না থাক, আমার মনের বিস্ময় দমন করে আমি জিজ্ঞেস করি; ভালুক কি আপনার কানে কানে কিছু বলেছিলো।
না। ভালুক আবার কি বলবে? তিনি অবাক হন।
ওরা বলে কিনা, ওই ভালুকরা। আমি বলিঃ কানাকানি করা ওদের বদভ্যাস। পড়েননি কথামালায়?
মশাই এ আপনার কথামালার ভালুক নয়। আপনার ঈশপ কিংবা গাঁজার শপ পাননি। তাঁর মুখে-চোখে বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। আস্ত ভালুক একেবারে জলজ্যান্ত।
ভালুক শিকারীর পর শুরু। এক কর্মবীর। তাঁর কচ্ছপ ধরার কাহিনী করলেন তাঁরটাও জলজ্যান্ত। জল থেকেই তিনি তুলেছিলেন কচ্ছপটাকে।
কচ্ছপটা জলের তলায় ঘুমোচ্ছিল অঘোরে। হেদো-গোলদীঘির কোথাও হবে। আর উনি ড্রাইভ খাচ্ছিলেন–যেমন খায় লোকে। খেতে খেতে একবার হলো কি ওঁর মাথাটা গিয়ে কচ্ছপের পিঠে ঠক করে ঠুকে গেল। সেই ঠোক্কর না খেয়ে তিনি রেগেমেগে কচ্ছপটাকে টেনে তুললেন জলের থেকে।
ইয়া প্রকাণ্ড এক বিশমণী কাছিম। বিশ্বাস করুন। তিনি বললেন। একটুও গাঁজা নয়, নির্জলা সত্যি। জলের তলা থেকে আমার নিজের হাতে টেনে তোলা।
অবিশ্বাস করবার কি আছে? আমি বলি? তবে নির্জলা সত্যি–এমন কথা বলবেন না।
কেন বলব না কেন? তিনি ফোঁস করে উঠলেন।–কেন শুনি?
আজ্ঞে, নির্জলা কি করে হয়? জল তো লেগেই ছিলো কচ্ছপটার গায়ে। আমি সবিনয়ে জানাই।–গা কিংবা খোল–যাই বলুন, সেই কচ্ছপের। আমি আরো খোলসা করি।
তারপর আরম্ভ করলেন এক মৎস্য অবতার–তার মাছ ধারার গল্প। মাছ ধরাটা শিকারের পর্যায়ে পড়ে না তা সত্যি, কিন্তু আমাদের আড্ডাটা পাঁচ জনের। আর, তিনিও তার একজন। তিনিই বা কেন বাদ যাবেন। কিন্তু মাছ বলে তার কাহিনী কিছু ছোটখাট নয়। একসা পেল্লায় সব মাছ তিনি ধরেছে, সামান্য ছিপে আর নাম মাত্র পুকুরে–যা নাকি ধর্তব্যের বাইরে। তার কাছে তিমি মাছ কোথায় লাগে।
তুমি যে-তিমিরে তুমি সে-তিমিরি। আমি বলি। আপন মনেই বলি–আপনাকেই।
মাছরা: যতই তার চার খেতে লাগল তার শোনাবার চাড় বাড়লে লাগল ততই তার কি, তিনি তো মাঝ ধরতে লাগলেন, আর ধরে খেতে লাগলেন আকচার। কেবল তার মাছের কাঁটাগুলো আমাদের গলায় খচখচ করতে লাগলো।
তার ফিস ফিসিনি ফিনিশ হলে, আমরা বাঁচলাম।
কিন্তু হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই শুরু হলো এক গণ্ডার বাজের। মারি তো গণ্ডার কথায় বলে থাকে। তিনি এক গণ্ডার দিয়ে শুরু গণ্ডারটাকেই নয়, আমাদেরও মারলেন। তাকে বাদ দিয়ে আমরাও এক গণ্ডার কম ছিলাম না।
এক গণ্ডারের টেক্কায়–একটি ফুঙ্কালে আমাদের চার জনকেই যেন তিনি উড়িয়ে দিলেন। চার জনার পর আমার শিকারের পালা–এলো।
নাচার হয়ে আরম্ভ করতে হলো আমায়।
হ্যাঁ, শিকারের দুর্ঘটনা জীবনেও যে না ঘটছে তা নয়, আমাকেও একবার বাধ্য হয়ে.. আমার শিকারোক্তি শুরু করি।
মাছ, না মাছি? মৎস্য-কুশলী প্রশ্ন করেন।
আমি অস্বীকার করি মাছ? না, মাছ না। মাছিও নয়। মশা, মাছি, ছারপোকা কেউ কখনো ধরতে পারে? ওরা নিজগুণে ধরা না দিলে?
তবে কি? কোন আর্সোলা-টার্সেলাই হবে বোধ হয়?
আরশোলা? বাবা, আরশোলার কেই তার কাছে ঘ্যাঁষে? বলতেই আমি ভয়ে কাঁপি।-–না আরশোলার ত্রিসীমানায় আমি নেই, মশাই। তারা ফরফর করলেই আমি সফরে বেরিয়ে পড়ি। দিল্লী কি আগ্রা অদুরে যাই নে, যেতেও পারি নে, তবে হ্যাঁ, বালিগঞ্জ কি বেহালায় চলে যাই। তাদের বাড়াবাড়ি থামলে, ঠাণ্ডা হলে, বাড়ি ফিরি তারপর।
তা হলে আপনি কি শিকার করেছিলেন, শুনি? হাসতে থাকে সবাই।
এমন কিছু না, একটা বাঘ। আমি জানাই : তাও সত্যি বলতে আমি তাকে বাগাতে যাই নি, চাইও নি। বাঘটাই আমাকে মানে বাধ্য হয়েই আমাকে, মানে কিনা, আমার দিকে একটুও ব্যগ্রতা না থাকলেও শুধু কেবল ও তরফরে ব্যম্রতার জন্যেই আমাকে ওর খপ্পরে পড়তে হয়েছিলো। এমন অবস্থায় পড়তে হলো আমায়, সে তখন আর তাকে স্বীকার না করে উপায় নেই….
আরম্ভ করি আমার বাঘাড়ম্বর।
…তখন আমি এক খবর-কাগজের আপিসে কাজ করতাম। নিজস্ব সংবাদদাতার কাজ। কাজ এমন কিছু শক্ত ছিল না। সংবাদের বেশীর ভাগই গাঁজায় দম দিয়ে মনশ্চক্ষে দেখে লেখা এই যেমন, অমুক শহরে মাছবৃষ্টি হয়েছে, অমুক গ্রামে এক ক্ষুরওয়ালা চার পেয়ে মানুষে জন্মেছে (স্বাভবতঃই নাহিত নয়, কোন গহিন পাহাড়ে এক অতিকায় মানুষ গেল, মনে হয় মহাভারতের আমলের কেউ হবে, হিড়িম্বা–ঘটোৎকচ-বংশীয়। কিংবা একটা পাঠার পাঁচটা ঠ্যাং বেরিয়েছে অথবা গোরুর পেটে মানুষের বাচ্চা-মানুষের মধ্যে সে-সব গোরু দেখা যায় তার প্রতিশোধ স্পৃহাতেই হয়ত বা দেখা দিয়েছে কোথাও! এই ধরনের যত মুখরোচক খবর। ‘আমাদের স্টাফ রিপোর্টারেরা প্রদত্ত সংবাদ’ বাংলা কাগজে যা সব বেরোয় সেই ধারর আর কি! আজগুবি খবরের অবাক জলপান!…
আসল কথায় আসুন না! তাড়া লাগালো ভালুক-মার।
আসছি তো। সেই সময়ে গৌহাটির এক পত্রদাতা বাঘের উৎপাতের কথা লিখেছিলেন সম্পদককে। তাই না পড়ে তিনি আমায় ডাকলেন, বললেন, যাও তো হে, গৌহাটি গিয়ে বাঘের বিষয়ে পুঙ্খলনুপুঙ্খ সব জেনে এসো তো। নতুন কিছু খবর দিতে পারলে এখন কাগজের কাটতি হবে খুব।
গেলাম আমি–কাগজ পেনসিল আর প্রাণ হাতে করে। চাকরি করি, না গিয়ে উপায় কি?
সেখানে গিয়ে বাঘের কীর্তিকলাপ যা কানে এলো তা অদ্ভুত; বাঘটার জ্বালায় কেউ নাকি গোরু-বাছুর নিয়ে ঘর করতে পারছে না। শহরতলীতেই তার হামলা বেশি, তবে ঝামেলা কোথাও কম নয়। মাঝে মাঝে গ্রাম এলাকাতেও সে টহল দিতে আসে। হাওয়া খেতেই আসে বলাই বাহুল্য। কিন্তু হাওয়া ছাড়া অন্যান্য খাবারেও তার তেমন অরুচি নেই দেখা যায়। এবার এসে এক মনোহারি দোকানের সব কিছু সে ফাঁক করে গেছে। সাবান, পাউডার, স্নো, ক্রীম, লুডো খেলার সরঞ্জাম–কিছু বাকি রাখে নি। এমন কি, তার শখের হারমোনিয়ামটাও নিয়ে গেছে।