এক তালুকের দারোগা। সে তবু কিছু সভ্য-ভব্য ছিল, হাজার হোক দারোগা তো! কিন্তু এ লোকটা? গান্ধীজির দিকে দৃষ্টিপাত করে গোবিন্দবাবু বিরক্তি গোপন করতে পারলেন না। বোধহয় কোন সিপাই-টিপাই কি দারোয়ানই হবে বোধ হয়! গোভলের আত্মীয়স্বজন, ভাই-বন্ধু-তাঁর প্রদেশের তাবৎ লোকের ওপর গোবিন্দবাবু বেজায় চটে গেলেন। তাদের কলকাতা আসার প্রবৃত্তিকে তিনি কিছুতেই মার্জনা করতে পারছিলেন না।

যাই হোক, নিতান্ত অপ্রসন্নমনে সিপাইকে লেজে বেঁধে গোবিন্দবাবু নগর ভ্রমণে বার হলেন। এই ভেবে তিনি নিজেকে সান্তনা দিলেন যে রাস্তার লোকে এও তো ভেবে নিতে পারে যে, এ তাঁর নিজেরই সেপাই। গোবিন্দবাবু আজ বডি গার্ড সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন তাদের এই সাময়িক ভুল বোঝার ওপর কিঞ্চিৎ ভরসা করে তিনি কিঞ্চিৎ আত্মপ্রসাদ পাবার চেষ্টা করলেন।

পরেশনাথ মন্দিরের কারুকার্য্য, সেখানকার মাছের লাল, নীল ইত্যাদি রং বেরং হবার রহস্য, মনুমেন্ট কেন অত উঁচু হয়, কলকাতার গঙ্গা কোন কোন প্রদেশ পেরিয়ে এসেছে, হাওড়া-পুল কেন জলের ওপর ভাসে আর ভাসা পুল কেন যে ডুবে যায় না তার বৈজ্ঞানিক কারণ ইত্যাদি কলকাতা শহরের যা কিছু দ্রষ্টব্য ও জ্ঞাতব্য ছিল লোকটাকে তিনি ভাল করে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলেন।

ওকে ক্রমশই তার ভাল লাগছিল। এমন সমঝদার শ্রোতা তিনি বহুদিন পাননি। এমন কি কালকের সেই দারোগাটিও এমন নয়। দারোগাটি তবু মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করার প্রয়াস পেয়েছে বলেছে অত বড় মনুমেন্ট কেবল ইটের বাজে খরচ, মানুষ যদি না থাকল ত অত উঁচ করার ফায়দা কি! বলেছে মাছের ঐ লাল, নীল রং সত্যিকার নয়, রাত্রে লুকিয়ে রং লাগিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এই সিপাইটি সে রকম না; তিনি যা বলেন তাতেই ঘাড় নেড়ে এ সায় দেয়। তবে অসুবিধার কথা এই যে কালকের দারোগাটি তবু কিছু ইংরেজি বুঝত, ইংরেজির সাহায্যে তাকে বোঝানো সহজ ছিল কিন্তু এ সিপাই ত ইংরেজির এক বিসর্গও বোঝে না। অথচ হিন্দিতে সমস্ত বিষয়ে বিশদ করতে গিয়ে গোবিন্দবাবুর এবং হিন্দি ভাষায় প্রাণান্ত হচ্ছিল।

গোবিন্দবাবু সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়লেন মিউজিয়ামে গিয়ে। চিড়িয়াখানায় তেমন কিছু দুর্ঘটনা হয়নি, কেন না, জন্তু জানোয়ারের অধিকাংশই উভয়ের কাছে অজ্ঞাতকুলশীলে নয়। ই হাঁথি, বান্দর–এই বলে তাদের পরিচিত করার পরিশ্রম গোবিন্দবাবুকে করতে হয়নি! কিন্তু মিউজিয়ামে গিয়ে বাঁদরের পূর্ব্বপুরুষ থেকে কি করে ক্রমশ মানুষ দাঁড়াল তার বিভিন্ন জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ডারুইনের বিবর্তনবাদ বোঝাতে গোবিন্দবাবুর দাঁত ভাঙবার যোগাড় হল। কিন্তু সিপাইটির ধৈর্য ও জ্ঞান-তৃষ্ণা আশ্চর্য বলতে হবে। গোবিন্দবাবু যা বলেন তাতেই সে ঘাড় নেড়ে সায় দেয়, আর–সমঝাতা হ্যায়, সমঝাতা হ্যায়।

সমস্ত দিন কলকাতা শহর আর হিন্দি বাতের সঙ্গে রেষারেষি করে গোবিন্দবাবু পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। মাঝে মাঝে ছ্যাকরা গাড়ির সাহায্যে নিলেও অধিকাংশ পথ তাদের হেঁটেই মারতে হয়েছিল। ফিরবার পথে গোবিন্দুবাবু স্থির করলেন আর হাঁটা নয়, এবার সোজা ট্রামে বাড়ি ফিরবেন। সারাদিনের ধস্তাধস্তিতে গোবিন্দবাবু কাবু হয়ে পড়লেও সিপাইটির কিছুমাত্র ক্লান্তি দেখা গেল না।

অশ্ব-বাহন ছেড়ে কলকাতায় তখন প্রথম বিদ্যুৎ বাহনে ট্রাম চলছে। গোবিন্দবাবু ট্রামে উঠলেন বটে, কিন্তু সিপাইটি যে তার পাশে বসে এটা তাঁর অভিরুচি ছিল না। যদি চেনাশোনা লোকের সঙ্গে দৈবাৎ চোখাচোখি হয়ে যায়। কিন্তু সিপাইটির যদি কিছুমাত্র কান্ডজ্ঞান থাকে। সে আম্লানবদনে কিনা তার পাশেই বসল। তার আস্পর্ধা দেখে গোবিন্দবাবু মনে মনে বিরক্ত হলেন এবং সংকল্প করলেন আর কখনও গোখলের বাড়ির ছায়া মাড়াবেন না।

তাঁদের মুখোমুখি আসনে একজন ফিরিঙ্গি বসেছিল, তার কি খেয়াল হল, সে হঠাৎ গোবিন্দবাবু এবং সিপাইয়ের মধ্যে যে জায়গাটা ফাঁক ছিল, সেইখানে তার বুটসুদ্ধ পা সটান চাপিয়ে দিল।

গোবিন্দবাবু বেজায় চটে গেলেন। ফিরিঙ্গিটার অভদ্রতার প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা থাকলেও ওর হোকা চেহারার দিতে তাকিয়ে একা কিছু করবার উত্সাহ তাঁর হচ্ছিল না। সিপাইটির দিকে বক্র কটাক্ষ করলেন, কিন্তু তার রোগাপটকা শরীর দেখে সেদিক থেকেও বড় একটা ভরসা পেলেন না। অগত্যা তিনি নীরবে অপমান হজম করতে লাগলেন।

কিন্তু একটু পরে তিনি যে প্রভাবিত দৃশ্য দেখলেন তাতে তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। সিপাইটি করেছে কি, তার ধূলিধূসারিত চরণযুগল সোজা সাহেবের পাশে চাপিয়ে দিয়েছে। বাবাঃ সিপাইটির সাহস তো কম নয়, তিনি মনে মনে তার তারিফ করলেন। সামান্য নেটিভের সুঃসাহস দেখে ফিরিঙ্গিটাও বুঝি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তার ফেরঙ্গ স্বভাব চাড়া দিয়ে উঠল। সে রুক্ষ স্বরে হুকুম করলে- এইও! গোর হঠা লেও!

সিপাইটি কোন জবাবও দেয় না, পাও সরায় না; যেন শুনতেই পায়নি সে।

সাহেব সিপাইয়ের পাজরায় বুটের ঠোক্কর মেরে বলল–এই! তুম! শুনতা নেহি?

প্রতুত্তরে সিপাই পা না সরিয়ে মৃদু একটু হাসল কেবল।

এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার সাহেব জীবনে কখনো দেখিনি। সাহেবের হুমকিতে ভয় খায় না, অথচ পদাঘাতের প্রতিশোধ নেবারও চেষ্টা করে না, ভয়ও নেই ক্রোধও নয়–অপমান ও লাঞ্ছনার হাস্যতর এমন সমন্বয়ের সাক্ষাৎ এর আগে সে পায়নি। বিস্ময়ে এবং পরাজয়ে তার স্পর্ধা স্বভাবতই সঙ্কুচিত হয়ে এল। সে এবার গোবিন্দবাবুকে ইংরেজিতে বলল–তোমার বন্ধুকে পা তুলে নিতে বল।

গোবিন্দবাবুর আত্মসম্মানে আগাত লাগল। সেই সামান্য সিপাইটা তাঁর বন্ধু! দস্তরমত রাগ হল তার। তিনি গোবিন্দবাবু, হাকিমের দক্ষিণ হস্ত, আর এই সিপাইটা কিনা তার সমকক্ষ। ফিরিঙ্গির ওপর গোড়া থেকেই তিনি চটেছিলেন, এখন তার এই অমূলক সন্দেহে তিনি অসম্ভব ক্ষেপে গেলেন। দ্বিরুক্তি না করে উঠেই রাগের মাথায় তিনি ফিরিঙ্গিটার নাকের গোড়ায় এক ঘুসি কষিয়ে দিয়েছেন।

সারা ট্রামে হৈ-চৈ পড়ে গেল। ফিরিঙ্গিও আস্তিন গুটিয়ে দাঁড়াল। সেই গাড়িতে হিন্দু স্কুলের জনকতক ছাত্র যাচ্ছিল, তারা গোবিন্দবাবুর পক্ষ নিল। ফিরিঙ্গিটিকে হিড়হিড় করে রাস্তায় নামিয়ে তুলো ধুনাবার উদ্যোগ করল তারা।

যে সিপাইটি নিজের লাঞ্ছনায় এতক্ষণ নিরুদ্বিগ্ধ ও নির্বিকার ছিল, সাহেবের প্রতি অত্যাচারের সম্ভাবনায় সে এবার ব্যস্ত হয়ে Oh my boys বলে ছেলেদের সমোধন করে বক্তৃতা শুরু করে দিল। সেই বক্তৃতার মর্ম হচ্ছে সাহেবের কোন দোষ নেই। তাকে মারবার কোন অধিকার নেই আমাদের। কারকেই মারবার আমাদের অধিকার নেই। মানুষ যেন মাকে আঘাত না করে। তোমরা অন্যায় আচরণকারীকে ক্ষমা করতে শেখ, ভালবাসতে শেখ। ভালবাসার দ্বারাই অন্যায়কে জয় করা যায়। অহিংসা পরম ধর্ম–ইত্যাদি ইত্যাদি।

সিপাইয়ের মুখে ইংরেজির চোস্ত বুলি শুনে গোবিন্দবাবু তো হতভম্ব। এ যদি এমন চমৎকার ইংরেজি জানে তবে এতক্ষণ তা বলেনি কেন? তাহলে কি তাকে সারাদিন এমন হিন্দি কসরৎ করে এমন গলদঘর্ম হতে হয়? আহা, আগে জানলে ডারউইনের বিবর্তনবাদ কত ভাল করেই না একে বোঝান যেত। ছেলেরা নিরস্ত হল কিন্তু গোবিন্দবাবুর উন্মা যায় না। তিনি বললেন–ও কেন আমাদের পাশে বা তুলে দিল?

ও আরামের জন্য পা তুলেছে, আমিও আরাম পেয়েছি, পা তুলে দিয়েছি। শোধ-বোধ হয়ে গেছে।

আমি তো সেজন্য ওকে কিছু বলছি না।

লাঞ্ছনার হাত তেকে রক্ষা পেয়ে, এই অদ্ভুত লোকটির কথায় ও ব্যবহারে সাহেব চমৎকৃত হয়ে গেছল। সে সিপাইটির করমর্দন করে ধন্যবাদ জানিয়ে চলতি একজনের মোটরে চড়ে চলে গেল। সিপাইটি গোবিন্দবাবু ও ছেলেদের হয়ে সাহেবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে।

ঠেঙাবার এমন দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় গোবিন্দবাবু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তিনি সারা পথ আর বাক্যব্যয় করলেন না, সিপাইয়ের দিকে তাকালেন না পর্যন্ত। ভীতু কোথাকার। যদিও ভাল ইংরেজি বলতে পারে তবু তার কাপুরুষতাকে তো মার্জনা করা যায় না। তাকে গোখলের আস্তানায় পৌঁছে দিয়ে তিনি সটান বাড়ি ফিরলেন। সিপাইয়ের সঙ্গে বিদায়সম্ভাষণ পর্যন্ত করলেন না।

পরদিন গোখলের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন–আপনার সিপাই কিন্তু খাসা ইংরেজি বলতে পারে।

সিপাই কৌন? আরে মোহনদাস। তুমি সিপাহি বন গিয়া। বলে গান্ধীজীকে ডেকে গোখলে একচোট খুব হাসলেন। গান্ধীজীও হাসতে লাগলেন।

এত হাসাহাসির মর্মভেদ করতে না পেরে গোবিন্দবাবু অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন, কিন্তু তার পরমুহূর্তেই যখন রহস্যভেদ হল, সিপাহির যথার্থ পরিচয় তার অজ্ঞাত রইল না, তখন তিনি আরো কত বেশি অপ্রস্তুত হয়েছিলেন তা অনুমান করতে পার। বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন মানুষ এতখানি অপ্রস্তুত হয়নি।

 ঘোড়ার সঙ্গে ঘোরাঘুরি

আর কিছু না, একটু মোটা হতে শুরু করেছিলাম, অমনি মামা আমার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বললেন–সর্বনাশ! তোর খুড়তুতো দাদামশাই–কী সর্বনাশ!

কথাটা শেষ করবার দরকার হয় না। আমার মাতুলের খুড়ো আর জ্যেঠা স্থূলকায়তায় সর্বনাশের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। নামের উল্লেখেই আমি বুঝতে পেরে যাই।

খুড়তুতো দাদামশায়ের বুকে এত চর্বি জমে ছিল যে হঠাৎ হার্টফেল হয়েই তাঁকে মারা যেতে হল, ডাক্তার ডাকার প্রয়োজন হয়নি। জ্যেঠতুতো দাদামশাইয়ের বেলা ডাক্তার এসেছিলেন কিন্তু ইনজেকশন করতে গিয়ে মাংসের স্তর ভেদ করে শিরা খুঁজে না পেয়ে, গোটা তিনেক উঁচ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গচ্ছিত রেখে, রাগে-ক্ষোভে-হতাশায় ভিজিট না নিয়েই রেগে প্রস্থান করেছিলেন। রেগে এবং বেগে।

যে বংশের দাদামশায়দের এরূপ মর্মভেদী ইতিহাস, সে বংশের নাতিদের মোটা হওয়ার মতো। ভয়াবহ আর কী হতে পারে? কাজেই আমার নাতিবৃহৎ হওয়ার লক্ষণ দেখে বড়মামা বিচলিত হয়ে পড়েন।

প্রতিবাদের সুরে বলি কি করব! আমি কি ইচ্ছে করে হচ্ছি?

উঁহু, আর কোনো অসুখে ভয় খাই না। কিন্তু মোটা হওয়া–বাপস! অমন মারাত্মক ব্যাধি আর নেই। সব ব্যায়রামে পার আছে, চিকিচ্ছে চলে; কিন্তু ও রোগের চিকিচ্ছেই নেই। ডাক্তার কবরেজ হার মেনে যায়। হুঁ!

অগত্যা আমাকে চেঞ্জে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, রোগা হবার জন্য। লোকে মোটা হবার জন্যেই চেঞ্জে যায়, আমার বেলায় উল্টো উৎপত্তি। গৌহাটিতে বড় মামার জানা একজন ভালো ডাক্তার থাকেন; তার কাছেই যেতে হয়। তিনিই আমায় রোগা-রোগা করে আরোগ্য করার ভার নেন–।

প্রথমেই তার প্রশ্ন হয়–ব্যায়াম-ট্যায়াম কর?

আজ্ঞে দুবেলা হাঁটি। দুমাইল, দেড় মাইল, এমনকি আধ মাইল পর্যন্ত–যেদিন যতটা পারি। রাস্তায় বেরলেই হাঁটতে হয়!

হা! হাঁটা আবার একটা ব্যায়াম নাকি! ঘোড়ায় চড়ার অভ্যাস আছে?

না তো! সসংকোচে কই।

ঘোড়ায় চড়াই হল গিয়ে ব্যায়াম। পুরুষ মানুষের ব্যায়াম। ব্যায়ামের মত ব্যায়াম। একটা ঘোড়া কিনে ফেলে চড়তে শেখো–দুদিনে শুকিয়ে তোমার হাড়গোড় বেরিয়ে পড়বে।

ডাক্তারের কথা শুনে আমার রোমাঞ্চ হয়। গোরু থেকে ঘোড়ার পার্থক্য সহজেই আমি বুঝতে পারতাম, যদিও রচনা লিখতে বসে আমার এসেতে ঘোড়া-গরু এক হয়ে এসে মিলে যেত, সেই একতার থেকে ওদের আলাদা করা ইস্কুলের পণ্ডিতের পক্ষে কষ্টকর ছিল। চতুম্পদের দিক থেকে উভয়ে প্রায় এক জাতীয় হলেও বিপদের দিক থেকে বিবেচনা করলে ঘোড়ার স্থান কিছু উঁচু হবে বলতে হয়।

যাইহোক, ডাক্তার ভদ্রলোক গৌহাটির লোক হলেও গৌ গাবৌ গাবঃ না করে, গোড়াতেই গোরাকে বাতিল করে ঘোড়াকেই তিনি প্রথম আসন দিতে চাইলেন–অবশ্য আমার নিচেই। আমিও, ঘোড়র উপরেই চড়ব, এই সংকল্প করে ফেললাম। বাস্তবিক, ঘোড়ায় চড়া সে কী দৃশ্য! সার্কাসে তো দেখেইছি, রাস্তাতেও মাঝে মাঝে চোখে পড়ে যায় বই কি!

আম্বালায় থাকতে ছোটবেলায় দেখেছি পাঞ্জাবিদের ঘোড়ায় চড়া। এখনও মনে পড়ে, সেই পাগড়ী উড়ছে, পারপেন্ডিকুলার থেকে ইষৎ সামনে ঝুঁকে সওয়ারের কেমন সহজ আর খাতির নাদার ভাব আর তার দাড়িও উড়ছে সেই সঙ্গে! যেন দুনিয়ার কোনো কিছুর কেয়ারমাত্র নেই! তাবৎ পথচারীকে শশব্যস্ত করে শহরের বুকের ওপর দিয়ে বিদ্যুৎবেগে ছুটে যাওয়া। পরমুহূর্তে তুমি দেখবে কেবল ধুলোর ঝড়, তাছাড়া আর কিছু দেখতে পাবে না।

হ্যাঁ ঘোড়ায় আমায় চড়তে হবেই! ঠিক তেমনি করেই। তা না হলে বেঁচে থেকে লাভ নেই, মোটা হয়ে তো নেই-ই।

আশ্চর্য যোগাযোগ। ডাক্তারের প্রেসকৃপশনের পর বিকেলের দিকে বেড়াতে বেরিয়েছি, দেখি সদর রাস্তায় নীলাম ডেকে ঘোড়া বিক্রি হচ্ছে। বেশ নাদুস-নুদুস কালো কালো একটি ঘোড়া–পছন্দ করে সহচর করবার মতই।

বাইশ টাকা! বাইশ টাকায় যাচ্ছে–এক, দুই–

তেইশ রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আমি হাঁকলাম।

চব্বিশ টাকা। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন যেন আমার কথারই জবাব দিল।

চব্বিশ টাকা। নীলামওয়ালা ডাকতে থাকে, ঘোড়া, জিন, লাগাম মায় চাবুক–সব সমতে মাত্র চব্বিশে যায়। গেল গেল–এক দুই–

বলে ফেলি একবারে সাতাশ।

আটাশ! ভিড়ের ভেতর থেকে আবার কোন হতভাগার ঝগড়া।

আমার পাশে একজন লোক আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যায়–আমি ঘোড়া চিনি, সে বলে, অদ্ভুত ঘোড়া মশাই! এত সস্তায় যাচ্ছে, আশ্চর্য! এর জিনের দামই তো আঠাশ টাকা!

বলেন কি! আমার চোখ বড় হয়ে ওঠে, তা হলে আরো উঠতে পারি–কী বলেন?

নিশ্চয়! ভাবছেন বুঝি দিশী ঘোড়া? মোটে তা নয়, আসল ভুটানী টাট্টু–যাকে বলে!

ভুটানী বলতে কি বোঝায় তার কোন পরিচয়ই আমার জানা ছিল না, কিন্তু ভদ্রলোকের কথায় ভঙ্গিতে এটা বেশ বুঝতে পারলাম যে এ যেন একটা জানোয়ারের মালিক না হতে পারলে ভূভারতে জীবনধারণই বৃথা!

আকুতোভয়ে ডাকছাড়ি–তেত্রিশ।

চৌৎ-আমার পাশের এক ব্যক্তি ডাকার উদ্যম করে। উৎসবের পুত্রপাতেই ওকে আমি দমিয়ে দিই–সাইত্রিশ! তারপর আমি হন্যে হয়ে উঠিপর পর ডেকে যাই–উনচল্লিশ, তেতাল্লিশ, সাতচল্লিশ, ঊনপঞ্চাশ।

পর পর এতগুলো ডাক আমি একাই ডেকে যাই! ঊনপঞ্চাশে গিয়ে ক্ষান্ত হই।

উনপঞ্চাশ-উনপঞ্চাশ! এমন খাসা খোঁড়া মাত্র ঊনপঞ্চাশে যায়! গেল—গেল–চলে গেল। এক-দুই–

তারপর আর কেউ ডাকে না। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিরস্ত হয়ে পড়েছে তখন। এক দুই তিন।

নগদ ঊনপঞ্চাশ টাকা গুনে ঘোড়া দখল করে পুলকিত চিত্তে বাড়ি ফিরি। সেই পার্শ্ববতী অশ্ব সমঝদার ভদ্রলোক আমার এক উপকার করেন। একটা ভাড়াটে আস্তাবলে ঘোড়া রাখবার ব্যবস্থা করে দেন। তারাই ঘোড়ার খোরপোশের, সেবা শুশ্রূষার যাবতীয় ভার নেবে। সময়ে-অসময়ে এক চড়া ছাড়া কোনো হাঙ্গামাই আমাকে পোহাতে হবে না। অবশ্য এই অশ্ব সেবার জন্য কিছু দক্ষিণা দিতে হবে ওদের।

ভদ্রলোককে সন্দেশের দোকানে নেমন্তন্ন করে ফেলি তক্ষুণি।

পরের দিন প্রাতঃকালে আমার অশ্বারোহনের পালা। ভাড়াটে সহিসরা ঘোড়াটাকে নিয়ে আসে। জনকতক ধরছে ওর মুখের দিকে, আর জনকতক ওর লেজের দিকটায়। মুখের দিকের যারা, তারা লাগাম, ঘোড়ায় কান, ঘাড়ের চুল অনেক কিছুর সুযোগ পেয়েছে কিন্তু লেজের দিকে লেজটাই কেবল সম্বল। ও ছাড়া আর ধর্তব্য কিছু ছিল না। আমি বিস্মিতই হইয়া কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করি না, পাছে আমায় আনড়ি ভাবে। ঘোড়া আনার এই নিয়ম হবে হয়তো, কে জানে।

সেই ডাক্তার ভদ্রলোক বাড়ির সামনে দিয়ে সেই সময় যাচ্ছিলেন, আমাকে দেখে থামেন। এই যে। একটা ঘোড়া বাগিয়েছে দেখছি। বেশ বেশ। কিনলে বুঝি? কতয়? উনপঞ্চাশে? বেশ সন্তাই তো। খাসা-বাঃ।

ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে নিজের প্রেসকৃপশনকেই বড় করেন–হ্যাঁ, হাঁটা ছাড়ো। হ্যাঁ-টা ছাড়ো। হাঁটা ব্যায়াম নাকি আবার। মানুষে হাঁটে? ঘোড়ায় চড়তে শেখো। অমন ব্যায়াম আর হয় না। দুদিনে চেহারা ফিরে যাবে। এত কাহিল হয়ে পড়বে যে তোমার মামারাই তোমাকে চিনতে পারবেন না। হুম।

তাঁর ‘রুগী’ দেখার তাগাদা, অপেক্ষা করার অবসর নেই। ঘাড় নেড়ে আমাকে উৎসাহ দিয়েই তিনি চলে যান। দর্শকদের মধ্যে তাঁকে গণনা না করেই আমার অভিনব ব্যয়ামপর্ব শুরু হয়।

সহিসরা বশে কষে তাকে ধরে থাকে, আমি আস্তে আস্তে তার পিঠের উপর বসি; বেশ যুত করেই বসি; শ্ৰীযুত হয়ে।

কিন্তু যেমনি না তাদের ছেড়ে দেওয়া, ঘোড়াটা চারটে পা একসঙ্গে জড়ো করে, পিঠটা দুমড়ে ব্যাখারির মতন বেঁকিয়ে আনে। এবং করে কি, হঠাৎ পিঠটা একটু নামিয়েই না, ওপরের দিকে এক দারুণ ঝাড়া দেয়–ধনুকে টঙ্কার দেওয়ার মতই। আর তার সেই এক ঝাড়াতেই আমি একেবারে স্বর্গে-ঘোড়ার পিঠ ছাড়িয়ে প্রায় চার পাঁচ হাত উঁচুতে আকাশের বায়ুস্তরে বিরাজমান।

শূন্যমার্গে চলাচল আমার ন্যায় স্কুল জীবের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে নামতে হয়, ঐ ঘোড়ার পিঠেই আবার। সেই মুহূর্তেই আবার যথাস্থানে আমি প্রেরিত হই, কিন্তু আমার অধঃপতন। এবার জিনের মাথায়। আবার আকস্মিক উন্নতি, এবার নেমে আসি ঘোড়ার উপর। আবার আমাকে উপরে ছুঁড়ে দেয়; এবার যেখানে নামি সেখানে ঘোড়ার চিহ্নমাত্র নেই। অশ্ববর আমার আড়াই হাত পেছনে দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তখন, আমাকে লুফে নেবার জন্যই কিনা কে জানে।

ঘোড়ার মতলব মনে মনে টের পেতেই, তার ধরবার আগেই আমি শুয়ে পড়ি। জানোয়ারটা ততক্ষণে আমাকে উন্মুক্ত গৌহাটির পথ ধরে টেলিগ্রামের মতো দ্রুত ছুটে চলেছে।

আস্তে আস্তে উঠে বসি আমি। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি, ঘোড়ায় চড়ার বিলাসিতা পোষাল না আমার। একটা হাত কপালে রাখি, আর একটা তলপেটে। মানুষের হাতের সংখ্যা যে প্রয়োজনের পক্ষে পর্যাপ্ত নয় এ কথা এর আগে এমন করে আমার ধারণাই হয়নি কখনও। করাণ তখনও অরো কয়েকটা হাতের বিলক্ষণ অভা বোধ করি। ঘাড়ে পিঠে কোমরে, পাঁজরায় এবং শরীরের আরো নানা স্থানে হাত বুলোবার দরকার ছিল আমার।

কেবল যে বেহাতই হয়েছি তাই নয়, বিপদ আরো;–উঠতে গিয়েই সেটা টের পাই। দাঁড়াবার এবং দাঁড়িয়ে থাকার পক্ষে দুটো পা-ও মোটেই যথষ্টে নয়, বুঝি তখন। সহিসরা ধরে বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেয়, কিন্তু যেমনি না ছাড়ে অমনি আমি সটান। তখন সবাই মিলে, সহানুভূতিপরবশ হয়ে ধরাধরি করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারেও আমার নিজের হাত পা নিজের কোন-ই কাজে লাগে না, লাগে না, এক ওদের হ্যাঁন্ডেল হওয়া ছাড়া….নিজের চ্যাংদোলায় নিজে চেপে আসি।

তারপর প্রায় এক মাস শয্যাশায়ী। সবাই বলে ডাক্তার দেখাতে কিন্তু ডাক্তার ডাকার সাহস হয় না আমার। মামার বন্ধু-তিনিই তো? এই অবস্থাতেই আবার ঘোড়র চড়ার ব্যবস্থা দিয়ে বসবে কিনা কে জানে। অশ্বচিকিৎসা ছাড়া আর কিছু তো জানা নেইকো তার। সেই পলাতক ভূটানী টাটুকে যদি খুঁজে না-ও আর পাওয়া যায়, একটা নেপালী গাঁট্টার যোগাড় করে আনতে কতক্ষণ? ডাক্তার? নাঃ। মাতৃপুরুষানুক্রমে সে আমাদের ধাতে সয় না।

বিছানা ছেড়ে যেদিন প্রথম বেরুতে পারলাম সেদিন হোটেলের বড় আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চমকে গেলাম। অ্যাঁ এতটা কাহিল হয়ে পড়েছি নাকি? নিজেকে দেখে চেনাই যায় না যে; মুখের দিকে তাকাতেই ইচ্ছা করে না।–বিকৃতবদনে বাইরে বেরিয়ে আসি।

রাস্তায় পা দিতেই আস্তাবলের বড় সহিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ।–হুজুর আপনার কাছে আমাদের কিছু পাওনা আছে।

পাওনা? আবার আমাকে চমকাতে হয়–কিসের পাওনা?

আজ্ঞে, সেই ঘোড়ার দরুন।

কেন, তার দাম তো চুকিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ, চাবুকের দরুন ক-আনা পাবে বটে তোমরা। তা চাবুক তো আমার কাজেই লাগেনি, ব্যবহারই করতে হয়নি আমায়। ও ক-আনাও কি দিতেই হবে নেহাৎ?

আজ্ঞে কেবল ক-আনা নয় তো হুজুর। বাহাত্তর টাকা সাড়ে বারো আনা মোট পাওনা যে। এই দেখুন বিল।

বাহাত্তর টাকা সাড়ে বারো আনা? আমার চোখ কপালে ওঠে। কেন, আমার অপরাধ?

আজ্ঞে আপনার ঘোড়ায় খেয়েছে এই এক মাসে সাড়ে বাইশ টাকার ছোলা সোয়া পাঁচ টাকার ঘাস—

আমি বাধা দিয়ে বলি– কেন, সে তো পালিয়ে গেছে গো।

আপনার ঘোড়া? মোটেই না। খাবার সময়েই ফিরে এসেছিল, আর তার পর থেকে আস্তাবলে ঠিক রয়েছে। সেই ছোট সহিসকে হুকুম দেয়–নিয়ে আয়তো ভূটানী টাট্ট হুজুরের সামনে।

বলতে বলতে সহিসটা ঘোড়াকে এনে হাজির করে। ঘোড়াটা যে ভাল খেয়েছে দেয়েছে তার আর ভুল নেই, বেশ একটু মোটাসোটাই হয়েছে বলে আমার বোধ হোলো।

আমরা তো তবু ওকে কম খেতে দিয়েছি, দিতে পারলে ওর ডবল, আট ডবল খেতে পারত। কিন্তু সাহস করে খাওয়াতে পারিনি, হুজুর বেঁচে উঠবেন কিনা ঠিক ছিল না তো। এর আগের–সহিসটা হঠাৎ থেমে যায়, আর কিছু বলতে চায় না।

পরবর্তী বাক্যটি প্রকাশ করার জন্য আমি পীড়াপীড়ি লাগাই। ছোট সহিসটা বলে ফেলে-ওকে চেপে এর আগে আর কেউ বাঁচেনি হুজুর।

বড় সহিসটা বলে–এই তো ঘাস আর ছোলাতেই গেল সওয়া পাঁচ আর সাড়ে বাইশ। একুনে সাতাশ টাকা বারো আনা। ভুট্টা খেয়েছে মোট দশ টাকার। ভুটানী টাট্ট কিনা, ভুট্টা ছাড়া ওদের চলে না। এই গেল সাঁইত্রিশ টাকা বারো আনা দেখুন না বিল।

এর ওপর আবার বজরা–ছোট সহিসটি বলতে যায়।

থাম তুই। বলে বড় সহিসটা তাকে বাধা দেওয়ায় আমাকে আর বজরাঘাতটা সইতে হয় না।

বিল এনেছ, আমার ছাল ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। মনে বলি।–খাল বিল এক হয়ে যাক আমার।

এবার ছোট সহিসটা শুরু করে–তারপর ঘোড়ায় বাড়ি ভাড়া বাবদে গেল দশ টাকা–

ঘোড়ার জন্যে আবার একটা বাড়ি? আমি অবাক হয়ে যাই।

আজ্ঞে একটা গোটা বাড়ি নিয়ে একটা ঘোড়া করবেই বা কি? ওদের তো খাবার ঘর কি শোবার ঘর, বৈঠকখানা কি পায়খানা আলাদা লাগে না। এক জায়গাতেই ওদের সব কাজ–কিন্তু হুজুর, ঐ জায়গটার ভাড়াই হচ্ছে মাসে দশ টাকা

আমার কথা বেরোয় না। সহিসটা সরু মোলায়েম করে বলে, তারপ হুজুরেরা ঘোড়ার খিদম খেটেছি, আমাদের মজুরি আছে। আমরাই দশ পনের টাকা কি না আশা করি হুজুরের কাছে?

হুজুরের অবস্থা তখন মজুরের চেয়েও কাহিল। তবু মনে মনে হিসাব করে অঙ্ক খাড়া করি–তা হলেও সব মিলিয়ে বাষট্টি বারো আনা হয়। আর দশ টাকা দুপয়সা কিসের জন্যে?

ছোট সহিসটা চটপট বলে–আজ্ঞে ও দুপায়সা আমাকে দিবেন। খৈনির জন্যে।

ঘোড়ায় খৈনি খায়? আশ্চর্য তো!

আজ্ঞে ঘোড়ায় খায়নি। আমিই খাবার জন্য বলছিলাম, ওটার মুখের কছেই। কিন্তু যেমনি না ফটফটিয়েছি অমনি হারমীটা হেঁছে দিয়েছে–বিলকুল খৈনিটাই বরবাদ।

তখনই পকেট থেকে দুটো পয়সা বের করে ওকে দিয়ে দিই। যতটা পাতলা হওয়া যায়। দেনা আর শত্ৰু কখনও বাড়াতে নেই।

বড় সহিস বলে–আর বাকি দশ টাকার হিসাব চান? জানোয়ার এমন পাজী আর বলব কি হুজুর! একদিন বাড়ির মালিকের পাকিটের মধ্যে নাক ডুবিয়ে একখানা দশ টাকার নোট বেমালুম মেরে দিয়েছে। একদম হজম।

অ্যাঁ, বল কি?–আমি বিচলিত হই–একেবারে খেয়ে ফেলল নোটখানা? কড়কড়ে দশ-দশটা টাকা?

এক্কেবারে। আমরা আশা করলাম পরে বেরুবে, কিন্তু না, পরে অনেক আস্ত ছোলা পেলাম, সেগুলো ঘুগনিওয়ালাদের দিয়েছি, কিন্তু নোট বিলকুল গায়েব। এ টাকাটাও ঘোড়ার খোরাকীর মধ্যে ধরে নেবেন হুজুর।

আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি। দশ-দশটা টাকা ঘোড়ার নস্যি হয়ে গেল ভাবতেই আমার মাথা ঘুরতে থাকে।

সহিসটা আশ্বাস দেয়–চাবুকের দামটা তো ধরা হয়নি হুজুর, যদি মর্জি করেন তা হলে ওটার কয় আনা জুরে পুরো তেয়াত্তর টাকাই দিয়ে দিবেন। আর আমাদের দুজনকে ওই দুটো টাকা, বিনয়ের বাড়াবাড়িতে জড়ীভূত হয়ে বলে সে–আপনাদের মতো আমীর লোকের কাছেই তো আমাদের বকসিসের আশা-প্রত্যাশা হুজুর!

প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে সহিস বিদায় করি। মামার দেওয়া যা উপসংহার থাকে তার থেকে হোটেলের দেনা চুকিয়ে, হয়তো মালগাড়িতে বামার হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। যাই হোক, ঘোড়াকে আর আস্তাবলে ফিরিয়ে নিতে দিই না। সামনেই একটা খুঁটোয় বেঁধে রাখতে বলি, রাস্তাই আমার ঘোড়ার আস্তানা এখন থেকে। সেই উপকারী ভদ্রলোককে ডেকে দিতে বলি, সহিসদের, যিনি কেবল ঘোড়া চিনিয়েই নিরস্ত হননি, আস্তাবলও দেখিয়েছিলেন। সেই ভদ্রলোককে ঘোড়াটা উপহার দিয়ে তাঁর উপকারের ঋণ পরিশোধ করব।

অভিলাষ প্রকাশ করতেই বড় সহিত বলে–ওকে কি দেবেন হুজুর! ওঁর ভগ্নীপতিরই তো ঘোড়া।

আমার দম ফেলতে দেরি হয়। সেই নীলামওয়ালা ওর ভগ্নীপতি? সে ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ছোটটা যোগ দেয়–আর ওনারই তো আস্তাবল হুজুর!

আমি আর কিছু বলি না, কেবল এই সংকল্প স্থির কির, যদি আমি গৌহাটিতে থাকতে থাকতেই সেই উপকারী ভদ্রলোকটি মারা যান, তাহলে আমার যাবতীয় কাজকর্ম গল্পের বই পড়া, বায়স্কোপ দেখা, চপকাটলেট খাওয়া এবং আর যা কিছু সব স্থগিত রেখে ওঁর শবযাত্রায় যোগ দেব। সব আমোদ-প্রমোদ ফেলে প্রথমে ঐ কাজ। সেদিনকার অ্যামিউজমেন্ট ঐ।

সহিসরা চলে যায়। আমি ঘোড়র দিকে তাকাই আর মাথা ঘামাই–কি গতি করব ওর? কিংবা ও-ই আমার কি গতি করে? এমন সময়ে ডাক্তারের আবির্ভাব হয় সেই পথে। আমাকে দেখে এক গাল হাসি নিয়ে তিনি এগিয়ে আসেন–এই যে! বেশ জীর্ণশীর্ণ হয়ে এসেছ দেখছি! একমাসেই দেখলে তো? তখনই বলেছিলাম! গোড়ায় চড়ার মতন ব্যায়াম আর হয় না। পায়ে হেঁটে কি এত হালকা হতে পারতে? আরও মুটিয়ে যেতে বরং। যাক, খুশি হলাম তোমার চেহারা দেখে! বাড়ি ফিরে মামাকে বোলো, মোটা রকম ভিজিট পাঠিয়ে দিতে আমায়।

মামা কেন, আমিই দিয়ে যাচ্ছি! সবিনয়ে আমি বলি, এই ঘোড়াটাই আপনার ভিজিট।

খুশি হলাম, আরো খুশি হলাম। ডাক্তারবাবু সত্যিই পুলকিত হয়ে ওঠেন, তা হোলে এবার থেকে আমার রুগী দেখার সুবিধেই হল।

ডাক্তারবাবু লাফিয়ে চাপেন ঘোড়ার পিঠে, ওঠার কায়দা দেখেই বুঝতে পারি এককালে ওই বদঅভ্যাস দস্তুরমতই ছিল ওঁর। পর মুহূর্তের তাকে আর দেখতে পাইনা। বিকালে হোটেলের সামনে আস্তে আস্তে পায়চারি করছি, তখন দেখি, মুহ্যমানের মতো তিনি ফিরছেন, হেঁটেই আসছেন সটান।

আপনার ঘোড় কি হল? ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি। আমার দিকে বিরক্তিপূর্ণ দৃকপাত করেন তিনি।–এই হেঁটেই ফিরলাম। কতটুকুই রা পথ! চার মাইল তো মোটে। ঘোড়ায় চড়া ভালো ব্যায়াম বটে, কিন্তু বেশি ব্যায়াম কি ভালো? অতিরিক্ত ব্যায়ামে অপকারই করে, মাঝে মাঝে হাঁটতেও হয় ভাই! বলে তিনি আর দাঁড়ান না।

খানিক বাদে ডাক্তাবাবুর চাকর এসে বলে–গিন্নীমা আপনার ঘোড়া ফিরিয়ে দিলেন।

কিন্তু ঘোড়া কই? ঘোড়াকে তোমার সঙ্গে দেখছি না তো?

ঘোড়া যে কোথায় তা চাকর জানে না, ডাক্তারবাবুও জানেন না, তবে তার কাছ থেকে যা জানা গেছে তাই জেনেই কর্তার অজ্ঞাতসারেই গিন্নী এই মোটা ভিজিট প্রত্যার্পণ করতে দ্বিধা করছেন না। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গিন্নীপক্ষ যা জেনেছেন আমি তা কর্মবাচ্যের কাছ থেকে জানাবার চেষ্টা করি। যা পঙ্কোদ্ধার হয় সংক্ষেপে তা এই–অশ্বপৃষ্ঠে যত সহজে ডাক্তারবাবু উঠতে পেরেছিলেন নামটা ঠিক ততখানি সহজসাধ্য হয়নি, এবং যথাস্থানে তো নয়ই। দুচার মাইলের কথাই নয়, পাক্কা নয়, পাক্কা পনের মাইল গিয়ে ঘোড়াটা তাকে নামিয়ে দিয়েছে বললেও ভুল বলা হয়, ধরাশায়ী করে পালিয়েছে। কোথায় গেছে বলা কঠিন, এতক্ষণে একশ মাইল, দেড়শ মাইল কি এক হাজার মাইল চলে যাওয়া অসম্ভব না। কর্তা বলেণ একশ, গিন্নীর মতে দেড়শ, এক হাজার হচ্ছে চাকরের ধারণায়।

আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি, ততক্ষণাৎ গাড়ি ধরে বাড়ি ফেরার জন্যে। খাবার সময় তো প্রায় হয়ে এল, যে-এক হাজার মাইল সে এক নিঃশ্বাসে গেছে, খিদের ঝোঁকে তা পেরিয়ে আসতেই বা তার কতক্ষণ? ঘাড় থেকে না নামিয়ে গৌহটিতে বাস করা বিপজ্জনক।

ছারপোকার মার

ছারপোকা আমি মারি নে। মারতে পারি নে। মারতে মারতে হাত ব্যথা হয়ে যায় কিন্তু মেরে ওদের শেষ করা যায় না।

তাছাড়া, মারলে এমন গন্ধ ছাড়ে। বিচ্ছিরি। শহীদ হয়ে ওরা কীর্তির সৌরভ ছড়ায় এমন আমার কীর্তি আর ওদের সৌরভ যাতে আমাদের উভয় পক্ষকেই ঘায়েল হতে হয়।

প্রাণ দিয়ে ওরা আমাদের নাক মলে দিয়ে যায়। যা নাকি কানমলার চেয়েও খারাপ। এই কারণেই আমি ছারপোকা কখনো মারি নে।

আমার হচ্ছে সহাবস্থান। ছারপোকাদের নিয়ে আমি ঘর করি। আত্মীয়-স্বজনের মতোই একসঙ্গে বাস করি তাদের নিয়ে।

আমার বিছানায় হাজার-হাজার ছারপোকা। লাখ-লাখও হতে পারে। এমন কি কোটি কোটি হলেও আমি কিছু অবাক হব না।

কিন্তু তারা আমায় কিছু বলে না।

আমিও তাদের মারি নে, তারাও আমায় কামড়ায় না। অহিংসানীতির, গান্ধীবাদের উজ্জ্বল আবাদ আমার বিছানায়।

আমি করেছি কি, একটা কম্বল বিছিয়ে দিয়েছি বিছানায়। কম্বলের ঝুল চৌকির আধখানা পায়া অবধি গড়িয়েছে।

চৌকির ফাঁকে-ফোকরে তো ওদের অবস্থান। আমার গায়ে এসে পড়তে হলে তাদের কম্বলের একড়োখেবড়ো পথ ভেঙে আসতে হবে। আসতে হবে পশমের জঙ্গল ভেদ করে।

কিন্তু সেই উপশমের উপর নির্ভর করেও আমি আর একটা কৌশল করেছি। চৌকির চারদিকে কম্বলের ঝুল বরাবর ফিনাইলের এক পোচ লাগিয়ে দিয়েছি। রোজ রাত্রেই শোবার আগে নিপুণ তুলির দক্ষতায় একবার করে লাগাই। তাই দিয়ে কম্বলের তলায় দিকটা কেমন চটচটে হয়ে গেছে। হোকগে, তাতে আমার চটবার কোন কারণ নেই। ফিনাইলের গন্ধ, আমার ধারণা, মানুষের গায়ের চেয়ে জোরালো। সেই গন্ধের আড়ালে আমি গায়েব। আমার গন্ধথ তারা পায় না। চৌকির উপরেই যে আমি তা তারা টের পায় না।

তাদের মধ্যে যারা ভাস্কো-ডি গামা কি কলম্বাস গোছের, তারা হয়তো চৌকির তলায় থেকে বেরোয়–আমার আবিষ্কার উদ্দেশে। কিন্তু ফিনাইলের বেড়া অবধি এসে ঠেকে যায় নির্ঘাত, এগুতে পারে না আর। তাদের নাকে লাগে, তারপর আরও এগুলে পায়ে লাগে, ফিনাইলের কাদায় তাদের পা এঁটে বসে যায়, চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত চটচটে কম্বলের সঙ্গে তাদের চটাচটি হয়ে যায় নিশ্চয়। বিশ্বসংসারের উপর বীতশ্রদ্ধ তিতবিরক্ত হয়ে তারা ঐখানেই জবড়জং হয়ে পড়ে থাকে।

বছরের পর বছর আমার রক্ত না খেয়ে কী করে যে তারা বেঁচে আছে তাই আমার কাছে এক বিস্ময়। সেই রহস্যের আমি কিনারা পাইনি এখনও। যাকে উপোসী ছারপোক বলে, আমার মনে হয়, সেই রকম কিছু একটা হয়ে রয়েছে তারা।

তা থাক, তারা সুখে থাক, বেঁচে থাক। তাদের আমি ভালোবাসি। তারাই আমাকে একবার যা বাঁচিয়ে দিয়েছিল–

সকালে সবে ক্ষুর নিয়ে বসেছি, আমার বন্ধু বদ্যিনাথ হন্তদন্ত হয়ে হাজির।

পালাও পালাও, করছ কী। বলতে বলতে আসে।

পালাব কেন? দাড়ি কামাচ্ছি যে।

আরে হরেকেষ্টদা আসছে। এসে উঠবে এখানে–তোমার বাসায়। সে জানায়, এইখানে আস্তানা গাড়বে।

সস্তা না। দাড়ি কামাতে কামাতে বলি, সস্তা নয় অত।

গতবারে যখন কলকাতায় এসেছিল, উঠেছিল আমার ওখানে। যাবার সময় বলে গেছে আবার এলে তোর বাসাতেই উঠব, আর তোকে যদি বাসায় না পাই তো উঠব গিয়ে শিবুর কাছে….! বলে সে একটু দম নেয়। তারপরে ইঞ্জিনের মতো হাঁফ ছাড়ে একখানা।

আজ সকালে আমার এক টি-টি আই বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছলাম শেয়ালদায়। ইস্টিশানের প্লার্টফর্মে, দেখি কিনা, হরেকেষ্টদা ব্যাগ হাতে নামছে ট্রেন থেকে।

বটে?

দেখেই আমি পালিয়ে এসেছি….

যাতে হরেকেষ্টদা বাসায় গিয়ে তোমায় না পায়?

হ্যাঁ। চলে এলাম তোমার কাছেই। দিতে এলাম খরবটা। আমাকে যদি না পায় তো সটান তোমার এখানেই সে….।

আরে আমার এখানে উঠবে কেন সে? আমি তাকে আশ্বস্ত করি, একখানা মাত্র ছোট্ট চৌকি আমার দেখছ তো, এর মধ্যে আমার সঙ্গে তোণ্ঠতি করতে যাবে কেন? তার কিসের অভাব? দুশো বিঘে তার ধানের জমি, দশটা আমবাগান, কাড়ি কাড়ি টাকা–সে কলকাতার যে-কোনো নামকরা ভালো হোটেলে উঠতে পারে।

এক নম্বরের কঞ্জুস। গতবারে আমার মেসে উঠেছিল, গেস্ট চার্জ দিয়ে ফতুর হয়ে গেছি। তিনটি মাস নড়বার নামটি ছিল না। যাবার সময় সর্বস্বান্ত করে গেল আমায়।

কি রকম?

আমার শখের জিনিসগুলি নিয়ে গেল সব। ড্রেসিং টেবিলটা নিল, ডেক চেয়ারটাও, ব্রাকেট, তার ওপরে অ্যালার্ম টাইমপিসটা অবধি। বললে খাসা হবে, এসব জিনিস পাড়াগাঁয়ের লোক চোখে দেখেনি এখনো! শেষটায় আমার টুথব্রাশটা ধরে টানাটানি।

সে কী! একজনের বুরুশ কি আরেকজন ব্যাভার করে নাকি?

বললে, জুতোয় কালি দেওয়া যাবে এই দিয়ে। এমন কি, আলমারিটা ধরেও টানছিল বইপত্র-সমেত! কিন্তু বড্ড ভারী বলে পেরে উঠল না। বলেছে পরের খেপে এসে মুটের সাহায্যে নিয়ে যাবে….

মোটের ওপর আলমারিটা তোমার বেঁচে গেছে। মুটের ওপরে চাপেনি।

আমি পালাই। এখুনি হরেকেষ্টদা ব্যাগ হাতে এসে পড়বে হয়তো। সে ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

বাড়ি যাবে এক্ষুনি? বোসো, চা খাও।

বাড়ি? আজ সারাদিন নয়। খুব গভীর রাত্রে ফিরব বাসায়। আমি ভাই এখন যাই।

হরেকেষ্টদার ভয়ে বাসাতেই ফিরবে না আজ? সারাদিন থাকবে কোথায় শুনি? আমি জিজ্ঞেস করি।

হরেকেষ্ট হরেকেষ্ট কেষ্ট কেষ্ট হরে হরে–করে ঘুরে বেড়াব রাস্তায় বাস্তায়। বলে সে আর দাঁড়ায় না।

দাড়ি কামিয়ে মুখ না–ধুতে হরেকেষ্টদা হাজির।

আসুন আসুন হরেকেষ্টদা! আস্তাজ্ঞে হোক! আমি অভ্যর্থনা করি, আমার কী ভাগ্যি যে আজ আপনার পায়ের ধুলো পড়ল।

বদ্যিনাথকে বাসায় পেলাম না, তাই তোর কাছেই চলে এলাম। ব্যাগ নামিয়ে তিনি বললেন।

আসবেন বইকি! হাজারবার আসবেন। আপনি হলেন হরেকেষ্টদা। আমাদের গায়ের মাথা। আমরা কি আপনার পর?

তা নয়। তবে বদ্যিনাথ ছেলেটি ভালো। তার ওখানেই উঠি। আমাকে পেলে সে ভারী খুশি হয়।

আমিই কি অখুশি? বসুন, চা খান। চা আনাই, জিলিপি শিঙারা কচুরি–কি খাবেন বলুন?

যা হচ্ছে আন। চা-টা খেয়ে চান করে দুটি ভাত খেয়ে বেরুব একটু। কলকাতায় এসেছি, এবার তোর এখানেই থাকব ভাবছি। বদ্যিনাথকে পেলুম না যখন….

তা, থাকুন না যদ্দিন খুশি। দাঁড়ান,–আনাই, পোর্টম্যানটো খুলে পয়সা যার করি। ওমা, কী, বাকসর চাবি কোথায়? খুঁজে পাচ্ছি না তো। চাবিটা কোথায়! ভাঙতে হবে দেখছি বাকসটা! চাবিওয়ালা কোথায় পাই এখন? ভাবতে হবে দেখছি।

না, না, ভাঙবি কেন বাকসটা? দুবেলা চাবিওয়ালা হেঁকে যায় রাস্তায়। চাবি করিয়ে নিলেই হবে। বে পোর্টম্যানটোটি! ভাঙবি কেন? আমায় দিয়ে দিস বরং। দেশে নিয়ে যাব! শুনে আমি হাঁ হয়ে যাই নিজের চাবি নিজেই চাবি নিজেই সারিয়ে ভাল করলাম কিনা খতিয়ে দেখি।

এখন টাকার দরকার তোর বল না? দিচ্ছি না-হয়!

গোটা পাঁচেক দাও তাহলে।

পাঁচ টাকা! ব্যাগ খুলে তিনি বলেন, পার্ট টাকা তো নেই রে দশ টাকার নোট আছে।

তাই দাও তাহলে। পরে বাক্স খুলে দেব ধন তোমায়।

হরেকেষ্টদার পয়সায় চা কচুরি শিঙাড়া জিলিপি জিবেগজা রাজভোগ দরবেশ বসানো যায় বেশ মজা করে।

দুপুরের আহার সেরে হরেকেষ্টদা বললেন, যাই, এবার একটু বদ্যিনাথের বাসা থেকে ঘুরে আসি। সে আমাকে একটা আলমারি দেবে বলেছিল। আধুনিক ডিজাইনের আলামারিটা! দেখতে খাসা। তার ওপরে রবিঠাকুরের বই ঠাসা। আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিল বদ্যিনাথ। মুটের মাথায় চাপিয়ে নিয়ে আসি গে।

সেই যে বেরিয়ে গেলেন হরেকেষ্টদা, ফিরবেন সেই রাত দশটায়।

হায় হায় করতে করতে এলেন কোথায় গেছে বদ্যিনাথটা সরাদিন দেখা নেই। বাসায় লোক বলল সকালে বেরিয়েছে, কিন্তু এই রাত সাড়ে দশটা অপেক্ষা করে…করে….করে…

এতক্ষণ বদ্যিনাথের বাসাতেই ছিলেন তাহলে?

না, বাসায় থাকব কোথায়? ওর ঘরে তো চাবি বন্ধ। কার ঘরে থাকতে দেবে? বাসার সামনের একটা চায়ের দোকানে বসে বসে এতক্ষণ কাটালাম।

সেই দুপুরবেলার থেকে এতক্ষণ!

শুধু শুধু কি বসতে দেয়? বসে বসে চা খেতে হল। তিনশো কাপ চা খেয়েছি। এনতার খেলাম। খান পঞ্চাশেক টোস্ট। আড়াই ডজন আমলেট। সব বদ্যিনাথের অ্যাকাউন্টে। খেয়েছি আর নজর রেখেছি বাসার দরজার, কখন সে ফেরে। কিন্তু নাঃ, এতক্ষণেও ফিরল না।…

তাহলে আর কী করবেন। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ুন এবার।

না কিছু খাব না। যা খেয়েছি তাতেই অম্বল হয়ে গেছে। তিনশো কাপ চা বাপ জীবনে কখনো খাইনি।….না, কিছু আর খাব না। শুয়ে পড়ব সটান। মেজেয় আমার বিছানা করে দে। আছে তোর বাড়তি বিছানা? আমি তো বেডিং-ফেডিং কিছু আনিনি। বদ্যিনাথের বাসায় উঠব ঠিক ছিল। এই মেজেয়…এইভেনেয়…মাদুর-টাদুর যা হোক কিছু পেতে দে না হয়।

তুমি মেজেয় শোবে? তুমি বলছ কী হরেকেষ্টদা? অমন কথা মুখে এনো না, পাপ হবে আমার। তুমি আমার চৌকিতেই শোবে। আমি ঐ কম্বলটা বিছিয়ে সোবখন মেজেয়….

বলে আমি ফিলাইল-লাঞ্ছিত কম্বলট বিছানার থেকে তুলে নিয়ে মাটিতে বিছোই। আর চৌকিতে তোশকের ওপর ধবধবে চারদ পেড়ে হরেকেষ্টদার জন্যে পরিপাটি বিছানা করে দিই।

হরেকেষ্টদা শুয়ে পড়েন। আমিও আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। শুতে না–শুতে হরেকেষ্টদা নাক ডাকতে থাকে। রাত বোধ হয় বারোটা হবে তখন, দারুণ একটা চটপটে আওয়াজে আমার ঘুমস ভেঙে যায়।

কী ব্যাপার? হরেকেষ্টদা নাক আর ডাকছে না! খালি মাঝে মাঝে চটাস টচ চটাচট চটাপট চটাপট চটাপট….শুনতে পাচ্ছি কেবল।

ওরে, ওরে শিবু! আলোটা জ্বাল তো!

আলো জ্বালা যাবে না হরেকেষ্টদা। এগারটার পর মেন পর সুইচ অফ করে দেয়।

কি কামড়াচ্ছে রে? ভয়ঙ্কর কামড়াচ্ছে। দেশলাই আছে তোর?

দেশলাই কোথায় পাব দাদা? আমি কি সিগ্রেট খাই?

তাহলে মোমবাতি?

বাজারে।

কী সর্বনাশ! টর্চ আছে? টর্চ?

রাতে দুপুরে কেন এই টর্চার করছেন হরেকেষ্টদা? চুপচাপ ঘুমোন!

ঘুমোব কী রে? জ্বালিয়ে যাচ্ছে যে! বাঁ পাশটা যে জ্বলে গেল রে-বাঁ–পাশে ছুঁয়েছিলাম…পা থেকে ঘাড় পর্যন্ত জ্বলছে।

পাশ ফিরে শোন।

পাশ ফিরে শোব কী রে? শুতে কী দিচ্ছে? উঠে বসেছি। বসতেও দিচ্ছে না। ভীষণ কামড়াছে রে?

কে জানে! আমি নিস্পৃহ কণ্ঠে বলি? কি আবার কামড়াবে?

এ তো দেখছি খুন করে ফেলবে আমায়। একদম তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। কী পুষেছিস তুই জানিস। ছারপোকা নয় তো রে?।

ছারপোকা? অসম্ভব। আমি অ্যাদ্দিন ধরে শুচ্ছি, আমি কি তাহলে আর টের পেতুম না

তুই একটা কুম্ভকর্ণ। নাঃ, বিছানায় কাজ নেই আমার। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।

তিনি বিছানা ছেড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকলেন ঠায়।

সকালে আমরা উঠে দেখি আমি উঠে দেখলাম, তিনি তো আগের থেকেই উঠেছিল। তিনি শুধু দেখলেন কেবল চৌকির ওপর হাজার হাজার মৃতদেহ। ছারপোকার হয়ে যাব চাপে আর চটাপট চাপড়ে ছারপোকাদের ধ্বংসাবশেষ।

ইস, তুই এখানে থাকিস কি করে রে? এই বিছানায় ঘুমোস কি করে তুই একটা রাসকেল। রাবিশ–কুম্ভকর্ণ। নাঃ, আর আমি এখানে নেই। মা কালির দিব্বি আর কখনো এখানে আসছি না বাবা! আমার নাকে খত। বদ্যিনাথের বাসাতেই আমি থাকব। সেখানেই চললাম। সকাল সকাল গিয়ে পাকড়াই তাকে। বলেই তিনি আর দাঁড়ালেন না। ব্যাগহাতে বেরিয়ে পড়লেন, তার ধার দেওয়া দশ টাকার উদ্ধারের বেমালুম ভুলে গিয়ে।

জাহাজ ধরা সহজ নয়

গঙ্গাযাত্রার থেকে শুনেছি, খুব কম লোকই বেঁচে ফেরে। পদ্মযাত্রাও আমার কাছে প্রায় তাই।

যতবার পদ্মযাত্রায় বেরিয়েছি একটা না একটা বিপদ ঘটেছেই। একবার তো আমার খুড়তুতো বোনকে শ্বশুরবাড়ি দিতে গিয়ে ….না, সে দুঃখের কথা কেন আর! ঠিক নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের মত না হলেও, নাকাল হবার কাহিনী তো বেটই।

পদ্মা আমার কাছে বিপদ-দা! আমার জীবনে বিপদের দান নিয়ে এসেছে বারবার।

সেই বিপদজ্জনক পথেই পা বাড়িয়েছি আবার। সাধের কলকাতা ছেড়ে আমার পদ্মাপারী মামার বাড়ি চলেছি এই গরমের ছুটিতে–আমের আশায়।

শেয়ালদা থেকে লালগোলার ঘাট–রেলগাড়ির লম্বা পাড়ি। সেখানে নেমে, পদ্মার ধারে গিয়ে গোদাগাড়ির ইস্টিমার ধরতে হয়। লালগোলার ঘাটে ইস্টিমারে চেপে পরপারে গোদাগাড়ির ঘাটে গিয়ে নামো, তারপর গোদাগাড়িরতে আবার চাপো রেলগাড়িতে। তারপরে প্রথম ইষ্টিশনই বুঝি

আমনুরা। ইষ্টিশনের নাম শুনেই সজল জিভে সেই আমের কথাই মনে পড়বে তোমার।

আমের রাজ্যের শুরু সেই আমনুরা থেকেই। তুমি মালদহের আমরাজ্যে এসে পড়লে–রাজ্যের আম যে যোগায় সেই মালদা। সারা বাংলায় যার সাম্রজ্য!

আমি অবিশ্যি আমনুরাতেই থামব না। আমনুরা ছাড়িয়ে–আরো কি কি সব পার হয়ে– ইংরেজবাজার পেরিয়ে–আরো কয়েক স্টেশন পরে পৌঁছব গিয়ে সামশিতে। আমের রাজ্য ভেদ করে–আমসত্ত্ব দেশের ওপর দিয়ে–অনেক-অনেক পরে নিজের গাঁয়ের ইষ্টিশনের গায়ে ভিড়ব গিয়ে–প্রায় আমসি হয়েই।

সামসি থেকে ফের এক হাঁটার পাল্লা-পাক্কা দশ মাইলের ধাক্কা–সারা পথটা পায়দলে যাও! ঘন্টা তিন-চার পায়দল যাবার পর তবেই আমাদের আমার মামাদের গ্রাম-চঞ্চল! আর সেই মামাতো–আমবাগান! ভাবতেই, ট্রেন থেকে নামতেই প্রাণে চাঞ্চল্য জাগল। লালগোলাতেই লালায়িত হয়ে উঠলাম–নিজেকে যেন একটু সজীব বোধ করলাম।

সুটকেশটা হাতে করেই পা চালালাম পাড়ের দিকে। শোনা ছিল, লালগোলার ইস্টিমারদের চালচলন সুবিধের নয়। কখন আসে, কখন যায়, তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। খুশি মতন আসে, খেয়ালমাফিক ছাড়ে। কিছু তার ঠিকঠিকানা নেই, কাজেই সব–আগে ঘাটে গিয়ে তার পাত্তা নেওয়া ভাল।

চলেছিলাম হনহন করে! মাঝপথে থামাল এক মেঠাইওয়ালা।

আরে বাবু এতো দৌওয়াচ্ছেন কেন? আইসন, গরম পুরী খাইয়ে যান!

হ্যাঁ, বসে-বসে তোমার পুরী খাই, আর এদিকে আমার ইস্টিমার ছেড়ে দিক!

জাহাজ ছাড়তে আখুন ঢের দেরি আছে। জানায় মিঠাইওয়ালা : আখুন তো সজ ভি হোয়নি। সাত বাজবে, আট বাজবে, সওয়া-দশ-ভি বাজ যাবে, বহুৎ পাসিনজর আসবে–ডেক-উক সোব ভরতি হোবে, তব তত ছোড়বে জাহাজ!

ওমা! এমনি ধারাই জাহাজ নাকি? জাহাজের গতিবিধি বুঝি ওই রকম? তা হয়ত হতেও পারে। এমনটাই যে হবে তার একটা আন্দাজও ছিল আমার …মামাদের মুখে শুনে শুনেই। শুনেছিলাম যে, গোদাগাড়ির ইস্টিমারের গদাইলস্কলি চাল! তবে আর হন্যে হয়ে ছুটে কি হবে? আমিও এদিকে জাহাজী কারবার লাগাই না কনে? জাহাজের হন্যে হয়ে ছুটে কি হবে? আমিও এদিকে জাহাজী কারবার লাগাই না কেন? জাহাজের অনুকরণে নিজের পেটের খোল ভর্তি করতে লাগি। আমার উদরও তো বলতে গেলে জাহাজের মতই উদার।

মিষ্টি-টিষ্টি আছে কিছু?

আছে না? কি চাহি আপনার? রসগুলা, পেঁড়া, বরফি, জিলাবি–সবকুছ। বহুৎ বাঢ়িয়া বাঢ়িয়া মিটাই বাবু!

তা বেশ তো? দেখলাও কেইসা বাঢ়িয়া? সব চীজ দেও দো–চারঠো। ইস্টিমার যতক্ষণ না ছাড়ে ততক্ষণ তোমার মিষ্টি মারা যাক। ইস্টিমারকে সামনে রেখে আমার ইষ্টের সাধনায় লাগি। দহিবড়া থেকে শুরু করে, বরফি রসগোল্লা জিলাবি সাবড়ে, এমনকি, লাড্ড পর্যন্ত পান করতে বাকি রাখি না কিছুই। পেঁড়াও গোটা-চার পাচার করি।

খাবার মাঝখানে ইস্টিমারের বাঁশি কানে বাজে। চমকে উঠি–অ্যাঁ। ছাড়লো নাকি ইস্টিমার? মেঠাইওয়ালা কিন্তু ভরসা দেয়–ঘাবড়াইয়ে মৎ বাবু! উ তো পহলী আওয়াজ। ওই রোকম চার-চার দফে ভোঁ-ভো কোরবে তব তো ছাড়বে জাহাজ। দশ-দশ মিনিট যাবে, অউর এক-এক ভোঁ ছোড়বে।

ও, তাই নাকি? শুনে একটু ভরস পাই। তা-তাতো হতেই পারে ইস্টিমার তো ইংরেজি ব্যাকরণে স্ত্রীলিঙ্গই? প্রোনাউনে She! আর মেয়েরা কি একবার আসি বলে বিদায় নিতে পারে? নিয়েছে কখনো? বিনিকেই তো দেখছি, আসি ভাই, আসি ভাই, অন্ততঃ বিরাশীবার না বলে কিছুতেই নড়বে না!

আমি তখন আরো গোটাকয়েক মণ্ডা ঠাসি! মন ঠাণ্ডা করে।

তারপর হালকা-মনে হেলতে-দুলতে ইস্টিমার-ঘাটের দিকে এগোই। ঘাট পেরিয়ে জেটির ডেকে পা দিয়ে দেখি–ওমা একি! আমার ইষ্টিমার যে মাঝপদ্মায়! আমার জন্যে অপেক্ষা না করে নিজেই জেটির মায়া কাটিয়েছে!

সর্বনাশ! আবার কখন আসবে ইস্টিমার? খালাসীদের কাছে জানা গেল যে কাল সকালের আগে নয়। শুনে নিজের ওপর যতো না, তার চেয়ে বেশি রাগ হলো মিঠাইওয়ালার ওপর। সে কেন তার মিঠে বুলিতে এমন করে আমায় মজাল? মজা পেয়েছে?

তাকে পাকড়ালাম গিয়ে তক্ষুণি।

আমার গালাগাল সে অম্লানবদনে হজম করলো। তারপরে নিজের গালে হাত দিলো ঈস! হামকো ভি তো খেয়াল ছিলো না বাবু! আজ হাটবার ছিল যে! হাট-কা আদমি যেতো ফিরোৎ গিলো না? উসি—বাস্তে–জাহাজ জলদি ভোরে গিলো আর ছেড়ে ভি দিলো জলদি।

কিন্তু এই জলদিতে আমার আগুন নিভলো না।–তব-তব-তুম কাহে এইসা ঝুটমুঠ বাতলায়কে আমাকে তকলিফ দিলে?

তকফিল কেনো হোবে বাবু? একঠো একরাত কো বাত তো? আপনি হামার দু-কানে আইসুন ওহি হামার দুকান! মেঠাইওয়ালা অদূরে পথের ধারে তার খেড়োঘরের আটচালার দিকে আঙুল ছোঁড়ে–উখানে হামি থাকে। হামি আউর হামার বিটিয়া–লছমি। আজ রাতঠো হামার ঘরে থাকে, কাল সবেরে জাহাজমে চলিয়ে যান–পুরী-কাচৌরি খাকে নিদ যান খুশীসে-কুনো কসটো হোবে না। হামার পুরী-কছৌরিভি খুব উমদা চীজ আছে বাবু! লালগোলাকে কেতনা আমীর আদমী–

তোমার পুরীকচুরী খায়কে আধমরা হয়ে আছে। এই তো বলছো? তা আমি বুঝতা হ্যায়। কিন্তু বোঝা উচিত ছিলো অনেক আগে। কে জানে, তোমার ঐ সব গেলাবার মতলবেই তুমি আজ আমায় ইস্টিমার ফেল করাবে!

গজরাতে গজরাতে তার পিছু পিছু যাই। ঘরের সামনে গিয়ে সে হাঁক ছাড়ে–লছ মি? আরে বিটিয়া, এই বাবুকো–বাস্তে ই-ঘরমে হামরা খাঁটিয়াঠো…

দোকানের পাশের ঘরটিতে খাঁটিয়া পেতে আমার শোবার ব্যবস্থা সব সেই লছমিই করে দিলো, মেঠাইওয়ালার সেই মুখ-বুজে থাকা বাচ্চা মেয়েটি। আর সে নিজে তুলসীদাসী রামায়ণ পেড়ে তার লালটিম জ্বালিয়ে রামভজন গান করতে লাগল। নামেই লালটিম, আসলে কারো টি টিম্‌।

আর আমি আরেক দফা তার লাড্ডু-পেঁড়ার সঙ্গ রফা করে আমার খাঁটিয়ায় লম্বা হলাম। আর তার পরেই শুরু হল আমার দফা রফা! কী মশা রে বাবা সেখানে। আর যেমন মশা, তেমনই কি ছারপোকা। পদাতিকবাহিনী আর বিমানবহরে যেন যুগপৎ আমাকে আক্রমণ করল। ওপর থেকে–নীচের থেকে–এক সঙ্গে কামড়াতে লাগল আমায়। আগাপাশতলার কোথাও আর আস্ত রাখল না।

হাত পা ছুঁড়ে–এলোপাথাড়ি লাগলাম মশা তাড়াতে। কিন্তু কতো আর তাড়াবো? তাড়াবো কোথায়? পিন-পিন করে কোত্থেকে যে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে! আর সেই সঙ্গে লাখে লাখে ছারপোকাও! পিন পিন করে না এলেও, তাদের জাহাজে আলপিন নিয়ে আসার কসুন নেই। আর এদের রামভোজনের সঙ্গে তাল রেখে….. সেই সঙ্গে চলেছে মেঠাইওয়ালার রামভোজন।

ভোরের দিকে সারা গায়ে চাদরমুড়ি দিয়ে একটু ঘুমের মতো এসেছিলো বুঝি! তন্দ্রার ঘোরে আরেক দিনের ছবি দেখছিলাম! এই পদ্মাতেই আরেক যাত্রার ওই ইস্টিমারের বুকেই যে-কাণ্ডটা ঘটেছিল, তার ছবি কেমন করে জেগে উঠে আবার যেন আমার স্বপ্নালু চোখের ওপর ভাসছিল!

কী বিপদেই না পড়েছিলাম সেদিন-সেদিন এমনি এই পদ্মাতেই। সেই দুর্ঘটনার ঠেলাতেই না আমার ছোটবেলাকার তোতলামি সেরে গেল একবেলায়। একদিনেই জন্মের মতন। সেরকম দুর্দৈব যেন কারুর কখনো না হয়!….

সে-ই আরেক ইস্টিমারযাত্রা। পদ্মার বুকের ওপর দিয়ে চলেছি, পূর্ব্ব বাংলার মুলুকে– খুড়তুতো দিদির শ্বশুরবাড়িতে–দিদি আর জামাইবাবুর সঙ্গে। এইতো কবছর আগের কথা?

সেই প্রথম চেপেছি ইস্টিমারে। চেপে ফূর্তি হয়েছে এমন! ঘুরে-ঘুরে দেখছি চারদিকে। ইস্টিমার কেমন করে জল কেটে-কেটে যাচ্ছে! আঃ সে কী মজা!

আর, কী জোর হাওয়া রে বাব! উঠিয়ে নিয়ে যায় যেন। পদ্মার জলবায়ুর কী উপকারিতা কে জানে! গঙ্গার আর সমুদ্রের হাওয়া খেলে যেমন চেঞ্জের কাজ করে- জোর হয় গায় পদ্মার এই জোরালো-হাওয়ায় তেমনি হয়ে থাকে কিনা জানবার আমার কৌতূহল হয়।

জিজ্ঞাসু হয়ে জামাইবাবুর কাছে যাই। ব-বলি ও জা-জা-জা জাম-, বলতে গিয়ে কথাটা জাম হয়ে যায় গলায়।

ব-ব-বলছিলাম কি যে, এই চে-চে-চে-চে-চেঁ

এই চেঁচাচ্ছো কেন, হয়েছে কি? চেঁচিয়ে ওঠেন উনি নিজেই।

চে-চে-চেঁচাব কেন? ব-ব-বলছি যে, চে-চে-চে-চেইন…!

ঐ পর্যন্তই রইল। চেইন-কে আর ওর বেশি টানা গেল না।

না ইস্টিমারের চেইন থাকে না। ইস্টিমার কি রেলগাড়ি যে চেন থাকবে?

জবাব দিলেন জামাইবাবু।আর চেনের কথাই-বা কেন? চেন টেনে ইস্টিমার থামাবার কি দরকার পড়ল তোমার হঠাৎ, শুনি?

না-না, চে-চেইন না। চে-চে-চে-চে–জবাবদিহি দিতে গিয়ে আমার চোখ-মুখ কপালে উঠে যায়। কিন্তু ঐ চে-কারই সার, তার বেশি আর বার করা যায় না। তখন ভাবলাম যে, চেঞ্জ-কথাটা এই পাপ গলা দিয়ে যদি না গলতে চায়, তার বদলে বায়ু পরিবর্তনকেই না হয় নিয়ে আসি। কিন্তু শোনার ধৈর্য থাকলে তো জামাইবাবুর! চে-চে-চেন্না! ব-বলছি কি, যে বা-বা-বা-বা বা-বা-বাবা … কিন্তু মাঝ পথেই তিনি বাধা দিয়েছেন–বাবা রে-বাবা! পাগল করে দেবে নাকি?…বলেছি না তোমাকে? কতবার তো বলেছি যে তোমার যা বলবার তা গান করে বলবেশ করে সুরে ভেঁজে নিয়ে গাও? গানই হচ্ছে তোতলামির একমাত্র দাবাই। যদি সারাতে চাও তোমার এই তোতলামো তো গানের সাহায্য নাও। কেন, সুর খেলিয়ে বলতে কি হয়? আর সুর বার করা এমন কিছু শক্তও না। স্বরটা নাকের ভেতর দিয়ে বার করলেই সুর হয়। আর কিছু না থাক, নাক তো আছে?

তা তো আছে। কিন্তু তাই বলে হাতির মতন এমন কিছু লম্বা নাক নয় যে ইচ্ছে করলেই আমি শুঁড় খেলাতে পারবো? কিন্তু কথাটা আর মুখ খুলে বলার দুশ্চেষ্টা করি নে। মনে মনেই বলে বিমুখ হয়ে দিদির কাছে চলে যাই।

দিদি তখন ডেকের মেয়েলী এলাকায় রেলিঙের ধার ঘেষে পদ্মার শোভা দেখছিলেন। ইস্টিমারের দাঁত কেমন ঢেউ কেটে চলেছে, দেখছিলেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। দেখতে-দেখতে–

দেখতে না দেখতে তক্ষুণি আবার ছুটে আসতে হয়েছে তার বরের–সেই বর্বরের কাছেই আবার।

দি-দি-দি-দি-দি-দি…।

দিদির কথাটা ভাল করে বলতেই তার বাগড়া এল।–না, কিছু তোমার দিতে হবে না কিছু আমার চাইনে।

দি-দিচ্ছেনে তো–বলছি কি যে, তো-তো-তো-তো-তো।

অবার তোতলাতে লেগেছো? কি বললাম একটু আগে?

যা বললাম গান করে বলতে বলিনি? তিনি বেঁকিয়ে উঠলেন।

বলো, গান গেয়ে বলো! প্রাণ খুলে গাও, গান খুলে বাতলাও। আমি কান খুলে শুনি! শুনে আমার জন্ম সার্থক করি।

তখন বাধ্য হয়ে আমায় বাল্মীকি হতে হয়। তিনি যেমন ক্রৌঞ্চ বিরহে কাতর হয়ে তাঁর প্রথম শ্লোক ঝেড়েছিলেন, আমিও তেমনি মুখে-মুখে আমার গান বাঁধি–মনের দুঃখে :

ইস্টিমারে চেন থাকে না বলছিলে না মশায়,
কিন্তু থাকলে ভাল হতো এখন এরূপ দশায়।

বাঃ বাঃ বেশ! এই তো! এই তো খাসা বেরুচ্ছে। তিনি বাহবা দেন, বেশ সুরেলা হয়েই বেরুচ্ছে তো! তোফা!

ভগ্নকণ্ঠে আবার আমায় সুর নাড়তে হয়?

আমার দিদি, তোমার বৌ গো–
বলতে ব্যথা লাগে!
মরি হায় রে—

মরি হায় রে! মরে যাই–মরে যাই! বড়-বড় ওস্তাদের মতোই টিটকিরি মারতে শিখেছো দেখছি? তিনি টিটকিরি মারেন।

কিন্তু ওস্তাদি কাকে বলে জানি না, আমার গানের সুরগুলি নাকের থেকে- gun থেকে গুলির মতই শেষ পর্যন্ত না দেখে থামা যায় না–

মরি হায় রে!…
তোমার যে বৌ–আমার যে বোন–
বলতে বেদন জাগে।
জলে পড়ে গেছেন তিনি
মাইল তিনেক দূরে
মরি হায় হায় রে!!!

দুঃস্বপ্ন ভাঙতেই খাঁটিয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছি। কখন সকাল হলো? ইস, বড্ডো বেলা হয়ে গেছে যে! ইস্টিমার ধরতে পারলে হয় এখন!

সুটকেসটা তুলে নিয়েই ছুটলাম। পথে নামতেই সেই সদালাপী মেঠাইওয়ালা সামনে এল–আরে বাবু! জাহাজ ছোড়তে আবি বহু দেরি! জাহাজ আখুনো আসেই নাই! গরমাগরম পুরী ভাজিয়েছে–খাইয়ে যান!

তোমার পুরী আমার মাথায় থাক! বলে আমি মাথা নাড়ি : তোমার আর কি? তুমি খাইয়ে যাও, আর আমি খুইয়ে যাই! কালকেও তুমি ঐ কথাই বলেছিলে। ঐ বলে সারারাত তোমার ছারপোকা আর মশার কামড় খাইয়েছে। কিন্তু আর না!

সেই সঙ্গে সঙ্গীত–সুধা পানের কথাটা আর পাড়লাম না। পা বাড়ালাম। মনে মনেই বললাম, একবার নিজের পুরীতে গিয়ে যদি পৌঁছুতে পারি–আমনুরার গাড়ি ধরতে পারি যদি–তাহলে আসল মেঠাই খাবো আমার মামার বাড়ি। আমের চেয়ে মিঠে কিছু আর আছে নাকি? ঝুড়িখানেক আম আর এক গামলা ক্ষীর নিয়ে বসে যাও, খোসা ছাড়িয়ে ক্ষীরে ডুবিয়ে খোস মেজাজে থাকো। এক পয়সা খরচা নেই আমের পেছনে। আরামসে খাও। তারপর বিকেলে ছুরি হাতে বেরিয়ে পড়ো বাগানে, আমগাছের ডালে উঠে আমোদ করে! হনুমানদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাগো। আমের জন্যে কোন ব্যয় নেই। যা কিছু ব্যায়াম তা শুধু খাওয়ার। হাতের আর মুখের।

ছুটতে-ছুটতে ঘাটের কিনারায় পৌঁছই। পৌঁছেই দেখি–আঃ ঐ যে আমার ইস্টিমার সামনেই খাড়া! ধড়ে আমার প্রাণ এল এতক্ষণে। এক দৌড়ে জেটির কোলে গিয়ে পড়লাম।

জেটিতে ইস্টিমারে চারধারেই তাড়া। ভীষণ হৈ-চৈ। এ-খালাসী ডাকছে ও খালাসীকে ভাইয়া হো! ইস্টিমারও ডাকছে কাকে তা বলা কঠিন। কিন্তু তার দারুণ ভেঁয়েজ কানে তালা ধরিয়ে দেয়।

জেটির কিনারে ইস্টিমারের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ওমা, ইস্টিমার যে জেটির বাঁধ কেটেছেন! ইস্টিমারে আর জেটিতে তখন বেশ কিছুটা ফারাক! ইস্টিমারের পাটাতন ইস্টিমার ভিড়লে যেটি জেটির গায়ে এসে লাগে-সেতুবন্ধের মতই–যার ওপর দিয়ে যাত্রীরা ওঠে নামে–যায় আসে–গটগট করে হাঁটে– কুলীরা যতো মাল তোলে, নামায়–যার সঙ্গে ইস্টিমারের জ্যেঠতু্তো সম্পর্ক–সেই সম্পর্ক আর নেই।

সে-সম্বন্ধ ছিন্ন হয়েছে আমার আসার আগেই। ইস্টিমারের খালাসীরা তাদের পাটাতন তুলে নিতে যাচ্ছে…

এখন বুকের পাটা চাই। লালগোলায় ইস্টিমার ধরতে বেগ পেতে হবে বেশ–আমায় জানানো হয়েছিল বার-বার। সেই বেগ পেতে হলো এখন। আমি আগু-পিছু করি বেগ পাবো কি পাবো না? তারপর মারি একলাফ সবেগে। মরিয়া হয়ে পড়ি গিয়ে পাটাতনের ওপর পদ্মার ভগ্নাংশ পার হয়ে। গিয়ে বসে পড়ি। আমার কাণ্ড দেখে সবাই হৈ-হৈ করে ওঠে!

ইস্টিমারে–জোটির যতো লোক। কিন্তু কে কী বলছে, তা শোনার তখন কি আমার হুশ আছে! না কিছু দেখছি–না শুনছি! পায়ের তলায় পাটাতন পেয়েছি এই ঢের। মুহূর্তটাক বসে থাকি, তারপরে টলতে-টলতে উঠি-উঠে দাঁড়াই! সুটকেস আমার হাতে। তারপর আমার নজর, নীচের দিকে। পাটাতনের তলায়–ওমা, এ যে থৈ-থৈ জল! দেখে আবার আমি বসে পড়ি। পাটাতনের নীচেই পদ্মার বিস্তার! আমার মাথা ঘুরতে থাকে।

উপুড় হয়ে পড়ি আবার–পাটাতনের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটি…আস্তে আস্তে এগুতে থাকি…সুটকেস টানতে টানতে। দিচ্ছি তো দিচ্ছিই হামাগুড়ি। যেন এর শেষ নেইকো। ইস্টিমারের ডেক মনে হয়, মাইল দেড়েক দূরে। যাই হোক, যত দেরিই হোক, গুঁড়ি মেরে মেরে পৌঁছালাম গিয়ে। উঠলাম ডেকে। তখন দেহের সাথে সাথে সারা মনও যেন আমাকে ডেকে উঠল–পেয়েছি! পেয়ে গেছি!!

ডুকরে উঠল মনের থেকে ধন্যবাদ বিধাতার উদ্দেশ্যে ইস্টিমারের উদ্দেশ্যে আমার নিজের উদ্দেশ্যে মুখর হয়ে ডেকের উপর নিজেকে রেখে হাঁপাতে থাকলাম।

নাঃ, আর না–আর ককখনো না। কদাপি আর এমন বিপজ্জনক কাজে হাত দেবো না–হাত পা কোনাটাই নয়। শপথ করি নিজের মনে। মা দুর্গার দয়ায় বড্ডো বেঁচে গেছি এ-যাত্রা।

হুঁশ হতে দেখলাম, এক-জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে।

নীল পোশাকে এক খালাসী।

ঈস! ইস্টিমার–ধরা কি চাট্টিখানি? হাঁপ ছেড়ে আমি বলি কিন্তু ধরতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত। কি বল খালাসী সায়েব?

খালাসীটা হাসল-–কি দরকার ছিল বাবু এত মেহনতের? জাহাজ তো আমরা ভেড়াচ্ছিলাম জেটিতেই। খানিক পরে এমনি আসতেন–হেঁটেই আসতেন সোজা। সবুর করলেই পারতেন একটু।

অ্যাঁ? তাই নাকি? তখন আমার খেয়াল হলো। হ্যাঁ, তাও হতে পারে। পাটাতন তুলছিল না, নামাচ্ছিলই খালাসীরা। নামিয়ে জেটির গায়ে লাগানো হচ্ছিল–বুঝতে পারলাম তখন।

তাকিয়ে দেখলামও তাই। গোদাগাড়ির সোরগোল করে লালগোলার জেটির কোলে এসে ভিড়েছে। জ্যেঠতুতো সম্পর্কের আত্মীয়তা সুনিবিড় হয়েছে এতক্ষণে।

ওপারে যাত্রীদের নিয়ে ইস্টিমারটা এসে পৌঁছল সেই মাত্তর!

 জোড়া ভরতের জীবন কাহিনী

বেশ কিছুদিন আগের কথা। গত শতাব্দীর শেষের দিকে, তখন তোমরা আসোনি পৃথিবীতে। আমিও আসব কিনা তখনো আন্দাজ করে উঠতে পারছিলাম না। সেই সময়ে বারাসতে এই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটেছিল। অবশ্য তারপর আমিও এসেছি, তোমারাও এসেছ। আমি আসার কিছুদিন পরেই দিদিমার কাছে গল্পটি শুনি। তোমাদের দিদিমারা নিশ্চয়ই বারাসতের নন, কাজেই তোমাদের শোনাবার ভার আমাকে নিতে হল।

সেই সময় একদা সুপ্রভাতে বারাসতে রামলক্ষ্মণ ওঝার বাড়িতে যমজ ছেলে জন্মালো। যমজ কিন্তু আলাদা নয়–পেটের কাছটায় মাংসের যোজক দিয়ে আশ্চর্য রকমে জোড়া। সেই অদ্ভুত লক্ষণ রামলক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন–আমার বরাতের জোর বলতে হবে। লোকে একেবারে ছেলেই পায় না, আমি পেলাম দু-দুটো–একসঙ্গে এবং একাধারে।

ডাক্তার এসে বলেছিল–কেটে আলাদা করার চেষ্টা করতে পারি কিন্তু তাতে বাঁচবে কিনা বলা যায় না।

রামলক্ষ্মণ বললেন–উঁহু-হুঁ! যেমন আছে তাই ভাল। ভগবান দিয়েছেন, কপালের জোরে ওরা বেঁচে থাকবে।

ছেলেদের নাম দিলেন তিনি রামভরত ও শ্যামভরত।

পৌরাণিক যুগে জড়ভরত ছিল, তার বহুকাল পরে কলিযুগে এই বিস্ময়কর আবির্ভাব জোড়াভরত।

জোড়াভরত প্রতিদিনই জোরালো হয়ে উঠতে লাগল। ক্রমশ হামাগুড়ি দিতেও শুরু করল। চার হাতের চার পায়ের সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। কে একজন যেন মুখ বেঁকিয়েছিল–ছেলে না তো, চতুস্পদ! রামলক্ষ্মন তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করেছেন–চতুর্ভুজও বলতে পার।সাক্ষাৎ ভগবান! সকালে উঠেই মুখ দেখি, মন্দ কি! তারপর পুনশ্চ জোড় দিয়েছেন–হ্যাঁ, নেহাত মন্দ কি?

ক্রমশ তারা বড় হল। ভায়ে-ভায়ে এমন মিল কদাচ দেখা যায় না। পরস্পরের প্রতি প্রাণের টান তাদের এত প্রবল ছিল যে কেউ কাউকে ছেড়ে একদণ্ডও থাকতে পরে না। তাদের এই অন্তরঙ্গতা যে-কেউ লক্ষ্য করেছে সেই ভবিষয়দবাণী করেছে যে, এদের ঘনিষ্ঠতা বরাবর, থাকবে, এদের ভালবাসা চিরদিনের। সকলেই বলেছে যে, ভাই ভাই ঠাই ঠাই একটা প্রবাদ আছে বটে, কিন্তু যে রকম ভাবগতিক দেখা যাচ্ছে তাতে এদের দু-ভাইয়ের মধ্যে কখনো ছাড়াছাড়ি হবে, দুঃস্বপ্নেও এমন আশঙ্কা করা যায় না। এদের আত্মীয়তা কোনেদিন যাবার নয়, নাঃ বাঙলা দেশে আদর্শ ভ্রাতৃত্বের জন্যে মেডেল দেবার ব্যবস্থা সে সময়ে থাকলে সে মেডেল যে ওদেরই কুক্ষিগত হত একথা অকুতোভয়ে বলা যায়।

দু ভায়ে একসঙ্গেই খেলা করত, একসঙ্গে বেড়াত, একসঙ্গে খেত, আঁচাত এবং ঘুমোত অন্য সব লোকের সঙ্গ তারা একেবারেই পছন্দ করত না। সব সময়েই তারা কাছাকাছি থাকত, একজনকে ছেড়ে আরেকজন খুব বেশি দূরে যেত না। রামলক্ষ্মণের গিন্নি তাদের এই সুগুণের কথা জানতেন, এই কারণে যদি কখনো কেউ হারিয়ে যেত, স্বভাবতই তিনি অন্যজনের খোঁজ করতেন। তাঁর অটল বিশ্বাস ছিল যে একজনকে যদি খুঁজে পান তাহলে আরেকজনকে অতি সন্নিকটেই পাবেন। এবং দেখা গেছে তার ভুল হত না।

আরও বড় হলে রামলক্ষ্মণ ওদের গরু দুইবার ভার দিলেন। রামলক্ষ্মণের খাটাল ছিল। সেই খাটালে গরুরা বসবাস করত, তাদের দুধ বেচে ওঝা মহাশয়ের জীবিকা নির্বাহ হত। রামভরত গরু দুইত, শ্যামভরত তার পাশে দাঁড়িয়ে বাছুর সামলাতে–কিন্তু সবদিন সুবিধে হয়ে উঠত না। এক একদিন দুরন্ত বাছুরটা অকারণ পুলকে লাফাতে শুরু করত। শ্যামভরতকেও তার সঙ্গে লাফাতে হত, তখন রামভরতের না লাফিয়ে পরিত্রাণ ছিল না। রামভরতের হাতে দুধের বালতিও লাফাতে ছাড়ত না এবং দুধের অধঃপতন দেখে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে রামলক্ষ্মণ স্বয়ং লাফাতেন।

এত লাফালাফি সহ্য করতে না পেরে রামলক্ষ্মণের গিন্নি একদিন বলেই ফেললেন–দুধের বাছা, ওরা কি দুধ দুইতে পারে?

রামলক্ষ্মণ বিরক্তি প্রকাশ করেছেন–নাঃ, কিছু হবে না ওদের দিয়ে। ইস্কুলেই দেব, হ্যাঁ।

ইস্কুলের নামে দু-ভায়ের মুখ শুকিয়ে একটুকু হয়ে গেল।

একদিন তো বাছুরটা শ্যামভরতকে টেনে নিয়ে ছুটতে আরম্ভ করল। রামভরতকে তখন দুধ দোয়া স্থগিত রেখে, অগত্যা বাছুর এবং ভায়ের সঙ্গে দৌড়তে হল।

রামলক্ষ্মণ সেদিন স্পট্টই বলে দিলেন–না তোরা আর মানুষ হবি না। যা, তবে ইস্কুলেই যা তাহলে।

ইস্কুলে গিয়ে দু-ভায়ের অবস্থা আরো সঙ্গীন হল। একসঙ্গে ইস্কুলে যায়, ইস্কুল থেকে আসে। কিন্তু সেকথা বলছি না। মুশকিল হল এই, এক ভাই লেট করলে আরেক ভায়ের লেট হয়ে যায়। সেই অপরাধের সাজা দিতে এক ভাইকে কনফাইন করলে আরেক ভাই তাকে ফেলে বাড়ি চলে আসতে পারে না, তাকেও আটকে থাকতে হয়। বিনা দোষেই। একজন যদি পড়া না পারে এবং তাকে মাষ্টারমশাই বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন, তখন অন্য ভাইকে নিখুঁত ভাবে পড়া দেওয়া সত্ত্বেও, সেইসঙ্গে বেঞ্চে দাঁড়াতে হয়। সবচেয়ে হাঙ্গামা বাধল সেইদিন যেদিন দুজনের কেউই পড়া পারল না আর মাষ্টার বললেন একজনকে বেঞ্চে দাঁড়াতে, আরেকজনকে মেঝেতে নিলডাউন হতে। মাষ্টারের হুকুম পালন করতে দুজনেই প্রাণপণ চেষ্টা করল খনিকক্ষণ। কিন্তু দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। ধুত্তোর বলে সেইদিন তারা ইস্কুল ছাড়ল–ও মুখোই হল না আর।

বাড়িতে বাবাকে এসে বলল–মানুষ হবার তো আশা ছিলই না, তুমিই বলে দিয়েছ! অমানুষ হবার চেষ্টা করলাম, তাও পারা গেল না।

শ্যামভরত ভায়ের কথায় সায় দিয়েছে–অমানুষিক কাণ্ড আমাদের দ্বারা হবার নয়। নিলডাউন আর বেঞ্চে দাঁড়ানো। দুটো একসঙ্গে আবার।

তারপর থেকে রামলক্ষ্মণ ছেলেদের আশা একেবারেই ছেড়েছেন।

ওরা যখন যুবক হয়ে উঠল তখন ওদের মধ্যে এক-একটু গরমিলের সূত্রপাত দেখা গেল। রামভরত ভোরের দিকটায় ঘুমাতেই ভালবাসে। তার মতে সকালবেলায় ঘুমটাই হচ্ছে সবচেয়ে উপাদেয়। কিন্তু শ্যামভরতের সেই সময়ে প্রাতভ্রমণ না করলেই নয়। ভোরের হাওয়ায় নাকি গায়ের জোর বাড়ে। বাধ্য হয়ে আধ-ঘুমন্ত রামভরতকে ভায়ের সঙ্গে বেরুতে হয়।

মাইল-পাঁচেক হেঁটে হাওয়া খেয়ে শ্যামভরত ফেরে, ক্লান্ত রামভরত তখন শুতে পারলে বাঁচে। ঘুমোতে ঘুমোতে ভায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে সেই কখন, আর দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরল এই এখন এরকম অবস্থায় কার না পা জড়িয়ে আসে, কে না গড়াতে চায়? কিন্তু শ্যামভরত তখন-তখনই আদা ছোলা চিবিয়ে ডনবৈঠক করতে লাগবে–কাজেই রামভরতের আর গড়ানো হয় না, ভাইয়ের সঙ্গে ওঠবোস করতে হয়।

ব্যায়াম সেরেই শ্যামভরত স্নান সারবে। রামভরত বিছানার দিকে করুণ দৃষ্টিপাত করে তেল মাখতে বসে–কী করবে? স্নান সেরেই শ্যামভরতের রুটির থালার সামনে বসা চাই–সমস্ত রুটিন বাঁধা। ব্যায়াম করেছে, ভোরে হেঁটেছে, তার চো চো খিদে। বেচারা রামভরতের রাত্রে ঘুম হয়নি, ভোরেও তাকে জাগতে হয়েছে, দারুণ হাঁটাহাঁটি। তারপর ফিরে এসেই এক মুহূর্ত পায়নি–গরহজম হয়ে এখন তার চোঁয়া ঢেকুর উঠছে।

সে বলেছে–এখন খিদে নেই, পরে খাবো।

ভাই ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছে–পরে আবার খাবি কখন? পরে আমার আবার কখন সময় হবে? আমার কি আর? অন্য কাজ নেই?

সে জবাব দিয়েছে–আমার খিদে নেই এখন।

শ্যামভরত চটে গেছে–খিদে নেই, কেবল খিদে নেই! কেন যে খিদে হয় না আমি তো বুঝি না। কেন, তুমিও তো ব্যায়াম করেছ বাপু! তবে? খিদেয় আমি মরে যাচ্ছি, আর তোমার খিদে নেই–এ কেমন কথা?

কাজেই রামভরতকে গরহজমের ওপরেই আবার গলাধঃকরণ করতে হয়েছে।

খাওয়া-দাওয়া সেরে, প্রথম সুযোগেই ভাইকে বিছানার দিকে টেনে নিয়ে গেছে। এবার একটু শুলে হয় না?

শোয়া আর শোয়া! দিনরাত কেবল শোয়া! কী বিছানাই চিনেছ বাবা!–শ্যামভরত গম্ভীরভাবেই ছিপ হাতে নেয়।

এই দুপুর রোদে দারুণ গরমে তুমি মাছ ধরতে যাবে?–রামভরত ভীত হয়ে ওঠে।

যাবই তো।–শ্যামভরত বলে–কেবল শুয়ে শুয়ে হাড় ঝরঝরে হবার জোগাড় হল। তোমার ইচ্ছে হয় তুমি পড়ে ঘুমোও, আমি মাছ ধরতে চললুম।

শ্যামভরতের গায়ে জোর বেশি, টানও প্রবল। কাজেই কিছু পরেই দেখা যায়, শ্যামভরত মাছ ধরতে আর রামভরতকে তার কাছে চুপটি করে বসে থাকতে হয়েছে।

বেলা গড়িয়ে আসছে, এক ভাই মাছ ধরে, আরেক ভাই পাশে বসে ঢুলতে থাকে।

এইভাবে দু-ভাই ক্রমশ আরো বড় হয়ে ওঠে।

একদা বাপ রামলক্ষ্মণ বললেন–বড় হয়েছিস, এবার একটা কাজকর্মের চেষ্টা দ্যাখ। বসে বসে খাওয়া কি ভাল?

বসে বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে কিম্বা দৌড়তে দৌড়তে কী ভাবে খাওয়াটা সবচেয়ে ভাল সে সম্বন্ধে জোড়া ভরত কোনদিন ভাবেনি,কাজেই অনিচ্ছাসত্ত্বে বাপের কথা মেনে নিয়েই চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।

গাট্টা-গোট্টা চেহারা দেখে একজন ভদ্রলোক শ্যামভরতকে দারোয়ানির কাজে বহাল করলেন। কিন্তু রামভরতকে কাজ দিতে তিনি নারাজ। শ্যামভরত দিনরাতক পাহারা দেয়, রামভরতও ভায়ের সঙ্গে গেটে বসে থাকে।

ভদ্রলোক শ্যামভরতের খোরাকি দেন। রামভরতকে কেন দেবেন? রামভরত তো তার কোনো কাজ করে না। সে যে গায়ে পড়ে, উপরন্তু তাঁর বাড়ি পাহারা দিয়ে দারোয়ানির কাজে বিনে-পয়সায় অমনি পোক্ত হয়ে যাচ্ছে তার জন্যে যে তিনি কিছু চার্জ করেন না এই যথেষ্ট।

তিন দিন না খেয়ে থেকে রামভরত মরিয়া হয়ে উঠল, বললে–আমি তাহলে গাড়োয়ানিই করব।

এই না বলে গরুর গাড়ির একজন গাড়োয়ানের সঙ্গে, কেবল খাওয়া- পরার চুক্তিতে অ্যাপ্রেনটিস্ট নিযুক্ত হয়ে গেল।

এরপর রামভরত গাড়োয়ানি করতে যায়। শ্যামভরতকেও ভায়ের সঙ্গে যেতে হয়। উক্ত সদর দ্বারা বিনা রক্ষণাবেক্ষণে পড়ে থাকে। কোনদিন বা শ্যামভরত দরজা কামড়ে পড়ে থাকে সেদিন আর রামভরতের গাড়োয়ানিতে যাওয়া হয় না।

অবশেষে একদিন এক কাণ্ড হয়ে গেল। ক্ষুধাতুর রামভরত থাকতে না পেরে বাগানের এক কাঁদি মর্তমান কলা চুরি করে খেয়ে বসল। শ্যামভরত ভাইকে বারণ করেছিল কিন্তু ফল হয়নি। তখন থেকে শ্যামভরতের মনে বিবেকের দংশন শুরু হয়ে গেছে।

কর্তা তাকে পাহারা দেবার কাজে বহাল করেছেন। চুরি-চামারি যাতে না হয়, তা-ই দেখাই তো তার কর্তব্য। কিন্তু এ চুরি যে কেবল তার চোখের সামনেই হয়েছে তা নয়, সে একে বাধা দেয়নি, দিতে পারেনি; এমন কি একরকম প্রশ্রয়ই দিয়েছে বলতে গেলে। তার কি, এতে কর্তব্যের ক্রটি হয়নি? এ কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়? কে বড়? ভাই, না বর্তমান কলা?

অবশেষে আর থাকতে না পেরে, শ্যামভরত চুরির কথাটা কর্তার কাছে বলেছে। কর্তা হুকুম দিয়েছেন–চোরকে পাকড় লেয়াও।

চোর পাকড়ানো অবস্থাতেই ছিল, সুতরাং তাকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। কর্তা তৎক্ষণাৎ রামভরতকে শ্যামভরতের সাহায্যে থানায় ধরে নিয়ে পুলিশের হাতে সমর্পণ করেছেন।

সাতদিনে ধরে বারাসতের আদালতে এই চুরির বিচার চলেছিল। রামভরত আসামী, শ্যামভরত সাক্ষী। রামভরত আসামীর কাঠগড়ায়, তার হাতে হাতকড়া–শ্যামভরত ভায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। আবার শ্যামভরত যখন জবানবন্দী দেয় তখন রামভরতকে ভায়ের সঙ্গে সাক্ষীর কাঠগড়ায় আসতে হয়।

অবশেষে রামভরতের একমাস জেলের হুকুম দিলেন হাকিম। রামভরতকে জেলে নিয়ে গেল, কিন্তু শ্যামভরতকেও সেই সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়। অথচ শ্যামভরতের জেল হয়নি। মহা মুশকিল ব্যাপার। নির্দোষের অকারণ সাজা হতে পারে না। অগত্যা রামভারতকে জেল থেকে খালাস দিতে হল।

খালাস পাওয়া মাত্র রামভরত বলা নেই কাওয়া নেই, ভাইকে ঠ্যাঙাতে শুরু করে দেয়। তাদের জীবনে প্রথম ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব। শ্যাম রামকে ঘুসি মেরে ফেলে দেয় সঙ্গে সঙ্গে নিজেও গিয়ে পড়ে তার ঘাড়ে, তারপর দুজনে জোড়াজড়ি, হুটোপাটি, তুমুল কাণ্ড।

রাস্তার লোকেরা মাঝে পড়ে বাধা দেয়। দুজনকে আলাদা করবার চেষ্টা করে। কিন্তু আলাদা করতে পারে না। অল্পক্ষণেই বুঝতে পারে,দুজনকে তফাৎ করা তাদের ক্ষমতার অসাধ্য। কাজেই তাদের ছেড়ে দেয় পরস্পরের হাতে। তারাও মনের সুখে মারামারি করে। অবশেষে দুজনেই জখম হয়, তখন দুজনকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়–একই স্ট্রেচারে।

হাসপাতাল থেকে ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে ছেড়ে দেবার পর দুজনে বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি চলে, কিন্তু কেউ একটি কথা বলে না। রামভরত গুরুগম্ভীর, শ্যামভরত ভারি বিষণ্ণ। রামভরত আস্তে হাঁটে, মাঝে-মাঝে কপালের ঘাম মোছে। শ্যামভরত থেকে-থেকে ঘাড় চুলকোয়। সেই ফাঁকে আড়চোখে ভায়ের মুখের ভাব লক্ষ্য করার চেষ্টা করে।

দু-ভাই চুপ-চাপ হেঁটে চলে।

অবশেষে রামভরত আফিমের দোকানের সামনে এসে পৌঁছয়। একটা টাকা ফেলে দেয় দোকানে। এক ভারি আফিম কেনে, কিনেই মুখে পুরে দেয় তৎক্ষণাৎ।

শ্যামভরত ব্যস্ত হয়ে ওঠে, রামভরত কিন্তু উদাসীন। শ্যামত মাথা চাপড়ায়, রামভরত এক ঘটি জল খায়। শ্যামভরত চায় ভাইকে নিয়ে তখুনি আবার হাসপাতালের দিকে ছুটতে। রামভরত কিন্তু দেওয়াল ঠেস দিয়ে একটা খাঁটিয়ায় বসে পড়ে। শ্যামভরত তখন কেঁদে ফেলে–একী করলি ভাইয়া।

রামভরত ভারী গলায় জবাব দেয়–কলা খেলে আফিম খেতে হয়।

আচ্ছা এবার তুই যত খুশি কলা খাস, আমি আর বলব না। শ্যামভরত লুটিয়ে পড়তে চায় মাটিতে।

রামভরত গম্ভীর হয়ে ওঠে–আফিম খেলে আর কলা খেতে হয় না।

এই কথা বলে সে খাঁটিয়ার ওপর সটান হয়। দেখতে দেখতে রামভরত মারা যায়।

আর শ্যামভরত?

শ্যামভরতকে যেতে হয়ে সহমরণে।

ডাক্তার ডাকলেন হর্ষবর্ধন

বউয়ের ভারী অসুখ মশাই। কোন ডাক্তারকে ডাকা যায় বলুন তো? হর্ষবর্ধন এসে শুধোলেন আমায়।

কেন, আমাদের রাম ডাক্তারকে? বললাম আমি। তারপর তাঁর ভারী ফিজ –এর কথা ভেবে নিয়ে বলি আবার : রাম ডাক্তারকে আনার ব্যয় অনেক, কিন্তু ব্যায়রাম সারাতে তাঁর মতন আর হয় na।

বলে বৌয়ের আমার প্রাণ নিয়ে টানাটানি, আমি কি এখন টাকার ভাবছি নাকি। তিনি জানান- বউয়ের আমার আরাম হওয়া নিয়ে কথা।

কি হয়েছে তার? আমি জানতে চাই।

কী যে হয়েছে তাই তো বোঝা যাচ্ছে না সঠিক। এই বলছে মাথা ধরেছে, এই বলছে দাঁত কনকন, এই বলছে পেট কামড়াচ্ছে…..

এসব তো ছেলেপিলের অসুখ, ইস্কুলে যাবার সময় হয়। আমি বলি–তবে মেয়েদের পেটের খবর কে রাখে। বলতে পারে কেউ?

বউদির পেটে কিছু হয়নি তো দাদা। জিজ্ঞেস করে গোবরা। দাদার সাথে সাথেই সে এসেছিল।

পেটে আবার কি হবে শুনি? ভায়ের প্রশ্নে দাদা কুঞ্চিত করেন : পেটে তো লিভার পিলে হয়ে থাকে। তুই কি লিভার পিলের ব্যামো হয়েছে, তাই বলছিস?

আমি ছেলেপিলের কথা বলছিলাম।

ছেলেপিলে হওয়াটা কি একটা ব্যামো নাকি আবার?

হর্ষবর্ধন ভায়ের কথায় আরো বেশি খাপপা হন : সে হওয়া তো ভাগ্যের কথা রে। তেমন ভাগ্য কি আমাদের হবে? বলে তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন।

হতে পারে মশাই। গোবরা ভায়া ঠিক আন্দাজ করেছে হয়ত। ওর সমর্থনে দাঁড়াই : পেটে ছেলে হলে শুনেছি অমনটাই নাকি হয় মাথা ধরে, গা বামি করে, পেট কমড়ায়…ছেলেটাই কামড়ায় কি না কে জানে।

ছেলের কামড়ের কথায় কথাটা মনে পড়ে গেল আমার…

হর্ষবর্ধনের এক আধুনিকা শ্যালিকা একবার বেড়াতে এসেছিলেন ওঁদের বাড়ি একটা বাচ্চা ছেলেকে কোলে নিয়ে।

ফুটফুটে ছেলেটিকে দেখে কোলে করে একটু আদর করার জন্য নিয়েছিলাম, তারপরে দাঁত গজিয়েছে কিনা দেখবার জন্যে যেই না ওর মুখের মধ্যে আঙুল দিয়েছি উফ। লাফিয়ে উঠতে হয়েছে আমায়।

কি হলো কি হলো? ব্যস্ত হয়ে উঠলেন হর্ষবর্ধনের বউ।

কিছু হয়নি। আমি বললাম : একটু দন্তস্ফুট হল মাত্র। হাতে হাতে দাঁত দেখিয়েছে ছেলেটা।

ছেলের মুখে আঙুল দিলেন যে বড়? রাগ করলেন হর্ষবর্ধনের শালী ও আঙুলটা আপনার অ্যান্টিসেপটিক করে নিয়েছিলেন?

অ্যান্টিসেপকি? ও কথাটায় অবাক হই। সে আবার কি?

লেখক নাকি আপনি? হাইজীনের জ্ঞান নেই আপনার? বলে একখানা টেকসট বই এনে আমার নাকের সামনে তিনি খাড়া করেন। তারপরে আমি চোখ দিচ্ছি না দেখে খানিকটা তার তিনি নিজেই আমায় পড়ে শোনান :

শিশুদের মুখে কোন খাদ্য দেবার আগে সেটা গরম জলে ফুটিয়ে নিতে হবে…

আঙুল কি একটা খাদ্য না কি? বাধা দিয়ে মুধান হর্ষবর্ধন পত্নী।

একদম অখাদ্য। অন্ততঃ পরের আঙুল তো বটেই। গোবরভায়া মখু গোমড়া করে বলে?

নিজের আঙুল কেউ কেউ খায় বটে দেখেছি, কিন্তু পরের আঙুল খেতে কখনো কাউকে দেখা যায় নি।

আঙুল আমি ফুটিয়ে নিইনি সে কথা ঠিক, আমতা আমতা করে আমরা সাফাই গাই : তবে আপনার ছেলেই আঙুলটা আমায় ফুটিয়ে নিয়েছে। কিম্বা ফুটিয়ে দিয়েছে…যাই বলুন। এই দেখুন না।

বলে খোকার দাঁত বসানোর দগদমে দাগ তার মাকে দেখাই। ফুটফুটে বলে কোলে নিয়েছিলাম কিন্তু এতটাই যে ফুটবে তা আমার ধারণা ছিল না সত্যি।

রাম ডাক্তারকে আনবার ব্যবস্থা করুন তাহলে। বললাম হর্ষবর্ধন বাবুকে?

কল দিন তাঁকে এক্ষুনি। ডাকান কাউকে পাঠিয়ে।

ডাকলে কি তিনি আসবেন? তাঁর সংশয় দেখা যায়।

সে কি। বল পেলেই শুনেছি ডাক্তাররা বিকল হয়ে পড়ে না এসে পারে কখনো? উপযুক্ত ফী দিলে কোন ডাক্তার আসে না? কী যে বলেন আপনি।

ডেকেছিলাম একবার। এসেও ছিলেন তিনি। কিন্তু জানেন তো, আমার হাঁস মুর্গি পোর বাতিক। বাড়ির পেছনে ফাঁকা জায়গাটায় আমার কাঠ চেরাই কারখানার পাশেই পোলট্রির মতন একটুখানি করেছি। তা হাঁসগুলো আমার এমন বেয়াড়া যে বাড়ির সামনেও এসে পড়ে এক এক সময়। রাম ডাক্তারকে দেখেই না সেদিন তারা এমন হাঁক ডাক লাগিয়ে দিল যে….

ডাক্তারকেই ডাকছিল বুঝি?

কে জানে। তাদের আবার ডাক্তার ডাকার দরকর কি মশাই? তারা কি চিকিচ্চের কিছু বোঝে? মনে তো হয় না। হয়ত তার বিরাট ব্যাগ দেখেই ভয় খেয়ে ডাকাডাকি লাগিয়েছিল তারা, কিন্তু হাঁসদের সেই ডাক শুনেই না, গেট থেকেই ডাক্তারবাবু বিদায় নিলেন, বাড়ির ভেতরে এলেনই না আর। রেগে টং হয়ে চলে গেলেন একেবারে।

বলেন কি? শুনে আমি অবাক হই।

হ্যাঁ মশাই। তারপর আরো কতবার তাঁকে কল দেয়া হয়েছে মোটা ফীয়ের লোভ দেখিয়েছি। কিন্তু এ বাড়ির ছায়া মাড়াতেও তিনি নারাজ।

আশ্চর্য তো। কিন্তু এ পাড়ায় ভাল ডাক্তার বলতে তো উনিই। রাম ডাক্তার ছাড়া তো কেউ নেই এখানে আর…

দেখুন, যদি বুঝিয়ে সুঝিয়ে কোনো রকমে আপনি আপতে পারেন তাঁকে… হর্ষবর্ধন আমার অনুনয় করেন।

দেখি চেষ্টা চরিত্র করে, বলে আমি রাম ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সত্যি একেকটা ডাক্তার এমন অবুঝ হয়। এই রাম ডাক্তারের কথাই ধরা যাক না।

সেবার পড়ে গিয়ে বিনির একটু ছড়ে যেতেই বাড়িতে এসে দেখবার জন্যে তাঁকে ডাকতে গেছি, কিন্তু যেই না বলছি, ডাক্তারবাবু, পড়ে গিয়ে ছড়ে গেছে যদি এসে একটু দয়া করে…

ছড়ে গেছে? রক্ত পড়ছে?

তা একটু রক্তপাত হয়েছে বই কি।

সর্বনাশ। এই কলকাতা শহরে পড়ে গিয়ে ছড়ে যাওয়া আর রক্তপাত হওয়া ভারি ভয়ংকর কথা, দেখি তো…

বলেই তিনি তার ডাক্তারি ব্যাগের ভেতরে থেকে থার্মেমিটারটা বার করে আমার মুখের মধ্যে গুঁজে দিলেন।

এবার শুয়ে পুড়ন তো চট করে। বলে আমার একটি কথাও আর কইতে না দিয়ে ঘাড় ধরে শুইয়ে দিলেন তার টেবিলের ওপরে।

শুয়ে পড়ুন। শুয়ে পড়ুন চট করে। আর একটি কথাও নয়।

মুখগহ্বরে থার্মোমিটার নিয়ে কথা বলব তার উপায় কি। প্রতিবাদ করার যো-ই পেলাম না। আর তিনি সেই ফাঁকে পেল্লায় একটা সিরিঞ্জ দিয়ে একখানা ইনজেকশন ঠুকে দিলেন আমায়।

ব্যাস। আর কোন ভয় নেই। অ্যানটি টিটেনাস ইনজেকশন দিয়ে দিলাম। ধনুষ্টঙ্কারের ভয় রইল না আর। বলে আমার মুখের থেকে থার্মোমিটার বার করলেন, করে দেখে বললেন জ্বরটরও হয়নি তো। নাঃ। ভয় নেই কোন আর। বেঁটে গেলেন এ যাত্রা।

মুখ ভোলা পেতে তখন আমি বলবার ফুরসত পেলাম–ডাক্তারবাবু; আমার তো কিছু হয়নি। আমি পড়ে যাইনি, ছড়ে যায়নি আমার। আমার বোন বিনিই পড়ে গিয়ে ছড়ে গেছে। কথাটা আপনি না বুঝেই…

ওঃ তাই নাকি? তা বলতে হয় আগে। যাক, যা হবার হয়ে গেছে। চলুন তাকেও একটা ইনজেকশন দিয়ে আসি তাহলে। ছড়ে যাবার পর ডেটল দেওয়া হয়েছিল? ডেটল কি আইডিন?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তবে তো হয়েইছে। তবু চলুন, ইনজেকশনটা দিয়ে আসি গে। সাবধানের মার নেই, বলে কথায়।

বিবেচনা করে বিনির ইনজেকেশনের বিনিময়ে তিনি আর কিছু নিলেন না, আমারটার দাম দিতে হলো অবিশ্যি। প্লাস তার কলের দরুণ ভিজিট।

সেই অবুঝ রাম ডাক্তারের কাছে যেতে হচ্ছে আজ। বেশ ভয়ে ভয়েই আমি এগোই…বলতে কি।

বুঝে সুঝে পাড়তে হবে কথাটা, বেশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে…যা অবুঝ ডাক্তার বাবা।

চেম্বারে ঢুকে দূর থেকেই তাঁকে নমস্কার জানাই।

ডাক্তারবাবু। আপনাকে কল দিতে এসেছি। কিন্তু নিজের জন্য নয়। আমার কোন অসুখ করেনি, কিছু হয়নি আমার। পড়ে যাইনি, ছড়ে যায়নি। আমাকে ধরে আবার ছুঁড়ে টুড়ে দেবেন না যেন সেই সেবারের মতন…।

বলে হর্ষবর্ধন বাবুর কথাটা পাড়লাম।

শুনেই না তিনি, আমাকে তেড়ে এসে ছুঁড়ে না দিলেও এমন তেড়ে খুঁড়ে উঠলেন যে আর বলবার নয়।

নাঃ, ওদের বাড়ি আমি যাব না। প্রাণ থাকতে নয়, এ জন্মে না। ওরা ভারি অভদ্দর

হর্ষবর্ধনবাবু অভদ্র। এমন কথা বলবেন না। ওঁর শত্রুতেও এমন কথা বলে না বলতে পারে ।

অভদ্র না তো কি? বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে অপমান করাটা কি দ্ৰতা না কি তাহলে?

আপনাকে বাড়িতে ডেকে এনে অপমান করেছেন উনি? বিশ্বাস হয় না, মশাই। আপনি ভুল বুঝেছেন। আপনি যা অ-বলতে গিয়ে অবুঝ কথাটা আমি চেপে যাই একেবারে।

উনি নিজে না করলেও ওঁর পোষা হাঁসদের দিয়ে করিয়েছেন। সে একই কথা হলো।

হাঁসদের দিয়ে অপমান? আমার বিশ্বাস হয় না।

হা মশাই। মিথ্যে বলছি আপনাকে? আমাকে দেখেই না তার সেই পাজী হাঁসগুলো এমন গালাগালি শুরু করল যে কহতব্য নয়।

হাঁসেরা গাল দিল আপনাকে? আরে মশাই, হাঁসকেই তো লোকে গাল দেয়। আমার বোন পুতুল এমন চমৎকার ডাক-রোস্ট রাধে যে কী বলব। গালে দিলে হাতে স্বর্গ পাই।

সে যাই বলুন, হর্ষবর্ধনবাবুর হাঁসগুলো তেমন উপাদেয় নয়। বিলকুল বিষতুল্য। আমাকে দেখেই না তারা কোয়াক কোয়াক বলে এমন গাল পাড়তে শুরু করল যে– বলতে বলতে তিনি রাঙা হয়ে উঠলেন ও কেন, আমি–আমি কি কোয়াক? আমি কি হাতুড়ে ডাক্তার নাকি? লোকে বললেই হলো?

ও। এই কথা। আমি ওঁকে আশ্বাস দিই? না মশাই না, হাঁসগুলো আপনার কোন গুপ্ত কথা ফাস করেনি, এমনিই ওরা হাঁসফাঁস করছিল। হর্ষবর্ধনবাবুর ওগুলো বিলিতি হাঁস কিনা, তাই ওই রকম ইংরেজী ভাষায় কথা বলে। ইংরেজীতে কোয়াক বলতে যা বোঝায় তা ঠিক ওর অর্থ নয়, বাঙালী হাঁস বলে ওই কথাটার মানে হতো মানে, বঙ্গ ভাষায় ওর অনুবাত করলে হবে, প্যাক, প্যাক।

প্যাঁক প্যাঁক? ঠিক বলছেন? তাহলে আর কোন কথা নেই। চলুন তবে।

বলে তিনি রাজি হলেন যেতে। দাঁড়ান, আমার ব্যাগটা গুছিয়ে নিই আগে এই ব্যাগ নিয়েই হয়েছে আমার যত হাঙ্গামা। এটাকে ব্যাগে নেওয়াই দায়। একেক সময় এমন মুশকিলে পড়তে হয় মশাই–

ব্যাগাড়ম্বর বেশি না করে–আমি বলতে যাই, বাধা দিয়ে তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন ও ব্যাগাড়ম্বর? বৃথা ব্যাগাড়ম্বর করছি আমি?

না না, সে কথা না। বলছিলাম যে—

কি বলছিলেন?

বলছিলাম, একটু ব্যগ্র হবেন দয়া করে। রোগীণীর অবস্থা ভারী কাহিল ছিল কিনা।

ব্যগ্রই হচ্ছি তো। ব্যাগ না হলে কি ব্যগ্র হই? এই ব্যাগের মধ্যেই তো আমার থামোমিটার, স্টেথিস্কোপ, রক্তচাপ মাপার যন্তর, ওষুধপত্তর যাবতীয় কিছু।

বলে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে সব্যাগ হয়ে তিনি সবেগে আমার সাথে বেরিয়ে পড়লেন।

কিন্তু এক কদম না যেতেই তিনি থমকে দাঁড়ালেন একদম। পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে বকতে লাগলেন আমায় :

নাঃ, আমি যাব না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে আপনার ঐ কোয়াক কোয়াকই হোক আর পেঁক কেই হো, ওই হাঁসরা থাকতে ও বাড়িতে আমি পা দেব না প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আমার শপথ আমি ভাঙতে পারব না। মাপ করবেন আমায়।

বলে তিনি বেঁকে দাঁড়ালেন।

এবং আর দাঁড়ালেন না। তারপর আর না এঁকে বেঁকে সোজা তিনি এগুলেন নিজের বাড়ির দিকে।

রাম ডাক্তার এমন অবুঝ, সত্যি।

অগত্যা, কী আর করা? সব গিয়ে খোলসা করে বললাম হর্ষবর্ধনকে। বললাম বউকে যদি বাঁচাতে চান তো বিদেয় করে দিন আপনার হাঁসদের। শুনে হর্ষবর্ধন খানিকক্ষণ গুম হয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেলেন ।

কাতব কান্তা কস্তে পুত্র। দারা পুত্র পরিবার তুমি কার কে তোমার-এ কে কার?…হাঁস কি আমার? হাঁসের কি আমি? হাঁস কি আমার সঙ্গে যাবে? দুনিয়ায় হাঁস নিয়ে কেউ আসে না, যদিও সবাই হাঁস ফাস করে মরে। হাঁস নিয়ে কি আমি ধুয়ে খাবো? যাক গে হাঁস। রাখে রাম মারে কে? মারে রাম রাখে কে কার হাঁস কে পোষে। বলতে বলতে তিনি যেন পরমহংসের পরিহাস হয়ে উঠলেনঃ টাকা মাটি, মাটি টাকা যাক গে হাঁস। যেতে দাও। বিস্তর টাকায় কেনা হাঁসগুলো। বহুৎ টাকা মাটি হলো এই যা।

বলে খানিকক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর ককিয়ে উঠলেন আবার : নাঃ বৌকে আমি হাসপাতালে পাঠাতে পারব না। তার চেয়ে হাঁসগুলোই বরং রসাতলে যাক।

তারপর গিয়ে তিনি পোলট্রির আগল খুলে দিয়ে খেদিয়ে দিলেন হাসদের। পাড়ার ছেলেদের সমবেত উল্লাসের মধ্যে তারা ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে চলে গেল।

হংসবিদায়ের খবরটা চেম্বারে গিয়ে জানাতে তারপরে ব্যাগ হস্তে ব্যগ্র হয়ে বেরুলেন আবার রাম ডাক্তার।

এলেন রাম ডাক্তার।

আসতেই হর্ষবর্ধন তার হাতে ভিজিট হিসেবে করকরে দুখানা একশ টাকার নোট ধরে দিয়ে তাকে নিয়ে গৃহিনীর ঘরে গেলেন। আমরাও গেলাম সাথে সাথে।

কি কষ্ট হচ্ছে আপনার বলুন তো? রোগীণীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে শুধালেন রাম ডাক্তার।

মাথটা টনটন করেছ, দাঁত কনকন করছে, গা শিরশির করছে, তার ওপর পেট কামড়াচ্ছে আবার। জানালেন গিন্নি।

বটে? বলে রাম ডাক্তার মুখ ভার করে কী যেন ভাবলেন খানিক, তারপরে হর্ষবর্ধনকে টেনে নিয়ে বাইরে এলেন।

কেস খুব কঠিন মনে হচ্ছে আমার। গম্ভীর মুখ করে বললেন রাম ডাক্তার।

বউ আমার বাঁচাবে তো?

না না, ভয়ের কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে মারাত্মক কিছু ঘটনার আশঙ্কা করিনে। তবে এসব রোগী সাধারণতঃ দশজন রোগীর ন জনাই মারা যায়। একজন মাত্র বাঁচে কেবল।

তাহলে? হর্ষবর্ধনের আতঙ্ক এবার বেড়ে আরো যেন দশগুণ বেড়ে যায়।

অ্যাঁ, বলেন কি মশাই? তবে তো বউদির বাঁচানোর আর কোনই আশা নাই। গোবরা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে। বলে কাঁদতে থাকে।

ইনি বাঁচবেন। ভরসা দেন ডাক্তারবাবু ও এর আগে এই রোগে ন জন আমার হাতে মারা গেছে। ইনিই দশম। এঁকে মারে কে!..যাক আপনারা আমায় রুগীকে দেখতে দিন তো দয় করে এবার। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখি আগে, বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন আপনারা। রুগীর ঘরে আসবেন না যেন এখন। বলে আমাদের ভাগিয়ে দিয়ে তিনি ভেতরে রইলেন।

আমরা তিনজন পাশের ঘরে এসে বসলাম। হর্ষবর্ধনের মুক ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আর গোবরার মুখ শুকিয়ে হয়েছে ঠিক নারকেলের ছোবড়ার মতই।

মাথা টনটন, দাঁত কনকন, পেট চনচন–শক্ত অসুখ বই কি। আমি বলি। আবহাওয়ার গুমোটটা কাটাবার জন্যই একটা কথা বলি আমি মোটের ওপর সেই গুমোটের ওপর। এর একটা হলেই রক্ষে নেই একসঙ্গে তিনটে।

ব্যামোটা বউদির শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েছে দাদা। গোবরা মন্তব্য করে : সারা গা শির শির করছে বলল না বৌদি?

শীরঃপীড়াই হয়েছে তো। আমিও একটু ডাক্তারি বিদ্যা ফলাই। মাতা টনটন করছে বললেন না?

রাম ডাক্তার দরজার গোড়ায় দাঁড়ালেন এসে উকো দিতে পারেন একটা আমায়? নিদেন একটা ছেনি?

হর্ষবর্ধন একটা উকো এনে দিলেন। ছেনিও।

উকো দিয়ে কি করবে দাদা? বউদির মাথায় উকুন হয়েছে নাকি? গোবরা শুধোয়ঃ উকো ঘষে ঘষে উকুনগুলো মারবে বলে বোধ হচ্ছে।

হতে পারে। আমার সায় তার কথায় ও তারাই হয়ত মাথায় কামড়াচ্ছে সেইজন্যই এই শিরঃপীড়াটা হয়েছে বোধ হয়।

হর্ষবর্ধন চুপ করে বসে রইলেন মাথায় হাত দিয়ে।

কিম্বা দাঁতের জন্যেও লাগতে পারে উকো। আমার পুনরুক্তি ও দাঁতে কেরিজ হয়ে থাকলে তাতেও দাঁতের যন্ত্রণা হয়। উকো দিয়ে ঘষেই সেই কেরিজ তুলবেন হয়ত উনি। দাঁত নেহাত ফ্যালনা জিনিস না মশাই। দাঁত ফেলবার পর তবেই দাঁতের মর্যাদা বুঝতে পারে মানুষ। খারাপ দাঁত থেকে হাজার ব্যাধি আসে। মাথা ব্যাথা, পেট ব্যথা, বকের ব্যামো, হজমের গোলমাল, এমনকি বাতের দোষও আসতে পারে ঐ দাঁতের দোষ থেকে।

রাম ডাক্তার আবার এসে উঁকি মারলেন দরজায়।

হাতুড়ি কিম্বা বাটালি জাতীয় কিছু আছে আপনাদের কাছে?

হর্ষবর্ধন হাতুড়ি এনে ডাক্তারের হাতে তুলে দেন।

হাতুড়ি নিয়ে কি করবে দাদা? আঁতকে ওঠে গোবরাঃ দাঁতের গোড়ায় ঠুকবে নাকি গো? দাঁতের ব্যথা সারতে দাঁতগুলোই সব না তুলে না ফ্যালে বউদির?

কি জানি ভাই? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন দাদা?

লোকে রাম ডাক্তারকে কেন হাতুড়ে বলে থাকে কে জানে।

তার মানে তো পাওয়া যাচ্ছে হাতে হাতেই গোবরা হাতুড়ির সঙ্গে হাতুড়ের একটা যোগসূত্র স্থাপন করতে চায়।

দাঁত না হয়ে মাথাতেও পিটতে পারে হাতুড়ি…বাধা দিয়ে আমি বলি ও শকট্রিটমেন্ট বলে একটা জিনিস আছে না?

দাদার শক যেমন। আপনার মতন হাতুড়ে লেখকের পরামর্শ শুনে হাতুড়ে ডাক্তার এনে নিজের শখ মেটান উনি এবার। গোবরা আমার কথার ওপর কথা কয় : বউদির মধুর হাসি আর দেখতে হচ্ছে না দাদাকে এ জন্মে নয়। হায় হায়, এই ফোকলা বউদি ছিল আমার বরাতে শেষটায় কি করব তার। সে হায় হায় করতে থাকে।

মাথায় হাতুড়ি ঠুকলে শিরঃপীড়া সারে বলে শুনেছি। তবুও আমি ভরসা দিয়ে বলতে যাই।

মাথা না থাকলে তো মাথা ব্যথাই থাকে না মশাই। হর্ষবর্ধন বলেন : শকট্রিটমেন্ট মানে হচ্ছে হঠাৎ একটা ঘা মেরে শক দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রোগ সারিয়ে দেওয়া। শক্ত রোগ যা তা নাকি।

তাতেই সেরে যায়। আমার বক্তব্য রাখি : রাম ডাক্তারের কোন কসুর নেই মশাই। যথাশক্তি করেছে বেচারা। তা যদি হয় তো আমার বলার কিছু নেই। হাল ছেড়ে দেন হর্ষবর্ধন। যথাসাধ্য করতে দিন ডাক্তারকে বাধা দেবেন না আপনারা। আমার কথাটর শেষে পুনশ্চ যোগ করি।

একটা করাত দিতে পারেন আমায়? ছোটখাট হলেও চলবে। দরজার সামনে আবার রাম ডাক্তারের আবির্ভার। হর্ষবর্ধনের কাঠ চেরাই করাতী কারখানায় করাতের অভাব ছিল না। এনে দিলেন একখানা। তারপরে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন তিনি? কি সর্বনাশ হবে কে জানে।

বউদির পেট কেটে ছেলেটাকে বার করবে বোধ হচ্ছে। গোবর্ধন পরিস্কার বলে?

বউদি কাটা পড়বে আর ছেলেটা মারা পড়বে, ডাক্তারের করাতে আমাদের বরাতে এই ছিল, যা বুঝতে পারছি।

বেঁচে যাবে আপনার বউ। আমি তাকে ভরসা দিই ও বড়ো বড়ো যাদুকর দেখেননি, করাত দিয়ে একটা মেয়েকে দু আধখানা করে কেটে ফ্যালে, তারপর সঙ্গে সঙ্গে জুড়ে দেয় আবার দ্যাখেননি কি? কেন, আমাদের পি সি সরকারের ম্যাজিকেই তো তা দেখা যায়। তেমনি ভেলকি দেখাতে পারেন বড় বড় ডাক্তাররাও তারাও কেটে জোড়া দিতে পারেন।

কিন্তু হর্ষবর্ধন আর চুপ করে ব েথাকতে পারেন না, লাফিয়ে ওঠেন হঠাৎ আমার চোখের সামনে বউটাকে করাতচেরা করবে আর আমি বসে বসে তাই দেখব। লোকটা পেয়েছে কি? বলে তিনি ঝড়ের বেগে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। গোবর্ধনও সাথে সাথে যায়। চকরবরতি আমি তাদের পশ্চাদ্বর্তী হই।

কি পেয়েছেন আপনি? ঝাঁঝিয়ে ওঠেন তিনি ডাক্তারের ওপর : করাত দিয়ে আমার বউকে কাঠবেন যে? কেটে দু-কুটরো করবেন আপনি? কেন? কেন? যতই কাঠের ব্যবসা করি মশাই, এতটা আকাট হইনি এখনো কেন, কি হয়েছে আমার বউয়ের যে করাত দিতে তার

কিসের বউ! বাধা দেন ডাক্তার ও আমি পড়েছি আমার ব্যাগ নিয়ে। বউকে আপনার দেখলাম কোথায়। হতভাগা ব্যাগটা একেক সময় এমন বিঘড়ে যায়। হাতুড়ি পিটে, ছেনি দিয়ে উকো ঘষে কিছুতেই এটাকে খুলতে পারছি না। করাত দিয়ে কাটতে লেগেছি এবার। এর মধ্যেই তো আমার যন্তরপাতি, ওষুধপত্র, এমনকি থার্মোমিটারটি পর্যন্ত। আগে এসব বার করলে তবে তো দেখব আপনার বউকে। রাজ্যের রোগ সারাই আমি কিন্তু নিজের ব্যাগ সারাতে পারি না। এই ব্যাগটাই হয়েছে আমার ব্যায়াম।

দাদুর চিকিৎসা সোজা নয়

টুসির দাদুকে ধরেছে এবার এক অদ্ভুত ব্যারামে–এক আধ দিন নয়, প্রায় মাসখানেক থেকে কিছুতেই ঘুম হচ্ছে না ওঁর; কত ডাক্তার, কবিরাজ, হাকিম, বৈদ্য, হোমিওপ্যাথ ও হাতুড়ে–নামজাদা আর বদনামজাদা, নানারকমের চিকিৎসা করে হদ্দ হয়ে গেল–কিন্তু অসুখ–সারার নামটি নেই আর। এই একমাসে এ ডিসপেনসারি ঔষুধই গিলে ফেললেন তিনি, কিন্তু অসুখ একেবারে অটল–যেমনকে তেমন।

ঘুম তার হয় না আর। রাত্রে তো নয়ই, দিনের বেলায়, দুপুর কিংবা বিকেলের দিকে–তাও না! ভোরবেলায়, কি সকালে ঘুম ভাঙবার পর, কিংবা রাত্রে খাবারের ডাক আসবার আগে–যেসব অধোদয়যোগে টুসির এবং সব স্বাভাবিক মানুষেরই স্বভাবতই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে, প্রগাঢ় নিদ্রা আপনা থেকেই এসে জমে, তিনি আপাদমস্তক চেষ্টা করে দেখেছেন, কিন্তু না, সে-সব মাহেন্দ্রক্ষণেও ঘুম তার পায় না, এমন কি, টুসির পড়ার টেবিলে বসেও দেখেছেন, টুসির পরামর্শ মতই, কিন্তু সব প্রাণপণ প্রয়াসই ব্যর্থ হয়েছে তার। অবশেষে তিনি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়েছেন–

যখন হাকিমি দাবাই-ই দাবাতে পারলো না, তখন এ রোগ আর–

বাক্যটার তিনি আর উপসংহার করেননি, নিজেকে দিয়েই তা করতে হবে হয়তো, এইরকমই তার আশঙ্কা।

ডাক্তারিতেই বা কি হবে? বলে, পুরো একটা ডিসপেনসারিই সরিয়ে ফেললাম–হ্যাঁ!

কোথায় সরালে দাদু? কই আমি জানি না, তো! বিস্মিত হয়ে জিগগেস করে টুসি–দাদুর এবং বিধ কার্য্যকলাপের সে তো ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি কখনো।

কোথায় আবার! আমার এই পেটেই–পেটের মধ্যেই!

ও তাই বলো। পেটের খবর সে টের পাবে কি করে?

তবুও সারলো না অসুখ।

দাদুর খেদোক্তিতে টুসির মন কেমন করে। তাই এবার সে নিজেই দাদুর চিকিৎসার ভার নেবে, এইরকমই সে স্থির করেছে। তখন থেকেই দস্তুরমতো মাথা ঘামাতে লেগেছে। স্কুলের টাস্ক, মার্বেল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, এমন কি সুযোগ পেলেই একটু ঘুমিয়ে নেওয়া ইত্যাদি সব জরুরি কাজ ছেড়ে দিয়ে কেবল ওর দাদুকে ভাল করার কথাই সে ভাবছে এখন। কতকগুলো উপায় মনেও যে আসেনি তার, তা নয়। কোন সম্রাট অসুস্থ ছেলের বিছানার চারদিকে ঘুরপাক খেয়ে ছেলেকে আরাম করে এনেছিলেন–সেই ঐতিহাসিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? অসুখ সারাবার এইটেই তো সবচেয়ে সহজ ও শ্রেষ্ঠ উপায়, তার মনে হতে থাকে। এক্ষুনি– আজ রাত্রেই বা যে কোনো সময়ে দাদু খানিকক্ষণের জন্যে একটু চোখ বুজোলেই এই চিকিৎসা শুরু করে দিতে পারে–

কিন্তু দাদু যে চোখই বোজয় না ছাই। এক মিনিটের জন্যেও না।

তখন মরীয়া হয়ে আর কোনো উপায় না দেখে সে সজাগ দাদামশায়ের চারদিকেই প্রদক্ষিণ লাগিয়ে দেয়, কিন্তু দাদুর চোখও ঘুরতে থাকে তার সাথে সাথে।

এই। এই। ওকি হচ্ছে? ঘুরণি লেগে পড়ে যাবি যে-আমার ঘাড়েই পড়বি ঘুরে থাম থাম।

বাধা পেয়ে সে বসে পড়ে লজ্জিত হয়ে–থামের মতই বসে যায়। ঘুরপাকের রহস্য দাদুকে জানাবার তার আর উৎসাহ হয় না। কে জানে, কি ভাববে দাদু?

আচ্ছা, সেই রেলিং চিকিৎসাটা কেমন? হঠাৎ তার মনে পড়ে এখন। এক গভীর রাত্রে দাদুর জন্যে ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে বেরসিক এক কুকুরের পাল্লায় পড়ে হন্তদন্ত হয়ে পার্ক ভেদ করে যাবার মুখে রেলিংয়ের ফাঁকে আটকে গেছল সে-না পারে রেলিংকে বাড়াতে, না পারে নিজেকে ছাড়াতে। কিন্তু সেই অবস্থায় সটান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই কি তোফা ঘুমটাই না দিয়েছিলো সে। তেমন ঘুম তার আর কোনদিনই হয়নি। কখন কোন ফাঁকে যে ভোর হয়েছে, টেরই পায়নি টুসি, কিন্তু–

হতাশভাবে যে ঘাড় নাড়ে। নাঃ, এ-চিকিৎসায় রাজি করানো যাবে না দাদুকে। দাঁড়াবার জন্যে ততটা নয়, কেন না, বলতে গেলে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই আমরা ঘুমুই, যদিও সে হচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে সমান্তরালভাবে দাঁড়ানো, কিন্তু টুসি ভেবে দেখে, রেলিং-এর কবলে ঐভাবে আটকে থাকাটা একবারেই পছন্দ করবেন না দাদামশাই। ওর নিজেরই তো পছন্দ হয়নি প্রথমটায়।

তবে? আর কি কোন উপায় নেই? ভয়ানকভাবে ভাবতে থাকে টুসি। ডাক্তারেরা হাল ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু সে তো ছাড়তে পারে না যেহেতু দাদুর যা হাল, তাতে হাল ছেড়ে দেওয়া মানে– দাদুকেই ছেড়ে দেওয়া। দাদুকে ছাড়ার কথা মনে হলেই দেদার কান্না পরতে থাকে।

আচ্ছা দাদু, এক কাজ করলে হয় না–?

কি কাজ?

আমতা আমতা করে কোনরকমে বলে ফেলে টুসি–নতুন একটা বুদ্ধি খেলেছে ওর মাথায়–সেই যে এক রাত্তিরে তোমার কলিকের জন্যে ডাক্তার ডাকতে বেরিয়েছিলাম, রাস্তায় দেখেছিলাম কি, বড়ো রাস্তাতেই দেখেছিলাম, ফুটপাথের ওপর সারা ফুটপাথ জুড়ে কত লোক যে শুয়ে আছে, একফুট পথও বাদ রাখেনি। আর তারা শুয়ে আছে দিব্যি আরামে, বালিশের বদলে মাথায় কেবল একখানা করে ইঁট দিয়ে। অক্লেশে ঘুম দিচ্ছে–খাসা ঘুমোচ্ছে তারা–কুকুর-ফুকুর কারু কোনো তোরাক্কা না করেই–

ফুটপাথে গিয়ে আমি শুতে পারবো না বাপু। তা তুমি যাই বলো। তা ছাই আমার ঘুম হোক, আর নাই হোক–

না-না ফুটপাথে কেন, আমার মনে হয় কি জানো দাদু ফুটপাথ নয়, ঐ হাঁটের সাথেই ঘুমের কোন যোগাযোগ আছে। একটা শক্ত জিনিসে মাথা রাখলে ঘুম না হয়েই পারে না-জানো দাদু, ইস্কুলের ডেক্সওয়ালা বেঞ্চে বসে বইয়ের গাদায় মাথা রেখে ছেলেরা কেমন তোফা ঘুমোয় মাস্টার ক্লাসে এলেও টের পায় না। তখনো তাদের নাক ডাকতে থাকে, মাস্টারের হাঁক-ডাকেও ঘুম ভাঙে না। জানো?

দাদু ভুরু কুঁচকে ব্যবস্থাপত্রটা ভেবে দেখেন।

টুসি উৎসাহ পায় বুঝেছ–দাদু, ঐ বালিশের জন্যেই ঘুম হচ্ছে না তোমার। যা নরম। যখন আমার মাথায় তলায় বালিশ থাকে না, চৌকির তলায় চলে যায়, তখনই আমি দেখছি–আমার ঘুম সবেচেয়ে ঘন হয়ে ওঠে–বুঝেছো দাদু।

যা তবে, নিয়ায় ইঁট! ঢালাও হুকুম দিয়ে দেন ওর দাদু। রাস্তার থেকেই আনবি তো? ভাল দেখে আনিসি কিন্তু। দেখে-শুনে ভাল করে বাজিয়ে–বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখে–বুঝলি? হাঃ, রাস্তার ইঁট আবার ভাল হবে! কিন্তু কি আর করা, উপায় তো নেই!

মনোহারি দোকানে তো কিনতে পাওয়া যায় না ইঁট। টুসির অনুযোগ।

তবে যা, তাই নিয়ে আয়গে–সাবান দিয়ে সাফ করে নিলেই হবে। যা।

বলতে না বলতেই দৌড়ান টুসি। একখানা আঠারো ইঞ্চি, একটুকরো কার্বলিক–সোপ আর তিনখানা চন্দন-সাবান আর পামোলিভ নিয়ে আসে সেই সঙ্গে। প্রথমে কার্বলিকটা দিয়ে হঁটের যত জীবাণু-ছাড়ানো, তারপরে পামোলিভ ঘসে ঘসে কার্বলিকের গন্ধ–তাড়ানো! সবশেষে চন্দন সুরভিত করা। তার সৌরভ বাড়ানো।

দেখছো দাদু! সাবান-টাবান মাখিয়ে কিরকম করে ফেলেছি ইঁটখানাকে?

দাদু শুঁকে দেখেন একবার–হুম! বেশ উপাদেয় হয়েছে বটে।

রাজভোগ্য ইঁট-মাথায় সারারাত কেটে যায় দাদুর–কিন্তু ঘুমোবার ভাগ্য আর হয় না। একপলের জন্যেও চোখের পলক পড়ে না তার।

সকালে উঠেই তার গজগজানি শুনতে হয় টুসিকে–হ্যাঃ ইঁট না ছাই! ইঁট মাথায় দিয়ে শুয়ে আছে সবাই! দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে তারা! কি দেখতে কি দেখছেন, তার নেই ঠিক। মাঝখানে থেকে আমার–উঃ! সেই তখন থেকেই মাথাটা টাটিয়ে আছে! বলে মাথার বদলে ঘাড়েই হাত বুলোতে থাকেন তিনি।

উঃ কী মাথাটাই না ধরেছে!…ক্যাফিয়াস্পিরিন? ক্যাফিয়াস্পিরিনে কি হবে আমার? ক্যাফিয়াস্পিরিন কে কিনে আনতে বললো তোকে? একি তোের সেই আধকপালে? বলছেন মাথা ধরেছে? সমস্ত মাখাটাই এই ঘাড়ের এখান থেকে ও-ঘাড় পর্যন্ত। ক্যাফিয়াস্পিরিনে কি করবে এর? ঘাড় ধরা কি সারে ওতে? অ্যাস্পিরিন-ট্যাস্পিরিনের কম্মো নয় বাপু!

ঘাড়ের দুধারই ধরে গেছে তোমার, বলছো কি দাদু? ।

ধরবে না? ইঁটখানা কি একটুখানি? দাদু ঘাড় নাড়েন।

আমূল-মস্তকের সর্বত্রই ধরেছে, কিন্তু যার ধরবার ছিল–নিদ্রাদেবী, যদি-বা তিনি আসতেন, কিন্তু ইটের বহর দেখে ত্রিসীমানার মধ্যেও আর ঘেঁস দ্যাননি তিনি–ইত্যাকার নিজের মতামত প্রবলভাবে ব্যক্ত করতে থাকেন ওর দাদু!

টুসি? টুসি আর কি করবে? চুপ করে শুনতে থাকে। এঁটের আপরাধ অম্লানবদনে নিজের ঘাড় পেতেই নেয় সে।

কয়েকদিন পরে একরাত্রে দাদু অনিদ্রার আতিশয্যে ছটফট করছেন, পাশের বিছানায় শুয়ে ওর নিজের চোখেও ঘুম নেই–ভয়ে-ভয়ে একটা কথা বলে ফেলে টুসি–

আচ্ছা দাদু তুমি উপক্রমণিকা পড়ে দেখেছো কখনো? সত্যি-সমসকৃত পড়তে বসলেই এমন ঘুম পায়, অ্যাতো ঘুম পায় আমার, যে কী বলবো!

কথাটা মনে ধরে ওর দাদুর। টুসির দিদিমা বই হাতে নিয়ে দিবানিদ্রা শুরু করতেন, স্মরণ হয় ওঁর। প্রত্যহই প্রথম থেকে হরিদাসের গুপ্তকথা তাঁর আরম্ভ হতো, কিন্তু কোনোদিনই আড়াই পাতার বেশি এগুতে পারতে না; বলতেন–আঃ কী ঘুমটাই না আছে ঐ বইটাতে! অবশেসে গুপ্তকথা অজ্ঞাত রেখেই একদা ওঁকেই ভবলীলা সাঙ্গ করতে হয়েছে, কোন এক গুপ্ততর জগতে চলে যেতে হয়েছে, ভেবে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে দাদুর চোখ। একদিন বইখানা খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেদিন দুপুরে, কী আশ্চয্যি, ঘুম তো হলোই না বৌয়ের, উপরন্তু তার বদলে তার সঙ্গে বকাবকি করে অম্বল হয়ে গেল।

যা, নিয়ায় তো! উপক্রমণিকাকেই দেখব আজ।

টুসি কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু ওর দাদু মাথার কাছে আলো জ্বেলে উল্টে যাচ্ছেন পাতার পর পাতা–উপক্রমণিকাও শেষ আর রাতও কাবার! বাস্তবিক, কী চমৎকার বই এই উপক্রমণিকা, ঘুম না হোক, দুঃখ নেই কিন্তু কী ভালই লেগেছে যে দাদুর! সন্ধি বিধি ও যত্ন-ণত্তের অনুক্রম থেকে শুরু করে দ্বন্দ্ব ও মধ্যপদলোপী আর যাবতীয় সমাসকে অবহেলায় অতিক্রম করে, নরঃ-নরৌ-নরাঃ এবং লট-লোট-লঙ-বিধিলিঙের বৃহভেদ করে বীরবিক্রমে এগিয়েছেন তিনি, তুদাদি ধাতু থেকে, তদ্ধিত প্রত্যয় পর্যন্ত পার হয়ে গেছে তার, সহজেই হয়ে গেছে; ণিজন্ত প্রকরণ ও পরস্মৈপদীয় ব্যাপারটাও বেশ হাড়ে-হাড়েই বুঝেছেন, অবশেষে কর্মবাচ্য ও কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে এসে ঠেকেছেন এন। আগাগোড়া সবই তিনি পড়েছেন সাগ্রহে। পড়েছেন আর ভেবেছেন। ভেবেছেন আর অবাক হয়েছেন। কত সত্য, কত তত্ত্ব, কত রহস্য, কী গভীরত্বের পরিচয়ই না নিহিত আছে ওর পাতায় পাতায়? ওর বিধি-বিধানে জীবনের কত জটিল সমস্যা সমাধানই না খুঁজে পেলেন। বাস্তবিক, ওকে ব্যাকরণ না বলে ব্যাকরণদর্শনই বলা চলে, এর জন্যে যদি ষড়দর্শনের তালিকায় আরেকটা সংখ্যা বাড়াতে হয়–বাড়িয়ে সপ্তম দ্রষ্টব্যেরও আমদানি করতে হয়–তবুও। আহা! অবহেলা না করে ছেলেবেলায় এই সদগ্রন্থ মন দিয়ে পড়তেন যদি!–

তাহলে কী যে হতো আজ, তা অবিশ্যি তিনি আন্দাজ করতে পারেন না। সকালে উঠে টুসি, দাদুকে নিদ্রিত না দেখুক, কিন্তু খুশি দেখেছে। পুলকিত না দেখতে পাক, অন্তত তিতবিরক্ত দেখতে হয়নি।

উপক্রমণিকা মুখস্থ করেও যখন বিনিদ্রার ব্যতিক্রম দেখা গেল না, তখন অন্য প্রস্তাব পাড়ে টুসি। খেলাধুলো করলে কেমন হয়? ফুটবল কি টেনিস বা ঐরকমের একটা কিছু? ফুটবল খেলে ফিরলে কেমন গা ঝিম ঝিম করে। আপনার থেকেই চোখের পাতা জড়িয়ে আসে টুসির। সেইজন্যেই তো সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসেই যে সে চেতনা হারায়, রাত্রে খাবার সময় অমন ষাড়ের ডাকাডাকিতেও সহজে তার সাড়া মেলে না।

মাঠে গিয়ে তোমার মতো বল পিটতে পারব না বাপু! ওসব গোঁয়ারদের খ্যালা। যতো সব গুণ্ডারাই খ্যালে! তারপর ল্যাং মেরে ফেলে দিক আমায়! ফেলে আমার ঠ্যাং ভেঙে দিক আর কি! দাদু মুখ বেঁকান।

মাঠে কেন, ছাদে? আমাদের বাড়ির ছাদেই তো। টুসি তাঁকে আশ্বস্ত করে। আর কেউ না, কেবল তুমি আর আমি।

হ্যাঁ, তাহলে হয় বটে! কিন্তু দয়াখো বাপু, কেয়ারি করতে পাবে না, ফাউল টাউল করা চলবে না তা বলে। আর দাদু শেষ পর্যন্ত খোলসা করেই কন–আর আমাকেও কিন্তু বল মারতে দিতে হবে–মাঝে-মাঝেই।

বাঃ, তুমিই তো মারবে তোমারই তো দরকার একসারসাইজের! টুসি বিশদ করে দেয়–ভয় সেই, আমি একলা-একলা খেলবো না।

আমি গোল দেবো কিন্তু! আমাকেও গোল মারতে দিতে হবে! হা!

বেশ তো, তুমিই খালি গোল দিয়ে। আমি একটাও গোল দেব না তোমায়। গোড়াতেই অভয় দিয়ে টুসি গোলযোগ থামাল।

তারপরে পাড়ার এক টেনিসক্লাব থেকে বহু ব্যবহৃত ও বহিস্কৃত একটা ডিউস বল যোগাড় করে হাজির হয় টুসি।

অ্যাঁ! এত ছোট?; দাদু অবাক হন–ফুটবল এত ছোট কেনরে?

ফুটবল না তো। টুসি জানায়, ছাদে কি অত বড়ো ফুটবল চলে কখনো? আমার এক শটে তাহলে তো কোথায় উড়ে যাবে, তার ঠিক নেই। তাই টেনিসের বল নিয়ে এলাম। টেনিসই বা মন্দ কি দাদু?

তা মন্দ কি! তিনিও সায় দেন–তবে টেনিসই হোক,ক্ষতি কি তাতে? ফুটবল সম্পর্কে ব্যাটবল, ব্যাটবল আর টেনিস, টেনিস আর ক্রিকেট, ক্রিকেট আর হকি–তাদের তারতম্য বিশেষত্ব কেবল নামমাত্র নয়, ভালোভাবেই দাদুর জানা; ওদের ভেদাভেদের সব খবর তাবৎ রহস্য কিছুই তার অবিদিত নেই আর।

তারপর থেকে দুপদাপ, ধুপধাপ–পাড়ার লোক সচকিত হতে থাকে প্রত্যহ। বাড়িওয়ালা এসে বলেন–ছাদ ভেঙে ফেলবেন দেখছি। কি হয় আপনাদের ফুটবল খেলা?

ফুটবল? না তো। দাদুর চোখ কপালে ওঠে–ফুটবল! রামমাঃ! ফুটবল আবার খ্যালে মানুষে? ওতো গোঁয়ারদের খ্যালা মশাই! আমরা, টেনিস খেলি। আসবেন, আপনিও আসবেন–তিনজনেই খালা যাবে না হয়।

বাড়িওয়ালাকে আমন্ত্রণ করে তো বসেন, কিন্তু সন্দিগ্ধভাবে একটা থেকেই যায় তাঁর। আপনমনেই বলেন তিনি আসবেন তো খেলতে, তবে টুসির সঙ্গে পেরে উঠলে হয়! আমি যে আমি–-আমাকেই গলদঘর্ম করে দিচ্ছে!

বাড়িওয়ালা আসেন বিকেলে, ঈষৎ আপ্যায়িত হাসিমুখ নিয়েই–হ্যাঁ! বাড়রি ছাদ আমার বেশ বড়োই, টেনিস খ্যালা যায় বটে। তবে আপনারাই খেলুন, আমি দেখি। এই স্কুলদেহ নিয়ে এ-বয়সে আর ঐসব খ্যালাধুলোর হুলস্থুল আমার পোর না মশাই!

টেনিসের বল পড়ে ছাদে। বলটাকে রাখা হয় সেন্টারে নাতি আর দাদু দুজনেই মুখোমুখি হন–নাতি বৃহৎ কুরুক্ষেত্রের সম্মুখে।

নেট? নেট আবার কি? নেট কে? নেটে কি হবে? কিসের নেট? দাদুও কম বিস্মিত নন।

কেন টেনিস নেট? বাড়িওয়ালা বলেন। বলই তো দেখছি কেবল–তাও তো কুল্লে একটাই। র‍্যাকেটই বা কোথায়?

ততক্ষণে খেলা শুরু হয়ে যায় ওঁদের। খেলতে-খেলতেই বলেন দাদু-বলের সঙ্গে ই তার গলা চলেও, ব্যাটের কথা বলছেন? আমাদের তো এ ব্যাটবল-খেলা নয় মশাই! ভুল করছেন আপনি–খ্যালার কোনো খবর তো রাখেন না! আর কি করেই বা রাখবেন–এসব খ্যালাধুলো তো আর ছিল না আমাদের কালে! তাই এসব খ্যালার নাম-ধাম জানার কথাও নয় আপনার। আরে মশাই–আমরা টেনিস খেলছি যে। ওই যাঃ! দেখুন তো গোল দিয়ে দিলে বকতে বকতে সামলাই বা কখন ছাই!

আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে গোলের মুখে গিয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়া তিনি। দুড়দাড় করে বল পিটিয়ে আনছে টুসি, কোন ফাঁকে যে গোল দিয়ে বসে কিসের ফাঁকতালে যে ফের আবার গোলযোগ ঘটায়, ঠিক নেই কিছু। তর্ক মাথায় রেখে এখন রেখে এখন সতর্ক হয়ে থাকতে হয় তাঁকে।

বাড়িওয়ালা চটেই যান, তাঁর নিজের বাড়ির ওপর একটা বাড়াবাড়ি তার বরদাস্ত হয় না। বাড়ির মায়ার জন্যে ততটা নয়; যেরকম খেলার দাপট, তাতে এর ইহকাল, পরকাল-সমস্তই ঝরঝরে! এবাড়ির ভবিষয়তের আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছেন–খেলোয়াড়দের স-বলতার জন্যই ছাড়তে হয়েছে; কিন্তু তাহলেও টেনিস-বলের প্রতি ফুটবলের ন্যায় এই দুর্ব্যবহার তার সহ্য হয় না– এইটেই সবচেয়ে তাঁর প্রাণে লাগে। বিশেষ রকম ব্যথা দেয়।

ঘুম না হোক, খেলার ফল অবিশ্যি একটা দেখা যায়–সেটাকে হয়তো সুফলই বলা যেতে পারে।

টুসির দাদু আর অভিযোগ করেন না, নিদ্রাহানির জন্যে কোন ক্ষোভের বাণী তার মুখে শোনা যায় না আর।–নাই হোকগে–ঘুম না হয় নাই হোলো, না হোলো তো বয়েই গ্যালো আমার! ঘুমের দরকারটাই বা কি? ঘুমিয়ে কে কবে বড়লোক হয়েছে? দুরদুর–ঘুমোয় আবার মানুষ! যতো গরু, ভ্যাড়া, ছাগল, গাধারই খালি ঘুমিয়ে সময় বাজে নষ্ট করে। এবংবিধ সব বাক্যই বরং তাঁর মুখে এখন।

আজকাল সকাল থেকেই শুরু হয় তাঁর উপক্রমণিকা-পাঠ, এরকম নিত্যক্রিয়ার মধ্যে; আর বিকেলে টুসি ইস্কুল থেকে ফিরলে পরে টেনিস-পর্ব– সেটাকে নৃত্য ক্রীড়া বলা যেতে পারে। আর রাত্রে? সারারাত তার চোখে ঘুম ত নেইই, টুসিরও ঘুমের দফা রফা।

কোন গোলটা তাঁকে নিতান্ত অন্যায় করে দেওয়া হয়েছে, কোনটাকে আর একটু হলেই নির্ঘাৎ বাঁচানো গিয়েছিল, কোন গোলটার পায়ের ফাঁকের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়ার অপরাধ কিছুতেই তিনি মার্জনা করতে পারেন না, এমনি না জানিয়ে সুড়ুৎ করে চলে গেল যে হঠাৎ! কোন অবশ্যম্ভাবী গোলকে তিনি অকস্মাৎ দুপা জুড়ে দিয়ে গলে যেতে দেননি, সোজাসুজি গোল দেবার কি-কি নতুন কায়দা তিনি আবিষ্কার করেছেন, কোনটাকে তিনি কৃপা করে ছেড়ে দিয়েছেন বলের প্রতি নয়, টুসির প্রতি কৃপাবশেই, কোন গোলটা তিনি নিজেই, হ্যাঁ, তিনি নিজেই ত-আর একটু হলেই প্রায় দিয়ে ফেলেছিলেন আর কি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে সেইসব কূটকচালে আলোচনায় টুসিকে যোগ দিতে হয় তাঁর সঙ্গে।

আচ্ছা ফুটবলেও ত গোল দ্যায় বলে শোনা যায়? দ্যায় না? টেনিসেও দ্যায়। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ফুটবলের গোলে আর টেনিসবলের গোলে তাহলে প্রভেদ কোথায়? দুটোর আকারে আর ওজনে তফাত আছে অবশ্যি, তা ঠিক! যদিও দুটোই গোলাকার তাহলেও ভারি গোলমাল ঠেকে ওর দাদুর। দুটো খেলাতেই যখন গোল দেবার প্রথা এক, কোন প্রকারভেদ নেই, তখন আলাদা নামকরণ কেন? বলের আকারভেদের জন্যেই কি তাহলে?

দাদুর জিজ্ঞাসুতার কি জবাব দেবে টুসি? শুনতে শুনতে নাজেহাল হয়ে পড়ে সে।

প্রহরের পর প্রহর চলে যায়–অফুরন্ত বাক্যলাপ আর ফুরোয় না। হঠাৎ ওর দাদু মোড় ঘোরেন তদ্ধিত-প্রত্যয় জানিস? জানিস কি? জানিস। আচ্ছা, বল ত তাহলে লকারার্থ নির্ণয় কাকে বলে?

খেলার ঠেলা তবুও ভাল উপক্রমণিকার উপক্রমেই গলা শুকিয়ে আসে টুসির। ক্ষীণস্বরে সে জানায়–উঁহু! এ বিষয়ে তার নিজের প্রতি একটুও প্রত্যয় আছে বলে মনে হয় না।

বটবৃক্ষ সন্ধিবিচ্ছেদ করত। করতে পারিস? খেলার থেকে ব্যাকরণে নেমেছেন ওর দাদু! দেখেছিস করে?

ভাল করেই দেখে টুসি। বটবৃক্ষের শাখা-প্রশাখাগুড়ির থেকে শুরু করে মায় গাছের ডগা অব্দি, পাতার থেকে মাথা পর্যন্ত কোথাও বাদ রাখে না, কিন্তু কোথাও কোন বিচ্ছেদের আভাসমাত্রও তার নজরে পড়ে না।

পারলিনে ত? বট ছিল বৃক্ষ, হলো গিয়ে বটবৃক্ষ–দেখলি?

ওর দাদু জোর দিয়েই জানতে চান যে, এটা হলো গিয়ে স্বরসন্ধি এবং নিশ্চয়ই এর কোন ভুল নেই কিন্তু মানতে কিছুতেই রাজি হয় না টুসি। অদৃশ্য সন্ধিতে সে ঘোরতর অবিশ্বাসী। ওর মতে যদি হতেই হয়, তবে নিছক এটা দাদুর একটা অভিসন্ধি কেবল।

সেও পাল্টা প্রশ্ন করে বসে দাদুকে–আচ্ছা, Buchanan সন্ধিবিচ্ছেদ কর ত তুমি!

বুচানন? এ আর এমন শক্তটা কি? বুচা ছিল আনন, হলো গিয়ে বুচানন–যেমন পঞ্চানন আর কি! আবার সমাসও হয় বুচা আনন যাহার, সেই বুচানন; কিন্তু কি সমাস, কে জানে! দ্বন্দ্ব না বহুব্রীহি? ওঁর নিজেরই কেমন খটকা লাগে। মধ্যপদলোপী কর্মধারায়ও হতে পারে বা। সমাস-প্রকরণটায় এখন উনি তেমন পাকা হতে পারেননি, অকালপক্ক এখন টুসির মতই! ভাল করে পোক্ত হতে কমাস লাগে, কে জানে!

হঠাৎ ওঁর প্রাণে সন্দেহ জাগে–আমাদের পাড়ার সেই ফিরিঙ্গিটা নয়ত রে? বুচানন সাহেব? সাবধান, ওর সঙ্গে যেন কোন সন্ধি বাধাতে যাস না। মারখুনে মানুষ—কাণ্ডজ্ঞানহীন–কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই তো!

নাতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপ তিনি সাবধান করে দেন।

আচ্ছা উপসর্গ কয় প্রকার বল ত দেখি?

পর-পর তিনবার একটা বেজে গেছে ঘড়িতে–সাড়ে বারোটার, একটার এবং দেড়টা ঘণ্টা–সেও হয়ে গেল কতোক্ষণ! ঘুমে সারাদেহ জড়িয়ে আসছে টুসির–এখন উপসর্গে কেন–সোজা স্বর্গে যেতে বললেও সে রাজি নয়, শক্তিও নেই তার।

আচ্ছা আমি বলে যাচ্ছি, তুই গুণে যা। প্র, পরা অপ, সং–

ঘুমের ঘোরেই শুনতে থাকে টুসি। কটা হলো উপসর্গ সবশুদ্? দশটা না না দুশোটা? ওর নিজেকে নিয়ে? দাদুকে ধরে, না বাদ দিয়ে? আর বুচানন? সেও তো দেখতে অনেকটা সঙের মতোই! সঙও তো একটা উপসর্গ? বুচানন তাহলে উপসর্গ। আর বটবৃক্ষ? বটগাছের তদ্ধিত হয়? বুচাননের?–

–উৎ পরি, প্রতি, অভি, অতি, উপ, আ! কিরে? গুণলি? কটা হলো? আরে মোলো যা, এ যে নাক ডাকতে লেগেছে!

দেখতে না দেখতে আরেক উপসর্গ দেখা দিয়েছে টুসির। নাঃ ভারী ঘুম কাতুরে হয়েছে ছেলেটা! এই কথা বলছে–বলতে-বলতে–এই ঘুম? দিনরাতই ঘুমুচ্ছে! আশ্চয্যি! ঘুমিয়ে কি সুখ পায় এরা? ঘুমিয়ে হয়টা কি, অ্যাঁ? নাক-ডাকানো নাহক সময়ের অপব্যয়! নাঃ ঘুমিয়েই ফতুর– মানুষ আর হলো না ছোঁড়াটা। কড়িকাঠের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়তে থাকে দাদুর।

সকালে টেবিলে বসে মলিনমুখে দৈনিক কাগজের পাতা ওলটায় টুসি। এত বড়ো আনন্দবাজার সামনে, তবু সে নিরানন্দ। দাদুর অসুখ সারাতে গিয়ে নিজের সুখও তার গেছে। হঠাৎ বিজ্ঞাপনের এক জায়গায় তার চোখ গিয়ে আটকায়–স্বামীজির অদ্ভুত যোগবল! পড়ে উৎপুল্ল হয়ে দাদুকে লুকিয়ে সেই ঠিকানায় একটা চিঠি লিখে ছেড়ে দেয় তক্ষুনি।

পরদিন প্রাতঃকালেই নধর-দর্শন স্বামীজির প্রাদুর্ভাব হয় তাদের বাড়িতে। কি চাই আপনার?

জয়োস্তু! আপনার দৌহিত্রের আত্নানেই আসা। তার পত্রে আনুপূর্বিক সমসস্তই প্রণিধান করেছি। অত না লিখলেও হতো–যোগবলেই সব।

কি? হয়েছে কি? দাদু একটু ভীতই হন।

আপনার দুঃসাধ্য ব্যাধি–তবে আমি সারিয়ে দেবো। যোগবলে সবই সম্ভব। শুরু যোগবলেই সম্ভব।

কিছু তো বুঝতে পারছি না মশাই! থমমত খান উনি।

সন্ত্রস্ত হবে না। তখন স্বামীজিই সমস্ত বুঝিয়ে দেন সাবলীল ব্যাখ্যায়–এই যে নিদ্রাহীনতা, এ সামান্য ব্যাধি নয়, আশু না সারালে এতেই গতাসু হবার ধাক্কা! যোগের দ্বারাও নিদ্রা আনানো যায়, যাকে বলে যোগনিদ্রা, নিদ্রাযোগের সঙ্গে অবশ্যই তার অগাধ পার্থক্য; যোগবলে মানুষকে এমন কি, চিরনিদ্রায় পর্যন্ত অভিভূত করে দেওয়া যায়, যদিও বলযোগেও সেটা সম্ভব, কিন্তু দুইয়ের ফারাক বহুৎ। উনি ইচ্ছা করলে টুসির দাদুকে এই মুহূর্তেই নিদ্রালু করে দিতে পারেন।

কিন্তু সন্ত্রস্ত হতেই হলো এঁকে–কি আলু? আলুত্বে পরিণতির ভয়াবহ আমঙ্কায় তাঁর চোখ-মুখ তখন বেগুনের মত নীল হয়ে গেছে।

নিদ্রালু। এক্ষুণি হঠযোগের সাহায্যে আপনার ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি আমি। সহজ করে বলেন স্বামীজি।

কি যোগ বললেন?

হঠযোগ।

ওতে কিসসু হবে না। হতাশভাবে ঘাড় নাড়ের টুসির দাদু। ইঁটযোগ করে দেখা হয়েছে মশাই, কিসসু হয়নি।

ইটযোগ বলতে স্বামীজি কি প্রণিধান করলেন, স্বমীজিই জানেন, কিন্তু তারপরই তিনি ইঁটযোগ আর হঠযোগের পার্থক্য, প্রথমোক্তের চেয়ে শেষোক্তের শ্রেষ্ঠতা, যোগের পরম্পরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মরূপে বোঝাতে অগ্রসর হন। টুসির দাদুর প্রথমে সংশয়, তারপরে সন্দেহ, তারপরে বিজাতীয় রাগ হতে থাকে। অবশেষে স্বামীজি যখন টাকাকড়ির প্রস্তাবে আসেন, যোগ থেকে একবারে বিয়োগের ব্যাপারে-হঠযোগের ক্রিয়াকলাপে কি কি এবং কত কত খরচ তখন আত্মসংবরণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না।

কী? জোচ্চুরির আর জায়গা পাওনি? বোকা পেয়ে ঠকাতে এসেছ আমায়? বটে? বোমার মতন ফাটেন তিনি–নিয়ায় তো টুসি, সেই হঁটখানা। ইঁটযোগ কাকে বলে, একবার বুঝিয়ে দিই লোকটাকে।

আপমান-সূচক কথা বলবেন না বলছি। স্বামীজিও চটে যান।–তাহলে আমি রাগান্বিত হয়ে এই মুহূর্তেই হয়তো আপনাকে ভস–ভস্মীভূত করার আগেই ফস করে তাঁকে থামতে হয় হঠাৎ। সেই মুহূর্তে ইঁট হস্তে টুসির প্রবেশ ঘটে।

আহা ক্রোধ-পরবশ হচ্ছেন কেন। ক্রোধ-পরবশ–বলতে বলতে কয়েক–পা পিছিয়ে যান স্বামীজি এবং পরমুহূর্তেই সুপরিকল্পিত এক পশ্চাৎ লাফে অদৃশ্য হন, বোধকরি যোগবলেই।

টুসির দাদু শুধু বলেন–ছ্যাঃ!

ঐ অব্যায়–শব্দে টুসির কি প্রণিধান হয় কে জানে; সে লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে থাকে।

ওর বিষণ্ণ-মুখ দেখে মায়া হয় দাদুর!–যাক, তাতে আর কি হয়েছে? তুই তো ভালই চেয়েছিলি–যাকগে, ভালই হয়েছে। পরশু আছে শিবরাত্রি। ছোটবেলা থেকে ভেবে আসছি যে, শিবরাত্রি করবে; কিন্তু করা আর হয় না! হয় খেয়ে ফেলি, নয় ঘুমিয়ে পড়ি। এবার তো আর ঘুমোনোর ভয় নেই, কেবল খাওয়াটা বাদ দিতে পারলেই হয়। তাহলে হলো। পুণ্যটা করে ফেলা যাক এই ফাঁকে। কি বলিস?

টুসি এতক্ষণে খুশি হয়–আমিও দাদু করবো তাহলে!

তখন দুজনে মিলে প্ল্যান আঁটেন–না-খাওয়ার, না-ঘুমোনোর প্ল্যান। দীর্ঘ এক ফিরিস্তি বেরোয়–কখন কি কি না করতে হবে তার। টুসি কি না খেয়ে থাকতে পারবে, বিশেষ করে না ঘুমিয়ে? যা ঘুম পায় ওর। আর যেমন বিটকেল খিদে। দিনরাত খালি খাই-খাই। আর সারাদিন না হয় টেনিস খেলেই গেল, কিন্তু রাত্রে? রাত্রে টেনিস খেলা তো সম্ভব নয়, আর রাত্রে তো ঘুম পাবেই টুসির। এ বিষয়ে টুসির দাদুর বিশ্বাস সুদৃঢ়; টুসির নিজেরও যে একেবারে সন্দেহ নেই, তা নয়।

টুসি প্রস্তাব করে–সরারাত সিনেমা দেখা যাক না কেন? তাহলে কিছুতেই ওর ঘুম পাবে না, শিবের দিব্যি গেলে সে বলতে পারে। কত ভাল-ভাল বাংলা বই আর বিলিতি সিরিয়াল হোলনাইট শো রয়েছে সব হাউসেই।

বায়স্কোপে দাদুকে রাজি করাতে বেশী বেগ পায় না সে। আর তখন থেকেই লাফানো শুরু হয়ে যায় তার।

শিবরাত্রির সকাল থেকেই উপবাস শুরু হয় টুসির। প্রথমে রাস্তায় বেরিয়েই এক বন্ধুর আমন্ত্রণে রেস্তোরাঁয় বসে অন্যমনস্কতার বশে এককাপ চা একখানা মামলেট; তারপরে ঘন্টা-দুয়েক বাদ আর এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মনের ভুলে ফের চিনেবাদাম আর ডালমুটের সদ্ব্যবহার; তারপরে আরেজনার খপ্পরে পড়ে আবার শোন পাপড়ি আর চন্দ্রপুলি, সেও অবিশ্যি ভুলক্রমেই; তারপরে বিকেলে যোগেশদার আহ্বানে অনিচ্ছাসত্ত্বেই একপ্লেট মটনকারি আর খানকয়েক টোস্ট তারপর সন্ধ্যের মুখে ওদের ক্লাসের সেকেন্ড বয় সমীরের বাড়ি হানা দিয়ে এবং সে না সাধতেই–তাকে সতর্কতার অবকাশ না দিয়েই তার পাত থেকে পাঁচখানা পরোটা আর গোটা-আলুর দম–এইভাবে সারাদিন দারুন উপবাস চালিয়ে শ্রান্ত, ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত টুসি রাত নটার দাদুর সঙ্গে যায় নামজাদা এক সিনেমায়।

 দাদুর ব্যারাম সোজা নয়

মাঝরাতে টুসির দাদুর পেট-ব্যাথাটা খুব-জোর চাগাড় দিয়ে উঠলো। দুহাতে পেট আঁকড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লে তিনি–এই কলিক। এতেই প্রাণ তার লিক করে বুঝি এক্ষুনিই। তার মর্মান্তিক হাঁকডাক শুরু হয়–টুসি টুসি।

টুসি ঘুমোচ্ছিল পাশের বিছানাতেই, জেগে ওঠে সে। কি দাদু। ডাকছো আমায়?

এক্ষুণি যা একবার বামাপদ ডাক্তারের কাছে। ছুটে যাবি। বলবি যে, মরতে বসেছে দাদামশাই।

অ্যাঁ?–টুসি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে।

বলবি যে, সেই কলিকটা–। হঠাৎ ভয়ানক–। উঃ বাবাগো।

ওঃ। সেই কলিক। অনেকটা আশ্বস্ত হয় টুসি। স্টোভে জল ফুটিয়ে বোতলে পুরে দেবো তোমায় দাদু? চেপে ধরবো তোমার পেটে?

ধুত্তোর বোতল। বোতলেই যদি কাজ হোতো, তাহলে লোকে আর ডাক্তার ডাকতো না। বোতলের কাছেই ব্যবস্থা নিত সবাই। উঃ। আঃ। ওরে বাবারে। গেলাম রে।

দাদুর আর্তনাদে বিকল হয়ে পড়ে টুসি। বামাপদবাবুকে কল দিতে যেতেই হয় । কি আর করা?

কিন্তু এই রাত্রিরে? এত রাত্তিরে আসবেন কি ডাক্তার? রাতবিরেতে রাস্তায় বেরুতে টুসি একটু ইতস্তত করে।

বেশি কি রাত হয়েছে শুনি? এই তো সবে দুটো। আর এমন কি দূর? দেরি করিসনে যা। আর্তনাদের ফাঁকে ফাঁকে উৎসাহ-বাণী বিতরণ করেন ওর দাদু।

শার্ট গায়ে, শ্লিপার পায়ে তৈরি হয় টুসি। ছোট্টো মানিব্যাগটা পড়ে যায় পকেট থেকে; যথাস্থানে তাকে আবার তুলে রাখে। ফাউন্টেনপেনটাও আঁটে বুকে। এত রাত্তিরে কে আর দেখছে তার কলম। তাহলেও—তবুও–।

ছুটতে ছুটতে যাবি। দাঁড়াবিনে কোথায়। যাবি আর আসবি। আমি খাবি খাচ্ছি। বুঝেছিস?

অতঃপর মর্মন্তুদ যত অব্যয়শব্দ-অপপ্রয়োগের পালা শুরু হয়ে এর দাদুর–মা গো বাবা গো। গেলুম গো। উঃ। আ। ইস। উঁহুহু।

ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে পড়ে টুসি। এক পলকও দাঁড়ায় না আর।

প্ৰথম খানিকটা সে সবেগেই যায় কিন্তু ক্রমশইঃ ওর গতিবেগ মন্দীভূত হয়ে আসে। খেয়ে না খেয়ে সে বেশ একটু মোটাই; তাড়াহুড়ার পক্ষে খুবই যে উপযোগী নয়, অল্পক্ষণেই সে তা বুঝতে পারে। তবু তার দাদুর যে এখন-তখন, একথা ভাবতেই টুসির মন ভারী হয়ে আসে-ভারী পা-কে তাড়িত করে দেয়। হাঁপাতে হাঁপাতেই সে ছোটে।

এমন সময় রাস্তার এক প্রাণী অযাচিতভাবে এসে টুসির গতিবৃদ্ধির সহায়তায় লাগে, যদিও সে সাহায্য না করলেও টুসির নিজের মতে–বিশেষ কোন ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না।

জনবিরল পথ। কোনো লোক নেই কোথাও। একটা মোটরও চলে না রাস্তায় কেবল ইঁদুররাই এই সুযোগে মহাসমারোহে রাস্তা পারাপার করছে এধারের ফুটপাথ পেরিয়ে ওদিকের অন্দরে গিয়ে সেঁধুচ্ছে। ওদিকে থেকে ছুটে আসছে এদিকে।

যথাসম্ভব তেজে চলেছে, টুসি, ইঁদুরের শোভাযাত্রার পদাঘাত না করে–সবদিক বাঁচিয়ে।

এমন সময় একটা কুকুর–

ইঁদুরদের অন্বেষণেই এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল সে বোধহয়, কিন্তু বৃহত্তম শিকার পেয়ে ক্ষীণজীবীদের পরিত্যাগ করতে মুহূর্তের জন্যেও সে দ্বিধা করলো না। টুসির পেছনে এসে লাগলো সে।

ঘেউ—ঘোউ–ঘেউউউ।

টুসি দৌড়োয় আরো-আরো-জোরে। আরো-আরো–তীরবেগে সে ছুটতে শুরু করে।

কুকুর সশব্দে দৌড়ায়। টুসির পেছনে-পেছনেই।

হাঁপ ফেলার ফাঁক নেই টুসির প্রাণপণে সে দৌড়াচ্ছে–। ফিরে তাকাবার ফুসরৎ নেই তার। না ফিরেই সে উদ্ধত আওয়াজ শোনে, উদ্যত নখদন্ত নিজের মনশ্চক্ষেই দেখে নেয়। আরো জোরে সে ছুটতে থাকে।

ছুটতে-ছুটতে তার মনে হয়, দৌড়োচ্ছে সে এমন আর মন্দ কি। মোটা বলে ইস্কুলের ছেলেরা দৌড়ের-স্পোর্টসে নামাবার জন্যে প্রায়ই ওকে ওসকায়; কিন্তু এরকম একটা কুকুরের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রথম পুরস্কারই মেরে দিতে পারে সে একছুটেই–হ্যাঁ।

কিন্তু দরকারের সময় কোথায় তখন কুকুর? এখন-যখন তেমন তাড়া নেই, কুকুরের তাড়নায় ছুটতে হচ্ছে ওকে।

ছুটবার মুখে টুসির সম্মুখে এসে পড়ে একটা পার্ক লোহার সরু করগেট, শিকের রেলিং দিয়ে ঘেরা। পার্কের মধ্যে ঢুকে পড়ে হাঁপ ছাড়ে টুসি। কুকরটা বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরীক্ষণ করতে থাকে। বড় আর একটা উচ্চবাচ্য করে না সে-কি হবে অকারণে ঘেউৎকারে গলা ফাটিয়ে? নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে শিকার এখন। শিকের রেলিং ডিঙিয়ে, কি তার কায়দায় দরজা খুলে ভেজিয়ে ভেতরে ঢোকার কৌশল তো ওর জানা নেই। বাইরে দাঁড়িয়ে নিতান্তই জিহ্বা-আস্ফালন এবং ল্যাজ-নাড়া ছাড়া আর উপায় কি?

পার্কের ওধারে একটা গ্যাসে বাতি খারাপ হয়ে দপদপ করছিল। প্রায় নিভবার মুখেই আর কি। বাতির অবস্থা দেখে দাদুর অবস্থা ওর মনে পড়ে। তার জীবন-প্রদীপও হয়তো ওই বাতির মতোই–ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে টুসি।

পার্কের ওধারের গেটটা পেরিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে খানিকটা গেলেই বামাপদবাবুর বাড়ি।

টুসি পার্কের অন্যধারে যায়। গেটটা আবার কিছুটা দূরেই–অতটা ঘুরে যেতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। সামনেই রেলিং এর একটা শিক বেশ ফাঁক করা দেখতে পায় সে। ছেলেফিলেদের যাতায়াতের সুবিধার জন্যেই বিধাতার সাহায় নিশ্চয়ই এই ফাঁকের সৃষ্টি। ফাঁকের নেপথ্য দিয়ে –ফাঁকি দিয়ে গলে যাবার সোজা রাস্তা নেয় সে।

কিন্তু টুসির হিসেবে ভুল ছিল ঈষত্মাত্র। ছেলের মধ্যে ধরলেও পিলের মধ্যে কিছুতেই গণ্য করা যায় না ভুল ছিল ঈষত্মাত্র। ছেলের মধ্যে ধরলেও পিলের মধ্যে কিছুতেই গণ্য করা যায় না তাকে, বরং পিপের সঙ্গেই তার উপমা ঠিক মেলে। কাজেই মধ্যপথেই সে আটকে যায়–ঠিক তার দেহের মধ্যপথে। এগুতেও পারে না, পেছিয়ে আসাও অসম্ভব।

বহুক্ষণ রেলিং এর সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে–করগেট শিকের বাহুপাশ কিন্তু একচুলও শিথিল হয় না। অবশেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় সে। কি মুশকিলেই সে পড়লো বলো তো। কোথায় বিছানায় আরামে না কোথায় রেলিং-এর ব্যাড়া মে। কান্না পেতে থাকে তার।

কুকুরটাও এতক্ষণে গোটা পার্কটা ঘুরে-ফিরে তাঁর কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিল। টুসির মুখের ওপরেই সে লাফাতে-ঝাপাতে শুরু করে এবার।

অসহায় হয়ে হাত পা ছুঁড়ে টুসি কী আর করবে? তাও একখানা হাত, আধখানা পা-তার বেশি আর নয়। পালিয়ে বাঁচবার উপায়ও তার নেই। আগেই সে-পথ সে বন্ধ করেছে।

ওকে ছেড়ে ওর কোঁচা ধরে টানতে থাকে কুকুরটা। অ্যাঁ! মুক্তকচ্ছ করে দেবে নাকি! মতলব তো ভাল নয় ওর! দুহাতে প্রাণপণে কাপড় চেপে ধরে টুসি–গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে। এক কামড়ে কোচার খানিকা ছিঁড়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যায় কুকুরটা। হ্যাঁ, বিরক্ত হয়েই বেশ। হুটোপাটি নেই, দৌড়ঝাঁপ নেই এরকম ঠায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রেলিং-এর গায় লেগে থাকা খেলা ভাল লাগে না ওর। ইঁদুরের খোঁজেই সে চলে যায় আবার।

কুকুরটা ওকে বর্জন করে গেলে কিছুটা স্বস্তি পায় সে। খানিক বাদে একটা লোক যায় পাশ দিয়ে–টুসি তার দিকে ডাক ছাড়ে।

ও মশাই! মশাই গো!

কে? লোকটা চমকে ওঠে। কি? কি হয়েছে তোমার? টুসির কাছে এসে জিগ্যেস করে সে।

আমাকে এখান থেকে বের করে দিন না মশাই! টুসির কণ্ঠস্বর অতিশয় করুণ। ভারি মুশকিলে পড়েছি আমি।

ওর অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করে দ্যায় লোকটা–বাঃ! বেড়ে তো! কার অঞ্চলের নিধি এসে এখানে আটকে পড়োছো চাঁদ! আছে নাকি কিছু তাঁকে?

টুসির পকেটে হাতড়ে মানিব্যাগটা সে হাতিয়ে নেয়। দাদুর দেওয়া ইস্কুলের মাইনে আর বায়োস্কোক দেখার পয়সা–সবই যে রয়েছে ঐ ব্যাগে। টুসির যথাসর্বস্ব! সবটা বাগিয়ে নিয়ে লোকটা সত্যিই চলে যায় যে-! বাঃ! বেশ মজার তো!

টুসি চেঁচাতে শুরু করে–পিক-পকেট! পকেটমার! পুলিশ। ও পুলিশ! চোর, ডাকাত, খুনে পালাচ্ছে পুলিশ! ও পুলিশ।

লোকটা ফিরে আসে ফের–অমন করে চাচাচ্ছো কেন যাদু? এই নিশুতি-রাতে শুনবে কে? কে জেগে বসে আছে সারারাত তোমার জন্যে হারানিধি? এই যে, বাঃ। ফাউন্টেনপেনও একটা আছে দেখছি! দেখি বাঃ বেশ পেনটি তো। পার্কার? কিছু মনে কোরো না লক্ষ্মী ভাইটি।

অতঃপর কলমটি হস্তগত করে ওর মাথায় আদর করে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় লোকটা। টুসি আর চাঁচায় না এবার।

কতক্ষণ যে এভাবে কাটে, জানে না সে-হঠাৎ ভারী একটা সোরগোল শুনতে পায় টুসি।

চোর-চার! পাকড়ো! পাকড়ো উধর ভাগা-উস তরফ।

হ্যাঁ, সেই পকেট-কাটা হতভাগাই। ছুটতে ছুটতে সে এসে টুসির পাশের রেলিং টপকে পার্কের গেট দিয়ে উধাও হয়।

কয়েক মুহূর্ত পরেই এক পাহারাওয়ালা এসে টুসিকেই জাপটে ধরে–পাকড় গয়ি! এই ভাইয়া! নিজের উচ্চকণ্ঠ ছেড়ে দেয় সে–এবার ফুর্তি ওর দ্যাখে কে!

আরেকজন পাহারাওয়ালা এসে যোগ দেয় তার সঙ্গে–এই! বাহার আও। নিকলো জলদি! টুসিকে এক ঘুসি লাগায় সে কষে–চোট্টা কাঁহাকা?

টুসি ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে।

আরে! ই তো রোনে লগি! বহুৎ বাচ্চা বা!

বাচ্চা হোই চায় সাচ্চা হই, লেকিন একঠো কো তো থানামে লে-যানা পড়ি।

অপর পাহারাওয়ালাটা বলে–এই! চলো থানাতে।

থানাতেই তো যেতে চাচ্ছি আমি। টুসি কাঁদতে কাঁদতে জানায়–আমায় নিয়ে যাও না থানায় ধরে-বেঁধে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও না আমাকে। ভারী করুণ কণ্ঠ ওর।

যদি চুরির দায়ে পড়েও মুক্তির সম্ভাবনা আসন্ন হয় এই লৌহ-শৃঙ্খলের কবল থেকে–টুসি তাতেও রাজি এখন। বেশ প্রসন্নমনেই রাজি।

দেহের সমস্ত বল দিয়ে দুই পাহারাওয়ালার দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হয় তখন–কিন্তু দারুণ টানাটানিতেও বিন্দুমাত্রও ধসকানো যায় না টুসিকে। একচুলও এদিকে ওদিকে করতে পারে না ওরা।

দুজনের থমকে গিয়ে হাপাতে থাকে। টুসিও।

বড়ি জোরসে সাটল বা! ই-তো এইসা নিকলবে না! একজন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে!

অন্যজন কপালের ঘাম মোছে–লোহা তোড়না লগি। মিস্তির চাহি ভাইয়া!

অতঃপর দুজনের মধ্যে কি যেন পরামর্শ হয়। কানাকানি ফুরোলে দুজনেই ওরা মুখ ব্যাজার করে–ছোড় দে ভাইয়া! ই-চোরসে হামলোগোঁকা কাম নহি!

এই বলে—’স্থানত্যাগেন দুর্জনাৎ’ চাণক্যের এই নীতি-বাক্য মেনে নিয়ে সরে পড়ে তারা তৎক্ষণাৎ।

চোর তো ছেড়েই গেছে, এখন পুলিশেও ছেড়ে চলে গেল, তাহলে পরিত্রাণের ভরসা সেই এতক্ষণে বুঝতে পারে টুসি। কুকুর, পকেটমার, পাহারাওয়ালা একে-একে সবাই ওকে ছেড়ে গেল!

সকলের পরিত্যাক্ত হয়ে একা সে দাঁড়িয়ে থাকে নির্জ্জন পার্কের একধারে রেলিং-এর সঙ্গে একাকার হয়ে একটা আলোর দিকে তাকিয়ে–

বাতিটা দপদপ করছে তখন থেকেই—

তার দাদুও বোধহয়….

ভোর হয়ে আসে। দু-একজন করে লোক এসে দেখা দেয় পার্কে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক সব আসেন–খবরের কাগজ তাঁদের হাতে।

টুসি ঐ তটস্থ অবস্থাতেই নিজের ঘাড়ের ওপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে তখন। একজন ভদ্রলোক ব্যাপারটা দেখতে যান ইশারায় তিনি ডাকেন অপর সবাইকে।

ফিস ফিস করে আলোচনা শুরু হয় তাঁদের—

সেই ছেলেটিই না? যার নিরুদ্দেশের খবর বেরিয়েছে আজকের কাগজে?

তাই তো মনে হচ্ছে।

এই যে লিখেছে–ছেলেটি শ্যামবর্ণ, দোহারা চেহারা, দোহারা বলিলে হয়তো কমিয়েই বলা হয় বরং বেশ হৃষ্টপুষ্টই বলিতে হইবে। যেমন হৃষ্ট, তেমনই পুষ্ট! অদ্য রাত্রি প্রায় দেড় ঘটিকার সময় ডাক্তার ডাকিবার অজুহাতে বাড়ি হইতে বাহির হইয়া নিরুদ্দিষ্ট হইয়াছে। যদি কেহ উক্ত শ্রীমানকে দেখিতে পান দয়া করিয়া শ্ৰীমানের খোঁজ দেন, তাহা হইলে চিরকৃতজ্ঞ থাকিব। কোনোরকমে একবার ধরিতে পারিলে নগদ পাঁচশত পুরস্কার।

আরো এই যে, এখানেও আবার!-–টুসি ভাই! যেখানেই থাক, ফিরিয়া আইস। আর তোমাকে ডাক্তার ডাকিতে হইবে না। তোমার দাদু আর মৃত্যুশয্যায় নেই, এখন জীবন্ত-শয্যায়। সুতরাং আর কোন ভয় নেই তোমার। কতো টাকা চাই তোমার, লিখিও। লিখিলেই পাঠাইয়া দিব।

আবার এই যে-পুনশ্চ! প্রিয় টুসি, তুমি ফিরিয়া আসিলে ভারী খুশি হইব। এবার তোমার জন্মদিনে তোমাকে একটা টু সীটার কিনিয়া দিব। যেখানে যে- অবস্থায় থাকো, লিখিয়া জানাইও। মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইব। ইতি তোমার দাদু।

তাঁদের একজন খবর দিতে ছোটেন টুসির দাদুকে। বাকি সবাই টুসিকে ঘিরে আগলাতে থাকেন। কি জানি, যদি পালিয়ে যায় হঠাৎ! জেগে উঠেই টেনে দৌড় মারে যদি! হাওড়া গিয়ে ট্রেনে দৌড় মেরে হাওয়া হয়ে যায়। ওঁরা খুব সন্তর্পণেই ওকে ঘিরে দাঁড়ান, ঘুণাক্ষরেও শব্দ হয় না–নিঃশ্বাস ফেলার শব্দও না!

একজন মন্তব্য করছিলেন–ঘুমোবার কায়দাটা দেখুন! শোবার জায়গাটিও বেছে নিয়েছে বেশ–ফাঁকা-মাঠে-খোলা হাওয়ায়-তোফা আরামে-মজা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোঁড়ার ফুর্তি দেখুন এককার?

অমনি আর সবাই তার মুখে চাপ দিয়েছে–চুপ! চুপ! করছেন কি? জেগে উঠবে যে! জেগে উঠলে পালাতে কতক্ষণ! আমরা কি তখন ধরতে পারবো দৌড়ে? ওর বাবার বাবাই পারেনি যেখানে…।

ধরা শক্ত বলেই ত পুরস্কার দিয়েছে ধরবার জন্যে-কোন রকমে একবার ধরিতে পারিলে–দেখছেন না?

টুসির দাদু এসে পড়েন ট্যাক্সিতে।

নাতিকে দেখে তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে। বলে–আমি মরছি কলিকের জ্বালায় আর উনি কিনা এখানে এসে মজা করে–আয়েস করে ঘুমোচ্ছেন!

এক থাপ্পড় কসিয়ে দেন তিনি টুসির গালে।

আহাহা! মারবেন না, মারবেন না! সবাই হাঁ হাঁ হাঁ করে ওঠেন।

না, মারব না! মারব না বইকি! মশাই, সেই দেড়টার সময় বেরিয়েছে ডাক্তার ডাকতে, দেড়টা গেল, দুটো গেল, আড়াইটা গেল, তিনটেও যায় যায়। পাত্তাই নেই বাবুর! কলিক উঠে গেল আমার মাথায়! জানেন মশাই, পঞ্চাশ টাকার ট্যাক্সিভাড়া বরবাদ গেছে একরাত্রে আমার? কলিক পেটে নিয়েই সেই রাত্রেই দৌড় কি দৌড়! এ-থানায়, সে-থানায় কোন থানাতেই নেই উনি! এ হাসপাতাল, ও-হাসপাতাল–কোথাও নেই হতাহত হয়ে! হাত-পা কেটে পড়ে থাকলেও ত বাঁচতুম! কিন্তু তাও নেই। কি বিপদ ভাবুন ত। কি করি! গেলুম তখন খবরের-কাগজের আপিসে। সেই রাত্রেই। রাত আর কোথায় তখন, ভোর চারটে! নাইট এডিটারের হাতে-পায়ে ধরে মেশিন থামিয়ে স্টপ প্রেস করে একমুঠো টাকা গচ্ছা দিয়ে তবে এই বিজ্ঞাপনটা ছাপিয়ে বের করেছি জানেন?

একখানা আনন্দবাজার পকেটের ভেতর থেকে টানাটানি করে বের করেন তিনি।

তবেই এই বিজ্ঞাপন বেরোয় আজকের কাগজে! আর আপনি বলছেন কিনা, মারবেন না! তিনি আরো বেশি অগ্নিশর্মা হন। মারবো না? তবে কি আদর করবো নাকি ওই বাঁদরকে?

চড়ের চাপটেই চটকা ভেঙে গেছল টুসির কিন্তু সবই ওর কেমন যেন গোল- মাল ঠেকছিল; মাথায় ঢুকছিল না কিছুই। কিন্তু এখন চোখের সামনেই স্বয়ং দাদু এবং তাঁর বিরাশী সিক্কার একত্র যোগাযোগ দেখে তার ফলাফল অচিরেই কতদূর মারাত্মক হতে পারে, মালুম করতে বিলম্ব হয় না টুসির।

এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে যায় টুসি-লৌহ-বেষ্টনীর আলিঙ্গন পাশ থেকে মুক্ত হবার অন্তিম-প্রয়াসে!

আশ্চয্যি! শিকের বগল থেকে সে গলে আসে আপনার থেকেই–অনায়াসেই! চেষ্টা না করতেই একেবারে সুড়ুৎ করে চলে আসে! এক রাত্রেই চুপসে আধখানা হয়ে এসেছে বেচারা– কাজেই আলগা হয়ে বেরিয়ে আসতে দেরি হয় না তার!

আর, দাদুর ঘুষি টুসির কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই সে সরেছে। সরেছে উদ্দামগতিতে।

চোখের পলক পড়তে না পড়তে টুসি পার্কের অন্য পারে! রেলিং টপকাবার আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে, সন্নিহিত আরেকটা শিকের উন্মুক্ত আহ্বান উপেক্ষা করে, এমন কি আরেকটা ছেলেপিলের যাতায়াতের ফাঁসের প্রলোভন সংবরণ করেই টুসি এবার সদর-গেট দিয়েই বেরিয়ে গেছে সটান।

বেরিয়েই ছুট কি ছুট! ডাইনে না, বায়ে না, সোজা বামাপদবাবুর বাড়ির দিকে।

ওর দাদু এদিকে গজগজ করতে থাকেন-বাবু এখন বাড়ি গেলেন ত গেলেন। না গেলের ত ওঁরই একদিন কি আমারই একদিন।

একজন এগিয়ে গিয়ে বলতে সাহস করে–আপনার নাতি যে আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেল মশাই!

উনি গর্জ্জন করেন–নিরুদ্দেশ হয়ে গেল বলেই ত বেঁচে গেল এ-যাত্রা। নইলে কি আর আস্ত থাকত? দেখেছেন ত সেই চড়খানা? সেই নাতিবৃহৎ চড়? তার পরেও কি কোন নাতির-যতই সে বৃহৎ হোক না! উদ্দেশ পাওয়া যেত এতক্ষণ?

গুম হয়ে ট্যাক্সিতে গিয়ে বসেন তিনি।

ও মশাই, পুরস্কার?–পুরস্কার?

দু-চারজন দৌড়ায় ওঁর পেছনে–পেছনে। ছাড়বার মুখে ট্যাক্সিটা ভর-ভরর-ভরর ভরর-র র র র–ভরাট গলায় এক আওয়াজ ছাড়ে, আর সেই সাথে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে যায় ও দের মুখে।

 নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ

সেদিন পয়লা বোশেখ! কমল নিয়ে বসে কি লিখি কি লিখি করছিলাম। কিছুই আসছিল না কলমে।

অবশেষে বিরক্ত হয়ে কলম ফেলে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিলাম। সামনেই পড়েছিল রিসিভারটা, আমার টেবিলের এক কোণে।

কিন্তু এখন কাকে ফোন করি? টেলিফোনের রিসিভারটা হাতে নিয়ে ভাবছিলাম। আজ সম্বচ্ছরের প্রথম দিন–কাউকে ডেকে নতুন বছরের সাদর সম্ভাষণ জানালে কেমন হয়?

কিন্তু কাকে জানাই? কাকে আবার! যাকে তাকে, যাকে খুশি তাকেই। আজকের দিনে কে আপনার, কে-ই বা পর? একধার থেকে ডেকে ডেকে সবাইকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে দিই। ধরে পাকড়ে তাই করাটাই কি ঠিক হবে না?

টেলিফোন ডিরেকটরী নিয়ে নাড়াচাড়া করি। অসংখ্য নাম। নম্বরও বহুৎ। কোন ধার থেকে শুরু করা যায়?

চক্রবর্তীদের নিয়েই আরম্ভ করা যাক না। চ্যারিটি বিগন্স অ্যাট হোম। তাছাড়া বঙ্কিমবাবুও বলে গেছেন–। কী বলে গেছেন? না, চক্রবর্তীদের নিয়ে বিশেষ করে কিছু বলেন নি, তবে চক্রবর্তীদের নিয়েও সেকথা বলা যায়। একটু ঘুরিয়েই বলতে হয় বলতে গেলে। হ্যাঁ চক্রবর্তীকে চক্রবর্তী না ডাকিলে কে ডাকিবে? অতএব একে একে চক্রবর্তীদের ধরে ধরে ডেকে যাই। এবং মিষ্টি করে নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ জ্ঞাপন করি। আমার দ্বারা, তাদের চক্রবর্তীসুলভ যৎকিঞ্চিৎ জীবনে কিছু কিছু আরামের আমদানি হোক। ক্ষতি কি?

কিন্তু চক্রবর্তীও খুব কম নেই! তারাই দেড় গজ জুড়ে আছে ডিরেকটরীর। কলকাতার ফুটপাথ হতে পারে, কিন্তু টেলিফোনের পাতারও যে এমন চক্রবর্তী সঙ্কুল এ ধারণা আমার ছিল না। যাই হোক, প্রথম একটা চক্রবর্তীকে পছন্দ করলাম, এবং টেলিফোনটা কাছে এনে রিসিভারটা তুলে ধরলাম যথারীতি নম্বর বলা হলো। অনেকক্ষণ ধারে কোন সাড়া-শব্দ নেই। হালখাতায় বেরিয়ে গেছেন নাকি ভদ্রলোক? এতো বেলা পড়ে থাকতেই? বিচিত্র নয়, চক্রবর্তীরা যেরূপ মিষ্টান্নলোলুপ আর উদরহৃদয়, অবাক হবার কিছু নেই।

বহুক্ষণ বাদে একটা আওয়াজ এল। মাছের মুড়ো মুখে করে কে একজন কথা বলেছ বোধ হল আমার। রং নম্বার। রং নম্বার। রং নম। বলতে বলতেই নিরুদ্দেশে মিলিয়ে গেল সেই আওয়াজ।

ভারী বিরক্তি লাগে। নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ জানাতে বসে মন্দ না। ভাব জমাবার গোড়াতেই আড়ি। দূর দূর!

রিং করতে শুরু করি ফের।

আওয়াজটা আবার ঘুরে আসে এসে জানায় : নাম্বার এনগেজট।

এবং এই বলেই আবার সেটা উধাও হবার চেষ্টা করে, কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা। শুনুন মশাই, শুনুন। উপরচড়াও হয়ে আওয়াজটাকে পাকড়ে ফেলি।

বলুন! বলুন তাহলে! আওয়াজটাকে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে মনে হয়।

আপনিই শ্ৰীযুত চক্রবর্তী? আমি বলি।

না। মেগাফোন বিনিন্দিত কণ্ঠে উনি জবাব দিলেন।

আপনি-আপনি কে তবে?

এই! এই ঠাকুর! ইলিশমাছের বোসট কই আমার? রোসট? ইলিশের গোসত কাবাব? যাও, নিয়ে এস জলদি! তাঁ, কি বলছেন? আমি? আপনি কে? বলেছি তো আমি রং নাম্বার। তার ওপরে এখন আবার রীতি মতন এনগেজড।

তারপর আর কোন উচ্চবাচ্যই নেই। কিন্তু আমিও সহজে পরাস্ত হবার পাত্র না। আমার আরেক ডাকাতি শুরু হয়।ও-বেচারী এখন নাচার-রোসটলেস বলেই হয়তো রেস্টলেস এবং চক্রবর্তীও হয়তো নয়। দেখে শুনে দ্বিতীয় এক চক্রবর্তীকে ডাক দিই।

আপনিই কি মিস্টার চক্রবর্তী?

হ্যাঁ আপনি কে? নিজের নাম বললাম।

টেলিফোনের অপর-প্রান্তবর্তী সশব্দে ফেটে পড়লেন–

বাধিত হলাম। কিন্তু আপনাকে তো আমি চিনি না মশাই! নামও শুনি নি কক্ষনো! আমার কাছে কি দরকার আপনার? .

আজ্ঞে, দরকার এমন কিছু নয়। এই, কেবল আপনাকে আমার নমস্কার–অর্থাৎ–এই নববর্ষের–

কে হে বদ ছোকরা? ইয়ার্কি দেবার আর জায়গা পাও নি? আধঘণ্টা ধরে রিং করে অনর্থক বাথরুম থেকে টেনে আনলে আমায়? এখন ঠাণ্ডা লেগে আমার সর্দি হবে, সর্দি বসে গিয়ে ব্রংকাইটিস হবে। তারপরে নিউমোনিয়া দাঁড়িয়ে নিমতলা হয় কিনা কে জানে! হায় হায়, তোমার মতন গুণ্ডার পাল্লায় পড়ে অবশেষে আমি বেঘোরে মারা পড়লাম।

এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি কানেকশন কেটে দিলেন। নববর্ষ অবধি হয়ে থাকল, সাদর সম্ভাষণটা ভাল করে জানাবার ফুরসন্টুকুও পাওয়া গেল না। সে অবকাশ তিনি দিলেন না আমায়।

আবার ডাক দিতে হলো ভদ্রলোককে। দুঃখের সহিত, সেই বাথরুম থেকেই টেনে আনতে হল আবার। কি করব? কোন কাজ অসমাপ্ত কি অর্ধসমাপ্ত রাখা ঠিক নয়। সেটা চক্রবর্তীদের কাজ না। বিশেষ করে আজকের দিনে কারো সঙ্গে নতুন বছরের প্রথম খাতির জমাতে গিয়ে অখ্যাতি লাভটা যেন কেমন–!

আপনি মিষ্টার চক্রবর্তী?

আলবাৎ! আমি সেই! তুমি কোন বেয়াক্কেলে?

আজ্ঞে, আমি-আমি–আমতা আমতায় দ্বিধাভরে বলতে যাই।

একটু আগেই তো আমার জবাব দিয়েছি, আবার কেন? আচ্ছা তাঁদোড় তো!–

এই বলে সশব্দে তাঁর রিসিভার ত্যাগ করলেন, স্বকর্ণেই শুনতে পেলাম। আমাকে পরিত্যাগ করে আবার তাঁর বাথরুমেই প্রস্থান করলেন বোধহয়। নাঃ, উনি ওঁর জীবনকে সমুজ্জ্বল করতে উৎসুক নন। অন্তত আপাতত এই মুহূর্তে যে নন, তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে।

তালিকার তৃতীয় ব্যক্তিকে ধরে টানি এবার।

শ্ৰীযুত চক্রবর্তী আপনি?

ঠিক ধরেছেন? আপনি কে?

আজ্ঞে, আমিও আরেক শ্ৰীযুত–আজ্ঞে হ্যাঁ,চক্রবর্তীই। যুতসই হয়ে জানিয়ে দিই।

ও, তাই নাকি? চোখা গলায় বলতে শুরু করেন তৃতীয় ব্যাক্তি?

দু হপ্তা ধরে আমি গরু খোঁজা খুঁজছি আপনাকে। সেই যে আপনি কেটে পড়লেন দালালির টাকাটা মেরে দিয়ে তারপরে আপনার আর কোন পাত্তাই নেই। আচ্ছা লোক আপনি যাহোক! আপনার আক্কেলকে বলিহারি।

আমি একটু বিব্রত বোধ করি। সাদর সম্ভাষণের পূর্বেই একজন অপরিচিতের কাছ থেকে এতটা মোলায়েম অভ্যর্থনা–এমন সাগ্রহ হাপিত্যেশ আমি প্রত্যাশা করি না। বিশেষ করে একটু আগেই, দুদুটো সংঘর্ষ সামলাবার ঠিক পরেই। আমি তো কেবল সম্ভাষণ করেই সারতে চাই, এবং সরতে চাই। তারপরে আর কিছুই চাই না। কিন্তু ইনি তো দেখছি তারও বেশি অগ্রসর হতে উদগ্রীব। যেভাবে যেরূপ ঘোরতরভাবে আমাকে খোঁজাখুঁজি করেছেন বললেন, তাতে হয়তো এব পরেও রীতিমত ঘনিষ্ঠতা জমাবার পক্ষপাতী বলেই তাকে মনে হয়। এখন, ধরে বেঁধে কোরবানি না করলেই বাঁচি।

আমার তরফে বাক্যস্ফুর্তি হতে বিলম্ব হয়, স্বভাবতই একটু সময় লাগে। একি! চেপে গেলেন যে একেবারে? অন্য তরফে সম্ভাষণের দ্বিতীয় পালা শুরু হয়েছে ততক্ষণে : বেশ ভদ্রলোক আপনি! দালালির টাকাটা তো অক্লেশে মেরে দিয়ে যেতে পারলেন, কিন্তু এই পচা বাড়িতে কোনো মানুষ বাস করে? এঁদো, ড্যাম্পো, মশার আড্ডায়, কাঁকড়া বিছের সঙ্গে থাকতে পারে কেউ? এরকম বাড়ি আমাদের ভাড়া গছিয়ে এভাবে ঠকিয়ে কি লাভ হল আপনার শুনি? তিনি জবাবদিহি চান।

কী জবাব দেব? এবার আমাকেই কানেকশন কাট আপ করতে হলো, সম্ভব বজায় রাখা আর সম্ভব হলো না। দফায় দফায় করো রাহাজানি চললে তার সঙ্গে রফা করে নিজের দফা রফা করা আমার মত সুরাহাবাদীর রপ্ত নয়। কাজেই বিদায় সম্ভাষণ না করেই সাদর সম্ভাষণ স্থগিত রাখতে হল বাধ্য হয়েই–কী করব?

এবার চতুর্থ ব্যক্তির উদ্দেশে ডাক ছাড়লাম। এবং তাকে কাছাকাছি পাবা মাত্রই আর অন্য কথা পাড়তে দিই না, সর্বপ্রথমেই আমার কাজ সেরে নিই ।

শ্ৰীযুত চক্রবর্তী! আপনাকে আমার সাদর সম্ভাষন জানাই। নববর্ষের সাদর সম্ভাষণ!…

কাঁদো কাঁদো গলায় জবাব আসে; তা জানাবে বৈকি! তা না হলে বন্ধু? তা না জানাবে কেন? আজ তো তোমাদেরই সুখের দিন হে, তোমাদেরই স্ফুর্তি। এতদিনে আমার সর্বনাশ হয়েছে, পরশু মামলায় হেরেছি, শুশুরমশাই আত্মহত্যা করেছেন, আর আজ সকাল থেকে যত কাবলেওয়ায় ছেকে ধরেছে, আগামীকার আমায় দেউলে খাতায় নাম লেখাতে হবে, আজই তো তোমাদের মত হিতৈষীদের দহরমের সময় গোয় আনন্দ উথলে ওঠবার দিন তো। আমার সর্বনাশ না হলে আর তোমাদের পৌষমাস ফলাও হবে কি করে?

টেলিফোনের অপর প্রান্তে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর্তনাদ উচ্ছাসিত হতে থাকে।

এই ব্যক্তিকেও, এই চক্রবর্তীটিকেও, বরখাস্ত করে দিই তৎক্ষণাত। যে রকম বুঝছি, সব দিক থেকেই আমার সাদর সম্ভাষণের একদম অযোগ্য বলেই একে বোধ হচ্ছে। নববর্ষের জন্য একেবারেই ইনি প্রস্তুত নন। অতএব, পঞ্চম চক্রবর্তীকে বেশ একটু ভয়ে ভয়েই ডাকতে হয়।

সাড়া দিতে না দিতেই সদ্যলদ্ধ চক্রবর্তীমশাই আরম্ভ করেন–বুঝেছি আর বলতে হবে না গলা পেতেই চিনেছি। তা, সুদটা দিচ্ছেন কবে শুনি? আসল দেবার তো নামই নেই। কত জমে গেল খেয়াল আছে? অ্যাঁ? একেবারেই উচ্চবাচ্চই নেই যে! ঢের ঢের লোক দেখেছি বাবা, কিন্তু তোমার মতন এক নম্বরের এমন জোচ্চোর আর একটাও চোখে পড়ল না। একবার যদি সামনে পেতাম মেরে পসতা ওড়াতাম তোমার। পসতালেন তিনি।

আর বেশি শোনবার আমার সাহস হল না। পস্তায়মান এই ধারদাতার ধাক্কায় আমি আঁধার দেখলাম। তা ছাড়া সামান্য সাধারণ একজন, এক নামমাত্র চক্রবর্তী কেই আমি ডাকতে চেয়েছিলাম, এহেন কোন রাজচক্রবর্তীকে না!

রিসিভার নামিয়ে অনেকক্ষণ কাহিল হয়ে থাকি।

তারপর বিস্তর ইতস্তত করে যষ্ঠ ব্যক্তির জন্য রিসিভার তুলি। কথায় বলে, বার বার তিনবার। আবার তিনে শত্রুতাও হয়, বলে থাকে। এতএব, কার্য্যত, তিনবারের ডবল করে, নয় ছয় করে তবেই ছাড়া উচিত।

হ্যালো, আপনি কি শ্ৰীযুত চক্রবর্তী? ও, আপনি? নমস্কার! আমি? আমিও একজন চক্রবর্তী আপনারই সগোত্র নগণ্য এক নরাধম। হ্যাঁ, নমস্কার! আজ নববর্ষের প্রথম দিনটিতেই আপনাকে আমার সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি। সাদর সম্ভাষণ–আজ্ঞে হ্যাঁ!

অন্য তরফ থেকে অন্যতর চক্রবর্তীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল বেশ গদগদ স্বরে। মোলায়েম তার মিহি হয়ে। এ চক্রবর্তীটিকে অন্যান্য চক্রবর্তীর থেকে একটু স্বতন্ত্র বলেই মনে হয়! বঙ্কিমবাবুর কথাটা রকমফের, হয়ে এঁরও যেন জানা আছে মনে হচ্ছে।

তিনি বলতে থাকেন–ধন্যবাদ! হ্যাঁ, কি বললেন? নামটা তো বললেন, কিন্তু আপনার ঠিকানাটা, একশো চৌত্রিশ নম্বর, বেশ বেশ! রাস্তার নাম? বাঃ। নাম ঠিকানায় কবিতা মিলিয়ে হরিহরাত্ম হয়ে আছেন দেখছি, বাঃ বাঃ! এই তো চাই। ছেলেপিলে কটি? একটি। আপনিই একমাত্র? তার মানে? ও, এখনো বিয়েই হয় নি? হবার আর আশঙ্কাও নেই? তা না থাক! মানুষ আশাতেই, এমন কি, আমঙ্কা নিয়েও বেঁচে থাকে। বয়েসটা কত বললেন? আন্দাজ করা একটু কঠিন? আটাশ থেকে আটাশীর মধ্যে? তাহলেই চলবে। এত কথা জিজ্ঞেস করছি কেন? এক্ষুনি জানতে পারবেন, আমি যাচ্ছি আপনার কাছে। না না, কোন ঘটকালি নয়। তবে আপনি যেমন আমাকে সাদর সম্ভাষণ দ্বারা আপ্যায়িত করলেন, তেমনি আজ নববর্ষের প্রথম দিনে একটা ভাল কাজ আপনার জন্যও আমি করতে চাই। আপনার জীবনবীমাটা আজই করে ফেলুন। শুভস্য শীঘ্রম। জীবন-বীমার দ্বারাই জীবনের সীমা বাড়ানো যায়। এতএব শুভকাজ দিয়েই বছরের প্রথম শুভদিনটা আরম্ভ হোক। কেমন?… দাঁড়ান, এই দণ্ডেই আমি যাচ্ছি।

এই প্রত্যুত্তর লাভের পর বলা বাহুল্য আমি আর দাঁড়াইনি। সেই দণ্ডেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম।

 নরখাদকের কবলে

শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছ, এটা ভীষণ অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। যথার্থই তাই, সত্যিই ভারি রোমাঞ্চকর ঘটনা–নিতান্তই একবার আমি এক ভয়ঙ্কর নরখাদকের পাল্লায় পড়েছিলাম।

আফ্রিকার জঙ্গলে কি কোনো অজ্ঞাত উপদ্বীপের উপকূলে নয়–এই বাংলাদেশের বুকেই, একদিন ট্রেনে যেতে যেতে। সেই অভাবনীয় সাক্ষাতের কথা স্মরণ করলে এখনো আমার হৃঙ্কম্প হয়।

বছর আটেক আগের কথা, সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছি–মামার বাড়ি যাচ্ছি বেড়াতে। রাণাঘাট পর্যন্ত যাব, তাই ফুর্তি করে যাবার মতলবে বাবার কাছে যা টাকা পেলাম তাই দিয়ে একখানা সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কিনে ফেললাম। বহুকাল থেকেই লোভ ছিল ফাস্ট-সেকেন্ড ক্লাসে চাপবার, এতদিনে তার সুযোগ পাওয়া গেল। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু–কথাটা প্রায় ভুলে গেছলাম। ভুলে ভালই করেছিলাম বোধ করি, নইলে এই অদ্ভুত কাহিনী শোনার সুযোগ পেতে না তোমরা।

সমস্তক কামরাটায় একা আমি, ভাবলাম আর কেউ আসবে না তাহলে বেশ আরামে যাওয়া যাবে একলা এই পথটুকু। কিন্তু গাড়ি ছাড়বার পূর্ব্ব-মুহূর্তেই একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক এসে উঠলেন। একমাথা পাকা চুলই তাঁর বার্ধক্যের একমাত্র প্রমাণ, তা না হলে শরীরের বাঁধুনি, চলা-ফেরার উদ্যম, বেশ-বাসের ফিটফাট কায়দা থেকে ঠিক তার বয়স কত অনুমান করা কঠিন।

গাড়িতে আমরা দুজন, বয়সের পার্থক্য সত্ত্বেও অল্পক্ষণেই আমাদের আলাপ জমে উঠল। ভদ্রলোক বেশ মিশুক, প্রথম কথা পাড়লেন তিনিই। এ-কথায় সে-কথায় আমরা দমদম এসে পৌঁছলাম। হঠাৎ একটা তারস্বর আমাদের কানে এল–অজিত, এই অজিত, নেমে পড় চট করে। গাড়ি ছেড়ে দিল যে!

সহসা ভদ্রলোকের সারা মুখ চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তুরিত দৃষ্টিতে সমস্ত প্ল্যাটফর্মটা একবার তিনি দেখে নিলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–নাঃ, সে অজিতের কাছ দিয়েও যায় না!

কিছু বুঝতে না পেরে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম। ভদ্রলোক বললেন–অজিত নামটা শুনে একটা পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল আমার। কিছু নাঃ এ–অজিত সে–অজিতের কড়ে আঙুলের যোগ্যও নয়–এমনি খাসা ছিল সে–অজিত! অমন মিষ্টি মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। শুনবে তুমি তার কথা?

আমি ঘাড় নাড়তে তিনি বললেন–গল্পের মাঝ পথে বাধা দিয়ে না কিন্তু। গল্প বলছি বটে, কিন্তু এর প্রত্যেকটা বর্ণ সত্য। শোনো তবে।–

জিভ দিয়ে ঠোঁটটা একবার চেটে নিয়ে তিনি শুরু করলেন; বছর পঞ্চাশ কি তার বেশিই হবে, তখন উত্তর–বর্মায় যাওয়া খুব বিপদের ছিল। চারিধারে জঙ্গল আর পাহাড়। জঙ্গল কেটে তখন সবে নতুন রেললাইন খুলেছে সেই অঞ্চলে অনেকখানি জায়গা জুড়ে মাঝে মাঝে এমন ধ্বসে যেত যে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যেত একেবারে। তার ওপরে পাহাড়ে-ঝড়, অরণ্য-দাবানল হলে তো কথাই না। রেঙ্গুন থেকে সাহায্য এসে পৌঁছতে লাগত অনেকদিন–এর মধ্যে যাত্রীদের যে কি দুরবস্থা হতো তা কেবল কল্পনাই যেতে পারে।

তখনকার উত্তর-বর্মা ছিল এখনকার চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা, রীতিমত বরফ পড়ত–সময়ে সময়ে চারিধারে সাদা বরফের স্তূপ জমে যেত। এখন তো মগের মুলুকের প্রকৃতি অনেক নম্র হয়ে এসেছে, তার ব্যবহারও এখন ঢের ভদ্র। সেই সময়কার ব্রহ্মদেশের মেজাজ ভাবলে শরীর শিউরে ওঠে।

সেই সময় একবার এক ভয়ানক বিপাকে আমি পড়েছিলাম–আমি এবং আরও আঠারো জন। আমরা উত্তর-বর্মায় যাচ্ছিলাম-আমরা উনিশনই ছিলাম সমস্ত গাড়ির যাত্রী। উনিশজনই বাঙালি প্রথম রেললাইন খুলেছিল, কিন্তু দুর্ঘটনার ভয়ে সেখানকার অধিবাসীরা কেউ রেলগাড়ি চাপত না। ভয় ভাঙাবার জন্যে রেল কোম্পানি প্রথম প্রথম বিনা-টিকিটে গাড়ি চাপবার লোভ দেখাতেন। বিনা পয়সার লোভে নয় অ্যাডভেঞ্চারের লোভে রেঙ্গুনের উনিশজন বাঙালি আমরা তো বেরিয়ে পড়লাম।

সহযাত্রী মোটে এই কজন–কাজেই আমাদের পরস্পরের মধ্যে আলাপ-পরিচয় হতে দেরি হলো না। কোনখানে যে সেই ভয়াবহ পাহাড়ের ঝড় নামল, আমার ঠিক মনে পড়ে না এখন, তবে রেলপথের প্রায় প্রান্ত সীমায় এসে পড়েছি। ওঃ সে কী ঝড় সেই দুর্দান্ত ঝড় ঠেলে একটু একটু করে এগুচ্ছিল আমাদের গাড়ি–অবশেষে একেবারেই থেমে গেল। সামনের রেললাইন ছোট বড় পাথরের টুকরোয় ছেয়ে গেছে –সেই সব চাঙর না সরিয়ে গাড়ি চালানোই অসম্ভব। এতএব পিছননা ছাড়া উপায় ছিল না।

অনেকক্ষণ ধরে এক মাইল আমরা পিছোলাম। এত আস্তে গাড়ি চলছিল, চলছিল আর থামছিল যে মানুষ হেঁটে গেলে তার চেয়ে বেশি যায়। কিছু পিছিয়েই কি রেহাই আছে? একটু পরেই জানা গেল যে পেছনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ধ্বস নেমেছে। ঘণ্টাখানেক আগে যে রেলপথ কাঁপিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটেছে, এখন কোথাও তার চিহ্নই নেই।

অতএব আবার এগুতে হলো। যেখানে যেখানে পাথরের টুকরো জমেছে, আমার সব নেমে লাইল পরিষ্কার করব ঠিক হলো। তা ছাড়া আর কি উপায় বলো? কিন্তু সেদিকেও ছিল অদৃষ্টের পরিহাস। কিছুদুর এগিয়েই ঝড়ের প্রবল ঝাঁপটায় ট্রেন ডিরেলড হয়ে গেল। লাইন থেকে পাথর তোল আরেক কথা। পাঁচ দশজন মিলে অনেক ধরাধরি করলে এক-আধটা পাথরের চাঙড় যে না সরানো যায় তা নয়, কিন্তু সবাই মিলে বহুৎ ধ্বস্তাধস্তি করলেও গাড়িকে লাইনে তোলা দূরে থাক এক ইঞ্চিত নড়ানো যায় না। এমন কি আমরা ঊনিশজন মিলেও যদি কোমর বেঁধে লাগি, তাহলেও তার একটা কামরাও লাইনে তুলতে পারব কিনা সন্দেহ! তারপরে ঐ লম্বা চওড়া ইঞ্জিন-ওকে তুলতে হলেই তো চক্ষুস্থির! ওটা কত মণ কে জানে। আমরা ইঞ্জিনের দিকে একবার দৃকপাত করে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম।

পেছনের অবস্থা তো দেখেই আসা গেল, সামনেও যদি তাই ঘটে থাকে, তাহলেই তো চক্ষুস্থির! কেন না যেদিক থেকেই হোক, রেলপথ তৈরি করে সাহায্য এসে পৌঁছিতে কদিন লাগবে কে জানে। চারিধারে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল, একশো মাইলের ভেতরে মানুষের বাসভূমি আছে কিনা সন্দেহ! ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গের যা খাবার-দাবার তা তো এক নিঃশ্বাসেই নিঃশেষ হবে তারপর? যদি আরো দুদিন এইভাবে থাকতে হয়? আরো দু-সপ্তাহ? কিম্বা আরো দু-মাস? ভাবতেও বুকের রক্ত জমে যায়।

পরের কথা তো পরে–এখন কি করে রক্ষা পাই? যে প্রবল, গাড়ি সমেত উড়িয়ে না নিয়ে যায় তো বাঁচি। মাঝে মাঝে যা এক-একটা ঝাঁপটা দিচ্ছিল, উড়িয়ে না নিক, গাড়িকে কাত কিম্বা চিতপাৎ করার পক্ষে তাই যথেষ্ট। নিজের নিজের রুচিমত দুর্গানাম, রামনাম কিম্বা ত্রৈলঙ্গস্বামীর নাম জপতে শুরু করলাম আমরা।

সে-রাত তো কাটল কোনোরকমে, ঝড়ও থেমে গেল ভোরের দিকটায়। কিন্তু ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে খিদেও জোর হয়ে উঠল। বর্মার হাওয়ায় খুব খিদে হয় শুনেছিলাম, প্রথম দিনেই সেটা টের পাওয়া গেল। খিদের বিশেষ অপরাধ ছিল না যে হাওয়াটা কাল আমাদের ওপর দিয়ে গেছে।

কিন্তু নাঃ, কারু টিফিন ক্যারিয়ারে কিছু নেই, যার যা কিছু কাল রাত্রের চেটে-পুটে সাবাড় করেছে। কেবল অ্যালুমিনিয়াম প্লেটগুলো পড়ে রয়েছে, আমাদের উদরের মত শোচনীয় অবস্থা–একদম ফাঁকা। সমস্ত দিন যে কি অস্বান্তিতে কাটল কি বলব! রাত্রে কষ্টকল্পিত নিদ্রার মধ্যে তবু কিছু শান্তির সন্ধান পাওয়া গেল–বড় বড় ভোজের স্বপ্ন দেখলাম।

দ্বিতীয় দিন যা অবস্থা দাঁড়াল, তার আর কর্তব্য নয়। সমস্ত সময় গল্প গুজব করে, বাজে বকে, উচ্চাঙ্গের গবেষণার ভান করে, খিদের তাড়নাটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করলাম! গোঁফে চাড়া দিয়ে খিদের চড়াটা দমিয়ে দিতে চাইলাম,–তারপর এল তৃতীয় দিন।

সেদিন আর কথা বলারই উৎসাহ নেই কারো রেলগাড়ির চারদিকে ঘুরে, আনাচ-কানাচ লক্ষ্য করে, অসম্ভব আহার্যের অস্তিত্ব পরিকল্পনায় সেদিনটা কাটল। চতুর্থ দিন আমাদের নড়া-চড়ার স্পৃহা লোপ পেল–সবাই এক-এক কোণে বসে দারুণভাবে মাথা ঘামাতে লাগলাম।

তারপর পঞ্চম দিন। নাঃ, এবার প্রকাশ করতেই হবে কথাটা-আর চেপে রাখা চলে না। কাল সকাল থেকেই কথাটা আমাদের মনে উঁকি মারছিল, বিকেল নাগাদ কায়েম হয়ে বসেছিল এখন প্রত্যেকের জিভের গোড়ায় এসে অপেক্ষা করছে সেই মারাত্মক কথাটা–বোমার মত এই ফাটল বলে। বিবর্ণ রোগা, বিশ্রী বিশ্বনাথবাবু উঠে দাঁড়ালেন, বক্তৃতার কায়দায় শুরু করলেন–সমবেত ভদ্রমহোদয়গণ–

কি কথা যে আসছে আমরা সকলেই তা অনুমান করতে পারলাম। উনিশজোড়া চোখের ক্ষুধিত দৃষ্টি এক মুহূর্তে যেন বদলে গেল, অপূর্ব্ব সম্ভাবনার প্রত্যাশায় সবাই উদগ্রীব হয়ে নড়ে-চড়ে বসলাম।

বিশ্বনাথবাবু বলে চারজন–ভদ্রমহোদয়গণ, আর বিলম্ব করা চলে না। অহেতুক লজ্জা, সঙ্কোচ বা সৌজন্যের অবকাশ নেই। সময় খুব সংক্ষিপ্ত–আমাদের মধ্যে কোন ভাগ্যবান ব্যক্তি আজ বাকি সকলের খাদ্য জোগাবেন, এখন আমাদের তা স্থির করতে হবে।

শৈলেশবাবু উঠে বললেন, আমি ভোলানাথবাবুকে মনোনীত করলাম।

ভোলানাথবাবু বললেন, কিন্তু আমার পছন্দ অমৃতবাবুকেই।

অমৃতবাবু উঠলেন–অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যে তিনি লজ্জিত কি মর্মাহত বোঝা গেল না, নিজের সুস্পষ্ট দেহকেই আজ সবচেয়ে বড় শত্রু বলে তার বিবেচনা হলো। আমতা আমতা করে তিনি বললেন, বিশ্বনাথবাবু আমাদের মধ্যে প্রবীণ এবং শ্রদ্ধেয়, তা ছাড়া তিনি একজন বড় বক্তাও বটেন। আমার মতে প্রাথমিক সম্মানটা তাকেই দেওয়া উচিত, অতএব তার সপক্ষে আমি নিজের মনোনয়ন প্রত্যাহার করছি।

কমল দত্ত বললেন, যদি কারুর আপত্তি না থাকে তাহলে অমৃতবাবুর অভিলাষ গ্রাহ্য করা হবে।

সুধাংশুবাবু আপত্তি করাতে অমৃতবাবুর পদত্যাগ অগ্রাহ্য হলো, এই একই কারণে ভোলানাথবাবুর রেজিগনেশনও গৃহীত হলো না।

শঙ্করবাবু বললেন, ভোলানাথবাবু এবং অমৃতবাবু–এঁদের মধ্যে কার আবেদন গ্রাহ্য করা হবে, অতঃপর ভোটের দ্বারা তা স্থির করা যাক।

আমি এই সুযোগ গ্রহণ করলাম–ভোটাভুটির ব্যাপারে একজন চেয়ারম্যান দরকার, নইলে ভোট গুনবে কে? অতএব আমি নিজেকে চেয়ারম্যান মনোনীত করলাম।

ওদের মধ্যে আমিই দূরদর্শী, সাহায্য এসে না পৌঁছানো তক নিত্যকার ভোটায়নের জন্যে চেয়ারম্যানকেই কষ্ট করে টিকে থাকতে হবে, শেষ পর্যন্ত, এটা আমি সূত্রপাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। অমৃতবাবুর দিকেই সকলের দৃষ্টি নিবন্ধ থাকতে, আমি সকলের বিনা অসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়ে গেলাম।

অতঃপর প্রভাসবাবু বললেন, আজকের দুপুরবেলার জন্যে দুজনের কাকে বেছে নেওয়া হবে, সেটা এবার সভাপতিমশাই ব্যালটের দ্বারা স্থির করুন।

নাদুবাবু বললেন–আমার মত ভোলানাথবাবু নির্বাচনের গৌরব লাভের অযোগ্য। যদিও তিনি কচি এবং কাঁচা, সেইসঙ্গে তিনি অত্যন্ত রোগা ও সিঁড়িঙ্গে। অমৃতবাবুর পরিধিকে এই দুঃসময়ে, আমরা অবজ্ঞা করতে পারি না!

শৈলেশবাবু বললেন, অমৃতবাবুর মধ্যে কি আছে? কেবল মোটা হাড় আর ছিবড়ে। তাছাড়া পাকা মাংস আমার অপছন্দ, অত চর্বিও আমার ধাতে সয় না। সেই তুলনায় ভোলানাথবাবু হচ্ছে ভালুকের কাছে পাঠা। ভালুকের ওজন বেশি হতে পারে–কিন্তু ভোজনের বেলায় পাঠাতেই আমাদের রুচি।

নাদুবাবু বাধা দিয়ে বললেন, অমৃতবাবুর রীতমত মানহানি হয়েছে, তাকে ভালুক বলা হয়েছে–অমৃতবাবুর ভয়ানক রেগে যাওয়া উচিত আর প্রতিবাদ করা উচিত–

অমৃতবাবু বললেন, শৈলেশবাবু ঠিকই বলেছেন, এত বড় খাঁটি কথা কেউ বলেনি আমার সম্বন্ধে। আমি যথার্থই একটা ভালুক।

অমৃতবাবুর মত কূটতার্কিক যে এত সহজে পরের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন, আশা করতে পারিনি। বুঝতে পারলাম, তার আত্মগ্লানির মূলে রয়েছে stuggle for existence। যাক, ব্যালট নেওয়া হলো। কেবল ভোলানাথবাবুর নিজের ছাড়া আর সকলের ভোট তার সপক্ষে গেল। অমৃতবাবুর বেলাও তাই, একমাত্র অমৃতবাবু স্বয়ং নিজের বিপক্ষে ভোট দিলেন।

অগত্যা দুজনের নাম একসঙ্গে দুবারব্যালটে দেওয়া হলো–আবার দু জনেই সমান সমান ভোট পেলেন। অর্ধেক লোক পরিপুষ্টতার পক্ষপাতী, বাকি অর্ধেকের মত হচ্ছে, যৌবনে দাও রাজটীকা।

এরূপ ক্ষেত্রে সমস্যার সমাধান সভাপতির ওপর নির্ভর করে; আমার ভোটটা অমৃতবাবুর তরফে দিয়ে অশোভন নির্বাচন প্রতিযোগিতার অবসান করলাম। বাহুল্য, এতদিনের একাদশীর পর অমৃতে আমার বিশেষ আরুচি ছিল না।

ভোলানাথবাবু পরাজয়ে তাঁর বন্ধুদের মধ্যে বিশেষ অসন্তোষ দেখা গেল, তারা নতুন ব্যালট দাবি করে বসলেন। কিন্তু রান্নাবান্না যোগাড়ের জন্য মহাসমারোহে সভাভঙ্গ হয়ে যাওয়ায়, ভোলানাথবাবুকে বাধ্য হয়ে স্থগিত রাখতে হলো। তাঁর পৃষ্ঠপোষকরা নোটিশ দিয়ে রাখলেন, পরদিনের নির্বাচনে তারা পুনরায় ভোলানাথবাবুর নাম তুলবেন। কালও যদি যোগ্যতম ব্যক্তির অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে তাঁরা সবাই একযোগে হাঙ্গার স্ট্রাইক করবেন বলে শাসালেন।

কয়েক মুহূর্তেই কি পরিবর্তন। পাঁচদিন নিরাহারের পর চমৎকার ভোজের প্রত্যাশায় প্রত্যেকের জিভই তখন লালায়িত হয়ে উঠেছে। এক ঘন্টায় মধ্যে আমরা যেমন আশ্চর্য রকম বদলে গেলাম–কিছুক্ষণ আগে আমরা ছিলাম আশাহীন, ভাষাহীন, খিদের তাড়নায় উন্মাদ–অর্ধমৃত; আর তখন আমাদের মনে আশা, চোখে দীপ্তি, অন্তরে এই কথাটা তুলতে যদি চলে তো তুলবেন না, ভালবাসা–এমন প্রগাঢ় প্রেম, যা মানুষের প্রতি মানুষ কদাচই অনুভব করে! এমন একটা অপূর্ব্ব পুলক, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। অর্ধ-মুমূর্ষুতা থেকে একেবারে নতুন জীবন। শপথ করে বলতে পারি তেমন অনির্বচনীয় অনুভূমির আস্বাদ জীবনে আমি পাইনি।

অমৃতকে আমি আন্তরিক পছন্দ করেছিলাম। সত্যিই ভাল লেগেছিল ওকে আমার। স্কুল মাংসল বপু, যদিও কিছু অতিরিক্ত রোমশ (শৈলেশবাবু ভালুক বলে বেশি ভুল করেননি), তবু ওঁকে দেখলেই চিত্ত আশ্বস্ত হয়, মন কেমন খুশি হয়ে ওঠে। ভোলানাথও মন্দ নন অবশ্য; যদিও একটু রোগা, তবু উঁচুদরের জিনিস তাতে সন্দেহ নেই। তবে পুষ্টিকারিতা এবং উপকারিতার দিক থেকে বিবেচনা করলে অমৃতর দাবি সর্ব প্রথম। অবশ্য ভোলানাথের উৎকৃষ্টতার সপক্ষেও অনেক কিছু বলবার আছে, তা আমি অস্বীকার করবার চেষ্টা করব না। তবু মধ্যাহ্নভোজনের পাতায় পড়বার যোগ্যতা ওঁর ছিল না, বড়-জোর বিকেলের জলখাবার হিসেবে ওঁকে ধরা যেতে পারে।

দীর্ঘ উপবাসের পর প্রথম দিনের আহারটা একটু গুরুতরই হয়ে গেল। অমৃত এতটা গুরুপাক হবে আমরা ভাবিনি–বাইরে থাকতে যিনি আমাদের হৃদয়ে এতটা আবেগ সঞ্চার করেছিলেন, ভিতরে গিয়ে যথেষ্টই বেগ দিলেন। সমস্ত দিন আমরা অমৃতের সেঁকুর তুললাম। সকলেরই পেট (এবং সঙ্গে মন খারাপ থাকায়, পরদিন লঘু পথ্যের ব্যবস্থাই সঙ্গত স্থির হলো–অতএব কচি ও কাঁচা ভোলানাথবাবুকে জলযোগ করেই সেদিন নিরস্ত হলাম। তারপর দিন আমরা অজিতকে নির্বাচিত করলাম। ওরকম সুস্বাদু কিছু আর কখনো আমরা খাইনি জীবনে। সত্যিই ভারী উপাদেয়, তার বউকে পরে চিঠি লিখে আমি সে-কথা জানিয়েছি। এক মুখে তার প্রশংসা করে শেষ করা যায় না–চিরদিন ওকে আমার মনে থাকবে। দেখতেও যেমন সুশ্রী, তেমনি মার্জিত রুচি, তেমনি চারটে ভাষায় ওর দখল ছিল। বাংলা তো বলতে পারতই। তা ছাড়া ইংরাজি, হিন্দি এবং উড়েতেও অনর্গল তার খই ফুটত। হিন্দি একটু ভুলই বলত, তা বলুকগে; তেমনি এক-আধটুকু ফ্রেঞ্চ আর জামার্নও ওর জানা ছিল, তাতেই ক্ষতিপূরণ হয়ে গেছল। ক্যারিকেচার করতেও জানত, সুর ভাঁজতেও পারত,–বেশ মজলিসী ওস্তাদ লোক এক কথায় অমন সরেশ জিনিশ আর কখনো ভদ্রলোকের পাতে পড়েনি। খুব বেশি ছিবড়েও ছিল না, খুব চর্বিও নয় ওর ঝোলটাও ভারি খাসা হয়েছিল। এখনো যেন সে আমার জিভে লেগে রয়েছে।

তার পরদিন বিশ্বনাথবাবুকে আমরা আত্মসাৎ করলাম–বুড়োটা যেমন ভূতের মত কালো তেমনি ফাঁকিবাজ, কিছু তার গায়ে রাখেনি, যাকে বলে আমড়া-আঁটি আর চামড়া। পাতে বসেই আমি ঘোষণা করতে বাধ্য হলাম, বন্ধুগণ, আপনাদের যা খুশি করতে পারেন, আবার নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমি হাত গুটোলাম। শৈলেশবাবু আমার পথে এলেন, বললেন–আমারো ঐ মত। ততক্ষণ আমিও অপেক্ষা করব।

অজিতকে সেবা করার পর থেকে আমাদের অন্তর যে আত্মপ্রসাদের ফাল্গুধারা আগোচরে বইছিল, তাকে ক্ষুণ্ণ করতে ইচ্ছে ছিল না। কাজেই আবার ভোট নেওয়া শুরু হলো-এবার সৌভাগ্যক্রমে শৈলেশবাবুই নির্বাচিত হলেন। তার এবং আমাদের উভয়েররই সৌভাগ্য বলতে হবে; কেন না, কেবল রসিক লোক বলেই তাকে জানতাম সরস লোক বলেও জানলাম তাঁকে। তোমাদের বিশ্বকবির ভাষায় বলতে গেলে, তার যে-পরিচয় আমাদের কাছে অজ্ঞাত ছিল; সেই নতুন পরিচয়ে তিনি আমাদের অন্তলঙ্গ হলেন।

তারপর? তারপর–একে একে ব্যোমকেশ, নিরঞ্জন, কেদারনাথ, গঙ্গাগোবিন্দ– গঙ্গগোবিন্দ নির্বাচনে খুব গোলমাল হয়েছিল, কেন না ও ছিল যেমন রোগা তেমনি বেঁটে তারপর নিতাই থোকদার-থোকদারের এক পা ছিল কাঠের সেটা থোখ ক্ষতি, সুস্বাদুতার দিক থেকে সে মন্দ ছিল না, নেহাত–অবশেষে এক ব্যাটা ভাগ্যবৎ, সঙ্গী হিসাবে সে মোটেই বাঞ্ছনীয় ছিল না, খাদ্য হিসেবেও তাই। তবে রিলিফ এসে পৌঁছবার আগে যে তাকে খতম করতে পারা গেছল এইটাই সুখের বিষয়। নিতান্তই একটা আপদ–চুকানো দায় কার কি।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আমি ভদ্রলোকের কাহিনী, শুনছিলাম, এতক্ষণে আমার বাক্যস্ফুর্তি হলো–তাহলে রিলিফ এসেছিল শেষে?

হ্যাঁ, কবির ভাষায়, একদাসুপ্রভাতে, সুন্দর সূর্যালোকে, নির্বাচনও সদ্য শেষ হয়েছে, আরও রিলিফ ট্রেনও এসে পৌঁছেছিল, তা নইলে আজ আমাকে দেখবার সৌভাগ্য হত না তোমার।…এই যে বারাকপুর এসে পড়ল, এখানেই নামব। বারাকপুরেই আমি থাকি গঙ্গার ধারে, যদি কখনো সুবিধে হয়, দু একদিনের জন্যে বেড়াতে এসো আমার ওখানে। ভারী খুশি হব তাহলে। তোমাকে দেখে আমার কেমন বাৎসল্য–ভাব জাগছে। বেশ বাল লাগল তোমাকে, এমন কি অজিতকে যথটা ভাল লেগেছিল, প্রায় ততখানিই, একথা বললে মিথ্যা বলা হয় না। তুমিও খাসা ছেলে,–আচ্ছা আসি তাহলে।

ভদ্রলোক বিদায় হলেন। এমন বিমূঢ়, বিভ্রান্ত আর বিপর্যস্ত আমি কখনো হইনি। বৃদ্ধ চলে যাবার পর আমার আত্মাপুরুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তাঁর কণ্ঠস্বর মৃদু- মধুর, চালচলন অত্যন্ত ভদ্র–কিন্তু হলে কি হবে, যখনই তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন, আমার হাড়-পাঁজরা পর্যন্ত কেঁপে উঠছিল। কি রকম যেন ক্ষুধিত দৃষ্টি তাঁর চোখে–বাবাঃ। তারপর তার বিদায়-বাণীতে যখন জানালেন যে তার মারাত্মক স্নেহ-দৃষ্টি লাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছে, এমন কি তাঁর মতে আমি অজিতের চেয়ে কোনো অংশেই ন্যূন নই,–তেমনি খাসা বোধকরি তেমনি উপাদেয়–তখন আমার বুকের কাঁপুনি পর্যন্ত বন্ধ হবার মত হয়েছিল।

তিনি যাবার আগে মাত্র একটি প্রশ্ন তাঁকে করতে পেরেছিলাম–শেষ পর্যন্ত আপনাকেও ওরা নির্বাচন করেছিল? আপনি তো সভাপতি ছিলেন, তবে কি করে এটা হল?

শেষ পর্যন্ত আমিই বাকি ছিলাম কিনা। আগের দিন ভ্যাগাবণ্ডটার পালা গেছল; আমি একাই সমস্তটা ওকে সাবাড় করেছিলাম। বলব কি, পাহাড়ের যেমন আমার খিদে হতো, তেমনি হজম করবার ক্ষমতাও খুব বেড়ে গেছল। হতভাগা লোফারটা শেষ পর্যন্ত টিকেই ছিল, তার কারণ অখাদ্য লোক বলে তাকে খাদ্য করতে সবার আপত্তি ছিল। কিন্তু খাবার জিনিসে অত গোঁড়ামি নেই আমার–উদয়ের ব্যাপারে আমি খুব উদার। তাছাড়া এতদিনেও নির্বাচিত হবার সুযোগ না পেয়ে নিশ্চয়ই অত্যন্ত মনোক্ষোভ জেগেছিল ওর; আমার আত্মমর্যাদা লাভ করে সে যে কৃতার্থ হয়েছে এতে আমার সন্দেহ নেই।

হ্যাঁ, তুমি কি জানতে চাচ্ছিলে কি করে আমার পালা হলো? পরদিন আবার নির্বাচনের সময় এল। কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করায়, আমি যথারীতি নির্বাচিত হয়ে গেলাম বিনা বাধায়। তারপর কারু আপত্তি না থাকায়, আমি তৎক্ষণাৎ সেই সম্মানার্য পদ থেকে পদত্যাগ করলাম। আপত্তি করবার কেউ ছিল না তখন। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পৌঁছেছিল ট্রেনটা–দুরূহ কর্তব্যের দায় থেকে রেহাই পেলাম আমি–নিজেকে আর গলাধঃকরণ করতে হলো না আমায়!

 নিখরচায় জলযোগ

সেই থেকে নকুড় মামার মাথায় টাক। ফাঁস করছি সেকথা অ্যান্দিনে….

চালবাজি করতে গিয়ে চালের ফাঁকিতে বানচাল হয়ে–মাথার আটচালায় ঐ ফাঁক! সেদিন যে হাল হয়েছিল যা নাজেহাল হতে হয়েছিল আমাদের….কী আর বলব!

সাড়ে-এগারোটা থেকে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, ভিড় ঠেলে, ঘোড়ার ধাক্কা সয়ে কতো তপস্যার পর তো ঢুকলাম খেলার গ্রাউন্ডে! ভিড়ের ঠেলায় পকেট ছিঁড়ে যা ছিল সব গড়িয়ে গেছে গড়ের মাঠে। মানে, মামার পকেটের যা কিছু ছিল। আমার পকেট তো এমনিতেই গড়ের মাঠ!

ছিন্ন হয়ে ক্যালকাটা গ্রাউন্ডে ঢুকেছিলাম, ভিন্ন হয়ে বেরুলাম খেলার শেষে। ঐ ভিড়ের ঠেলাতেই।

ভাগ্যিস মামা ছিলেন হুশিয়ার! খাড়া ছিলেন গেটের গোড়ায়, তাই একটু না আগাতেই দেখা মিলল, নইলে এই গোলের মধ্যে (মোহনবাগানের এত গোলের পর) আবার যদি মামাকে ফের খুঁজতে হতো তা হলেই আমার হয়েছিল! আমার হাঁকডাকে কতো জনার সাড়া মিলতো, কতো জনার কতো মামাই যে অযাচিত এসে দেখা দিতেন কে জানে! এই জন-সমুদ্রে আমি নিজেই হারিয়ে যেতাম কিনা তাই কে বলবে! আমার নিজেই খেই হারিয়ে গেলেই তো হয়েছিল।

মামা বললেন, একটু চা না হলে তো বাঁচিনে রে, যা তেষ্টা পেয়েছে, বাপস! গলা শুকিয়ে যেন কাঠ মেরে গেছে জিভ-টিভ সব সুখতলা।

আমারো তেষ্টা লেগেছে মামা–আমি বলি ও তবে চা যদি নেহাত নাই মেলে, শরবত হলেও আমার হয়।

হ্যাঁ, শরবত! বলে চায়েরই পয়সা জুটছে না, তো শরবত! নকুড় মামা চাচান : দু-আনা পয়সা হলে এক কাপ চা কিনে দুভাগ করে খাওয়া যায়। গলাটা একটু ভিজিয়ে বাঁচি–দুজনেই বাঁচি। আছে কি তোর কাছে দু-আনা?

না মামা।

একটা দুয়ানিও নেই? একদম না? দেখেছিস ভাল করে? তা দুয়ানি না থাক– দুটো আনি? দুটো আনি হলেও তো হয়।

অ্যাঁ! তাও না? একটা আনি আর দুটো ডবল পয়সা? নেইকো? যাকগে, তবে চারটে ডবল পয়সা–তাই দে? তাও পারবিনে? তাহলে ডবল আর বে- ডবলে মিলিয়ে বার কর। মোটের ওপর যে করেই আটটা পয়সা হলেই হয়ে যায়। তবুও ঘাড় নাড়ছিস? তাও নেই? তাহলে ফুটো পয়সাই সই–তাই বার কর দেখি আটটা–তাহলেই চালিয়ে নেব কোন রকমে।

না মামা। আমার পুনঃপুনরুক্তি।

আহা, প্রাণে যেন আমার চিমটে কেটে দিলেন? কেতাখ হলুম। মামা আমায়–ন্যা ম্যা ম্যা।

কার্জন পার্কের কোণ অবদি মামা চুপচাপ আসেন, আধমড়ার মতন। তারপর চৌরঙ্গীর মোড়ে পৌঁছাতেই যেন চমকে আবার।চ তোদের পাড়ায় যাই, সেখানকার চায়ের দোকানে নিশ্চয় তোকে ধার দেবে। তোর চেনাশোনা লোক সব-ভাবসাব আছেই! তাই চল্ ।….চা না পেলে আজ আমি বাঁচবো না। পঞ্চত্ব লাভ করবো। দেখিস তুই।

আমার পাড়ার চা-ওয়ালারা? তুমি তাদের চেনো না মামা! এমন খুঁতখুঁতে তোক আর হয় না। এত কেপপণ তুমি সাতজন্মে দ্যাখেনি। আর, এমনি হুঁশিয়ার যে, তুমি যদি সিগ্রেট ধরাতে যাও আর দেশলায়ের বাকস চাও, না?–তারা বাকসর বদলে শুধু একটা কাঠি দেবে তোমাকে, আর খোলটা শক্ত করে ধরে রাখবে হাতের মুঠোয়। বাকসটা হাতছাড়া-ই করবে না, এক মিনিটের জন্যেও নয়, ধার দেয়া দূরে থাক। কেবল তার ধারে কাঠিটা ঘষে তোমার সিগ্রেট ধরিয়ে নাও, ব্যাস। দেশলায়ের গায়ে ঘষতে দেবে কেবল, কিন্তু দেশলায়ের কাছে ঘেঁষতে দেবে না তোমায়। এমনি মারাত্মক লোক সব।

বলিস কিরে, অ্যাঁ? এই বয়সেই সিগ্রেট খাওয়ার বিদ্যে হয়েছে? গোঁফ না গজাতেই বিড়ি ধরাতে শিখেছো? বটে? মামা ভারি খাপপা হয়ে ওঠেন।

বা রে, তা আমি কখন বলুম? এতো আমার চোখে দেখার কথাই বলচি –চোখ দেখার কথা বলেচি কি? আমি আপত্তি করি।

খাসনি? খাসনি তো? খাসনে তো? তাহলেই হলো! না খেলেই ভাল। তুই আমার একমাত্র ভাগনে নোস তা জানি, কিন্তু অদ্বিতীয় তোঃ তোর মতন মার্কামারা আরেকটা তো আমার নেই। তুইও যদি সিগ্রেট ফুকে অকালে যাদবপুর হয়ে কেটে পড়িস, অবশ্যি দুঃখে আমি যাব না, তা ঠিক কিন্তু তাই বলে টি-বি হওয়াটা কি ভাল? তুইও যদি টিবিয়ে কেঁসে যাস–সান্ত্বনা দেবার আরো ভাগনে আমার থাকবে বটে–

কিন্তু, ভাগে যে একটা কম পড়বে তাও বটে! ভয় নেই মামা, আমি তোমার ভাগবো না। জানাতে হয় আমায়।

আমার ভাগ্যি!…এখন আয়, এখানে বসে নিখরচায় চা খাবার একটা বুদ্ধি বার করি…নকুড় মামা বলেন। দুজনে মিলে তখন মাথা খাটাই আমরা। ভিখিরি হলে যেমন ভেক এসে পড়ে, ফকির হলেই তেমনি যতো ফিকির দেখা যায়।

শোন, এক কাজ করা যাক মামা বালান তুই যেন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিস এই রকম ভাব দেখাবি। অ্যাকটিং করবি আর কি! আমি তোকে ধরে ধরে নিয়ে যাবো একটা চায়ের দোকানে, কিংবা ঢুকবো কোন একটা রেস্তোরাঁয়–

কী রকমের অ্যাকটিং? প্রথম অঙ্কের আগেই আমার প্রস্তাবনা : ভালো করে বুঝিয়ে দাও আগে।

ডালুদির হস্টিরিয়া হতে দেখেছিস তো? আমার ডালুদি, তোর ডালু মাসি রে? তুই সেই ডালুদির মত সেইরকম গা নাড়তে থাকবি হাত পা কাঁপাবি। যদি কাছে পিঠে কেউ না থাকে তো হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করতে–

নকুড় মামা, ন কুরু, আমি সংস্কৃত করে বলি–তারপর ফের ব্যাখ্যা করে দিই সোজা বাংলায়–অমন কার্য্যটি কোরো না। কদাপি না। হিস্টিরিয়া হচ্ছে মেয়েলী ব্যাপার। ছেলেদের ওসব রোগ কি কখনো হয়? কক্ষনো না।

না, হয় না! তোকে বলেছে! ছেলেমাত্ৰই তো এক-একটি রোগ। আর ও জি উই ই। মামা সাদা বাংলায় বলে সিধে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দ্যান ফের : শোন, ওসব আদিখ্যেতা রাখ, এখন যা বলছি তাই কর। আমি তোকে ধরাধরি করে নিয়ে যাবো চা-খানায়! এইতো গেল প্রথম দৃশ্য। তারপর আমি যা যা বলি যা যা করি দেখতেই পাবি। তুই ভান করবি আর আমি ভনিতা করবো, কিন্তু আড়চোখে দেখে রাখবি সব ভাল করে কেন না।

হিস্টিরিয়া বানিয়ে আমার লাভ? সমস্ত দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে দেখেই এমন আমার বিসদৃশ লাগে। ঘিয়ের মত লাগতে থাকে আমার।

দেখতেই পাবি। হাতেনাতেই দেখবি, হিস্টিরিয়ার দাবাই হলো গরম দুধ, চা, টোসট, কেক, কারি, চপ, কাটলেট, পুডিং, পোচ, ডবল মামালেট, ফিস-ফ্রাই ইত্যাদি! ইত্যাদি!

আর বোলো না, বোলো না! বলতে না বলতেই আমি চলকে উঠি, রাজি হয়ে যাই তৎক্ষণাত।–-কিন্তু মামা, সে তো হলো আমার খাওয়া। তারপর? তোমার দশা কি হবে তারপর?

আরে, সেই কথাই তো বলছি রে। আমি যা-যা করি বলি দেখেশুনে মনের মধ্যে টুকে রাখবি ভাল করে। বলছি কি তবে? আরে, তার পরের দোকানটাতেই তো আমার পালা। তখন হবে হিস্টিরিয়া, আর তোকে করতে হবে আমার তদারক। বুঝেছিস রে হাঁদা?

জলের মতন। বলেই আমি একগাল হাসি। হেসেই হাঁটা বুজিয়ে ফেলি তক্ষুণি। অমন হাঁ, করে মামার ব্যাখ্যানা শুনছিলাম বলেই-ই ঐ হাঁদা–অপবাদ শুনতে হলো আমায়।–ধন্য মামা, ধন্য! এমন না হলে মাথা! মুক্তকণ্ঠে মামার প্রশংসাপত্র বিলাই–অ্যাতো বুদ্ধি ধরে তোমার ধড়ে, অ্যাঁ?

আরে, এ আর তুই কি দেখলি আমার মাথার? মাথা নাড়ে মামা, তো নয়, যেন সার জন মাথাই। বুদ্ধির একটি আটচালা এটি! আট রকমের চাল খেলছে এখানে! সব সময়েই বুঝেছিস?

তারপর আমাদের মামা-ভাগনের অভিযান শুরু হলো। অভিনয়ের দায় পড়লো আমার। প্রাথমিক শুশ্রষার ভার নিলেন মামা। বেন্টিক স্ট্রীট ধরে প্যারাডাইজ সিনেমার ধার দিয়ে আরম্ভ হলো আমাদের অভিযান।

আমার হাত পা কাঁপতে থাকলো, ডালু-মাসির মতই যতো ডালপালা নড়তে লাগলো আমার। দাঁতে দাঁতে লেগে গেল, চোখ বুজে এলো দেখতে না দেখতেই।

নকুড় মামা, আমাকে সযত্নে ধরাধরি করে এক চায়ের দোকানে এনে বসালেন।

চেয়ারটায় বসতেই আমি এলিয়ে পড়লাম।

নকুড় মামা, যাতে আমি গড়িয়ে মাটিতে না পড়ি, লক্ষ্য রাখবেন সেদিকে। আর জামার গলার দিকে বোতামগুলো খুলে দিলেন আমার। দোকানের টেবিলে সেদিনের সে খবরকাগজ পড়েছিলো, কাউকে একটিও কথা না বলে নকুড় মামা তাই দিয়ে সজোরে হাওয়া করতে লাগলেন আমায়। আমিও উঃ! আঃ! ইঃ! ঈঃ! এঃ! ওঃ! ঐঃ! ঔঃ! স্বরবর্ণের থেকে এইরকম এক একটা বিচ্ছিরি আওয়াজ বার করতে লাগলাম যে বলবার নয়।

ও মা, মা গো! ও মামা গো!–তারস্বর বেরুতে থাকে আমার। তাড়িতে বার্তার মতই চাপা যায় না কিছুতেই।

দেখেশুনে ব্যস্ত হয়ে উঠলো দোকানদার। সেই সঙ্গে, দোকানে বসে যারা চা খাচ্ছিল তারাও–কি হয়েছে, কি হয়েছে এর?

হিস্টিরিয়া আছে ছেলেটার। জানালেন মামা।

হিস্টিরিয়া! কী সর্বনাশ!

না, ও এমন কিছু না। ভাবনার কিছু নেই। খানিক একটু হাত-পা চালবে চাঁচাবে, এই রকম। তারপর দুয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেরে যাবে আপনা থেকেই।

দু-এক-ঘন্টা! শুনেই তো আর্তনাদ করে উঠেলো দোকানদার–দু-এক ঘণ্টা কি গো?

না না, ভয়ের কিছু নেই। অজ্ঞাত হয়ে পড়বে এক্ষুণিই। তারপর ওর শিরদাঁড়া বেঁকে যাবে। ধনুষ্টঙ্কার হতে পারে, হয়তো, তবে ভাববেন না আপনারা। ঘাবড়াবেন না কিছু সাধারণতঃ ওর ধনুষ্টঙ্কার বড় একটা হয় না।

কিন্তু ছোট একটাও তো হতে পারে? কাটলেট হাতে করে একজন এগিয়ে এলো : সেও তো খুব ভাল নয়। অন্তত দেখতে শুনতে ভাল নয় নিশ্চয়ই।

দেখতে? না, দেখতে ভাল না, সেকথা ঠিক। সায় দিলেন মামা শিরদাঁড়া বেঁকে যাওয়া কি দেখতে কখনো ভাল হয়? সে ভারি বিশ্রী। সত্যিই!

চায়ের দোকানের ইতর-ভদ্র সবাই এসে ঘিরে দাঁড়ালো। মামা আরো জোরে জোরে হাওয়া করতে লাগলেন আমায়।

কি করলে সারে? ওষুধ-টষুধ কিছু নেই এর? জিগ্যেস করলেন এক ভদ্রলোক।

এর আর ওষুধ কি? এমনিতেই সারবে একটু সময় নেবে খালি, এই যা। ধাক্কাটা কেটে গেলে সামলে উঠবে আপনিই। তবে বলকর কিছু একটা ওর পেটে পড়লে তার আগেই হয়তো সামলানো যায়। দুধ-টুধ আছে? দিতে পারেন একটা গরম করে? নিদেন এক কাপ গরম চা হলেও চলে।

এক গেলাস গরম দুধ এলো চিনি মেশানো! এক পেয়ালা চাও পেলাম, চা-টা আর আমি খেলাম না, অকারণ নষ্ট হয়ে যায় কেন, তাই কষ্ট করে মামাই সেটা মারলেন। সহানুভুতিরপরবশ একজন বললেন–আহা, শুধু দুধে কি হবে? একটু পাউরুটি ফেলে দাও ওতে। কিংবা একটা মামলেট করে দাও না ছেলেটাকে! পেটে কিছু শক্ত খাবার না পড়লে কি শক্তি আসে? মামলেট পড়লেই সামলে উঠবে মনে হয়। আচ্ছা, আমি দিচ্ছি দাম, দাও ওকে একটা মামলেট।

ডবল ডিমের মামলেট। বলতে মামা লেট খেলো না একটুও। মনে মনে মামার ধন্যবাদ জানালাম। এমন না হলে মামা?

মামলেট খেয়ে সামলালাম সত্যিই। কিন্তু একটুখানি, ওতে কি এই প্রচণ্ড ক্ষিদে মেটে? ফের আমার উপসর্গগুলি ফিরে আসতে লাগলো। আবার আমি অজ্ঞান হবার মত হলাম, এলিয়ে পড়লাম চেয়ারে। হাত-পা খিচুনি শুরু হলো আবার।

একটু ঘোলের শরবত করে দিতে পারনে? এ-ব্যারামে ঘোলটা খুব উপকারী।

মামার বললেন যেন একটু নিরুপায় হয়েই–অবশ্যি, অভাবে মাংসের জুস কি মুর্গির সুরুয়া হলেও হয়।

চায়ের দোকানে আর ঘোল-টোল কোথায়? অভাবে, মাংসের ঝোলই এলো কয়েক টুকরো মাংসও এলো সেই সঙ্গে। দু-তিন পীস রুটিও এসে গেল তার সাথে। এলোচা। খেয়ে-টেয়ে সত্যিই এবার আমি চাঙ্গা হলাম। পায়ে জোর এলো, গায়ে জোয়ার। এতক্ষণে আমার হিস্টিরিয়া ছাড়লো। উঠে দাঁড়ালাম আমি, ছাড়লাম সেই দোকান। পাড়ি দিলাম আমরা আরেকটায়।

পরেরটা একটা রেস্তোরাঁ। এবার ছিলো মামার অসুখের পালা। আমার সমস্ত দুর্লক্ষণ তখন দেখা দিলো মামার। আর আমি তার হেফাজতে রইলাম।

রেস্তারার এক কোণে মামাকে বসিয়ে গলার বোতামগুলো খুলে দিলাম পটাপট। খবরের কাগজের অভাবে নিজের শার্ট খুলেই হাওয়া করতে লাগলাম। নার্সিং-এর আমার মেডইজি–এই শার্ট-কাট।

অনে লোক ছিলো দোকানটায়, কিন্তু কেউ আমাদের দিকে লক্ষ্যটাই করল না। মামা, তোমার উঃ আঃ গুলো তেমন জোরে হচ্ছে না, শুনতেই পাচ্ছে না কেউ। ফিসফিস করলাম মামার কানে কানে।

তুই কি লাগিয়েছিস বলতো? শার্ট দিয়ে পিটোচ্ছিস খালি আমায়? এই কি তোর হাওয়া করা নাকি? ফিসফিসিয়েই জবাব দিলেন মামা, যা মার লাগিয়েছিস বাপু তোর জামার! আমি তো মারা গেলাম। বলে ওরই এক ফাঁকে চট করে নিজের নাকে একটু হাত বুলিয়ে নিলেন।

হাত-পা খেচুনির আগেই মামার দাঁত-মুখের খিচুনি দেখা গেল। দেখতে হলে আমাকেই।

বা রে! আমারো রাগ হয়ে যায়, সত্যিই! হাওয়া করতে গিয়ে তার চোটে যে জামার এতগুলো বোম উড়ে গেল আমার, তার কোনো কথাই নাই! আমার এই স্বার্থত্যাগটা যেন কিছুই না! মামার

এই সেলফিশনেস আমার ভারি খারাপ লাগে।

চেয়ারে তুমি কাত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তোমার কাতরানি বাপু মোটেই ঠিকমতো হচ্ছে না একেবারেই। দোকানের মালিকের কানে না গেলে কি করে হবে?

তারপর মামা সত্যিই সত্যিই ছাড়লেন একটা যা! রাতবিরেতে ছাতের ওপর বেড়ালছানা যেমন ছাড়ে সেইরকম একখানা আওয়াজ। পটাপট আরো গোটাকতক বোম ছিঁড়ে গেল। আমার ছিড়লো আমার হাওয়ার ঠেলাতেই। কিন্তু আমি গ্রাহ্যই করলাম না! ( কারো অসুখ-বিসুখে নিজের লাভ-ক্ষতির দিকে থাকালে চলে না। তাই আমি জামার দিকে তাকালাম না, মামার দিকেও নয়। মামা নাক মুখ সিটকালেন, কিন্তু কি করবো? শক্ত রোগীকে কি কখনো জামাই-আদর করা যায়?

চিঁ চি গলায় শুরু কর মামা হাউ মাউ করে উঠলেন শেষটা—

মিঁ-মিঁ-মিঁ- মিঁয়াও!…

অমন করে ডাকলে স্বয়ং মা জগদম্বাই এসে দেখা দেন, আর, মিঞা না এসে পারে? এগিয়ে এল দোকানদার–

এ কি? এসব কি হচ্ছে এখানে? এটা কি তোমার ওস্তাদির আখড়া পেয়েছে নাকি? গলা ভাঁজবার আর জায়গা পাওনি? গানের কসরতের জায়গা এ নয়। বললেন লেকটা।

অসুখ করেছে মামার। আমি জানালাম।

অসুখ করেছে তো এখানে কি? এখানে কি? ডাক্তারখানায় নিয়ে যাও! সোজা পথ দেখলো সেঃ ঐ যে, সামনেই তো ডাক্তারখানা। চোখের সামনেই দেখচো না?

ওষুধে সারবার অসুখ নয় এ। আমি বলে–এ হোলোগে হিস্টিরিয়া। ভালোমন্দ কিছু পেটে পড়লেই সারে। দেখছেন না, হাঁ করছে কি রকম?

হাঁ করছে? কুইনিনই হচ্ছে এর একমাত্র দাবাই, আছে আমার কাছে, এক্ষুণি আমি আনছি, দাঁড়াও।

আমি তো দাঁড়িয়েই ছিলাম, কিন্তু মামা আর দাঁড়ালেন না!

কুইনিনের নাম শুনেছি তার হ বুজে এসেছিল! হাঁ-হাঁ করে তিনি উঠে পড়লেন। সেরে উঠলেন চটপট। সরে আসতেও তার দেরি হলো না। এক মিনিটও আর তিনি দাঁড়ালেন না সেখানে। তারপর আর একটু রেস্ট না নিয়ে রেস্তেরা থেকে দৌড়ে আমরা বেরিয়ে এলাম।

একটা দোকান অমনি-অমনি চলে গেল আমাদের। যাক গে, গোটা বেন্টিক ইসটিই পড়ে আছে এখনো। বহরে খাটো, দেখতে বেঁটে হলে কি হবে, চায়ের দোকানের কিছু কমতি নেই রাস্তায়! আর এই শহরেই বা কম কি? আর, সব চা-ওয়ালাই এমনি ডাক্তার নয় সবার কাছেই কিছু কুইনিন মজুত নেই।!

পরের দোকানটাতেই মামার পেটে চা-মামলেট প্রভৃতিরা এসে পড়ে।

আর পড়তে থাকে পরের পর। তারপর থেকে চলতে থাকে এমনি ধারা। একবার আমি পড়ি, মামা ওঠেন। তারপর মামা পড়েন, আমি তাঁর শুষা করি। মামার আর আমার সেবায় উঠে পড়ে লাগি–পরম্পরায়। চললো এই রকম দোকানের পর দোকান।

চৌহদ্দিটার চারধারে চক্কর মেরে চা-র চক্রান্ত চলতে থাকে আমাদের। খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে ঢোল হয়ে উঠলো দুজনেরই। আমাদের জয়ঢাকও বলা যায়।

বেন্টিক স্ট্রিটের মোড় ঘুরে কফি-হাউসের পাশ কাটিয়ে যাই, সেখানে ঢুকতে সাহস হয় না আমাদের। কফি-হাউসের মতন অত বড় স্টেজে অভিনয় করা কি চাট্টিখানি? অগত্যা স্যান্ডউইচ, পটেটো-চিপ আর কাজুবাদামের মায়া কাটিয়ে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে ফের আসি ধর্মতলার মোড়টায়। বেন্টিক স্ট্রিটের গোড়াতেই ঘুরে আসি আবার।

চা খেয়ে-খেয়ে মানুষ চাতাল হয় কি না জানি না, কিন্তু যেতে-যেতে আর খেতে-খেতে পথঘাট আর দোকানপাট কখন যে গুলিয়ে গেছল আমাদের! আবার যে আমরা ঘুরপাক খেয়ে আগের দোকানে সবরের আগেকারটায় ফিরে এসেছি তো খেয়ালই হয়নি একদম।

চমক ভাঙল যকন টনক নড়ল দোকানদারের–আরে, এরা যে আবার ফিরে এসেছে রে! ঘুরে এসেছে আবার! দ্যাখ দ্যাখ, ফের সেই সেই হিস্টিরিওয়ালারা!

খালি দোকানদারই নয়, আগের চাপায়ীদের যারা তখন সেই দোকানে ছিল, তারাও বেশ অবাক হলো আমাদের আবিভার্বে।

বেয়ারিং চিঠির মতন ফের আমাদের ফেরত আসতে দেখে চাওয়ালাকে মোটেই খুশি দেখা গেল না। বেয়ারিং ডাক মানেই তো বেয়াড়া এক ডাকাতি। গাঁটের পয়সা খসিয়ে তাকে খালাস কর? আমাদের মতো অখদ্যে যত অখদ্দেরকে খাইয়ে খাইয়ে লাস কর! তাতে কার লালসা হয়?

কিন্তু ভেবে দেখলে, এতে এমন অবাক হবার কি ছিল? হিস্টিরি যখন রিপিট করে, তখন হিস্টিরিয়া কি রিপিট করতে পারে না? অবশ্যি, একটা খুঁত হয়েছিল বটে, সামান্যই সেই একটুই যা গলদ এক জায়গায়! মামার পালা পড়েছিল এবার! আমার হিস্টিরিয়া মামার জিওগ্রাফিতে রিপিট করেছিল এইটুকুই যা! হিস্টিরি আর জিওগ্রাফিতে গোল বেধেছিল শুধু এইখানেই ইতিহাস আর ভূগোল পালটে ছিল এই একটুখানিই। এমন কিছু ইতরবিশেষ নয়।

আমাদের অজ্ঞাতসারে, আমার হিস্টিরিয়া, মামার মানচিত্রে কম্পমান হয়ে দেখা দিয়েছিলো।

একটুকুই যা খুঁত। নামমাত্রই। এছাড়া, আর সবই আমরা ঠিক করেছি। জামার বোম খোলা, খবরের কাগজের হাওয়া লাগান বিলকুল! আমার দিক থেকে কোন ত্রুটি হয়নি। মামার অভিনয়ও যদ্দুর নিখুঁত হয়। কিন্তু হলে কি হবে, দোকানদাররা তবুও কেমন খুঁতখুঁত করে।

অ্যাঁ? এরকমটা হোলে যে? এ-রকম কেন? সেবারে দেখলাম বাচ্চাটার, এবারে দেখছি ধাড়ীটাকে ধরেছে। অ্যাঁ, এ কিরকমের ব্যায়রাম? খালি আওড়ান।

ভারী শক্ত ব্যায়রাম। আমি বললাম–ছোঁয়াচে ব্যায়রাম কি না! এপি ডেমিক তো একেই বলে। আমার থেকে মামার হয়েছে। মড়ক হলে যেমন হয়ে থাকে। যাই হোক, এ হচ্ছে হিস্টিরিয়া, এর ওষুধ হচ্ছে মামলেট। ডবল মামলেট। নিদেন একখানা মোগলাই পরোটা হলেও হয়।

কুছ পরোয়া নেই। সারাচ্ছি আমি এই ছোঁয়াচে। এই দণ্ডেই। এই! নিয়ায় তো গরম জলের কেটলিটা। হাঁকলো সেই চা-ওয়ালা।চায়ের দরকার নেই। পারেটারও পরোয়া করে না। সুষ্ঠু গরম জলেই সারবে এই রোগ।

টগবগে ফুটন্ত জলের কেটলিটা এসে পড়লো। চায়ের জল গরম হচ্ছিল যেটায়।

উপুর কর। দে উপুর করে পুরো কেটলিটা এই লোকটার উপর। হ্যাঁ তার আগে এই ছোঁড়াটার মাথাতেও ছটাকখানেক ছাড়।

শুনতে না–শুনতেই আমি ছটকে আসি–-বারে। আমি কেন? আমাকে কেন? আমার মাথায় কিসের জন্যে? আমার তো হিস্টিরিয়া হয়নি?

হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ? প্রিভেনসন ইজ বেটার দ্যান কিওর, পড়োনি বইয়ে? ব্যায়রাম হবার আগেই তো সারাতে হয়। কে জানে, তোমার হয়তো ফের জিওগ্রাফিয়া হতে পারে, সে আরো শক্ত অসুখ! আরো বেশি ছোঁয়াচে। তার আগেই আরাম করা যাক তোমায়।

আরামের কথা পাড়তেই আমি লাফ মারি। এক রাম লাফ। রামরাজ্যসুলভ লাভ! আর সেই এক লাফেহ সারা ধড়ামতলা পেরিয়ে আসি।

আর মামা? মামাও বেরিয়ে আসেন–তবে কিনা, একটু দেরি করে, আর মেডিক্যাল কলেজ হয়ে। মাসতিনেক বাদে।

আর, তার পরেই–সেই মাথার ফাঁড়ায়– সব চুল উঠে গেল মামার, টাক পড়ে গেল তাঁর। হবেই, জানা কথা। গরম জল চুলের বেজায় ক্ষতিকর। তাতে চুল উঠে যায়; পড়েছিলাম হাইজিনে। কথাটা মিথ্যে নয়। ট্যাকসো না দিয়ে চা খেতে গেলে যা হয়, বিনে পয়সায় ঐ টাক–Show!

পরোপকারের বিপদ

আমার বন্ধু নিরঞ্জন ছোটবেলা থেকেই বিশ্বহিতৈষী–ইংরেজীতে যাবে বলে ফিলানথ্রপিস্ট। এক সঙ্গে ইস্কুলে পড়তে ওর ফিলানথ্রিপিজমের অনেক ধাক্কা আমাদের সইতে হয়েছে। নানা সুযোগে দুর্য্যোগে আমাদের হিত করবেই, একেবারে বদ্ধপরিকর–আমরাও কিছুতেই দেব না ওকে হিত করতে। অবশেষে অনেক ধব্বস্তাধ্বস্তি করে, অনেক কষ্টে, হয়ত ওর হিতৈষিতার হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছি।

হয়ত ফুটবল ম্যাচ জিতেছি, সামনে এক ঝুড়ি লেমনেড, দারুন তেষ্টাও এদিকে–ও কিন্তু কিছুতেই দেবে না জল খেতে, বলেছে, এত পরিশ্রমের পর জল খেলে হার্টফেল করবে।

আমরা বলেছি, করে করুক, তোমার তাতে কি?

জল না খেলেও যে মারা যাব, দেখছ না?

সে গম্ভীর মুখে উত্তর দিয়েছে–সেই ভাল।

তখন ইচ্ছে হয়েছে আরেকবার ম্যাচ খেলা শুরু করি–নিরঞ্জনকেই ফুটবল বানিয়ে। কিম্বা ওকে ক্রিকেটের বল ভেবে নিয়ে লেমনেডের বোতলগুলোকে ব্যাটের মত ব্যবহার করা যাক।

পরের উপকার করবার বাতিকে নিজের উপকার করার সময় পেত না ও। নিজের উপকারের দিকটা দেখতেই পেত বা বুঝি। এক দারুণ গ্রীষ্মের শনিবারের হাফ-স্কুলের পর মাঠের ধায় দিয়ে বাড়ি ফিরছি, নিরঞ্জন বলে উঠল–দেখছ হিরণ্যাক্ষ দেখতে পাচ্ছ?

কী আবার দেখব? সামনে ধূ ধূ করছে মাঠ, একটা রাখাল গরু চরাচ্ছে, দু-একটা কাকা-চিল এদিকে ওদিকে উড়ছে হয়ত এ ছাড়া আর কোনো দ্রষ্টব্য পৃথিবীতে দেখতে পেলাম না। ভাল করে আকাশটা লক্ষ্য করে নিয়ে বললাম–হ্যাঁ দেখেছি, এক ফোঁটা ও মেঘ নেই কোথাও। শিগগির যে বৃষ্টি নামবে সে ভরসা করি না।

ধুত্তোর মেঘ! আমি কি মেঘ দেখতে বলেছি তোমায়? ঐ যে রাখালটা গরু চরাচ্ছে দেখছ না!

নিশ্চয়ই! এই দুপুর রোদে ঘুরলে বেচারাদের মাথা ধরবে না? গরু বলে মাথাই নয় ওদের। মানুষ নয় ওরা? বাড়ি নিয়ে যাক বলে আসি রাখালটাকে সকাল-বিকেলে এক-আধটু হাওয়া খাওয়ালে কি হয় না? সেই হলো গে বেড়ানোর সময়–এই কাটফাটা রোদ্দুরে এখন এ কি?

কিন্তু রাখাল বাড়ি ফিরতে রাজি হয় না–গরুদের অপকার করতে সে বদ্ধপরিকর।

নিরঞ্জন হতাশ হয়ে ফিরে হা-হুঁতাশ করে–দেখছ হিরণ্যাক্ষ, ব্যাটা নিজেও হয়ত মারা যাবে এই গরমে, কিন্তু দুনিয়ার লোকগুলোই এই রকম! পরের অপকারের সুযোগ পেলে আর কিছু চায় না, পরের অপকারের জন্যে নিজের প্রাণষ দিতেও প্রস্তুত!

যখন শুনলাম সেই নিরঞ্জন বড়লোকের মেয়ে বিয়ে করে শুশুরের টাকায় ব্যারিস্টারী পড়তে বিলেতে যাচ্ছে, তখন আমি রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। যাক, এতদিনে তাহলে ও নিজেকে পর বিবেচনা করতে পেরেছে, তা না হলে নিজেকে ব্যারিস্টরী পড়তে পাঠাচ্ছে কি করে? নিজেকে পর না ভাবতে পারলে নিজের প্রতি এতখানি পরোপকার করা কি নিরঞ্জনের পক্ষে সম্ভব?

অকস্মাৎ একদিন নিরঞ্জন আমার বাড়ি এসে হাজির। বোধ হয় বিলেত যাবার আগে বন্ধুদের কাছে বিদায় নিতেই বেরিয়েছিল। অভিমানভরে বললাম- চুপি-চুপি বিয়েটা সারলে হে, একবার খবরও দিলে না বন্ধুদেব? জানি, আমাদের ভালর জন্যই খবর দাওনি, অনেক কিছু ভালমন্দ খেয়ে পাছে কলেরা ধরে, সেই কারণেই কাউকে জানাওনি, কিন্তু না হয় না-ই খেতাম আমরা, কেবল বিয়েটাই দেখতাম। বউ দেখলে কানা হয়ে যেতাম না ত!

কি যে বলো তুমি! বিয়েই হলো না ত বিয়ের নেমন্তন্ন! নিজের উপকার করব তুমি তাই ভেবেছ। আমাকে? পাগল! ভাবছি তোতলাদের জন্যে একটা ইস্কুল খুলব। মুক-বধিরদের বিদ্যালয় আছে, কিন্তু তোতলাদের নেই। অথচ কি পসিবিলিটিই না আছে তোতলাদের!

কি রকম?–আমি অবাক হবার চেষ্টা করি।

জানো? প্রসিদ্ধ বাগ্মী ডিমস্থিনিস আসলে কি ছিলেন? একজন তোতলা মাত্র। মুখে মার্বেলের গুলি রাখার প্র্যাকটিস করে তোতলামি সারিয়ে ফেললেন। অবশেষে, এত বড় বক্তা হলেন যে অমন বক্তা পৃথিবীতে আর কখনো হয়নি। সেটা মার্বেলের গুলির কল্যাণে কিম্বা তোতলা ছিলেন বলেই হলো, তা অবশ্য বলতে পারিনা।

বোধহয় ওই দুটোর জন্যই–আমি যোগ দিলাম।

নিরঞ্জন খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল–আমারো তাই মনে হয়। আমিও স্থির করেছি বাংলাদেশের তোতলাদের সব ডিমস্থিনিস তৈরি করব। তোতলা তো তারা আছেই, এখন দরকার শুধু মার্বেলের গুলির। তাহলেই ডিমস্থিনিস হবার আর বাকি কি রইল?

আমি সভয়ে বললাম–কিন্তু ডিমস্থিনিসের কি খুব প্রয়োজন আছে এদেশে?

সে যেন জ্বলে উঠল–নেই আবার! বক্তার অভাবেই দেশের এত দুর্গতি, লোককে কাজে প্রেরণা জাগে না। কেন, বক্তৃতা ভাল লাগে না তোমার?

থামলে ভারি ভাল লেগে যায় হঠাৎ, কিন্তু যখন চলতে থাকে তখন মনে হয় কালারাই পৃথিবীতে সুখী।

আমার কথায় কান না দিয়া নিরঞ্জন বলে চলল–তাহলেই দ্যখো, দেশের জন্যে চাই বক্তা, আর বক্তার জন্যে চাই তোতলা। কেননা ডিমস্থিনিসের মতো বক্তা কেবল তোতলাদের পক্ষেই হওয়া সম্ভব, যেহেতু ডিমস্থিনিস নিজে তোতলা ছিলেন। অতএব ভেবে দয়াখো, তোতলারাই হলো আমাদের ভাবী আশাভরসা, আমাদের দেশের ভবিষয়ৎ।

যেমন করে ও আমার আস্তিন চেপে ধরল, তাতে বাধ্য হয়ে জামা বাঁচাতে আমাকে সায় দিতে হলো।

তোতলাদের একটা ইস্কুল খুলব, সবই ঠিক, তোতলাকে রাজিও করিয়েছি, কেবল একটা পছন্দসই নামের অভাবে ইস্কুলটা খুলতে পারছি না। একটা নামকরণ করে দাও না তুমি। সেইজন্যেই এলাম।

কেন, নাম তো পড়েই আছে–নিঃস্বভারতী,–চমৎকার!–মানে, বাক্য, যাদের নিঃস্ব–কিনা, থেকেও নেই, তারাই হলো গিয়ে নিঃস্বভারতী।

উঁহু ও নাম দেওয়া চলবে না। কারণ রবিঠাকুর ভাববেন বিশ্বভারতী থেকেই নামটা চুরি করেছি।

তবে একটা ইংরিজি নাম দাও–Sanatorium for faltering Tongues (স্যানাটোরিয়াম ফর ফলটারিং টাংস) বেশ হবে।

কিন্তু বড় লম্বা হলো যে।

তাতো হলোই। সেদিন দেখবে, তোমার ছাত্ররা তাদের ইস্কুলের পুরো নামটা সটান উচ্চারণ করতে পারছে, কোথাও আটকাচ্ছে না, সেদিনই বুঝবে তারা পাশ হয়ে গেছে। তখন তারা সেলাম ইকে নিতে পারে। নাম-কে নাম, কোশ্চেন পেপার-কে কোশ্চেন পেপার।

হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এই নামটাই থাকল।–বলে নিরঞ্জন আর দ্বিতীয় বাক্যব্যয় না করে সবেগে বেরিয়ে পড়ল, সম্ভবত সেই মুহূর্তেই তার ইস্কুল খোলার সু-মতলবে।

মহাসমারোহে এবং মহা সোরগোল করে নিরঞ্জনের ইস্কুল চলছে। অনেকদিন এবং অনেক ধার থেকেই খবরটা কানে আসছিল। মাঝে মাঝে অদম্য ইচ্ছেও হতো একবার দেখে আসি ওর ইস্কুলটা, কিন্তু সময় পাচ্ছিলাম না মোটেই। অবশেষে গত গুড়ফ্রাইডের ছুটিটা সামনে পেতেই ভাবলাম–নাঃ এবার দেখতেই হবে ওর ইস্কুলটা। এ সুযোগ আর হাতছাড়া নয়। নিরঞ্জন ওদিকে দেশের এবং দশের উপকার করে মরছে, আর আমি ওর কাছে গিয়ে একে একটু উৎসাহ দেব, এইটুকু সময়ও হবে না আমার! ধিক আমাকে!

মার্বেলের গুলির কল্যাণে নিশ্চয়ই অনেকের তোতলামি সেরেছে এতদিন। তাছাড়া আনুষঙ্গিকভাবে আরো অনেক উপকার যেমন দাঁত শক্ত, মুখের হাঁ বড়, ক্ষুধাবৃদ্ধি–এসবও হয়েছে। এবং ডিমস্থিনিস হবার পথেও অনেকটা এগিয়েছে ছাত্ররা–অন্ততঃ ডিম পর্যন্ত তো এগিয়েছেই, এবং যেরকম কষে তা দিচ্ছে নিরঞ্জন, তাতে স্থিনিসেরও বেশি দেরি নেই হয়ে এল বলে।

ঠিকানার কাছাকাছি পৌঁছাতেই বিপর্যয় রকমের কলরব কানে এসে আঘাত করল; সেই কোলাহল অনুসরণ করে স্যানাটোরিয়াম ফর ফলটারিং টাস খুঁজে বের করা কঠিন হলো না। বিচিত্র স্বরসাধনার দ্বারা ইস্কুলটা প্রতিমুহূর্তের যেন প্রমাণ করতে উদ্যত যে, ওটা মুক-বধিরদের বিদ্যালয় নয়–কিন্তু আমার মনে হলো, তাই হলেই ভাল ছিল বরং–ওদের কষ্ট লাঘব এবং আমাদের কানের আত্মরক্ষার পক্ষে।

আমাকে দেখেই কয়েকটি ছেলে ছুটে এল–কা-কা-কা-কা-কা-কা-কা-কে চান?

দ্বিতীয়টি তাকে বাধা দিয়ে বলতে গেল–মা-মা-মা-মা–কিন্তু মা-মার বেশি আর কিছুই তার মুখ দিয়ে বরোলে না।

তখন প্রথম ছাত্রটি দ্বিতীয়ের বাক্যকে সম্পূর্ণ করল–মাস্টার বাবা-বা- বা-আমি বললাম কাকাকে, মামাকে কি বাবাকে কাউকে আমি চাই না। নিরঞ্জন আছে?

ছেলেরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চায়ি করতে লাগল। সে কি, নিরঞ্জনকে এরা চেনে না? এদের প্রতিষ্ঠাতা নিরঞ্জন, তাকেই চেনে না! কিম্বা যার যার নাম উচ্চারণ–সীমার বাইরে, তাকে না চেনাই এরা নিরাপদ মনে করেছে?

একজন আধ্যবয়সী ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন ঐখান দিয়ে, মনে হলো এই ইস্কুলের ক্লার্ক, তাঁকে ডেকে নিরঞ্জনের খবর জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন–ও মাস্টারবাবু? এই পর্যন্ত তিনি বললেন, বাকিটা হাতের ইশারা দিয়ে জানালেন যে তিনি ওপরে আছেন। এই জ্বলোকও ভোলা নাকি?

আমাকে দেখেই নিরঞ্জন চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠল–এই যে অ- অনেকদিন পরে! খ-খবর ভাল?

অ্যাঁ? নিরঞ্জনও তেতলা হয়ে গেল নাকি? না ঠাট্টা করছে আমার সঙ্গে? বললাম–তা মন্দ কি! কিন্তু তোমার খবর তো ভাল মনে হচ্ছে না? তোতলামি অ্যাকটিস করছ কবে থেকে?

প্যা-প্যা-পর্যাক-এ্যাকটিস করব কে-কেন? তো-তো-তোতলামি আবার কে-কেউ প্রকটিস করে?

তবে তোতলামিতে প্রমোশন পেয়েছ বলো!

ভাই হি-হি-হিরান্না-ন্না-ন্না-ন্না-ন্না বলতে বলতে নিরঞ্জনের দম আটকে যাবার যোগাড় হলো। অমি তাড়াতাড়ি বললাম–হিরণ্যাক্ষ বলতে যদি তোমার কষ্ট হয়, না হয় তুমি আমাকে হিরণ্যকশিপুই বোলো। কশিপুর মধ্যে দ্বিতীয় ভাগ নেই।

স্বাস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিরঞ্জন বলল–ভাই-হি-হিরণ্যকশিপু, আমার এই স্যাটো টো-টো টো-টো।

এবার ওর চোখ কপালে উঠল দেখে আমি ভয় খেয়ে গেলাম। ইস্কুলের লম্বা নামটা সংক্ষিপ্ত ও সহজ করার অভিপ্রায়ে বললাম–হ্যাঁ, বুঝেছি, তোমার এই স্যানাটোজেন, তারপর?

নিরঞ্জন রীতিমত চটে গেল–স্যানাটোজেন? আমার ইস্কুল হো-হো- হলো গিয়ে স্যা স্যানাটোজেন? স্যানটোজেন তো এ-একটা ও-ও-ওষুধ!

আহা ধরেই নাও না কেন! তোমার ইস্কুলও তো একটা ওষুধ বিশেষ! তোতলামি সারানোর একটা ওষুধ নয় কি?

অতঃপর নিরঞ্জন খুশি হয়ে একটু হাসল। ভরসা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–তা, তোমার ছাত্ররা কদ্দুর ডিমস্থিনিস হলো?

ডি-ডিম হলো!

অর্ধেক যখন হয়েছে, তখন পুরো হতে আর বাকি কি! আমি ওকে উৎসাহ দিলাম।

নিরঞ্জন বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়ে অ-আর হবে না! মা-মা-মার্বেলেই মুখে রাখতে পা-পারে না তো কি-কি-কি-করে হবে?

মুখে রাখতে পারে না? কেন?

স-স-সব গি-গিলে ফ্যালে!

গিলে ফ্যালে? তাহলে আর তোতলামি সারবে কি করে, সত্যিই ত! তা, তুমি নিজেরটা সারিয়ে ফেল, বুঝলে? রোগের গোড়াতেই চিকিৎসা হওয়া দরকার, দেরি করা ভাল না!

হতাশভাবে মাথা নেড়ে নিরঞ্জন জবাব দেয়-আ-আমার যে ডি-ডি-ডি- ডিসপেসিয়া আছে! হ হ-হজম কোরতে পা-পারবো কেন?

ও, ডিসপেপসিয়া থাকলে তোতলামি সারে না বুঝি?

তা-তা কেন? অ-আমিও গি-গিলে ফেলি!–আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম; নিরঞ্জন বলল, আ আমার কি আর পা-পাথর হ-হজম করবার ব-ব-বয়েস আছে?

তাইত! ভারি মুশকিল ত! তোমার চলছে কি করে? ছেলেরা বেতন দেয় ত নিয়ম মত?

উহুঁ–সব-ফি-ফি-ফ্রি যে! অ-অনেক সা-সাধাসাধি করে আনতে হয়েছে!

তবে তোমার চলছে কি করে?

কে-কেন? মা মা-মা-মার্বেল বেচে? এক একজন দ-দ-দশটা-বারোটা করে খায় রোজ! ওগুলো মু-মুখে রাখা ভা-ভা-ভারি শক্ত।

বটে বিস্ময়ে অনেকক্ষণ আমি হতবাক হয়ে রইলাম, তারপর আমার মুখ দিয়ে কেবল বেরোলো–ব-ব-বল কি!

যেমনি না নিজের কণ্ঠস্বর কানে যাওয়া, অমনি আমার আত্মপুরুষ চমকে উঠল! তাঁ, আমিও তোতলা হয়ে গেলাম নাকি! নাঃ, আর একমুহূর্তও এই মারাত্মক জায়গায় নয়! তিন লাফে সিঁড়ি টপকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়লাম সদর রাস্তায়।

পাতালে বছর খানেক

তখনই বারণ করেছিলাম গোরাকে সঙ্গে নিতে। ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে কোনো বড় কাজে যাওয়া আমি পছন্দ করিনে।

আর ঐ অপয়া বাইখানা। প্রেমেন মিত্তিরের পাতাল পাঁচ বছর! যখনই ওটা ওর বগলে দেখেছি, তখনই জানি যে, বেশ গলে পড়তে হবে।

বেরিয়েছি সমুদ্র যাত্রায় পাতাল যাত্রায় তো নয়! সুতরাং কী দরকার ছিল ও বই সঙ্গে নেবার? আর যদি নিতেই হয়, তবে আমার বাড়ী থেকে পালিয়ে কী দোষ করলো? যতো সব বিদঘুঁটে কাণ্ড ঐ ছেলেটার! মনে মনে আমি চটেই গেলাম।

শেষে কিন্তু ভড়কাতে হলো জাহাজে উঠেই যখন বইয়ের করামণ ও ব্যক্ত করলে। আমাকে রেলিং-এর একপাশে ডেকে এনে চোখ বড়ো করে চাপাগলায় বললে, মেজ-মামাকে বলবেন না কিন্তু। খবু ভালো হয়, যদি জাহাজটা ডুবে যায়! আমি বললাম, কি ভালোটা হয়?

সটান পাতালে চলে যাওয়া যায় এবং সেখানে–এই বলেই গোরা উৎসাহের সহিত বইখানার পাতা ওলটাতে শুরু করে গোড়ার থেকেই।

আমি ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে, নিতান্তই অকস্মাৎ প্রচণ্ড সাইক্লোন কিংবা বরফের পাহাড়ের ধাক্কা যদি না লাগে, তাহলে সে রকম সুযোগ পাওয়াই যাবে কিনা সন্দেহ। আর সেই দুরাশা পোষণ করেই যদি ঐ বই এনে থাকে, তবে তা সে খুবই ভুল করেছে, কারণ আজকালকার নিরাপদ সমুদ্রযাত্রার পাতালের ভ্রমণ-কাহিনীকে কাজে লাগানো ভারী কঠিন।

আমার কথায় সে দমে গেল। গম হয়ে থেকে অবশেষে বললে–তাহলে কি কোনই আশা নেই একেবারে?

দেখছি না তো! নিস্পৃহকণ্ঠে আমি জবাব দিই–তাছাড়া, তুমি ব্যতীত জাহাজের এতগুলি প্রাণীর মধ্যে কারো ভুলে পাতালে যাবার শখ আছে বলেও আমার মনে হয় না!

বলেন কি? গোরা যেন আকাশ থেকে পড়ল–তা কখনো হয়? আপনিও কি যেতে চান না পাতালে?

আমি প্রবলবেগে ঘাড় নাড়লাম–পাতাল দূরে থাক,হাসপাতালেও না। মুখ ফাঁক করলাম আমার–কেউ কি মরতে যায় ওসব জায়গায়?

আপনি মিথ্যা বলছেন। গোরা অবিশ্বাসের হাসি হাসল, পাতালে যাবার ইচ্ছা আবার হয় না মানুষের!

আমার হয় না। আমাকে জানো না তুমি। আমি জানালাম, আমার পাতালে যাবার ইচ্ছে হয় না, মোটর চাপা পড়বার ইচ্ছা হয় না, রেলে কাটা যাবারও ইচ্ছা করে না। আমি যেন কিরকম!

আমি সঙ্গে থাকব, ভয় কি আপনার! ও আমাকে উৎসাহ দেয়– মেজমামাকে দেখে আসি, আপনি ততক্ষণ পড়ুন বইখানা।

বইটা হাতে নিয়ে ভাবলাম এটাকে এখনই, আমাদের আগেই পাতালে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়। সিঙ্গাপুরে যাচ্ছি, সিঙ্গা ফুঁকতে তো যাচ্ছিনে, আকাশ-পাতালের বৃত্তান্ত আমার কি কাজে লাগবে? তারপর কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বইটা পড়তে শুরু করি শেষের দিক থেকে। গোড়ার দিক থেকে পড়বে না বলেই শেষের দিকটাই ধরি আগে।

শেষপৃষ্ঠা থেকে আরম্ভ করে একশ চৌত্রিশ পাতা পর্যন্ত এগিয়েছি–কিংবা পিছিয়েছি–এমন সময়ে কর্ণবিদারী এক আওয়াজ এলো। সেই মুহূর্তেই আমার হাত থেকে খসে পড়ল বইটা এবং খসে পড়লাম চেয়ার থেকে। অত বড় জাহাজটা থর থর করে কাঁপতে লাগল মুহূর্মুহূ।

উঠব কিংবা অমনি করে পড়েই থাকব, অর্থাৎ উঠবার আদৌ আবশ্যক হবে কিনা, ইত্যাকার চিন্তা করছি, এমন সময় গোরার মেজমামা হন্দদন্ত হয়ে ছুটে আসেন।

এই যে, বেঁচে আছো? বেঁচেই আছো তাহলে। হার্টফেল কররানি এখনো?

উঁহু! সংক্ষেপে সারি।

আমার তো পিলে ফাটার উপক্রম। জানান গোরার মামা।

ব্যাপার কি? কি হয়েছে? এঞ্জিন বা করলো নাকি।

উঁহু আরেকখানা জাহাজ। জাহাজে জাহাজে ঠোকাঠুকি।

কী সর্বনাশ।

মনে হচ্ছে কোনো চারা জাহাজ। চোরাই মালের জাহাজ টাহাজ হবে বোধ হয়। ধাক্কা মেরেই ছুটেছে। ঐ দ্যখো না!

ঐ অবস্থাতেই ঘাড় উঁচু করে তাকালাম, আরেকখানা জাহাজের মতই দেখতে, সুদূর দিকচক্রবালের দিকে নক্ষত্ৰবেগে পালাচ্ছে। আমাদের শ্রীমান ততক্ষণে কাঁপুনি থামিয়ে স্তব্ধ হয় দাঁড়িয়েছেন স্তম্ভিত হয়ে।

দুধারেই এনতার ফাঁকা, দুশো জাহাজ যাবার মতন চওড়া পথ, তবু যে এরা কি করে মুখোমুখি আসে, মারামারি করে, আমি তো ভেবে পাই না। আমি বিরক্তি প্রকাশ করি।

উপকূল থেকে আমরা এখন কদ্দুরে? মেজমামার প্রশ্ন।

দেড় শো কি দুশো মাইল হবে বোধ হয়। আমি বলি, ছসাত ঘণ্টা তো চলছে আমাদের জাহাজখানা!

বলতে বলতে ঢং ঢং করে অ্যালার্ম বেল বাজতে শুরু করলো এবং শ্রীমদগৌরাঙ্গদেব লাফাতে লাফাতে আবির্ভূত হলেন।–মেজমামা, দেখবে এসো, কী মজা! আপনিও আসুন শিরামবাবু! জাহাজের খালে হুহু করে জল ঢুকছে। কী চমৎকার! তার হাতাতালি আর থামে না।

অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখি, কাপ্তেন সেখানে দাঁড়িয়ে। খালাসীরা পাম্পের সাহায্যে জলনিকাশ করছে। চারিদিকেই দারুণ ত্রাস আর এ্যস্ততা। যাত্রীরা ভীত-বিবর্ণ মুখে খালাসীদের কাজ দেখছে। সমস্ত জনপ্রাণীর মধ্যে আমাদের গেরোই কেবল আনন্দে আত্মহারা। পাতালে যাবার পথ পরিষ্কার হচ্ছে কিনা ওর, কাজেই ওর ফুর্তি!

কেন অনর্থক পাম্প করে মরছে? আমাকেই প্রশ্ন করে গোরা। জাহাজটা ডুবে গেলেই তো ভাল হয়।

ভালটা যাতে সহজে না হয়, তারই চেষ্টা করছে, বুঝতে পারছো না? আমার কণ্ঠস্বরে উম্মা প্রকাশ পায়।কলিযুগে কেউ কি কারো ভাল চায়?

যা বলেছেন! ভারী অন্যায় কিন্তু! এক মুহূর্তের জন্য থামে সে–ডাঙ্গা এখান থেকে কদুর?

তা–দু-তিন মাইল হবে বোধ হয়। আমি ভেবে বলি।

মোট্টে! তাহলে তো সাঁতরেই চলে যেতে পারবো। সে যেন একটু হতাশ হয়। কোন দিকে বলুন তো ডাঙ্গাটা?

সোজা নিচের দিকে।

ওঃ তাই বলুন! ওর মুখে হাসি ফোটে আবার আপনি যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন।

নাঃ, ভয় কিসের! আমি জোর করে হাসি।

পাতালে যেতে হবে এবং পুরো পাঁচবচ্ছর হবে সেখানে। তার আগে চলছে না। কি বলুন? তাই তো? আমার মতের অপেক্ষা করে গোরা। সমুদ্রটা তলিয়ে দেখতে সে অস্থির।

পাতাল যেরকম জায়গা, সেখানে পুরো পাঁচমিনিটও থাকা যাবে কিনা এই রকম একটা সংশয় আমার বহুদিন থেকেই ছিল, পাতাল কাহিনীর একশ চৌত্রিশ পাতা পর্যন্ত পড়েও সে সন্দেহ আমার টলেনি, কিন্তু আমার অবিশ্বাস ব্যক্ত করে ওকে আর ক্ষুণ্ণ করতে চাই না।

হঠাৎ সে সচকিত হয়ে ওঠে–বইটা? সেই বইখানা?

ডেকেই পড়ে রয়েছে। আমি বলি।

ডেকে ফেলে এসেছেন? কী সর্বনাশ!–কত কাজে লাগবে এখন ঐ বইটা। কেউ যদি নেয়– সরিয়ে ফ্যালে? বলে গোরা বইয়ের খোঁজে দৌড়োয়।

কি রকম বুঝছ গতিকটা? মেজমামা এগিয়ে আসেন।

স্বয়ং জাহাজ তাঁর কথার জবাব দেয়। তার একটা ধার ক্রমশ কাত হতে থাকে, ডেকের সেই ধারটা পাহাড়ের গায়ের মতো চালু হয়ে নেমে যায়। সে ধারটা দিয়ে জলাঞ্জলি যাওয়া খুবই সোজা বলে মনেহয়। বসে বসেই সুড়ুৎ করে নেমে গেলেই হল। অ্যালার্ম বেল আরো জোর জোর বাজাতে থাকে। কাণ্ডেন লাইফবেটিগুলো নামাবার হুকুম দ্যান। জাহাজ পরিত্যাগের জন্য যাত্রীদের প্রস্তুত হতে বলেন।

লাইফবোট নামানোর জন্য তেমন হাঙ্গামা পোহাতে হলো। জাহাজ তো কাত হয়েই ছিল, সেই ধার দিয়ে দড়ায় বেঁধে ওগুলো ছেড়ে দিতেই সটান জলে গিয়ে, দাঁড়াল। আরোহীরাও লাইফবোটের অনুসরণে প্রস্তত হলেন। সাবধানতা এইজন্য যে একটু পা ফসকালেই একেবারে লাইফ আর লাইফবোটের বাইরে–সমুদ্রগর্ভেই সটান!

গোরার মেজমামা এবং আমি-আমাদেরও বিশেষ দেরি ছিল না। যেমন ছিলাম, তেমনি বোটে যাবার জন্যে তৈরি হলাম। এমন দুঃসময়ে লাগেজ, হোন্ড-অল বা সুটকেসের ভাবনা কে ভাবে? সন্দেহের বাক্সের কথাই কি কেউ মনে রাখে? কেই-বা সঙ্গে নিতে চায় সেসব?

কিন্তু গোরা? গোরা? কোথায় গেল সে এই সংকট মুহূর্তে? আমি গলা ফাটাই এবং মেজমামা আকাশ ফাটান–গোরার, কিন্তু কোনো সাড়াই পাওয়া যায় না।

কে জানে হয়তো কেবিন বই পড়ছে! আমার প্রকাশ পায়।

এই কি পড়বার সময়? মেজমামা খাপ্পা হয়ে ওঠেন–পড়াশুনা করার সময় কি এই?

ওর কি সময়-অসময়–জ্ঞান আছে? আমি বলি, যা ওর পড়ার ঝোঁক!

দুজনে আমরা কেবিনের দিকে দৌড়োই, নাঃ, কেবিন তো নেই, তখন এদিকে-ওদিকে, দিগবিদিকে ছোটছুটি শুরু করি কিন্তু গোরা! অবশেষে আমাদের জন্য সবুর না করে শেষে বোটখানাও ছেড়ে দেয়।

সবগুলি বোটকেই দিকচক্রান্তে একে একে অন্তর্হিত হতে দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মেজমামা বসে পড়ে। আমি পড়ি শুয়ে। সেই পরিত্যক্ত জাহাজের প্রান্তসীমায় তখন কেবলি আমরা দুজন। গোরা অথবা লাইফবোট–কার বিরহ আমাদের বেশি কাতর করে বলা তখন শক্ত।

খট করে হঠাৎ একটা শব্দ হতেই চমকে উঠি। দেখি শ্রীমান গৌরাঙ্গ হাসতে হাসতে অবতীর্ণ হচ্ছেন। সমুন্নত ডেকের চুড়ায় গিয়ে তিনি উঠেছিলেন।

কোথায় ছিলিরে এতক্ষণ? গোরাকে দেখতে পাবামাত্র সেখানে বসেই মেজমামা যেন কামান দাগেন।

কতক্ষণে বোটগুলো ছাড়ে, দেখছিলাম। গোরার উত্তর আসে, সবগুলো চলে যাবার পর তবে আমি নেবেছি।

কৃতার্থ করেছে। মনে মনে আমি কই।

মেজমামার দিক থেকে সহানুভূতির আশা কম দেখে ছেলেটা আমার গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। কানে কানে বলে, পাতালে যাবার এমন সুযোগ কি ছাড়তে আছে মশাই? আপনিই বলুন না।

আমি চুপ করে থাকি। কী আর বলবো? আশঙ্কা হয় এমন কথা বলতে গেলেই হয়ত তা কান্নার মত শোনাবে। নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখে কান্নাকাটি করে লাভ!

ঘাবড়াবেন না, ওর চাপা গলার সান্ত্বনা পাই। ফিরে এসে আপনিও প্রেমেনবাবুর মতো অমনি একখানা বইয়ের মত বই লিখতে পারবেন।

আমি শুধু বলি–হ্যাঁ, ফিরে এসে; ফিরে আসতে পারি যদি! মুখ ফুটে এর বেশি বলতে পারি না, মুখের ফুটো বুজে আসছিল আমার।

ক্রমশ বিকেল হয়ে আসে। অনেকক্ষণ বসে থেকে অবশেষে আমরা উঠি। খাওয়ার এবং শোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তো! যতক্ষণ অথবা যতদিন এই জাহাজের এমনি ভেসে থাকার মতি গতি থাকবে, আর এই পাশ দিয়ে যেতে যেতে অন্য কোনো জাহাজ আমাদের দেখতে পেয়ে তুলে না নেবে, ততক্ষণ বা ততদিন টিকে থাকার একটা বন্দোবস্ত করতে হবে বই কি!

আফশোস করে আর ফল কি এখন?

জাহাজকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তিনি সেইরূপ কাত হয়ে রইলেন, বেশি আর তলাবার চেষ্টা করলেন না। আমরা তিনজনে এধারে ওধারে এবং কেবিনে পরিভ্রমণ শুরু করলাম।

নাঃ, খাবার দাবার অপর্যাপ্তই রয়েছে। পাঁচ বছর না হোক, পাঁচ হপ্তা টেকার মতো নিশ্চয়ই! বিস্কুট, রুটি, মাখন, চকোলেট, জ্যাম, ঠাণ্ডা মাংস টিন কে টিন। গোরা পুলক আর ধরে না! তার কলেবর আমাদের একেবারে ক্ষেপিয়ে তুললো প্রায়।

খাওয়া দাওয়া সেরে একটা প্রথম শ্রেণীর কেবিনে শয়নের আয়োজন করা গেল। ডেকের টিকিট কেটে প্রথম শ্রেণীতে যাওয়ার সুযোগ পাওয়া কতখানি সুবিধার, নরম গদির আরামের মধ্যে গদগদ হয়ে গোরা আমাদের তাই বোঝাতে চায়, কিন্তু তার সূত্রপাতেই এক ধমকে মেজমামা থামিয়ে দেন ওকে।

পরের দিন ভোরে ঘুম ভাঙলে সবাই আমরা চমৎকৃত হলাম। এ কি! কেবিনের দরজা কেবিন ছাড়িয়ে এত উঁচুতে গেল কি করে। রাতারাতি জাহাজটা কি আরেক ডিগবাজি খেলো না কি! বাইরে বেরিয়ে যে কারণ বের করব, তারও যোগ নেই। কেন না দরজা গেছে কড়িকাঠের জায়গায়, কিন্তু আমরা দরজার জায়গায় নেই। আমরা যে কোথায় আছি, ঠিক বুঝতে পারছি না।

গোরা কিন্তু আমাদের কাজের ছেলে। কোত্থেকে একটা দড়ি বাগিয়ে এনে হুক লাগিয়ে ফাঁসের মতো করে দরজার দিকে ছুঁড়ে দিল। কয়েকবার ছুঁড়তেই আটকালো ফাসটা। তারপর তাই ধরে সে অবলীলাক্রমে উপরে উঠে গেল। ফাঁসটাকে দরজার সঙ্গে বার করে বেঁধে দড়িটা নামিয়ে দিল সে আমাদের উঠবার জন্য।

যে দড়ি-পথ গোরার পক্ষে মিনিটখানেক পরিশ্রম, তাই বেয়ে উঠতে দুজনেই আমরা নাস্তানাবুদ হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণে, অনেক উঠে পড়ে, বিস্তর ধস্তাধস্তি করে, এ ওর ঘাড়ে পড়ে, পরম্পরায়, বহুৎ কায়দা-কসরতে ঘর্মাক্ত কলেবরে অবশেষে আমরা উপরে এলাম। এসে দেখি জাহাজ এবার অন্যধারে কাত হয়েছেন। অন্যদিকে হেলেছেন, তাই আমাদের প্রতি এই অবহেলা। সেইজন্যেই কেবিনের মেজে পরিণত হয়েছে দেয়ালে, আর দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাদ। জাহাজের মেজাজে!

জাহাজের এই রকম দোলায় অতঃপর কি করা যায়, তাই হলো আমাদের ভাবনা। ব্রেকফাস্ট করা যাক। গোরা প্রস্তাব করল।

এই রে! মেজমামা বাজের মতন ফাটবেন এইবার! মুখ না ধুতেই প্রাতরাশের সম্মুখে! এ প্রস্তাবে নাঃ আর রক্ষা নেই! কিন্তু আমার আশঙ্কা ভুল, মেজমামার দিক থেকে কোনই প্রতিবাদ এলো না। কাল থেকে গোরার প্রত্যেক কথাতেই তিনি চটছিলেন, কিন্তু একথায় তাঁর সর্বান্তঃকরণ সায় দেখা গেল।

প্রাতরাশ সেরে সব চেয়ে উঁচু এবং ওরই মধ্যে আরামপ্রদ একটা স্থান বেছে নিয়ে সেখানে আমরা তিনটি প্রাণী গিয়ে বসলাম। বসে বসে সারাদিন জাহাজটার আচার-ব্যবহার লক্ষ্য করি! প্রত্যেক ঘণ্টায়ই একটু একটু করে জলের তলায় তিনি সমাধিস্থ হচ্ছেন। এই ভাবে চললে তার আপাদমস্তক তলানো ক ঘণ্টার বা কদিনের মামলা, মনে মনে হিসাব করি।

হয়েছে হয়েছে। মেজমামা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন, যখন আমরা জাহাজে উঠলাম, মনে নেই তোমার? জাহাজের খোলে যত রাজ্যের লোহা লক্কর বোঝাই করছিল মনে নেই?

হ্যাঁ আছে। তা কি হয়েছে তার?

লক্করগুলো তো ভেগেছে, এখন ওই লোহার ভারেই জাহাজ ডুবছে। খোলের ভেতর থেকে লোহাগুলো তুলে এনে যদি জলে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে হয়তো জাহাজটাকে ভাসিয়ে রাখা যায়।

আমি ঘাড় নাড়ি–তা বটে। কিন্তু কে আনবে সেই লোহা? এবং কি করেই বা আনবে?

গোরা উৎসাহিত হয়ে ওঠে আনবো? আনবো আমি? তার কেবল মাত্র আদেশের অপেক্ষা!

থাম! মেজমামা প্রচণ্ড এক ধমক লাগান।

লক্করদের সবাই কি গেছে? আপাতত একে ফেলে দিলেও জাহাজটা কিছু হালকা হতে পারে বোধ হয়? দেব ফেলে? আমি বললাম।

থামো তুমি। মেজমামা গরম হলেন আরো তোমরা দুজনে মিলে আমাকে পাগল করে তুলবে দেখছি।

তার চেয়ে এক কাজ করা যাক। আমি গম্ভীরভাবে বলি, জাহাজের কেবিনগুলো ওয়াটার-টাইট বলে শুনেছি। বড়ো দেখে একটার মধ্যে ঢুকে ভাল করে দরজা এঁটে আজকের রাতটা কাটানো যাক তারপর কালকের কথা। কাল যদি ফের বেঁচে থাকি, তখন।

তাই করা গেল। স্টোর-রুম থেকে প্রচুর খাবার এনে সব চেয়ে বড়ো একটা কেবিনের মধ্যে আমরা আশ্রয় নিলাম। গোরা কতকগুলো টর্চ বাতি নিয়ে এসেছিল, তাদের আর আমাদের একসঙ্গে জ্বালাতে শুরু করলো। টর্চের সাহায্যে টর্চার করার নামই হচ্ছে জ্বালানো মেজমামা বললেন, এর চেয়ে জ্বালাতন আর কি আছে? আর ঠিক এই ঘুমোবার সময়টাতেই! বললেন মেজমামা।

অনেকক্ষণ কেটে গেল, কিন্তু রাত যেন আর কাটে না। যতক্ষণ সম্ভব এবং যতদূর সাধ্য, প্রাণপণে আমরা ঘুমিয়েছি; কিন্তু ঘুমানোর তো একটা সীমা আছে! গোরা সেই সীমানায় এসে পৌঁছেই ঘোষণা করে, এইবার ব্রেকফাস্ট করা যাক।

অ্যাঁ! এই রাত থাকতেই! শুয়েই আমি চমকে উঠি।

কী রাক্ষুসে ছেলে রে বাবা! মেজমামাও গর্জ্জন করেন, তোর কি ভোর হোতেও তর সইছে নারে?

খিদে পেয়েছে যে। গোরা বলে, ভোর না হলে বুঝি খিদে পেতে নেই?

খিদে কি আমারও পায়নি? মেজমামা ফোঁস করেন; কিন্তু–তা বলে কি রাত থাকতেই ব্রেকফাস্ট–এ রকম বে-আক্কেলে কথা কেউ শুনেছে কখনো?

কারো বাপের জন্মে? ভদ্রলোকে শুনলে বলবে কি?

আহা ছেলেমানুষ, খিদে পেয়েছে খাক না! এখানে তো ভদ্রলোক কেউ নেই। কে শুনছে? বিস্কুটের টিনটা গোরার দিকে আগিয়ে দিই।

বা-রে, আমি বুঝি বাদ? মেজমামা আমার দিকে হাত বাড়ান, ছেলেমানুষ বলে কি ও মাথা কিনেছে নাকি? ছেলেমানুষ না হলে খিদে পেতে নেইকো?

মেজমামাকেও একটা টিন দিতে হয় এবং নিজেও আমি একটা টিন শেষ করি। তারপর আবার ঘুম। তারপর আবার অনেকক্ষণ কাটে। আবার ঘুম ভাঙে। আবার খাবার পালা। এইভাবে বারবার তিনবার ব্রেকফাস্টের দাবী মিটিয়েও সকালের মুখ দেখা যায় না। বারোটা বিস্কুটের টিন ফুরোয়, কিন্তু বারো ঘণ্টার রাত আর ফুরোয় না, তখন বিচলিত হতে হয়, সত্যিই!

গোরা, জ্বালাতে টর্চটা একবার। কি ব্যাপার দেখা যাক–

টর্চের আলো ফেলে কেবিনের পোর্টহোলের ভেতর দিয় যা দেখি, তাতে চোখ কপালে উঠে যায়। জল, কেবল সমুদ্রের কালো জল! তা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না।

সর্বনাশ হয়েছে! মেজমামা কন–খুব সংক্ষেপেই।

হ্যাঁ আমরা জলের তলায়–ডুবে গেছি। আমাদের জাহাজ ডুবে গেছে কখন!

কিন্তু একথা মুখ ফুটে না বললেও চলতো, কেন না তথ্য আর অস্পষ্ট ছিল না যে, আমাদের আর আশেপাশের কেবিনগুলো সব ওয়াটার-টাইট বলেই আমরা বেঁচে আছি এখনো পর্যন্ত। পোর্টহোলের কাঁচের শাসিটা পুরু, এত পুরু যে, তা ভেঙে জল ঢুকতে পারবে না। তাই রক্ষা!

এবার কিন্তু মারা গেলাম আমরা। কান্নার উপক্রম হয় মেজমামার।

অনেকটা নিচেই তলিয়েছি মনে হয় এত নিচে যে, সুয্যির রশ্মিও এখানে এসে পৌঁছোয় না। দিন কি রাত, বোঝবার যো নেই।

কতক্ষণ আছি, তাই বা কে জানে! মেজমামার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে।

ব্রেকফাসেটর সংখ্যা ধরে হিসেব করলে মনে হয়, এক রাত কেটে গিয়ে গোটা দিনটা কাটিয়ে এখন আমরা আরেক রাতে এসে পৌঁছেছি।

তবে! তবে আর কি হবে। মেজমামার হতাশার স্বর শুনে দুঃখ হলো। তারপরে নিজেই তিনি নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন–তবে আর কি হবে! দাও আমার রুটি- মাখনের বাক্সটা সাবাড় করা যাক তাহলে!

মুখ থেকে কথা খসতে না খসতেই গোরা মাতুল-আজ্ঞা পালন করে। এসব দিকে ওর খুব তৎপরতা।

এইভাবে এতদিন এখানে কাটাতে হবে, কে জানে! হয়তো বা যাবজ্জীনই, পাউরুটির পেষণে মুখের কথা অস্পষ্ট হয়ে আসে মেজমামার।–না খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। অতএব খাওয়াই যাক কী করা যাবে?

তারপর থেকে উদরকেই আমরা ঘড়ির কাজে লাগাই। আবার খিদে পেলেই বুঝি, আরো ছ ঘণ্টা কাটলো। এই করেই দিনরাত্রির হিসেব রাখা হয়। এসব বিষয়ে গোরার পেট সব চেয়ে নিখুঁত– একেবারে কাঁটায় কাঁটায় চলে। ঘণ্টায় ঘন্টায় সাড়া দেয়!

এইভাবে কয়েকটা ব্রেকফাস্ট কেটে যাবার পর মনে হলো, কেবিনে অন্ধকার যেন অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। হ্যাঁ, এই যে বেশ আলো আসছে পোর্টহোল দিয়ে।

কী ব্যাপার? ব্যগ্র হয়ে ছোটেন মেজমামা পোর্টহোলের দিকে, কই, আকাশ তো দেখা যাচ্ছে না। চারদিকেই জল যে! তাঁর করুণধ্বনি আমাদের কানে বাজে!

নাঃ, এখনো জলের তলাতেই আছি বটে, তবে কিছুটা উপরে উঠেছি। সূর্যরশ্মি প্রবেশের আওতার মধ্যে এসেছি! আমার মনে হয়, ইতিমধ্যে উপরের মাস্তুল টাস্তুলগুলো বসে গিয়ে ভার কমে যাওয়ায় খানিকটা হালকা হয়ে নিমজ্জিত জাহাজটা কিছু উপরে উঠতে পেরেছে। যাক, একটু আলো তো পাওয়া গেল, এই লাভ!

থাক না জল চারদিকে, আমাদের কেবিনের মধ্যে তো নেই! এই বা কি কম বাঁচোয়া! সান্ত্বনার স্বরে এই বলে মেজমামার কথার আমি জবাব দিই।

প্রত্যুত্তরে মেজমামা শুধু আরেকটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করেন।

আমার কিন্তু এমনি জলের তলায় থাকতেই ভাল লাগে। কিরকম মাথায় উপরে, তলায়, চারধারেই অথৈ জল! কেমন মজা! যদ্দুর চাও–খালি সমুদ্র–আর সমুদ্দুর গোরা এতক্ষণে একটা কথা কয়–বাড়ির চেয়ে এখানে–এখন ঢের ভাল!

হ্যাঁ! বাড়ির চেয়ে ভাল বই কি! মেজমামা নতুন বিস্কুটের টিন খুলতে খুলতে বলেন, জলে ডুবে বসে আছি জলাঞ্জলি হয়ে গেছে আমাদের–ভাল না?

জল ডুবে কি রকম? গোরা প্রতিবাদ করে–ডুবে গেলেও আমরা কতো নিচে আছি শিব্রামবাবু?

বিশ-ত্রিশ-চল্লিশফিট, কি আরো বেশিই হবে–কে জানে! আমি জানাই।

ডুবন্ত লোকের কাছে ত্রিশ ফিট জলের তলাও যা, আর হাজার ফিটও তাই! সবই সমান! কোনোটাই ভাল নয়। আবার মেজমামার দীর্ঘনিঃশ্বাস।

কিন্তু মেজমামা, আমাদের কেবিনের মধ্যে তো এক ফোঁটাও জল ঢুকতে পারছে না! তাহলে ডুবলামই বা কি করে? আবার গোরার জিজ্ঞাস্য হয়।–জলে যদি না পড়ি–না যদি হাবুডুবু খাই–আমরা মরবো কেন? বলেই সে আমার দিকে প্রশ্নবাণ ছাড়ে, হ্যাঁ, শিব্রামবাবু বলুন না! জলে ডুবে গেলে কি বাঁচে মানুষ? আমরা যদি ডুবেছি, তাহলে বেঁচে আছি কি করে?

আহা, জল ঢুকছে না যেমন, হাওয়াও ঢুকতে পারছে না যে তেমনি। আমি ওকে বোঝাবার প্রয়াস পাই। আর আমার মনে হয়, মানুষে জলে ডুবে যে মারা যায়, সে জলের প্রভাবে নয় হাওয়ার অভাবেই! এই কারণেই গায়ে জলের আঁচড়টিও না লাগিয়ে আমরা শোনপাপড়ির মত শুকনো থেকেও সমুদ্রগর্ভে ডুবে মারা যেতে পারি। আজই হোক কিংবা কালই হোক-সঞ্চিত হওয়ার অক্সিজেন নিঃশেষ হয়ে গেলেই—অক্সিজেন–বঞ্চিত হলেই আমরা…

গুরুতর বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাঝখানেই গোরা সশব্দে লাফিয়ে ওঠে–একি? কে ওখানে? ও কে?

আমাদের সবার দৃষ্টি পোর্টহোমের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ওর শার্সির ওধারে বদন ব্যাদান করে এ আমার কোন প্রাণী বাবা? অজানা কোন জানোয়ার? সমুদ্রের তলায় এমন বিচ্ছিরি বিটকেল বিদঘুঁটে চেহারা–ভয় দেখাচ্ছে এসে আমাদের!

শার্ক! মেজমামা পর্যবেক্ষণ করে কন। এরই নাম শাক।

হ্যাঁ বইয়ে পড়েছি বটে। এই সেই শার্ক? গোরার উৎসাহের সীমা থাকে না। পোর্টহোলের। উপর সে ঝুঁকে পড়ে একেবারে।

উঁহু, অতো না! অতো কাছে নয়, কামড়ে দিতে পারে। আমি সতর্ক করে দিই, এমন কি, না কামড়ে একেবারে গিলে ফেলাও অসম্ভব নয়।

বাঃ শার্সি রয়েছে না মাঝখানে? গোরা মোটেই ভয় খাবার ছেলে নয়।

তোকে দেখলেই সুখাদ্য মনে করবে! মেজমামও সাবধান করতে চান–তখন শার্সি ফার্সি ভাঙতে ওর কতক্ষণ! মাঝখানে আমরাও মারা পড়বো তোর জন্যেই!

গোরা কিন্তু ততক্ষণে অতিথির সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান শুরু করেছে।

সেদিন বিকেল থেকেই কেবিনের বাতাস দুর্গন্ধ হয়ে উঠল–এইবার কমে আসছে অক্সিজেন, বিষাক্ত হয়ে উঠছে বাতাস। আমি বললাম, এর পর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে আমাদের।

তাহলে উপায়? মুখখানা সমস্যার মত করে তোলেন মেজমামা। তাহলে এক কাজ করা যাক তিনি নিজেই সাবধান করে দেন, যতো টিন আর বিস্কুট আছে, সব খেয়ে শেষ করা যাক এসো। খেয়ে দেয়ে তারপর গলায় দড়ি দিলেই হবে। খাবি খেয়ে অল্পে অল্পে মরার চেয়ে আত্মহত্যা করা ঢের ভালো!

ঠিক অতো উপাদেয় না হলেও আরেকটা উপায় আছে এখনো? মেজমামাকে আশ্বস্ত করি, আমাদের দুধারেই কেবিন, উপরে আর নিচের তলাতেও। আপাতত দেয়ালে এবং মেঝের ছ্যাদা করে ঐ সব ঘরের বিশুদ্ধ বাতাস আমদানি করা যাক। এ ঘরের দূষিত বায়ু সব দূর করে দিই। তারপর শেষে ছাদ ফুটো করলেই হবে। আপাতত এতেই চলে যাবে দিনকতক।

মেজমামা স্তস্তির সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন। গোরা বলে, তার চেয়ে আমরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলি না কেন। তাতেও তো কি বাতাস বাড়াতে পারে! কি বলেন?

মেজমামা কটমট করে তাকান ওর দিকে, আমি কোনো উত্তর দিই না।

এর পরের কদিনের ইতিহাস সংক্ষেপে এই : ঘরের বাতাস ফুরিয়ে এলেই এক একধারে একটা করে গর্ত বাড়ে। বাতাসের কমতি গর্তের বাড়তির দ্বারা পুষিয়ে যায়। গোটা জাহাজটা আমাদের ভাগ্যক্রমে এয়ার-ওয়াটার-টাইট ছিল বলেই এই বাঁচোয়ো!

শার্কটা গোরার রূপে-গুণে মুগ্ধ হয়েছিল নিশ্চয়। সে কেবলি ঘুরে ঘুরে আসে। গোরা তার শার্ক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করে সময় কাটায়। ইতিমধ্যেই দুজনের ভাব বেশ জমে উঠেছে। সামুদ্রিক সব বিষয়কৰ্ম ফেলে ঘুলঘুলির কাছেই ঘোরা-ফেরা করছে শার্কটা। আর গোরার তরফেও আগ্রহের অভাব নেই, সুযোগ পেলেই সে সমুদ্রচর বন্ধুর আদর-আপ্যায়নের কসুর করে না। বেশির ভাগ সময়ই ওদের মুখোমুখি দেখা যায়–মাঝে শার্সির ব্যবধান মাত্র। কোন দুর্বোধ্য ভাষায় যে ওরা আলোচনা করে, তা ওরাই জানে কেবল।

মেজমামা একটার পর একটা বিস্কুটের বাক্স উজাড় করে চলেন। আর কারো হস্তক্ষেপ করার যো নেই ওদিকে। মেজমামার প্রসাদ পায় গোরা। আর কখনো-সখনো নিজের প্রসাদের দু-এক টুকরো আমাকে দ্যায়। আমি হাঁ করেই থাকি, উঠে কি হাত বাড়িয়ে খাবার কষ্ট স্বীকার করার ক্ষমতাও যেন নেই আমার। গোরার ভুলবশত ক্বচিৎ কখনো এক-আধখানা যা গোঁফের তলায় এসে পড়ে, তাতেই আমার জীবিকা-নিৰ্বাহ হয়ে যায়।

শুয়ে শুয়ে প্রেমেনের বইখানা পড়ি। দুবার পড়ে ফেলেছি এর মধ্যেই একবার শেষ থেকে গোড়ার দিকে, আরেকবার গোড়া থেকে শেষের দিকে। এবার মাঝখান থেকে দুদিকে পড়তে শুরু করেছি যুগপৎ।

কদিন এইভাবে কাটে, জানি না! খাওয়া আর শোওয়া ছাড়া তো কাজ নেই শুয়ে পড়া, শুয়ে শুয়ে পড়া। এমনি করে একদিন যখন বইটার দিগ্বিদিকে পড়ছি, এমন সময়ে অকস্মাৎ সমুদ্রতল যেন তোলপাড় হয়ে উঠল। আমাদের কেবিন কাঁপতে লাগল, একটা গমগমে আওয়াজ শুনতে পেলাম। সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে বসলাম আমরা কী ব্যাপার? প্রশ্নের পরমুহূর্তেই পোর্টহোলের ফাঁক দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বল আলো আমাদের কেবিনের মধ্যে ঢুকলো। এ কী! এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সবাই আমরা চমকে গেলাম।

আকাশ, আকাশ! মেজমামা চিৎকার করে আকাশ ফাটান।

তাইতো! আকাশই তো বটে! ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে দেখি–রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুনীল আকাশ! নীলাভ শূন্যের তলায় দিগন্ত বিস্তার সমুদ্রের কাঁচলে নীল জল! আবার যে এইসব নীলিমার সাক্ষাৎ পাবো, এমন আশঙ্কা করিনি।

ভেসে উঠেছি আমরা। ভাসছি আবার। কিন্তু ভেসে উঠলাম কি করে? মেজমামা হঠাৎ কঠোরভাবে চিন্তা করেন–অনেক ভেবে চিন্তে বলেন, হয়েছে, ঠিক হয়েছে। জাহাজের খোলটা গেছে খসে সঙ্গে যত লোহালক্কর ছিল, সব গেছে জলের তলায়। তার জন্যই ওই বিচ্ছিরি আওয়াজটা হলো তখন, বুঝেছিস গোরা!

গোরা ততক্ষণে কেবিনের দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! তারও আর্তনাদ শোনা যায় সঙ্গে সঙ্গেই–জাহাজ! মেজমামা, জাহাজ! এদিক দিয়েই যাচ্ছে দ্যখোসে–

এতদিনে ও একটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করে। হাফ-প্যান্টের পকেট থেকে লাল সিল্কের রুমালটা বার করে নাড়তে শুরু করে দ্যায়। আমিই ওটা ওকে একদা উপহার দিয়েছিলাম! ওর জন্মদিনে।

আমাদের নব জন্মদিনে সেটা এখন কাজে লাগে।

রেঙ্গুন থেকে চাল–বোঝাই হয়ে জাহাজটা কলকাতা ফিরছিল। জাহাজে উঠে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি অচেনা মানুষের মুখ দেখে আনন্দ হয়! ক্যালেন্ডারের তারিখ মিলিয়ে জানা যায়, পুরো পাঁচ পাঁচটা দিন আমরা জলে তলায় ছিলাম।

যাহোক পাতাল–বাস হলো মামা। মেজমামা ঘাড় নাড়লেন–পাঁচদিন না তো–পাঁচ বচ্ছর।

পাতালে তো অ্যাদ্দিন কাটলো, এখন হাসপাতালে কদিন কাটে কে জানে! আমি বলি, যা বিস্কুক পেটে গেছে এই কদিনে। শুকনো বিস্কুট চিবুতে হয়েছে দিনরাত!–

গোরা বলে, বারে বিস্কুট বুঝি খারাপ। ও তো খুউব ভাল জিনিস। বিস্কুট খেতে পেলে ভাত আবার খায় নাকি মানুষ!

গোরার মামা গুম হয়ে থাকেন। তাঁর ভোট যে বিস্কুট আর গোরার পক্ষেই সেটা বোঝা যায় বেশ

প্রবীর পতন

নেহাত অমূলক নয়। বরং বলতে গেলে বলতে হয় মূলোই এই কাহিনীর মূলে।

কথায় বলে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। সমূলে তাকে সংহার করাই উচিত।

আমার সংহার পর্বটা প্রায় তার কাছাকাছিই যায়। সমূলে তাকে আমি শেষ করেছি।

সেদিন রবিবার হলেও সবাই আমরা গেছি ইস্কুলে। আমার, মানে, আমাদের সেকেন্ড ক্লাসের ছেলেরাই কেবল; আমাদের কেলাসে গিয়ে জমেছি সক্কলে।

ইস্কুলের বার্ষিক উৎসবের দিনে একটা নাটক অভিনয়ের কথা হচ্ছিল। সেদিন সেই নাটকের মহড়া শুরু হবার কথা।

কী নাটক আমরা জানিনে। আমাদের বাংলার স্যার লিখেছিলেন পালাটা। আর, তার বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করবার পালা ছিল আমাদের। সেদিনকে সেই সব পার্ট বিলি হবার কথা।

ক্লাসের আমরা বসতে না বসতেই স্যার এসে দাঁড়ালেন। হাতে-খেড়ড়া বাঁধা মোটা একটা খাতা। সেইটেই তাঁর স্বরচিত নাটকের কপি বলে মনে হলো আমাদের।

জনা-কে কেউ জানো তোমরা? ক্লাসে বসেই তিনি শুধোলেন আমাদের। কারো মুখে কোন জবাব নেই। কোন জনার কথা উনি বলছেন কে জানে। কত জনাকেই তো জানি।

প্রবীরের মা জনা। তিনিই জানালেন।

আমরা সবাই একদৃষ্টে প্রবীরের দিকে তাকালাম।

প্রবীর ত তার মার নাম কোনদিন আমাদের জানায়নি স্যার। আমি বললাম–জানব কি করে?

কেউ কি তার মার নাম কখনো মুখে আনে? আপত্তি করে প্রবীর : আনতে আছে কি? মা গুরুজন না?

মহাগুরু। সায় দিলেন মাস্টারমশায়। কিন্তু আমাদের প্রবীরের মার কথা এখানে হচ্ছে না। পৌরাণিক প্রবীরের কাহিনী নিয়েই আমার নাটকটা। মহাভারতের প্রবীর–যেমন বীর তেমনি যোদ্ধা। তাকে নিয়েই আমাদের এই পালা। আর সেই প্রবীরের মার নামই হচ্ছে জনা।

তাই বলুন স্যার। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

আমার নাটিকাটির নাম হচ্ছে জনা, ওরফে প্রবীন পতন। বললেন বাংলার স্যার। মহাকবি গিরিশচন্দ্র বিখ্যাত বই জনা-কে কেটে হেঁটে তোমাদের উপযোগী করে বানিয়েছি আমি।

তারপর তাঁর কথার সারাংশ প্রকাশিত হলো–প্রবীরই হলো এই বইয়ের হীরো। নাটকের যেন পার্ট। এখন তোমাদের মধ্যে কে এই পার্ট নিতে চাও জানাও আমায়।

ক্লাসশুদ্ধ সব ছেলেই আমি আমি করে উঠল। আমি স্যার…আমি স্যার.. আমি স্যার। এবং আমিও।

হীরো হতে চায় না কে? আমার আমিত্বও কারো চাইতে কিছু কম নয়। হারবার পাত্র নয় কারও কাছে।

কিন্তু প্রবীর বলল–না স্যার, আমাকেই এই পার্ট দেওয়া উচিত আপনার। আমি এর জন্য আগের থেকেই বিধিনির্দিষ্ট।

বিধিনির্দিষ্ট? বাংলার স্যার বিস্মিত।

নইলে স্যার আমার নাম প্রবীর হতে গেল কেন? এই স্কুলে আমি পড়তে এলাম কেন? এখানে ভর্তি হতে গেলাম কেন? এই কেলাসে প্রোমোশনই বা পেলাম কেন?

এত কেন-র জবাবে আমার ছোট্ট একটি প্রতিবাদ–তোর নাম প্রবীর হতে পারে, কিন্তু তোর মার নাম তো আর জনা নয়। বইটার নাম শুনেছিস? জনা ওরফে প্রবীর পতন।

মার নাম জনা না হতে পারে কিন্তু জনাই আমাদের দেশ। জানায় প্রবীর।

জনাই? যেখানকার মনোহরা বিখ্যাত? মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করেন–মনোহরা নামক মেঠাই প্রসিদ্ধ যেখানকার?

হ্যাঁ স্যার, সেখানেই আমার জন্ম। সেই জনাই আমার মাতৃভূমি। আর মা আর মাতৃ মা তো এক; তাই নয় কি স্যার?

তা বটে। ঘাড় নাড়েন বাংলার স্যার–সে কথা ঠিক। জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।

তাহলে পার্টটা আমার পাওয়া উচিত কিনা আপনি বলুন স্যার?

কিন্তু শুনেছ তো, বইটার নাম প্রবীর পতন। প্রবীর খুব বীর হলেও যুদ্ধ করতে করতে পড়বে শেষটায়। শেষ পর্যন্ত মারা পড়তে রাজি আছ তো তুমি?

কেন মরব না স্যার? সত্যি সত্যি তো আর মরতে হবে না। তবে যতক্ষণ আমি পারব বীরের মত লড়াই করে যাবো। সহজে মরব না স্যার–তা কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি।

তোমাকে পাঁচ মিনিট লড়াই করতে হবে, তার বেশি নয়। তারপর যেই আমি উইং এর পাশে থেকে ইশারা করব–এইবার, তক্ষুনি তোমাকে ধপাস করে পড়তে হবে কিন্তু গায়ে একটু লাগতে পারে; কিন্তু তা গ্রাহ্য করলে চলবে না। এর নাম হচ্ছে পতন ও মৃত্যু। ভেবে দয়াখো কথাটা…রাজি আছ?

এক কথায় সে রাজি। তার নামের টু-থার্ড বীর তো-সেই কথাটাই, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সে বললে যে বীরের মৃত্যু তার শিরোধার্য। (আহা, নামমাত্র মরে নাম করতে কে চায় না যেন।)

প্রবীরের পার্টটা সে-ই পেল। আর সব পার্টও বিলি হলো। সবাই পেল এক একটা পার্ট আমিও পেলাম একটা।

আমারটা কাটা সৈনিকের পার্ট। তাতে কোন বক্তৃতা নেই, লম্ফ ঝম্ফ কিছু না। স্টেজের এক কোণে চুপটি করে মড়ার মতন শুয়ে থাকা কেবল। নাকে মাছি বসলেও নড়া চলবে না, মশা কামড়ালেও নয়। প্রবীর যখন বীরদর্পে তার তরোয়াল ঘুরিয়ে স্টেজময় দাপাদাপি করে লড়াই কররে, আমি তখন লাশের মতোই পড়ে থাকব এক পাশে। একটি কথাও কইতে পারবো না। ও যদি আমার পায়ের কাছেও এসে লাফায়, আমায় ডিঙিয়ে যায়, বারংবার আমার এধার থেকে ওধারে টপকাতে থাকে, এমন কি আমার ওপরে দাঁড়িয়েই লড়াই জমায় তবু আমি মোটেই ওকে ল্যাং মারতে পারব না। আমার মুখে যেমন কথাটি নেই, পায়ের বেলাও ও-কথা নয়।

সেরকম কথা থাকলে স্টেজের ওপরে শুয়েই এইসা একটা ল্যাং মারতাম ওকে যে বাছাধনের আর পাঁচ মিনিট ধরে লড়াই চালাতে হত না, সেই একটি ল্যাংয়েই পতন। আর পতনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

কিন্তু মাস্টারমশাই বললেন, প্রবীর যাই করুক না, আমার পক্ষে কোন ল্যাং বা ল্যাংগুয়েজ নাস্তি।

বইয়ের সব পাটেরই ব্যবস্থা হলো, কিন্তু জনা সাজতে রাজি হলো না ছেলেদের কেউই। পার্টটা ডিফিকালট বলে নয়, মেয়ের পার্ট বলেই। বরং নেপথ্যে কোলাহল হতে রাজি হলো কিন্তু জনা হতে একজনাও না।

তখন মাস্টারমশাই নিজেই জনার পার্ট নিলেন।

জোর মহলা চলল তারপর কদিন ধরে। তেঁড়ে কুঁড়ে হাত পা নেড়ে যা শুরু করল প্রবীরটা…

দাও মাগো সন্তানে বিদায়।
চলে যাই লোকালয় ত্যজি।
ক্ষত্রিয়-সন্তান,
অপমান–কত সবো আর?…

তাকিয়ে দেখবার মতোই ব্যাপার। তার অঙ্গভঙ্গী রকমসকম হাবভাব দেখে, এমন কি, প্রবীর-প্রসবিনী জননী জনা (ওরফে আমাদের বাংলার মাস্টারেরও) তাক লেগে যায়।

আর এমন রাগ ধরে আমার। হাত পা খেলানো অ্যায়সা চমৎকার পার্টটা আমার হলে কী মজারই না হত। অবিশ্যি, শেষ পর্যন্ত, ‘পতন ও মৃত্যু’ অবধারিত হলেও আমার কোন আপত্তি ছিল না। তার বদলে আমাকে হতে হলো কিনা কাটা সৈনিক । চিরকাল ধরে দেখে আসছি আমার কপালটাই এমনি ফাটা।

তাহলেও, নিজের পার্টটা তৈরি করতে কোন কসুর ছিল না আমার। সুবিধের এইটুকু যে, এর রিহার্সাল স্টেজে না দিলেও চলে, নিজের ঘরে বিছানায় শুয়ে শুয়েই আরামে রপ্ত করা যায় বেশ খানিকক্ষণ নিঃস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকা–এই বইতো নয়।

বিছানায় শুয়ে শুয়েই মতলব খেলতে থাকে আমার মাথায়। দাঁড়াও বৎস, তোমার ঐ হাত পা নেড়ে বক্তৃতা দেওয়া বার করছি আমি-এর ল্যাং মারতে না পারি, কিন্তু তোমার ঐ ল্যাংগুয়েজই মারব তোমায়। ল্যাং-ল্যাংগুয়েজ নাই মারলাম, ল্যাংগুয়েজের ল্যাং মেরেই কেড়ে ফেলব তোমাকে–দাঁড়াও না।

উৎসবের দিন সকার বেলায় এক কোচর মুড়ি আর আস্ত একটা মূলো নিয়ে প্রবীরের পাড়া দিয়ে যাচ্ছি–দেখি যে তখনো সে তার পার্ট নিয়ে দারুণ সোরগোল তুলেছে। সারা বাড়ি ফাটিয়ে পার্ট দিয়ে তার বাড়াবাড়ি।

সামনে দিয়ে আমায় যেতে দেখে সে বলল–কি খাচ্ছিস রে?

মুড়ি আর মূলো।

দিবি আমায় দুটি?

তা খা না, কত খাবি। বজার থেকে আজ এক ঝুড়ি মূলো নিয়ে এসেছে আমাদের বাড়ি। তুই খা ততক্ষণ, আমি পোস্টাফিস থেকে বাবার জন্যে ডাকটিকিট কিনে আনি।

বলে মূলো আর মুড়ি তার জিম্মায় রেখে আমি চলে গেলাম। বেশ খানিকক্ষণ বাদ ফিরে এসে দেখি, মুড়ির স্বাদ আর আমায় পেতে হবে না–মুড়ির সঙ্গে আস্ত মূলোটিও খতম। আমূল সে শেষ করেছে সবটা।

যাকগে-খাকগে। কথায় বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। সেই বসুন্ধরার সামান্য একটা মূলোর গোটাটাই সে হজম করবে সে আর বেশি কি। আজকের দিনটির বীর তো ঐ প্রবীরই।

উৎসবের ক্ষণটি এলো অবশেষে। ঠিক দুপুরবেলায় স্কুলের প্রাঙ্গণে খাটানো সামিয়ানার তলায় প্রথম সারিতে বসে হেড স্যার, জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, আর পুলিস সাহেব এবং আমাদের ছোট্ট শহরের আরো সব বড় বড় লোক।

দৃশ্যপট উঠল স্টেজের।

আলুলায়িতকুন্তলা জনা। (ছদ্মবেশে আমাদের বাংলার স্যার) স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, আর প্রবীর তার সামনে খাড়া। কাটা সৈনিকের ন্যায় আমি রণক্ষেত্রের এক পাশে ধরাশায়ী।

হাত পা নাড়া দিয়ে শুরু হলো প্রবীরের

দা-দাও মা-মা গো স-স-স-সন্তানে বিদায়-হিক-হিক-হিক-….দা-দাও মা-মা গগা…হিক…হিক…

হেঁচকিরা এসে ওর বক্তৃতার তোড়ে বাধা দিতে লাগল।

দাদা আর মামা পাচ্ছ কোথায়? ফিস ফিস করলেন জনা।-তোমার তো তোতলামি ছিল না, এ ব্যরাম আবার কবে থেকে?

প্রবীর। চ-চ-চ-চ-চ-চ-চ-চ-….

জনা (জনান্তিকে) এই সেরেছে।

প্রবীর। চলে যাই হিক হিক…লো-লোলো-লো লোকালয় ত্যজি-হি-হিক

কী হচ্ছে কি। জনা এগিয়ে গেলেন প্রবীরের কাছে–ওমা, দারুণ মূলোর গন্ধ বেরুচ্ছে যে মুখ দিয়ে। মুলো খেয়েছিল না কি আজ? প্রবীবের কানে প্রশ্ন তার।

আ-আমি মূ-মূ-মূ-মূলো হিক হিক হিক খা-খাইনি স্যার। ও-ও-ও আমায় খা-খাইয়ে দিয়েছে বলে সে ধরাশায়ী আমায় একটা তরোয়ালের খোঁচা লাগায়।

খাইয়ে দিয়েছে। জনা-মশাই তো অবাক।

হ্যাঁ স্যার। ও বলললে যে খা। তখন কি জা জানি মূ-মূ-মূ-মূ-মূলো খেলে এমন হেঁ হেঁ হেঁ হেঁচকি ওঠে। হিক হিক।

জনার মুখে কথাটি নেই। আড়চোখে দেখি দেখি তিনি রোষ-কষায়িত নেত্রে তাকিয়ে রয়েছেন আমাদের দুজনার দিকেই।

আবার শুরু করে প্রবীব ও লোকালয় ত্যজি।

ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-ক্ষ-হিক হিক।

প্রবীরের ক্ষয় আর শেষ হয় না। কিন্তু ওকে ক্ষয়িষ্ণু হতে দেখে মাস্টারমশাই আর সহিষ্ণু থাকতে পারলেন না। খুব হয়েছে। বেশ চড়া গলাতেই বলে ফেললেন এবার।

কিন্তু প্রবীরের হেঁচকি উঠতেই লাগল। জনার ধিক্কারে তার হিক্কার বাধা পেল না একটুও।

জা-জানি সার। ও আমার শত্রুর। চি-চি-চিরদিন জানি। কি-কিন্তু এত বড় শত্রুর তা-তা আমি জা-জা জানতুম না।

বলে সে আমাকে আবার এক তরোয়ালের খোঁচা লাগাল।

পড়ে পড়ে মার খেতে হয় আমায়। কিন্তু মড়ার উপর খাড়ার ঘা কত আর সওয়া যায় বল?

আমি লাফিয়ে উঠি। উঠে দৌড় মারি স্টেজ থেকে। আর প্রবীর এদিকে প্রাণ ভরে হেঁচকাতে থাকে।

হেঁচকি সমেত প্রবীরকে এক হ্যাঁচকায় টেনে নিয়ে জনাও স্টেজে তেকে অদৃশ্য হন।

যবনিকা পড়ে যায়–অট্টহাস্যে সামিয়ানা ফেটে পড়ে। আমি ততক্ষণে তার ত্রিসীমানা থেকে কেটে পড়েছি।

সংস্কৃতের স্যার তার ব্যাকরণের সূত্রে নিপাতনে সিদ্ধ কতবার করে বুঝিয়েছিলেন ক্লাসে, কিন্তু আমাদের মাথায় ঢোকেনি। আজ প্রবীবের নিপাতনে আমার সিদ্ধিলাভ হওয়ায় তার মানে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম আমি। তারোয়ালের খোঁচাগুলোই টের পাইয়েছিল আমায়।

আর এর মূলে ছিল সেই মূলো–মূলতঃ আমি হলেও, মূলোকেই আসলে আসামী করা উচিত।

বক্কেশ্বরের লক্ষ্যভেদ

আমাদের বকু শরীরের ঈশ্বরলাভের পর ভারী কে সমস্যায় পড়ে গেল। আর কিছু না– নিজের নামকরণের সমস্যার।

এ জন্মে ঈশ্বরলাভ হলে এইখানেই ফ্যাসাদ! অকস্মাৎ নাম থেকে নামান্তরে যাবার হাঙ্গামা। এজন্মে না পেলে এসব মুশকিল নেই, নাম বদলাতে হয় না, যথাসময়ে কলেবর বদলে ফেললেই চলে যায়। কিন্তু দেহরক্ষা না করে ঈশ্বরলাভ ভারী গোলমেলে ব্যাপার।

বকুল বরাতে এই গোলোযোগ ছিল–সশরীরে স্বর্গীয় হবার সঙ্কট। মরে যাবার পর যারা স্বর্গীয় হয়, বা স্বভাবতঃই ঈশ্বর পায়–তারা বিনা সাধ্যসাধনাতেই পেয়ে যায়; এইজন্য তাদের নামের আগে একটা চন্দ্রবিন্দু যোগ করে দিলেই চলে। যেমন চিত্তরঞ্জন–আশু মুখুজ্যে ইত্যাদি। স্বৰ্গত র নামের আগে অনুস্বর ও বিসর্গের পরবর্তী চিহ্নটি দিয়ে লেখা দস্তুর ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তিমে, বিসর্গের শেষে স্বর্গের চূড়ান্ত ব্যঞ্জনার যেটি সংক্ষেপ। সংক্ষিপ্ত স্বর্গীয় সংস্করণ। তবে উচ্চারণের সময়ে তোমরা যা খুশি পড়তে পারো ও স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন কিংবা চন্দ্রবিন্দু চিত্তরঞ্জন বা ঈশ্বর চিত্তরঞ্জন। চিত্তরঞ্জন আপত্তি করতে আসবেন না।

বকুর বেলা আমাদের সে সুবিধে নেই। চন্দ্রবিন্দুযযাগে বকুর নিজেরও আপত্তি হতে পারে, তার মা বাবার তো বটেই এবং পাড়াপড়শীরাই কি ছেড়ে কথা কইবে? শ্রদ্ধের নেমন্তন্ন না ডেকে হঠাৎ নাম-ডাকে ঈশ্বর হয়ে যাওয়া–ফাঁকতালে একটা বাহাদুরি বরদাস্ত করতে তারা রাজী হবে না। সবাই কি হাসি মুখে যুগপৎ, পরের লাভ ও নিজের ক্ষতি স্বীকার করতে পারে? উঁহ।

ঈশ্বর সে তো মুঠোর মধ্যে?–এরকম সন্দেহ যার মনে ঘৃণাক্ষরেও জেগেছে সে-ই পিতৃদত্ত নাম পালটে নতুন নামে উত্তীর্ণ হয়। ব্যাঙাচি বড় হলেই তার ল্যাজ খসে যায়, ওরফে, ব্যাঙাচির ল্যাজ খসে সে বড় হয়। এতএব পৈতৃক নাম খসে গেলেই বুঝতে হবে যে লোকটা কিছু যদি হাতাতে পেরে থাকে তো সেই কিছু আর কিছু না, খোদ ঈশ্বর।

এখন, আমাদের বকুও ঈশ্বরকে বাগিয়ে ফেলেছে। তারপরেই এই নতুন নামকরণের নিদারুণ সমস্যা।

আনন্দ যোগ করে একটা উপায় অবশ্যি ছিল; কিন্তু কেউ কি তার কিছু বাকি রেখেছে আর? বিবেকানন্দ থেকে আরম্ভ করে আড়ম্বরান্দ, বিড়ম্বনানন্দ পর্যন্ত যা কিছু ভালমন্দ এবং ভালমন্দের অতীত আনন্দদায়ক নাম ছিল, সবাই বকুর বেদখলে। এই কারণে বকু ভারী নিরানন্দ কদিন থেকে। দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর হাতানো যত সোজা, ঐশ্বরিক নাম হাতড়ানো ততটা সহজ নয়।

অনেক নামাবলী টানা-ছেঁড়ার পর একট আইডিয়া ধাক্কা মারে আমার মাথায়; আচ্ছা ব্যাকরণ মতে একটা নাম রাখলে হয় না?

ব্যাকরণের নাম–কি রকম নাম–কি রকম শুনি আবার? বকু একটু আশ্চর্যই হয়। কিন্তু নিমজ্জমান লোকের কুটোটিকেও বাদ দিলে চলে না এবং কুটোটি এগিয়ে পরের উপকার করতে, ঈশ্বর যে পায় নি, সেও কদাচই পরানুখ হয়।

সোৎসাহে আমি অগ্রসহ হইঃ এই যেমন এই ধর না কেন, বকু ছিল ঈশ্বর–

সে বাধা দেয়ঃ বারে! আমি আবার ঈশ্বর ছিলাম কবে?

ছিলে কি ছিলে না তুমিই জানো! আমার জানা থাকার কথা নয়। ব্যাকরণের ব্যবস্থাটাই বলছি আমি কেবল। বেশ, তাহলে এই ভাবেই ধরো–বকু হলো ঈশ্বর–তো হয়? হতে পারে তো?

বাঃ! আমি হবো কেন? সে আপত্তি করে, আমি তো কেবল ঈশ্বরকে পেলাম!

বেশ, তাই সই। তবে এই রকম হবে–বকু পেল ঈশ্বর ইতি বক্কেশ্বর। কেমন, হলো এবার?

ততটা মনঃপুত হয় না বকুর। কিন্তু অনেক টানা–হ্যাঁচড়ার পর কষ্টেসৃষ্টে এই একটা বেরিয়েছে, এটাও খোয়ালে, অগত্যা বিনামা হয়েই থাকতে হবে যে বকুকে, কিংবা নেহাত কোনো বদনামই না বইতে হয় শেষটায় একথা স্পষ্টাস্পষ্টিই আমি ওকে জানিয়ে দিই।

ব্যাকরণের সূত্রটা কি শোনা যাক তো?

যাবে বলে একেবারে দীর্ঘসূত্র। আমি ব্যাখ্যার দ্বারা বোঝাই। সন্ধিও বলতে পারো। সমানও বলা যায়। সমাস হলে হবে দ্বন্দ্ব সমাস–বকুশ্চ ঈশ্বররশ্চ–

আর বলতে হয় না। নামের মহিমায় বকু বিহ্বল হয়ে পড়ে। বিলি বকু প্রগলভ হয়ে ওঠে, বাঃ বেশ নাম! নামের মতো নাম। বক্কেশ্বর! বকু ছিল–নাঃ, ছিল কি? ছিল কেন? এ তো অতীতের কথা নয়–বকু হলো—হ্যাঁ–হওয়া আর পাওয়া একই। হলেই পায়, পেলেই হয়–বকু হলো ঈশ্বর। আবার ব্যাকরণসিদ্ধও বটে? কটা সিদ্ধপুরুষের আছে এমন নাম। বকুশ্চ ঈশ্বরশ্চ–যেন দিল্লীশ্বরো বা জদীশ্বরো বা! খাসা!

সেই থেকে দ্বন্দ্ব সমাসে ঈশ্বরের সঙ্গে ওর সন্ধি স্থাপিত হয়েছে এবং মার্বেলের ট্যাবলেট পড়েছে বাড়ির সদরে : স্বামী বক্কেশ্বর পরমহংস।

ঈশ্বরের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে জড়িত হবার ঢের আগে থেকেই বুকু বেচারা আমাদের ঈশ্বরে জর্জরিত। ছোট বেলা থেকেই ওর ঈশ্বর–উপার্জনের দুরভিসন্ধি। সদ্য প্রকাশিত ওর নিজের কথামৃতে রয়েছে: বরাবরই আমার ঝোঁক ছিল, এই পরম বর্বরের দিকে বাড়িই বলল আর জুড়িগাড়িই বলো কিংবা জারিজুরিই বলো এ সবই পেতে হবে বর্বর হয়ে। বর্বরতা ব্যতিরেকে এসব লভ্য হবার নয়। নায়মাত্মা বলহীনের লভ্য। বল আর বর্বরতা এক; দয়াখো ভূতপূর্ব্ব ইংরেজ আর বর্তমান জাপানকে, দয়াখো অভূতপূর্ব্ব হিটলার, মুসোলিনী আর চেঙ্গীজ খাকে। এইসব বর্বর শক্তির মূলে আছেন সেই বর্বর শক্তিমান মহাবীর। হিটলাটের হিট-এর যোগান এই কেন্দ্র থেকেই। মুসোলিনীর মুষল ইনিই। প্রচুর অর্থ বা প্রচুর অর্থ যাই যাই করতে চাও না কেন, খোদ ভগবানের কাছ থেকেই তার ফন্দি ফিকির জেনে নিতে হবে। এই রহস্য হচ্ছে উত্তম রহস্য–উপনিষদের রহস্যমুত্তমম। তার কাছ থেকেই জানতে হবে সুকৌশলে। কায়দা করে। সহজে জানান দেবার পাত্র তিনি নন–যোগবলেই তাঁকে টের পাবে। যোগঃকর্মসুকৌশলম। এবং তার ফলেই হবে বলযোগ। অচিরাৎ এবং নির্ঘাৎ।

এই কথামৃত পড়ার পর থেকেই আমার ধারণা বলবৎ হয়েছে, যে বৈধ বা অবৈধ যে কোনো উপায়ে হোক, ঈশ্বরকে আত্মসাৎ না করে ও ছাড়বে না। আর তার পরেই ওর কেল্লা ফতে–বাড়িই কি আর দাড়িই কি, জুড়িই কি, আর ভুঁড়িই কি–সবই ওর হাতের আওতায়। তখন ওকে কে পায়!

হ্যাঁ, যা বলছিলুম…ছোটবেলার থেকেই ওর এই ভাগবৎ দৌর্বল্যের কথা। সেই কালেই একদিন ওর বাড়িতে গিয়ে যে-দুর্ঘটনা দেখেছিলাম তাতেই আমার আন্দাজ হয়েছিল যে ঈশ্বর না পেয়ে ওর নিস্তার নেই। বকু তখন স্কুলের ছাত্র, সেকেন্ড ক্লাসে এবং হাফপ্যান্টে। যদি পড়ার কথা ধরো, বইয়ের চেয়ে প্যান্টেই ছিল ওর বেশি মনোযোগ–প্যান্টই ছিল ওর একমাত্র পাঠ্য। এবং অদ্বিতীয়। প্রায় সময়েই পড়া না, প্যান্ট পরা নিয়েই ওকে বিব্রত দেখেছি।

এমনি একদিন গেছি ওদের বাড়ি, ক্লাস পরীক্ষার ফলাফলের বৃত্তান্ত নিয়ে, গিয়ে দেখি বকু এবং বকুর বাবা মুখোমুখি বসে–আর বুক দিচ্ছে বাবাকে ধর্মোপদেশ। কথাগুলো ঠিক ধরতে পারলাম না, তবে এটুকু বুঝলাম যে বড় বড় বাণী গড় গড় করে বকে যাচ্ছে বকু–বোধহয় মুখস্থ কোনো বই থেকে–আর হাঁ করে শুনছেন ওর বাবা।

আমাকে দেখে বকু সহসা থেকে যায়–কিরে কি খবর?

পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে–আমি ইতস্তত করি, বল–বলবো কি?

বল না কি হয়েছে?

ফেল গেছিস তুই! বাংলা, ইংরেজী, অঙ্ক পালি–সব সাবজেকটেই। বলে ফেলি আমি।

সামলাতে একটু সময় লাগে বকুর, ওর বাবার হাঁটা, কেবল আরো একটু বড়ো হয়। বকু বলে যাক, সংস্কৃতি যে পাস করেছি এই ঢের। ওতেও তো ফেল যেতে পারতুম। তবু ভাল।

সংস্কৃত তোর ছিল না, তুই পালি নিয়েছিলিস তো!

আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে বকু যেন কেমন হয়ে গেল হঠাৎ!—ও–তাই নাকি! এই বাঙনিষ্পত্তি করেই তার চোখ ঠেলে কপালে উঠল, নাক গেল বেঁকে, মুখ গেল সাদা ফ্যাকাসে মেরে।

আমি ঘাবড়ে গিয়ে ওকে ধরতে গেলাম। ওর বাবা আমাকে ইঙ্গিতে নিরস্ত করলেন–তারপর আস্তে আস্তে ওর চোখ বুজে এল, ঘাড় হোল সোজা, সারা দেহ কাঠ হয়ে অনেকটা ধ্যানী বুদ্ধের মতো হয়ে গেল বুক।

আমি যেন সার্কাস দেখছি তখন, কিন্তু ঠিক উপভোগ করতে পারছি না, এমন সময়ে ওর বাবা বললেন-ভয় পেয়ো না, ভয়ের কিছু নেই। ওর সমাধি হয়েছে!

সমাধি? সমাধি কি? মরে গেলেই তো সমাধি হয়! আমি এবার সত্যিই ভয় পাই, যাকে বলে কবর দেওয়া! তাহলে বকু কি আর বাঁচবে না? আমার কণ্ঠস্বর কাঁদো কাঁদো।

না-না মরবে কেন। বেঁচেই আছে, জলজ্যান্ত বেঁচে আছে।

ও, বুঝেছি! আমি মাথা নাড়ি–জীবন্ত সমাধি! এরকম হয় বটে। অনেক সময়ে সমুদ্রে জাহাজ ডুবে গেলে এরকমটা হয়ে যায় নাকি!

বকুর বাবা ঘাড় নাড়েন–উঁহু, সে সমাধিও নয়। তাতে তো লোক মারা যায়, প্রায় সব লোকই মারা যায় জলে ডুবই মারা যায়। কিন্তু এ সমাধিতে মরবার কিছু নেই, খাবি খায় না পর্যন্ত।

তারপর একটু থেকে তিনি অনুযোগ করেন, এরকম ওর মাঝে মাঝে হয়। প্রায়ই হয়।

তবে বুঝি কোন শক্ত ব্যায়রাম? সভয়ে জিজ্ঞাসা করি।

ব্যায়রাম! হ্যাঁ, ব্যায়রামই বটে! অমায়িক মৃদু মধুর হাস্য ওর বাবার। কেবল ঈশ্বরজনিত মহাপুরুষদেরই হয় এই ব্যায়রাম।

আমি এর ওষুধ জানি। বলি ওর বাবাকে। আমার পিসতুতো ভায়ের এই রকম হতো। ঠিক হুবহু। তারপর পাঁচু ঠাকুরের মাদুলি পরে ভাল হয়ে গেল। আপনি যদি ওকে মাদুলি আনিয়ে দ্যান, ও সেরে যাবে।

পাগল। এ পেঁচোয় পাওয়া নয় যে সারবে। এ হচ্ছে ভগবানে পাওয়া– এ সারে না। তাঁর কণ্ঠস্বর আশাপ্রদ কি হতাশাব্যঞ্জক ঠিক ধরতে পারি না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, আর একবার ভগবানের হাতে পড়লে, মানে ভগবানের হাতে কারু কি পরিত্রাণ আছে? তাঁর কাছ থেকে কি পালিয়ে বাঁচতে পারে কেউ?

এই অভিযোগের আমি আর কি জবাব দেব? তবু তাঁকে আশ্বাস দিতে চেষ্টা করি, যদি বলেন, এখনকার মতো আমি বকুকে ভাল করে দিতে পারি?

তিনি শুধু সবিস্ময়ে আমার দিকে, কিছু বলেন না।

আপনাদের বাড়িতে নস্যি নেয় কেউ? এক টিপ ওর নাকে দিলেই এক্ষুণি–

খোকা, তুমি নেহাৎ ছেলেমানুষ! সমাধির ব্যাপার বোঝ তোমার সাধ্য নয়। এ যে পরমহংসদেবের মতো! সমাধি সারানো নস্যির কর্ম না–তা পরিমলই দাও কি কড়া মুকুথলই দাও।

নস্যির কর্ম নয়–তাহলে-তাহলে-তাহলে তো ভারী মুশকিল! বেচারার দৈহিক বিপর্যয় দেখে দুঃখ হয় আমার। অজ্ঞান মানুষকে জ্ঞান দেবার ইচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক। এই ইচ্ছার বশে যারা ডুবন্ত অবস্থায় জল খেয়ে বা আত্মহত্যার আকাঙ্ক্ষায় আত্মহারা হয়ে আফিং গিলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাদের অভিরুচির তোয়াক্কা বা অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই তাদের ঠ্যাং ধরে প্রবল প্রতাপে আমরা ঘুরিয়ে তাকি, দুমদাম দুদ্দাড় পিঠে কিলাচড় সাঁটিয়ে যাই তাদের দেহে লাগবে কি মনে ব্যথা পাবি মিছুমাত্রও একথা ভাবিনে, তাদের আবার ধাতস্থ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাতেই আমাদের আনন্দ।

তাহলে তো সত্যিই ভারী মুশকিল! একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলি কথাটা, অবশ্যি আরো একটা উপায় আছে সমাধি সারাবার। যদি বলেন–যদি বলেন আপনি–তবে র‍্যাক চড়ে–

মনে হলো বকু চমকে উঠলো। চড়ের উঠলো। চড়ের কথায় নড়েচড়ে বসলো যেন। কিন্তু সেদিকে দেখব কি, আমার চড়ের গুণই বা কি দেখাব, তার আগেই ওর বাবার চাড় দেখা গেল। ওর বাবা করছেন কি, আমার কথা শুনেই না হাতের কাছে ছিল এক ভাঙা ছাতা, তাই নিয়ে এমন এক তাড়া করলেন আমায়, যে তিন লাফে সিঁড়ি ডিঙিয়ে সটান ছাতে উঠে পাশের বাড়িতে টপকে পড়ি বেচারা বকুকে সমাধির গর্ভে অসহায় ফেলে রেখে পালিয়ে আসি প্রাণ নিয়ে। বকুর আগে আমাকে নিজেকে বাঁচতে হয়।

পরের দিন ইস্কুলে এসে বকুর কি না বকুনি আমায়।

আমার সমাধি তুই কি বুঝিস রে হতভাগা? বোকা গাধা কোথাকার। জানিস শ্রীরামকৃষ্ণের, শ্রীচৈতন্যের সমাধি হতো? শ্রীবকুরও তাই হয়। তুই তার জানবি কি মুখ? চড় দিয়ে উনি সমাধি সারাচ্ছেন! আহাম্মোক! সমাধি হলে কানের কাছে রাম নাম কৃষ্ণ নাম করতে হয় তাহলেই হয় তাহলেই জ্ঞান ফিরে আসে। সবাই জানে একথা, আর উনি কিনা–

বকুর আফশোস আর ফোঁস ফোঁস সমান তালে চলে। বাধা দিয়ে বলতে যাই–রাম নামের মহিমা আমারও জানা আছে। আমাকে আর তোর শেখাতে হবে না। কিন্তু মারের চোটেও ভূত পালায় নাকি? তোকে পোঁচা ভূতে পেয়েছিলো তাই আর–

সেই মুহর্তে মাষ্টারমসাই আসেন ক্লাসে–বিতণ্ডা চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পর মুহূর্তেই, বকুর কি বরাত জানি না, সেই পুরাতন দুর্লক্ষণের পুনরাবৃত্তি। মাষ্টারমশাই পড়া নিয়ে কী প্রশ্ন করেছেন, বুকু পারেনি; অমনি হুকুম হয়ে গেছে বেঞ্চির উপর নীল ডাউনের। আর নীল ডাউন হবার সঙ্গে সঙ্গেই বকুর সমাধি।

ব্যাপার দেখে ভড়কে গিয়ে মাষ্টারমশাই তো জল আনতে ছুটে বেরিয়েছেন। ক্লাসসুদ্ধ সবাই গেছে হকচকিয়ে; কী করতে হবে ভেবে পাচ্ছে না কেউ। ভারী বিভ্রাট!

আমি ওর কানে কাছাকাছি গিয়ে রাম না, মার–কোনটা যে লাগাবো ঠিক করতে না পেরে বলেই ফেলি হঠাৎ–চাঁটাও কসে য়্যাক চড়!

যেই না এই বলা, অমনি বকু সমাধি আর নীল ডাউন ফেলে রেখে এক সেকেন্ডে স্ট্যান্ড আপ অন দি বেঞ্চি।

তারপর–তার পরদিনই বকু ইস্কুলে ইস্তফা দিল।

এসব তো বেশ কিছুদিন আগের কথা। ইতিমধ্যে বকু বয়সে বেড়ে এবং বুদ্ধিতে পেকে যে ঈশ্বরকে নিয়ে বাল্যকালে তার নিতান্তই খুচরো কারবার ছিল তাকেই এখন বেশ বড় রকমের আদমানী রপ্তানীর ব্যাপারে ফলাও রকমে ফাঁদতে চায়। আর সেই জন্যেই ওকে জাঁকালো রকমের নাম নিতে হচ্ছে, শ্রীমৎ বক্কেশ্বর পরমহংস। যে কোনো ব্যবসাতেই নামটাই হচ্ছে আসল। সেইটাই–গুড-উইল কিনা।

বকু থেকে বক্কেশ্বর হবার পর, অনেকদিন আর যাওয়া হয়নি ওর কাছে। ভাবলাম যাই একবার। ঈশ্বরই লাভ করেছে বেচারা, কিন্তু ঈশ্বরকে ভাঙিয়ে আরো কতদূর কী লাভ কোনো সুরাহা করতে পারলো কিনা দেখে আসা যাক। পুরো টাকাটা পেয়ে কোনোই সুখ নেই–যদি না মোলো আনায়ও চৌষট্টি পয়সায়–এবং কত আধলায় কে জানে–তার বহুল ও বহুবিস্তৃত হবার সম্ভাবনা থাকে। যে টাকাকে আনায় আনা যায় না, তা নিতান্তই অচল টাকা। তাকে পাওয়াও যায় না, না পাওয়াও তাই–একেবারেই বদলাভ বলতে গেলে।

বকুই আমাকে বলেছিল একথা। যে ঈশ্বর ব্যাঙ্কে বাড়েন না, তিনি নিতান্তই বক্কেশ্বর। বক্কেশ্বর। বকেশ্বরের তাকে আদৌ কোন দরকার নেই। অকেজো জিনিসের ঝামেলা কে সইবে বাপু??

গিয়ে দেখি বেশ ভীড় ওর বৈঠকে। ঘর জুড়ে শতরঞ্জি পাতা, ভক্ত শিষ্য পরিবেষ্টিত বকু মাঝখানে সমাসীন। নির্লিপ্ত, নির্বিকার প্রশান্ত ওর মুখচ্ছবি– কেমন যেন ভিজেবেড়াল ভাব।

আমিও গিয়ে বসি একপাশে, ও দেখতে পায় না, কিংবা দেখেও দেখে না, কে জানে!

ভক্তদের একজন প্রশ্ন করেছে, প্রভু, ব্ৰহ্ম কি? ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধই বা কি?

প্রথমে বকুর মৃদু হাস্য-তারপরে বকুর সুমধুর কণ্ঠ। ব্ৰহ্ম! ব্রাহ্মকে দেখা স্বয়ং ব্রহ্মারও অসাধ্য। আর ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের সম্বন্ধ বলছ? সে হচ্ছে ডিমের সম্বন্ধ! এই জন্যেই জগৎকে ব্রহ্মাণ্ড বলে থাকে। আমাদের জন্যে ব্রহ্মের কোনোই হাপিত্যেশ নেই; আমরা বাঁচি কি মরি, খাই কি না খাই, খাবি খাই কি খাবার খাই তা নিয়ে ব্রহ্মের মোটেই মাথা ব্যাথা করে না। মাথাই নেই তো–মাথা ব্যাথা! ব্রহ্মণ সে এক চীজ। এই প্রত্যয় যার হয়েছে তাকেই বলা যায় ব্রহ্মালু। ব্রহ্মের আলু প্রত্যয় আর কি? খুব কমলোকেরই এই প্রত্যয় আসে জীবনে। যাদের হয় তাঁদেরই বলা হয় সিদ্ধ মহাপুরুষ। অর্থাৎ কিনা–

ভিড়ের ভেতর থেকে আমি ফোড়ন কাটি, আলুসেদ্ধর মহাপুরুষ।

ক্ষণেকের জন্য বকুর খাইফোঁটা বন্ধ হয়, ভক্তরাও চঞ্চল হয়ে ওঠে।

কিন্তু ভক্তির স্রোত কতক্ষণই বা রুদ্ধ থাকে! আরেক জনের প্রশ্ন হয়–দেখুন, আপনি ভগবানকে মাতৃভাবে সাধনা করতে বলেছেন। কিন্তু মার কাছে যা চাই তাই পাই, কিন্তু ভগবানের কাছে চেয়ে পাই না কেন বলুন তো?

ভারী মুশকিলের কথাই। এই নিদারুণ সমস্যার বকু কি সমাধান করে, জানবার আমারও বাসনা হয়।

বকুর আবার মৃদু হাস্য–তবে এবার হাসির পরিধি সিকি ইঞ্চি সংক্ষিপ্ত।

আমরা কি ভগবানের কাছে চাই পাগলা? সত্যি সত্যিই কি তাঁকে মা বলে ভাবতে পারি? আমাদের প্রার্থনা তো রাম শ্যাম যদু মধুর কাছেই। তাদের কাছে চেয়ে-চিন্তে আমাদের পাওয়া- গণ্ডা না পেলে তখন গিয়ে ভগবানকেই গাল পাড়ি।

কিন্তু রাম শ্যাম যদু মধুর মধ্যেও কি সেই ভগবান– সেই মা নেই কি? তবে তাদের আচরণ ঠিক মাতৃবৎ হয় না কেন মশাই?

তার কারণ, সেই মা যখন সীমার মধ্যে আসেন তখন সে মাসীমা হয়ে পড়েন। মার চেয়ে মাসীর দরদ কি বেশি হয় কখনন? মাসীর যদি বা কদাচ দেবার ইচ্ছাই হয় সে নিতান্তই যৎকিঞ্চিৎ, কখনো বা হয়ই না, কখনো যদি বা হলো, দিলেন আবার ঠিক উল্টোটাই। তাই এত হা-হুতাশ।

বকু তাক লাগিয়ে দেয় আমায়। এই সব মুরুব্বির মতো আর মোরব্বার মতো বোলচাল–যেমন মিষ্টি তেমনি গুরুপাক। অ্যাতো তত্ত্ব পেলো কোথায়। তবে কি সত্যিই ভগবান পেয়েছে নাকি? সন্দিগ্ধ হতে হয়। এ যে স্বয়ং পরমহংসদেবের মতোই প্রাঞ্জল ভাষায় প্রাণ জল করা কথা সব। আমার নাস্তিক হৃদয়েও ভক্তির ছায়াপাত হতে থাকে।

এমন সময়ে জনৈক ভক্ত এক ছড়া পাকা মর্তমান নিয়ে এসে হাজির। দণ্ডবৎ হয়ে বকুর শ্রীচরণে কলার ছড়াটা নিবেদন করে দেন তিনি।

বকু হাত তুলে আশীর্বাদ জানায়–জয়স্ত।

তারপর একটা কলা ছাড়িয়া মুখের কাছে তোলে নিজের মুখের কাছে। কাকে যেন অনুনয় করে–মা খাও!

আমি চারিদিকে তাকাই, বকুর মাকে দেখতে পাই না কোথাও। তিনি হয়তো তখন তেতলায় বসে। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে পান দোক্তাই চিবুচ্ছেন হয়ত। সেখান থেকে কি শুনতে পাবেন বকুর ডাক? তাছাড়া হাজার অনুনয় বিনয়েও, তিনি কি আসতে চাইবেন এই দঙ্গলে? সাধের দোক্তা ফেলে খেতে চাইবেন এই কলা?

বকুর পুনরায় সকাতর অনুরোধ–খাও না মা?

তাহলে বোধহয় দরজার আড়ালেই অপেক্ষা করছেন উনি। এতক্ষণ হয়তো নেপথ্যেই বিরাজ করছিলেন।

আমি মার আগমনের প্রতীক্ষা করি, বকু কিন্তু করে না, কলাটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে, সুচারুরূপে বিচিয়ে ফ্যালে একদম।

দ্বিতীয় কলাটিও ঐভাবে মুখের কাছাকাছি আনে। আবার বকুর বেদনামথিত আহ্বান–মা! মাগো! খাও না মা! আরেকটা কলা খাও!

আমি অবাক হইয়া এবার। পাশের একটি ভক্তকে জিজ্ঞেস করি–মহাপ্রভুর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এমন করছেন কেন?

শুনে তিনি তো চোখ পাকান, আরেকজন ঘুসি পাকায়। অবশেষে পেছনের একটি সদাশয় ভদ্রলোক আমাকে সব বুঝিয়ে দেন; তখন আমি জানতে পারি যে, ভগবানের সঙ্গে আমাদের চিরদিনের আদা ও কাঁচকলার সম্পর্ক চেষ্টা করে হলে গিয়ে, আত্মীয়বোধে তার সঙ্গে বাতচিত করা আধুনিক ভাগবৎ সাধনারই একটা প্রত্যঙ্গ। তারপর আর বুঝতে দেরী হয় না আমার। অর্থাৎ ভগবানকে মা-মাসী বলে একটা সম্পর্ক পাতিয়ে আমাদের ধর্ম মা যেমন–ভুলিয়ে ভালিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বাগিয়ে নেবার ফন্দি। ভগবানের সঙ্গে এহেন চালাকি আমার ভাল লাগে না। চালাকির দ্বারা একে চালাকি করা ছাড়া কি বলব? কিন্তু চালাকির দ্বারা কি কোনো বড় কাজ হয়?

তৃতীয় কলার প্রাদুর্ভাবেই আমি প্রতিবাদ করি–উঁহু, মা বেচারীকে অত কলা খাওয়ানো কি ঠিক হবে? সর্দি হতে পারে মার। তার চেয়ে বরং এখানকার বাবাজীদের মধ্যে বিতরণ করলে কি হয় না?

বকুর কদলী সেবন কিন্তু বাধা পায় না। চিবুতে চিবুতেই সে বসে, হ্যাঃ, মার আবার সর্দি হয় নাকি? তিনি হলেন আদ্যশক্তি। সর্বশক্তীময়ী! সর্দি হলেই হলো। আর যদি হয়ই, মা কি আমার আদা-চা খেতে জানেন না?

সাধ্য-সাধনের লোকে চেঁকি গেলে, কলা তো কি ছার! সমস্ত ছড়াটাই বকুর মাতৃগর্ভে গেল! মার বিকল্পে বকুর অন্তরালে দেখতে না দেখতে হাওয়া!

তারপর একে একে মা আঁচাও মা মুখ মোছ–ইত্যাদি হয়ে যাবার পর একটি পান মাতৃজাতির মুখে দিয়ে বকুর দ্বিতীয় কিস্তি কথামৃত শুরু হয়। মাঝে একবার একটা সমাধির ধাক্কাও সামলাতে হয় বেচারা বকুকে।

অবশেষে অনেক বেলায়, ভক্তদের সবার অন্তর্ধানের পর, থাকি কেবল বকু আর আমি।

এই যে শিব্রাম যে! অনেকদিন পরে কি মনে করে? ভারিক্কী চালে বকু বলে।

এলাম তোমাকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমায় যাব বলে! মডার্ন টাইমস হচ্ছে মেট্রোয় চার্লি চ্যাপলিনের। চল, দেখে আসা যাক আর হেসে আসা যাক খানিক।

আমার কত কাজ, কি করে যাই বল! বকুর মুখ ভার।

আচ্ছা মাকে একবার জিজ্ঞেস করেই নাও না বাপু। তিনি তো এখনো দেখেননি ছবিটা। কিংবা যদি দেখেও থাকেন তো দেখেছেন সেই ফিল্ম তোলার সময় হলিউডে। তারপর সটান চলে এসেছে কলকাতায়, এই প্রথম শো।

আঃ, কী যা তা বকছ! মার এখন সময় কই?

তবে মাকে নাই নিয়ে গেলে, তোমাকে নিয়ে গেলেই হবে। মার কি মাসীমার কি যারই হোক, অনুমতিটা নিয়ে নাও চটপট।

ভাই শিব্রাম, বকুর দ্বিতীয় দফার দীর্ঘনিঃশ্বাস : ঈশ্বর ছাড়া কি কোনো কাম্য আছে আমার জীবনে? না, আর কোনো চিন্তা? না, কিছু দ্রষ্টব্য? না। এখন ঈশ্বরই আমার একমাত্র লক্ষ্য।

তা বেশ তো। লক্ষ্য তাই থাক না, কিন্তু সিনেমাটা উপলক্ষ্য হতে বাধা কি? চার্লি চ্যাপলিন–

তা হয় না ভাই শিব্রাম বকু বাধা দিয়ে বলে–তুমি নিতান্ত মূঢ়মতি! মহৎ গূঢ় রহস্য কি বুঝবে! লক্ষ্য মাত্রই ভেদ করার জিনিস তা তো মানো? কথায় বলে লক্ষ্যভেদ। ঈশ্বর যদি জীবনের লক্ষ্য হয় তাহলে ঈশ্বাকেও ভেদ করতে হবে বৈ কি। ঈশ্বরকে ফাঁক না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।

আমার কি রকম একটা ধারণা ছিল যে, ঈশ্বর লক্ষ্য হতে পারে কিন্তু ভেদ্য নন, কিংবা ভেদ্য হতে পারেন কিন্তু লক্ষ্য নন অথবা ও দুয়ের কিছুই তিনি নন সমস্ত ভেদাভেদের বিলকুল অতীত তিনি। সেই কথাই পরিষ্কাররূপে প্রমাণ করতে যাচ্ছি কিন্তু পাড়তে না পাড়তেই সে আমাকে বাগড়া দেয়–বাঃ, ভেদ করা যায় না কে বলল? ঈশ্বরকে ভেদ করেই তো আমরা এলাম। এলো এই বিশ্ব চরাচর! নইলে এলাম কোত্থেকে? ঈশ্বরকে ছিন্নভিন্ন ছত্রাকার করেই তো আমরা এসেছি ধাবমান পলাকতক বিধাতার ছত্রভঙ্গ আমরা! যা একবার ভেদ হয়েছে তা আবার ভেদ হবে! বার বার ভেদ হবে। তবে হ্যাঁ, দুর্ভেদ্য বটে।

এই বলে সে অর্জুনের লক্ষ্যভেদের উদাহরণ ঠেলে নিয়ে আসে আমার সামনে, আমার কিন্তু ওরফে ধনঞ্জয় য়ের, অধিকতর মুখরোচক দৃষ্টান্তে প্রহারের দুরভিসন্ধিই জাগতে থাকে মাথায়।

নিজেকে সামলে নিয়ে কোনরকমে–না, এতখানি বরদাস্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার পিত্ত প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে, একটা নিষ্কাম রাগ, নিঃস্বার্থ ভাবে তাকে ধরে অহেতুক পেটাবার সদিচ্ছা আমার পেটের মধ্যে প্রধুমিত হয়। না,বকু এতটা বাড়ে তাহলে বকুকেই আমার জীবনের লক্ষ্য করে বসব কোনদিন! ধরে ঠ্যাঙাব, বা একেবারে ভেদ করেই ফেলব ওকে জরাসন্ধের মত সরাসরি। জরাসন্ধকে কে ফাঁক করেছিল? অর্জ্জুন, না, ধনঞ্জয়–কে? সে যেই হোক, য়্যাডভাইস বা একজাম্পলের পরোয়া নেই আমার ওকেও আমি দেখে নেব, হুবহু, তা যাই থাক কপালে, মানে বুকর কপালে! আর বলতে কি, বকুকে আমার ততটা দুর্ভেদ্য বলে মনে হয় না আদপেই।

চটেমটেই চলে আসি–সেদিনকার মতো ওকে মার্জনা করে দিয়ে।

আসবার সময় সে রহস্যময় হাসি হেসে বলে–জানতে পাবে, ক্ৰমশঃই জানতে পাবে। অচিরেই প্রকাশ হবে সব। ভগবান যখন ফাটেন, বোমার মতোই ফাটেন! যেমনি অবাক করা তাঁর কাণ্ড তেমনি কান ফাটানো তার আওয়াজ! না দেখার, না শোনার মত কি! কতজনকে যে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যান তার পাত্তাই পাওয়া যায় না। ভগবানের মুখে যে পড়েছে তার কি আর রক্ষে আছে ভাই?

দিনকতক পরে যথেষ্ট ইচ্ছাশক্তি সঞ্চয় করে আবার যাই বকুর কাছে। দৃঢ়সংকল্প হয়েই যাই, এবার বলা নেই কওয়া নেই, সোজা গিয়েই ওকে চাটাতে শুরু করে দেব, তা যাই থাক বরাতে–ভক্তবৃন্দই এসে বাধা দিক কি মাঝখানে পড়ন। কারুর কথা শুনছি না!

কিন্তু যাবার মুখে দোরগোড়াতেই প্রথম ধাক্কা। দেখি বকুর সাইনবোর্ড বদলেছে, শ্রীমৎ বক্কেশ্বর পরমহংসের বিনিময়ে স্রেফ স্বামী বক্কানন্দ! আমার মনে আঘাত লাগে, ভাল হোক মন্দ হোক বকু আমার বন্ধুই–বিনা হাফপ্যান্ট এবং হাফপ্যান্টের সময় থেকেই। ধনরত্ন কিছুই ওকে দিতে পারিনি, কেবল মান–মাত্র দান করেছিলাম, তাও অভিমান বশে সে প্রত্যাখ্যান করল।

অভিমানবশে কি ক্রোধভরে, কে জানে। আমি ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে অনুযোগের সুর তুলতেই ও বলে, আর ভাই, বোলো না! পাড়ার চ্যাঙড়াদের জ্বালায় পাল্টাতে হোলে! পরমহংসের জায়গায় কেবল পরমবক বসিয়ে দিয়ে যায়। চক দিয়ে, কালি দিয়ে, উড পেন্সিল নিয়েই–যা পায় তাই। কাঁহাতক আর ধোয়া মোছা করি? আর যদি দিনরাত কেবল নিজের নাম দিয়েই পাগল হব, ভগবানকে তাহলে ডাকব কখনও কাল আবার আলকাতরা দিয়ে লিখে গেছে–সে লেখা কি ছাই সহজে ওঠে? ভারী খিটকাল গেছে কাল; তারপরই ভাবলাম ধুত্তোর নাম। নাম নিয়ে কি ধুয়ে খাবো? রোজ রোজ নাম ধুয়ে খেতে হবে? বদলে ফেললুম নাম। তা বক্কানন্দ! এমন মন্দই বা কি হয়েছে?

শ্রীমৎ বক্কেশ্বর পরম্বক? আমি বলি, তাই বা এমনকি খারাপ হতো? ছেলেরা তো তোমার ভালই করছিল। বক্কানন্দের চেয়ে ভালই ছিল বরং।

বারে! তুমিও আবার বক বক করছ! বক যে একটা গালাগাল! বকু বলে– দারুণ গলাগাল যে! হংসমধ্যে বাকো কথা, পড়নি বইয়ে?

ধার্মিক মানুষদের তো বকের সঙ্গেই তুলনা করে। বলে বক ধার্মিক। বক কি যা তা? বকের পক্ষে আমি দাঁড়াই–হাঁসের চেয়েও বক ভাল এমন কি প্যাঁচার চেয়েও।

তোমার কাছে ভাল হতে পারে বকু এবার চলে, আমার কাছে নয়। তোমার ইচ্ছা হয়, বকের মাদুলি বানিয়ে গলায় বোলাওগে। আমি কিন্তু বক দেখলেই মুছে ফেলব, মেরেই বসব একেবারে! কেউ যদি একবার আমাকে বক দেখায়। যদি হাতের নাগালে পাই কাউকে। বকু গজরাতে থাকে।

তা যাকগে। আমি ওকে ঠাণ্ডা করি, ব্যাকরণ থেকে বের করা ছিল কিনা নামটা, তাই বলছিলাম–!

বাঃ, এতেও তো ব্যাকরণ বজায় আছে। বিলক্ষণ! বকু ছিল আনন্দ কিংবা বন্ধু পেল আনন্দ অথবা বকুর হল আনন্দ ইতি বক্কানন্দ! এমন কি মন্দ!

কিন্তু এই যে নামের গোড়ায় স্বামী বসিয়েছ! স্বামী কেন আবার?

বাঃ তাও জানে না? স্বামী বসাতে হয় যে। বিয়ে না করলেও বসানো যায়। আমার বোকামিতে বকুর বিস্ময় ধরে না–তার ওপরে আমি তো বিয়েও করতে যাচ্ছি শিগগির।

আমি আকাশ থেকে পড়ি–বল কি? বিয়ে? এই এত বয়সে?

অবাক হচ্ছ যে! বিয়ে কি করতে নেই? বকু বলে, দুদিন বাদে বক্কানও লোপ পাবে আমার। থাকবে কেবল স্বামী। শুধুই স্বামী।

হ্যাঁ।

তোমাকে লক্ষ্যভেদের কথা বলেছিলাম না? সে লক্ষ্যভেদে হয়ে গেছে আমার অ্যাদ্দিনে।

হ্যাঁ বলো কি? ঈশ্বরকে ফাঁক করেছো তাহলে?

একেবারে চৌচির–এই দয়াখো। ব্যাঙ্কের একটা পাস বই বের করে আমাকে দেখায়, তাতে বকুর নামে লক্ষ টাকা জমা। পুনরায় আমার পিলে চমকায়–অ্যাঁ! এত টাকা বাগালে কোত্থেকে?

ভক্তদের কাছ থেকে প্রণামী পাওয়া সব। ধারও আছে কিছু কিছু–তাও বেশ মোটারকমের। তবে ধর্তব্য নয়। ফেরত দেবার কোনো কথা নেই।

ভক্তদের ফাঁকি দেবে? বেচারাদের?

ভক্তিতে মানুষকে কানা করে! গুরুর কাজ হচ্ছে চক্ষুদান করা। এইজন্যে গুরুকে বলেছে জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া। সেই গুরুতর কাজটাই করছি আমি কেবল!

বারে আমার ভাই বক্কানন্দ! বলে আমি তারিফ করি–বাহবা কি বাহবা! গদাম—গদাম–গুম!

শেষের কথাগুলো বলে আমার দক্ষিণহস্ত…ওর প্রশস্ত পিঠে–বেশির ভাগ অব্যয় শব্দ সব হাতের অপব্যয় থেকেই আসে তা!

আমার তারিফের তাল সামলাতে ওর সময় লাগে। এটা অনুরোগের বহর, না কি, অনেকদিনের রাগের ঝাল…ও ঠিক বুঝতে পারে না। আমিও না।

পুনাবৃত্তির সূত্রপাতেই ও পিছিয়ে যায়। আমি চললুম ব্যাঙ্কে। য়্যাদ্দিন শুধু সমাধিই করেছি। এবার সমাধা করি!

আমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। লক্ষ টাকা ভেদ করা কি চারটি খানি? দুর্ভেদ্য রহস্যের মতোই বকুকে বোধ হতে লাগল আমার।

ব্যাঙাচির ল্যাজ খসে সে ব্যাঙ হয়, আর বড়ো হলে তার ব্যাঙ্ক হয় তারপরে যখন ঠ্যাংটাও খসে যায় তখন থাকে শুধু ব্যা।

তা, ভক্তদের কাছে অপদস্থ হলেও বকুর আর কোনো তুয়াক্কা নেই। সে আবার বিয়ে করতে যাচ্ছে। নতুন ব্যা–কারনে।

ভক্তরা ওর পীঠস্থানে যদি পাদ্যর্ঘ দেয় তাতেই বা কি যায় আসে ওর এখন?

বিগড়ে গেলেন হর্ষবর্ধন

এমন পাল্লায় পড়ে মানুষ। চিরদিন সহর্ষ দেখেছি বিগড়োতে দেখিনি কখনো, এমন যে মানুষ তাঁকেও সেদিন বিগড়ে যেতে দেখা গেলো…

সেই যে ডি এল রায়ের হাসির গানে আছে না?

রাজা গেলেন…

দিল্লী কিংবা বম্বে নয়,
মাদ্রাজ কিংবা ব্ৰম্ভে নয়,
ট্রেনে নয় প্লেনে নয়,
রেল কি স্টীমার চেপে
রাজা গেলেন ক্ষেপে।

অনেকটা সেই রকমরেই ব্যাপার হলো যেন!

জীবনে হাজার মানুষের হাজারো রকমের পাল্লা কাটিয়ে এসে শেষটার কিনা সামান্য এক জানলার পাল্লায় পড়লেন হর্ষবর্ধন!

আর সেই এক পাল্লাতেই তার এমন দিলদরিয়া মেজাজ খিঁচড়ে গেল।

হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন আর আমি তিনজনেই দুর পাল্লার যাত্রী। একটা ফাস্ট ক্লাস কামরার তিনটে বার্থ রিজার্ভ করে পাটনা যাচ্ছি আমরা সন্ধ্যেয় চেপেছি হাওড়ায়, সকালে পৌঁছোবো পাটনা স্টেশনে।

ওপরের দুটো বার্থে গোবরা আর আমি। তলাকার একটা বার্থে হর্ষবর্ধন। তলার অপর বার্থটায় ছিলেন অন্য এক ভদ্রলোক, কোথায় যাচ্ছেন কে জানে!

হর্ষবর্ধন পাটনায় তাঁর কারখানায় কাঠের কারবারের একটা শাখা খুলতে যাচ্ছিলেন, আমাকে এসে ধরলেন–চলুন। আপনি আমার দোকানের দ্বার উদঘাটন করবেন।

আমি কেন? ও-সব কাজ তো মন্ত্রীরাই করেন মশাই। পাটনায় কী কোন মন্ত্রী পাওয়া যায় না? আমি একটু অবাক হই, কেন, সেখানে কি মন্ত্রীর পাট নেই?

সত্যি বলতে এসব কাণ্ড-কারখানার মধ্যে যেতে আদৌ আমার উৎসাহ হয় না। উদঘাটন, উন্মোচন, ফিতে-কাটা এগুলোকে আমি মন্ত্রীদের অভিনয়ে পার্ট বলেই জানি।

থাকবে না কেন? বললেন তিনি, তবে তাদের কারো সঙ্গে আমার তেমন দহরম নেই–একদম নেই।

একদমে কথাটা শেষ করে নবোদ্যমে তিনি পরের খবরটি জানালেন। তাছাড়া, জানেন কি মশাই…দাদার কথায় বাধা দিয়ে গোন ফোড়ন কাটল মাঝখান থেকে–তাছাড়া, আপনিই বা মন্ত্রীর চেয়ে কম কিসে বলুন? দাদার মুখ্যমন্ত্রী আপনিই তো! দাদাকে যত কুমন্ত্রণা আপনি ছাড়া কে দেয় আর?

তাছাড়া, আরেকটা কথা, হর্ষবর্ধন তাঁর কথাটা শেষ করেন কলকাতায় তো এখন ছানা কন্টোল হয়ে মিষ্টি-ফিষ্টি একেবারে নেই! এখানকার কারিগররা গেছে কোথায় জানেন? সবাই সেই পাটনায় গিয়ে সন্দেশ বানাচ্ছে! কলকাতার মেঠাই সব সেখানে। নতুনগুড়ের সন্দেশ যদি খেতে চান তো চলুন পাটানায়।

নতুন গুড়ের এই নিগূড় সন্দেশ লাভের পর পাটনায় আর কোন বাধা রইল না তারপর।

বম্বে এক্সপ্রেস অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ঘটাংঘটের ঘটঘটা তুলে ছুটে চলছিলো….

তলার সেই অপর বার্থটির ভদ্রলোক উঠে জানলার পাল্লাটা নামিয়ে দিলেন হঠাৎ।

হর্ষবর্ধন বললেন, একি হলো মশাই! জানালাটা বন্ধ করলেন কেন? মুক্ত বাতাস আসছিল বেশ।

ঠাণ্ডা আসছে কিনা। বললেন সেই ভদ্রলোক।

ঠাণ্ডা! ওপরের বার্থ থেকেই যেন ধপাস করে পড়লেন হর্ষবর্ধন, তাঁর নিচেকার বার্থে শুয়ে থেকেই।ঠাণ্ডা এখন কোথায় মশাই! সবে এই অঘ্রাণ মাস! শীত পড়েছে নাকি এখনই? উঠে জানলার পাল্লাটা তুলে দিয়ে প্রাণভরে যেন তিনি অঘ্রাণের ঘ্রাণ নিলেন–আহা! কী মিষ্টি হাওয়া।

রীতিমতন হাড় কাঁপানো হাওয়া মশাই! জবাব দিলেন সেই ভদ্রলোক। তারপরই জানলাটা ফের নামিয়ে দিলেন তক্ষুনি।

হাড় কাঁপানো হাওয়া! দেখছেন না, আমি ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছি! বলে হর্ষবর্ধন জানলাটা তুলে দিলেন আবার।

ফিনফিনে তো দেখছি ওপরে। কিন্তু তার তালায়? শুধোলেন সেই অচেনা লোকটি, ফিনিফিনের তলায় তো বেশ পুরু কোট এঁটেছেন একখানা, তার তলায় আবার একটা অলেষ্টারও দেখছি….

আজ্ঞে এবার আমাকেই প্রতিবাদ জানাতে হয়–আজ্ঞে ওটা ওঁর কোট নয়, গায়ের মাংস! বেশ মাংসল দেহ দেখছেন না ওঁর? আর যেটাকে আপনি অলেষ্টার বলে ভ্রম করছেন সেটা আসলে ওঁর ভুড়ি….।

ওই হলো মাংসের কোটিং তো, তা সেটা কোটের চেয়ে কম না কি? ওতেও গা বেশ গরম থাকে? কোটের মতই গরম রাখে গা। হাড়ে তো ঠাণ্ডা হাওয়া লাগতে পায় না। আমার এই হাড় জিরজিরে শরীরে অলেষ্টার চাপিয়েও ঠাণ্ডার শিরশির করছে হাত পা! বলতে বলতে সত্যিই যেন তিনি শিহরিত হতে লাগলেন শীতে; তারপর আমার মাফলারটাও আনতে ভুলে গেছি আবার! আমার টনসিলের দোষ আছে জানেন? গলায় যদি একটু ঠাণ্ডা লাগে তো আর রক্ষে নেই।

মুক্ত বাতাস দারুণ স্বাস্থ্যকর। তাতে কখনো টনসিল বাড়ে না। হর্ষবর্ধন জানান–বাড়তে পারে না। বলে পাল্লাটা গভীরভাবে তুলে দেন আবার।

আপনার বাড়ে না। কিন্তু আমার বাড়ে। আপনার কি, গলায় তো বেশ মোটা একটা কমফর্টার জড়িয়ে রয়েছেন!

আপনার গলায় কমফর্টার? হর্ষবর্ধন ঊর্ধ্বনেত্রে আমাকেই যেন সাক্ষী মানতে চান।

না মশাই! গলায় ওঁর কোনো কমফর্টার নেই। বাধ্য হয়ে বলতে হয় আমায়।

আপনার টনসিলের দোষ বলছেন, কিন্তু চোখেরও বেশ একটু দোষ আছে দেখছি। ওঁর গলায় পুরু মতন ওটা যা দেখছেন, ওকে কী বলা যায় আমি জানিনে। গরুর হলে গলায় পুরু মতন ওটা যা দেখছেন, ওকে কী বলা যায় আমি জানিনে। গরুর হলে গলকম্বল বলা যেত, কিন্তু ওঁকে তো গোরু বলা যায় না বলে হর্ষবর্ধনকে একটু কমফর্ট দিই। ওঁর ক্ষেত্রে ওটাকে গলার ভুড়িই বলতে হয় বাধ্য হয়ে, কিংবা ভুরি ভুরি গলাও বলতে পারেন।

গলায় কেউ কম্বল জড়ায় নাকি? হর্ষবর্ধন আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি হানেন এবার গরুরাই গলায় কম্বল জড়ায়।

সেই কথাই তো বলেছি আমি। কৈফিয়তের সুরে জানাই, গরুর হলে ওটা গলকম্বল হত। আপনার বেলা নয়। তাই তো আমি বলছিলাম ওনাকে।

আপনার টনসিল ঢাকা একটা কিছু রয়েছে তো তবু। বলে ভদ্রলোক উঠে জানলার পাল্লাটা নামিয়ে দিলেন আবার যাক, আমি কোন তর্কের মধ্যে যেতে চাইনে। নিজে সতর্ক থাকতে চাই।

হর্ষবর্ধনও উঠে তুলে দিলেন পাল্লাটা-গরমে আমার দম আটকে আসে। বন্ধ হওয়ায় স্বাস্থ্য খারাপ হয়। চারদিক বন্ধ করে দূষিত আবহাওয়ার মধ্যে আমি মোটেই থাকতে পারিনে।

আপনি কি আমাকে খুন করতে চান নাকি? ভদ্রলোক উঠে খুলে ফেললেন ফের পাল্লা–ঠাণ্ডা লেগে আমার সর্দি থেকে কাশি, কাশি থেকে গয়া–আই মীন; টাইফয়েড, তার থেকে নিমোনিয়া…!

তার থেকে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। ওপরের বার্থ থেকে জুড়ে দেয় গোবর্ধন। ব্যঙ্গের সূরেই বলতে কি!

তাই হোক আমার। তাই আপনি চান নাকি? আপনি তো বেশ লোক মশাই! বলে তিনি পাল্লাটা দিলেন জানলার।

আর আপনি কী চান শুনি? দূষিত বদ্ধ আবহাওয়ায় আমার হেঁচকি উঠুক, হাঁপানি হোক, যক্ষ্মা হোক, টি-বি হোক, ক্যানসার হোক, নাড়ি ছেড়ে যাক, দম আটকে মারা যাই আমি, তাই আপনি চান নাকি?

হর্ষবর্ধন উঠে পাল্লাটা তোলেন আবার।

এইভাবে চলল দুজনের….পালা করে পাল্লা ভোলা আর নামানো….পাল্লা দিয়ে চলল দু জনার। করতে করতে এসে পড়ল খড়গপুর।

বম্বে এক্সপ্রেস গার্ড থামতেই হর্ষবর্ধন তেড়ে-ফুড়ে নামলেন কামরার থেকে যাচ্ছি আমি গার্ড সাহেবের কাছে। আপনার নামে কমপ্লেন করতে চললাম।

আমিও যাচ্ছি। তিনিও নামলেন সঙ্গে সঙ্গে।

আমিও নামলাম ওঁদের পিছু পিছু। কেবল গোবরা রইল কামরায় মালপত্র সামলাতে।

গার্ড সাহেব দু-পক্ষেরই অভিযোগ শোনেন। শুনে মাথা নাড়ে গম্ভীরভাবে –এতো, ভারী মুস্কিল ব্যাপার দেখছি। শার্সি তুললে আপনার স্বাস্থ্যহানি হয়, আর শার্সি নামলে আপনার? তাই তো? ভারি মুস্কিল তো! চলুন দেখিগে…।

কোন কামরাটা বলুন তো আপনাদের?… বলতে বলতে তিনি এখোন ঐ ফার্স্ট ক্লাস কামরাটা বলছেন? জানলাটা এখন বন্ধ রয়েছে, না, ভোলা আছে?

আমি নামিয়ে দিয়ে এসেছি পাল্লাটা সেই ভদ্রলোক জানান।

ওটার শাসিটা তো ভাঙা বলেই জানতাম, ওর পাল্লার কাঁচটা তো বসানো হয়নি এখনো। যতদুর আমার মনে পড়ে আপনি বলছেন, কাঁচের পাল্লাটা নামিয়ে দিয়ে এসেছেন? কিন্তু কে যেন মুখ বাড়াচ্ছে না। জানলা দিয়ে?

আমার ভাই গোবর্ধন। হর্ষবর্ধন জানান।

পাল্লার কাঁচটা ভাঙাই রয়েছে তাহলে। নইলে ছেলেটা শার্সির ভেতরে দিয়ে মুখি বাড়ায় কি করে? যান, যান উঠে পড়ন চট করে। এক্ষুনি গাড়ি ছেড়ে দেবে….টাইম ইজ আপ….।

বলতে বলতে গার্ড সাহেবের নিশান নড়ে, গাড়ি ছাড়ার ঘন্টা পড়ে। আর হর্ষবর্ধন কামরায় এসে গোবরাকে নিয়ে পড়েন।

তোর কি সব তাতে মাথা না গলালে চলে না? কি আক্কেল তোর বল দেখি? কে বলেছিল–কে? সমস্ত চোটটা তার ওপরই গিয়ে পড়ে তখন। এমন তিনি বিগড়ে যান যে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেন গোবরাকে।

কাঁচের ভেতর দিয়ে মাথা গলানো। সত্যি, এমন কাঁচা কাজ করে মানুষ। আমিও গোবরাকে না দুয়ে পারি না।

বিজ্ঞাপনে কাজ দেয়

টুসিকে নিয়ে আবার মুশকিল হয়েছে ঘনশ্যামবাবুর। রবিবার দিন আফিসের তাড়া নেই, তাই একটু দেরি করে ওঠেন তিনি। সেদিনও সাতটা বাজিয়ে উঠেছেন; উঠে দেখেন টুসির কোন পাত্তা নেই। যা সন্দেহ করেছিলেন তাই, পকেট হাতড়ে দেখলেন ট্রামের মান্থলিখানাও হাওয়া।

ছুটির দিনে ভোরে উঠেই হাওয়া খেতে বেরিয়েছে টুসি।

ফিরল বারোটা বাজিয়ে–প্রায় একটার কাছাকাছি।

ছিলি কোথায় এতক্ষণ? আমার মান্থলি নিয়ে বেরিয়েছিস? কতদিন বলেছি এটা বে-আইন; তাছাড়া মান্থলির মধ্যে আমার…

বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে গেছলাম। সাড়ে দশটার শো-এ সিনেমা দেখে ফিরছি… জানালো টুসিঃ বুঝলে দাদু, ছবিটায় কি মারামারি কাটাকাটি… উঃ, কি মারামারি যে কী বলব।

বুঝেছি। কিন্তু মান্থলির খাপের ভেতর দুশো কত টাকা ছিল না?

দুশো সাত টাকা ছিল যেন। কিন্তু এখন আর তা নেই। আমরা বন্ধু মিলে সিনেমা দেখলাম? আর এতক্ষণ অব্দি না কিছু খেয়ে থাকা যায়? রেস্তোরাঁয় খেতেও হলো। বেশি খাই নি দাদু, একখানা করে মোগলাই পরোটা আর প্লেট করে কষা কারি।

কেতাত্থ করেছে! এখন দাওতো আমার মান্থলি আর দুশো টাকা!

পকেটে হাত দিয়ে টুসি আঁতকে ওঠে–ওমা, কোথায় গেল মান্থলিটা। এ পকেট ও পকেট হাতড়ায়। প্যান্টের পকেট পর্যন্ত।

নাঃ, হাফ প্যান্টের পকেটেও তো নেই। নিশ্চয় পড়ে গেছে কোথাও। ট্রামেই পড়েছে নিশ্চয়।

দুখানা একশো টাকার নোট ছিল যে রে। আর খুচরো সাত টাকা।

সাত টাকা আর নেই, বলেছি তো।

দুশো টাকাই রয়েছে যেন। রাগে উথলাতে থাকেন ঘনশ্যাম,–পড়ে গেছে না হাতি! বন্ধুদের কেউ হাতিয়ে নিয়েছে নিশ্চয়। যা সব বন্ধু! নয় তো কেউ পকেট মেরেছে নির্ঘাত।

আমার বন্ধুরা তেমন নয়–টুসির প্রতিবাদ–তারাও আমায় খাওয়ায়, সিনেমা দেখায়, তাই আমিও তাদের দেখালুম। আর আমার পকেট মারবে এমন কেউ জন্মায় নি এই কলকাতায়।

তুই নিজেই ত পকেটমার। আমার পকেট সাফ করাই তো তোর কাজ। বদ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে দিনকে দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছিস। তোকে আমি ত্যজ্যপুত্র করব।

ত্যজ্যপুত্র কি করে হবে দাদু? আমি তো তোমার পুত্র নই।

ত্যজ্যনাতি করে দেব তোকে।

ত্যজ্যনাতিও হয় না দাদু। শুনি নি কোনকালে।

হয় না, হবে। হলেই দেখতে পাবি। আমার সব বিষয়-আশয় থেকে বঞ্চিত করব তোকে।

বিষয়-আশয় আমার চাইনে দাদু। ও নিয়ে আমি কি করব? বলে টুসি। সত্যি, দাদুর বিষয়ের কোন আশায় সে করে না, সে বিষয়ে তার উৎসাহই নেই, কেবল দাদুর পকেটই তার লক্ষ্যস্থল। সেই সম্বল বজায় থাকলেই ঢের।

আমি তোর অনেক অত্যাচার সয়েছি, কিন্তু আর না। আজই আমি খবর-কাগজে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি যে তোর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই…এখুনি আমি চললাম কাগজের আপিসে।

খবরের কাগজে যাচ্ছোই যখন দাদু, তখন ঐ সঙ্গে মান্থলিটার জন্যেও একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দাও না–এই বলে যে যদি কোন সদাশয় ভদ্রলোক আমার মান্থলি টিকিটটি খুঁজিয়া পান তাহা হইলে দয়া করিয়া…।

দয়া করিয়া! সে আমি বুঝবো। তোমাকে আর উপদেশ দিয়ে আমার মাথা কিনতে হবে না।

কেন, পাওনি একবার খুঁজে? সেই যেবার হারিয়ে গেছলাম, রাত দুপুরে তোমার কলিকের ওষুধ কিনতে গিয়ে, খবর-কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাওনি আমায় তুমি? বিজ্ঞাপন দিতে না দিতেই তো পেয়ে গেছলে আমাকে। বিজ্ঞাপনে কাজ হয় দাদু।

সে কথা কানে না তুলে ঘনশ্যাম বেরিয়ে পড়েন। তা এখানে কি করতে শুনি? শুধান বটকেষ্ট।

একটা বিজ্ঞাপন দিতে এসেছি ভাই। বোলা না আর। বখা ছেলেদের পাল্লায় পড়ে নাতিটা আমার গোল্লায় গেছে। বিজ্ঞাপন দিয়ে ভাবছি ওকে ত্যজ্যপুত্র করে দেব। ত্যজ্যপুত্র বা ত্যজ্যনাতি যাই বলো!

ও বাবা।এ যে দেখছি নাতিবৃহৎ ব্যাপার। বটকেষ্ট অবাক হলো–পুঁচকে একটা নাতিকে নিয়ে একটা বৃহৎ কান্ড বাধিয়েছে দেখছি।

নইলে ছেলেটা মানুষ হবে না। বাপ-মা-মরা ছেলে-অসৎ সঙ্গে মিশে অধঃপাতে যেতে বসেছে। ঐ বিজ্ঞাপনটা দিলে ভাবছি ও শুধরোবে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যবস্থা করে দেওঘর কি কনখল, গুরুকুলে কি রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে কোনো আশ্রমে পাঠিয়ে দেব ওকে সেখান থেকে সৎসঙ্গে যদি ছেলেটা মানুষ হয় কোনোদিন। আমার কাছে আদরে মানুষ হয়েছে। কিন্তু দেখছি, ঠিকই বলে থাকে সবাই, আদর দিয়ে ছেলের মাথা খাওয়া হয় কেবল। আমি আর টুসির মুখ দেখব না ঠিক করেছি।

To see ro not to see? কিন্তু ও যাবে আশ্রমে?

না গিয়ে উপায় কি? ছাপার অক্ষরে যখন দেখবে ওর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তারপর আশ্রম থেকে ওকে নিতে এসেছে….ভাল কথা, তুমি এখানে কেহ হে?

একটা কুকুর হারানোর বিজ্ঞাপন দিতে ভাই। অ্যালসেসিয়ান কি কোন নামী জাতের কুকুর নয়, এমনি দেশী কুকুর কিন্তু দেখতে ভাল। আর ভারী প্রভুভক্ত। ভারী মায়া পড়ে গেছে কুকুরটির ওপর আমার। কেউ খুঁজে দিতে পারলে নগদ পাঁচশো টাকা পুরস্কার দেবার বিজ্ঞাপন।

দিয়েছ বিজ্ঞাপন।

দশটার সময় এসে দিয়ে গেছি…

দিয়েছ তো! তা এখন আবার এই বেলা দুটোর সময় কি? তোমার বিজ্ঞাপন তো ছেপে বেরুবে কাল সকালের কাগজে।

তা তো জানি, তবে বিজ্ঞাপনটার খবর নিতে এসেছিলাম।

ও, তার প্রুফ দেখতে চাও বুঝি?

কিন্তু এসে দেখছি, যে কর্মচারিটির কাছে বিজ্ঞপনটা দিয়েছিলাম সে লোকটা নেই। বিজ্ঞাপন বিভাগে সকাল দশটায় সাতটা লোক দেখেছিলাম এখন তাদের একটাও দেখছিনে। কী যেন জরুরি কাজে বেরিয়ে গেছেন সবাই।

বিভাগে তা হলে আছে কে এখন?

কেবল বেয়ারা। সে তো কোন খবর দিতে পারে না। অপেক্ষা করছি তাই তো।

তা হলে তো আমাকেও অপেক্ষা করতে হবে দেখছি।

কিন্তু কাঁহাতক অপেক্ষা করা যায়? অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তারা আবার সেই বিজ্ঞাপন-বিভাগে গিয়ে হানা দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন বেয়ারাকে কর্তারা সব কি জরুবী কাজে বেরিয়েছেন জানতে পারি কি?

কুকুর খুঁজতে বেরিয়েছেন সবাই।

কুকুর।

হ্যাঁ, আমিও বেরুতাম, কিন্তু আপিস ফাঁকা রেখে যাই কি করে? কুকুরটার জন্য নগদ পাঁচশো টাকার বকশিস আছে মশাই।

কিন্তু কুকুর তো… বলতে গিয়ে বাধা পান বটকেষ্ট। ঘেউ ঘেউ করতে করতে বিজ্ঞাপন বিভাগের এক কর্মচারী এসে উপস্থিত। যার হাতে, বটকেষ্টবাবু বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন, তিনিই। তার ঘেউল্কারই বাধা দিল।

তিনি নন, তার সঙ্গীটিই ঘেউ ঘেউ করছিল।

এই নিন মশাই আপনার কুকুর। খুঁজে খুঁজে হয়রান। বলেন ভদ্রলোক–এবার পুরস্কারটা বার করুন তো দেখি।

সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিভাগের আরেকজন এসে হাজির আর একটা কুকুর নিয়ে। আবার আনকোরা ঘেউ ঘেউ।

তারপর আরোও একজন। তিনিও একটাকে খুঁজে এনেছেন।

সাতজন এলেন একে একে–সাতটা কুকুর সাথে নিয়ে।

বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্তা সাতটা কুকুর লম্বা দড়ায় বেঁধে এনেছেন। যেমন ঢেউ এর পর ঢেউ আসে, তেমনি ঘেউ-র পর ঘেউ ঘেউ আসতে লাগল।

দারুণ হৈ চৈ পড়ে গেল সারা আফিসে। সবারই দাবি নগদ পুরক্ষারের।

নিন আপনার কুকুর–বেছে নিন এর ভেতরে থেকে। আর দিয়ে দিন পুরস্কারের টাকাটা। আমার বাঁটোয়ারা করে নেব সবাই।

কিন্তু আমি তো কুকুর নিতে আসি নি। আমি সেই বিজ্ঞাপনটার সম্পর্কেই বলতে এসেছিলাম।

বলুন তা হলে।

বিজ্ঞাপনটা আমি আর দিতে চাই না। ওটা আমি ফেরত চাই। বিজ্ঞাপন দিতে না দিতেই কুকুরটা আবার ফিরে এসেছে–নিজের থেকেই কখন এসে গেছে।

বিজ্ঞাপনে কাজ হয়, বলছিল টুসি। মনে পড়ে ঘনশ্যামের।

ফিরে এলে চলবে কেন। এসব কুকুর এখন কে নেবে তাহলে? বিজ্ঞাপন বিভাগের ভদ্রলোকেরা প্রশ্ন তোলেন–আর আমাদের প্রাপ্য পুরক্ষারেই বা কী হবে? কুকুর তো আমরা এনেছি এখন নেওয়া না নেওয়া আপনার মর্জি। সব এরা দেশী কুকুর, নেড়ি কুত্তা–যেমনটি আপনি চেয়েছিলেন।

কিন্তু এদের তো আমি চাই না…বোঝাতে যান বটকেষ্টবাবু–আমার নিজেরটিকেই চাই।

দারুণ ঘেউ ঘেউ শুনে এর মধ্যে আফিসের বড়কর্তা বেরিয়ে এসেছেন।

এখানে এত হট্টগোল কিসের? এসেই তিনি তম্বি করেন।

ইনি…এঁর কুকুর সব…নিয়ে যেতে বলছি এঁকে। ইনি নিচ্ছেন না কিছুতেই।

নিয়ে যান আপনার কুকুরদের। হুকুম দেন বড় কর্তা–দারোয়ান, ইন লোককো নিকাল দেও।–

দারোয়ানরা এসে দড়িসমেত কুকুরগুলো বটকেষ্ট জড়িয়ে দেয়–নিয়ে যান আপনার কুকুর মশাই। আপনি আমাদের চাকরি খাবেন দেখছি।

কুকুরের দলবলসহ বটকেষ্টকে তারা গলির মোড় অবধি পার করে দিয়ে আসে। তারপর, সদলবলে বটকেষ্ট চলে গেলে আসেন আরেক ভদ্রলোক।

হারানো—প্রাপ্তি–নিরুদ্দেশ বিভাগে আমি একটা বিজ্ঞাপন দিতে এসেছি।

দিন, বিজ্ঞাপন-বিভাগ থেকে তাঁকে বলা হয়–কিন্তু আমরা কুকুর- হারানো কোনো বিজ্ঞাপন নেব না। কুকুরের বিজ্ঞাপন একদম নেওয়া হয় না।

না না, কুকুর নয়। হারানোর বিজ্ঞাপনও না। আমি একটা ট্রামের মান্থলি টিকিট খুঁজে পেয়েছি। আজ বেলা সাড়ে বারোটার সময় ট্রামের মধ্যেই পড়েছিল মান্থলিটা।

বিশদ বিবরণ দিন। বিজ্ঞাপন-বিভাগের কর্মচারী কপি লিখে নিতে তৈরি হন।

মান্থলিটার খাপে G-H G-H মার্কা মারা…

জি-এইচ জি-এইচ? লাফিয়ে ওঠেন ঘনশ্যাম–ও তো আমার মান্থলি। আমার নাম ঘনশ্যাম ঘাই। তারই আদ্যাক্ষর জি-এইচ জি-এইচ।

তাই নাকি? বলুন তো আর কি ছিল সেই মান্থলির ভেতরে?

একশো টাকার দু-খানা নোট-মোট দুশো টাকা। কিছু খুচররাও থাকতে পারে। নোটের নম্বর দিতে পারি তবে তার জন্যে দয়া করে আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিতে হবে একবার। আমার নোটবুকে টোকা আছে নম্বর।

তার দরকার নেই–এই নিন আপনার মান্থলি আর টাকাটা। বিজ্ঞাপন দেওয়ার খরচটা আমার বেঁচে গেল মশাই, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ আপনাকেও। আমিও ঐ মান্থলির জন্যই বিজ্ঞাপন দিতে এসেছিলাম। আমার নাতি বলছিল যে বিজ্ঞাপন দিলে নাকি কাজ হয়। তা, দেখছি ব্যাপারটা সত্যি!

ভারী বুদ্ধিমান তো আপনার নাতি!

সে কথা বলতে। অমন ছেলে আর হয় না। তিনি গালভরা হাসি হাসেন– এমন কি বিজ্ঞাপন না দিয়েও কেবল দিতে এলেই কাজ হয় তাও দেখলাম।

বিহার মন্ত্রীর সান্ধ্য বিহার

সেবার পুজোর সেই বিহারেই যেতে হলো আবার।

ভূমিকম্পের পর থেকে বিহারের নাম করলেই আমার হৃৎঙ্কম্প হয়।

আর্থাকোয়েক আর হার্টফেল নোটিশ না দিয়েই এসে পড়ে, আর নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতে কাজ সেরে চলে যায়।

তুমি হয়তো বলবে, ও-দুটোরই দরকার আছে। প্রাচীণ বাড়ি-ঘর যেমন শহরের বুকে কদর্যতা, তেমনি সেকেলে শহর-টহর পৃথিবীর পিঠে আর্বজনা–ভূপৃষ্ঠ থেকে ওরা কি সহজে সরতে ভূমিকম্প না থাকলে? এতো আর এক আধখানা পুরানো ইমারত নয় যে, মেরামত করে টরে বদলে ফেলবে? একে তো সারিরে সরানো যায় না, সরিয়ে সারাতে হয়–আর ভেঙ্গে গড়বার জন্য শহরকে–শহর সরিয়ে ফেলা কি চারটিখানি কথা?

তারপর হার্টফেল হ্যাঁ–ওটাও সেকেলে লোকদের জন্যই, তুমি বলবে। নিজের হৃদয়ের কাছে হেলাফেলা না পেলে বুড়ো মানুষরা কি মরতে চাইতো সহজে? আধমরা হয়েও আধাখাচরা জীবনকে আঁকড়ে ধরে থাকতো–বলবে তুমি।

তুমি তো বলেই খালাস, কিন্তু আমি যে নিজেকে যথেষ্ট সেকেলে মনে করতে পারছিনে, নতুবা বিহারে পা বাড়াতে আর কি আপত্তি ছিল আমার? হৃৎকম্প থেকে হৃঝম্প একটার থেকে আরেকটার কতখানি বা দুরত্ব?

যাক–সেই বিহারেই যেতে হলো বেড়াতে।

গেছলাম যেখানে, জায়গাটার নাম করব না, আমার পিশেমশাই সেখানে দারোগা আর হাসপাতালে ডাক্তার হচ্ছেন সাক্ষাৎ আমার মেসোমশাই।

দারোগার দোর্দন্ড প্রতাপে যারা রোগা হয়ে পড়ে, অচিরাৎ ডাক্তারের কবলে তাদের আসতে হয়; কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে তারা কোথায় যায়, ডাকঘরে খবর নিয়েও তার হদিশ মেলে না। অর্থাৎ তারা একেবারে সুদূরপরাহত হয়ে যায়। রোগী আর রোগ দুজনকেই যুগপৎ আরোগ্য করার দিকে কেমন যেন একটা গো আছে মেলোমশায়ের।

পই পই করে বলে দিয়েছিলেন মা-মরে গেলেও ওষুধ খাসনে। হাজার অসুখ করলেও মেলোমশায়ের কাছে যাসনে।

আর পিসেমশাই? তার কাছে গেছি কি, অমনি তিনি ছাতুখোর পাহারাওয়ালাদের দিয়ে আমাকে পিসে ফেলে আরেক প্রস্থ ছাতু বানিয়ে থানায় পুরে রাখবেন আমায়, কিন্তু এসে দেখলাম। যতটা ভয় করা গেছল, ততটা না; তেমন মারাত্মক কিছু না। মেশোমশায়ের তো মায়ার শরীর, রোগযন্ত্রনা রুগীর যদি বা সয়, ওঁর আদপেই সহ্য হয় না, রোগের যাতনা লঘু করতে গিয়ে রুগীকেই লাঘব করে ফেলেন তিনি–আর পিশেমশাই? সারা পৃথিবীটাই তার কাছে মায়া! দুনিয়াটাই জেলখানা তাঁর কাছে। তাই দুনিয়াটাকেই জেলখানায় পুরতে পারলে তিনি বাঁচেন।

তবে আমার অন্তত ভয়ের কিছু ছিল না কোনো পক্ষ থেকেই। আমার প্রতি ভয়ানক অমায়িক ওরাঁ দুজনেই। দু-একদিনেই ভুব ভাব জমে গেল আমাদের।

একদা পড়ন্ত বিকেলে হাসপাতালের ডাক্তারখানায় বসে মেসোমশায়ের সঙ্গে খোস গল্প করছি, এমন সময় এক খোট্টই মার্কা রুগী আস্তে আস্তে এসে হাজির হোলো সেখানে। দেখলেই বোঝা যায়, দেহাতী লোক, যন্ত্রনাবিকৃত মুখ। এসেই বিরাট সেলাম ঠুকলো মেসোমশাইকে।

মেশোমশাই তাকে আমলই দিলেন না। তোর মনে থাকবার কথা না তুই আর তখন কতটুকু! তবে তোর মাকে জিজ্ঞেস করিস। অনেকরকম খোস দেখেছি, সারিয়েছিও, কিন্তু সে কি খোস রে বাবা–!

সে খোস-গল্পের স্বয়ং আমি জড়িত, তা আমার ভালো লাগবার কথা নয়। আমি তেমন উৎসাহ দেখাই না; কিন্তু মেসোমশাইকে উৎসাহ দেখাতে হয় না।

যেন আমাদের দেখোস। কত বৈদ্য-হাকিম হদ্দ হয়ে গেল। কিন্তু সারিয়েছিল কে তোর সেই খোশ-পাঁচড়া? শুনি? এই শৰ্মাই! সবে তকন মেডিকেল কলেজ ঢুকেছি–তখনই। তুই মরিস খোসের জ্বালায়, আর আমার মরি খোশবুর জ্বালায়–!

খোশবু কি মেশোমশাই? অনুসন্ধিৎসু হতে হয়, জেনারেল নলেজের পরিধি বাড়াবার প্রায়স পাই।

তোর সেই খোস পচে গিয়ে কী গন্ধই না বেরিয়েছিল, বাপস! আমি যতই বোঝাই তোর মাকে যে আগে আম ডাসা থাকে, তারপর পাকে, তারপর পচে, তারপরে শুকোয়, তারপরেই তো হয় আমসি–তখনই হলো গিয়ে আমের আরাম! আমাশা সারাতেও সেই কথা। তোর মা ততই বলেন, ছেলেটাকে তুমিই সারালে সনাতন! আরো বাপ, বলল যে সারালে, তা না সারলে। আর সারলে কি এক হোলো? দুটো কি এক ক্রিয়াপদ? আকারের তফাৎ নেই দুজনের?।

তবে সারালো কিসে? এবার আর নিজের খোস গল্পে সাগ্রহে যোগ না দিয়ে পারি না।

সারলো যেমন করে যাবতীয় ঘা সারে–যেমন করে ডাক্তারী-মতে সরিয়ে থাকি আমরা। খোস পচে হলো শোষ, শোষ থেকে হলো কাবাঙ্কল–তারপরে সারলো, সহজেই সারলো, শুকিয়ে গিয়ে সেরে গেল শেষে। সারবেই, ও তো জানা কথা, কলেরা হলেই আমাশা সেরে যায়–সারছে না আমাশা–কলেরা করে দাও, তারপর তখন নুনজল দাও ঠেসে। হামেশাই এই করে সারাচ্ছি–আরে, চিকিচ্ছে কি চারটিখানি কথা? হয় এম্পার, নয় ওস্পার! ডাক্তারকে ধরে দুর্গা বলে ঝুলে পড়তে হয়।

তা বটে।

সারানোর পদ্ধতিই এই। বাতের কি কোনো চিকিচ্ছে আছে? মানে, সোজাসুজি চিকিছে? উঁহু! কেবল পক্ষাঘাত হলেই বাত সারে। তারপর পক্ষাঘাতের ওষুধ হলোগে ম্যালেরিয়া। জ্বরের যা কাঁপুনি বাপু, সাতখানা কম্বল চাপা দিলেও বাগ মানে না, লাফিয়ে ওঠে রোগী। আর যাঁহাতক লাফানো, তাঁহাতক পক্ষাঘাত–সারা!

কিন্তু ম্যালেরিয়া থেকে গেল যে?

পাগল! জ্বর সারাতে কতক্ষণ? দুশো গ্রেন কুইনিন ঠেসে দাও, একদিনেই দুশ্মে। তারপর আর দেখতে শুনতে হবে না–

কিন্তু ম্যালেরিয়া আবার সময়মত পাওয়া গেলে হয়! আমি সন্দেহ প্রকাশ করি।

আরে, ম্যালেরিয়ার আবার অভাব আছে এদেশে? এনোফিলিস তো চারধারেই কিলবিল করছে। ডাক্তারের চেয়ে তাদের সংখ্যা কি কিছু কম, তুই ভেবেছিস? তবু যদি বিহারের এ-অঞ্চলে নিতান্তই না মেলে, পক্ষাঘাতের রুগীকে আমি চেঞ্জে পাঠিয়ে দিই বর্ধমানে! আমার কাত হয়ে রুগী যে বাত সারিয়ে ফিরে এসেছে বর্ধমান থেকে! তবে–

অকস্মাৎ থেমে যান মেসোমশাই। তারপর কতিপয় হ্রস্ব-নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলেন–কতক আর ফেরেনি রে! তাদের শেষটা নিউমোনিয়া ধরে গেল কিনা!

ও! নিউমোনিয়া হলে বুঝি আর সারে না মেসোমশাই? আমার কৌতূহল হয়। না কি, টাইফয়েড হলে তবেই তা সারবার?

মেসোমশাই নিরুত্তর।

গোদ কিংবা গলগন্ড হলে সারে বুঝি?

মেসোমশাই মাথা নেড়ে বাধা দেন।

তবে কি–তবে কি–সর্দিগর্মিই হওয়া চাই?

উঁহই। হার্টফেল হলে তবেই সারে নিউমোনিয়া। বলেই মেসোমশাই গম্ভীর হয়ে যান বেজায়।

তাহলে তো মারাই গেল? গেল নাকি? আমার সংশয় ব্যক্ত হয়।

গেলই তো! মেসোমশাই কোপান্বিতি হন–যাবেই তো! যত সব আনাড়িকেষ্ট বর্ধমানের! কেন যে রুগীদের নিউমোনিয়া হতে দ্যায় ভেবেই পাই না। সারানো না যাক, নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক ছিল তো!

ছিলো! প্রতিষেধক থাকতে বেচারা বেতো-রুগীরা মারা গেল অমন বেঘোরে? বলেন কি মেসোমশাই? আমি প্রায় লাফিয়ে উঠি। ছিলো প্রতিষেধক?

ছিলোই তো! ম্যালেরিয়া থেকে কালাজ্বর করে দিতে পারতো! কালাজ্বরের তো ভালো চিকিচ্ছেই রয়েছে। ইউরিয়া স্টিবামাইন! আমাদের উপেন ব্রহ্মচারীর বের করা। নেহাৎপক্ষে যক্ষ্মা তো ছিল–যক্ষ্মা হলে আর নিউমোনিয়া হয় না। হাতি যেখান দিয়ে যায়, ইঁদুর কি সে-ধার মাড়ায় রে? ঘোড়া যেখানে ঘাস খায়, বাছুর কি সে জায়গা ঘেঁসে কখনো?

আমি একটু হতাশ হয়েই পড়ি। কিন্তু যক্ষ্মা হলে আর কি হোলো! যক্ষ্ম কি সারে আর?

সারে না আবার! তেমন গা ঝেড়ে বসন্ত হয়ে গেলে যক্ষ্মা তো যক্ষ্মা, যক্ষ্মার বাবা অবদি সেরে যায়! পকসের জার্মের কাছে লাগে আবার যক্ষ্মার ব্যসিলি :!

বসন্ত! শুনে আরো দমে যাই আমি।-–বসন্ত কি ইচ্ছে করলেই হয় সবার?

আলবৎ হয়–হবে না কেন? মেসোমশাই বেশ জোরালো হয়ে ওঠেন–টিকে না নিলেও হবে। আর টিকে যদি নিয়েছে, তাহলে তো কথাই নেই।

সেই পাগড়ি-পরা লোকটি এতক্ষণ অস্ফুট কাতরোক্তি দিয়ে মেলোমশায়ের মনোযোগ আকর্ষণের দুশ্চেষ্টা করছিল, এবার যে অর্ধস্ফুট হয়ে ওঠে–বাবুজি!

মেসোমশাই কিন্তু কর্ণপাত করেন না–এসব তথ্য বুঝতে হলে ডাক্তার হওয়া লাগে। তাই তো ডাক্তার হতে বলছি তেকে। বলি যে, ডাক্তারি পড় বোকাঁচন্দর।

মেসোমশায়ের আদুরে ডাকে আমার রোমাঞ্চ হয়।

আমপনার চিকিচ্ছে তো খাসা মেসোমশাই, ওষুধ খর্চা হয় না! রোগ দিয়েই রোগ সারিয়ে দ্যান! যাকে বলে রোগারোগ্য, বাঃ!

বিলক্ষণ! ওষুধ দিয়েই তো সারাই বিনা ওষুধে কি সারে? কিন্তু ওষুধের কাজটা হোলো কি? আরেকটা ব্যামো দেহে ঢুকি য়ে তবেই না একটা সারানো। উকিলদের যেমন! আরেকটা মামলার পথ পরিষ্কার করে, তাহলেই তাদের একন্ন মেটে! আমাদের ডাক্তারদেরও তাই! ওষুধ দিয়ে আনকোরা একটা ব্যারামের আমদানি না করলে কি–

দেহাতী লোকটির দেহ হঠাৎ যেন কুঁকড়ে যায়। তার আর্তনাদে আমাদের আলোচনা ব্যাহত হয়। বাবুজী হম মর গিয়া!

মেসোমশাই চটেই যান–ক্যা হুয়া, হুয়া ক্যা?

বহুৎ শির দুখাতা, আউর পিঠমে ভি দরত—

আভি কেয়া? কল ফজিরমে আও! যো বখৎ হাসপাতাল খুলা রহতা–

নেই বাবুজি, মর যায়গা, গোড় লাগি। হামারা বোখার ভি আগয়ী–

কাকুতি-মিনতিতে মেশোমশাই ঈষৎ টলেন। থার্মোমিটারটা বার করেন; কিন্তু থার্মোমিটারের কাঠিটাকে খাপ থেকে বার করার কথা তিনি বিস্মৃত হন, খাপ-সমেত সমস্তটাই অবহেলাভরে দ্যান বেচারার বগলে ভরে।

তারপর সখাপ সেটাকে বগল থেকে বহিষ্কৃত করে সামনে এসে মনোযোগ সহকারে কি যেন পাঠ করেন। অতঃপর ওঁর মন্তব্য হয়–হুঁম বোঘর ভি হুয়া জারাসে!

প্রয়োজন ছিল না, তবু আমিও কিঞ্চিৎ ডাক্তারি বিদ্যা ফলাই–হুয়া বই কি! জারা লাগতি তো? জারা জারা?

মেসোমশাই ছাপানো ফর্মে খস খস করে দুলাইন ঝেড়ে দ্যান। ও প্রেসকৃপসন আমিও লিখে দিতে পারতুম! ব্যবস্থাপত্রের বাঁধা গৎ আমার জানা। আমার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে ডিসপেনসিং রুমের প্রকাণ্ড কাঁচের জার এবং তার আভ্যন্তরীণ অদ্বিতীয় মহৌষধ যার রঙ কখনো লাল, কখনো বেগুনী, কখনো বা ফিকে জরদা। সর্দি-কাশি কি পেটব্যাথা, পিত্তশুল কি পিলে জ্বর, জরবিকার কি গলগণ্ড–যারই রুগী আসুক না কেন, সবারই সে এক দাবাই, সর্বজীবে সমদৃষ্টি সমদৃষ্টি মেলোমশায়ের, ভদ্রলোকে এক কথায় মত একমাত্র ব্যবস্থা।

পিঠে দারদওয়ালার বেলাও অবশ্য তার অন্যথা হয়নি, সেই একমাত্র ওষুধের একমাত্রা বা একাধিক নিশ্চয়ই তিনি বরাদ্দ করে দিয়েছেন– অকাতরেই। সে-বেচারা চিরকূট নিয়ে দাবাইখানার দিকে এগুতেই আমিও মেলোমশায়ের কাছ থেকে কেটে পড়ি। ডাক্তারি-বিদ্যা এক ধাক্কায় অনেকখানি হজম করা সহজ নয় আমার পক্ষে।

হাওয়া টাওয়া খেয়ে ফিরতে একটু রাতই হয়। পিসেমশায়ের নিকটে যাই–রাত্রের আহারটা তার আস্তানাতেই চলে কিনা! ইয়া ইয়া মাছ, মুরগী আর পাটা কোত্থেকে না কোত্থেকে প্রায় প্রত্যহই জুটে যায় পিসেমশায়ের পয়সা খরচ করে কিনতে হয় না। নৈশপর্বটা আমাদের জোরালো হয় স্বভাবতঃই।

থানায় পৌঁছেই দেখি, সেখানেও এসে জুটেছে সেই পাগড়ি-পরা লোকটা। আড়াই মাইল দুরে কোথায় তার আত্মীয়ের বাড়ি কি চুরি গেছে না কোন হাঙ্গামা হয়েছে তারই তদন্তে নিয়ে যেতে চায় পিসেমশাইকে। পিসেমশাই তাকে খুব বকেছেন, ধমকেছেন দাবড়ি দিয়েছেন হাজতে পোরাবার ভয় দেখিয়েছেন–কিন্তু লোকটা নাছোড়বান্দা, দারোগা দেখে সহজে রেগো হবার পাত্র না। পিসেমশাই রাত্রে এক পা নড়তে নারাজ, অগত্যা, সেই পাগড়ি পরা দশটা টাকা তার হাতে গুঁজে দিয়েছে, তখন তিনি কেসটা কেবল ডারেরীতে টুকে নিয়ে প্রস্তুত হয়েছেন। এখানে আসা অবধি বরাবর আমি লক্ষ্য করেছি, পিসেমশায়ের বামহাত দক্ষিণের জন্যে ভারি কাতর–বেশ একটু উদ্ব্যগ্র বললেই হয়–আর দক্ষিণহাত কি ইতর, কি ভদ্র–সবার প্রতি স্বভাবতঃই কেমন বাম–সবাইকে গলহস্ত দেবার জন্যে সর্বদাই যেন শশব্যস্ত হয়ে আছে।

ডায়েরী লেখা শুরু করেন পিসেমসাই। নামধাম জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁর প্রশ্ন হয়–কেয়া কাম করতে হো?

মন্ত্ৰীকা কাম।

কেয়া? মিস্ত্রীকা কাম? কনটাকে চাগিয়ে নেন পিসেমশাই।

নেহি নেহি, জি! মিস্ত্রী নেহি–মন্ত্রী!

সমঝ গিয়া! পিসেমশাই লিখে নেন তাঁর ডায়েরীতে। আমাকে বলেন–আমরা যাদের মিস্তির বলি এইসব দেহাতী লোকেরা তাদেরই মন্ত্রী বলে, বুঝেচিস? লেখাপড়া জানে না তো, অকাট মুখখু, আবার সমসকত করে বলা হচ্ছে?

মন্ত্রীকা কাম…।

তারপর পাগড়ি পরার দিকে ফেরেন?

সমঝ গিয়া! কেয়া মন্ত্রী? রাজমন্ত্রী, না ছুতোর-মন্ত্রী?

রাজমন্ত্রী! বিরক্ত হয়েই বুঝি জবাব দ্যায় পাগড়ি-পরা।

ওই যো-লোক দেশকো ইমারত বনা? বাঁশকো ভারা বাঁধতে মাথপর ইঁটকো বোঝা লোক উপর উঠতা–? পিসেমশাই প্রাঞ্জল ব্যাখা দ্বারা পরিষ্কাররূপে প্রাণিধান করতে চান।

জি হ্যাঁ,! বহুত ভারী বোঝা! সায় দ্যায় সে।

উসি ব্যাস্তে তুমারা শির দুখাতর? নেহি জি? আমি জিজ্ঞাসা করি। এতক্ষণে ওর দাবাইখানা যাবার কারণ আমি টের পাই।

পিঠমে ভির দরদ! সে বলে একটু মুচকি হেসে। উসি বাস্তে।

পিসেমশাই তার জেরা চালিয়ে যান–উঠনেকা বখ? কভি কভি গিরভি যাতা উলোক–ঐ রাজমন্ত্রী লোক? কেয়া নেহি?

ঠিক হ্যায়। পাগড়ি পরা ঘাড় নাড়ে।–কভি কভি।

বহুৎ ধ্বস্তাধস্তি, বিস্তর বাদানুবাদের পর ডায়েরী লেখা শেষ হয়! লোকটা চলে গেলে পিসেমশাই নোটখানা খুলে দ্যাখেন, পরীক্ষা করেন আসল কি জাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন তিনি–না, আসলই বটে, তবে চোরাই কিনা কে জানে! কোনো মিনিস্টারের পকেট মেরে আনা নয় তো?

কি করে জানলেন? শার্লক হোমসের জুড়িদার বলে সন্দেহ হয় আমার পিসেমসাইকে।

ক্যাবিনেটেরে একজনের নামের মত নাম লেখা নোটের গায়ে। তবে নাও হতে পারে। এসব তো এধারের বাজার-চলতি চালু নাম, অনেক ব্যাটারই এমন আছে।

সকালবেলায় খাওয়াটা মেলোমশায়ের বাড়িতেই হয় আমার। রাত্রের গুরুভোজনের পর ঘুম থেকে উঠে পিসেমশায়ের সঙ্গে একচোট দাবা খেলে স্নান টান সেরে যেতে প্রায় বারোটাই বেজে যায়।

আজ গিয়ে দেখি মাসীমা বিচলিত ভারী। মেসোমশাই হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে সেই যে সাত সকালে হাসপাতালে গেছেন, ফেরেননি এখনো। কারণ জিজ্ঞাসা করি।

মাসীমা বলেন–কাল বিকেলে হাসপাতালে কে একটা উটমুখো এসেছিল না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি তখন ছিলাম তো। কে এক রাজমিস্ত্রী না ছুতোরমিস্ত্রী!

সেই সর্বনেশের কাণ্ড দয়াখো! টেবিলের ওপর খোলা চিঠিটার দিকে দৃকপাত করেন মাসীমা–খুব বিরক্তিভরেই।

আগাপাশতলা পড়ে দেখি চিঠিটা বিহারের জনৈক মন্ত্রী লিখছেন–নামটা নাই করলাম–লিখেছেন অনেক কথাই। তিনি জানিয়েছেন যে, থার্মোমিটারের খাপের, যে কোনো নামী মেকারের যত দামী জিনিসই হোক না কেন, বগলে গলিয়ে দিলেই কিছু জ্বার-উত্তোলনের ক্ষমতা জন্মে না, বরং তাকে বগলদাবাই করাই এক বিড়ম্বনা। উপরন্তু আরো বিশেষ করে এই কথাও তিনি জানাতে চেয়েছেন যে, সবাই হচ্ছে চিকিৎসকের ধর্ম; যখন, যে সময়ে, যে অবস্থাতেই রোগার্ত আসুক না কেন, তাকে সুস্থ না করা পর্যন্ত ডাক্তার তটস্থ থাকবেন, তা সে রুগী ইতরই হোক, কি দ্রই হোক! গরীবই হোক, আর বড়লোকই হোক; সরকারী ভারী চাকুরেই হোক কি সে বেসরকারী ভবঘুরেই হোক;

তা ছাড়া আরো তিনি বলেছেন : আমরা–সরকারী কর্মচারীরা, তা মন্ত্রীই হই, কি ডাক্তারই হই; দারোগা হই; দারোগা হইয়া বা পাহারাওয়ালাই হই; ভুলেও যেন কখনো না মনে ভাবি যে, আমরাই জনসাধারণের মনিব। জনসাধারণেরই নিছক খাই, তাদের সেবার জন্যেই আছি, আমরা তাদের ভৃত্য মাত্র।

ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ সদুপদেশের পর তাঁর সার কথাটি আসে সর্বশেষে। নিজের দুরবস্থা তো তিনি স্বচক্ষেই কাল দেখে গেছেন হাসপাতালের আর সব রুগীরা কিভাবে আছে, তাদের দুর্দশা পর্যবেক্ষণ করতে আজ স্বয়ং তিনি সেই তিনিই আসবেন…ছদ্মবেশে নয় অবিশ্যি এবার–ভদ্রবেশে প্রকাশ্যরূপে!

ছুটি হাসপাতালে।

গিয়ে দেখি বিপর্যয় ব্যাপার! বেজায় হৈ হৈ, ভারী শশব্যস্ততা সবদিকে। প্রেসকৃপশন সব পালাটানো হচ্ছে, বদলানো হচ্ছে খাতা-পত্ৰ, রঙ-বেরঙের ভালো ভালো দাবাই পড়ছে রুগীদের শিশিতে। মিনিস্টার আসছেন হাসপাতাল পরিদর্শনে! বহুরূপী সেজে নয়–দস্তুরমত সরকারী কেতায়! অফিসিয়াল ভিজিট–যা তা না!

কাজেই, নিঃশ্বাস ফেলবার ফুরসৎ নেই মেলোমশায়ের। হাসপাতালের কায়েমী রুগীদের অনেক করে জপানো হচ্ছে চিকিৎসার কিরকম সুব্যবস্থা করা হয় এখানে ওদের। ঘণ্টায় ঘন্টায় কি সব সুপাচ্য ও সুপৃথ্য ওদের দেওয়া হয়। এই যেমন–আঙ্গুর-বেদনা, সাগু-মিছরি, দুধ-বার্লি, মাখন পাউরুটি, সূপ-সুরুয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনাস্বাদিত তালিকা মুখস্থ করতে করতে হাঁপ ধরে যাচ্ছে, নাভিশ্বাস উঠছে বেচারাদের, মনে মনে তারা গাল পাড়ছে মিনিস্টারকে।

ওদের মধ্যে দু-একজন আবার হয়তো যুধিষ্ঠির সেজে বসেছে, তারা দাবি করেছে, শুধু শুধু মিথ্যেকথা বলা তাদের ধাতে পোষাবে না, উপরোক্ত খাদ্যখাদ্যগুলি বস্তুত যে কি চীজ, কেবল কানে শুনে সঠিক ধারণা করা যায় না, এমন কি চোখে দেখাও যথেষ্ট নয়, চোখে দেখার দরকার। ঐ তালিকা মনে রাখবার মতো মুখস্থ করতে হলে সত্যি সত্যিই ওদের মুখস্থ করে দেখতে হবে। তাদের সত্যবাদিতার পরাকাষ্ঠা বজায় রাখতে রান্নার তোড়জোড় করতে হয়েছে। নাজেহাল হয়ে পড়েছেন মেসোমসাই।

ডাক্তারখানায় তো এই দৃশ্য! সেখানে থেকে সটান ছুটি থানায়। সেখানে আবার কি দুর্ঘটনা, কে জানে।

গিয়ে দেখি পিসেমশাই তো মাথা হাত দিয়ে বসে পড়েছেন। তিনিও পেয়েছেন এক চিঠি।

চিঠির আসল মর্ম–আসল মর্ম তিনিই জানেন কেবল! কাউকে জানতে দিচ্ছেন না তিনি। দাবাবোডেরা তাঁর পাশেই গড়াগড়ি যাচ্ছে, তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের মতই তার মুখ বেশ থমথমে। কার সাধ্য, তার কাছে ঘেঁসে! মনে হয় কে যেন মশাই! পিসে ফেলেছে আমার পিসেমশাইকে—আপাদমস্তক–একেবারে পা থেকে শিরোপা অব্দি।

ওধারে হাসপাতালে ভূমিকম্প দেখে এলাম, এখানে যা দেখছি, তাতে তো হৃঙ্কম্পের ধাক্কা!

পিসেমশায়ের এক দাবা, আর সেসোমশায়ের একমাত্র—দাবাই–এসে অবধি কেবল এই দেখছি এঁদের দুজনের। এই দিয়েই এতদিন এখানকার সবাইকে ওঁরা দাবিয়ে এসেছেন; কিন্তু আজ যেন ওঁরাই দাবিত–নিজের চালে নিজেরাই মাত হয়ে গেছেন কিরকমে! ওঁদের কাত দেখে আমারো ভারী রাগ হয়–কিন্তু কার ওপর যে বুঝতে পারি না সঠিক!

ভূমিকম্পেরই দেশ বটে বিহার! ছোটখাটো ভুমিকম্প যেখানে সেখানে যখন তখন লেগেই রয়েছে ও অঞ্চলে আজকাল!

ভালুকের স্বর্গলাভ

গল্প কেমন লিখি জানিনে, কিন্তু শিকারী হিসেবে যে নেহাৎ কম যাই না, এই বইয়ের আমার ভালুক শিকার, এই তোমরা তার পরিচয় পেয়েছে। আমার মাসতুতো বড়দাদাও যে কত বড় শিকারী, তাও তোমাদের আর অজানা নেই। এবার আমার মামাত ছোট ভাইয়ের একটা শিকার-কাহিনী তোমাদের বলব। পড়লেই বুঝতে পারবে, ইনিও নিতান্ত কম যান না। হবে না কেন, আমারই ছোট ভাই।

গল্পটা, যতদূর সম্ভব, তার নিজের ভাষাতেই বলবার চেষ্টা করা গেলঃ

ভালুকদের ওপর আমার বরাবর ঝোঁক, ছোটবেলা থেকেই। দাদুর ভালুক শিকারের গল্পটা শুনে অবধি, ভালুকদের ওপর আমার ছোটবেলার টানটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেল। সর্বদাই মনে হয়, কোন ফাঁকে একটা ভালুক শিকার করি। কিন্তু শিকারের জন্য এয়ারগান পাওয়া সোজা হতে পারে (আমাদের দেবুই একটা আছে)–কিন্তু ভালুক যোগাড় করাই শক্ত। অবশ্য রাস্তায় প্রায়ই ভালুকওয়ালাদের দেখা পাওয়া যায় সেসব নিঃসন্ধিগ্ধ নৃত্যপটু ভালুকদের শিকার করাও অনেকটা সহজ, কিন্তু তাতে ভালুকদের আপত্তি না থাকলেও তাদের গার্জেনদের রাজি করানো যাবে কি না সন্দেহ।

কিন্তু চমৎকার সুযোগ মিলে গেল হঠাৎ। আমাদের পাহাড়ে দেশে সার্কাস–টার্কাস বড় একটা আসে না। সার্কাস দেখতে হলে আমরা কলকাতায় যাই বড়দিনে দাদার ওখানে। যাই হোক, এবার একটা সার্কাস এসে পড়েছে আমাদের অঞ্চলে। শুনলাম, অনেকগুলো ভালুকও এনেছে তারা। ভারী আনন্দ হল।

দেবুকে গিয়ে বললাম, এই, তোর বন্দুকটা দিবি দিন কতোর জন্যে?

কি করবি?

ভালুক শিকারের চেষ্টা দেখব।

আমার এটা তো এয়ার-গান, এতে কি ভালুক মরে? কেন অমল, তোর তো সেজকাকারই ভাল বন্দুক রয়েছে।

দুর, সেটা বেজায় ভারী। তোলাই দায়, ছোঁড়া তো পরের কথা। তাছাড়া আমি একটা গল্পে পড়েছি, ভারি বন্দুক ভালুক-শিকারের পক্ষে বড় সুবিধের নয়।

ও, তোর সেই দাদার গল্পটা? কিন্তু আমি যে এটা দিয়ে কাকমারি।

এট হল গিয়ে দেবুর স্রেফ গুল। বললে কাক মারি, কিন্তু আসলে ওই ও মাছি তাড়ায়। এয়ার গান থাকে ওর পড়ার টেবিলে, সেখানে কাকা একটাও নেই, কিন্তু যত রাজ্যের মাছি।

বেশ, আমি তোকে একটা জিনিস দেব, তাতে মারা না যাক কাক ধরা পড়বে।–দেবু উৎসুকচোখে তাকায়–আমার ক্যামেরাটা দেব তোকে ওর বদলে। কাকের ছবি ধরা আর কাক ধরা একই ব্যাপার নয় কি?

দেবু সে কথা মেনে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহিত হয়ে উঠে। আমার জাইস, আইকনের সঙ্গে ওর বন্দুকটা বিনিময় করে আমরা দুজনেই বেরিয়ে পড়ি সার্কাসের তাঁবুর উদ্দেশ্যে–ভালুক মারার মত্সব নিয়ে আমি, আর ভালুক ধরার উৎসাহ নিয়ে দেবু।

বাজারের কাছ দিয়ে যাবার দেবু এক গাদা কালো জাম কেনে। আমার দিকে, বোধ করি তার স্মরণশক্তির পরিচয় দেবার জন্যই, গর্বভরে তাকায়–জানিস, ভালুকেরা জাম খেতে ভাল বাসে?

হুঁ, জানি; কিন্তু যাকে শিকার করতে যাচ্ছি তাকে জাম খাওয়ানো আমি পছন্দ করি না–সাবাড়ের আগে খাবারের ব্যবস্থা একটা নিষ্ঠুর ব্যবহার নয় কি? আমার মতে ওটা দস্তুরমত অত্যাচার-ভালুকের প্রতি এবং নিজের পকেটের প্রতি। দেবুকে জবাব দিই, ভালুকের সঙ্গে ভাব করা তো মলব নেই আমার।

সার্কাসের তাঁবুর পেছন দিকটায় জানোয়ারের মিনেজারী–হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, ভালুক, জেব্রা–একটা উটও দেখলাম। খোটায় বাঁধা হাতি শুঁড় তুলে অপরিচিত লোককেও সেলাম ঠুকছে, জেব্রা এবং উটও কম দর্শক আকর্ষণ করেনি। কতকগুলো ছোঁড়া বাঘের খাঁচার দিকে গিয়ে ভিড়েছে, ওদের আফিং খাইয়ে রাখা হয় কিনা এই হলো ওদের আলোচ্য বিষয়। দেখা গেল, বাঘেরা মনোযোগ দিয়ে সেই গবেষণা শুনছে এবং মাঝে মাঝে হাই তুলে ওদের কথা সমর্থন করছে।

মোটের উপর সমস্তটা জড়িয়ে বেশ উপভোেদ্য ব্যাপার। কিন্তু এ সমস্ত থেকে কাঠোরভাবে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে ভালুকের খাঁচার দিকে আমার অগ্রসর হলাম।

পথে-ঘাটে সর্বদাই যাদের দেখা মেলে স্বভাবতঃই তাদের মর্যাদা কম; বেচারা ভালুকদের বরাতে তাই একটিও -য়্যাডমায়ারার- জোটেনি।

একটি বড় খাঁচার একধারে দুটো মোটাসোটা ভালুক–আর তার পাশেই পার্টিশান-করা অন্য ধারে একটা বেঁচে ভালুক। পার্টিশানের মাঝখানের দরজাটা বাইরে থেকে লাগানো। এতক্ষণ অবধি কোনো সমঝদার না পেয়ে মোটা ভালুক দুটো যেন মুষড়ে পড়েছিল, আমাদের দুজনকে যেতে দেখে নড়ে-চড়ে বসল। কিন্তু বেঁটে ভালুকটার বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। বুঝলাম নিতান্ত উজবুক বলেই ওটাকে আলাদা করে রেখেছে।

দেবু পকেট থেকে একমুঠো জাম বার করল–তাই না দেখে বেঁটে ভালুকটার লম্ফঝম্ফ দেখে কে? কিন্তু আমরা প্রথমে দিলাম মোটা ভালুকদের, তারা দু-একটা চাখলো মাত্র, তারপর আর ছুঁলোও না। এই ভালুক দুটোর টেস্ট উঁচুদরের বলতে হবে, কেননা আমরাও রাস্তায় চেখে দেখেছি জামগুলো একেবারে অখাদ্য, এমন বিশ্রী জঘন্য জাম প্রায় দেখা যায় না।

কিন্তু বেঁটে ভালুকটা তা-ই অম্লানবদনে সবগুলো খেলো; খেয়ে আবার হাত বাড়ায়! দেবু দুপকেট উলটিয়ে জানায় যে হোপলেস আর আগ্রহের নিবৃত্তি হয় না। বুঝলাম ব্যাটার বুদ্ধিশক্তি একটু কম।

দেবু আমার কাছে আবেদন করে,–এই অমল, দে না তোর একটা চকোলেট একে।

আমি অগত্যা বিরক্তিভরে একটা চকোলেট ছুঁড়ে দিই–ভারি হ্যাংলা তো।

দেবু মাথা নেড়ে জানায়, ছেলেমানুষ কিনা। বড় হলে শুধরে যাবে।

কিন্তু ভালুকটা চকোলেট স্পর্শও করে না, জামের জন্য দেবুর জামার নাগাল পাবার চেষ্টা করে। আমি এয়ার-গানের সাহায্যে চকোলেটটা সন্তর্পণে বাগিয়ে এনে বদন ব্যাদান করতেই দেবু বাধা দেয়, খাস নে, সেপটিক হবে।

বাধ্য হলে চকোলেটটা মোটা ভালুকদের দান করতে হয়। যথার্থই ওদের টেস্ট উঁচুদরের। ওদের একজন ওটা সযত্নে কুড়িয়ে নেয়, নিয়ে সুকৌশলে রূপোলী কাগজের মোড়ক খুলে ফেলে চকোলেটটা বার করে, তারপর সমান দুভাগ করে দুজনে মুখে পুরে দেয়। ভালুকদের মধ্যে এরূপ সভ্যতা আর সাধুতা আমি কোনদিন আশা করিনি। একদম অবাক হয়ে যাই। এ রকম ন্যায়পরায়ণ আদর্শ ভালকুকে মারাটা সঙ্গত হবে কিনা এয়ার গান হাতে ভাবতে থাকি।

দেবু চমৎকৃত হয়–দেখছিস কি রকম শিক্ষিত ভালুক। তারপর একটু থেমে যোগ করে–শিক্ষিত প্রাণীদের শিকার করা কি উচিত? অবশেষে আমার মতামত না পেয়েই আপন মনে ঘাড় নাড়তে থাকে–একেই তো আমাদের দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কম,….এই ভালুকটি গেলে স্থান কি আর পূর্ণ হবে?

ওর সহৃদয়তার প্রশ্রয় না দিয়ে গম্ভীরভাবেই জবাব দিই–না, এখন আর শিকার করবো না। সার্কাস দেখবার আগে এদের খতম করা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না।

আড়াইটার শোরর টিকিট কেটে আমি আর দেবু ঢুকে পড়ি; আমার হাতে দেবুর এয়ার-গান, আর দেবুর হাতে আমার ক্যামেরা। স্থিরসংকল্প হয়েই ঢুকেছি, সার্কসের পরেই অব্যর্থ শিকার; কেননা অনেকে ভেবে দেখলাম, সাকার্স-এর সঙ্গে কারকাসই হচ্ছে একমাত্র মিল এবং খুব ভাল মিল। শিকারী জগতে ভয়ানক পিছিয়ে রয়েছি, অন্ততঃ আমার পিসতুতো দাদা এবং তার মাসতুততা বড়দার চেয়ে ত বটেই,–সেই অপবাদ আজ দূর করতে হবে।

প্রথমেই সেই মোটা ভালুক দুটোকে এরিনায় এনে হাজির করেছে। বেঁটেটাকে ওদের সঙ্গে দেবু একটু ক্ষুণ্ণ হলো,–সেই বাচ্চাটাকে আনবে না?

ওটা আস্ত জানোয়ারই আছে, এখনো মানুষ হয়ে ওঠেনি কিনা।

দেবু চুপ করে থাকে, বোধ করি ওর প্রাণের ভালুককে অমানুষ বলাতে মনে মনে দুঃখিত হয়। খানিক বাদে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে, হতভাগার জন্যে জাম এনেছিলাম।

আমি ওর দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকাই–য়্যা? তোরও বুঝি ভালুক শিকারের মতলব? একরাশ ওই বিদঘুঁটে জাম খেয়ে কেউ বাঁচে কখনও? পেটে গেছে কি নির্ঘাৎ ধনুষ্টাংকার। তুই বুঝি জাম খাইয়ে কাজ সারতে চাস? দেবু উত্তর দেয় না। আমি আশ্বাস দিই–তা বেশ ত, এয়ার গানে ঐ জাম পুরে ছুঁড়লে নেহাৎ মন্দ হবে না। জাম খাওয়ানো–কে জাম খাওয়ানো, কাম ফতে–কে কাম ফতে।

দেবু সান্তনা পায় কিনা ও-ই জানে। দেখি ওর দুপকেট জামে ভর্তি। ইতিমধ্যে সেই মোটা ভালুক দুটো বাইসাকেলে চেপে এমন অদ্ভুত কসরৎ দেখাতে থাকে যা নিজের চোখে দেখলেও বিশ্বাস করা যায় না। ভালুকের ভাষা আলাদা না হলে এবং আলাপের সুবিধা থাকলে ওদের কাছ থেকে দুএকটা সাইকেলের প্যাঁচ শিখে নিলে নেহাৎ মন্দ হত না। সেটা সম্ভব কিনা মনে মনে চিন্তা করছি এমন সময়ে দেবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে–আমার সেজ মামা কি বলে জানিস অমল?

দেবুর সেজ মামা কি বলে জানবার আগ্রহ না থাকলেও জিজ্ঞাসা করি। বলে, যে সার্কাসে মানুষে ভালুকের খোলস গায়ে দিয়ে সেজে থাকে। সাইকেলের খেলা দেখে আমার তাই মনে হচ্ছে।

আমি প্রতিবাদ করি–পাগল। আমি কখনো কোনো মানুষকে এমন অদ্ভুত সাইকেল চালাতে দেখিনি, এ কেবল ভালুকের পক্ষেই সম্ভব।

দেবু ঘাড় নাড়ে–তা বটে।

আমি জোর দিয়ে বলি–নিশ্চয়ই তাই। শিক্ষালাভের ফলে কত কি হয় বইতে পড়িসনি? এ তো কিছুই না, আমি যদি ভালুকটাকে তারের ওপর সাইকেল চালাতে দেখি তাহলেও আশ্চর্য হব না।

এমন কি এখুনি যদি ওরা স্পষ্ট বাংলায় কথা কইতে শুরু করে দেয় তাহলেও না।

দেবু সায় দেয়–হু, তা বটে

কায়দা-কসরৎ দেখিয়ে ভালুকেরা চলে গেল। একটু পরে যখন হাতি চার পায়ে একটা পিপের পিঠে দাঁড়াবার দুশ্চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে–আমি দেবুকে অপেক্ষা করতে বলে, অলক্ষ্যে ওদের অনুসরণ করলাম। দেখলাম এখন হাতির কসরতের ওপরেই সকলের যারপরনাই মনোযোগ, ভালুক শিকারের এই হচ্ছে সুযোগ।

সার্কাসের পেছন দিকে, একেবারে তাঁবুর শেষ প্রান্তে ভালুকের আস্তানা। দূর থেকে মনে হলো ভালুক দুটো যেন নিজেদের বাহাদুরির গল্প ফেঁদেছে। বেশ স্পষ্ট দেখলাম ধেড়ে-মোটাটা পিঠ চাপড়ে ছোট ভাইকে সাবাস দিচ্ছে। ওরা কী ভাষায় কথোপকথন করে জানবার কৌতূহল ছিল কিন্তু আমাকে দেখতে পাবামাত্র যেন একদম বোবা মেরে গেল।

আমি বললাম–কি হে ভায়ারা। বেশ তা আজ্ঞা চলছিল, থামলে কেন?

আমার কথা শুনে এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। তার মানে–এই ছেলেটা কি বলছে হ্যাঁ? নিশ্চয়ই আমাদের বুলি ওদের বোধগম্য নয়। উঁহু, স্বদেশী ভালুক না; তবে কি উত্তর মেরুর? যাকে, পোলার বেয়ার বলে, তাই নাকি এরা? পোলার বেয়ার মারতে পারলে বড়দার চেয়ে বড় কীর্তি রাখতে পারব ভেবে মনে ভারি ফুর্তি হল। এয়ার-গানটা বাগিয়ে ধরলাম।

প্রথমে বাচ্চা থেকেই শুরু করা যাক, কিন্তু খাঁচার পাখি শিকার করে আরাম নেই। বেঁটে ভালুকটার খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। বিপদ এবং মুক্তি এক কথা বিপন্মুক্তির সম্মুখীন হয়ে ও যেন প্রথমটা ভ্যাবাচকা খেয়ে গেল। কেননা অনেক ইতস্তত করে তবে সে খাঁচায় নীচে পা বাড়ালো।

এমন একটা অঘটন ঘটল। অকস্মাৎ দৈববাণী হলো–পালাও পালাও, মারাত্মক ভালুক।

চারিদিকে তাকালাম, কেউ কোথাও নেই, সার্কাসের লোকজন সার্কাস নিয়ে ব্যস্ত। তবে এ কার কণ্ঠধ্বনি? নিজের স্বৰ্গতোক্তি বলেও সন্দেহ করবার কারণ ছিল না। ভাল করে চেয়ে দেখি, ওমা, সেই মোটা ভালুকদেরই একজন হাত নাড়ছে আর ওই কথা বলছে।

আগেই আঁচ করা ছিল, তাই আর আশ্চর্য হলাম না। বাংলাভাষাও যে এরা আয়ত্ত করেছে, এই ধরণের একটা সন্দেহ আমার গোড়া থেকেই ছিল। শিক্ষিত ভালুকের পক্ষে একটা বিদেশী ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করা এমন আর বেশি কথা কি? ইতিমধ্যে সেই বেঁটে ভালুকটা দেখি আমার বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে এসে পড়েছে।

মোটা ভালুকটা আবার আওয়াজ ছেড়েছে–ওহে দেখছ না। ভালুক যে।

ভালুক যে, তা অনেকক্ষণ আগেই দেখেছি। ভালুক আমি খুব চিনি। চিনি এবং নিজেকেও চেনাতে জানি–আমি এবং আমার দাদা দুজনেই। কিন্তু এই মোটা ভালুকটার আহাম্মকি দেখ! একটু শিক্ষা পেটে পড়েছে কি আর অহঙ্কারের সীমা নেই অমনি নিজের জাত ভুলতে শুরু করেছেন। কোন কোন বাঙালি যেমন দুপাতা ইংরেজি পড়েই নিজেকে আর বাঙালি জ্ঞান করে না, একেবারে খাস ইংরেজ ভেবে বসে, ওরও তাই দশা হয়েছে। নিজেও যে উনি একটি নাথিং বাট ভাল্লুক, তা ওঁর খেয়াল নেই।

ভারি রাগ হয়ে গেল আমার। চেঁচিয়ে বললাম–ও তো ভালুক, আর তুমি কি? তুমি যে আস্ত একটা জাম্ববান।

ওকে একটু লজ্জা দেবার চেষ্টা করলাম, এ রকম না দিলে চলে না। শিক্ষিত লোককেও অনেক সময় শিক্ষা দেবার দরকার হয়। আমার অত্যুক্তি শুনে বোধ করি ভালুকটার আত্মগ্লানি হলো, কেননা সে আর উচ্চবাচ্য করল না। বেঁটেটা আর এক পা এগুতেই আমি,এয়ার-গান ছুঁড়লাম, ছররাট ওর পেটে গিয়ে গিয়ে লাগল। ও থমকে দাঁড়িয়ে পেটটা একবার চুলকে নিল, কিন্তু মোটেই দমল না; ধীরে পদে অগ্রসর হতে লাগল–বন্দুকের মুখেই।

দুঃসাহসী বটে! বাধ্য হয়ে এবার আমাকেই পশ্চাৎপদ হতে হলো। আবার, আবার সেই কামান গর্জ্জন। কিন্তু ও একটু করে গা চুলকোয় আর এগিয়ে আসে। গ্রাহ্যই করে না, যেন অনেক কালের গুলি খাবার অভ্যাস!

বুঝলাম খুব শক্ত শিকারের পাল্লায় পড়া গেছে, আমার বড়দার বরাতে যা জুটেছিল, ইনি মোটেই তেমন সন্তোষজনক হবেন না। হঠাৎ উনি একটা উদ্ভুত গর্জ্জন করলেন; ওটা বাংলায় কোনো

অব্যয় শব্দ কিংবা কোন অপভাষা কিনা মনে মনে এইরূপ আলোচনা করছি এবং যখন প্রায় সিদ্ধান্ত করে ফেলেছি যে ওই গর্জনের ভাষাটা বাংলা নয় বরং গ্রীক হলেও হতে পারে, সেই সময়ে ভালুকটা অভদ্রের মত দৌড়ে এসে অকস্মাৎ আমকে এক দারুণ চপেটাঘাত করল।

স-বন্দুক আমি বিশ হাত দূরে ছিটকে পড়লাম। জানোয়ারদের খাবার জন্য কি শোবার জন্য জানি না বিচালির গাদি স্থূপাকার করা ছিল, তার ওপরে পড়েছিলাম বলেই বাঁচোয়া। এক মুহূর্তর চিন্তাতেই বুঝলাম গতিক সুবিধের নয়। যে পালায় সেই কীর্তি রাখে এবং রাখতে পারে কেবল সেই বেঁচে যায়, এমন কথা নাকি শাস্ত্রে বলে। আজ যদি শাস্ত্রবাক্য রক্ষা করি, তাহলে কাল ফিরে এসে শিকার আবার করলেও করতে পারি। অতএব–

চড়-টা আমার পালানোর পক্ষে সাহায্যই করল, না হেঁটে, না হটে এবং না লাফিয়ে বিশ হাত এগিয়ে পড়া কম কথা নয়! উঠেই উদার পৃথিবীর দিকে চোচা দৌড় দিলাম। ভালুক বাবাজীবনও অমনি পিছু নিলেন–যেমন ওদের দুস্বভাব। অনুকরণ আর অনুসরণ করতে যে ওরা ভারি মজবুত, দাদার গল্প পড়েই তা আমার জানা ছিল।

পাহাড়ের যে দিকটায় আলোয়ার ভয়ে দিনেও লোকে পথ হাঁটে না, প্রাণভয়ে সেইদিকেই ছুটলাম। মাঝখানে একটা জায়গা এমন স্যাঁৎসেতে, সেখান দিয়ে যেতে কি রকম একটা গ্যাসে যেন দম আটকে আসে; জায়গাটা পেরিয়ে উঁচু একটা পাথরের ঢিবিতে দাঁড়িয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।

দৌড়তে দৌড়তে ভালুকটা সেই স্যাঁৎসেতে জায়গাটায় এসে পিছলে পড়ল। মিনিটখানেক পরে উঠতে গিয়ে আবার মুখ থুবড়ে গেল। হঠাৎ কি হলো ভালুকটার? বার বার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই যেন আর দাঁড়াতে পারে না।

আমিও সেই উঁচু ঢিবিটার ওপরে দাঁড়িয়ে–অনেকক্ষণ কেটে গেল। হঠাৎ দেখি ভালুকটা উঁচু হয়েছে, উঠেই দাঁড়িয়েছে, কিন্তু মাথার দিকে নয় লেজের দিকে! অবাক কাণ্ড! মাথার নীচের দিকে, লেজ ওপরের দিকে এ অবাক কি রে! এটা কি এখানেই সার্কাস শুরু করল নাকি!

আরো খানিকক্ষণ কাটল! ভালুকটা আরো একটু উঁচু হল। ভাল করে চোখ রগড়ে দেখি–ও দাদা, এ যে একেবারে মাটি ছেড়ে উঠে পড়েছে। দাঁড়িয়েই আছে বলতে হবে, যদিও তার মাথাই নীচে আর পা ওপরের দিকে। ভালুকটা দুহাত মাটি আঁকড়াবার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে, কিন্তু তার আকাশে পদাঘাত করাই সার–কেননা পৃথিবী আর তার মধ্যে তখন দুহাত ফারাক। মাটির নাগাল পাওয়া মুশকিল!

খানিক বাদে ভালুকটা উড়তে শুরু করল। ভালুক উঁড়ছে এ কখনও কল্পনা করতে পার? কিন্তু আমার স্বচক্ষে দেখা। আমার হাত থেকে এয়ার গান খসে পড়ল। উড়তে উড়তে ভালুকটা এবার আমার মাথার কাছাকাছি পর্যন্ত এল–আমি বসে পড়ে আত্মরক্ষা করলাম। ও যে রকম হাত বাড়িয়েছিল,–ঠিক ডুবন্ত লোক যেভাবে কুটো ধরতে যায়,–আর একটু হলেই আমায় ধরে ফেলেছিল আর কি! ওর চোখে এক অসহায় সপ্রশ্ন ভাবটা যেন, হায়, আমার একি হলো। আমাকে ধরতে ওকে সাহায্য না করায়, ও যে আমার ওপর খুব বিরক্ত আর মর্মাহত হয়েছে, তা ওর মুখভাব দেখলেই বোঝা যায়।

লক্ষ্য করে দেখলাম ওর পেটটা ভয়ানক কেঁপে উঠেছে–চারটে জয়ঢাক এক করলে যা হয়। ঠিক যেন একটা রক্তমাংসের বেলুন। ভালুকটা ক্রমশঃই ওপরের দিকে যেতে লাগল–লেজ সর্বাগ্রে। দেখতে দেখতে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে অবশেষে বিন্দুমাত্রে পরিণত হলো, তারপর পলকে শূন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অমল ভ্রাতাজীবনের শিকার কাহিনী পাঠে বিজ্ঞানবিদ পাঠক হয়ত এই ব্যাখ্যা দেবেন যে বেচারা ভালুক সে স্যাঁতসেতে জায়গায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সেখানটায় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রাদুর্ভাব ছিল; সেই উদরস্থ করার ফলেই বাবাজী বেলুনে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। আমার বিশ্বাস ওই ভালুকটা ছিল অতিরিক্ত পুণ্যাত্মা–কেননা সশরীরে স্বর্গারোহণের সৌভাগ্য খুব কম লোকেরই হয়। এভাবে মহাপ্রস্থানের পথে যাবার এ্যাকসিডেন্ড এ পর্যন্ত চারজনের মোটে হয়েছে, এই ভালুক–নন্দনকে ধরে; যাদের মধ্যে কেবল একজন মাত্র দুর্বিপাক কাটিয়ে কোন গতিকে স্বস্থানে ফিরতে পেরেছেন। প্রথম গেছলেন স্বয়ং যুধিষ্ঠির, দ্বিতীয়–তাঁরই সমভিব্যাহারি জনৈক কুকর শাবক, তৃতীয় আমার বন্ধু শ্ৰীযুক্ত প্রবোধকুমার সান্যাল, আর চতুর্থ–?

চতুর্থ এদের কারো চেয়েই কোন অংশে নূন্য নয়।

মন্টুর মাস্টার

বি. এ. পাশ করে বসে আছে মিহির, কি করবে কিছুই স্থির নেই। এমন সময়ে দৈনিক আনন্দবাজারে একটা বিজ্ঞাপন দেখল কর্মখালির। কোনো বনেদী গৃহস্থের একমাত্র পুত্রের জন্য একজন বি. এ. পাশ গৃহশিক্ষক চাই–আহার ও বাসস্থান দেওয়া হইবেক, তাছাড়া বেতন মাসিক ত্রিশ টাকা।

বিজ্ঞাপনটা পড়েই লাফিয়ে উঠল মিহির, এই রকমই একটা সুযোগ খুঁজছিল সে…খাওয়া থাকাটা অমনিই হবে, তাছাড়া ত্রিশ টাকা মাস-মাস-কিছু বাড়িতেও পাঠাতে পারবে, এম. এটাও পড়া হবে সেই সঙ্গে, সিনেমা ফুটবল-ম্যাচ দেখার মতো পকেট-খরচারও অভাব হবে না।

একবার তার মনে হল এই বিজ্ঞাপনটা এর আগেও যেন দেখেছে সে-ওই আনন্দবাজারেই। হ্যাঁ, প্রায়ই সে দেখেছে। গত বছরও দেখেছিল, তখনই তার ইচ্ছা হয়েছিল একটা আবেদন করে দেয়,কিন্তু তখনো সে বি. এ. পাস করেনি। খবু সম্ভব ছেলেটি একটি গবাকান্ত–তাই বেতন ভারী দেখে কেউ এগোলেও ছেলে আবার তার চেয়ে ভারী দেখে পিছিয়ে পড়ে।

সে কিন্তু পেছোবে না, প্রাণপণে পড়াবে ছেলেটাকে–পড়াতে গিয়ে যদি পাগল হয়ে যেতে হয় তবুও! ত্রিশ টাকা কম টাকা নয়–তার জন্য গাধা পিটিয়ে মানুষ করা আর বেশি কথা কি, মানুষ পিটিয়েও গাধা বানানো যায়। ভদ্রলোক অতগুলো টাকা কি মাগনা দিচ্ছেন নাকি?

বিকেলেই মিহির সেই ঠিকানায় গেল। বি.এ.-র সার্টিফিকেটটা সঙ্গেই নিয়ে গেছল কিন্তু ভদ্রলোক তা দেখতেও চাইলেন না, কেবল মিহিরকে পর্যবেক্ষণ করলেন আপাদমস্তক। মিহিরই যেন মিহিরের সার্টিফিকেট, মিহির খুশিই হল এতে।

অবশেষে ভদ্রলোক বললেন, তোমার জামাটা একবার ভোলো তো বাপু?

মিহির ইতস্তত করে। জামা খুলতে হবে কেন? বুঝতে পারে না সে!

–আপত্তি আছে তোমার?

–না, না। মিহির জামাটা খুলে ফেলে। ত্রিশ টাকা জন্য জামা খোলা কেন, যদি জামাই হতে হয় তাতেও রাজি।

–তুমি একসারসাইজ কর?

–এক আধটু!

–বেশ বেশ। ভদ্রলোককে একটু চিন্তান্বিত দেখা যায়। মিহির ভাবে, একসারসাইজ করার অপরাধে চাকরিটা খোয়াল না তো? নাই বলতো কথাটা, কিন্তু কি করেই বা সে জানবে যে ভদ্রলোক একসারসাইজের উপর এমন চটা। কিন্তু এও তা ভারি আশ্চর্য, সে গ্রাজুয়েট কি না, কোন বছরে পাশ করেছে এসবের কিছুই তিনি জিজ্ঞাসা করছে না।

–আর একটা কথা খালি জিজ্ঞাসা করব তোমায়।

মিহির পকেটের মধ্যে সার্টিফিকেটটা বাগিয়ে ধরে–এইবার বোধ হয় সেই প্রশ্নটা আসবে! আর সে উত্তর দিয়ে চমৎকৃত করে দেবে যে বি. এ.-তে সে ফার্স্ট ক্লাস উইথ ডিস্টংশন পেয়েছে।

ভদ্রলোক মিহিরকে আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, তোমার শরীরটা নেহাত মন্দ নয়। ওজন কত তোমায়!

ওজন? আকাশ থেকে পড়ে মিহির অবশেষে কি না এই প্রশ্ন-তা প্রায় দু মনের কাছাকাছ!

–বেশ বেশ। কিছুদিন টিকতে পারবে তুমি, আশা হয়। কি বলিস মন্টু তোর ও মাস্টার মশাই কিছুদিন টিকে যাবে, কি মনে হয় তোর?

মিহিরের ছাত্র কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সে সায় দিল হ্যাঁ বাবা, এ মাস্টার মশাইয়ের গায়ে অনেক রক্ত আছে।

ভদ্রলোক অবশেষে তাঁর রায় প্রকাশ করলেন কিছুদিন টেকা আশার কথা, বেশ কিছুদিন টেকাটাই হল আশঙ্কার। যাক, সবই শ্রীভগবানের হাত–

মন্টু বাধা দিল–ভগবানের হাত নয় বাবা, শ্রী ছার–

–চুপ! কথার উপর কথা কস কেন? কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি হল না তোর। হ্যাঁ, দেখ বাপু, পড়াশুনার সঙ্গে এটিকেও একে শেখাতে হবে। পিতামাতা গুরুজনদের কথায় উপর কথা বলা, অতিরিক্ত হাসাএই সব মহৎ দোষ সারাতে হবে এর। বেশ, আজ থেকেই ভর্তি হলে তুমি। ত্রিশ টাকাই বেতন হল, মাসের পয়লা তারিখেই মাইনে পাবে, কিন্তু একটা শর্ত আছে। পুরো এক মাস না পড়ালে, এমন কি একদিন কম হলেও একটা টাকাও পাবে না তুমি। পাঁচ দিন দশ দিন পড়িয়ে অনেক প্রাইভেট টিউটার ছেড়ে চলে গেছে, সে রকম হলে আমি বেতন দিতে পারি না, সে কথা আমি আগেই বলে রাখছি–

মন্টু বলল, একজন কেবল বাবা উনত্রিশ দিন পর্যন্ত ছিলেন আরেকটা দিন যদি কোনো রকমে থাকতে পারতেন, কিন্তু কিছুতেই পারলেন না।

–থাম তা তোমার জিনিসপত্র সব নিয়ে এসোগে। আজ সন্ধ্যা থেকেই ওকে পড়াবে। মন্টু, যা, মাস্টার মশায়ের ঘরটা দেখিয়ে দে, আর ছোট্ট রামকে বলে যে বেতন-নিবারকে মাস্টার মশায়ের বিছনা পেড়ে দিতে।

আগাগোড়াই অদ্ভুত ঠেকছিল মিহিরের, কিন্তু ত্রিশ টাকা–এক সঙ্গে ত্রিশ টাকা মাসের পয়লা তারিখে পাওয়াটাও কম বিস্ময়ের নয়। চিরকাল মাস গেলে টাকা দিয়েই সে এসেছে কলেজের টাকা, মেসের টাকা, খবরের কাগজওয়ালার টাকা; এই প্রথম সে মাস গেলে নিজে টাকা পাবে। এই অনির্বচনীয় বিশ্মীয়ের প্রত্যাশায় ছোটখাট বিস্ময়গুলো সে গা থেকে ঝেড়ে ফেলল।

সন্ধ্যার আগেই সে জিনিসপত্র নিয়ে ফিরল। বেশ ঘরখানি দিয়েছে তাকে–ভারি পছন্দ হল তার। এমন সাজানো গোছানে ঘরে এর আগে থাকেনি কখনো। একধারে একটা ড্রেসিং টেবিল–পুরনো হোক, বেশ পরিষ্কার। একটা ছোট বুককেসও আছে–তার বইগুলি সাজিয়ে রাখল তাতে। আর একধারে পড়াশুনার, টেবিল, তার দু ধারে দুটো চেয়ার–বুঝল, এই ঘরেই পড়াতে হবে মন্টুকে। সব চেয়ে সে চমৎকৃত হল নিজের বিছানাটা দেখে।

ঘরের একপাশে একখানা খাট, তাতেই তার শোবার বিছানা। চমৎকার গদি দেওয়া, তার উপরে তোশক, তার উপরে ধবধব করছে সদ্য পাটভাঙা বোম্বাই চাদর। ভারি ভদ্রলোক এরা,–না কেবল বললে অপমান করা হয় যথার্থই এরা মহৎ লোক।

সত্যিই খাটে শোবার কল্পনা তার ছিল না। জীবনে কখনো সে গদিমোড়া খাটে শোয়নি। আনন্দের আতিশয্যে সে তখনই একবার গড়িয়ে নিল বিছানায়। আঃ, কী নরম! আজ খুব আরামে ঘুমানো যাবে–খেয়েদেয়ে সে তো এসেছেই, আজ আর কোনো কাজ নয়, এমন কি মন্টুকে পড়ানোও না, আজ খালি ঘুম! তোফা একটা ঘুম বেলা আটটা পর্যন্ত।

মন্টু এল বই-পত্র নিয়ে। মিহির প্রস্তাব করল, এসো, খাটে বসেই পড়াই।

–না স্যার, আমি ও–খাটে বসব না!

মিহির বিস্মিত হল, কেন? এমন খাট!

–আপনি মাস্টার মশাই গুরুজন, আপনার বিছানায় কি পা ঠেকাতে আছে আমার? বাবা বারণ করেছেন।

–ওঃ তাই? তা হলে চল চেয়ারে বসিগে। ক্ষুণ্ণমনে সে চেয়ারে গিয়ে বসল কিন্তু যাই বল, বেশ বিছানাটি তোমাদের। ভারী নরম। বেশ আরাম হবে ঘুমিয়ে।….দেখি তোমার বই।….Beans!…বীনস মানে জানো?

মন্টু ঘাড় নাড়ে। তার মানে সে জানে না।

–Beans মানে বরবটি এক রকম সবজি-তরকারি হয়, আমরা খাই। Beans দিয়ে একটা সেনটেন্স কর দেখি। পারবে?

মন্টু ঘাড় নেড়ে জানায়—হ্যাঁ। তারপর অনেক ভেবে বলে। I had been there.

মিহির অত্যন্ত অবাক হয়–এ আবার কি! উঃ, এতক্ষণে সে বুঝতে পারলো কেন সব মাস্টার পালিয়ে যায়। গবাকান্ত বলে গবাকান্ত। মরীয়া হয়ে সে জিজ্ঞাসা করে তার মানে কি হল?

মন্টুও কম বিস্মিত হয় না–তার মানে তো খুব সোজা সার! আপনি বুঝতে পারছেন না? সেখানে আমার বরবটি ছিল। আই হ্যাড বিন দেয়ার আমার ছিল বরবটি সেখানে…সেইটাই ঘুরিয়ে ভাল বাংলায় হবে সেখানে আমার–

–থাম, থাম, আর ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না তোমাকে। আই হ্যাড বিন দেয়ার মানে আমি সেখানে ছিলাম।

মন্টু আকাশ থেকে পড়ে–তবে যে আপনি বললেন বীন মানে বরবটি? তাহলে আমি সেখানে বরবটি ছিলাম–বলুন।

মিহির সন্দেহ প্রকাশ করে–খুব সম্ভব তাই ছিলে তুমি। Bean আর Been কি এক জিনিস হল? বানানের তফাত দেখছ না? এ Been হল be ধাতুর form–

বাধা দিয়ে মন্টু বলে, হ্যাঁ বুঝেছি স্যার, আর বলতে হবে না। অর্থাৎ কিনা এBeen হল মৌমাছির চেহারা। বি মানে মৌমাছি আর ফর্ম মানে চেহারা! আমি জানি।

বিস্ময়ে হতবাক মিহির শুধু বলে, জানো তুমি?

–হ্যাঁ আজ সকালেই জেনেছি। আপনি চলে যাবার পর বাবা বললেন, তোর নতুন মাস্টার মশায়ের বেশ ফর্ম তখনই জেনে নিলাম।

মিহির কথাটা ঠিক ধরতে না পেরে, বললে, আমার চেহারা মৌমাছির মতো? জানতাম না তো। কিন্তু সে কথা যাক, যে Beans মানে বরবটি, তা দিয়ে সেনটেন্স হবে এই রকম–Peasants grow beans অর্থাৎ চাষীরা বরবটি উৎপন্ন করে, বরবটির চাষ করে। বরবটি ফলায়। বুঝলে এবার।

মন্টু ঘাড় নেড়ে জানায়, বুঝেছে।

–অতটা ঘাড় নেড়ো না, ভেঙে যেতে পারে। তোমার তো আর মৌমাছির চেহারা নয় আমার মতন। বেশ, বুঝেছ যদি, এই রকম আর একটা সেনটেন্স বানাও দেখি বীনস দিয়ে।

অনেকক্ষন ধরে মন্টুর মুখ নড়ে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বার হয় না। মিহির হতাশ হয়ে বলে, পারলে না? এই ধর যেমন, Our cook cooks Beans আমাদের ঠাকুর বরবটি রাধে। এখানে তুমি কুক কথাটার দু রকম ব্যবহার পাচ্ছ, একটা নাউন আরেকটা ভাব। আচ্ছা, আর একটা সেনটেন্স কর দেখি।

এতক্ষণে বীনস ব্যাপারটা বেশ বোধগম্য হয়ে এসেছে মন্টুর। সে এবার চটপট জবাব দেয়। We are all human beans.

–অ্যাঁ বল কি? আমরা সবাই মানুষ–বরবটি? বরবটি মানুষ?

–কেন? বাবাকে অনেকবার বলতে শুনেছি যে হিউম্যান বীনস।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মিহির। অর্থাৎ বসে তো সে ছিলই, মাথায় হাতটা দেয় কেবল। দিনের পর দিন-মাসের পর মাস এই ছেলেকেই পড়াতে হবে তাকে? ওঃ এইজন্যই মাস্টাররা টিকতে পারে না? কি করে টিকবে? পড়াতে আসে–কুস্তি করতে তো আসা নয়। রোজই যদি এ রকম ধস্তাধস্তি করে দুবেলা ওকে পড়াতে হয়, তাহলেই তো সে গেছে। তাহলে তাকেও পালাতে হবে টিউশানির মায়া ছেড়ে, ত্রিশ টাকার মায়া কাটিয়ে, নরম আরাম ফেলে—

নাঃ, সে কিছুতেই পালাচ্ছে না। একজন ঊনত্রিশ দিন পর্যন্ত টিকেছিল আর একদিন টিকতে পারলেই ত্রিশ টাকা পেত, কিন্তু একটা দিনের জন্য এক টাকাও পেল না। বোধ হয় তার কেবল পাগল হতেই বাকি ছিল–পাগল হয়ে যাবার ভয়ে পালিয়েছে। আর একটা দিন পড়াতে হলেই পাগল হয়ে যেত। কিংবা পাগল হয়েই সে পালিয়ে গেছে হয়তো, নইলে ত্রিশ-ত্রিশটা টাকা কোন সুস্থ মানুষ ছেড়ে যায় কখনো? কী সর্বনাশ। ভাবতে তার স্বকম্প হয়।

সে কিন্তু চাকরিও ছাড়বে না, পাগলও হবে না, তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। মন্টু যা বলে বলুক-না পড়ে না পড়ুক–বোঝে বুঝুক, না বোঝে না বুঝুক–মন্টুকে সে বই খুলে পড়িয়ে যাবে–এই মাত্র; ও কে নিয়ে মোটেই সে মাথা ঘামাবে না আর মাথাই যদি না ঘামায় পাগল হবে কি করে? নির্বিকার ভাবে সে পড়াবে–কোনো ভয় নেই তার।

তার গবেষণায় বাধা পড়ে, মন্টু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসে বেতন-নিবারক বিছানা-এর ইংরেজী

কি হবে সার?

–বেতন-নিবারক বিছানা আবার কি?

–সে একটা জিনিস। বলুন না ওর ইংরেজীটা জেনে রাখা দরকার।

–ও রকম কোনো জিনিস হতেই পারে না।

–হতে পারে না কি হয়ে হয়েছে। আপনি জানেন না তাহলে ওর ইংরেজী। সেই কথা বলুন।

ওর ইংরেজী হবে পে-সেভিং বেড (Pay-saving bed)।

মন্টু সন্দেহ প্রকাশ করে–শেভিং মানে তো কামানো। ছোটুরাম আমাদের চাকর, সে বেতন কামায়, বেতন-নিবারকে শোয় না তো সে। তাকে অনেক বার অনেক করে বলা হয়েছে কিন্তু কিছুতেই সে শোয় না। সেইজন্যই তো এ-চাকরটা টিকে গেল আমাদের। বাবা ভারি দুঃখ করেন তাই।

কী সব হেঁয়ালি বকছে ছেলেটা? মাথা খারাপ না কি এর? অ্যাঁ? যাক, ওসব ভাববে না সে। সে প্রতিজ্ঞাই করেছে মোটেই মাথা ঘামাবে না এদের ব্যাপারে। একবার ঘামাতে আরম্ভ করলে তখন আর থামাতে পারবে না–নির্ঘাৎ পাগল হতে হবে। আজ আর পড়ানো নয়, অনেক পড়ানো হয়ে গেল, কেবল মাথা কেন, সর্বাঙ্গ ঘেমে উঠেছে তার ধাক্কায়। আজ এই পর্যন্তই থাক। মন্টুকে সে বিদায় দিল ।–যাক আজকের মতন তোমার ছুটি।

এইবার একটা তোফা নিদ্রা বিছানায়। দু-দুবার বৌবাজার আর বাগবাজার করেছেন আজ, অনেক হাঁটাচলা হয়েছে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। আজ রাত্রে সে খাবে না বলেই দিয়েছে–এক বন্ধুর বাড়িতেই খাওয়াটা সেরেছে বিকেলে। ব্যাস, সুইচ অফ করে এখন শুলেই হয়।

নরম বিছানায় সর্বাঙ্গ এলিয়ে দিয়ে আরামে মিহিরের চোখ বুজে এল–আঃ। নিদ্রার রাজ্যে সবেমাত্র প্রবেশ করেছে সে, এমন সময়ে তার মনে হল সর্বাঙ্গে কে যেন এক হাজার উঁচ বিধিয়ে দিল এক সঙ্গে। আর্তনাদ করে মিহির লাফিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। বাতি জ্বেলে দেখে, সর্বনাশ–সমস্ত বিছানায় কাতারে কাতারে ছারপোকা ছারপোকা আর ছারপোকা। হাজারে হাজারে, লাখ-লাখ-গুনে শেষ করা যায় না। শুধুই ছারপোকা।

এতক্ষণে বেতন-নিবারক বিছানায় মানে সে বুঝল, বুঝতে পারল কেন মাস্টাররা টেকে না। ও বাবাঃ। কেবল ছাত্রই নয়, ছারপোকাও আছে তার সাথে। ঘরে-বাইরে যুদ্ধ করে একটা লোক পারবে কেন? তবু যে ভদ্রলোক ঊনত্রিশ দিন বুঝেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না ছেড়ে পালাতে হল যাকে তিনি একজন শহীদ পর্যায়ের সন্দেহ নেই। ত্রিশ টাকা মাইনের মাষ্টার রেখে বেতন না দিয়েই ছেলে পড়ানো নাঃ, ভদ্রলোক কেবল উদার আর মহৎ নন, বেশ রসিক লোকও বটেন তিনি। মায়া দয়া নেই একটু, একেবারে অমায়িক।

ভীতি-বিহ্বল চোখে সে ছারপোকা বাহিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। গুনে শেষ করা যায় না–ওকি মেরে শেষ করা যাবে? আর সারারাত ধরে যদি ছারপোকাই মারবে তো ঘুমোবে কখন? নাঃ চেয়ারে বসেই আজ কাটাতে হল গোটা রাতটা।

আলো দেখা মাত্র ছারপোকার আবার মিলিয়ে গেল। মিহির ভাবল–বাপস, এরা রীতিমতো শিক্ষিত দেখছি। যেমন কুচকাওয়াজ করে এসেছিল তেমনি কুচকাওয়াজ করে চলে গেল–আধুনিক যুদ্ধের কায়দা-কানুন সব এদের জানা দেখা যাচ্ছে। কোথায় গেল ব্যাটারা?

সদ্য পাট-ভাঙা ধবধবে চাদরের এক কোণ তুলে দেখে তোশকের গদির খাঁজে খাঁজে থুক থুক করছে ছারপোকা অন্যধারেও তাই। আর বেশি সে দেখল না, কি জানি এখন থেকেই যদি তার মাথা খারাপ হতে থাকে। চেয়ারে গিয়ে বসল কিন্তু ভয়ে আলো নিবোল না কি জানি যদি ব্যাটারা সেখানে এসেও তাকে আক্রমণষ করে। বলা যায় নি কিছু….

পরদিন মন্টুর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, বেশ ঘুম হয়েছিল রাত্রে?

–খাসা। অমন বিছানায় ঘুম হবে না, বলেন কি আপনি?

ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে বললেন, বেশ বেশ, ঘুম হলেই ভাল। জীবনের বিলাসই হল গিয়ে ঘুম।

–আর ব্যাসন হল বেগুনি? না বাবা?

–তা তোমার ঘুমটা বোধ হয় বেশ জমাট? ঘুমিয়ে আয়েস পাও খুব?

–আজ্ঞে, সে-কথা আর বলবেন না। একবার আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাশের বাড়ি চলে গেছলাম। কিন্তু মোটেই তা টের পাইনি।

–বল কি?

–আমাদের বাড়ি বর্ধমানে। শুনেছেন বোধ হয় সেখানে বেজায় মশা-মশারি না খাঁটিয়ে শোবার যো নেই। একদিন পাশের বাড়িতে খুব দরকারে ডেকেছিল আমাকে কিন্তু ভুলে গেছলাম কথাটা। যখন শুতে যাচ্ছি তখন মনে পড়ল, কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেছে, অত রাত্রে কে যায়, আর দরজা টরজা বন্ধ করে তারা শুয়ে পড়েছে ততক্ষণ আমি করলাম কি, সেরাত্রে আর মশারি খাটালাম না। পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল মশাই, বলব কি, দেখি পাশের বাড়িতেই শুয়ে রয়েছি।

দারুণ বিস্মিত হলেন ভদ্রলোক–কি রকম?

–মশায় টেনে নিয়ে গেছে মশাই। সেইজন্যেই তো মশারি খাটাইনি। রাত-বিরেতে অনায়াসে পাশের বাড়ি যাবার ওইটেই সহজ উপায় কি না।

ভদ্রলোক বেজায় মুশড়ে পড়লেন যেন-মশাতেই যখন কিছু করতে পারেনি তখন কিসে আর কী করবে তোমার। তুমি দেখছি টিকেই গেলে এখানে।

মিহির বলল, আমার কিন্তু একটা নিবেদন। কয়েকটা টাকা আমাকেদিতে হবে আগাম। ছারপোকার অর্ডার দেব।

–ছারপোকার আর্ডার। কেন? সে আবার কি হবে?

–ও, আপনি জানেন না বুঝি? ছারপোকার মতো এমন মস্তিষ্কের উপকারী মেমোরি বাড়ানোর মহৌষধি আর নাই। বিলেতে ছারপোকার চাষ হয় এইজন্যে। গাধা ছেলে সব দেশেই আছে তো, তাদের কাজে লাগে।

একটু থেমে সে আবার বললে, আমার এক বন্ধু তো এই ব্যবসাতেই লেগে পড়েছে রেলগাড়ির ফাঁকফোকর থেকে সব ছারপোকা সে টেনে বার করে নেয়।

সাগ্রহে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, কি রকম, কি রকম? বিলেতে ছারপোকার চাষ হয়? দাম দিয়ে কেনে লোকে? আমাদানি রপ্তানি হয় তুমি জানো? আমি বেচতে পারি, হাজার হাজার, লাখ লাখ–যতো চাও।

–বেচুম না। আমিই কিনে নেব। আমার নিজের কাজে লাগবে। ছারপোকার রক্ত ব্রেনের ভারি উপকারী একটা ছারপোকা ধরে নিয়ে এমনি করে মাথায় টিপে মারতে হয়, এই রকম হাজার হাজার লাখ লাখ ছারপোকার রক্তে এক ছটাক ব্রেন; সঙ্গে সঙ্গে ব্রেন;–বি. এ. পাশের সময়ে আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। সারা বছর ফাঁকি দিয়েছি, ফেল না হয়ে আর যাই না। এমন সময়ে এক বিলেতি কাগজে ছারপোকার উপকারিতা পড়া গেল, অমনি সমস্ত বাসা খুঁজে যার বিছানায় যত ছারপোকা ছিল, সব সদ্বব্যহার করলাম। পরীক্ষা দেবার তখন মাত্র তিন দিন বাকি। তারপর ফল যা পেলাম নিজের চোখেই দেখুন, আমার কাছেই দেখুন, আমার কাছেই আছে, বি.এ. পাশ করলাম উইথ ডিস্টিংশন–ফার্স্ট ক্লাস উইথ…

কাল থেকেই সে ব্যর্থ হয়ে ছিল, এখন সুযোগ পেতেই সার্টিফিকেটখানা মন্টুর বাবার মুখের সামনে মেলে ধরল। ভদ্রলোকের চোখ দুই ছানাবড়ার মতো হয়ে উঠল বিস্ময়ে–সত্যিই। একটা কথাও মিথ্যে নয়, Passed with distinction–লেখাই রয়েছে। বটে এমন জিনিস ছারপোকা। কে জানতো গো।

পয়সা খরচ করে ছারপোকা কিনতে হবে না, তোমার বিছানাতেই রয়েছে হাজার হাজার, লাখ লাখ, যত চাও। তোমার ভয়ানক ঘুম বলে জানতে পারোনি।

এতক্ষণ কেন বলেননি আমায়? অনেকখানি ব্রেন করে ফেলতাম। এ বেলা আমার নেমন্তন্ন আছে ভবানীপুরে, এখনই বেরোতে হবে নইলে,এক্ষুনি, যাক, দুপুরে ফিরেই ওগুলোর সদ্বব্যহার করব। তারপরে পড়াতে বসব মন্টুকে।

মিহির চলে গেলে পিতাপুত্রে চাওয়াচাওয়ি হয়। অবশেষে মন্টুর বাবা বলেন, ছারপোকার সঙ্গে যে ব্রেনের সম্বন্ধ আছে, অনেক দিনই একথা মনে হয়েছিল আমার। ছারপোকার ব্রেনটা একবার ভাব দিকি–অবাক হয়ে যাবি তুই। খুচ করে এসে কামড়েছে, তক্ষুনি উঠে দেশলাই জ্বাল, আর পাবি না তাকে, কোথায় যে পালিয়েছে, তার পাত্তা নেই। মানুষ যে দেশলাই আবিষ্কার করেছে এ পর্যন্ত ওদের জানা। এটা কি কম ব্রেন? আর এ ব্রেন তো ওদের ওই রক্তেই, কেন না মাথা নেই ওদের গায়েই ওদের সব ব্রেন। ঠিক বলেছে মিহির।

–হ্যাঁ বাবা।

–তারপর ছারপোকার সঙ্গে শিক্ষার সম্বন্ধও কম নয়। ছারপোকা বিস্তারের সাথে সাথে শিক্ষার বিস্তার বাড়ে। ট্রামে বাসে সিনেমায় যেমন ছারপোকা বেড়েছে, তেমনি হু হু করে খবরের কাগজের কাটতিও বেড়ে গেছে। এই সেদিন বায়স্কোপে আমাদের সামনেই সাড়ে চার আনার সীটে একটা কুলী বসেছিল, তোর মনে পড়ে না মন্টু

–হ্যাঁ–বাবা।

–সে তো লেখাপড়া কিছুই জানে না। দু মিনিট না বসতেই দু পয়সা খরচা করে একখানা আনন্দবাজার কিনে আনলে সে। এতে শিক্ষা বিস্তার হলো না কি? মন্টু কি বলিস তুই?

–হ্যাঁ বাবা।

চল তবে এক কাজ করিগে। তোর মাস্টার মশাই ফেরার আগে আমরাই ছারপোকাগুলোর সদ্ব্যবহার করে ফেলি। ব্রেন তো তারও দরকার, আর আমারও মেমারিটও দিন দিন কেমন যেন কমে আসছে। সেদিন শ্যামবাবুকে মনে হল গোবর্ধনবাবু মনে হল হারাধন কান্ত। এ তো কথা নয়রে মন্টু। কি বলিস তুই?

–হ্যাঁ বাবা।

সন্ধের পরে ফিরল মিহির। কাল সারা রাত ঘুম নেই, তারপর আজ সমস্ত দিন বন্ধুদের আড্ডায় তাস পিটে এতই ক্লান্ত হয়েছে যে ঘুমোতে পারলে বাঁচে। আজ সে আলো জ্বালিয়েই শোবে-আলো দেখে যদি না আসে ব্যাটারা। এখন নমো নমো করে মন্টুকে খানিকক্ষণ পড়ালেই ছুটি,–

মন্টু বই নিয়ে আসতেই গোটা ঘরটা একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

–নতুন ধরনের এসেন্স-টেসেন্স মেখেছ না কি কিছু? ভারি গন্ধ আসছে তোমার গা থেকে। মিহির জিজ্ঞাসা করল।

–গা নয় স্যার, মাথার থেকে।

–কিসের গন্ধ? বেজায় খোশবাই দিচ্ছে।

–ছারপোকার। আপনি চলে যাবার পর বাবা আর আমি দুজনে মিলেই বেতন-নিবারকেরর যতো ছারপোকা ছিল সব শেষ করেছি। ছোটুরামকেও বলা হয়েছিল কিন্তু সে ব্যাটা মোটেই ব্রেন চায় না। বসে যে বিরেন সে কেয়া কাম? আর একটাও ছারপোকা নেই আপনার বিছানায়। হি-হি-হি।

–হ্যাঁ? সিংহনাদ করে মিহির চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে পড়ে সটান চিৎপটাং। মন্টু তো হতভম্ব। দারুণ সেই চিৎকার শুনে মন্টুর বাবা ছুটে আসেন–কী হয়েছে রে, মন্টু? কী হল?

–ছারপোকা নেই শুনে মাস্টারমশাই অজ্ঞান হয়ে গেছেন।

–তা তুই বলতে গেলি কেন? বারণ করলাম না তোকে? অতগুলি ছারপোকার ব্রেনের শোক।

–আমি কী করে জানব যে উনি অমন করবেন। আমি কিছু বলিনি। উনি কী করে গন্ধ পেলেন উনিই জানেন। মুখে জল ছিটোলে জ্ঞান হয় শুনেছি, ছিটবো, বাবা? অজ্ঞান অবস্থাতেই মিহিরের গলা থেকে বের হয়–উঁহু।

মন্টুর বাবা বললেন কাজ নেই। জ্ঞান হলে যদি কামড়ে দেয় রে? ঐ দ্যাখ বিড়বিড় করছে–

মিহির তার শোক সামলে উঠল পরদিন সাড়ে আটটায়। ষাঁড়ের মতন সারারাত এক নাগাড়ে ডাকাবার পর।

 মাসতুতো ভাই

জীবন-মরণ সমস্যার দিন আজ একটা। বৌকে খুন করে সেশন কোর্টের আসামী ভজহরি। তার রায় বেরুবার দিন আজ।

মাসতুতো ভাইকে মাসতুতো ভাই না দেখলে কে দেখবে? কিন্তু আজ আর ভজহরিকে দেখা দিচ্ছেন না হর্ষবর্ধন।

দেখা শোনা, মামলার তদ্বির যা করবার তা এতদিন সবই করেছেন তিনি, এমন কি ষোলোআনার ওপর আঠারো আনাও। কিন্তু আজ আদালতের দিকে পা বাড়াবার তাঁর সাহস হয় না। নিজের চোখে ফাঁসি দেখা যেমন কষ্টকর, নিজের কানে সেই দণ্ডাজ্ঞা শোনাও তার চেয়ে কিছু কম কঠিন নয়। ভজুকে প্রাণদণ্ড থেকে যদি বাঁচানো না গিয়ে থাকে, এগিয়ে নিজের কানদণ্ড নেওয়া কেন?

ভাই গোবর্ধনকে বলে রেখেছেন, আদলতের লাঞ্চের সময়ে সেশন কোর্টের বার লাইব্রেরিতে উকিলবাবুকে ফোন করে যেন খবরটা জেনে নেয়।

কিন্তু গোবর্ধনকে আর ফোন করতে হলো না, সাড়ে বারোটার সময় উকিলবাবুই খবর দিলেন টেলিফোনে। এই মাত্তর ভজহরির দ্বীপান্তর হয়ে গেলো। যাবজ্জীবন। যার মানে আসলে হচ্ছে বারো বছরের জেল, উকিলবাবু জানালেন।

ভজুটা বেঁচে গেলো এ-যাত্রা। হাঁপ ছাড়লেণ হর্ষবর্ধন: ফাঁসিকাঠে লটকাতে হলো না বেচারাকে।

তারপর একটু পরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন : ভজুর ভাগ্যকে আমার হিংসে হয়, জানিস গোবরা?

কিসের হিংসে?

জানিস গোবরা, বছর বারো আগে আমারও মাথায় খুন চেপেছিলো একবার। খুন করবার ইচ্ছে হয়েছিলো তোর বৌদিকে।

বলল কি দাদা? গোবর্ধন আঁতকে ওঠে।

তোর বৌদির জ্বালায় অস্থির হয়ে–আর বলছিস কেন? ভেবেছিলাম যে খুন করে বরং ফাঁসি কাঠে চলে যাই, রেহাই পাই দুজনেই!

অমন কথা মুখেও আনতে নেই।

পারলাম কই করতে? পারলেও তো বাঁচতাম। হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়ে গেলো অ্যান্দিনে।

এখনো তোমার সেই মতলব আছে নাকি দাদা?

এখন…এই বয়সে? অসম্ভব। কিন্তু হায়, যদি পারতাম তখন…! হর্ষবর্ধনের হায় হায় শোনা যায়। তাহলে বারো বছর বাদে আজ তো আমি মুক্ত পুরুষ রে!

জেল থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করতে বুঝি আবার?

আবার? রামোঃ!

তুমি যে এমন সর্বনেশে লোক দাদা, আমি তো তা জানতুম না।

সর্বনেশেই বটে ভাই! নইলে এমন করে নিজের সর্বনাশ করি!

আমাদের অতো ভালো বৌদি–গোবরা মুখ গোমড়া করে–আর তাকেই কিনা তুমি?

তো বৌদি তার ভালো, আমার কে! দাদাও ফোঁস করে ওঠেন। ভজহরির বরাত জোর, নিজেও বাঁচলো বৌয়ের হাত থেকেও বাঁচলো! বারো বছর বাদে ফিরে এসে দিব্যি স্বাধীন হয়ে চরে বেড়াবে।

ভজুদা তোমার জন্যই তো বাঁচলো দাদা! গোবরা বলে।

তা বলতে পারিস–ওকে বাঁচাতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি আমায় আবার তোর জন্যেও। বটে!

সত্যি দাদা, এই বুড়ো বয়সে কেঁচে গুণ্ডুষ করতে হলো আমায়। লেখাপড়া শিখতে হলো আবার। তবে আসলে তোমার বুদ্ধিতেই বাঁচলো ভজুদা। যাটালো দাদা, তোমার বুদ্ধি কিন্তু অঢেল।

ভাইয়ের সার্টিফিকেট দাদার বুক বিস্ফারিত হলেও তিনি খাতিয়ে দেখেন বুদ্ধিটা আসলে ভজুরই। নিজের বুদ্ধিতেই বেঁচে গেলো ভজু। কথায় বলে না–আপ্তবুদ্ধি শুভঙ্করী, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী! বৌ বেঁচে থাকলে আর বুদ্ধি দেবার সুযোগ পেলে ভজুকে আর বাঁচতে হোত না।

ভজহরির হাজত হবার খবর পেতেই ছুটে গিয়েছিলেন হর্ষবর্ধন। আমি বড়ো বড়ো উকিল লাগাবো, তুমি কিছু ভেবো না ভজু। আশ্বাস দিয়েছিলেন মাসতুতো ভাইকে।

উকিল তো ছাই করবে! উকিলের বিষয়ে বিশেষ ভরসা নেই ভজহরির; উকিল বলবে এখন তো দুর্গা বলে ঝুলে পড়ো বাপু, তারপর তোমায় আপীলে খালাস করে আনবো।

তাহলে? মিথ্যা সাক্ষী দিলে হয় না?

মিথ্যে সাক্ষীতে কাজ হয় বরং, কিন্তু এখানে তো সাফাই দেবার পথ রাখিনি ভাই। খুন করে রক্ত মাথা দা হাতে নিজেই থানায় গিয়ে ধরা দিয়েছি। কবুল করেছি সব।

এক দা-য়ে তোমাদের দুজনকেই কেটেছে দেখছি।

তখন কি আমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান ছিলো? যেমন করে পারো আমায় বাঁচাও ভাই। দীপান্তরের আমার দুঃখু নেই, ফাঁসিটা যেন আটকায়।

টাকার আমার অভাব নেই। হর্ষবর্ধন জানায়ঃ তোমাকে বাঁচাবার জন্য খরচের আমি কোনো কসুর করবো না….

আন্দামান থেকে ফিরে এসে মনের মতো বৌ নতুন করে সংসার পাতবো আবার।

বৌ কখনো মনের মতো হয় না দাদা। নিজেকেই বৌয়ের মনের মতো করে নিতে হয়। আমি যেমন নিজেকে গড়ে পিটে করে তুলেছি।

শোনো হর্ষ, নিচের কোর্টে আমার এ মামলার কোনো ফয়সালা হবে না। সেশনে জুরিদের ভাঙচি দিয়ে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে…।

বুঝেচি। আর বলতে হবে না হর্ষবর্ধন বাধা দেন, কেউ শুনতে পেতে আমাকেও ধরে ফাটকে পুরে দেবে। ঘুষ দিতে গেলেও জেলে যেতে হয়। তুমি কিছু ভেবো না। টাকায় যা হতে পারে তার কোনো ত্রুটি হবে না তুমি নিশ্চিত থাকো।

কিন্তু সেশন কোর্টে পৌঁছে দেখলো সে বড়ো কঠিন ঠাই। হোমরা-চোমরা যতো জুরি, গোমড়া মুখ সেখানে তার জারিজুরি খাটবে না।

তবে ওদের মধ্যে চিনতে পারলেন একজনকে। তাঁদের পাড়াতেই থাকেন, দরিদ্র স্কুল-মাস্টার। চল্লিশ টাকা বেতন নিয়ে বেতনের খাতায় একশো কুড়ি টাকা পাইলাম বলে লিখতে হয় যাকে, উদায়াস্ত দশ পাঁচটাকার গোটা দশেক টুইশানি করে সংসার চালাতে হয় যাকে।

ভাবলেন তাকেই পাকড়াবেন।

কথাটা পাড়লেন গোবরার কাছে–বুঝলি শ-দুই টাকার একটা টুইশানি দিয়ে ওকেই হাত করতে হবে।

কিন্তু পড়বে কে? বাড়িতে পড়বার ছেলে কই তোমার? গোবরা শুধায়।

তা বটে। হর্ষবর্ধন খাতিয়ে দেখেন, বাড়িতে ছেলে বলতে গোবরা আর মেয়ে বলতে উনি, গোবরার বৌদি। ওঁকে পড়বার কথা বলতে তাঁর সাহস হয় না, তাহলে হয়তো বৌকে বিধবা করে বৌয়ের হাতের নিজেকেই খুন হতে হবে। অগত্যা–

–কেন তুই তো আছিস। ছোট ভাই তো ছেলের মতই। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সম পিতা বলে থাকে শুনিসনি। তুই-ই পড়বি।

আমি? গোবরা আকাশ থেকে পড়ে। এই বয়সে?

পড়বার আবার বয়স আছে নাকি? সব বয়সেই বিদ্যা শিক্ষা করতে হয়। মরবার আগে পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করে যায় মানুষ।

না দাদা, লেখাপড়া করা আমার দ্বারা হবে না।

আরে পড়বি নাকি? পড়ার ছলনা করবি তো।

ছলনা করতে আমি পারবো না। মাস্টারকে আমার ভারি ভয়। নীলডাউন করিয়ে দেবে।

তা দেবে। সে কথা ঠিক। সায় দিতে হয় দাদাকে : আমি না হয় চেয়ার বেঞ্চির বদলে নরম গদির ফরাশ পেতে পড়বার ব্যবস্থা করবো। তাহলে তোর হাঁটুতে আর তেমন লাগবে না।

না লাগুক। আমার আত্মসম্মান হানি হবে তো? যদি আমার কান মলে দেয়?

তখন বাধ্য হয়ে হর্ষবর্ধনকে উদাত্ত হতে হয়:–কিন্তু ভাই গোবরা, বাঙালীকে বাঙালী না রাখিলে কে রাখিবে? কে বলেছিলো এ-কথা?

চন্দ্রশেখর।

চন্দ্রশেখর বলেছিলো? শুনে দাদা তো হতবাক।

না। কপালকুন্ডলা।

কপালকুন্ডলা বলেছিলো এ-কথা?

তাহলে বিষবৃক্ষ। বিষবৃক্ষই বলেছিলো বোধ হচ্ছে।

বিষবৃক্ষ। বৃক্ষ আবার কথা বলে নাকি?

তবে বঙ্কিমচন্দ্রর।

যা বলেছিস। বঙ্কিমচন্দ্রই বলেছিলো এ-কথা। কথাটা একবার ভেবে দ্যাখ তুই। এখানে তো শুধুই বাঙালী নয়। বাঙালীর চেয়েও সে আপনার তার জীবনমরণের প্রশ্ন।…মাসতুতো বাঙালীকে মাসতুতো বাঙালী না রাখিলে কে রাখিবে?

অগত্যা গোবর্ধনকে বুড়ো বয়সে পড়ুয়া হতে হয়। ক্লাস সিক্স যে পেয়নি সে প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল দিতে বসে। মাস্টারের কাছে পাটীগণিত নিয়েই পড়ে প্রথমে।

একেবারে সাঁইত্রিশের উদাহরণ মালা নিয়ে। এই অংকটা আমায় বুঝিয়ে দিন সার। বুঝিয়েই দেন মাস্টার।

এইবার এই আটত্রিশ উদাহরণ মালার অংকগুলো বোঝন।

সাঁইত্রিশের গুলো কষো আগে। কষে দেখাও।

ও আর কষবো কি সার? ওতো বুঝে নিয়েছি।

বুঝেছ কিনা কষে দেখাও।

আপনি বলছেন বুঝিনি আমি? বলছেন কি আপনি। তাহলে এতক্ষণ ধরে আপনি কি বোঝালেন আমায়।

এই রকম দিনের–পর দিন উদাহরণের পর উদাহরণ এগুতে থাকে। অঙ্কের বোঝা বাড়ে। অবশেষে গোবরা আর পারে না, দাদার কাছে এসে কেঁদে পড়ে–আর তো পড়তে পারি না দাদা? অঙ্ক কষতে বলছে কেবল। এবার রক্ষা করো আমায়। তখন দাদা নিজেই ভাইয়ের বোঝা ঘাড় পেতে নেন।

বোঝার ওপর শাকের আঁটি নিয়ে এগোন। একশোখানা একশো টাকার নোট। তার অর্ধেক মাস্টারের হাতে তুলে দিয়ে বলেন-এই বাকিগুলোও আপনার। পরে দেব আপনাকে। বলে মাস্টারকেই একটা নতুন অঙ্ক বোঝাতে লাগেন।

আপনাকে আর এর বেশি করতে হবে না। কেবল বাকি পাঁচজন জুরিকে নিজের মতে আনতে হবে। তা আপনি পারবেন। মাস্টারদের সবাই খাতির করে ভক্তি করে যেমন ভয়ও করে তেমনি। আপনার পক্ষে এ-কাজ কিছুই নয়। ক্লাসে যেমন ছেলেদের পড়ান তেমনি এখানে এই বুড়ো খোকাদের একটু পড়াবেন এই আর কি?

আপনি বলেছেন যেমন করে হোক ওর জেলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে এই তো? জেল ছাড়া আর কিছু যেন না হয় এই তো? বেশ, আমার সাধ্যমত আমি চেষ্টা করবো। দেখি কদুর কী পারা যায়।

তা মাস্টারমশাই ভালোই পেরেছেন দেখা যাচ্ছে। হর্ষবর্ধন বলেন গোবর্ধনকে ও ফাঁসিকাঠ থেকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভজুকে। আর এজন্য তোকেও বাহাদুরি দিতে হয় গোবরা। তুই কষ্ট করে এতো ত্যাগ স্বীকার করে পড়েছিলি বলেই তো।

বলতে না বলতে মাস্টারমশাই এসে হাজির–সাফল্যের হাসি মুখে নিয়ে।

আসুন আসুন মাস্টারমশাই। আসতে আজ্ঞা হোক। তাকে দেখে হর্ষবর্ধন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন : নমস্কার-দণ্ডবৎ-প্রণাম। আপনার ঋণ আমরা জীবনে শুধতে পারবো না।

মাস্টারমশাই বসলে তিনি ড্রয়ার থেকে নোটের তাড়াটা বের করে এগিয়ে দেন-এই নিন, আপনার বাকি পাঁচ হাজার। আমাদের যৎকিঞ্চিৎ প্রণামী। এই সামান্য দিয়ে আপনার মহৎ উপকারের প্রতিশোধ দেওয়া যায় না।

না, না। এমন করে বললেন না। কৃতজ্ঞতার মূল্য কম নয়। এ পৃথিবীতে ক-জন তা দিতে পারে? মাস্টারমশাই বলেন :–কথা রাখতে পেরেছি বলে আমিও কম কৃতার্থ নই হর্ষবর্ধনবাবু।

জুরিদের আপনার মতে আনতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল নিশ্চয়?

বেগ বলে বেগ। এরকম বেগ আমি জীবনে পাইনি। তিনি জানান : মুশকিল হয়েছিল কোথায় জানেন? বাকি জুরিদের সবাই বিবাহিত, বৌয়ের জ্বালায় অস্থির। তাঁদের কাছে ভজহরিবাবু একজন হীরো। তাদের মতে ভজহরিবাবু কোনো দোষ করেননি বৌকে মেরে। তারা নিজেরাও পারলে তাই করতে চায়, কিন্তু তারা পরে না, ভজহরিবাবু পেরেছেন। তাদের চেয়ে তিনি একজন বীরপুরুষ।

তাই তারা বুঝি চাইছিল সে বীরের মতই মৃত্যুবরণ করুক? ফাঁসিতে লটকাক?

না ঠিক তা নয়, তবে আমি বৌয়ের মর্ম বুঝিনে, বিয়েই করিনি আদপে। সামান্য আয়ে নিজেরই কুলায় না, বোকে খাওয়াবো কি? আমি দেখলাম না, এমন করতে হবে যাতে আইনের লাঠিও ভাঙে অথচ সাপও না মরে। অনেক কষ্টে দ্বীপান্তর দিতে পেরেছি মশাই। জুরিদের ঘরে গিয়ে–প্রায় তিনঘন্টা ধরে বক্তৃতা দিয়ে তাদের বোঝালাম,….বুঝিয়ে নিজের মতে আনলাম।

তা নইলে তারা ফাঁসি দিয়ে দিত? নিঘাৎ। গোবর্ধন প্রকাশ করে।

না। তারা চাইছিলো বেকসুর খালাস দিতে।

 শিবরাম চকরবরতির মত কথা বলার বিপদ

আর কিছু না, বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেছি খালি : চা খাও আর না খাও, আমাকে তো চাখাও।

অমনি দোকানের ও-কোণ থেকে কে যেন তার কান খাড়া করল, ছোট্ট একটি ছেলে, আমি লক্ষ্য করলাম।

দূর। এই অবেলায় এখন চা খায়? শুদু একগ্লাস জল–আর কিছু না। বন্ধুর জবাব এল :–আর-আর না হয় ওই সঙ্গে একখানা বিস্কুট। ভাগভাগি অবিশ্যি।

ভারী যে নিরাসক্তি। না বাপু, আধখানা বিস্কুটে আমার লোভ নেই, আর নীরেও আমার আসক্তি নেই তুমি জানো আমার। চা-ই চাই।

কান-খাড়া করা ছেলেটি এবার বলে উঠল?

অ্যাঁ, কি বললেন?

তোমাকে তো কিছু বলিনি ভাই।আমি বললাম : আমি বকচি এই-এই পাশের আমার পাশের কি বলব একে? এই পার্শ্ববর্তীকে।

আপনি শিবরাম চকরবতির মতো কথা বললেন না?

অ্যাঁ? কার মতো কথা বল্লাম? আমার বেশ চমক লাগে।

শিব্রাম চকরবরতির মতো।

এবার আমি হকচকিয়েই গেছি। বা রে। আমি আবার কার মতো কথা বলতে যাব? আমি কি বলতে কি আমি নিজেই কি উক্ত অভদ্রলোক সেই শিব্রাম চকরবরতি নাই?

ওই রকম মিলিয়ে-মিলিয়ে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ল্যাজামুড়ো এক করে কথা বলা খারাপ। ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। বুঝলেন মশাই?

তুমি কি–ঐ কি নাম বললে–সেই ভদ্রলোককে কখনো দেখে?

না দেখিনি, দেখবার আমার বাসনাও নেই। ঐ ভদ্রলোক আমাকে যা বিপদে ফেলেছিলেন একবার।

অ্যাঁ, বলো কি? তোমাকে তিনি বিপদে ফেলেছিলেন? আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ওকে পর্যবেক্ষণ করি কই, আমার তো তা মনে পড়ছে না।

উনি কি আর ফেলেছিলেন? ওঁর মতো কথা বলতে গিয়ে আমি নিজেই ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম। ছেলেটি বললঃ হাড় কখানা আস্ত নিয়ে যে নিজের আস্তানায় ফিরতে পেরেছি এই ঢের।

ও বুঝেচি। সেই তারা, সেই সব বিচ্ছিরি লোক, শিব্রাম চকরবরতির লেখা যারা একদম পছন্দ করে না, তারাই বুঝি? তারা তোমার কথা শুনে, তোমাকেই শিব্রাম চকরবরতি ভেবে, সবাই মিলে, ধরে বেঁধে এক চোট বেধড়ক

উঁহুহু। ছেলেটি বাধা দেয়। তারা কেন মারবে? তারা কারা? তারা কোথাথেকে এল? না, তারা নয়। সেই জন্যেই তো বারন করচি, শিব্রাম চকরবরতির মতো কথা কক্ষনো বলবেন না। ওই ধরনের কথা বলার বদভ্যাস ছাড়ুন, জন্মেম মতো ছেড়ে দিন তা নাহলে আপনাকেও হয়তো কোনদিন আমার মতো বিপদে পড়তে হবে।

বন্ধুর উদ্দেশ্যে বললাম–তাহলে চা থাক। খোকার গল্পটাই শোনা যাক। বলো তো ভাই, কান্ডটা। ওই বিষয়ে বলতে কি, সব চেয়ে বেশি আমারই আগে সাবধান হওয়া দরকার।

এবং আমার বন্ধু যিনি এতক্ষণ চায়ের বিপক্ষে ছিলেন চাউর করলেন?

না, চা আসুক। এবং তুমিও এসো এই টেবিলে। ওহে, তিন কাপ চা, আর আর তিন ডজন, বিস্কুট। চা খাই আর না খাই, তোমাদের তো কি বলে গিয়ে চা পান করাতে দোষ নেই?

খুব সামলে নিয়েছেন। ছেলেটি আমাদের টেবিলে এসে বসল : বলতে পারতেন যে ঐটেই দস্তুর। সঙ্গে বলতে পারতেন আরো। কিন্তু খুব বাঁচিয়ে নিয়েছেন। শিব্রাম চকরবরতি এখানে থাকলে, ঐ দোষের জন্যে, দস্যুকেও নিয়াসতেন বিনা দোষেই। ঐটেই ওঁর মস্ত দোষ। টেনে হিঁচড়ে কেমন করে যে তিনি এনে ফেলেন।

কি করে যে এত পারেন ভদ্রলোক, আমি আশ্চর্য হই। আশ্চর্য হয়ে আমি বলি।

যেমন করে মুর্গিতে পাড়ে, তেমনি আর কি। বন্ধুবরের অনুযোগ? এমন কি শক্ত?

শক্ত? কিছু না। ছেলেটি বলে আমরা সবাই পারি। আমাদের ক্লাসের পেত্যেক ছেলে। আমাদের বাড়িতে দাদারা, দিদিরা, এমন কি বৌদি পর্যন্ত। ওতো এনতার পারা যায়, ঐ উনি যা বললেন একেবারে মুর্গির মতোন। আস্ত ঘোড়ার ডিম। পেড়ে দিলেই হলো–পারতে কি। তবে লেখকের মধ্যে ঐ একজনই শুধু পারেন কিন্তু পাঠকের হাজার হাজার। পাঠকের মধ্যে এক আমিই যা ঠেকে শিখেচি, আমি আর পারব না। ছেলেটি নিজের অক্ষমতা জ্ঞাপন করে।

এরপর, আসল গল্পটা যতদূর সম্ভব ছেলেটির নিজের ভাষায় বলার চেষ্টা করা যাক ।

গরমের ছুটিটা কোথায় কাটানো যায়! ভাবলুম, অনেক দিন তো যাইনি, কাকার ওখানেই যাই ছেলেটি শুরু করল বলতেঃ আসানসোলে গিয়ে সোলে শান দিয়ে আসি। কলকাতার বাইরে ফাঁকাও হবে, আর আরাম করে থাকাও হবে। একেবারে আমের আশা যে ছিল না তাও না, তবে না মশাই, আমার আমাশা ছিল না। তবে, কাকার বাগানে ঢুকে আম জাম যে বাগানো যাবো সে আশা খুবই ছিল।

ছেলেটি অম্লানবদনে অকাতরে বলে যাচ্ছিল, আর আমার চোখ ক্রমশই বড়ো থেকে আরো হতে হতে, ছানাবড়া কি, লেডিকেনি পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেল। অবশেষে আমি আর থাকতে পারলাম না।

থামো, থামো। তুমি বলছ কি? তুমি কি বলছ, তুমি শিব্রাম চকরবরতি নও? তুমি নিজেই নও? ঠিক বলছ? ঠিক জানো? আমার গুরুতর সন্দেহ হচ্ছে, তুমিই শিব্রাম চকরবরতি?

আমি? না, আমি না ছেলেটি ম্লান একটুখানি হাসল।

বলো, নির্ভয়ে বলো, কোন ভয় নেই। লোকটার ওপর রাগ আছে, কিন্তু আমরা তোমাকে ধরে ঠ্যাঙাব না। আমার বন্ধুটি অভয় দিয়ে বলেন:–না, এমন সামনে পেয়ে বাগে পেলেও না।

কী যে বলেন। শিব্রাম চকরবরতি লোকটি কি এতই ছোট হবে? এই বলে ছেলেটি আত্মরক্ষার খাতিরেই কিনা বলা যায় না, অদূরবর্তী আয়নায় প্রতিফলিত নিজের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল : চেয়ে দেখুন তো। আর শিব্রাম চকরবরতির নাকি গোঁফ-দাড়ি একদম থাকবে না?

সে একটা কথা বটে। আমি ঘাড় নাড়ি ও শিব্রাম চকরবরতি লোকটা এত ছোট না হওয়াই উচিত। এতদিনে তো সাবালক হবার কথা। তবে কিনা, ছোট লোকের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তা ছাড়া–আমি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠিঃ তুমি ঠিক ছদ্মবেশে আসো নি তো? মানে কিনা–ভদ্র ভাষার বলতে হলে আপনি ছদ্মবেশে আসেন নি তো শিব্রাম বাবু?

ছেলেটি মুখ ভার করে ভাবতে লাগল, বোধহয় তারা ধরা পড়ে যাওয়া ছদ্মবেশের কথাই সে ভাবতে লাগল। আমিও ভাবতে থাকি, ঐ শিব্রাম হতভাগাটাকে অনুকরণীয় বলেই আমার ধারণা ছিল। একটু অহঙ্কারও না ছিল তা নয়। অনুকরণীয় মানে, অনুকরণের অযোগ্য। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ওর সম্বন্ধে আমার, অনেকের মতো আমারও একটা ভুল ধারণাই এতদিন থেকে গেছে। অত্যন্ত সহজেই যে-কেউ ওকে-মানে, ঐ শিব্রামটাকে টেক্কার পর টেক্কা মেরে বেটর যেতে পারে। তবে আর কষ্ট করে ওর লেখাপড়া কেন? ছছাঃ। অন্ততঃ আমি তো আর পড়ছিনে; ওর আজে-বাজে যতো বই, আজ থেকে সব তালা দিলাম, তালাবন্ধ থাকল বাক্সে।

আপনি বলছেন আমিই সেই? ছেলেটি আরো একটু ম্লান হাসল। ছদ্মবেশে এসেছি বলে আপনাদের মনে হচ্ছে? বেশ, তাহলে আমার নাক কান টেনে টেনে দেখুন। দেখতে পারেন টানাটানি করে। মুখোস হলে তো খুলে আসবে?

ছেলেটি তার মুখ বাড়িয়ে দিল। আমার, হাত সুড় সুড় করলেও আত্মসম্বরণ করে বললাম : আচ্ছা, পরে পরীক্ষা করে দেখবখন। এখন তোমার গল্প তো শেষ কর।

আরম্ভ করল ছেলেটি?

গেছি তো কাকার বাড়ি। নিরাপদে পৌঁছেচি। কাকা তখন বেদানা খাচ্ছিলেন; কোন জ্বরজারি হয়নি, এমনই সুস্থ শরীরে বেদনা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করছেন, দেখেই বুঝতে পারলাম।

আমি যেতেই বলেন, এইযে, এইযে। মন্টু যে। খবর কি? আছিস কেমন?

খবর ভাল। সামার ভেকেশন আমার কিনা। ভাবলুব, আসানসোল এসে সোলে একটু

কাকাবাবু বাধা দিয়ে বলেন : বেশ বেশ। এসেছিস, বেশ করেছিস। যখন পারবি তখনই আসবি। কাকা-কাকীর বাড়ি সবাই আসে। আসে না কে?

ডাকাডাকি না করেই তো আসে। ঐ সঙ্গে এইটুকুও যদি যোগ করতেন কাকাবাবু, ভারী খুশি হতাম। কিন্তু কাকাবাবু ওর বেশি আর এগুলেন না অধিক ভলা বাহুল্য মাত্র ভেবে চেপে গেলেন। একেবারে। বোধহয় শিব্রাম চকরবরতির বই ওঁর তেমন পড়াটড়া ছিল না।

পায়ের ধূলো নিতে না নিতেই তিনি গলে পড়লেন : এই নে। বেদানা খা।

বেদানার অনুরোধে বেশ দমে গেলাম। ও-জিনিষ অসুখবিসুখে খেতেই যা বিচ্ছিরি, তার ওপর সুস্থ শরীরে খেতেহলেই তো গেছি। বেদানাটা হাতে নিয়ে বললাম : কাকাবাবু। বেদানা দিলেন বটে, কিন্তু বলতে কি, একটু বেদনাও দিলেন।

কাকা আমার কথাটায় কানই দিলেন না।

নে নে, খেয়ে ফ্যাল। খেলে গায়ে জোর হয়। ভাল শরীরে খেলেই আরো জোর বাড়ে। নে, ছাড়িয়ে খা। কাকা বেদানা দিলে খেতে হয়।

মনে মনে আমি বলি, কাকস্য পরিবেদনা। এবং প্রাণপনে বেদনা দূর করি, এক একটাকে পাকড়ে, গলা ধরে দূর করে দিই একেবারে গালের ভেতরে। তারপর আমার গলার তলায়।

তুমি গলাধঃকরণ করে। বুঝতে পেরেছি। আমি বলি।

ঠিক বলেচেন! চমৎকার বলেছেন, কিন্তু ছেলেটি উসকে উঠেই তক্ষুনি আবার নিবু নিবু হয়ে আসে, কেমন যেন মুষড়ে পড়ে। তারপরে শুনুন।

এমন সময়ে কাকীমা এসে পড়লেন। এসেই কাকার কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করলেন।

কী, সকাল বেলায় ছেলেটাকে ধরে ধরে বেদানা খাওয়াচ্ছ? ওসব ওদের কখনো ভাল লাগে? রোচে কখনো? মন্টু, আয় চপ খাওয়াব তোকে, ভাল এঁচোড়ের চপ, আমার নিজের তৈরি রান্নাঘরে আয়।

পিতৃব্যস্নেহ থেকে পরিত্রাণ পেয়ে হাঁফ রান্নাঘরে গিয়ে উঠলাম। কাকীমা ছোট্ট একটু পিড়ি দিলেন বসতে : বোস।

না, এই ভূঁয়েই বসি। আমি বললাম : পিড়ি দিয়ে কেন আর পীড়িত করছেন কাকীমা?

অ্যাঁ, কি বললি? কাকীমা কান খাড়া করলেন।

পিঁড়ি তো নয়, পীড়ানের যন্ত্র। আমার পুনরুক্তি হলোর যন্ত্রণাও বলতে পারেন। আরো ভাল করে বললাম আবার : না, কাকীমা, আমি প্রপীড়িত হতে চাইনে।

কাকীমা যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না।

এসব আবার কেমন কথা? কাকীমা হাঁ করে রইলেন : যন্ত্র আবার যন্ত্রণা কীসব যা তা বকচিস আবোল তাবোল? কাকীমার দুই চোখ বিস্ময়ে চোখা হয়ে উঠল।

চপ দিন, তাহলে চুপ করব। বললাম আমি। কাকীমা একটু ইতস্ততঃ করে চপের প্লেটটা এগিয়ে দিলেন।

কামড়াতে গিয়ে দেখি দাঁত বসে না। চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র বাইরে এ আবার কি জিনিস রে বাবা?

কাকীমা, এ কি বানিয়েছেন? এ কি চপ? এর চাপ তো আমি সইতে পারছি না। আমি জানাইঃ এচোড়গুলো আগে কিমা করে নেন নি কেন কাকীমা? এ যে চোরেরাও অখাদ্য হয়েছে। এই চাপের আঘাত না করে আমাকে চপেটাঘাত করলেও পারতেন। আমি হাসিমুখে খেতাম।

ফাকীমার চোখ কপালে উঠে যায়, বহুক্ষণ তার মুখে কথা সরে না। তারপর তাঁর সমস্ত মুখ কেমন একটা আশঙ্কার আবছায়ায় ভরে ওঠে। তিনি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করেন : ঢোকবার আগে তুই এ-বাড়ির ছাঁচতলাটায় দাঁড়িয়ে ছিলি না? তুই-ই তো? আমি ওপর থেকে দেখলুম যেন?

হ্যাঁ, ভাবছিলুম, আপনাদের নতুন দারোয়ান বাড়িতে ঢুকতে দেবে কিনা! আমাকে দ্যাখেনি তো আগে। আমি কৈফিয়ত দিই : নাম লিখে পাঠাতে হবে ভেবে কাগজ পেনসিল খুঁজছিলাম, কিন্তু দরকার হলো না। সে একটু কাত হতেই আমি তার পেছন দিক দিয়ে সাঁত করে গলে পড়েছি।

ছাঁচতলাতে তুইই দাঁড়িয়েছিলি! কাকীমার সমস্ত মুখ ফ্যাকাসে হয়ে আসে; তাই তো বলি! কেন আমার এমন সর্বনাশ হলো।

কাকীমা পা টিপে টিপে পেছোতে থাকেন : চুপ করে বসে থাকো। নড়ড়া না যেন। আমি আসচি এক্ষুনি।

কাকীমার এই অদ্ভুত বিহেভিয়ার আমি যতই ভাবছি ততই মনে মনে হেভিয়ার হচ্ছি। ওরকম ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার মানে? আমিও কি একটা এঁচোড়ের চপ না কি?

একটু পরে কে যেন দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে। আবার কে একজন, একটু গলা বাড়িয়েই সরে যায়। আমার কাকতুত ভাইবোন সব, বুঝতে পারি। কাকার আর সব পরিবেদনা, কাকীমার অন্যান্য অনাসৃষ্টি। ইকোয়ালি অখাদ্য। এক একটি পাকা এঁচোড়ের চপ! কেন বাপু, অমন উঁকিঝুঁকি মরামারি কেন? আমি যদি এমনই দ্রষ্টব্য, সামনাসামনি এসে কি আমাকে দেখা যায় না?

ওদের সবার হাবভাব আমার ভারী খারাপ লাগে। কেমন কেমন ঠেকে যেন। আশপাশ থেকে চাপা গলা কানে আসে, চারধার থেকে ফিস ফিস গুজ গুজ শুনি, আর আমার দু-হাত নিসপিস করতে থাকে। ইচ্ছে করে, হাতের নাগাল না পাই, কসে এক ঘা–এই চপ ছুঁড়েই লাগাই না কেন এক একটাকে?

ভাবতে ভাবতে যেমন না দরজা তাক করে একটা চপ নিক্ষেপ করেছি ওই নেপথ্যের দিকেই–অমনি হুটপাট বেধে গেছে। হুড়মুড়, দুড়দুড়, হৈ-হৈ, দুদ্দাড়–রৈ রৈ কাণ্ড!

বাবা রে! মা রে! ধরলে রে! গেছি রে! কি ভূত রে বাবা! খেয়ে ফেললে রে! ভারী হৈ চৈ পড়ে গেল হঠাৎ।

আমি বিরক্ত হই। ভারী অসভ্য তো এরা! খেয়ে ফেললাম কখন? ও-চপ তো খেয়েই আমি ফেলেচি, এঁটো, তো নয়, তবে কেন?

অবশেষে কাকীমা এলেন। সঙ্গে সঙ্গে এল সনাতন। সনাতন এ-বাড়ির পুরাতন চাকর। সনাতন–কাল থেকে ওকে দেখছি।

দুজনেই সসঙ্কোচে ঢুকল।

সনাতন একেবারে আমার অদূরে এসে দাঁড়াল। কীরকম চোখ পাকিয়ে কটমট করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে, যেন চিনতেই পারছে না আমায়।

পুরানো চাল যেমন ভাতে বাড়ে, পুরানো চাকর তেমনি চালে বাড়বে, এ আর আর বিচিত্র কি? তবু আমি একটু অবাক হলাম।

কাকীমা একি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

কাকীমা কি রকম একটা সন্ত্রস্ত ভাবে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন, বেশি আর এগোননি। তিনি কোন জবাব দিলেন না। তার পেছনে, চোখ বড়ো বড়ো করে বাড়ির যত ছেলেমেয়েরা, ঝি চাকর যত!

সনাতন বিড়বিড় করে কী সব বকে, আর সরষে ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমায় লাগায়। আমার সারা গায়ে।

আমার ভারি বিচ্ছিরি লাগে। এবং লাগেও মন্দ না বলি : সনাতন, এসব কি হচ্ছে? তোমাদের সব মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কী বিড়বিড় করচ? তোমার ঐ কটাক্ষ আমার একেবারেই ভাল লাগছে না।

সনাতন তবুও বিড় বিড় করে।

কথং বিড়বিড়য়সি সনাতনং? আমি সংস্কৃত করে বলি : সনাতন, তোমার এ বিড়ম্বনা কেন?

আপনি কে? সনাতন এতক্ষণ পরে একটা কথা বলে।

আমি–আমি তোমাদের মন্টু। আমাকে চিনতে পারছ না, সনাতন? আমি অবাক হয়ে যাই।

মন্টু না হাতি! সনাতন বলে? বলুন আপনি কে? আপনি কি আমাদের বেলগাছের বাবা? দয়া করে এসেছেন পায়ের ধূলো দিতে, আজ্ঞে?

ওসব রসিকতা রাখো। কারো বাবা-টাবা আমি নই, তা বেলগাছেরই কি আর তালগাছেরই কি! ওসব গেছো ছেলেদের আমি ধার ধারিনে।

তবে কে তুমি? তুমি কি তাহলে আমাদের গোরস্থানের মামদো? সনাতন একটু সভয়েই এবার বলে।

বলছি না, আমি মন্টু? ন্যাকামি হচ্ছে কিনা? কদ্দিন কতো চকোলেট খাইয়ে তোমায় মানুষ করলাম! আমার রাগ হয়ে যায়।

মন্টু না ঘন্টা। আমাকে আর শেখাতে হবে না। আমার কাছে চালাকি? ভুত চরিয়ে চরিয়ে আমার জীবন গেল। হাড় ভেঙ্গে সুরকি বানিয়ে দেব। বল, কোন ভূত আমাদের মন্টুর ঘাড়ে চেপেছিস? বল আগে?

বোধ হয় কোন রামভূত! আমি আর না বলে পারি না। আধাগল্পের মাঝখানেই বাধা দিয়ে। বলি। স্বনামধন্য আমার নিজের প্রতিই কেমন যেন একটু কটাক্ষ হয়, কিন্তু না পারা যায় না।

সনাতনও ঠিক ঐ কথাই বলল। বলল, গিন্নীমা, এ হচ্ছে কোন রামভূত! সহজে এ ছাড়বে না। রাম নামেও না। সরষে-পোড়া নয়, এর অন্য ওষুধ আছে।

এই বলে–

ছেলেটি আরো বিস্তরিত করেঃ সনাতন করল কি, জলভর্তি বড় একটা পেতলের ঘড়া এনে হাজির করল আমার সামনে। বলল বুঝেছি, তুই কে? অ্যাশশ্যাওড়ার শাকচুন্নী। টের পেয়েছি ঢের আগেই তোল তোল এই ঘড়া দাঁতে করে।

ভাবুন দিকি, কী ব্যাপার! ঘড়া দেখেই তো আমার চোখ ছানাবড়া। আমাকে ওরা যে কী ঠাউরেছে তাও আর আমার বুঝতে বাকী নেই। ওদের কাছে আমি এখন কিম্ভুতকিমাকার! আমার প্রতি ওদের কারু যে মায়া দয়া হবে না তাও বেশ বুঝতে পেরেছি। আমার ভূত না ছাড়িয়ে ওরা ছাড়বে না।

তবু একবার কাকীমাকে ডাকি শেষ ডাকা ডেকে দেখি : কাকীমা, এসব তোমাদের কি হচ্ছে? আমাকে তোমরা পেয়েছ কি? এসব কি বাড়াবাড়ি? আমার একদম ভাল লাগছে না।

কাকীমা চোখের জল মুছে চুপ করে থাকেন।

তখন সনাতনকে নিয়েই শেষ চেষ্টা করতে হয়। তাকেই বলি : বাপু, তোমার এই সনাতনপদ্ধতি অতিশয় খারাপ। কি চাও বলো তো? চকোলেট না চারটে পয়সা? তাই দেব, ছেড়ে দাও আমায়।

শাকচুন্নী ঠাকুরন, আর নাকে কান্না কেঁদনি! ভাল চান তো যা বলি তাই করুন দিকি এখন। এই বলে সতাতন ঘড়াটাকে মন্ত্র পড়ায়।

আমার মাথা ঘুরে যায়! জলভরা ঐ বড় ঘড়া-এক মণের কম হবে না। দুহাতেই কোনদিন তুলতে পারিনি, আর তাই কিনা, মুষ্টিমেয় এই কটা দাঁতে আমায় তুলতে হবে?

জাতও গেল, দাঁতও গেল, প্রাণও যায় যায়!

ধমক লাগায় সনাতন :–ভাল চাস তো ন্যাকাপনা রাখ! তোল দাঁতে করে। নইলে দেখেছিস—

বলতে না বলতে সনাতন—

ছেলেটি থেমে যায়। মুখ চোখ তার লাল হয়ে ওঠে। চকচকে চোখ ছলছল করতে থাকে।

আমার বন্ধুটি উৎসাহ দেয় ও বলো বলো–জমেছে বেশ।

আমি কিছু বলতে পারি না। মুখ কাঁচুমাচু করে বসে থাকি। সব দায়, সমস্ত অপরাধ যেন আমার আমারই কেবল! এই কেবলি আমার মনে হতে থাকে।

বলতে না বলতে সনাতন ঘা কতক আমাকে লীগয়ে দেয়! এই সনাতন, যাকে আমি চকোলেট খাইয়েছি, ছোটবেলায় কত না ওর পিঠে চেপেছি, কতই না ওকে পিটেছি, আর সেই কিনা….

ছেলেটির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। আমার এক চোখ দিয়ে জল গড়ায়। আমার বন্ধু রুমালে নাক মোছেন।

জগতের এই নিয়ম। বর্ষণমুখর চোখটা মুছে ফেলে আমি দার্শনিক হবার চেষ্টা করি। তুমি কেঁদ না, কেঁদ না তোমরা সনাতন রীতিই এই! আজ তুমি যার পিঠে চাপছ, কাল তোমার পৃষ্ঠপোষক! উপায় কি? এই বলে আমার যথাসাধ্য ওদের সান্ত্বনা দিই।

ছেলেটি ম্লান একটুখানি হেসে আবার শুরু করে : বেশ বোঝা যায়, সনাতন আমার হাতে যত না মার খেয়েছে এর আগে, এখন বাগে পেয়ে সে সবের শোধ তুলে নিচ্ছে। এই সুযোগে এক ছুতো করে বেশ একচোট হাতের সুখ করে নিচ্ছে। সুদে আসলে পুষিয়ে নিচ্ছে, বেশ বুঝতে পারি।

কি করি? কাঁহাতক মার খাব? প্রাণের দায়ে ঘড়াকে মুখে তুলতে যাই। কিন্তু পারব কেন? একটু আগে আমি যে চপেই দাঁত বসাতে পারিনি, কিন্তু সে তো এর চেয়ে ঢের নরম ছিল। আর এর চেয়ে হালকা তো বটেই!

সনাতন কিন্তু ঘড়ার চেয়েও কড়া। সে ধা করে তার ওপরেই—

ছেলেটি আর বলতে পারে না।

বলতে হবে না। আবার ঘা কতক! বুঝতে পেরেছি। আমার বন্ধুটি ভগ্নকণ্ঠে বলেন, এবং রুমালে নিজের চোখ মুছতে ভুল করে তার পাশের আরেক জনের মুখ মুছিয়ে দেন।

আমার অপর চোখটি দিয়ে এবার জল গড়াতে থাকে।

তখন আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়। এই ধাক্কায় মূচ্ছিত হয়ে গেলে কেমন হয়? তাহলে হয়তো এ-যাত্রা বেঁচে যেতেও পারি। রোজার হাত থেকে ডাক্তারের খর্পরে পড়ব, হয়ত ইনকেজসনই লাগাবে, তেঁতো ওষুধ গেলাবে, কিন্তু সেও ঢের ভাল এর চেয়ে।

ব্যস, অমনি আমি পতন ও মূৰ্ছা–একেবারে নট নড়ন চড়ন, নট কিছু!

এই বলে এতক্ষণ পরে ছেলেটি একটু হাসল, এবার আত্মপ্রসাদের হাসি!

মূছার মধ্যেই আমি শুনতে থাকি, চোখ বুজেই শুনতে পাই, সনাতন বলছে–গিন্নীমা, আমার মনে হয় ভূত নয়। ভূত হলে আলবৎ দাঁতে করে তুলতো। এর চেয়ে ভারী ভারী ঘড়া অক্লেশে তুলে ফেলে। আমার নিজের চোখেই দেখা! আমার মনে হয় মন্টুবাবুর মাথা বিগড়ে গেছে। বা বড় বড় চুল, এ গরমে, তাই হবে। আপনি কাচিটা আমায় দিন ত! চুলগুলো কদম ছাঁট করে মাথায় ঠাণ্ডা গোবর লাগালে দু-এক দিনেই থোকাবাবু শুধরে উঠবেন। শিবঃ রচনাসমগ্র-১২-ক

এই কথা যেই না আমার যাওয়া, আমি তো আর আমাতে নেই। অ্যাঁ, আমার এমন সাধের একচোখ–ঢাকা চুল–শিব্রাম চকরবরতির দেখাদেখি কত করে বাড়িয়েছি–

আমি বাধা দিয়ে বলি :–তবে যে তুমি বললে, শিব্রাম চকরবরতিকে কখনো দেখনি?

ঠিক স্বচক্ষে দেখিনি। তবে আজকাল ওঁর যত বইয়ে ওঁর চেহারার সে সব কার্টুন বেরয় তাই দেখেই আন্দাজ করে রেখেছিলাম। আপনিও তো মশাই প্রায় তার মত করেই চুল রেখেচেন দেখ যাচ্ছে। আমার প্রতি কটাক্ষ করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে ছেলেটিঃ কত কষ্ট করে কত বকুনি সয়ে, কত সমাদরে বাড়ানো এই চুল, তাই যদি গেল, তাহলে আর আমার থাকল কি!

সনাতনের গিন্নীমা কাঁচি আনতে গেছেন, আর আমি এদিকে চোখ টিপে টিপে চেয়ে দেখলাম, সনাতন ঘড়াটা সরাচ্ছে, সেই সুযোগে আমি না, একলাফে তিড়িং করে না উঠে, চৌকাঠ পেরিয়ে, কাকাতুত রাক্কোসদের এক ধাক্কায় কক্ষচ্যুত না করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে একেবারে সেই সদরে!

দারোয়ান হতভাগা, দ্বারে যার ওয়ান হয়ে সব সময়ে থাকবার কথা, সে ব্যাটা তখন জিরো হয়ে পড়েছিল। ইংরিজি ওয়ান-এর বদলে, বাংলা ১ বনে গিয়ে পা গুটিয়ে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে জিবরাচ্ছিল, আমি না সেই ফাঁকে…

ধর ধর ধর ধর! সোরগোল উঠল চারদিকে।

আর ধর! এই ধুরন্ধর ততক্ষণে–ছেলেটি থেমে গেল। গল্পটাকে সুচারুরূপে শেষ করার জন্য, কপাল কুঁচকে, যুৎসই একটা কথা খুঁজতে লাগল মনে হয়।

পালিয়ে এসেচ। বুঝতে পেরেছি, আর বলতে হবে না। আমার বন্ধুটিই পালা শেষ করেন।

পালানো হচ্ছে একটা লম্বা ড্যাশ-ওর কোথাও ফুলস্টপ নেই।

তোমার নামটি কি? আমি জিগ্যেস করি? মন্টু তো বলেছ। কিন্তু ভাল নামটি কি তোমার?

ধ্রুবেশ।

বাঃ বেশ! বলতে গিয়ে আমার বলা হয় না। গলায় আটকায়।

শুঁড়ওয়ালা বাবা

বই-টই গুছিয়ে নিয়ে বেরুবার উদ্যোগ করছে, এমন সময়ে দাদামশাই ডেকে বললেন–আজ আর স্কুল যেতে হবে না। তোর গুঁড়-ওলা বাবা আসচেন, দুপুরে এসে পৌঁছনর তার পেয়েছি। আজ আবার মেল ডে, আমার তো আপিস কামাই করা চলবে না। বাড়ি থাকবি তুই!

ইস্কুলে যেতে হবে না জেনে মন্টুর ফুর্তি হল, কিন্তু সে বেশ ভাবনায় পড়ে গেল। শুঁড়-ওলা বাবা আবার কি রকম বাবা?

সে ত প্রায় বছর দশেক হতে চলল তার বাবা স্বর্গে গেছেন সে শুনেছে, তার কিছুদিন পরে মা ও তাঁর অনুসরণ করলেন। তখন থেকে মন্টু থেকে মামার-বাড়িতেই মানুষ। এতদিন সে কোনো প্রকার বাবার সম্বন্ধেই কিছুমাত্র উচ্চবাচ্য শোনেনি, তবে অকস্মাৎ এই শুঁড়-ওলা বাবার প্রাদুর্ভাব হলো কোত্থেকে আবার?

বই-টই রেখে দিয়ে মন্টু বৈঠকখানায় গিয়ে বসল এবং মনে মনে বাবার বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে লাগল।

বাবা তাহলে দুরকম? এক শুঁড় আছে আরেক–শুঁড় নেই। তবে সাধারণত বাবাদের গুঁড় থাকে না। যথা নীতু, নীলিম ও ঝনকুর বাবার নেইকো। যে কটি বন্ধুর বাবার সঙ্গে তার চাক্ষুষ ঘটেছে তাঁদের গুঁড় নেই।

মন্টুর মতে বাবাদের গুঁড় না থাকাই বাঞ্ছনীয়। বাবারা ছেলেদের গাধা হওয়া পছন্দ করেন না, বাবাদের হাতি হওয়াটাও তেমনি ছেলেদের রুচিতে বাঁধে! তবে মন্টুর দুর্ভাগ্য, বেচারার বাবাই নেই। আর সব বন্ধুর কেমন বাবা আছে, তারা বাবার কাছ থেকে কত কি প্রাইজ পায়, তমু তো সেদিন একটা সাইকেল পেয়ে গেছে, কিন্তু বেচারা মন্টু–।

যাক সৌভাগ্য বলতে হবে, এতদিন বাদে তবু মন্টুর একজন বাবা আসছেন। তবে দুঃখের মধ্যে ঐ যা– গুঁড়! তার জন্যে আর কি করা যায়, নেই মামার চেয়ে কানা মামা যেমন ভালো, তেমনি একেবারে বাবা না থাকার চেয়ে শুঁড়ওলা বাবাই মন্দ কি! তারপর কাল আবার মন্টুর জন্মদিন–হয়ত তিনি কেবল উঁড় নাড়তে নাড়তেই আসছেন না, কত কি উপহারও ঝাড়তে আসচেন।

বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা, এমন সময়ে এক ভদ্রলোক মন্টুদের বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নামলেন এবং সোজা ভেতরে এসে জিজ্ঞাস করলেন–এইটে ঘনশ্যামবাবুর বাড়ী না?

–হ্যাঁ।

–তাকে বলগে সত্যপ্রিয়বাবু এসেছেন। আমি সকালে তার করেছি, পেয়ে থাকবেন বোধহয়।

তবে ইনিই! মন্টুও পায় এই আন্দাজ করেছিল। খুব মোটা বটে, তবে হাতির কাছাকাছি একেবারে নন। তাছাড়া, শুঁড় নেই। শুঁড় না থাকার জন্য মন্টু যে ক্ষুব্ধ হলো তা নয়, বরং তাকে যেন একটু খুশিই দেখা গেল।

–দাদামশাই আপিস গেছেন। আপনি বসুন।

–তুমিই বুঝি উৎপল? আমি তোমা গুরুজন। প্রণাম করো। মন্টু ঈষৎ হতভম্ভ হয়ে জিজ্ঞাসা করল–কাকে?

–কেন, আমাকে? আশ্চর্য হবার কি আছে? গুরুজনদের ভক্তি করতে শিখবে, তাদের কথা শুনবে। এসব শেখনি?

–ও কি? ও কি প্রাণাম হলো? দেখছি এখানে শিক্ষাদীক্ষা সুবিধা হয়নি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে হয়। যাক, ক্রমশঃ সব শিখবে। এখান থেকে গেলেই–

–আপনি কি আমাকে নিয়ে যাবেন এখান থেকে? কোথায়?

–কেন? দেশে। তোমার বাবার বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে তোমাকে নিয়ে যেতেই ত আমি এসেছি।

–আপনি আমার বাবা যদি তবে আপনার শুঁড় কই?

–শুঁড়?

-–হ্যাঁ। দাদামশাই যে বললেন যে মন্টু তুই তুই বাড়ি থাকিস, তোর শুঁড়গুল বাবা আজ আসবেন। কিন্তু আপনার শুঁড় নেইত! শুঁড় কোথায়?

–হু।

হু বলে ভদ্রলোক ভারী গম্ভীর হয়ে গেলেন, মন্টুর সঙ্গে তারপর আর কোনো কথাই তার হলো না! ঘাট হয়ে গেছে ভেবে মন্টু ম্লান মুখে চুপ করে রইল। সে বইয়ে পড়েছিল বটে যে কানাকে কানা বলিও না, খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না ইত্যাদি–পড়েছিল এবং মুখস্থ করেছিল, কিন্তু বইয়ের হুকুম কাজে না মানলে যে অঘটন ঘটবে তা সে ভাবেনি। যার পা নেই তাকে খোঁড়া বললে সে যেমন মনঃক্ষুণ্ণ হয়, এঁকে শুঁড় নেই বলাতে বোধহয় ইনি তেমনি বিচলিত হয়েছেন! অঙ্গহীনতার অনুযোগ না করাই মন্টুর উচিত ছিল।

ঘনশ্যামবাবু অফিস থেকে ফিরলে অন্যান্য কথাবার্তার পর সত্যপ্রিয়বাবু বললেন–দেখুন, উৎপলকে আমি নিয়ে যেতে চাই। দাদা বৌদি নেই, কিন্তু আমি ত আছি। আমিই এখন ওর অভিভাবক।

-–কেন, এখানে তো ও বেশ আছে। সেই অজ পাড়াগাঁয়ে–

–তাহলে খুলেই বলি। এখানে ওর যথার্থ শিক্ষা হচ্ছে না।

–যথার্থ শিক্ষা বলতে কি বোঝায়?

–অনেক কিছু। তা নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করা আমার পক্ষে বাতুলতা। তবে এখানে থেকে যথার্থ অশিক্ষা যে ওর হচ্ছে তাতে ভুল নেই।

–যথার্থ অশিক্ষা হচ্ছে? কি রকম শুনি।

–আপনি বলেচেন আমি নাকি ওর গুঁড়-ওলা বাবা। উৎপল তাই বলছিল। এতদ্বারা ওকে মিথ্যাবাদিতা শেখানো হচ্ছে। আমি তো ওর বাবা নই, তাছাড়া আমার গুঁড়ও নেই।

–এই কথা! তুমি ওর কাকা তো বটে! ব-এ শুঁড় দিলেই ক হয় এও বোঝে না বাপু!

কিন্তু কিছুতেই সত্যপ্রিয়কে বোঝানো গেল না; পরদিন সকালেই মন্টুকে নিয়ে তিনি রওনা হলেন। পথে যেতে যেতেই মন্টুর যথার্থ শিক্ষা শুরু হয়ে গেল।

-–দেখ উৎপল! আজ আমি তোমাকে মাত্র তিনটি উপদেশ দেব। যদি মানুষ হতে চাও তাহলে আমার এই তিনটি উপদেশ তোমার মূলমন্ত্র হবে আর জীবনে সর্বদা মেনে চলবে! প্রথম হচ্ছে, সত্যনিষ্ঠ হবে, সত্যের জন্য ত্যাগ, যে কষ্ট, যে লঞ্ছনাই স্বীকার করতে হোক না কেন, কখনো পিছুবে না। দ্বিতীয় উপদেশ, সব সময়ে নিয়মানুবর্তী হবে। নিয়ম না মানলে শৃঙ্খলা থাকে না, তাতে করে সামাজিক ব্যবস্থায় গোলযোগ ঘটে। আমার তৃতীয় উপদেশ হচ্ছে এই–

উপদেশগুলো মন্টুর কানে যাচ্ছিল কিনা বলা যায় না, কানে গেলেও তার মানে নিশ্চয় তার মাথায় ঢোকেনি। একটু আগে একটি ছেলে তার পাশ দিয়ে যাবার সময় আকারণে, বোধহয় অকারণ পুলকেই, মাথায় চাটি মেরে গেছল, কাকার নিয়ম-নিষ্ঠা প্রচারের মাঝখানে তার প্রতিশোধ নেবার সুযোগ সে খুঁজছিল। তৃতীয় উপদেশের সূত্রপাতেই, পথে চলতি ছেলেটি আবার যেমনি তার পাশে এসেছে, অমনি সে তাকে ল্যাং মেরে ধরাশায়ী করে ফেলল।

মন্টু নিজের ক্ষুদ্রবুদ্ধি অনুসারে সম্ভবত নিয়মরক্ষাই করেছিল, কিন্তু সত্যপ্রিয় উলটো বুঝলেন–দ্যাখো, এইমাত্র তুমি পথে চলার নিয়মভঙ্গ করলে!

–ও যে আমাকে চাটি মারল আগে!

–আমি তো দেখেছি, কিন্তু ওকে ক্ষমা করাই তোমার উচিত ছিল নাকি? আমার তৃতীয় উপদেশ হচ্ছে, কখনো কাউকে আঘাত করবে না। কেউ যদি তোমার বাঁ গালে চড় মারে তাকে ডান গাল ফিরিয়ে দেবে?

স্টেশনে গিয়ে সত্যপ্রিয় দারুণ ভাবনায় পড়লেন। মন্টুকে জিজ্ঞাসা করলেন –তোমার কি টিকিট কিনব? হাফ না ফুল? একটু মুশকিল আছে দেখছি।

-–আমি তো হাফ-টিকিটে যাই।

–বারো বছর পুরে গেলে পুরো ভাড়া দিতে হয়। আজ তোমার ঠিক বারো বছর পূর্ণ হবে। তবে হিসেব করে দেখলে ঠিক বারো বছরে পড়তে এখনো তোমার চার ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট তের সেকেন্ড বাকি। তারপর থেকেই তোমার ফুল টিকিটের বয়স হবে।

–তা কেন? আমাদের পাড়ার হবালা দেখতে বেঁটে? কিন্তু তার বয়স সতের বছর। সে এখনো হাফ-টিকিটে যায়, তাকে কই ধরে না তো।

–এতক্ষণ কি বোঝালাম তোমাকে? সর্বদা সত্যনিষ্ঠ হবে–বাক্যে, চিন্তায় এবং আচরণে। কাজেই এখনো যখন তোমার বারো বছর পূর্ণ হয়নি, এখন ফুল টিকিট কেনা যেতে পারে না। কিন্তু গাড়িতে যেতে যেতে পূর্ণ হবে, সেইটাই ভাবনার কথা! আচ্ছা তখনকার কথা তখন দেখা যাবে।

গাড়িতে উঠে সত্যপ্রিয় একদৃষ্টে হাতঘড়ির দিকে চেয়ে রইলেন। মন্টু জানালার ফাঁকে বাইরের পৃথিবীর পরিচয় দিতে লাগল।

কিন্তু যেই না চার ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট তের সেকেন্ড গত হওয়া, অমনি সত্যপ্রিয়বাবু তাঁর বিপুল দেহ নিয়ে গাড়ির গ্যালার্ম সিগন্যালের শেকল ধরে ঝুলে পড়লেন। ফল হলো ঠিক মন্ত্রের মত ঝড়ের বেগে যে-গাড়ি ছুটছিল, গাছপালাদের ছোটাচ্ছিল, দুধারের দিগন্ত প্রসারিত মাঠের মধ্যখানে অকস্মাৎ তা থেকে গেল। ট্রেনের গার্ড এসে জিজ্ঞাসা করলেন–কে শেকল টেনেছে?

সত্যপ্রিয় বুঝিয়ে বললেন, দেখুন এই ছেলেটির বারো বছর এইমাত্র পূর্ণ হলো। এর পর তো একে আর হাফ টিকিটে নিয়ে যেতে পারি না; কোনে স্টেশনে থামলেই ভাল হোতো, কিন্তু মাঠের মাঝখানে যে বয়স পূর্ণ হবে তা কি করে জানব বলনু! অসত্যকে প্রশ্রয় দিতে আমি অক্ষম, তা ছাড়া রেল কোম্পনীকে আমি ঠকাতে চাইনে। ওর হাফ-টিকিট আছে। এখান থেকে পুরুলিয়া পর্যন্ত আরেকটা হাফ-টিকিট আপনি আপনি দিন কিম্বা হাফ- টিকিটের ভাড়া নিয়ে রসিদ দিন।

— এই জন্য গাড়ি থামিয়েছেন? আচ্ছা পরের স্টেশনে দেখা যাবে।

–তা দেখতে পারেন, কিন্তু ভাড়া এখান থেকে ধরতে হবে পরের স্টেশন থেকে নিলে চলবে পরের স্টেশনে গাড়ি থামতেই গার্ড সত্যপ্রিয়কে জানালেন যে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে! তিনি আকাশ থেকে পড়ে বললেন–কেন, গ্রেপ্তার কিসের জন্য?

–দেখছেন না। অকারণে শেকল টানলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা! স্পষ্টই লেখা রয়েছে। দরজার মাথায় ওই!

–অকারণে তো টানিনি।

–সে কথা আদালতে বলবেন।

সত্যপ্রিয় কিছুতেই গাড়ি থেকে নামবেন না, সত্যের মর্যাদা রাখবার জন্য যা করা দরকার, যা প্রত্যেক সত্যনিষ্ঠ ভদ্রলোকেই করবে, তাই তিনি করেছেন। তিনি তো কোনো নিয়ম লঙ্ঘন করেননি, কারণ গুরুত্বর কারণ ছিল বলেই শেকল টেনেছেন। কাজেই তিনি প্রেপ্তার হতে নারাজ, এটে বেশ ওজস্বিনী ভাষায় সবাইকে জানিয়ে দিলেন।

তিনি নামতে প্রস্তুত নন, অথচ তিনি না নামলে ট্রেনও ছাড়তে পারে না অনর্থন ডিটেন হতে হবে ভেবে সত্যপ্রিয়র সহযাত্রীরা গার্ডের সাহায্যে অগ্রসর হল। মাঠের মাঝখানে গাড়ি থামানোর জন্য তারা তখন থেকেই বিরক্ত হয়ে আচে। সকলে মিলে তাকে ধরে জোর করে নামাতে গেল। টানা টানিতে সত্যপ্রিয় দামী সিল্কের পাঞ্জাবিটা গেল ছিঁড়ে; সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেজাজও গেল রুখে, তিনি ধা করে একজন সহযাত্রীর নাকে ঘুসি মেরে বসলেন। তখন সকলে মিলে চাদা করে তাঁকে ইতস্ততঃ মারতে শুরু করে দিলে। কদাচ কাহাকেও আঘাত করিয়ো না– জীবনের এই মূলমন্ত্র তিনি ভুলে গেলেন। তবে, বাঁ গালে মার খাবার পর ডান গাল তিনি বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন বটে, কিন্তু সেটা বোধ হয়, বাধ্য হয়ে এবং অনিচ্ছাসত্বে, কেননা আক্রমণ থেকে এক গাল বাঁচাতে গিয়ে অন্য গাল বিপন্ন হচ্ছিল। অসুবিধা এই যে দুটো গাল এক সঙ্গে ফেরানো যায় না।

একা সত্যপ্রিয় কি করবেন? খানিকক্ষণ খন্ডযুদ্ধের পরেই দেখা গেল যে একা তিনি সাত জনকে মারবার চেষ্টা করে কাউকেই বিশেষ মারতে পারেননি, কিন্তু সাত জনের মার তাঁকে হজম করতে হয়েছে। সকলে মিলে তাকে চ্যাংদোলা করে স্টেশনের একটা গুদাম ঘরে নিয়ে ফেলে তার বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দিল–সেই যতক্ষণ না থানার থেকে পুলিশ এসে তার হেফাজত নেয়। মন্টুও কাকার সঙ্গে স্বেচ্ছায় সেই ঘরে আটক রইল।

তারপর ট্রেন ছাড়ল। স্টেশন জুড়ে ব্যস্ত উত্তেজনা, বিরাট সোরগোল, সেই সব গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। ছোট্ট স্টেশনটা সত্যপ্রিয়র মত নির্জীব নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল। সেই বদ্ধ ঘরের মধ্যে সত্যপ্রিয় ঘোৎ ঘোঁৎ করতে লাগলেন। তাঁকে তখন আর চেনাই যায় না। সমস্ত মুখখানা ফুলে মস্ত হয়েছে, চোখ দুটো ছোট হয়ে গেছে, প্রকাণ্ড মুখে তাদের খুঁজেই পাওয়া যায় না–হ্যাঁ, এতক্ষণে হাতির মাথার সঙ্গে তুলনা করা চলে। অচিরেই হয়ত শুঁড়ও বেরুতে পারে এমন সম্ভাবনা আছে বলে মন্টুর সন্দেহ হতে থাকে।

শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনী

দেশবিদেশ বেড়াতে তোমরা সকলেই খুব ভালবাস। সব ছেলেই ভালবাসে। কিন্তু আমাদের শ্রীকান্তর। ভ্রমণে আনন্দ নেই, তার কাছে ভ্রমণের মানেই হচ্ছে দেড় মণ।

তার মামা ভারি কৃপণ কোথাও যেতে হলে গোটা বাড়িখানাই সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কি জানি, বিদেশে কোনো জিনিসের দরকার পড়লে যদি সেটা আবার পয়সা খরচ করে কিনতে হয়! কিন্তু শ্রীকান্তর এদিকে প্রাণ যায় সেই বিরাট লটবহর তাকেই বইতে হয় কি না! সে-সব মালপত্র গাড়িতে তুলতেও শ্রীকান্ত, গাড়ি থেকে নামতেও শ্রীকান্ত, স্টেশনে যে কুলি নামক একজাতীয় জীবের অস্তিত্ব আছে, একথা শ্রীকান্তকে দেখলে মামা একদম ভুলে যান।

কেবল কুলির কাজ করেই কি নিষ্কৃতি আছে? তাকে সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গাড়ির দরজায় পাহারা দিয়ে। কেন না মামার ধারণা, ওইভাবে দরজার মুখে মাথা গলিয়ে খাড়া থাকলে সে কামরার দিকে কেউ আর এগোয়ে না! এবং যে-কামরার দিকে কেউ এগোয় সেদিকে কেবল একজন নয়, সেই স্টেশনের যত ভোলদাস সবাই সেই কামরাটার দিকেই ঝুঁকে পড়ে–তা তার ভেতর জায়গা থাক বা না থাক। কিছু দূরে খালি কামরা থাকলেও সেদিকে তাদের যেন দৃষ্টি যায় না।

তার মামা আবার পারতপক্ষে মেল-গাড়িতে যান না, প্যাসেঞ্জার গাড়ি পেলে। যা দু-চার পয়সা বাঁচে। সময়ের আর কি মূল্য আছে বল? দু-ঘন্টা পরে পৌঁছলে যদি দুটো পয়সা বাঁচে, তারই দাম। প্যাসেঞ্জারে গাড়ির সব স্টেশন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়–দু-তিন মিনিট অন্তর স্টেশন–কাজেই একটুখানি বসতে না বসতে অবার গিয়ে দরজায় দাঁড়াতে হয়। রাত্রেও ছাড়ান নেই–কেন না তখন যাতে কামরাতে স্থান বাহুল্য না কমে, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখা দরকার। তার মামা আয়েসি লোক, সারারাত দিন গাড়িতেওবাড়ির মতো আরাম চান–তখন যদি অনাহুত কেউ এসে তার জায়গা জুড়ে বসবার জন্য তার ঘুম ভাঙতে চায়, তাহলে যে কি দুর্ঘটনাই ঘটে তা শ্রীকান্ত ভেবে পায় না। কাজেই রিজার্ভ কামরার নোটিশ বোর্ডের মতো তাকে গাড়ির দরজায় লটকে থাকতে হয়।

এই সব নানা কারণে ভ্রমণে শ্রীকান্তের সুখ নেই, শখও নেই। কিন্তু না চাইলেও অনেক জিনিস আপনি আসে। হাম হোক, কে আর চায়? কিন্তু হামেশাই তা হচ্ছে, ফেল হতে আর কোন ছেলের বাসনা, তবু কাউকে না কাউকে ফেল হতেই হয়।

যেমন আজ তাকে যেতে হচ্ছে। ছ্যাকরা গাড়ির ছাদে যা জিনিস ধরে তার চার গুণ চাপানো হয়েছে, গাড়ির মধ্যে শ্রীকান্ত, তার মামা এবং মামী, আর মামাতোবোন টেঁপি। কিন্তু তারই ফাঁকে গাড়ির ফোকরেও মালের কিছু কমতি নেই–জলের কুঁজো, হ্যারিকেন লণ্ঠন, হাতব্যাগ, ছাতা, পানের ডিবে, খাবারের চাঙ্গারি, টুকরো-টুকরো কত কি! কিন্তু এগুলোর জন্য শ্রীকান্তর ভাবনা নেই, কেন না এসব টেপির ভার–পানের ডিবে মামীমা সামলাবেন আর খাবারের চাঙ্গারি মামা। কিন্তু গাড়ি ছাদে বাক্স-তোরঙ্গ, বিছানার লাগেজ আর কাপড়-চোপড়ের বিপুলকায় হেন্ডঅল–ওসব এখন থেকেই যেন শীতের ঘাড়ে চেপে বসেছে।

শিয়ালদহ পৌঁছেই মামা সর্বাগ্রে নামলেন। নেমেই বললেন, ওগো হাতপাখাটা দাও তো! শ্রীকান্ত মোটঘাট সব নামা। ও বাপু কোচম্যান, তুমি একটু ধর, বুঝলে? আমি টিকিটগুলো কেটে আনি।

গাড়ি দাঁড়াতে জনকতক কুলী এসে জুটেছিল, তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাল নামাতে গেল। মামা টিকিট কাটতে পা বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু কুলীদের এই অয়াচিত কর্মস্পৃহা দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন। বাধা দিলে বললেন, কি, তোমারা মাল নামাবে না কি? আবদার তো কম নয়! কেন, আমাদের কি হাত পা নেই?

একজন কুলী শ্রীকান্তর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, ওই বাচ্চা ছেলে, ওকি সেকবে বাবু?

কেন সেকবে না শুনি? ওদের বয়সে আমরা লোহা হজম করেছি। শ্রীকান্ত, সব চটপট নাবিয়ে ফেল, ও ব্যাটাদের ছুঁতে দিসনে। যাও, যাও, একি রুটি সেকা? এখন থেকেই ওকে সব শেকতে হবে। তোমরা সব যাও।

বলে যেভাবে মাছি তাড়ায় সেইভাবে কুলীদের তাড়াবার একটা চেষ্টা করলেন, কিন্তু তারা নড়ল না দেখে বললেন, দেখ বাপু মালে হাত দিও না, পয়সা পাবে না আগেই বলে দিচ্ছি।

এই কথা বলে টিকিট কিনতে চলে গেলেন। শ্রীকান্তের ইচ্ছা হল একবার বলে যে লোহা হজম করা যদিবা সম্ভব হয়, সেই লোহা বহন করা তত সহজ নয়। কিন্তু বলেই বা কি লাভ, সমালোচনা করলে তো লোহার ওজন কমবে না, এই ভেবে সে আস্তে আস্তে বাক্স-পেঁটরা, বাসনের ছালা, বিছানার লাগেজ, সুটকেস, মার জলের কুঁজোটি পর্যন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের একাংশে স্তূপাকার করতে লাগল।

টিকিট কিনে মামা ছুটতে ছুটতে ফিরলেন–বললেন, গাড়ি ছাড়তে আর দেরি নেই রে মোটে আট মিনিট বাকি। শ্রীকান্ত, এই সামান্য কটা জিনিস প্ল্যাটফর্মে নিতে তোর কবার লাগবে? বার তিনেক, বোধ হয়? বার তিনেক হলে ফি বারে দু মিনিট মোট ছ মিনিট, বাড়তি থাকে আরো দু মিনিট, খুব গাড়ি ধরা যাবে। টেপি, তুই এখানে দাঁড়িয়ে মালপত্রগুলো আগলা, শেষবারে শ্রীকান্তর সঙ্গে আসবি। আমি আর তোর মা এগোলাম। একটা খালি দেখে কামরা দেখতে হবে তো? শ্রীকান্ত, তুই ট্রাঙ্কটা মাথায় নে, তার উপরে ছোট সুটকেসটা চাপিয়ে দিচ্ছি, পারবি তো? বিছানার লাগেজটা বা বগলে নে, আর ডান হাতে বড় সুটকেসটা। বাঁ হাতে লণ্ঠন দুটো ঝুলিয়ে নিস, তাহলেই হবে। দ্বিতীয় বার বাসন-কোসনের থলেটা আর তোর মামীর তোরঙ্গটা নিবি। দৌড়ে যাবি আর দৌড়ে আসবি–নইলে গাড়ি ফেল হয়ে যাবে, বুঝেছিস? আমি এগোই ততক্ষণ।

তিনি তো এগোলেন, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দেখেন শ্রীকান্তর দেখা নাই। তিনি আশা করেছিলেন যে শ্রীকান্ত তার পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে, তাকে দেখতে না পেয়ে তিনি ক্ষুণ্ণ হলেন। ফিরে এসে দেখেন, শ্রীকান্ত মালপত্রের বোঝা নিয়ে একেবারে যেন চিত্র পুত্তলিকা!

–কি রে, এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে? গাড়ি ফেল করবি না কি?

–কি করব আমি এগোতে পাচ্ছি না যে। বড্ড ভারি হয়েছে মামা। চেঁপিকে বলাম তুই পেছন থেকে ঠেলে ঠেলে দে, আমি চলতে থাকি, তা ও–

–বারে! বাবা আমায় এখানে জিনিস আগলাতে বলল না? আমি ওকে ঠলতে ঠেলতে যাই আর এদিকে সব চুরি হয়ে যাক। তোমার আর কি, জিনিস কমে গেলে তোমাকে তো আর বইতে হবে না।

মামা বললেন, তাই তো, ভারি মুশকিল হল দেখছি।

একটা কুলী এবার সাহসভরে এগিয়ে এসে বলল–খোকাবাবু সেকবে কেননা? সোব ফেলে ভেঙে চুরমার হোবে। আর ইদিকে টিরেনভি ছেড়ে দিবে। তাই তো! ভারি মুশকিল!

কুলী করলে তো নগদ লোকসান, এদিকে জিনিস ফেলে ভাঙলেও ক্ষতি, গাড়িরও সময় নেই কিন্তু ভাববার আর সময় কই? কাজেই বাধ্য হয়ে মামাকে দুটো কুলী রাখতে হল। আধঘণ্টা আগে বেরুলে এই অপব্যয়টা হত না। শ্রীকান্তই পাঁচ-ছবারে কম কম করে গাড়িতে মালগুলো তুলতে পারত। থাকগে, আর উপয় কি?

অতঃপর একটা দেখবার মতো দৃশ্য হল। দুটো কুলী আগে আগে, তাদের মাথায় দুটো বড় বড় তোরঙ্গ। একজনের বগলে বিছানার ল্যাগেজ, আরেক জনের বগলে বাসনের থলে। মামী নিয়েছেন জলের কুঁজো আর চেঁপি নিয়েছে পানের বাট। মামার এক হাতে একটা ছোট হাতব্যাগ, অন্য হাতে তালপাখা– তারই ভারে মামা কাতর; এতই ঘেমে উঠেছেন যে, ওরই ফাঁকে তালপাখার হাওয়া খেতে হচ্ছে তাকে।

সব শেষে বলেছে শ্রীকান্ত–একেবারে কুঁজো হয়ে। বাড়তি ট্রাঙ্কটা তারই ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। শোভাযাত্রাটা দেখবার মতো।

গাড়িতে উঠেই মামা লম্বা বিছানা পেতে ফেললেন। এতক্ষণ গুরুতর পরিশ্রম গেছে, সেজন্য যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। চলতি গড়ির ফাঁকা হাওয়া গায়ে লাগতেই তিনি আরামে চক্ষু বুজে বললেন, আঃ, এতক্ষণে দেহটা জুড়োল। গোটা গাড়িটা ভর্তি, কিন্তু এ কামরাটা খুব খালি পাওয়া গেছে; কারু চোখে পড়েনি বোধ হয়।

বিচিত্র লটবহরে ওই ছোট কামরার প্রায় সমস্তটাই ভরে গেছল, তারই একধারে, বসে শ্রীকান্ত তার পীড়িত ঘাড়ে শুশ্রূষা করছিল। তার অবস্থাটা বুঝে মামী বললেন, বড্ড লেগেছে না কি রে?

অপ্রতিভ হয়ে শ্রীকান্ত ঘাড়ে হাত বুলানো বন্ধ করল–না, মামীমা।

মামা বললেন, ওয়েট লিফটিং একটা ভালো একসারসাইজ। এতে ওর ঘাড় শক্ত হবে। সেটা দরকার। এর পরে ওর বৌ-এর বোঝ রয়েছে না?

বৌ-এর না বইয়ের–কিসের বোঝা বললেন মামা, বোঝা গেল না সঠিক।

মামী বললেন, তোমার যেমন। যাচ্ছি তো কদিনের জন্য বিয়ের নেমন্তন্নে। এত মালপত্র নিয়ে বেরুনো কেন? কী কাজে লাগবে এসব?

মামা বললেন, যাকে রাখে সেই রাখে, কথাটা জান তো? সব জিনিসই কাজে লাগে, কাজের সময় তখন পাওয়া না গেলেই মুশকিল।

মামী বললেন, মদনপুরে গাড়ি তো দাঁড়ায় মোটে এক মিনিট। বোধ হয় এক মিনিটও দাঁড়ায় না। তার মধ্যে কি এই লটবহর নিয়ে নামা যাবে? দেখো, তখন কী ফ্যাসাদে পড়। বাক্স পেঁটরা সব গাড়িতেই থেকে যাবে দেখছি।

মামা বললেন, কি জানো গিন্নী, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। কিছু ভেব না তুমি।

মামার কথায় শ্রীকান্ত হৃৎকম্প হল, কেন না মদনপুর স্টেশন যেখানে এক মিনিট মাত্র গাড়ি থামে কিংবা তাও থামে না, সেখানে ভগবানের জায়গায় নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই সে কল্পনা করতে পারল না। এই বিরাট এবং বিচিত্র লাটবহর তাকেই গাড়ি থেকে নামাতে হবে। তাহলেই তো সে গেছে, ত তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না শ্রীকান্তর সারা শরীর রি রি করে কাঁটা দিয়ে উঠল।

দমদমে গাড়ি দাঁড়াতেই জনকতক কৃষ্ণকায় ফিরিঙ্গী যুবক এসে সেই কামরায় উঠল। মামার এবং মালপত্রের বহর দেখে তারা একে বারে হতভম্ব। অবশেষে, তাদের একজন ভাঙা বাংলায় মামাকে বলল, টোমরা ও গাড়িতে কেন বাবু? এটা সাহেবডের জন্যে–দরজায় নোটিস দেখ নাই For Europeasn only টোমাদের নামিটে হবে।

সবেমাত্র আয়েস করছেন, নামার কথায় মামার কথা গরম হয়ে উঠল। তিনি বললেন, কোনো নামটে হইব? আমরাও তোমাদের মটই খাঁটি ইউরোপীয়ান আছি। চাহিয়া ডেখ টোমাডের ও আমাড়ের গায়ের রঙ একপ্রকার।

–অল রাইট। ডেখি তোমরা নামিবে কি না? বলে তারা নেমে গেল এবং পরবর্তী স্টেশনে একজন রেল-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে এল।

কর্মচারীটিও এসে নামতে অনুরোধ করলেন।

মামা বললেন, সমস্ত গাড়ি ভর্তি, কেবল একটা খালি, কোথাও জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমরা এই কামরায় উঠেছি। অন্য কোথাও বা উঁচু ক্লাসে আমাদে জায়গা করে দিন, এখুনি আমরা নেমে যাচ্ছি।

আচ্ছা দেখছি জায়গা বলে কর্মচারীটি নেমে গেলেন, ফিরিঙ্গীরা গাড়িতে রইল! শ্রীকান্তর ভয় হল পাছে কর্মচারীটি অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে পান তাহলে তো এখুনি তাকে ভগবানের অবতার হয়ে আবার লটবহর বওয়া-বওয়ি করতে হবে।

কিন্তু কর্মচারীটি আর ফিরলেন না, গাড়িও ছেড়ে দিল। কেবল ফিরিঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে গজরাতে লাগল। মামা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। কিন্তু মামী বললেন, কাজ নেই বাপু, পরের স্টেশনে চল অন্য আকরায় যাই।

-হ্যাঁ, কোথায় খালি রয়েছে না কি?

–না থাকে, পরের গাড়িতে যাব না হয়।

–পাগল!

-–সবই তো পরের গাড়ি মামীমা, কোনটা আমাদের নিজেদের গাড়ি? বলল শ্রীকান্ত। আবার ওঠা-নামার ঝক্যি বওয়ার দায় এড়াতে বলতে হল তাকে!

–যদি পুলিসে ধরে নিয়ে যায়। সাহেবদের গাড়ি যে! মামীমা কন।

–হ্যাঁ, ধরলেই হল! তুমি চুপ করে থাক, ব্যাটারা বাংলা বোঝে তুমি ঘাবড়ে গেছ জানলে আরো লাফাবে।

অগত্যা মামী চুপ করলেন।

খানিক বাদেই ব্যারাকপুরে এল। গাড়ি দাঁড়াতেই ফিরিঙ্গীগুলো একজন সাহেব কর্মচারীকে ডেকে আনল। তিনি এসে বললেন, বাবু টোমাডের নামিটে হইবে–যাহাদের সাহেবি ড্রেস, এ কেবল টাহাদিগের জন্য!

মামা বললেন, তা একথা আগে বলনি সাহেব? আমাডোরো সাহেব পোশাক আছে। আমাদের সময় দাও, আমরা এখুনি সাহেব বনে যাচ্ছি। ওগো ট্রাঙ্কের চাবিটা দাও তো–

অগত্যা সাহেব কর্মচারীটি চলে গেল। মামার সত্যিই কিছু সাহেবি শোপাক ছিল না, একটা চাল মারলেন মাত্র। এদিকে গাড়িও ব্যারাকপুর ছাড়ল।

অতঃপর ফিরিঙ্গীরা আর কোনো উপায় না দেখে এদের তাড়াবার ভার নিজেদের হাতে নিল। পরস্পর পরামর্শ করে এমন চেঁচামেচি শুরু করে দিল মামী দস্তুরমতো ঘাবড়ে গেলেন। মামারও যে একটু ভয় না হল এমন নয়। মামী বললেন, হ্যাঁ গা, কামড়ে দেবে না তো?

মামা খানিকক্ষণ নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বললেন–কি জানি!

কামড়াবার কথা শুনে কেঁপি একেবারে বাবার বিরাট পরিধির পেছনে এসে আশ্রয় নিল!

মামা বললেন, ভালো ফন্দি মাথায় এসেছ। শ্রীকান্ত তুই কুকুর ডাকতে পারিস?

–না, না, বেড়াল ডাকতে হবে না। মাঝে মাঝে তুই কুকুরের মতো ডাক দিখি! শ্রীকান্ত ডাকল–ঘেউ ঘেউ।

–আরো একটু জোরে।

-–ঘেউ ঘেউ ঘেউউ।

সহসা কুকুরের ডাক শুনে ফিরিঙ্গীরা সব চুপ। শ্রীকান্ত আবার ডাকল–ঘেউ ঘেউ ঘেউ–

একজন জিজ্ঞাসা করল, ওরোকম ডাকছে কোনো সে? তার কি হোয়েছে?

মামা গম্ভীরভাবে বললেন, ও কিছু নয় সাহেব। দশ-বারো দিন হল ওকে একটা পাগলা কুকুরে কামড়িয়েছে। Bitten by a mad dog বুঝলে?

ফিরিঙ্গীরা যেন লাফিয়ে উঠল–অ্যাঁ? হাইড্রোফোবিয়া! একথা আগে বলল নাই কেন? ওটো কামড়াইটে পারে?

মামা বললেন–না না, কামড়াইবে না। সে ভয় নাই।

বলতে বলতে নৈহাটি এসে পড়ল। ফিরিঙ্গীরা আর এক মুহূর্তে বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে সেই কামরা থেকে পিটটান দিল।

যাক, বাঁচা গেল বলে যেই মাত্র না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন অমনি আরেকজন ফিরিঙ্গী যুবক এসে সেই কামরায় উঠল। সে কোনো উচ্চবাচ্য করে এককোণে গিয়ে বসল, মামাদের দিকে তাকালও না। মামা বললেন, দাঁড়াও। তোমাকেও ভাগাচ্ছি পরের স্টেশনে। শ্রীকান্ত, গাড়ি ছাড়লেই–বুঝেছিস?

যুবকটি ডিটেকটিভ নভেল বের করে পড়তে শুরু করে দিয়েছিল, হঠাৎ কুকুরের ডাক শুনে চমকে উঠে মামাক জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কি? কি হয়েছে ওর?

সাহেবের মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে মামা বাংলাতেই জবাব দিলেও কিছু না, জলাতঙ্ক–যাকে তোমরা হাউড্রেফোলিয়া বল!

ছোকরা আবার বইয়ে মন দিল। তার নিশ্চিন্ত নির্বিকার ভাব দেখে মামার পিত্তি জ্বেলে গেল। তবু তিনি বললেন, তোমাকে সাবধান করা আমার কর্তব্য। কি জান, যদি কামড়ে দেয়, বলা তো যায় না। তখন তোমাকেও ঐ রোগে–

যুবকটি মৃদু হেসে বলল–আহা, না না! যে কুকুর ডাকে সে কি আর কামড়ায়?

অগত্যা মামা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন এবং শ্রীকান্তও ডাক ছেড়ে দিল। তাকে কুকুর বলাতে সে মনে মনে এমনই চটেছিল যে, তার ইচ্ছা করছিল এখুনি গিয়ে ফিরিঙ্গীটাকে কামড়ে দেয়।

কাঁচড়াপাড়ায় গাড়ি থামাতেই যুবকটি মুখ বাড়িরে বাইরে দেখছিল। তার পরিচিত বন্ধুদের দেখতে পেয়ে ডাকাডাকি শুরু করতেই সে পুরাতন দল এসে উপস্থিত। তারা তাকে ঐ কামরায় দেখে ভারী আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুমি নিরাপদে আছ তো? ওখানে যে মারাত্মক হাইড্রোফেবিয়া!

–সে আমি সারিয়ে দিয়েছি।

–সারিয়ে দিয়েছ কি রকম?

তখন মামার চাল যুবকটি বন্ধুদের কাছে ফাঁস করে দিল–সে কামরায় ঢুকেই ছেলেটিকে জল খেতে দেখেছিল, জলাতঙ্ক রোগে যা কখনো সম্ভব নয়। তখন শ্রীকান্তর ভারি রাগ হল তার মামার উপর, জলাতঙ্ক রোগে জল খেতে নেই একথা কেন তাকে তিনি আগে বলেননি। তাইতো তাকে এমন অপদস্থ হতে হল! কুকুর না হবার অপমান সইতে হল এমন!

এইবার ফিরিঙ্গরী আবার সে কামরায় জাঁকিয়ে বসল এবং স্পষ্ট ভাষায় মামাকে জানাল যে একবার তাঁকে নামতেই হবে এবং এর পরের স্টেশনেই।

অসহায়ভাবে মামী বললেন, ওগো, কি হবে তাহলে?

মামা বললেন–কিছু ভেব না গিন্নী ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।

ভগবানের নাম শুনে শ্রীকান্তর নিজেকে মনে পড়ল এবং ঘাড়ের ব্যথাটা এতক্ষণে কতটা মরেছে জানবার জন্য সে একবার ঘাড়টাকে খেলিয়ে নিল।

পরের স্টেশন আসতেই মামা বললেন, এখানে তো হয় না, পরের জংশনে না হয় বদলানো যাবে। এখানে তো মিনিট খানেক যাত্রী গাড়ি থামে এত মালপত্তর আমাদের!

-–না, টা হইবে না, এইখানেই টোমাকে নামটে হইবে।

তখন তারা সবাই মিলে মামার বাক্স, তেরঙ্গ, বিছানা, সুটকেস-এ হাত লাগাল।

–ডেখি, টুমি কেমন না নাম। এই বলে একজন বাসনের থলেটা নামিয়ে দিয়ে বলল–Here You are আর এই নাও টোমার জলে পিচার!

কুঁজোর জাত যাওয়ায় মীমাসা হায় হায় করতে লাগলেন। ততক্ষণে দুজন মিলে ধরাধরি করে ভারি ট্রাঙ্কটা নামিয়ে ফেলেছে। মামা তখন বাঙ্কের উপরে আরো ভারি হোন্ডঅলটা ওদের দেখিয়ে দিলেন। একজন গিয়ে সেটা নামাল মামা বললেন, বেঞ্জির তলায় ঐ তোরঙ্গটা–ওই যে!

একজন সেটা নামিয়ে বলল এই নাও, টোমার টুরঙ্গ।

মামা সংশোধন করে দিলেন–তুরঙ্গ নয় তোরঙ্গ। সর্বশেষে বুদ্ধিশেষে বুদ্ধিমান যুবকটি ছোট হাতব্যাগটা মামাকে এগিয়ে বলল, গুডবাই, মিষ্টার!

মামা এতক্ষণ পুলকিত হয়ে ওদের কার্য্যকলাপ পর্যনবেক্ষণ করেছিলেন। এই বাক্স বললেন, ইহাই মদনপুর–এইখানেই আমরা নামতাম। এতএব গুডবাই মিস্টারস এবং থ্যাঙ্কস!

হরগোবিন্দের যোগফল

কঞ্জিভেরম থেকে ঘুরে এসে আমাদের পাড়ার হরগোবিন্দ মজুমদার কেবল তাল ঠুকতে লাগলেন–বলং বলং যোগবলম। বলযোগ কিছু হবে না, যদি কিছু হয় তো যোগবলে।

আমাদের সন্দেহ হলো, ভদ্রলোক বোধহয়, শ্রীঅরবিন্দর আশ্রমে গেছলেন এবং সেখান থেকে মাথা খারাপ করে রাঁচী না হয়েই বাড়ি ফিরেছেন। জিজ্ঞাসা করলাম–কঞ্জিভেরমটা কোথায় দাদা?

কঞ্জিভেরম কোথায় জানিসনে? কোথাকার ভেড়া। জিওগ্রাফি অপশনাল ছিল না বুঝি? কঞ্জিভোরম হলো পণ্ডিচেরমের কাছাকাছিই।

পণ্ডিচেরম। সে আবার কোথায়? বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই।

তিনি ততোধিক অবাক হন–কেন? আমাদের অরবিন্দর আস্তানা। পণ্ডিচেরম-এর বাংলা করলেই হবে পণ্ডিচারী। আসলে ওটা তেলেগু ভাষা কিনা। একটু থেমে আবার বলেন, তেমনি কঞ্জিভেরমের বাংলা হোলো কঞ্চি ভারী, মানে বাঁশের চেয়েও।

ওঃ, বোঝা গেছে। পণ্ডিচেরী না গিয়েই তুমি পিণ্ডচারী, মানে কিনা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েচ? তাই বলল এতক্ষণ।

তোরা বুঝবিনে। এসব বুঝতে হলে ভাগবৎ মাথা চাই রে, মানুষের মাথার কর্ম নয়। যোগবল দরকার। তিনি হতাশভাবে মাথা নাড়েন।

আমি তার চেয়ে বেশি মাথা নাড়ি–যা বলেছ দাদা। আমাদেরই মগেরম, অর্থাৎ মুণ্ডুর কিনা, কপালের গেরো।

বাড়ির চিলকোঠায় বসে দাদার যোগাভ্যাসের বহর চলে, পাড়ার চা খানায় বসে আমরা তার আঁচ পাই। একদিন খবর যা এল তা যেমন অদ্ভুত তেমনি অভূতপূর্ব্ব। দাদা নাকি যোগবলে মাধ্যকর্ষণকেও টেক্কা মেরেছেন—আসন–পিঁড়ি অবস্থায় নাকি আড়াই আঙুল মাটি ছাড়িয়ে উঠেছেন।

আমরা সন্দেহ প্রকাশ করি, এ কখনো হতে পারে? উঁহু। অসম্ভব।

কিন্তু সংবাদদাতা শপথ করে বলে (তার বিশ্বস্ত সূত্রকে টেনে হেঁড়ে যায় না) যে তা নিজের চোখে দেখা দাদার তলা থেকে পিঁড়ি টেনে নেওয়া হলো কিন্তু দাদা যেমনকার তেমনি বসে থাকলেন যেখানকার সেখানে–যেন তথৈবচ।

আমি প্রশ্ন করি, চোখ বুজে বসে ছিলেন কি?

উত্তর আসে–আলবাৎ। যোগে যে চোখ বুজতে হয়।

আমি বলি, তবেই হয়েছে। চোখ বুজে ছিলেন বলেই পিঁড়ি সরাতে দেখতে পান নি, নইলে ধূপ করে মাটিতে বসে পড়তেন।

ভরত চাটুজ্যে যোগ দেয়–নিশ্চয়ই। হাত পা গুটিয়ে আকাশে বসে থাকা কি কম কষ্ট রে দাদা। অমনি করে মাটিতে বসে থাকতেই হাতে পায়ে খিল ধরে যায়।

তার পরদিন খবর এল, আজ আর আড়াই আঙুল নয় প্রায় ইঞ্চি আড়াই। তার পরদিন আধ হাত, তারপর ক্রমশঃ এক হাত, দেড় হাত, পৌনে দুই–অবশেষে যেদিন আড়াই হাতের খবর এল সেদিন আর আমি স্থির থাকতে পারলাম না, পৃথিবীর নবম আশ্চৰ্য্য (কেননা, অষ্টম আশ্চর্য অনেকগুলো ইতিমধে ঘোষিত হয়ে গেছে) হরগোবিন্দ মজুমদার দর্শনে উদ্ধশ্বাস হলাম।

কিন্তু গিয়েই জানলাম তার একটু আগেই তিনি নেমে পড়েছেন–ভারি হতাশ হলাম। কি করব? কান থাকলেই শোনা সম্ভব কিন্তু দেখার আলাদা ভাগ্য থাকা চাই। ভূত, ভগবান, রাঁচীর পাগলা গারদ। বিলেত—জায়গা–এসব অনেক কিছুই আছে বলে শোনা যায়, কিন্তু কেবল ভাগ্য থাকলেই দর্শন মেলে। আমার চক্ষু ভাগ্য নেই করব কি?

উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রতা, ইত্যাদি আবেদনে আড়াই হাত আত্মোন্নতির জন্য হরগোবিন্দকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করব কিনা ভাবছি, এমন সময়ে দাদা আমার ইতস্ততঃ–চিন্তায় অকস্মাৎ বাধা দিলেন–তোরা আর আমাকে হরগোবিন্দবাবু বলিসনে।

তবে কি বলব?

হরগোবিন্দ মজুমদারও না

তবে?

তিনি আরম্ভ করেন–যেমন শ্রীভগবান, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরামচন্দ্র।

আমি যোগ করি–শ্রীমদ্ভাগবৎ, শ্রীহনুমান—

উঁহু, হনুমান, বাদ। যেমন শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবুদ্ধ, শ্রীচৈতনয়, শ্রীরামকৃষ্ণ—

আমি থাকতে পারি না, বলে ফেলি–শ্রীত্রৈলঙ্গস্বামী, শ্রীঅরবিন্দ–

হু এবার ঠিক বলেছিস। তেমনি আজ থেকে আমি, তোরা মনে করে রাখিস, আজ থেকে আমি শ্রীহরগোবিন্দ।

আমি সমস্ত ব্যাপারটা হৃদয়মঙ্গ করবার চেষ্টা করি, সত্যি তাইত, হবে ব্যাঙচি বড় হয়ে ব্যাঙ হলে তার ল্যাজ নোটিশ না দিয়েই খসে যায় তেমনি–যে মানুষ আড়াই হাত মাটি ছাড়িয়েছে সে তো আর সাধারণ মানুষ নয়, তারও ল্যাজামুড়ো যে বিনা বাক্যব্যয়ে লোপ পাবে সে আর আশ্চর্য কি।

আমি সবিনয়ে বলি–এতটাই যখন ত্যাগস্বীকার করলেন দাদা, তখন নামের মধ্যে থেকে ওই বদখৎ গোকথাটাও ছেটে দিন। ওকে ভারি ছন্দপাত হচ্ছে। নইলে শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে শ্রীহরিবিন্দ বেশ মিলে যায়।

দাদাকে কিঞ্চিৎ চিন্তান্বিত দেখি–ব্যাকরণে লুপ্ত অ-কার হয় জানি। কিন্তু গো-কার কি লুপ্ত হবার? তাঁর বিচলিত দৃষ্টি আমার ওপর বিন্যাস্ত হয়।

আমি জোর করে দিই–একেবারে লুপ্ত না হোক ওকে গুপ্ত রাখাও যায় তো? চেষ্টা করলে না হয় কি।

দাদা অমায়িক হাস্য করেন–পাগল। যোগদৃষ্টি থাকলে দেখতে পেতিস যে গুরু–মাত্রের মধ্যেই গরু প্রচ্ছন্ন রয়েছেন, গরুর জন্যে যেমন শস্য, গুরুর জন্যে তেমনি শিষ্য–আদ্যস্বরের ইতর বিশেষ কেবল। আসলে উভয়েরই হলো গিয়ে খাদ্যখাদক সম্বন্ধ। সুতরাং গো-কথাটায় আপত্তি করবার এমন কি আছে? তারপর দম নেবার জন্য একটু থামেন, তা ছাড়া গো-শব্দে নানার্থ। অভিধান খুলে দ্যাখ।

আমি কি একটা বলতে যাচ্ছিলাম, উনি বাধা দেন–এ নিয়ে মাথ ঘামাতে হবে না তোকে। তোর যখন ভাগবৎ মাথা নয়, তখন ও-মাথা আর ঘামাসনে। তুই বরং ভরতকে ততক্ষণ ডেকে আন। ওকে আমার দরকার।

ভরতচন্দ্র আসতেই দাদা সুরু করেন–বৎস, তোমার লেখা-টেখা আছে নাকি? এই করকম যেন কানে এসেছিল।

লিখি বটে এক-আধটু, সে-কিন্তু কিছু হয় না।

আরে সাহিত্য না হোক কথা-শিল্প তো হয়? তা হলেই হোলো। কথা-শিল্প আর কাঁথা-শিল্প এই দুটোই তো আমাদের জাতীয় সম্পদ, বলতে গেলে-আর কি আছে? সহসা আত্ম-প্রসাদের ভারে দাদা কাতর হয়ে পড়েন, ভরত, তোমাকেই আমার বাহন করব, বুঝলে? তুমিই আমার মহিমা প্রচার করবে জগতে। কিন্তু দেখো শ্রীভ কথিত যেন সাত খণ্ডের কম না হয়। (আমার দিকে দৃকপাৎ করে) তোদের কেনা চাই কিন্তু।

আমি দাদাকে উৎসাহ দিই–কিনব বইকি। আমরা না কিনলে কে কিনবে?

দাদা কিন্তু খিঁচিয়ে ওঠেন–কে কিনবে। দুনিয়া শুষ্টু কিনবে। আর কেউ না কিনুক রোমা রোলী কিনবে একখানি। (তারপর একটা সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে) ওই লোকটাই কেবল চিনল আমাদের,–আর কেউ চিনল না রে।

এমনি চলছিল–এমন সময়ে দাদার যোগচর্চার মাঝখানে এক শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটল। দাদা যোগবলে আড়াই হাত ওঠেন, পৌনে তিন হাত ওঠেন তিন হাত ওঠেন এমনি ক্রমশঃ চলে, হঠাৎ একদিন আকস্মিক সিদ্ধিলাভ করে একবোরে সাড়ে সাত হাত ঠেলে উঠেছেন। ফলে চিলকোঠার ছাদে দারুণভাবে মাথা ঠুকে গেছে দাদার। ঘরখানা, দুর্ভাগ্যক্রমে, সাড়ে পাঁচ হাতের বেশি উঁচু ছিল না।

কলিশনের আওয়াজ পেয়ে বাড়িশুদ্ধ লোক ওঘরে গিয়ে দ্যাখে, দাদা কড়িকাঠে লেগে রয়েছেন। মানে, মাথাটা সাঁটা, উনি অবলীলাক্রমে ঝুলছেন চোখ বোজা, গা এলানো। ওটা যোগ-সমাধি কি অজ্ঞান-অবস্থা, ঠিক বোঝা গেল না–দেখলে মনে হয়, যেমন কড়িকাঠকে বালিশ করে আকাশের ওপর আরাম করেছেন।

ভগবৎ মাথা বলেই রক্ষা, ছাতু হয়নি। অন্য কেউ হলে ঐ ধাক্কায় আপাদমস্তক চিড়ে চ্যাপটা হয়ে একাকার হয়ে যেত। যাই হোক দাদাকে তা বলে তো কড়িকাঠেই বরাবর রেখে দেওয়া যায় না,–কিন্তু নামানোই বা যায় কি করে?

বাড়িশুদ্ধ সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু কি করবে, ঘরের ছাদ সাধারণতঃ হাতের নাগালের মধ্যে নয়–বেশির ভাগ ছাদ এমনি বে-কায়দায় তৈরি। অবশেষে একজন বুদ্ধি দিল, দাদার পায়ে দড়ির ফাঁস লাগিয়ে, কূপ থেকে যেমন জলের বালতি তোলে, তেমনি করে টেনে নামানো যাক। অগত্যা তাই হলো।

আমি যখন দাদার সান্নিধ্যে গেলাম–যেমন শোনা তেমনি ছোটা, কিন্তু ততক্ষণ দাদার পঙ্কোদ্ধার হয়ে গেছে–তখন দাদার মাথা আর বাড়ির ছাদে নেই, নিতান্তই তুলোর বালিশে। হায় হায়, এমন চমকপ্রদ দৃশ্যটাও আমার চোখ ছাড়া হোলো, চক্ষুর আগোচরে একেবারেই মাঠে (মানে, কড়িকাঠে) মারা গেল–এমনি দুরদৃষ্ট। হায় হায়।

চারিদিকের সহানুভবদের বাঁচিয়ে, বিছানার একপাশে সন্তর্পণে বসলাম। মাথার জলপটিটা ভিজিয়ে দিয়ে দাদা বললেন–ভায়া। এইজন্যই মুনি ঋষিরা বাড়ি ঘর ছেড়ে, বনে-বাদড়ে যোগসাধনা করতেন। কেননা ফাঁকা জায়গায় তো মাথায় মার নেই। যত ইচ্ছে উঠে যাও, গোলোক, ব্রক্ষ্মলোক, চন্দ্রলোক, সূর্যলোক, যদ্দুর খুশি চলে যাও, কোনো বাধা নেই–আকাশে এনতার ফাঁকা। এই কথাই তো এতক্ষণ বোঝাচ্ছিলুম ভরতচন্দ্রকে।

ভরতচন্দ্র বাধিতভাবে ঘাড় নেড়ে নিজের বোধশক্তির পরিচয় দেন।

আর এ কথাও বল বাবা ভরতকে, যে কদাপি লেখার চর্চা ছেড়ো না। ওটাও খুব বড় সাধনা। কালি-কলম-মন লেখে তিন জন–এটা কি একটা কম যোগ হলো? আর যখন চাটুজ্যে হয়ে জন্মেছ তখণ আশা আছে তোমার।

আশান্বিত ভরত জিজ্ঞাসান্বিত হয়–প্রভু, পরিষ্কার করে বলুন। আমরা মুখ-সুখ মানুষ–

প্রভু পরিষ্কার করেন–চাটুজ্যে হলেই লেখক হতে হবে, যেমন বঙ্কিম চাটুজ্যে, শরৎ চাটুজ্যে! আর লেখক হলেই নোবেল প্রাইজ।

কিন্তু আমার লেখা যে নোবেল প্রাইজওলাদের লেখার দুহাজার মাইলের মধ্যে দিয়ে যায় না, গুরুদেব! তেমন লিখতে না পারি, তেমন-তেমন লেখা বুঝতে তো পারি।

পারো সত্যি? গুরুদেব যেন সাহসা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, কিন্তু পরক্ষণেই কণ্ঠ সংযত করে নেন–বাংলাদেশে কারই বা যায়? আর বিবেচনা করে দেখলে, তাদের লেখাও তো তোমাদের লেখার দু হাজার মাইলের মধ্যে আসে না। তবে?

আমি ভয়ে ভয়ে বলি–তফাণ্টা অতখানিই বটে, কিন্তু আগিয়ে কে, আর পিছিয়ে কে, সেই হোলো গে সমস্যা।

দাদা অভয় দেন–বৎস ভরত, ঘাবড়ে যেয়ো না। তুমি, নারাণ ভটজাচ আর মেরী করেলী হলে এক গোত্র। পাবে, আলাবাৎ পাবে, নোবেল প্রাইজ পেতেই হবে তোমাকে। বিলেতে যাবার উদযুগ কর তুমি। আমি শুনেছি, এদশে থেকে এক-আধ ছত্র লিখতে জানা কেউ বিলেতে গেছে কি অমনি তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নোবেল প্রাইজ গছিয়ে দিয়েছে। প্রায় কালিঘাটে পাঁঠা বলি দেওয়ার মত আর কি!

ভরতচন্দ্র উৎসাহ পায় কিন তার মুখ দেখে ঠাহর হয় না। আমি কানে কানে বলি–আরে নাই বা পেলে নোবেল প্রাইজ! এই সুযোগে বিলেতে দেখতে পাবে, অনেক সাহেব মেম দর্শন হবে, সেইটাই কি কম লাভ? বরং এই ফাঁকে এক কাজ করো, বন্ধু-বান্ধন, ভক্ত-টক্তদের মধ্যে বিলেত যাবার নামে চাঁদার খাতা খুলে ফেল, বোকা ঠকিয়ে যা দুপাঁচ টাকা আসে। তারপর নাই বা গেলে বিলেত! তোমার আঙুল দিয়ে জল গলে না জানি, নইলে এই আইডিয়াটা দেবার জন্য টাকা বখরা চাইতাম।

ভরতের মুখ একটু উজ্জ্বল হয় এবার।

তার বিলেত যাবার দিনে জাহাজঘাটে সে কী ভীড়! নোবেল-তলার যাত্রী দেখতে ছেলে বুড়ো সবাই যেন ভেঙে পড়েছে। চিড়িয়াখানার শ্বেতহস্তী দেখতেও এরকম ভীড় হয়নি কোনোদিন। স্বয়ং শ্রীহরগোবিন্দ যখন বলেছেন, তখন নোবেল প্রাইজ না হয়ে আর যায় না। যোগবাক্য কি মিথ্যে হবার? লেখার জোরে যদি না-ই হয়–যোগবল ত একটা আছে, কি না হয় তাতে? ভরতচন্দ্র জাহাজে উঠতে গিয়ে পুলকের আতিশয্যে এক কুকুরের ঘাড়ে গিয়ে পড়েন।

কিম্বা হয়ত কুকুরই তাঁর ঘাড়ে পড়েছিল, কেননা কুকরের হয়ে কুকুরের মালিক মার্জনা চান—I am sorry Babul

ভারতচন্দ্র জবাব দেন–But I am glad-very glad। আমার হাত টিপে ফিস ফিস্ করেন–দেখছিস, সাহেবের কুকুর এসে ঘাড়ে পড়েছে। সাদা চামড়ার লোক কামড়ে না দিয়ে আপ্যায়িত করেছে–এ কি কম কথা রে? নোবেলপ্রাইজ তো মেরেই দিয়েছি। কি বলিস?

আমি আর কি বলব! হয়ত কিছু বলতে যাই এমন সময় অকুস্থলে শ্রীশ্রীহরগোবিন্দর অভ্যুদয় হয়।

আশীর্বাদের প্রত্যাশায় ভরতচন্দ্র ঘাড় হেঁট করেন। কিন্তু দাদার মুখ থেকে যা বেরোয়, তা ঠিক আর্শীবাণীর মত শোনায় না–

বৎস, ফিরে চল, ফিরে চল আপন ঘরে। নোবেল প্রাইজ তোমার জন্য নয়।

শরতের আকাশে (কিম্বা ভারতের?) যেন বিনামেঘে বজ্রাঘাত! আমরা স্তম্ভিত, হতভম্ব, মুহ্যমান হয়ে পড়ি। এত আয়োজন, প্রয়োজন–সব পণ্ড তা হলে?

বস প্রথমে যোগবলে যা বলেছিলাম, তা ঠিক নয়। তাছাড়া সেদিন আমার ভাগবৎ মাথার অবস্থা ভালো ছিল না–ভাগবৎ যোগের সঙ্গে কড়িকাঠ যোগ ঘটেছিল কিনা! আজ সকালে আবার নতুন করে যোগ করলাম, সেই যোগফলই তোমাকে জানাচ্ছি।

ফুঁ দিয়ে বাতি নিবিয়ে দিলে ঘরের চেহারা যেমন হয়, ভরতচন্দ্রের মুখখানি ঠিক তেমনি হয়ে গেল (উপমাটা বাজারে–চলতি চতুর্থ শ্রেণীর উপন্যাস থেকে চুরি করা সেই মুখভাবেরা হুবহুব বর্ণনা দেবার জন্যই, অবশ্য!)

হরগোবিন্দ বাণীবর্ষণ চলতে থাকে;–বৎস, সব যোগের চেয়ে বড় যোগ কি, জানো? রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, ধ্যানযোগ, মনোযোগ, অধোদয়যোগ সব যোগের সেরা হচ্ছে। যোগাযোগ। এই যোগাযোগ ঘটলেই, তার চেয়েও বড়ো, বলতে গেলে শ্রেষ্ঠতম যে যোগের প্রকাশ আমরা দেখতে পাই, তা হচ্ছে অর্থযোগ। এবং তা না ঘটলেই বুঝতে পারছ যাকে বলে অনর্থযোগ। রবীন্দ্রনাথের বেলা এই যোগাযোগ ছিল, তাই তার নোবেল প্রাইজ জুটেছে; তোমার বেলা তা নেই। কি করে আমি এই যোগফলে এলাম, তোমরাও তা কষে দেখতে পারো। রবীন্দ্রনাথ + পাকা দাড়ি + টাকার থলি + নোবেল প্রাইজ। কিন্তু তোমার পাকা দাড়িও নেই, টাকাকড়িও নেই–বস বরতচন্দ্র, সে যোগাযোগ তোমার কই?

ভরতচন্দ্রের করুণ কণ্ঠ শোনা যায়–কিছু টাকা আমিও যোগাড় করেছি। আর দাড়ির কথা যদি বলেণ, না হয় আমি পরচুলার মত একটা পরদাড়ি লাগিয়ে নেব।

শ্রীহরগোবিন্দ প্রস্তাবটা পর্যালোচনা করেন, কিন্তু পরক্ষণেই দারুণ সংশয়ে তার মুখ-চোখ ছেয়ে যায়–কিন্তু তারা যদি প্রাইজ দেবার আগে টেনে দ্যাখে, তখন?

সেই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা আমার মনেও সাড়া তোলে। সত্যিই তো, তখন? ভরতচন্দ্রও বারবার শিউরে ওঠেন।

নাঃ, সে কথাই নয়! ভরতচন্দ্র, তুমি মর্মাহত হয়ো না। যেমন half a loaf is better than no loaf, তেমনি half a বেল is detter than নোবেল। তোমার জন্য আমি প্রাইজ এনেছি, তা নোবেলের চেয়ে বিশেষ কম যায় না। বিবেচনা করে দেখলে অনেকাংশে ভালোই বরং। বৎস, এই নাও।

বলে কাগজে-মোড়া একটা প্যাকেট ভরতচন্দ্রের হাতে দিয়ে, মুহূর্তে বিলম্ব না করে ভিড়ের মধ্যে তিনি অন্তর্হিত হন। আমরা প্যাকেট খুলতে থাকি, মোড়কের পর মোড়ক খুলেই চলি, কিন্তু মোড়া আর ফুরোয় না। অবশেষে আভ্যন্তরীণ বস্তুটি আত্মপ্রকাশ করে।

আর কিছু না, একটা কদবেল।

 হর্ষবর্ধনের কাব্যচর্চা

বাড়ির দরজায় কে যে এক-পাল ছাগল বেঁধে গেছল, তাদের চাঁ-ভা পাড়াটা মাত। হর্ষবর্ধন তখন থেকে উঠে-পড়ে লেগেছেন, কিন্তু মনই মেলাতে পারছেন না, তা কবিতা মেলাবেন কী!

দূর ছাই! বিরক্ত হয়ে বলেছেন হর্ষবর্ধন, পাঁঠার সঙ্গে খালি পেটের মিল হতে পারে কবিতার মিল হয় না। পাঠারা অপাঠ্য। •

আজই একটু আগে গোবরার হাতে তিনি মোটা খাতাটা দেখেছিলেন। চামড়ায় বাঁধানো চকচকে-অবিকল বইয়ের মতো। কৌতূহল প্রকাশ করায় গোবরা জানিয়েছিলো–এটা আমাদের কবিতার খাতা, আমরা কবিতা লিখবো। পরে ছাপা হয়ে বই আকারে বেরুবে! আমাদের কবিতার বই।

আমরা মানে? আমরা কারা? ভাইয়ের কথায় দাদা একটু ঘাবড়েই গেছেন।

আমরা অর্থাৎ তুমি আর আমি। আবার কে? গোবরা ব্যক্ত করেছে।

আমি! আমি লিখবো কবিতা! কেন, কি দুঃখে? হর্ষবর্ধন আকাশ থেকে পড়েছেন : আমাদের কাঠের কারবার বেঁচে থাকতে। কবিতা লিখতে যাবো কিসের দুঃখে?

চিরটা কাল তো আকাট হয়েই কাটালে। কেন, কবি হওয়াটা কি খারাপ?

ধুত্তোর কবি! কী পাপ করেছি যে আমায় কবিতা লিখতে হবে! হর্ষবর্ধনের কভি নেহি মেজাজ।

কেন, পাপ কিসের! গোবরা জবাব দিয়েছে, কবিতা লেখা কি পাপ? ব্যাস-বাল্মীকি, কালিদাস-কৃত্তিবাস, ওমর-ওমর বলতে বলতে গোবরার কোথায় যেন আটকে যায়।

দূর বোকা! ওমর নয়, অমর। জানি কবিতা লিখে এঁরা সবাই অমর। জানা আছে। হর্ষবর্ধন ভাইকে জানাতে দ্বিধা করেন না।

অমর নয়, ওমর। আরেকজন নামজাদা কবিতার নামের সঙ্গে আরো দু-দুটো খাবার জিনিস জড়ানো কিনা। খাবাগুলো আমার মনে আসছে না ছাই!

ওমরত্ব ছাড়াও দুরকমের খাবার? ভাল খাবার? ঠিক কাব্যরস না হলেও হর্ষবর্ধনের জিভে এক রকমের রস জমে।

মনে পড়েছে। খই আর আম। ওমর খৈআম। হ্যাঁ, তুমি কি বলতে চাও ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস, কৃত্তিবাস আর আমাদের ওই ওমর খৈআম–এঁরা সবাই কবিতা লিখে পাপ করে গেছেন?

ওমর খৈআম আমি পড়িনি। তবে খই আমরে মতো মতো ভাল হবে কি না বলতে পারবো না। হর্ষবর্ধন আসল প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে যান।

আমি পড়েছি। দই-চিঁড়ের চেয়েও ভাল। গোবরা নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে, ঢের উপাদেয়।

তা ভাল হতে পারে। কিন্তু কবিতা লেখা ভারি শক্ত! মেলাতে হয়। কবিতা মেলাতেই অনেকের প্রাণ যায়। ওমরের কথা জানি না, আর সবাই মরো–মরো।

কিছু শক্ত না। তুমি এই ভূমিকাটা পড়ে দেখো। জনৈক আন্ত লেখকের লেখা। লোকটাকে হয়তো কবিও বলা যায়। যা রীতিমত টাকা দিয়ে লেখাতে হয়েছে নগদ এক-কুড়ি টাকা। বইটা লেখবার আগেই বইয়ের ভূমিকাটি লিখিয়ে লাখলাম। কাজ এগিয়ে রইল।

মোটা খাতাটার গোড়াতেই একটা গোটা প্রবন্ধ কোন এক আস্ত লেখকের লেখা ছোট্ট এক ভূমিকা-ভূমিকাটার মাথায় বিশদ করে জানানো কবিতা লেখা মোটেই কঠিন না। হর্ষবর্ধন ভূমিকার মাথাটা পড়েন, কিন্তু মোটেই তার ভেতরে মাথা গলান না। এমনিতেই তিনি মাথা নাড়েন : না, শক্ত না! খুব শক্ত। এ কি বাপু কাঠ যে হাটে গেলেই মিলে যায়? এ হলো কবিতা। মেলা দেখি কবিতার সঙ্গে? খবিতা, গবিতা, ওবিতা, চবিতা, ছবিতা, ভবিতা, জবিতা-মায় ইস্তক হবিতা পর্যন্ত কিছু মেলে না। কবিতা লেখা কি সহজ রে বাপ! বললেই হলো আর কি!

এই আস্ত লেখকটা তাহলে আস্ত গুল ঝেড়েছে, এই তুমি বলতে চাও তো?

আলবৎ! কবিতা মেলাতে হয় নইলেনই কবিতাই হয় না। আর মেলানো ভারি শক্ত। দু রকমের মেলা আছে, রথের মেলা আর কবিতার মেলা কিন্তু দুটো মেলা একেবারে আলাদা রকমের। রথের মেলা ঠিক সময়ে আপনিই মেলে, কিন্তু কবিতা মেলায় কার সাধ্যি! তোর লেখক গুল না ঝাড়তে পারে, কিন্তু ভুল করে দুটো মেলায় গুলিয়ে ফেলেছে বলে বোধ হচ্ছে।

জানি, জানি। গোবরা ঘাড় নাড়ে : মিলও তোমার দুরকমের। কবিতার মিল, আবার কাপড়ের মিল। কিন্তু মিল ছাড়াও যেমন কাপড় হতে পারে–ধরো যেন তাঁতের কাপড়, তেমনি তোমার মিলেও কবিতা বানানো যায়। পড়ে দেখ না ভূমিকাটা।

আচ্ছা, যা তুই! ঘণ্টাখানেক পরে আসিস। আমি তোকে এমন একটা লম্বা কবিতা বানিয়ে দেবো যে তোর তাক লেগে যাবে। পারিস তো কোন কাগজে কিছু টাকা দিয়ে তোর নাম ছাপিয়ে দিস। তোর নামে উইল করে দিলাম।

এই বলে শ্রীমান ভ্রাতৃত্বকে ভাগিয়ে দিয়ে আমাদের কবিতার খাতা নামক মরোক্কো চামড়ার বাঁধাই মোটা খাতাটাকে নিয়ে তিনি পড়েছেন। লাইন দুয়েকের কবিতা দেখতে না দেখতেই তার এসে গেছে পলায়মান তাদের ধরে-পাকড়ে খাতার পাতায় তিনি পেড়ে ফেলেছেন। লাইন দুটি এই :

মুখখানা থ্যাবড়া।
নাম তার গোবরা।।

কিন্তু এই দু-ছত্রের পরে আর একছত্রও তাঁর নিজের কিংবা কমলের মাথায় আসছে না। বাড়ির তলায় ছাগলদের সমবেত ঐকতান সেই ছাগলাদ্য সঙ্গীত সুরধুনী ভেদ করে কাব্য সরস্বতীর সাধ্য কি যে তাঁর খাতার দিকে পা বাড়ায়! অগত্যা, বিতাড়িত হয়ে তিনি ভূমিকাটা নিয়ে পড়েছেন তার মধ্যে যদি গোবরা-কথিত কবিতা লেখার সত্যি কোন সহজ উপায় থাকে।

ভূমিকাটার আরম্ভ এই :

তোমাদের নিশ্চয় কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তোমরা হয়তো ভেবেছো, ওটা শক্ত কাজ। কিন্তু মোটেই তা নয়। কবিতা লেখার মতো সহজ কিছুই নেই। নাটক গল্প প্রবন্ধ–এ-সব খুব কষ্ট করে লিখতে হয়, কিন্তু কষ্ট করে একটি জিনিস লেখা যায় না, তা হচ্ছে কবিতা। খুব সহজে ও আসবে, নয়তো কিছুতেই ও আসবে না। সহজ না হলে কবিতাই হলো না।

এই অবধি পড়ে হর্ষবর্ধন আপন মনে বলতে থাকেন : আর, আমিও তো ঠিক সেই কথাই বলছি। কষ্ট করে কখনোই কবিতা লেখা যায় না। আর দেখো তো এই গোবরার কাণ্ড! আমার ঘাড়ে ইয়া মোটা একটা জাবদা খাতা চাপিয়ে গেছে –আমি অনর্থক কষ্ট করে মরছি। যতো সব অনাসৃষ্টি দেখো না!

হর্ষবর্ধন আবার ভূমিকার মধ্যে আরেকটু অগ্রসর হন–

নির্মল জলে যেমন আকাশের ছায়া পড়ে, তেমনি মানুষের মনে কবিতার মায়া লাগে। মনের সেই আকাশকে রঙে রেখায় ধরে রাখলেই হয় ছবি, আর কথায় বাঁধলে হয় কবিতা। তোমাদের মনে যন যে ভাব জাগে তাকে যদি ভাষায় জাহির করতে পারো তাই কবিতা–যেটা যতো ভাল প্রকাশ হবে, কবিতাও হবে ততো চমৎকার।

অতঃপর হর্ষবর্ধন নিজের মনের মধ্যে হাতড়াতে শুরু করেন। কিন্তু সমস্তই তার শূন্য বলে মনে হতে থাকে। অবশেষে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তাহলে আর আমি কি করে কবি হবো!

ভূমিকায় আরো ছিল?

শরীরের যেমন ব্যায়াম দরকার, যেমন বই পড়া আবশ্যক, তেমনি প্রয়োজন কবিতা লেখার। বই পড়লে চিন্তা করলে হয় মস্তিষ্কের ব্যয়াম, কবিতাচর্চায় মনের ভাবের। ভাণ্ডার যত পূর্ণ হবে, মন হয়ে ততই বড়ো–ততই অগাধ। ভাব এলেই লিখে ফেল। তাহলে, সেই প্রয়াসের দ্বারাই ঘুরে ফিরে সেই ভাব তোমার চেতনা বা অবচেতনার মধ্যে গিয়ে জমা হয়ে থাকলো। ভাবনা হচ্ছে, মৌমাছির মত যদি উড়ে যেতে দিলে তো খানিক গুনগুন করেই ও চলে গেলো আর কখনো ফিরে

আসতেও পারে। কিন্তু কথার রূপগুণের মধ্যে–ভাষার মৌচাকে যদি ওকে ধরতে পারো তাহলে মধু না দিয়ে ও যাবে না। সেই মধুই হলো আসল। এবং তোমার সেই মনের মধু পাঠকের মনকেও মধুময় করতে পারে তখনই তোমার কবিতা হয়ে ওঠে মধুর। তখনই তার সার্থকতা।

কবিতার আসল কথা হচ্ছে তা কবিতা হওয়া চাই। ছন্দ, মিল ইত্যাদি না হলেও তার চলে। ছন্দ যদি আপনিই এসে যায়, মিল যদি অমনি পাও, বহুৎ আচ্ছা, কিন্তু ও না হলেও কবিতার কোন হানি হয় না। আকাশের সঙ্গে বাতাস বেশ মিল খায়, আকাশের সঙ্গে পৃথিবীর কোথাও মিল নেই। অথচ আকাশ আর পৃথিবী মিলে চমৎকার একটা কবিতা।

ভূমিকাটা, দু-একটা উদাহরণের পরে এইভাবে শেষ। পরিশেষে পৌঁছে হর্ষবর্ধন মুখ বাঁকান : জানি, জানি। এ সবই আমার জানা। তুমি আর নতুন কথা আমাকে কি শেখাবে বাপু! তোমার চেয়ে ঢের ভাল ভূমিকা আমি লিখে দিতে পারি। আরে বাপু কে না জানে শ্রীবৎস লিখলেই বীভৎস দিয়ে মেলাতে হয়। কার খোকা আনলেই অমনি ছারপোকাকে আমদানি করতে হবে। গাড়ি ভাড়া করলে ভারি তাড়া না হয়ে আর যায় না! সবাই জানে, তুমি আর বেশি কি বলবে! কিন্তু একপাল ছাগল আর তাদের কান ফাটানো চ্যাঁ–ভ্যাঁর সঙ্গে যদি মেলাতে পারতে তাহলে জানতুম যে হ্যাঁ–তুমি একজন আস্ত জাত কবি। এমন কি তোমাকে আমি কবি অমর মুড়ি-কাঁঠাল বলে মানতেও রাজি ছিলাম।

গোবরা এসে এতক্ষণ পরে উঁকি মারে–কি দাদা? কদুর? বেরুল তোমার কবিতা?

হয়েছে, খানিকটা হয়েছে। দু-ছত্তর তোর বইয়ের ওপর গজিয়েছে, আর দু-ছত্তর আমার মাথায় গজগজ করছে, এখনো খাতায় ছাড়িনি!

দেখি তোমার কবিতা? গোবরা দাদার কাব্য–গঞ্জনা শুনতে উৎসুক হয়।

কিন্তু খাতার দু-লাইন–মুখখানা থ্যবড়া, নাম তার গোবরা দেখেই নিজের মুখের সঙ্গে সে মিলিয়ে দেখে কি না বলা যায় না–গোবরার মুখ কবিতার আরেকটা মিল হয়ে ওঠে–একেবারে গোমড়া হয়ে ওঠে।

আরে এখনি অবাক হচ্ছিস! আরো দু-লাইন আছে–বলছি শোন! হর্ষবর্ধন বাকি পংক্তি গুলোকেও নিজের দন্তপংক্তির সঙ্গে প্রকাশ করে দেন–বাকিটাও শোন তবে–শুনলে খুশিই হবি–

তলায় এক পাল ছাগল!
আর ওপরে এক পাগলা।

এই চার লাইনেই আমার অমরত্বলাভ। আজকের মতো এই যথেষ্ট। কেমন হয়েছে কবিতাটা? এমন কৈআমের সমকক্ষ হয়তো হইনি, কিন্তু ওমর মুড়কিজাম কি বলা যায় না আমায়?

হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

হর্ষবর্ধনকে আর রোখা গেল না তারপর কিছুতেই! বাঘ মারবার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন।

আরেকটু হলেই তো মেরেছিল আমায়। তিনি বললেন, ওই হতভাগা বাঘকে আমি সহজে ছাড়ছি না।

কি করবে দাদা তুমি বাঘ নিয়ে? পুষবে নাকি?

মারবো ওকে। আমাকে মেরেছে আর ওকে আমি রেহাই দেব তুই ভেবেছিস?

তোমাকে আর মারল কোথায়? মারতে পারল কই?

একটুর জন্যেই বেঁচে গেছি না? মারলে তারা বাঁচাতে পারতিস আমায়?

গোবর্ধন চুপ করে থাকল, সে-কথার কোন জবাব দিতে পারল না।

এই গোঁফটাই আমায় বাটিয়ে দিয়েছে বলতে কি! বলে নিজের গোঁফ দুটো তিনি একটু চুমরে, নিলেন এই গোঁফের জন্যই বেঁচে গেছি আজ! নইলে ওই লোকটার মতই হাল হতো আমার…

মৃতদেহটির দিকে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন–গোঁফ বাদ দিয়ে, বেগোঁফের বকলমে ও তো খোদ আমিই। আমার মতই হুবহু। ও না হয়ে আমিও হতে পারতাম। কি হতো তাহলে বল তো?

এই চৌকিদার! হঠাৎ তিনি হঙ্কার দিয়ে উঠলেন–একটা বন্দুক যোগাড় করে দিতে পার আমায়? যতো টাকা লাগে দেব।

বন্দুক নিয়ে কি করবে বাবু?

বাঘ শিকার করব আবার কি? বন্দুক নিয়ে কী করে মানুষ? বলে আমার প্রতি ফিরলেনঃ আমার এই বীরত্ব-কাহিনীটাও লিখতে হবে আপনাকে। যত সব আজেবাজে গল্প লিখেছেন আমাকে নিয়ে। লোক পড়ে হাসে কেবল। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে আমি শুনেছি।

তার কি হয়েছে? লিখে দেব আপনার শিকার-কাহিনী। এই বাঘ মারার গল্পটাই লিখে দেব আপনার। কিন্তু তার জন্যে বন্দুক ঘাড়ে এত কষ্ট করে প্রাণপণে বাঘ মারতে হবে কেন? বনে-বাদাড়েই বা যেতে হবে কেন? বাঘ মারতে এত হ্যাঁঙ্গামের কী মানে আছে? বন্দুকের কোন দরকার নেই! সাপ-ব্যাঙ একটা হলেই হলো। কলমের কেরামতিতে সাপ ব্যাঙ দিয়েই বাঘ মারা যায়।

মুখেন মারিতং বাঘং? গোবরা টিপপনি কাটে।

আপনি টাকার কথা বলছেন বাবু! চৌকিদার এতক্ষণ ধরে কী যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিল, মুখ খুলল এবার তা, টাকা দিলে এনে দিতে পারি একটা বন্দুক দু-দিনের জন্য। আমাদের দারোগা সাহেবের বন্দুকটাই চেয়ে আনতে পারি। বাঘের ভারী উদ্রব হয়েছে এধারে মারতে হবে বাঘটাকে– এই বললেই তিনি ওটা ধার দেবেন আমায়। ব্যাভারের পর আবার ফেরত দিয়ে আসব।

শুধু বন্দুক নিয়ে কি করব শুনি? ওর সঙ্গে গুলি-কার্তুজ-টোটা ইত্যাদি এ-সবও তিনি দেবেন তো? নইলে বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে কি বাঘ মারা যায় নাকি? তেমনটা করতে গেলে তার আগেই বাঘ আমায় সাবড়ে দেবে?

তা কি হয় কখনো? বন্দুকের সঙ্গে কার্তুজ-টার্তুজ দেবেন বইকি বাবু।

তাহলে যাও, নিয়ে এসো গে চটপটা। বেশি দেরি কোর না। বাঘ না– মেরে নড়ছি না আমি এখান থেকে। জলগ্রহণ করব না আজ।

না না, বন্দুকের সঙ্গে কিছু খাবার টাবার নিয়ে এসো ভাই।

আমি বাতলাইঃ খালি পেটে কি বাঘ মারা যায়? আর কিছু না হোক, একটু গাঁজা খেতে হবে অন্তত।

আনব নাকি গাঁজা? সে শুধায়।

গাঁজা হলে তো বন্দুকের দরকার হয় না। বনে-বাদাড়েও ঘুরে মরতে হয় না। বন্দুকের বোঝা বইবারও কোন প্রায়াজন করে না। বসেই বাঘ মারা যায় বেশ। আমি জানাই।

না না গাঁজা-ফাঁজা চাই না। বাবু ইয়ার্কি করছে তোমার সঙ্গে। তুমি কিছু রুটি মাখন বিস্কটু চকোলেট এইসব এনো, পাও যদি। গোবরা বলে দেয়।

বন্দুক এলে হর্ষবর্ধন শুধাল–কি করে বাঘ মারতে হয় আপনি জানেন?

বাগে পেলেই মামা যায়। কিন্তু বাগেই পাওয়া যায় না ওদের। বাগে পাবার চেষ্টা করতে গেলে উলটে নাকি বাঘেই পায়।

বনের ভিতরে সেঁধুতে হবে বাবু। চৌকিদার জানায়।

গভীর বনের ভেতরে পা বাড়াতে প্রথমেই যে এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা করল সে কোন বাঘ নয়, বাঘের বাচ্চাও না–আস্ত একটা কোলা ব্যাঙ।

ব্যাঙ দেখে হর্ষবর্ধন ভারী খুশি হলেন, বললেন, এটা শুভ লক্ষণ। ব্যাঙ ভারী পয়া, জানিস গোবরা?

মা লক্ষ্মীর বাহন বুঝি?

সে তা প্যাচা। দাদা জানান–কে না জানে।

যা বলেছেন। আমি ওঁর কথায় সায় দিই যতো পঁাচাল লোকই হচ্ছে মা লক্ষ্মীর বাহন। প্যাঁচ কষে টাকা উপায় করতে হয়, জান না ভাই?

তাহলে ব্যাঙ বুঝি সিদ্ধিদাতা গণেশের…, না…না বলে গোবরা নিজেই শুধরে নেয়–সে তো হলো গে ইঁদুর।

আমি পয়া বলেছি কারো বাহন টাহন বলে নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতায়। আমরা প্রথম যখন কলকাতায় আসি, তোর মনে নেই গোবরা? ধরমতলায় একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিলাম?

মনে আছে। পেয়েই তুমি সেটা পকেটে লুকিয়ে ফেলেছিলে, পাছে কারো নজরে পড়ে। তারপর বাড়ি এসে খুলে দেখতে গিয়ে দেখলে

দেখলাম যে চারটে ঠ্যাং। মনিব্যাগের আবার ঠ্যাং কেন রে? তার পরে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি কি, ওমা, ট্রামগাড়ির চাকার তলায় পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ব্যাঙ একটা।

আর কিছুতেই খোলা গেল না ব্যাগটা।

গেল না বটে, কিন্তু তার পর থেকেই আমাদের বরাত খুলে গেল। কাঠের কারবারে কেঁপে উঠলাম আমরা। আমরা এখানে টাকা উড়িয়ে দিতে এসেছিলাম, কিন্তু টাকা কুড়িয়ে থই পাই না তারপর।

ব্যাঙ তাহলে বিশ্বকর্মার বাহন হবে নির্ঘাত। গোবরা ধারণা করে; যত কারবার আর কারখানার কর্তা ঐ ঠাকুরটি তো। কী বলেন মশাই আপনি? ব্যাঙ বিশ্বকর্মার বাহনই তো বটে?

ব্যাঙ না হলেও ব্যাঙ্ক তো বটেই। বিশ্বের কর্মীদের সহায়ই হচ্ছে ঐ ব্যাঙ্ক। আর বিশ্বকর্মাদের বাহন বোধহয় ওই ওয়ার্ড ব্যাঙ্ক।

ব্যাঙ থেকেই ব্যাঙ্ক। একই কথা। হর্ষবর্ধন উচ্ছ্বসিত হন।ব্যাঙ থেকেও আমার আমদানি, আবার ব্যাঙ্ক থেকেও।

ব্যাঙটাকে দেখে একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। আমি বলি–জামপিং ফ্রগের গল্প। মার্ক টোয়েনের লেখা। ছোটবেলায় পড়েছিলাম গল্পটা।

মার্ক টোয়েন মানে? হর্ষবর্ধন জিজ্ঞেস করেন।

এক লেখকের নাম। মার্কিন মুলুকের লেখক।

আর জামপিং ফ্রগ? গোবরার জিজ্ঞাস্য।

জামপিং মানে লাফান, আর ফ্রগ মানে হচ্ছে ব্যাঙ। মানে যে ব্যাঙ কিনা লাফায়।

লাফিং ফ্রগ বলুন তাহলে মশাই।

তাও বল যায়। গল্পটা পড়ে আমার হাসি পেয়েছিল তখন। তবে ব্যাঙের পক্ষে ব্যাপারটা তেমন হাসির হয়েছিল কিনা আমি জানি না। গল্পটা শুনুন এবার। মার্ক টোয়েনের সময়ে সেখানে, ঘোড়দৌড়ের মতন বাজি ধরে ব্যাঙের দৌড় হোত। লাফিয়ে লাফিয়ে যে ব্যাঙ যার ব্যাঙ আর সব ব্যাঙকে টেক্কা দিতে পারত সেই মারত বাজি। সেইজন্যে করত কি, অরন্য সব ব্যাঙকে হারাবার মতলবে যাতে তারা তেমন লাফাতে না পারে লাফিয়ে লাফিরে এগিয়ে যেতে হবে তো–সেইজন্য সবার আড়ালে এক একটাকে ধরে পাথর কুঁচি খাইয়ে বেশ ভারি করে দিত কেউ কেউ।

খেত ব্যাঙ সেই পাথর কুঁচি?

অবোধ বালক তো। যাহা পায় তাহাই খায়।

আমার বিশ্বাস হয় না। হর্ষবর্ধন ঘাড় নাড়েন।

পরীক্ষা করে দেখলেই হয়। গোবরা বলে:–এই তো পাওয়া গেছে একটা ব্যাঙ-এখন বাজিয়ে দেখা যাক না খায় কি না।

গোবরা কতকগুলো পাথর কুঁচি যোগাড় করে এনে গেলাতে বসল ব্যাঙটাকে। হাঁ করিয়ে ওর মুখের কাছে কুঁচি ধরে দিতেই, কি আশ্চর্য, তক্ষুনি সে গোপালের ন্যায় সুবোধ বালক হয়ে গেল। একটার পর একটা গিলতে লাগল টুপটাপ করে। অনেকগুলো গিলে ঢাউস হয়ে উঠল ওর পেট। তারপর মাথা হেঁট করে চুপচাপ বসে রইল ব্যাঙটা। ভারিক্কি দেহ নিয়ে লাফান দূরে থাক, নড়া চড়ার কোন শক্তি রইল না তার আর।

খেলতো বটে, খাওয়ালিও তো দেখলাম, ব্যাটা এখন হজম করতে পারলে হয়।দাদা বললেন।

খুব হজম হবে। ওর বয়সে কত পাথর হজম করেছি দাদা। গোবরা বলে?

ভাতের সঙ্গে এতদিনে যতো কাঁকর গিলেছি, ছোটখাট একটা পাহাড়ই চলে গেছে আমাদের গর্ভে। হয়নি হজম?

আলবৎ হয়েছে। আমি বলি : হজম না হলে তো যম এসে জমত।

ওই দ্যাখ দাদা। আঁতকে চেঁচিয়ে ওটে গোবরা।

আমরা দেখি। প্রকান্ড একটা সাপ, গোখরোই হবে হয়ত, এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

চৌকিদার বলে-একটুও নড়বেন না বাবুরা। নড়লেই সাপ এসে ছোবলাবে। আপনাদের দিকে নয়, ব্যাঙটাকে নিতে আসছে ও।

আমরা নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে দেখলাম, তাই বটে। আমাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে সে ব্যাঙটাকে এসে আত্মসাৎ করল।

সাপটা এগিয়ে এসে ধরল ব্যাঙটাকে, তারপর এক ঝটকায় লহমার মধ্যে মুখের ভেতর পুরে ফেলল। তারপর গিলতে লাগলো আস্তে আস্তে।

আমরা দাঁড়িয়ে ওর গলাধঃকরণ লীলা দেখতে লাগলাম। গলা দিয়ে পুরুষ্ট ব্যাঙটা তার তলার দিকে চলতে লাগল, খানিকটা গিয়ে থেকে গেল এক জায়গায়, সেইখানেই আটকে রইল, তারপর সাপটা যতই চেষ্টা করুন না, সেটাকে আর নামাতে পারল না। পেটের ভেতর ঢুকে ব্যাঙটা তার পিঠের উপর কুঁজের নত উঁচু হয়ে রইল।

উটকো ব্যাঙটাকে গিলে সাপটা উট হয়ে গেল শেষটায়। তার মুখখানা যেন কেমনতর হয়ে গেল। খুব তীব্র বৈরাগ্য হলেই যেমনটা হয়ে দেখা যায়। ভ্যাবাচাকা মার্কা মুখে সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জবুথবু হয়ে নট-নড়নচড়ন সে পড়ে রইল সেইখানেই।

তারপর তার আর কোন উৎসাহ দেখা গেল না।

ছুঁচো গেলার চেয়েও খারাপ দশা হয়েছে সাপটার বুঝলে দাদা? সাপের পেটে ব্যাঙ, আর ব্যাঙের পেটে যতো পাথর কুঁচি। আগে ব্যাঙ পাথরকুঁচিগুলো হজম করবে, তারপর সে হজম করবে গিয়ে ব্যাঙটাকে। সে বোধহয় আর ওদের এজন্মে নয়।

ওদের কে কাকে হজম করে দেখা যাক। আমি তখন বলি, ততক্ষণে আমাদেরও কিছু হজম হয়ে যাক। আমরাও খেতে বসি এধারে।

চৌকিদারের আনা মাখন-রুটি ইত্যাদি খবর-কাগজ পেতে খেতে বসে গেলাম আমরা। সাপটার অদূরেই বসা গেল। সাপটা মার্বেলের গুলির মতনে তালগোল পাকিয়ে পড়ে রইল। আমাদের পাশেই।

এমন সময়ে জঙ্গলের ওধারে একটা খসখসানি আওয়াজ পাওয়া গেল। বাঘ এসে গেছে বাবু। চৌকিদার বলে উঠল, শুনেই না আমরা তাকিয়ে দেখি সত্যিই ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বাঘটা আমাদের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে।

রুটি মাখন-টাখন শেষ পর্যন্ত বাঘের পেটেই গেল দেখছি। দেখে আমি দুঃখ করলাম।

কি করে যাবে? আমরা চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছি না সব, ওর জন্যে রেখেছি নাকি? বলল গোবরা-পাউরুটির শেষ চিলতেটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে।

যেমন করে পাথর কুচিগুলো সাপের পেটে গেছে ঠিক সেই ভাবে। আমি বিশদ করি।

এক গুলিতে সাবাড় করে দিচ্ছি না ব্যাটাকে। দাঁড়ান না। বলে হর্ষবর্ধন হাতে কী একটা তুললেন–ওমা। এটা যে সাপটা। বলেই কিন্তু আঁতকে উঠলেন বন্দুকটা গেল কোথায়?

বন্দুক আমার হাতে বাবু। বলল চৌকিদার ও আপনি তো আমার হাত থেকে নেননি বন্দুক। তখন থেকেই আমার হাতে আছে।

তুমি বন্দুক ছুঁড়তে জান?

না বাবু, তবে তার দরকার হবে না। বাঘটা এগিয়ে এলে এই বন্দুকের কুঁদার ঘায় ওর জান খতম করে দেব। আপনারা ঘাবড়াবেন না।

হর্ষবর্ধন ততক্ষণে হাতের সাপটাকেই তিনি পাক ছুঁড়ে দিয়েছেন বাঘটার দিকে। সাপটা সবেগে পড়েছে গিয়ে তার উপর।

কিন্তু তার আগেই না, কয়েক চক্করের পাক খেয়ে, সাপের পেটের থেকে ছিটকে ব্যাঙটা আর ব্যাঙের গর্ভ থেকে যাতে পাথর কুচি তীর বেগে বেরিয়ে ছররার মতই বেরিয়ে লেগেছে গিয়ে বাঘটার তার চোখে মুখে নাকে।

হঠাৎ এই বেমক্কা মার খেয়ে বাঘটা ভিরমি খেয়েই যেন অজ্ঞান হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ আর। তার নড়া চড়া নেই।

সর্পাঘাতে মারা গেল নাকি বাঘটা? আমার পায়ে হতজ্ঞান। বাঘটার দিকে এগুলাম।

চৌকিদার আর দেরি না করে বন্দুকের কুঁদায় বাঘটার মাথা থেঁতলে দিল। দিয়ে বললোআপনার সাপের মারেই মারা পড়েছে বাঘটা। তাহলেও সাবধানের মার নেই বাবু, তাই বন্দুকটাও মারলাম তার ওপর।

এবার কি করা যাবে? আমি শুধাই ও কোনো ফোটে তোলার লোক পাওয়া গেলে বাঘটার পিঠে বন্দুক রেখে দাঁড়িয়ে বেশ পোজ করে ফোটো তোলা যেত একখানা।

এখানে ফোটো ওলা কোথায় বাবু এই জঙ্গলে? বাঘটা নিয়ে গিয়ে আমি ভেট দেব দারোগাবাবুকে। তাহলে আমার ইনামও মিলবে–আবার চৌকিদার থেকে একচোটে দফাদার হয়ে যাব আমি এই বাঘ মারার দরুন। বুঝলেন?

দাদা করল বাঘের দফারফা আর তুমি হলে গিয়ে দফাদার। গোবরা বলল– বারে।

সাপ ব্যাঙ দিয়েই বাঘ শিকার করলেন আপনি দেখছি। আমি বাহবা দিলাম ওর দাদাকে।

হর্ষবর্ধনের সূর্য-দর্শন

সূর্যদর্শন না বলে সূর্যগ্ৰাস বললেই ঠিক হয় বোধ হয়।

রাহুর পরে এক মহাবীরই যা সূর্যদেবকে বগলদাবাই করেছিলে, কিন্তু যতো বড় বীরবাহুই হন না, হর্ষবর্ধনকে হনুমানের পর্যায়ে কখনো ভাবাই যায় না।

তাই তিনি যখন এসে পড়লেন, সূয্যি মামাকে দেখে নেবো এইবার, তখন বলতে কি, আমি হা হয়ে গেছলাম।

আমার হা কারের কোনো জবাব না দিয়েই তিনি হেঁয়ালি পাড়লেন, সুন্দরবনের বাঘ শিকার তো হয়েছে, চলুন এবার পাহাড়ে বাঘটাকে দেখে আসা যাক।

যদ্দুর আমার জানা, না বলে আমি পারলাম না, বাঘরা পাহাড়ে বড়ো একটা থাকে না। বনে জঙ্গলেই তাদের দেখা মেলে। হাতিরাই থাকে পাহাড়ে। পাহাড়দের হাতিমার্কা চেহারা দেখেছেন তো?

কে বলছে আপনাকে? তিনি প্রতিবাদ করলেন আমার কথার, টাইগার হিল তাহলে বলেছে কেন? নাম শোনেনি টাইগার হিলের?

শুনবো না কেন? তবে সে হিলে, যদ্দুর জানি, কোনো টাইগার থাকে না। বাবুরা বেড়াতে যান।

সূর্যিঠাকুর সেই পাহাড়ে ওঠেন রোজ সকালে সে নাকি অপূর্ব্ব দৃশ্য!

তাই দেখতেই তো যায় মানুষ।

আমরা যাবো। আমি, আপনি আর গোবরা। এই তিনজন।

বিকেলের দিকে পৌঁছালাম দার্জিলিঙে। টাইগার পাহাড়ের কাছাকাছি এক হোটেলে ওঠা গেল।

খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত করে হোটেলের মালিককে অনুরোধ করলাম দয়া করে আমাদের কাল খুব ভোরের আগে জাগিয়ে দেবেন….

কেন বলুন তো?

আমরা এক-একটি ঘুমের ওস্তাদ কিনা, তাই বলছিলাম।

ঘুম পাহাড়ও বলতে পারেন আমাদের। বললেন হর্ষবর্ধন যে ঘুম পাহাড় খানিক আগেই পেরিয়ে এসেছি আমরা! তাই আমাদের এই পাহাড়ে ঘুম সহজে ভাঙবার নয় মশাই।

নিজগুণে আমরা ঘুম থেকে উঠতে পারবো না, গোবরাও যোগ দিলো আমাদের কথায় তাই আপনাকে এই অনুরোধ করছি…।

কারণটা জানতে পারি?

কারণ? আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, অদূরে এসেছি কেবল দূর্যোদয় দেখবার জন্য।

সূর্যোদয় দেখবার জন্য? কেন, কলকাতায় কি তা দেখা যায় না? সেখানে কি সূর্য ওঠে না নাকি?

উঠবে না কেন, কিন্তু দর্শন মেলে না। চারধারেই এমন উঁচু.উঁচু সব বাড়িঘর যে, সূয্যি ঠাকুরের ওটা নামার খবর টের পাবার জো নেই।

তাছাড়া তালগাছও তো নেইকো কলকাতায়, থাকলে না-হয় তার মাথায় উঠে দেখা যেতো.. গোবরা এই তালে একটা কথা বললো বটে তালেবরের মতন!

তাল গাছ না থাক, তেতলা বাড়ি আছে তো? তার ছাদে উঠে কি দেখা যেতো না? বলতে চান ম্যানেজার।

থাকবে না কেন তেতলা বাড়ি। তেতাল, চৌতাল, ঝাঁপতাল সবরকমের বাড়িই আছে। বলে হর্ষবর্ধন তার উল্লিখিত শেষের বাড়ির বিশদ বর্ণনা দেন, ঝাঁপতাল বাড়ি নামে যে-সব সাত-দশ তল বাড়ির থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরবার তালে ওঠে মানুষ, তেমন বাড়িও আছে বইকি! কিন্তু থাকলে কি হবে, তাদের ছাদে উঠেও বোধ হয় দেখা যাবে না সূর্যোদয়! দূরের উঁচু উঁচু বাড়ির আড়ালেই ঢাকা থাকবে পূর্ব্ব আকাশ।

এক হয়, যদি মনুমেন্টের মাথায় উঠে দেখা যায়…আমি জানাই।

তা সেই মনুমেন্টের মাথায় উঠতে হলে পুরো দিন লাগবে মশাই আমার এই দেহ নিয়ে…দেহটা দেখেছেন?

হর্ষবর্ধনের সকাতর আবেদনে হোটেলের মালিক তার দেহটি অবলোকন করেন। তারপরে সায় দেন–তা বটে।

তবে দেখুন এ জন্মে আমার সূর্যোদয়ই দেখা হচ্ছে না তাহলে এই মানবদেহ ধারণ বৃথাই হলো…।

তাই আমাদের একান্ত অনুরোধ….

এখানে নাকি অবাধে সূর্যোদয় দেখা যায়, আর তা নাকি একটা দেখাবার জিনিস সত্যিই…

সেই কারণেই আপনাকে বলছিলাম…

আমাদের যুগপৎ প্রতিবেদন-দয়া করে আমাদের ভোর হবার আগেই ঘুম থেকে তুলে দেবেন। এমনকি, দরকার হলে জোর করেও।

কোনো দরকার হবে না। তিনি জানান, রোজ ভোর হবার আগে এমন সোরগোল বাধে এখানে যে তার চোটে আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে যাবে আপনাদের।

সোরগোলটা বাধে কেন?

কেন আবার? ঐ সূর্যোদয় দেখবার জন্যেই। যে কারণে যেই আসুক না, হাওয়া খেতে কি বেড়াতে কি কোনো ব্যবসার খাতিরে, ঐ সূর্যোদয়টি সবারই দেখা চাই। হাজার বার দেখেও আশ মেটে না কারো। একটা বাতিকের মতই বলতে পারেন।

আমরাও. এখানে চেঞ্জে আসিনি, বেড়াতে কি হাওয়া খেতেও নয়– এসেছি ঠিক কি কারণেই…।

তাই রোজ রোজ হবার আগেই হোটেলের বোর্ডাররা সব গোল পাকায়, এমন হাঁকডাক ছাড়ে যে, আমরা, মাসে এই হোটেলের কর্মচারীরা, যারা অনেক রাতে কাজকর্ম সেরে ঘুমতে যায় আর অত ভোরে উঠতে চায় না, সূর্য ভাঙিয়ে আমাদের ব্যবসা হলেও সূর্য দেখার একটুও গরজ নেই, যাদের, একদম সেজন্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদেরও বাধ্য হয়ে উঠতে হয় ঐ হাঁকডাকের দাপটে। কাজেই আপনাদের কোনো ভাবনা নেই কিছু করতে হবে না আমাদের। কোন বোর্ডারকে আমরা ডিস্টার্ব করতে চাইনে কারও বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো আমাদের নিয়ম নয়…তার দরকার হবে না, সাত সকালেই সেই গোলমালে আপনাদের ঘুম যতই নিটোল হোক না কেন, না ভাঙলেই আনু অবাক হবো।

অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে হোটেলের ঘরে আমাদের মালপত্র রেখে বিকেলের জলযোগ পর্ব চা-টা সেরে বেড়াতে বেরুলাম আমরা।

তখন অবশ্য সূর্যোদয় দেখার সময় ছিল না, কিন্তু তা ছাড়াও দেখবার মতো আরো নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মজুদ ছিল তো। সেই সব অপূর্ব্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতেই আমরা বেরুলাম।

সন্ধে হয় হয়। এ-ধারের পাহাড়ের পথঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকাই এখন। একটা ভুটিয়ার ছেলে একপাল ভেড়া চরিয়ে বাড়ি ফিরছে গান গাইতে গাইতে।

শুনে হর্ষবর্ধন আহা-উঁহু করতে লাগলেন।

আহা আহা! কী মিষ্টি! কী মধুর…

কেমন মূছনা! যোগ দিল গোবরা। শুনে প্রায় মূছনা হয় আর কী!

একেই বলে ভাটিয়ালি গান, বুঝেছিস গোবরা? কান ভরে শুনে নে, প্রাণ ভরে শোন।

ভাটিয়ালি গান বোধ হয় এ নয়, মৃদু প্রতিবাদ আমার–সে গান গায় পূর্ব্ব-বাংলার মাঝিরা, নদীর বুকে নৌকার ওপর বৈঠা নিয়ে বসে। ভাটির টানে গাওয়া হয় বলেই বলা হয় ভাটিয়ালি।

তাহলে এটা কাওয়ালি হবে। সমঝদারের মতন কন হর্ষবর্ধন।

তাই-বা কি করে হয়? গোরু-চরাতে চরাতে গাইলে তাই হতো বটে, কিন্তু cow তো নয়, ও তো চারাচ্ছে ভেড়া।

কাওয়ালিও নয়? হর্ষবর্ধন যেন ক্ষুণ্ণ হন।

রাখালী গান বলতে পারো দাদা। ভাই বাতলায়, ভেড়া চরালেও রাখালই তো বলা যায় ছোঁড়াটাকে।

লোকসঙ্গীতের বাচ্চা বলতে পারেন। আমিও সঙ্গীতের গবেষণায় কারো চাইতে কম যাই না, এই বেড়ালই যেমন বনে গেড়ে বনবেড়াল হয়। তেমনি এই বানকই বড়ো হয়ে একদিন কে বিষ্ণু লোক হবে। অন্তত যখন ওর গোঁফ বেরুবে গানকে অক্লেশে লোকসঙ্গীত বলা যাবে। এখন নেহাৎ বালকসঙ্গীত।

ভেড়ার পাল নিয়ে ছেলেটা কাছিয়ে এলে হর্ষবর্ধন নিজের পকেট হাতড়াতে লাগলেন–ওকে কিছু বকশিস দেওয়া যাক। ওমা! আমার মানিব্যাগটা তো হোটেলের ঘরে ফেলে এসেছি দেখছি। আপনার কাছে কিছু আছে? নাকি, আপনিও ফেলে এসেছেন হোটেলে?

পাগল! আমি প্রাণ হাত ছাড়া করতে পারি, কিন্তু পয়সা নয়। আমার যৎসামান্য যা কিছু আমার সঙ্গে থাকে আমার পকেটে আমার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে কিনা।

বলতে গিয়েও বাধে আমার। চক্রবর্তীরা যে কঞ্জুস হয়, সে-কথা মুখ ফুটে বলি কি করে? নিজ গুণ কি গণনা করবার?

তাহলে ওকে কিছু দিন মশাই! একটা টাকা অন্তত।

দিলাম।

টাকাই পেয়ে তো ছেলেটা দস্তুরমত হতবাক। পয়সার জন্য নয়, প্রাণের তাগাদার অকারণ পুলকেই গাইছিল সে। তাহলেও খুশি হয়ে, আমাদের সেলাম বাজিয়ে নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে সে চলে গেলো।

খানিকবাদে সেই পথে আবার এক রাখাল বালকের আবির্ভাব! সেই ভেড়ার পাল নিয়ে সেইরকম সুর ভাজতে ভাজতে….তাকেও এক টাকা দিতে হয়।

আবার খানিকবাদে আবার আরেক! পঞ্চম গলা চড়িয়ে ফিরছে ঐ–পথেই।

তার স্বরাঘাতের হাত থেকেই রেহাই পেতে, অর্ধচন্দ্র দেওয়ার মতো একটা আধুলি দিয়ে তাকে বিদায় করা হলো।

তারপর আরো আরো মেষপালকের গাইয়ে বালকের দল আসতে লাগল পরম্পরায়…ঐ পথে, আর আমিও তাদের বিদায় দিতে লেগেছি। তিনটাকে আধুলি, চারটেকে পঁচিশ পয়সা করে, বাকীগুলোকে পুঁজি হালকা হওয়ার হেতু বাধ্য হয়েই দশ পয়সা, পচ পয়সা করে দিয়ে তাদের গন্তব্য পথে পাচার করে দিতে হলো।

সেই একটা ছেলেই ঘুরে ঘুরে আসছে নাতো দাদা, গোবরা সন্দেহ করে শেষটার পয়সা নেবার ফিকিরে?

সেই একটা ছেলেই নাকি মশাই? দাদা শুধান আমায়।

কি করে বলব? একটা ভুটিয়ার থেকে আরেকটা ভুটিয়াকে আলাদা করে চেনা যার পক্ষে শক্ত। এক ভেড়ার পালকে আরেক পালের থেকে পৃথক করা কঠিন। আমার কাছে, সব ভেড়াই একরকম। এক চেহারা।

বলেন কি? হর্ষবর্ধন তাজ্জব হন।

হ্যাঁ সব এক ভ্যারাইটি। যেমন এক চেহারা তেমনি এক রকমের স্বরলরী–কি ভেড়ার আর কি ভুটিয়ার!

আসুন তো, পাশের টিলাটার ওপরে উঠে দেখা যাক ছেলেটা যায় কোথায়! ছেলেটা

যেতেই আমরা টিলাটার ওপরে উঠলাম,

ঠিক তাই; ছেলেটা এই টিলাটার বেড় মেরেই ফের আসছে বটে ঘুরে.. গলা ছেড়ে দিয়ে সুরের সপ্তমে।

কিন্তু এবার আর সে আমাদের দেখা পেল না।

পেয়ে, টিলাটাকে আর চক্কর না মেরে তার নিজের পথ ধরল সে। আর চক্ৰত্তের থেকে মুক্তি পেলাম আমরাও।

কিন্তু ছেলেটা আমাকে কপর্দকশূন্য করে দিয়ে গেলো। আরেকটু হলে তার গানের দাপটে আমার কানের সবকটা পর্দাই সে ফাটিয়ে দিয়ে যেত। তাহলেও কানের পাতলা পর্দার বেশ কয়েকটাই সে ঘায়েল করে গেছে, শেষ পর্দাটাই বেঁচে, গেছে কোন রকমে। আমার মত আমার কানকেও কপর্দকশূন্য করে গেছে।

তাহলেও কোনো গতিকে কানে কানে বেঁচে গেলাম এ-যাত্রায়।

প্রাকৃতিক মাধুরীর প্রচুর ভুরিভোজের পর বহুৎ হন্টন করে হোটেলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো।

তখন ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলুঢুলু, পা টলছে। কোনো রকমে কিছু নাকে মুখে গুঁজেই আমাদের ঘরের ঢালাও বিছানায় গিয়ে আমরা গড়িয়ে পড়লাম।

গোবরাভায়া, দরজা জানলা খড়খড়ি ভালো করে এঁটে দাও সব। নইলে কোনো ফাঁক পেলে কখন এসে বৃষ্টি নামবে, তার কোনো ঠিক নেই। বললাম আমি গোর্বধনকে।

এটা তো বর্ষাকাল নয় মশাই।

দার্জিলিঙের মেজাজ তুমি জানো না ভাই। এখানে আর কোনো ঋতু নেই, গ্রীষ্ম নেই, বসন্ত নেই, শরৎ নেই, খালি দুটো ঋতুই আছে কেবল। শীতটা লাগাতার আর বর্ষণ যখন তখন।

তার মানে?

চার ধারেই হালকা মেঘ ঘুরছে নজরে না ঠাওর হলেও। মেঘলোকের উচ্চতাতেই দার্জিলিং তো। জানলা খড়খড়ির ফাঁক পেলেই ঘরের ভেতরে সেই মেঘ এসে বৃষ্টি নামিয়ে সব ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবে।

বলেন কি?

তাই বলছি। আমি বললাম কিন্তু আর বলতে পারছি না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম…

ঘুমোচ্ছন তো! কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে ঘুমোবেন। হাঁকলেন হর্ষবর্ধন।

তেমন করে কি ঘুমানো যায় নাকি? আমি না বলে পারি না চোখ তো বুজতে হবে অন্তত।

কিন্তু কান খাড়া রাখুন। কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে ঘুমোন। একটু সোরগোল কানে এলেই বুঝবেন ভোর হয়েছে। জাগিয়ে দেবেন আমাদের।

দেখা যাবে। বলে আমি পাশ ফিরে শুই। কান দিয়ে কদুর কতটা দেখতে পারবো তেমন কোনো ভরসা না করেই।

এক ঘুমের পর কেমন একটা আওয়াজ আমার কান খাড়া হয়। আমি উঠে বসি বিছানায়। পাশে ঠেলা দিই গোবরাকে–গোবরা ভায়া, একটা আওয়াজ পাচ্ছো না?

কিসের আওয়াজ?

পাখখায়াজ বাজছে যেন। কেউ যেন ভৈরো রাগিণী সাধছে মনে হচ্ছে। ভৈরো হললাগে ভোরবেলার রাগিণী। ভোরবেলায় গায়।

পাথোয়াজ বাজছে? গোবরাও কান তুলে শোনবার চেষ্টা করে।

হর্ষবর্ধনও সাড়া দেন ঘুম থেকে উঠে কি হয়েছে? ভোর হয়েছে নাকি?

খানিক আগে কি রকম যেন একটা সোরগোল শুনছিলাম–আমি বললাম।

ভোর হয়েছে বুছি?

ভাবছিলুম তাই। কিন্তু আর সেই হাঁকডাকটা শোনা যাচ্ছে না।

শুনবেন কি করে? বলল গোবরা–দাদা জেগে উঠলেন যে! দাদাই তো নাক ডাকাচ্ছিলেন এতক্ষণ।

কখনো না। বললেই হলো! কখনো আমার নাক ডাকে না, ডাকলে আমি শুনতে পেতুম না নাকি? ঘুম ভেঙে যেতো না আমার?

তুমি যে বদ্ধকালা। শুনবে কি করে? নইলে কানের অত কাছাকাছি নাক! আর ওই ডাকাত পড়া হাঁক তোমার কানে যেতে না?

তুমি একটা বদ্ধ পাগল! তোর সঙ্গে কথা কয়ে আমি বাজে সময় নষ্ট করতে চাই নে।বলে দাদা পাশ ফিরলেন আবার তাঁর হাঁকডাক শুরু হলো।

এরপর, অনেকক্ষণ পরেই বোধহয়, হর্ষবর্ধনই জাগালেন আমাদের কোনো সোরগোল শুনছেন?

কই না তো। আমি বলি–বিলকুল চুপচাপ।

এতক্ষণেও ভোর হয়নি? বলেন কি! জানলা খুলে দেখা যাক তো…তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে জানলাটা খুললেন–ওমা! এই যে বেশ ফর্সা হয়ে এসেছে, উঠুন! উঠুন! উঠে পড়ন। চটপট।

আমরা ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।

জামা কাপড় পরে না! সাজগোজ করার সময় নেই তাছাড়া দেখতেই যাচ্ছেন, কাউকে দেখাতে যাচ্ছেন না। নিন, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। দেরি করলে সূর্যোদয়টা ফসকে যাবে।

তিনজনেই শশব্যস্ত হয়ে আপাদমস্তক কম্বল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টাইগার হিলের উঁচু টিলার কাছেই। হন্তদন্ত হয়ে তিনজনায় গিয়ে খাড়া হলাম তার ওপর। বিস্তর লোক গিজগিজ করছে সেখানে। নিঃসন্দেহে, সূর্যোদয় দেখতে এসেছে সবাই।

মশাই। সূর্য্যি উঠতে দেরি কতো? হর্ষবর্ধন একজনকে শুধালেন।

সূর্য্যি উঠতে? ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে ওঁর কথায় জবাব দিলেন।

বেশি দেরি নেই আর। আমি বললাম–আকাশ বেশ পরিষ্কার। দিগ্বিদিক উদ্ভাসিত….উঠলো বলে মনে হয়।

কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। হর্ষবর্ধন বাধ্য হয়ে আরেকজনকে শুধান সূয্যি উঠচে না কোন মশাই?

এখন সূর্য উঠবে কি? সোকে অবাক হয়ে তাকান তার দিকে।

মানে, বলছিলাম কি সূর্য তো ওঠা উচিত ছিলো এতক্ষণ। পূবের আকাশ বেশ পরিষ্কার। সূর্যের আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে অথচ সূর্যের পাত্তা নেই।

সূর্য কি উঠবে না নাকি আজ? আমার অনুযোগ।

ঐ মেঘটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য, তাই দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি জানালেন মেঘটা নরে গেলেই

বলতে বলতে মেঘ সরে গেলো প্রকাশ পেলেন সূর্যদেব!

ও বাবা! অনেকখানি উঠে পড়েছেন দেখছি! বেলা হয়ে গেছে বেশ। আপসোস করলেন হর্ষবর্ধন সূর্যোদয়টা হাতছাড়া হয়ে গেলো দেখছি আজ।

ওমা! একি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি নেমে যাচ্ছে যেন! নামছে কেন সূয্যিটা? নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে যে! এ-কি ব্যাপার?

এরকমটা তো কখনো হয় না! আমিও বিস্মিত হইয়া সূর্যের এমন বেচাল ব্যাপার তো দেখা যায় না কখনো।

হ্যাঁ মশাই, এরকমটা হয় নাকি এখানে মাঝে মাঝে? একটু না উঠেই নামতে থাকেন আবার পথ ভুল হয় সূর্যদেবের?

তার মানে?

তার মানে, আমরা সূর্যোদয় দেখতে এসেছি কিনা। উদীয়মান সূর্য দেখতে না পাই, উদিত সূর্য দেখেও তেমন বিশেষ দুঃখিত হইনি-কিন্তু একি! উঠতে না উঠতে নামতে লাগলো যে!

আপনার জন্যে কি পশ্চিম দিকে উঠবে নাকি সূর্য অস্ত যাবার সময় সূর্যোদয় দেখতে এসেছেন! আঁঝালো গলা শোনা যায় ভদ্রলোকের–

কোথাকার পাগল সব! আরেক জন উতোর গেয়ে ওঠেন তাঁর কথার।

হাতাহাতির পর

একবার হাতি পোষার বাতিক হয়েছিল আমার কাকার। সেই হাতির সঙ্গেই একদিন তাঁর হাতাহাতি বেধে গেল। সে কথাও শুনেছিস। হাতির গুঁড় এবং কাকার কান খুব বেশি দূর ছিল না– সুতরাং তার আসন্ন ফল কি দাঁড়াবে তা আমি এবং হাতি দুজনেই অনুমান করতে পেরেছিলাম। কাকাও পারেনি তা নয়, কিন্তু দুঘর্টনা আর বলে কাকে! সেই কর্ণবধ–পর্বের পর থেকে এই পালার শুরু!

কান গেলে মানুষের যত দুঃখ হয় অনেক সময় প্রাণ গেলেও ততটা হয় না বোধ হয়। কান হারিয়ে কাকা ভারি মুশড়ে পড়েছিলেন দিনকতক।

কর্ণের বিপদ পদে পদে, এই কথাটাই কাকাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। মহাভারত পড়েও যায়, তা ছাড়া, পাঠশালায় পড়বার সময় ছেলেরাও হাড়ে হাড়ে টের পায়। হাড়ে হাড়ে না বলে কানে কানে বললেই সঠিক হবে, কেন না কানের মধ্যে বোধহয় হাড় নেই, থাকলে ওটা আদৌ অত সুখকর মূলতব্য ব্যাপার হত না।

কাকাকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করি। কিন্তু কাকা বোঝেন কিনা তিনিই জানেন। তত্ত্বকথা বোঝ সহজ কথা নয়। আর তাছাড়া তাঁকে বোঝাই মনে মনে, মুখ ফুটে কিছু বলবার আমার সাহস হয় না। কাকা যা বদরাগী, ক্ষেপে যেতে কতক্ষণ!

কাকাকে দেখলে আজকাল আমার ভয় হয়। কর্ণফ্লুত কাকা পদচ্যুত চেয়ারের চেয়েও ভয়াবহ। তার উপরে নির্ভর করা যায় না–করেছ কি কুপোকাৎ! আর আজকাল যে রকম কটমট করে তিনি তাকান আমার দিকে। মুখের পানে বড় একটা না, আমার কানের দিকে কেবল। ঐ দিকেই তার যত চোখ, যত ঝোঁক আর যত রোখ। আমি বেশ বুঝতে পারি আমার কর্ণসম্পদে তিনি বেশ ঈর্ষান্বিত। হাতির হাত থেকে বাঁচিয়েছি, এখন কাকার কবল থেকে কি করে কান সামলাই তাই হয়েছে আমার সমস্যা। কাকা একবার ক্ষেপে গেলে আমাকে তার নিজের দশায় আনতে কতক্ষণ?

তাই আমিও যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। নিতান্তই কাকার কাছাকাছি থাকতে হলে মর্মাহত হয়ে থাকি। এবং মনে মনেই তাকে সান্ত্বনা দিই।

অবশেষে একদিন সকালে কাকা অকস্মাৎ চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। শিবু-শিবু–ডাক পড়ে আমার।

কাকার কাছে দৌড়োই কান হাতে করে। এত যখন হাঁকডাক, কি সর্বনাশ হবে কে জানে? প্রাণে মরতে ভয় খাই না, মারা গেলে আবার জন্মাবো, কিন্তু কানে মারা যাবার আমার বড় ভয়।

কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? হয়েছে, সব ঠিক হয়েছে। আর কোন ভাবনা নেই! উৎসাহের

আতিশয্যে উথলে ওঠেন কাকা। আমি চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকি!

বুঝেছিস কিছু? কাকার প্রশ্ন হয়।

উঁহু–আমি দুকান নাড়ি। ঘাড় নাড়লেই কানরা নড়ে যায়, কেন যে তা জানি না, তবে বরাবর দেখে আসছি আমি।

রামপুরহাট যাব। টিকিট কিনে আনগে। একটা ফুল, একটা হাফ। তুই যাবি আমার সঙ্গে।

রামপুরহাট? হঠাৎ আমি বলে ফেলি।

হঠাৎ আবার কি? সেইখানেই তো যেতে হবে। আমার সবিস্ময়ে প্রশ্নে কাকা যেন হতভম্ব হয়ে যান।–বামাক্ষেপার জীবনী পড়িসনি? আর পড়বিই বা কি করে? বুড়ো হাতি হতে চললি কিন্তু ধর্মশিক্ষা হলো না তোর। যত বলি সাধু মহাত্মা যোগী-ঋষিদের জীবনী টিবনী পড়-–তা না, কেবল ডাণ্ডাগুলি, লুটু আর লাটাই। যদি তা পড়তিস তাহলে আর একথা জিজ্ঞেস করতিস না।

আমি আর জিজ্ঞাসা করি না। মৌনতা দ্বারা কেবল সম্মতি নয়, পাণ্ডিত্যের লক্ষণও প্রকাশ পায়, এই শিক্ষাটা আমার হয়ে যায়। না বলে কয়ে যদি সময়দার হওয়া যায় তাহলে আর কথা বলে কোন মুখ? কাকা স্বতঃপ্রবৃত্ত আমাকে সবিশেষ জ্ঞান দিতে উদ্যত হন। রামপুরহাটের কাছেই এক ঘোর মহাশ্মশান আছে, জানিস? এই দশ-বিশ মাইলের মধ্যেই। সেই শ্মশানে বসে কেউ যদি একটা না তিন লক্ষ বার কোনো দেবতার নাম জপ করতে পারে তাহলেই সিদ্ধি! নির্ঘাৎ! স্বয়ং বশিষ্টমুনি এই বর দিয়ে গেছেন। আমার ঠাকুর্দার কাছে শোনা। সেইখানেই আমি যাব।

সেখানে কেন কাকা? আমি একটু বিস্মিতিই হই। সিদ্ধির জন্য অত কষ্ট করে অতদূর যাবার কি দরকার? রামপুরহাট না গিয়ে, রামশরণ দুবেকে বললে এখনি তো এক লোটা বানিয়ে দেয়? কোনও হাঙ্গামা নেই? হা, সবটাতেই কাকার যেন বাড়াবাড়ি।

আমার সিদ্ধি মেডইজির ভূমিকা পড়ার মুখেই কাকা উসকে ওঠেন–উ হুঁ হু সে সিদ্ধি নয়। ও তো খেতে হয়, খেলে আবার মাথা ঘোরে। এ সিদ্ধি পেতে হয়। বামাক্ষেপা, বারদির ব্রহ্মচারী, আরও যেন কারা সব ঐ শ্মশানে বসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন! জানিস না? আমি দুর্গা দুর্গা দুর্গা এইরকম জপ করে যাব, যেমনি না তিন লক্ষ বার পুরবে আমনি মা দুর্গা হাসতে হাসতে দশ হাত নেড়ে এসে হাজির হবেন। বাবা গণেশও শুঁড় নাড়তে নাড়তে আসতে পারেন। তারা এসে বলবেন–বৎস বর নাও–

তখন আমি যা বর চাইব, বুঝেছিস কিনা, সঙ্গে সঙ্গে ফলবে। তাকেই বলে সিদ্ধিলাভ। আমি যদি চাই, আমার আরো দুটো হাত গজাক,তক্ষুনি গজাতে পারে। হুঁ! তৎক্ষণাৎ!

শুনে আমার রোমাঞ্চ হয়। চতুর্ভুজ কাকার চেহারা কল্পনা করার আমি প্রয়াস পাই।

কিন্তু কাকাবাবু! চার হাত হলে তুমি পাশ ফিরে শোবে কি করে?

কিন্তু আমি তো হাত চাইব না। হাত আমার আছেই। দুটো হাতই আমার পক্ষে যথেষ্ট। এই নিয়েই পেরে উঠি না। পায়েরও আমার আর দরকার নেই। দুটো পা–আমার মোর দ্যান এনাফ। আমি কেবল চাইব আর একটা কান। কান না হলে আমাকে মানায় না, আয়নার দিকে তাকানোই যায় না। তাই বুঝেছিস কিনা অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম–রামপুরহাট! মন্ত্র বলে চারটে হাত কি চারটে পা যদি আমার গজাতে পারে তাহলে একটা মাত্র কান গজানো আর এমন কি?

কাকা তার কথায় পুনশ্চ যোগ করেন আবার–ইচ্ছে করলেই যদি আমি চতুস্পদ হতে পারি তাহলে এমন বিকর্ণ হয়ে থাকব কেন? কিসের তরে?

আমারও–দারুণ বিশ্বাস হয়ে যায়। মন্ত্রবলে কতো কি হয় শুনেছি, কান হওয়া আর কি কঠিন? কানেই যখন মন্ত্র দেয়, তখন মন্ত্রেও কান দিতে পারে। আশ্চর্য কিছু নয়। তিল লাখ বার কেবল দুর্গা কি কালী কি জগদ্ধাত্রী এর যে কোনো একটা নাম–উঁহু জগদ্ধাত্রী বাদ–চার অক্ষরের মন্ত্র তার মধ্যে আবার দস্তুরমত দ্বিতীয় ভাগ! জগদ্ধাত্রীর তিন লক্ষ মানে কালীর ছলক্ষের ধাক্কা। শক্তির আরাধনাতেই নাহক শক্তির বরবাদ নেহাত সময়ের অপচয়! পয়সা না লাগুক, কিন্তু দেবতার নামের বাজে খরচ করতেও আমি নারাজ।

কাকা, আমিও তাহলেও বর চেয়ে নেব যাতে না পড়ে শুনে ম্যাট্রিকটা পাশ করতে পারি। আমি একটু ভেবে নিই, কেবল পাশ করাই বা কেন, স্কলারশিপটা নিতেই বা ক্ষতি কি? যে বরে পাশ হয়, স্কলারশিপও তাতে হতে পারে, কি বল কাকা? মা দুর্গার পক্ষে কি খুব শক্ত হবে এমন?

আর ম্যাট্রিকই বা কেন? না পড়ে একে বারে এম্-এ? এম টা আমি আরো বড়ো করি।

বারে! আমি মরব জপ করে আর তুমি পাশ করবে না পড়ে? বাঃ-রে!–-কাকা খাপ্পা হয়ে ওঠেন।

তা হলে আমার গিয়ে আর কি হবে! আমি ক্ষুণ্ণ হই। তোমার সঙ্গে নাই গেলাম তবে, আমার তো আর কানের তেমন অভাব নেই।

পাগল! তা কি করে হয়? তোকে যেতেই হবে সঙ্গে। সিদ্ধিলাভ করা কি অতই সোজা নাকি, জপ করতে বসলেই তুলে দেয় যে,–

কে? পুলিসে?

উঁহু। পুলিশ সেখানে কোথা? শুনছিস মহাশ্মশান! বারো কোশের ভেতরে কোনো জনমানব নেই!

ও বুঝেছি! শেয়াল! বেশ তোমার বন্দুকটা নিয়ে যাব না হয়–কাছে এলেই দুম-দুড়ুম।

শেয়াল নয় রে পাগলা, শেয়াল নয়। ডাকিনী যোগিনী, ভুত পেরেত, ভালবেতাল–এরা সব এসে তুলে দেয়। সিদ্ধিলাভ করতে দেয় না।

ভুত-প্রেত শুনেই আমি হয়ে গেছি! তাল-বেতালের তাল আমাকেই সামলাতে হবে ভাবতেই আমার হৃৎকম্প শুরু হয়। কাকা-কাকা! কম্পিত কণ্ঠে থেকে আমার কেবল কা কা ধ্বনি বেরোয়, তার বেশি বেরোয় না।

আরে, ভয় কিসের তোর। আমি তো কাছেই থাকব। গতিক সুবিধের নয় দেখলে দুর্গা পালটে রাম-নাম করতে যাব না হয়। রাম-নামে ভুত পালায়। তবে রাম হচ্ছে খোট্টাদের দেবতা–তা হোক গে, রামও বর দিতে পারে। সীতা উদ্ধার করেছিলেন আর একটা কান উদ্ধার করতে পারবেন না? তবে কিনা দুর্গা-দুর্গাই হল গিয়ে মোক্ষম! রামকেও দুর্গার কাছে বর নিতে হয়েছিল।

তথাপি আমি ইতস্তত করতে থাকি।

আচ্ছা, এক কাজ করা যাক! তুই নাহয় রাম রাম জপিস-তাহলে তো আর ভয় নেই তোর? রামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাশের ফিকিরও করে নিতে পারিস! আমার কোন আপত্তি নেই। ভোলানো খুব শক্ত হবে না হয়ত রামটা ভ্যাবা গঙ্গারাম। তা না হলে বাঁদরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এত মানুষ থাকতে? এতখানি বলে কাকাকে দম নিতে হয়–তা ছাড়া তোর দাঁত ব্যথা, পেট-কামড়ানো, সর্দিকাশি, লঙ্কা খেলে হেঁচকি ওঠা স্কুলের টাসক না হলে ডায়েরিয়া হওয়া–যত রাজ্যির ব্যারাম তো তোর লেগেই আছে, এসবও তোর সেরে যাবে শ্রীরামন্দ্রের মহিমায়।

পাশের কথায় আমার উৎসাহ সঞ্চার হয়। নতুন প্রস্তাবে কাকার সঙ্গে রফা করে ফেলতে দেরি হয় না একটুও। সেই দিনই আমরা রওনা দিই। সন্ধ্যার মুখে রামপুরহাটে পৌঁছানো; কাকার বন্ধু এক ডাক্তারের বাড়িতে আমাদের আবির্ভাব।

ডাক্তার ভদ্রলোক সে সময়ে একটা ঘোড়ার দর করছিলেন। একজন গেঁয়ো লোক ঘোড়া বেচতে এসেছিল, দিব্যি খাসা ঘোড়াটি–আকারপ্রকারে তেজী বলেই সন্দেহ হয়; প্রাথমিক কুশলপ্রশ্ন আদানপ্রদানের পরেই কাকা জিজ্ঞাসা করেন, ঘোড়া কেন হে হারাধন?

আর বল কেন বন্ধু! হারাধন ডাক্তার দুঃখ প্রকাশ করেন, দূর দূর যতো গ্রাম থেকে ডাক আসে, সেখানে তো মোটর চলে না, গরুর গাড়ির রাস্তাও নেই অনেক জায়গায়, সে স্থলে ঘোড়াই একমাত্র বাহন; অদূরস্থিত সাইকেলের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে–ওকে চেপে আর পোয় না ভাই! তাই দেখে শুনে একটা ঘোড়াই কিনছি এবার।

বেশ করেছ, বেশ করেছ। কাকার সর্বন্তকরণ সমর্থন–আমাদের স্বদেশী ঘোড়া থাকতে বিদেশী সাইকেল কেন হে! ঠিকই বুঝেছো এতদিনে। তা, তোমার ঘোড়াটিকে তো বেশ শান্তশিষ্ট বলেই বোধ হচ্ছে। কাছে গিয়ে কাকা ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে সার্টিফিকেট দেন।

তোমার তো ছোটবেলায় ঘোড়ায় চড়ার বাতিক ছিল হে! ঘোড়া দেখলেই চেপে বসতে, ডাক্তার বলেন, কি রকম জানোয়ার কিনলাম, চড়ে একবার পরীক্ষা করে দেখবে না? আমার তো ঘোড়ায় চড়া প্র্যাকটিস করতেই কিছুদিন যাবে এখন!

তৎক্ষণাৎ অশ্ব-পরীক্ষায় সম্মত হন কাকা; হাতি-ঘোড়র ব্যাপারে বেশি বেগ পেতে হয় না রাজি করাতে কাকাকে। চতুম্পদের দিকে কাকার স্বভাবতই যেন টান। সে তুলনায় আমার দিকেই একটু কম বরং, পদগৌরব করার মত কিছু আমার ছিল না বলেই বোধ হয়।

ঘোড়ায় চাপবার বয়েস কি আছে আর? কাকা সন্দিগ্ধ সুরেই বলেন–দেখি তবু চেষ্টা করে। তারপর ডাক্তারবাবু, আমি এবং অশ্ববিক্রেতা-সর্বোপরি স্বয়ং অশ্বের ব্যক্তিগত সহযোগিতায় কষ্টেসৃষ্টে, কোনো রকম তো চেপে বসেন শেষটা।

কাকার দেহখানি তো নয়, ভারাক্রান্ত হয়ে ঘোড়াটা কেমন যেন ভড়কে যায় নড়বার নামটিও করে না। কাকা যতই হেট হেট করেন ততই সে লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে থাকে।

অশ্ব বিক্রয়ের আশা ক্রমশই সুদূর রহিত হচ্ছে দেখে অশ্ববিক্রেতা বিচলিত হয়ে ওঠে; এবং তার হাতের ছিপটিও। কিন্তু যেই না ঘোড়ার পিঠে ছপাৎ করে একঘা বসিয়ে দেওয়া, অমনি ঘোড়াটা ঘুরপাক খেতে শুরু করে দেয়। এ আবার কি কাণ্ড! কাকা তো মরীয়া হয়ে ঘোড়ায় গলা জড়িয়ে ধরেন।

একদিকে ঘোড়ার ঘূর্ণবর্তের মধ্যে পড়ে ডাক্তারবাবুর শখের বাগানের দফা রফা, নানাপ্রকার গোলাপ গাছের চারা লাগিয়েছিলেন, ঘোড়া কেনবার কাছাকাছিই লাগিয়েছিলেন ঘোড়র পায়ে তাদের অপঘাতের আশঙ্কা তো করেননি কোনোদিন! অতঃপর অশ্ববর মুহুর্মুহ এগোতে আর পেছোতে থাকে, যে পথে এগোেয় সে পথে প্রায়ই পেছোয় না এবং বিদ্যুদ্বেগে অগ্রপশ্চাৎ গতির ধাক্কায় আর এক ধারের শাকসজির দফা সারে অশঙ্কুরে মুড়িয়ে যায় সব। এ-সমস্ত কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার! আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পরপর দুটি মহাদেশ এইভাবে বিধ্বস্ত করে অশ্বরত্ন নিদারুণ এক লাফ মারেন সেই এক লাফেই কাকা-পৃষ্ঠে, বাগানের বেড়া টপকে সামনের একটা নালা ডিঙিয়ে, তাকে অন্তর্হিত হতে দেখা যায়। আমিও দেরি করি না,তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের সাইকেলটায় চেপে পশ্চাদ্ধাবন করি। ঘোড়ার এবং কাকার। ধাবমান অশ্বকে সশরীরে খুব সামান্যই দেখা যায়, অল্পক্ষণ পরেই তিনি কেবল শ্রুতিগোচরহতে থাকে। দূর থেকে কেবল খটাখট কানে আসে; কিছুক্ষণ পরে পদধ্বনিও না–শুধুই চিহি চিহি। চিহিরই অনুসরণ করি।

অনেকক্ষণ অনেক ঘোরাঘুরির পর এক ধু-ধু প্রান্তরে এসে পড়ি। সন্ধ্যা কখন পেরিয়ে গেছে। আধখানা চাঁদের ম্রিয়মাণ আলোয় কোনরকমে সাইকেল চালিয়ে যাই কিন্তু সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও চিহ্নমাত্র নেই–না ঘোড়ার না সওয়ারের।

ইতস্তত সাইকেল চালাতে থাকি, কী করব আর? ফাঁকা মাঠ আর পরের সাইকেল পেলে কে ছাড়ে? কাকাহারা হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে কাকীর কাছে কী কৈফিয়ৎ দেব? মুখ দেখাব কি করে? সে ভাবনাও যে নেই তা নয়।

কে-রে? শিবু নাকিরে? শিবুই তো!

চমকে গিয়ে সাইকেল থামাই। দেখি কাকা এক উঁচু ঢিবির পাশে পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন।

আঃ, এসেছিস তুই? বাঁচলুম।

তোমার ঘোড়া কোথায় কাকা?

আমায় ফেলে পালিয়েছে। কোথায় পালিয়েছে জানি না। কাকার দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে–আঃ হতভাগার পিঠ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বেঁচেছি! কিন্তু এ কোথায় এনে ফেলেছেরে? এও কি রামপুরহাট?

উঁহু, মনে তো হয় না। রামপুরহাট কত মাইল দূরে তা বলতে পারব না, তবে বেশ কয়েকঘন্টা দূরে।

তাহলে এ কোন জায়গা? তুই কি বলছিস তবে লক্ষ্মণপুরহাট?

লক্ষ্মণপুর হতে পারে, ভরতপুর হতে পারে, হনুমানপুর হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু হাটের চিহ্নমাত্র নেই কাকা। চারধারেই তো ধুধু মাঠ! সাইকেল করে চারদিকে ঘুরলাম, জনমানবের পাত্তাই নেই কোথাও।

তবে…তবে এই কি সেই মহাশ্মশান? কাকা নিজেই নিজের জবাব দেন, দুর্লক্ষণ দেখে তাই তো মনে হয়। দমকা হাওয়ায় মড়া-পোড়ানোর গন্ধও পেয়েছি খানিক আগে। আর, দু-একটা শেয়ালকেও যেতে দেখলাম যেন। তাহলে–তাহলে কি হবে? কাকার কণ্ঠে অসহায়তার সুর।

কাকার বিচলিত হওয়ার কারণ অমি বুঝি না।–কেন? এখানে আসবার জন্যেই তো আমাদের আসা? তাই নয় কি? তাহলে সিদ্ধিলাভের ব্যাপারটা শুরু করে দিলেই তো হয়।

আজই? আর রাত্রেই? আজ যে সিদ্ধিলাভের জন্য মোটেই আমি প্রস্তুত নইরে। আজ কি করে হয়?

যখন হয়ে পড়েছে তখন আর কি করা? আমি কাকার পাশে বসে পড়ি। –তেমন ঝোঁপ-ঝাড় নেই, বেশ ফাঁকাই আছে কাকা! ভূতপ্রেত এলে টের পাওয়া যাবে তক্ষুনি।

সমস্ত দিন ট্রেনে-খাওয়া-দাওয়া হয়নি। খিদেয় নাড়ী চিঁ চিঁ করছে, এই কি সিদ্ধিলাভের সময়? তোর কি কোন আক্কেল নেই রে শিবু? এ রকম বিপদ হবে জানলে কে আসতে চাইত–এই আমি নিজের কান মলছি, যদি আজ উদ্ধার পাই–?

তাঁর একমাত্র কানকে কাকা একমাত্ৰা মলে দেন। কিন্তু উদ্ধারের কোন ভরসাই মেলে না। ততক্ষণে চাঁদ ডুবে অন্ধকার ঘোরালো হয়ে আসে। দুহাত দূরেও দৃষ্টি অচল হয়। আমি কাকার কাছ ঘেঁষে বসি, আমায় গা ছমছম করতে থাকে।

অবশেষে কাকা বলেন–তাই করা যাক অগত্যা। তোর কথাই শুনি। আজ রাত্রে এখান থেকে বেরুবার যখন উপায় নেই, তখন কি আর করা? কাল সকালে একেবারে সিদ্ধি পকেটে করে হারাধানের বাড়ি ফিরলেই হবে। এই নে আমার কোট, এই নে পিরাণকাকা একে একে আমার হাতে তুলে দিতে থাকেন। জিজ্ঞাসা করি–তুমি কি খালি গা হচ্ছ কাকা–

বাঃ, হব না? সাধু সন্ন্যাসী কি কাপড়জামা পরে চাদর দিয়ে তপস্যা করে নাকি? তাহলে কি হয় রে মুখ? এই নে চাদর এই নে আমার গেঞ্জি–এই নে আমার–

আমি সচকিত হয়ে উঠি। অতঃপর পরবর্তী বস্তুটি কী তা বুঝতে আমার বিলম্ব হয় না।–উঁহু, কাপড়টা থাক কাকা। কাপড় পরাতে তত ক্ষতি হবে না–

তুই তো জানিস। কাকা রাগান্বিত হন, হা কাপড়টা থাক। তাহলেই আমার সিদ্ধিলাভ হয়েছে! তবে এত কাণ্ড করে দরজি ডাকিয়ে গেরুয়া রঙের কৌপীনই বা তৈরি করলাম কেন, আর অমন কষ্ট করে সেটা এঁটে পরতেই বা গেলাম কেন তবে?,

কাপড়ও আমার হাতে চলে আসে। সেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে কৌপীনসম্বল কাকা কর্ণলাভের প্রত্যাশায় ঘোর তপস্যা লাগিয়ে দেন।

আমি আর কী করব? কাকার কাপড়টাকে মাটিতে পাতি, কোটকে করি বালিশ, গেঞ্জিটাকে পাশ বালিশ। তারপর আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে সটান হই। আমি দেখেছি, জেগে থাকলেই আমার যত ভয়, ঘুমিয়ে পড়লে আর আমার কোনো ভয় করে না!

অনেকক্ষণ অমনি কাটে। ঘুমেরও কোন সাড়া নেই, কাকারও না। সহসা একটা আওয়াজ–চটাস।

আমি চমকে উঠি! কাঁপা গলায় ডাকি–কাকা!

কাকার কোন সাড়া নেই। আরো বেশি করে আমি চাদর মুড়ি দিই।

আবার খানিক বাদে চটাস। এবার আওয়াজটা আরো যেন জোরালো।

আবার আমার আর্তনাদ–কাকা!

অন্ধকার ভেদ করে উত্তর আসে–উঁহুঁহুঁ!

কাকার চাপা হুঙ্কারে আমি নিরস্ত হই। আর উচ্চবাচ্য করি না। কাকার যোগভঙ্গ করে কি নিজের কানের বিঘ্ন ঘটাবে? অন্ধকারের মধ্যেই ওঁর হাত বাড়াতে কতক্ষণ?

অনেকক্ষণ কেটে যায়, আমার একটু তন্দ্রার মতো আসে। অকস্মাৎ ফের চটকা ভাঙে; উঠে বসি, শুনতে থাকিচটাচট চড় চটাচট-চট। অন্ধকার ফের চৌচির করে কেবল ঐ শব্দ, আর কিছু না এবং বেশ জোর জোর।

তবে কি–তবে কি…? ভয়ে আমার হাত পা গুটিয়ে আসে। তাহলে কি তাল-বেতালেই কাকাকে ধরে পিটাতে শুরু করে দিয়েছে নাকি? কিংবা ভূতপ্রেতরাই কাকাকে বেওয়ারিশ পেয়ে মজা করে হাতের সুখ করে নিচ্ছে? যাই হোক, কোনটাই ভাল কথা নয়।

আমি মরীয়া হয়ে ডাকতে শুরু করি–কাকা কাকা কাকা–!

বসতে দিচ্ছে নারে–

আওয়াজ পেয়ে আশ্বাস পাই। তবু যা হোক, আমার কাকান্ত ঘটেনি। ও-ও-ও কি-কি-কিসের শব্দ? আমার গলা কাঁপে।

আর বলিস না। করুণ কণ্ঠের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে দারুণ দীর্ঘনিঃশ্বাস। একদম, বসতে দিচ্ছে না।

কিসে বসতে দিচ্ছে না? ভূতে?

উহুঁ!

ডাকিনী–যোগিনী?

উ হুঁহু।

তবে কি তাল-বেতাল?

নাঃ। মশায়। মশার ভারি উৎপাত রে!

ওঃ, তাই বল। মশার কথা শুনে ভরসা পাই। তাহলে অন্য মারাত্মক কিছু নয়! তোমার চাদর মুড়ি দিয়েছিলাম বলে বুঝতে পারিনি এতক্ষণ! তাইতো! কী রকম মশার ডাক শুনছে কাকা,–পন পনপিন– কী ডাকবে বাবা! এরাই তোমার সেই ডাকিনী নয়তো?

কে জানে! কাকার বিরক্তির তীক্ষ্মতায় অন্ধকার বিদীর্ণ হয়, কিন্তু ডাকিনী না হলেও যোগিনী যে, তা আমি বিলক্ষণ টের পাই, আমার গায়ের সঙ্গে যোগ হওয়া মাত্রই।

আবার চটাপট শুরু হয়। মনের সুখে গালে মুখে হাতে পায়ে সর্বাঙ্গে চড়াতে থাকেন কাকা।

চপেটাঘাত ছাড়া মশকবধের আর কী উপায় আছে? অতঃপর কেবল এই চড়-চাপড়ই চলতে থাকে! এবং বেশ সশব্দেই। তপস্যা ও মাথায় উঠে যায়।

কিন্তু মশার সঙ্গে মারামারিতে পারবেন কেন কাকা? প্রাণী হিসেবে ওরা খেচর, কাকা নিতান্তই স্থলচর। ওদের হল আকাশ পথে লড়াই আর কাকার ভূমিষ্ট হয়ে। তাছাড়া কাকার একাধারে দুপক্ষকে আক্রমণ–মশাকে এবং কাকাকে। কাজেই, কিছুক্ষণ যুদ্ধ করেই কাবু হয়ে পড়েন কাকাবাবু। রণে ক্ষান্ত তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। এই ঘোরর সগ্রামে, মশাদের মধ্যে নিহতদের আমি দিতে পারব না–তবে আহতদের মধ্যে একজনের নাম আমি বলতে পারি–খোদ আমার খুড়োমশাই।

তার বৈরাগ্য এসে যায় তপস্যায়। এমন অবস্থায় কার বা না আসে? তিনি বলেন–দে আমার কাপড়জামা। গ্যায়ের চাদরটাও দে। সিদ্ধিলাভ মাথায় থাক। কানে আমার কাজ নেই আর, ঘুমিয়ে বাঁচি।

বিছানা, বালিশ, মশারি সবই ফিরিয়ে দিতে হয়। অবিলম্বেই লম্বা হন কাকা! মাটিতে শুয়ে পরনের কাপড়কেই লেপে পরিণত করি, কি আর করব? তারই তলায় গা ঢাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয় আমায়। লেপের প্রলেপে যতটুকু বাঁচোয়া!

অমন ভয়ঙ্কর রাতও প্রভাত হয়। আবার সূর্যের মুখ দেখি আমরা। ইতস্তত তাকাতেই চোখে পড়ে–সেই ঘোড়া! একটু দূরে উবু হয়ে বসে আছে। অদ্ভুত দৃশ্য! ঘোড়াকে এভাবে বসে থাকতে জীবনে কখনো দেখিনি। সারা রাত তপস্যা করছিল নাতো?

কাকা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন–যাক বাঁচিয়েছো। এতখানি পথ আর হেঁটে ফিরতে হবে না। বর হোক, অশ্ববর তো পাওয়া গেল আপাতত!

কিন্তু পরমুহূর্তেই ওঁর উৎসাহ নিভে আসে। গত সন্ধ্যার দুর্ঘটনা স্মরণ করে উনি দমে যান। আমি কাকাকে অভয় দিই–সমস্ত রাত মশার কামড় খেয়ে শায়েস্তা হয়ে এসেছে ব্যাটা। দাঁড়াবার ওর খ্যামতা নেই বসে পড়েছে দেখছ না!

তাই বটে! কাকা ঈষৎ চাঙ্গা হল, তাহলে ঠুকঠুক করে বেশ নিয়ে যেতে পারবে। কি বলিস তুই!

নিশ্চয়। আর আমার তো সাইকেলই আছে–আমি জানাই।

কাছে গিয়ে ওকে উঠতে বলি–ব্যাটার কোনো গ্রাহ্যই নেই। কাকা কান মলে দেন। নিজের নয়, ঘোড়ার: তবুও সে নট নড়ন–চড়ন। গালে ওর আমি থাবড়া মারি, তথাপি নিৰ্দ্ধক্ষেপ! অগত্যা আমি আর কাকা দুজনে মিলে ল্যাজ ধরে ওকে টেনে তুলতে যাই। আমাদের প্রাণন্ত চেষ্টায় অবশেষে ও খাড়া হয়।

সারারাত চুপচাপ ছিল ঘোড়াটা! এত কাছেই ছিল অথচ! এর কারণ কিরে শিবু? কাকা জিজ্ঞাসা করেন, এতো লক্ষণ ভালো নয়।

জপ করছিলো বোধ হয়। আমি ব্যক্ত করি, সমাধি হয়ে গেছে দেখছ না।

তাই হবে। স্থানমাহাত্ম যাবে কোথায়? কাকা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে,-এ তো সিদ্ধিলাভের জায়গা, তবে, হ্যাঁ–যদি না তুলে দেয়–

সিদ্ধিলাভের কথায় কাকার কানের দিকে তাকাই। কানটা যথাস্থানেই নেই। কাকার সিদ্ধিলাভ আর হল না এ-যাত্রা! আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে!

কাকা ঘোড়ার পিঠে চাপেন। ঘোড়ার চলবার উদ্যোগই নেই, সেই পুরনো বদঅভ্যাস। আমাদের ছিপটি মারার সাহস হয় না। কালকের অত ঘোরা-ঘুরির পর–আবার? অনেক করে ওকে বোঝাই। বাপু বাছা বলে ঘাড়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিই ওর।

ও কেবল জবাব দেয়, চিঁ হিঁ হিঁ।

এই ভাবে বহুক্ষণ আমাদের কথোপকথনের পর ও রাজী হয়। হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু এ আবার কি বদখেয়াল? পেছন দিকে হাঁটতে থাকে! হ্যাঁ, সটান পেছনেই।

গতিক দেখে তো প্রায় কেঁদে ফেলেন।–কান তো গেছেই, এবার কি ঘোড়ার পাল্লায় পড়ে প্রাণটাও বেঘোরে যাবে নাকিরে শিবু?

আমিও ভাবিত হইয়া কিন্তু ঘাবড়াতে দিই না কাকাকে। বলি–ভয় খেয়ো না কাকা। বুঝতে পেরেছি কি হয়েছে। আর কিছু না, ঘোড়াটা সিদ্ধিলাভ করেছে। একে স্থানমাহাত্ম, তার ওপরে কাল সারা রাত ঘোরতর তপস্যা–যাবে কোথায়? তার ফলেই ঘোড়ার এই কাণ্ড।

সিদ্ধিলাভ করেছে কি করে বুঝলি? কাকার কণ্ঠ করুণতর হয়।

এ আর বুঝছ না কাকা? যারা সিদ্ধিলাভ করে তারা কি আমাদের মতো হবে? তাহলে সিদ্ধপুরুষে আর আমাদের মতো কাঁচাপুরুষে তফাত কি? আমরা সামনে দিয়ে হাঁটি, সিদ্ধপুরুষ হাঁটবেন পেছনের দিকে। সিদ্ধিলাভ করলে পেছনে হাঁটতেই হবে। সিদ্ধপুরুষদের চালচলনই আলাদা। সিদ্ধঘোড়ারও।

আমার ব্যাখ্যা শুনে কাকার চোখ বড় হয়। তিনি তখন জাঁকিয়ে বসেন বাহনের পিঠে–যাক বাঁচা গেছে, সিদ্ধিলাভের ফাঁড়াটা ঘোড়া দিয়েই গেছে। আমার হলে কি রক্ষা ছিল? এই বাপু নিয়ে এতো বয়সে পেছন হাঁটাতে হলেই তো গেছলাম! অমন সিদ্ধি আমার পোষাত না বাপু!

আমি আন্দাজী রামপুরহাটের দিকে নির্ণয় করে নিয়ে সেই মুখো ঘোড়াটার পেছন ফেরাই। কাকা ঘুরে বসেন। বলেন দে, লেজটা তুলে দে আমার হাতে। ওর ল্যাজকেই লাগাম করব আজ। সিদ্ধপুরুষের আবার ল্যাজ কেন?

ল্যাজহস্তগত করে অনুরোধ করেন কাকা–এবার হাঁটা প্রভু! অনেকটা গানের সুরে মতো করে। ভজন গানের মতন।

আশ্চর্য, বলা মাত্রই ঘোড়াটা চলতে শুরু করে। বেশ ধীর চতুষ্পদক্ষেপে। রাগ হিংসা-ক্ষোভ-দুঃখ চালাকি-চতুরতা, কোন কিছুর বালাই নেই ওর ব্যবহারে। শুধু সিদ্ধ নয়, এ সমস্তই সুসিদ্ধ হওয়ার লক্ষণ।

ঘোড়া চলতে থাকে। পেছন ফিরিয়ে সামনের দিকে, কিংবা মুখ ফিরিয়ে পেছনের দিকে। যেটাই বলো।

আমিও সাইকেল চালিয়ে যাই। ওর পেছন-পেছন কিংবা মুখোমুখি।

 হাতির সঙ্গে হাতাহাতি

সংগ্রহ করার বাতিক কোনো কালেই ছিল না কাকার! কেবল টাকা ছাড়া। কিন্তু, টাকা এমন জিনিস যে যথেষ্ট পরিমাণে সংগৃহীত হলে আপনিই অনেক গ্রহ এসে জোটে এবং তখন থেকেই সংগ্রহ শুরু।

একদিন ওদেরই একজন কাকাকে বললে, দেখুন, সব বড়লোকেরই একটা না একটা কিছু সংগ্রহ করার ঝোঁক থাকে। তা না হলে বড়লোক আর বড়লোকের তফাত কোথায়? টাকায় তো নেই। ওইখানেই তফাত ওখানেই বিশেষ বড়লোকের বৈশিষ্ট্য। আর ধরুন, বৈশিষ্ট্যই যদি না থাকল তবে আর বড়লোক কিসের? আমাদের সম্রাট পঞ্চম জর্জেরও কালেকশনের—হবি ছিল।

কাকা বিস্মিত হয়ে গ্রহের দিকে তাকান–পঞ্চম জর্জেরও?

নিশ্চয়! কেন, তিনি কি বড়লোক ছিলেন না? কেবল সম্রাটই নন, দারুণ বড়লোকও যে! অনেকগুলো জমিদারকেই একসঙ্গে কিনতে পারতেন।

ও! তাই বুঝি জমিদার সংগ্রহ করার বাতিক ছিল তার? কাকা আরও বিস্মিয়ান্বিত।

উঁহুহ। জমিদার নিয়ে তিনি করবেন কি? রাখবেন কোথায়? ও চীজ তো চিড়িয়াখানায় রাখা যায় না। তিনি কেবল স্ট্যামপো কলেক্ট করতেন–

ইস্ট্যাম্পো? ওই যা পোস্টাপিসে পাওয়া যায় না?, দলিলের?

দলিলের নয়। নানা দেশের নানা রাজ্যের ডাকটিকিট, একশো বছর আগের, তারো আগের–তারো পরের–এমনি নানা কালের নানান আকারের, রঙ-বেড়ঙের মত ডাকটিকিট।

বাঃ, বেশত! কাকা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন–আমারও তা করতে ক্ষতি কি?

কিছু না। তবে একটা পুরনো টিকিটের দাম আছে বেশ। দু পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ দশ বিশ হাজার দুলাখ চারলাখ পর্যন্ত!

অ্যাঁ, এমন?–কাকা কিন্তু ভড়কে যান; তা হোক, তবুও করতেই হবে আমার। টাকার ক্ষতি কি একটা ক্ষতি নাকি?

নিশ্চয় নয়! আর তা না হলে বড়ালোক কিসের? এই বলে গ্রহটি উপসংহার করে। এবং, আমার কাকাকেও প্রায় সংহার করে আনে।

কাকা স্ট্যাম্প সংগ্রহ করছেন–এ খবর রটতে বাকী থাকে না। পঞ্চাশখানা য়্যালবাম যখন প্রায় ভরিয়ে এনেছেন তখন একদিন সকালে উঠে দেখেন বাড়ির সামনে পাঁচশো ছেলে দাঁড়িয়ে। কি ব্যাপার? জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় ওরা সবাই এসেছে কাকার কাছে, কেউ স্ট্যাম্প বিক্রি করতে, কেউ বা কিনতে। সবারই হাতে স্ট্যাপের য়্যালবাম।

কাকা তখন গ্রহকে ডাকিয়ে পাঠান, একি কাণ্ড? এরাও সব ইস্টাম্পো সংগ্রহ করছে যে? করছে বলে করছে, অনেকদিন ধরে করছে–আমার ঢের আগের থেকেই–একি কাণ্ড?

কি হয়েছে তাতে? গ্রহটি ভয়ে ভয়ে বলে, কাকার ভাবভঙ্গী তাকে ভীত করে তুলেছে তখন, কেন ওদের কি ও কাজ করতে নেই?

সবাই যা করছে, পাড়ার পুঁচকে ছোঁড়াটা পর্যন্ত–কাকা এবার একেবারে ফেটে পড়েন, তুমি আমাকে লাগিয়েছ সেই কাজে? ছ্যা! কেন, এরাও কি সব বড়লোক নাকি?

বড় বালকও তো নয়। আমি কাকাকে উসকে দিই তার ওপর–নেহাৎ কাছাবাচ্ছা যতো।

কাকা আবার আফসোস করতে থাকেন, ইস্টাম্পে আমার দশ-দশ হাজার টাকা তুমি জলে দিলে হ্যাঁ! ছ্যা!

গ্রহ আর কি জবাব দেবে? সে তখন বিগ্রহে পরিণত হয়েছে। পাথরের প্রতিমূর্তির মতই তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই আর। তিত-বিরক্ত হয়ে কাকা নিজের যত য়্যালবাম খুলে ছিঁড়ে চ্যাঙড়াদের ভেতর পাম্পের লুট লাগিয়ে দ্যান সেই দণ্ডেই।

কিন্তু স্ট্যাম্প ছাড়লেও বাতিক তাঁকে ছাড়ল না! বাতিক জিনিসটা প্রায় বাতের মতই, একবার ধরলে ছাড়ানো দায়! তিনি বললেন–ইস্টাম্পো নয়–এমন জিনিস সংগ্রহ করতে হবে যা কেউ করে না, করতে পারে ও না। সেই রকম কিছু থাকে তো তোমরা আমায় বাতলাও!

তখন নবগ্রহ মিলে মাথা ঘামাতে শুরু করল। তাদের প্রেরণায়, তাদেরই, আরো নব্বই জন উপগ্রহের মাথা ঘামতে লাগল। নতুন হবি বের করতে হবে এবার রীতিমতন বুদ্ধি খাঁটিয়ে।

নানা রকমের প্রস্তাব হয়! খেচরের ভেতর থেকে প্রজাপতি, পাখির পালক জলচরের ভেতর থেকে রঙিন মাছ, কচ্ছপের খোলা ইত্যাদি, ভূচরের ভেতর থেকে পুরানো আসবাবপত্র, সেকেলে ঢাল তলোয়ার, চীনে বাসন, গরুর গলার ঘণ্টা, রঙ-বেরঙের নুড়ি, যত রাজ্যের খেলনা–

কাকা সমস্তই বাতিল করে দ্যান। সবাই পারে সংগ্রহ করতে এসব। কেউ না কেউ করেছেই।

তখন পকেটচরদের উল্লেখ হয়। নানা দেশের একালের সেকালের মোহর, টাকা, পয়সা, সিকি, দুয়ানি ইত্যাদি। ফাউন্টেন পেন, দেশলায়ের বাক্সকেও পকেটচরদের মধ্যে ধরা হয়েছিল।

কিন্তু কাকাকে রাজি করানো যায় না। কেউ না কেউ করছেই, এসব, এতদিন ধরে ফেলে রাখেনি নিশ্চয়।

কেউ কেউ মরীয়া হয়ে বলে–কেরোসিনের ক্যানেস্তারা?

নস্যির ডিবে?

জগঝম্প? কিম্বা গাঁজার কলকে?

অর্থাৎ চরাচরের কিছুই তখন বাকি থাকে না। কাকা তথাপি ঘাড় নাড়েন।

নানা রকমের খাবার-দাবার? চপ, কাটলেট, সন্দেশ, শনপাপড়ি, বিস্কুট, টফি, চকোলেট, লেবেনচুস? মানে, খাদ্য অখাদ্য যত রকমের আর যত রঙের হতে পারে-আমিই বাতলাই তখন। তবুও কাকার উৎসাহ হয় না।

অবশেষে চটেমটে একজনের মুখ থেকে বেফাঁস বেরিয়ে যায়–তবে আর কি করবেন? শ্বেতহস্তীই সংগ্রহ করুন।

কিন্তু পরিহাস বলে একে গ্রহণ করতে পারেন না কাকা। তিনি বারম্বার ঘাড় নাড়তে থাকেন–শ্বেতহস্তী! শ্বেতহস্তী! সেনার পাথর বাটির মতো ও কথাটাও আমার কানে এসেছে বটে। ব্রহ্মদেশে না শ্যামরাজ্যে কোথায় যেন ওর পূজোও হয়ে থাকে শুনেছি। হ্যাঁ, যদি সংগ্রহ করতে হয় তবে ওই জিনিস! বড়লোকের অস্তাবল দূরে থাক, বিলেতের চিড়িয়াখানাতেও এক আধটা আছে কিনা সন্দেহ। হ্যাঁ, ওই শ্বেতহস্তীই চাই আমার!

কাকা সর্বশেষ ঘোষণা করেন, তাঁকে শ্বেতহস্তীই দিতে হবে এনে, শ্যমরাজ্য কি রামরাজ্য থেকেই হোক, হাতিপোতা কি হস্তিনা থেকেই হোক, করাচী কিম্বা রাচি থেকেই হোক, উনি সেসব কিছু জানেন না কিন্তু শ্বেতহস্তী ওঁর চাই। চাই-ই। যেখানে থেকে হোক, যে করেই হোক যোগাড় করে দিতেই হবে, তা যত টাকা লাগে লাগুক। এক আধখানা হলে হবে না, অন্তত ডজন খানেক চাই তার, না হলে কালেকশন আবার কাকে বলে?

এই ঘোষণাপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তিনি ইঞ্জিনীয়ার কন্ট্রাকটার ডাকিয়ে আসন্ন শ্বেতহস্তীদের জন্য বড় করে আস্তাবল বানাবার হুকুম দিয়ে দিলেন।

আশ্চর্য! দু সপ্তাহের ভেতর জনৈক শ্বেতহস্তীও এসে হাজির। নগ্রহের একজন উপগ্রহ কোথা থেকে সংগ্রহ করেন আনে যেন।

কাকা তো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন–বটে বটে? এই শ্বেতহস্তী! এই সেই, বাঃ! দিব্যি ফরসা রঙ তো! বাঃ বাঃ!

অনেকক্ষণ তার মুখ থেকে বাহবা ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। হাতিটাও সাদা গুঁড় নেড়ে তাঁর কথায় সমর্থন জানায়!

আমার দিকে তাকিয়ে বলেন–জানিস, বার্মায়–না না, শ্যামরাজ্যে এরকম একটা হাতি পেলে রাজারা মাথায় করে রাখে। রাজার চেয়ে বেশি খাতির এই হাতির; রীতিমতো পূজো হয়—হুহু! শাখ ঘন্ট বাজিয়ে রাজা নিজের পূজো করেন। যার নাম রাজপূজা। তা জানিস?

এমন সময় হাতিটা একটা ডাক ছাড়ে। যেন কাকার গবেষণায় তার সায় দিতে চায়।

হাতির ডাক? কিরকম সে ডাক? ঘোড়ার চিঁ-হি-হ্ কি গোরুর হাম্বার মতো নয়, ঘোড়ার ডাকের বিশ ডবল, গোরুর অন্তত পঞ্চাশ গুণ একটা হাতির আওয়াজ। বেড়ালের কি শেয়ালের ধ্বনি নয় যে একমুখে তা ব্যক্ত করা যাবে। সহজে প্রকাশ করা যায় না সে-ডাক।

হাতির ডাক ভাষায় বর্ণনা করা দুষ্কর। ডাক শুনেই আমরা দুচার-দশ হাত ছিটকে পড়ি। কাকাও পা গজ পিছিয়ে আসেন।

বাবা! যেন মেঘ ডাকল কড়াক্কড়। কাকা বলেন, সিংহের ডাক কখনো শুনিনি, তবে বাঘ কোথায় লাগে। হ্যাঁ, এমন না হলে একখানা ডাক।

এটাতে হাতির সিংহনাদ হয়ত বলা যায়? না কাকা? আমি বলি।

উপগ্রহটি, যিনি হাতির সমভিব্যাহারে এসেছিলেন, এতক্ষণে একটি কথা বলার সুযোগ পান–প্রায়ই ডাকবে এরকম। শুনতে পাবেন যখন তখন।

প্রায়ই ডাকবে? রাত্রেও? তাহলে তো ঘুমনোর দফা–কাকা যেন একটু দুর্ভাবিতই হন।

উঁহুরাতে ডাকে না। হাতিও ঘুমোয় কিনা। রাত্রে কেবল ওর গুঁড় ডাকে।

তা ডাকে ডাকুক। কিন্তু এর কিরকম রঙ বলত। আবার আমার প্রতি কাকার দৃকপাত-ফর্সা ধবধব করছে। আর সব হাতি কি আর হাতি? এর কাছে তারা সব জানোয়ার। আসল বিলাতী সাহেবের কাছে সাঁওতাল। এই ফর্সা রঙটি বজায় রাখতে হলে সাবান মাখিয়ে একে চান করাতে হবে দুবেলা–ভাল বিলিতি সাবান, হুঁ হুঁ পয়সার জন্য পরোয়া করলে চলবে না। নইলে আমার এমন সোনার হাতি কালো হয়ে যেতে কতক্ষণ?

অমন কাজটিও করবেন না। উপগ্রহটি সবিনয়ে প্রতিবাদ করে।ঐটিই বারণ। স্নানটান একেবারে বন্ধ এর। শ্বেত হস্তীর গায়ে জল ছোঁয়ানই নিষেধ, তাহলেই গলগণ্ড হয়ে, মারা পড়বে!

ঐ গলায় আবার গলগণ্ড? আমি শুধাই। তাহলে তো ভারী গণ্ডগোল!

অ্যাঁ, বলে কি? কাকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে, তাহলে?

সাধারণ হাতির মতো নয়তো যে রাত দিন পুকুরের জলে পড়ে থাকবে। শ্যামরাজ্যে রীতিমত মন্দিরে সোনার সিংহাসনের ওপরে বসানো থাকে। সেখানে হরদম ধূপধুনো পূজা আরতি চলে। কেবল চামৃত তৈরির সময়েই যা এক আধ ফোঁটা জল ওর পায়ে ঠেকানো হয়। এখানে তো সেরকমটি হবে না।

কাকা তার কথা শেষ করতে দ্যান না–এখানে হবে কি করে? রাতারাতি মন্দিরই বা বানাচ্ছে কে, সোনার সিংহাসনই বা পাচ্ছি কোথায়? তবে পূজারী যোগাড় করা হয়তো কঠিন হবে না, পুরুৎ বামুনের তো আর অভাব নেই পাড়ায়, কিন্তু হাতি পূজোর মন্তর কি তারা জানে?

কাকার প্রশ্নটা আমার প্রতিই হয়। আমি জবাব দিই–হাতির চন্নামেত্য আমি কিন্তু খেতে পারবো না কাকা!

গোড়াতেই বলে কয়ে রাখা ভালো। সেফটি ফার্সট! বলেই দিয়েছে কথায়।

পারবি না? কেন খেতে পারবি না? এ কি তোর গুজরাটি হাতি? কালো আর ভুত? এ হোলো গিয়ে ঐরাবতের বংশধর, স্বর্গের দেবতাদের একজন। খেতেই হবে তোকে–তা না হলে পরীক্ষায় তুই পাশ করতেই পারবিনে।

পরীক্ষার পাশের ব্যাপারে, মেড-ইজির কাজ করবে ভেবে আমি একটু নরম হই। কম্প্রমাইজের প্রস্তাব পাড়তে যাচ্ছি, এমন সময়ে উপগ্রহটি বলে ওঠে–না না, পূজা করবার আবশ্যক নেই। হস্তী পূজোর ব্যবস্থা তো নেই এদেশে। নিত্যকর্ম পদ্ধতিতেও তার বিধি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পূজো করার দরকার নেই এমনি আস্তাবলে ওকে বেঁধে রাখলেই হবে। গায়ে জলের ছোঁড়াচটিও না লাগে, সহিস কেবল এই দিকে কড়া নজর রাখে যেন।

সহিস? হাতির আবার সহিস কি? মাহুতের কথা বলছ বুঝি? কাকা জিজ্ঞেস করেন।

সহিস মানে, যে ওর সেবা করবে, সইবে ওকে। সহিস কাঁধে বসলেই মাহুত হয়ে যায়। কিন্তু ওর কাঁধে বসা যাবে না তো। ভয়ানক অপরাধ তাতে। উপগ্রহটি ব্যাখ্যা করে দ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাতির উদ্দেশ্যেই হাত তুলে নমস্কার জানায় কিম্বা মাথা চুলকায় কে জানে!

ওর স্নানের ব্যবস্থা তো হোলো, স্নানটান নাস্তি। আচ্ছা, এবার ওর আহারের ব্যবস্থা শুনি– কাকা উগ্রীব হন, সাধারণ হাতি তো নয় সে সাধারণ খাবার খাবে?–তারপর কি যেন একটু ভাবেন খায় টায় তো? না তাও বন্ধ?

তাঁর অদ্ভুত প্রশ্নে আমরা সবাই অবাক হই। বলে ফেলি, খাবে না কি বলছেন? না খেলে অত বড় দেহ টেকে কখনো তাহলে? হাতির খোরাক বলে থাকে কথায়।

আমি ভাবছিলাম, চানটানের পাট যখন নেই তখন খাওয়া টাওয়ার হাঙ্গামা আছে কিনা কে জানে। কাকা ব্যক্ত করেন, তা কি খায় ও বলতো?

উপগ্রহটি বলে, সব কিছুই খায়, সে বিষয়ে ওর রুচি খুব উদার। মানুষ পেলে মানুষ খাবে, মহাভারত পেলে মহাভারত। মানে, মানুষ আর মহাভারতের মাঝামাঝি ভুভারতে যা কিছু আছে সবই খেতে পারে।

আমি টিপ্পনী কাটি, তা হলে হজম শক্তিও বেশ ওর।

ভালো, খুবই ভালো। কাকা সন্তোষ প্রকাশ করেন, যদি মানুষ পায়, কতগুলো খাবে? টাটকা মানুষ অবশ্যি।

যতগুলো ওর কাছাকাছি আসবে টাটকা-বাসি নিয়ে বড় বিশেষ মাথা ঘামাবে না। বলেছি তো খুব উদার রুচি।

তুই ওর কাছে যাসনে যেন, খবরদার! কাকা আমাকে সাবধান করেন, তবে তোকে ও মানুষের মধ্যে ধরবে কিনা কে জানে!

হ্যাঁ, তা ধরবে কেন? আমি মনে মনে রাগি তা যদি ও ধরতে পারে, তাহলে ওকেই বা কে মানুষের মধ্যে ধরতে যাচ্ছে? ওর রুচি যেমনই হোক, ওর বুদ্ধিশুদ্ধির প্রশংসা তো আমি করতে পারব না। কাকার মধ্যেই বরং ওকে গণ্য করব আজ থেকে।

তবে একেবারেই নিশ্চিন্ত হতে চান কাকা, খাদ্য হিসাবে কি ধরনের মানুষের ওপর ওর বেশি ঝোঁক?

একবার কটাক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে নেন আমার জন্যেই ওঁর যত ভাবনা যেন।

চেনা লোকেরই পক্ষপাতী, চেনাদেরই পছন্দ করবে বেশি। তবে অচেনার ওপরেও বিশেষ আক্রোশ নেই। পেলে তাদেরো ধরে খাবে।

ভালো ভালো। আর কতগুলো মহাভারত? প্রত্যেক ক্ষেপে?

পুরো একটা সংস্করণই সাবড়ে দেবে।

বলছ কি? অষ্টাদশ পর্ব ইয়া ইয়া মোটা এক হাজার কপি–?

অনায়াসে! উপগ্রহটি জোরের সঙ্গে বলে, অনায়াসে!

সচিত্র মহাভারত? কাকা বাক্যটাকে শেষ করে আনেন।

ছবিটবির মর্ম বোঝে না! আমি যোগ করি।

সেই রকম বলেই বোধ হচ্ছে কাকা মন্তব্য করেন–আরে, সবাই কি আর চিত্রকলার সমঝদার হতে পারে?

উপগ্রহের প্রতি প্রশ্ন হয়, সে কথা থাক! মানুষ আর মহাভারত ছাড়া আর কি খাবে? খুঁটিনাটি সব জেনে রাখা ভালো।

ইট পাটকেল পেতে মহাভারত ছেবেও না; শালদোশালা পেলে ইঁট পাটকেলের দিকে তাকাবে, শালদোশালা ছেড়ে বেতালকেই বেশি পছন্দ করবে, কিন্তু রসগোল্লা যদি পায় তা বেতালকেও ছেড়ে দেবে, রসগোল্লা ফেলে কলাগাছ খেতে চাইবে, মানে, এক আলিগড়ের মাখন ছাড়া সব কিছুই খাবে।

কেন, মাখন নয় কেন? মাখন তো সুখাদ্য।

মাখনকে যুতমতো ঠিক পাকড়াতে পারবে না কিনা। শুড়েই লেপটে থাকবে ওকে কায়দায় আনা কঠিন হবে ওর পক্ষে।

ও! কাকা এইবার বুঝতে পারেন।

হ্যাঁ, যা বলেছেন। মাখন বাগানো সহজ নয় বটে! আমি বলি, এক পাউরুটি ছাড়া আর কেউ তা বাগাতে পারে না।

যাক খাদ্য তো খেলো, এখন পানীয়? কাকা জিজ্ঞাসু হন।

তরল পদার্থ যা কিছু আছে। দুধ, জল, ঘোলের সরবৎ, ক্যাস্টর অয়েল, মেথিলেটেড স্পিরিট–কত আর বলব? কার্বলিক এ্যাসিডেও কিচ্ছু হবে না ওর, তারও দু-দশ বোতল দু-এক চুমুকে নিঃশেষ করতে পারে। কেবল এক চা খায় না।

ওটা গুড হ্যাবিট। ভালো ছেলের লক্ষণ। কাকা ঈষৎ খুশি হন সিগারেট টানতেও শেখেনি নিশ্চয়। সবই তো জানা হোলো, কিন্তু কি পরিমাণ খায় তা তো কই বললে না হে।

যত যুগিয়ে উঠতে পারবেন। এক আধ মণ, এক আধ নিঃশ্বাসে উড়িয়ে দেবে।

তাতে আর কি হয়েছে। কেবল এক মানুষটাই পেয়ে উঠবে না বাপু, ইংরেজ রাজত্ব কিনা। হাতিকে কিম্বা আমাকেই–কাকে ধরে ফাঁসিতে লটকে দ্যায় কে জানে! তবে আজই বাজারে যত মহাভারত আছে সব বইয়ের দোকানে অর্ডার দিচ্ছি। ময়রাদের বলে দিচ্ছি রসগোল্লার ভিয়েন বসিয়ে দিতে। আমার কলা বাগানটাও ওরই নামে উইল করে দিলাম। পুত্র-পৌত্রাদিক্রমে ভোগ দখল করুক। আর ইঁট পাটিকেল? ইঁট পাটকেলের অভাব কি? আস্তাবল বানিযে যা বেঁচেছে আস্তাবলের পাশেই পাহাড় হয়ে আছে। যত ওর পেটে ধরে ইচ্ছামত বেছে খাক, কোনো আপত্তি নেই আমার।

অতঃপর মহাসমারোহে হস্তীপ্রভুকে আস্তাবলে নিয়ে যাওয়া হল। আমরা সবাই শোভাযাত্রা করে পেছনে যাই। শেকল দিয়ে ওর চার পা বেঁধে আটকানো হয় শক্ত খুঁটির সঙ্গে। শুঁড়টাকেও বাঁধা হবে কিনা আমি জিজ্ঞাসা করি। শুঁড় ছাড়া থাকবে জানতে পারা যায়। শুঁড় দিয়ে ওরা খায় কিনা, কেবল তরল ও স্থূল খাদ্যেই নয় হাওয়া খেতে হলেও ওই শুড়ের দরকার।

হাতির দাম শুনে তো আমার চক্ষু স্থির। পঞ্চাশ হাজারের এক পয়সা কম নয়; সে লোকটা বেচেছে সে থাকে দুশো ক্রোশ দুরে তার এক আত্মীয় শ্যামরাজ্যের জঙ্গল বিভাগে কাজ করে। সেখান থেকে ধরে ধরে চালান পাঠায়। উপগ্রহটি অনেক কষ্টে বহুৎ জপিয়ে আরো কেনার লোভ দেখিয়ে এটি তার কাছ থেকে এত কমে আদায় করতে পেরেছেন। নইলে পুরো লাখ টাকাই এর দাম লাগতো। এই হস্তীরত্বের আসলে যথার্থ দামই হয় না, অমূল্য পদার্থ বলতে গেলে।

হাতিকে এতদূর হাঁটিয়ে আনতে, তার সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে আসতেও ভদ্রলোকের কম কষ্ট হয়নি। কিন্তু কাকার হুকুম-কেবল সেই জন্যই নইলে কে আর প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে এহেন বিশ্বগ্রাসী মারাত্মক শ্বেতহস্তীর সঙ্গে।

তা ত বটেই–কাকা অম্লান বদনে তখুনি তাকে একটা পঞ্চাশ হাজারের চেক কেটে দ্যান।

আরো আছে এমন, আরো আনা যায়–উপগ্রহটি জানান, এ রকম শ্বেতহস্তী যত চান, দশ বিশ পঞ্চাশ–ওই এক দর কিন্তু।

আরো আছে এমন? কাকা এক মুহূর্তে একটু ভাবেন, বেশ, তুমি আবার ব্যবস্থা কর। তাতে আর কি হয়েছে, পঁচিশ লাখ টাকার শ্বেতহস্তীই কিনব না হয় হয়েছে কি।

বড় মানুষের বড় খেয়াল! সেই পুরাতন গ্রহটি এতক্ষণে বাঙনিষ্পত্তি করে, তা না হলে আর বড়লোক কিসের!

দু দিন যায়, পাঁচদিন যায়। হাতিটাও বেশ সুখেই আছে। আমরা দু বেলা দর্শন করি। কাকা ও আমি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কাকিমা বিশেষ ভক্তিভরে। কাকিমা অনেক কিছু মানতও করেছেন, হাতির কাছে ঘটা করে পুজো এবং জোড়া বেড়াল দেবেন বলেছেন। কাকিমার এখনো ছেলেপুলে হয়নি কিনা।

কলাগাছ খেতেই ওর উৎসাহ বেশি যেন। ইঁট পাটকেল পড়েই রয়েছে স্পর্শও করেনি। দু একটা বেড়ালও এদিক ওদিকে দিয়ে গেছে, হাতিকে তারা ভালো করেই লক্ষ করেছে, ও কিন্তু তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি! গাদা মহাভারত কোণে পুজি করা–তার থেকে একখানা নিয়ে ওকে আমি দিতে গেছলাম একদিন। পাওয়ামাত্র উপদরস্থ করবে আশা করেছি আমি। কিন্তু মুখে পোরা দুরে থাক, বইখানা শুড়িতলগত করেই না এমন সজোরে আমার দিকে ছুঁড়েছিল যে আর একটু হলেই আমার দফা রফা হোতো। কাকা বললেন, বুঝতে পারলি না বোকা? তোকে পড়তে বলেছে! ধর্মপুস্তক কিনা! মুখ্য হয়ে রইলি, ধর্মশিক্ষা তো হোলো না তোর!

ধর্মশিক্ষা মাথায় থাক। কাকার পুণ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে গেছি সেই রক্ষে! না, এর পর থেকে এই ধর্মাত্মা হাতির কাছ থেকে সন্তর্পণে সুদূরে থাকতে হবে; সাত হাত দূরে থেকে বাতচিৎ।

এইভাবে হপ্তাতিনেক কাটার পর হঠাৎ একদিন বৃষ্টি নামল। মুড়ি পাপরভাজা দিয়ে অকাল বর্ষণটা উপভোগ করছি আমরা। এমন সময়ে মাহুত ওরফে সহিস এসে খবর দিল, বাদলার সঙ্গে সঙ্গে হাতিটার ভয়ানক ছটফটানি আর হাঁকডাক শুরু হয়েছে। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটলাম আমরা সবাই।

কি ব্যাপার? সত্যিই ভারী ছটফট করছে তো হাতিটা। মনে হয় যেন লাফাতে চাইছে চার পায়ে।

কাকা মাথা ঘামালেন খানিকক্ষণ। বুঝতে পারা গেছে। মেঘ ডাকছে কিনা। মেঘ ডাকলে ময়ূর নাচে। হাতিও নাচতে চাইবে আর আশ্চর্য কি? ময়ূর আর হাতি বোধহয় একজাতীয়? কার্তিক ঠাকুরের পাছার তলায় ময়ূর আর গণেশ ঠাকুরের মাথায় ওই হাতি, আত্মীয়তা থাকাই স্বাভাবিক। যাই হোক, ওর তিন পায়ের শেকল খুলে দাও, কেবল এক পায়ের থাক, নাচুক একটুখানি!

তিন পায়ের শেকল খুলে দিতেই ও যা শুরু করল, হাতির ভাষায় তাকে নাচই বলা যায় হয়তো। কিন্তু সেই নাচের উপক্রমেই, আরেক শেকল ভাঙতে দেরি হয় না। মুক্তি পাবামাত্র হাতিটা ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়ে, সহিস বাধা দেবার সামান্য প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক শুড়ের ঝাঁপটায় তাকে ভূমিসাৎ করে দিয়ে চলে যায়।

তারপর দারুণ আর্তনাদ করতে মুক্তকচ্ছ ড় তুলে ছুটতে থাকে সদর রাস্তায়। আমরাও দস্তুরমত ব্যবধান রেখে, পেছনে পেছনে ছুটি। কিন্তু হাতির সঙ্গে ঘোড়াদৌড়ে পারব কেন? আমাদের মানুষদের দুটি করে পা মাত্র সম্বল। হাতির তুলনায় তাও খুব সরু সরু। দেখতে দেখতে হাতিকে আর দেখা যায় না। কেবল তার ডাক শোনা যায়। অতি দূর দুরান্ত থেকে।

তিনঘণ্টা পরে খবর আসে, মাইল পাঁচেক দূরে এক পুকুরে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আত্মহত্যা করবে না তো হাতিটা? শ্বেতহস্তীর কাণ্ড, কিছুই বোঝা যায় না। কাকিমা কাঁদতে শুরু করেন, পূজো আচ্চা করা হয়নি ঠিকমতন, হস্তীদেব তাই হয়ত এমন ক্ষেপে গেছেন, এখন কি সর্বনাশ হয় কে জানে? বংশলোপই হবে গিয়ে হয়তো।

বংশ বলতে তো সর্বসাকুল্যে আমি, যদিও পরস্মৈপদী। কাকিমার কান্নায় আমারই ভয় করতে থাকে।

কাকা এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে ছোটেন শ্বেতহস্তীকে প্রসন্ন করতে, আমরা সকলেই চলি কাকার সঙ্গে। কিন্তু হাতির যেরকম নাচ আমি দেখেছি তাতে সহজে ওকে হাতানো যাবে বলে আমার ভরসা হয় না।

পথের ধারে মাঝে মাঝে ভাঙা আটচালা চোখে পড়ে, সেগুলো ঝড়ে উড়েছে কি হাতিতে উড়িয়েছে বোঝা যায় না সঠিক। আশেআশে জনপ্রাণীও নেই যে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। যতদুর সম্ভব হস্তীরেরই কীর্তি সব! শ্বেত শুণ্ডের আবির্ভাব দেখেই বসিন্দারা মলুক ছেড়ে সটকেছে এই রকমই সন্দেহ হয় আমাদের।

কিছুদূর গিয়ে হস্তীলীলার আরো ইতিহাস জানা যায়। একদল গঙ্গাযাত্রী একটি আধমড়াকে নিয়ে যাচ্ছিল গঙ্গাযাত্রায়, এমন সময়ে মহাপ্রভু এসে পড়েন। অমন ঘটা করে ঢাল ঢোল পিটিয়ে রাস্তা জুড়ে যাওয়াটা ওঁর মনঃপুত হয় না। উনি ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। শোনা গেল, এক একজনকে অনেক দূর অবধি তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। কেবল বাদ দিয়েছেন, কেন জানা যায়নি, সেই গঙ্গাযাত্রীকে। সেই বেচারা অনেকক্ষণ অবহেলায় পড়ে থেকে অগত্যা উঠে বসে দেহররক্ষা কাজটা এ যাত্রা স্থগিত রেখে একলা হেঁটে বাড়ি ফিরে গেছে।

অবশেষে সেই পুকুরের ধারে এসে পড়া গেল। কাকা বহু সাধ্য-সাধনা, অনেক স্তব স্তুতি করেন। হাতিটা গঁড় খাড়া করে শোনে সব, কিন্তু নড়ে চড়ে না। রসগোল্লার হাঁড়ি ওকে দেখানো হয়, ঘাড় বাঁকিয়ে দ্যাখে, কিন্তু বিশেষ উৎসাহ দয়াখায় না।

পুকুরটা তেমন বড় নয়। কাকা একেবারে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ান–কাছাকাছি গিয়ে কথা কইলে ফল হয় যদি। কিছু ফল হয়, কেন না হাতিটা কাকা বরাবর তার শুঁড় বাড়িয়ে দ্যায়।

আমি বলি পালিয়ে এসো কাকা। ধরে ফেলবে।

দূর। আমি কি ভয় খাবার ছেলে? তোর মতন অত ভীতু নই আমি। কাকার সাহস দেখা যায়, কেন, ভয় কিসের? তোমাকে কিছু বলব না আমি ওর মনিব-মনিব-উঁ-হুঁ-হুঁ-শ্রীবিষ্ণু! সেবক–

বলতে বলতে কাকা ভিজ কাটলেন। কান মললেন নিজের!–উঁহু, মনিব হব কেন, অপরাধ নিয়ো না প্রভু শেতহস্তী! আমি তোমার ভক্ত-শ্রীচরণের দাসানুদাস। কি বলতে চাও বলল, আমি কান বাড়িয়ে দিচ্ছি । তোমার ভক্তকে তুমি কিছু বলবে না, আমি জানি। হাতির মতো কৃতজ্ঞ জীব দুই নেই, আর তুমি তো সামান্য হাতি নও, তুমি হচ্ছ একজন হস্তী-সম্রাট।

কাকা কান বাড়িয়ে দ্যান, হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দ্যায়–আমরা রুদ্ধশ্বাসে উভয়ের উৎকর্ণ আলাপের অপেক্ষা করি।

হাতিটা কাকার সর্বাঙ্গে তার শুঁড় বোলায়, কিন্তু সত্যিই কিছু বলে না। কাকার সাহস আরো বেড়ে যায়, কাকা আরো এগিয়ে যান। আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ করেন, দেখছিস, কেমন আদর করছে আমায়, দেখছিস?

কিন্তু হাতিটা অকস্মাৎ শুঁড় দিয়ে কাকার কান পাকড়ে ধরে। কানে হস্তক্ষেপ করায় কাকা বিচলিত হন। কেন বাবা হাতি! কি অপরাধ করেছি বাবা তোমার শ্রীচরণে যে এমন করে তুমি আমার কান মলছ?

কিন্তু হস্তীরাজ কর্ণপাত করে না। কাকার অবস্থা ক্রমশই করুণ হয়ে আসে। তিনি আমার উদ্দেশ্যে (চেষ্টা করেও আমার দিকে তখন তিনি তাকাতে পারে না।) বলেন–বাবা শিবু কান গেল, বোধ হয় প্রাণও গেল। তোর কাকিমাকে বলিস–বলিস যে সজ্ঞানে আমার হস্তীপ্রাপ্তি ঘটে গেছে!

আমরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি, কাকাকে গিয়ে ধরি! জলের মধ্যে একা হাতি স্থলের মধ্যে আমরা সবাই। হাতির চেষ্টা থাকে কাকার কান পাকড়ে জলে নামাতে, আর হাতির চেষ্টা যাতে ব্যর্থ হয় সেই দিকেই আমাদের প্রচেষ্টা। মিলনান্ত কানাকানি শেষে বিয়োগান্ত টানটানিতে পরিণত হয়, কান নিয়ে এবং প্রাণ নিয়ে টানাটানিতে।

কিছুক্ষণ এই টাগ অফ ওয়ার চলে। অবশেষে হাতি পরাজয় স্বীকার করে তবে কাকার কান শিকার করে তারপরে। আর হাতির হাতে কান সমর্পণ করে কাকা ও যাত্রা প্রাণরক্ষা করেন।

কাকার কানটি হাতি মুখের মধ্যে পুরে দেয়। কিন্তু খেতে বোধহয় তার তত ভালো লাগে না। সেইজন্যই সে এবার রসগোল্লার হাঁড়ির দিকে শুঁড় বাড়ায়।

যন্ত্রণা চিৎকার করতে করতে কাকা বলতে থাকেন দিসনে খবরদার, দিসনে ওকে রসগোল্লা। হাতি না আমার চোদ্দ পুরুষ। পাজী ড্যাম শুয়ার রাসকেল গাধা, ইস্টুপিট! উঃ, কিছু রাখেনি কানটার গো, সমস্তটাই উপড়ে নিয়েছে। উল্লুক, বেয়াদব আহাম্মোক!

কাকার কথা হাতিটা যেন বুঝতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে জল থেকে উঠে আসে। ও হরি, একি দৃশ্য! গলার নীচের থেকে যে অব্দি জলে ডোবানো ছিল, হাতির সেই সর্বাঙ্গ একেবারে কুচ কুচে কালো যেমন হাতিদের হয়ে থাকে। কেবল গলার উপর থেকে সাদা। অ্যাঁ, এ আবার কী বাবা?

তাকিয়ে দেখি, পুকুরের কালোজল হাতির রঙে সাদা হয়ে গেছে। শ্বেতহস্তীর আবার একি লীলা?

কর্ণহারা হয়ে সে শোকও কাকা কোনো মতে এ পর্যন্ত সামলে ছিলেন, কিন্তু হাতির এই চেহারা আর তার সহ্য হয় না। এত সাধের তার সাদা হাতি–!

মূর্ছিত কাকাকে ধরাধরি করে আমরা বাড়ি নিয়ে যাই। হাতির দিকে কেউ ফিরেও তাকাই না। একটা বিশ্রী কালো ভূতের মত চেহারা কদাকার কুৎসিৎ বুড়ো হাতি। উনি যে কোন কালো সোনার সিংহাসনে বসে রাজপূজা লাভ করেছেন একথা ঘুণাক্ষরেও কখনো মনে করা কঠিন।

পরদিন একজন লোক জরুরি খবর নিয়ে আসে–অনুসন্ধনী উপগ্রহের প্রেরিত অগ্রদূত। উপগ্রহটি আরো পঞ্চাশটি শ্বেতহস্তী সংগ্রহ করে কাল সকালেই এসে পৌচচ্ছেন এই খবর। কাকার আদেশে প্রাণ তুচ্ছ করে, বহু কষ্ট স্বীকার করে দুশো ক্রোশ দূর থেকে চারপেয়ে হাতিদের সঙ্গে দুপায়ে হেঁটে তিনি–ইত্যাদি ইত্যাদি!

কিন্তু কে তুলবে এই খবর কাকার কানে?

মানে, কাকার অপর কানে?

Exit mobile version