আমি আর আমার হাতি, কেবল এই দুটি প্রাণী পেছনে পড়ে রইলাম। আর পেছন থেকে তেড়ে আসছে পাগলা হাতির পাল। তেপায়া হাতির পিঠে নিরুপায় এক হস্তিমুখ।
কিন্তু ভাববার সময় ছিল না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাজ পড়ার মতো আওয়াজ চার ধার থেকে আমাদের ছেয়ে ফেলল। গাছপালার মড়মড়ানির সঙ্গে চোখ ধাঁধানো ধুলোর ঝড়। তার ঝাঁপটায় আমাদের দম আটকে গেল একেবারে।
মহারাজ!র উপদেশ মতো আমি এক চুল নড়িনি, হাতির পিঠে লেপটে সেটে রইলাম। হাতির পাল যেমন প্রলয় নাচন নাচতে নাচতে এসেছিল তেমনি হাঁক-ডাক ছাড়তে ছাড়তে নিজের ধান্দায় চলে গেল।
তারা উধাও হলে আমি হাতির পিঠ থেকে নামলাম। নামলাম না বলে খসে পড়লাম। বলাই ঠিক। হাতে পায়ে যা খিল ধরেছিল। নীচে নেমে একটু হাত-পা খেলিয়ে নিচ্ছি, ও-মা, আমার কয়েক গজ দূরে এক কি দৃশ্য! লম্বা চওড়া বেঁটে খাটো গোটা পাঁচেক বাঘ একেবারে কাত হয়ে শুয়ে! কর্তা গিন্নী, কাচ্চা-বাচ্চা সমেত পুরো একটি ব্যাঘ্র-পরিবার হাতির তাড়নায় হয়তো বা তাদের পদচারণায়, কে জানে, হতচৈতনয় হয়ে পড়ে আছে।
কাছাকাছি কোনও জলাশয় থাকলে কাপড় ভিজিয়ে এনে ওদের চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে পারলে হয়তো বা জ্ঞান ফেরানো যায়। কিন্তু এই বিভুয়ে কোথায় জলের আজ্ঞা, আমার জানা নেই। তাছাড়া, বাঘের চৈতনয়সম্পাদক করা আমার অবশ্য কর্তব্যের অন্তর্গত কি না, সে বিষয়েও আমার একটু সংশয় ছিল।
আমি করলাম কি, প্রবীণ বনস্পতিদের ঘাড় বেয়ে যেসব ঝুরি নেমেছিল তারই গোটাকতক টেনে ছিঁড়ে এনে বাঘগুলোকে একে একে সব পিছমোড়া করে বাঁধলাম। হাত মুখ বেঁধে-ছেনে সবাইকে পুটলি বানিয়ে ফেলা হল–তখনো ব্যাটারা অজ্ঞান।
হাতিটা এতক্ষণ নিস্পৃহভাবে আমার কার্য্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। এবার উৎসাহ পেয়ে এগিয়ে এসে তার লম্বা শুঁড় দিয়ে এক একটাকে তুলে ধরে নিজের পিঠের উপর চালান দিতে লাগল। সবাই উঠে গেলে পর সব শেষে ওর ল্যাজ ধরে আমিও উঠলাম। তখনো বাঘগুলো অচেতন। সেই অবস্থাতেই হাওদার সঙ্গে শক্ত করে আর এক প্রস্থ ওদের বেঁধে ফেলা হল।
পাঁচ-পাঁচটা আস্ত বাঘ–একটাও মরা নয়, সবাই জলজ্যান্ত। নাকে হাত দিয়ে দেখলাম নিঃশ্বাস পড়েছে বেশ। এতগুলো জ্যান্ত বাঘ একাধারে দেখলে কার না আনন্দ হয়? একদিনের এক চোটে এক সঙ্গে এতগুলো শিকার নিজের ল্যাজে বেঁধে নিয়ে ফেরা–এ কি কম কথা?
গজেন্দ্রগমনে তারপর তো আমার রাজধানীতে ফিরলাম। বাচ্ছা মাহুত বার্লি ব্যগ্র হয়ে আমাদের প্রতীক্ষা করছিল। এখন অতগুলো বাঘ আর বাঘান্তক আমাকে দেখে বারংবার সে নিজের চোখ মুছতে লাগল। এরকম দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেও সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।
খবর পেয়ে মহারাজ! ছুটে এলেন। বাঘদের হাওদা থেকে নামানো হলো। ততক্ষণে তাদের জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু হাত পা বাঁধা–বন্দী নেহাৎ! নইলে, পারলে পরে, তারাও বার্লির মতো একবার চোখ কচলে ভাল করে দেখবার চেষ্টা করতো।
এতগুলো বাঘকে আমি একা স্বহস্তে শিকার করেছি, এটা বিশ্বাস করা বাঘদের পক্ষেও যেমন কঠিন, মহারাজ!র পক্ষেও তেমনি কঠোর! কিন্তু চক্ষু-কর্ণের বিবাদভঞ্জন করে দেখলে অবিশ্বাস করবার কিছু ছিল না।
কেবল বার্লি একবার ঘাড় নাড়বার চেষ্টা করেছিল–এতগুলো বাঘকে আপনি একলা হাতিয়ার নেই, কুছ নেই–বৃহৎ তাজ্জব কি বাত…!
আরে হাতিয়ার নেই, তো কি, হাত তো ছিল? বাধা দিয়ে বলতে হলো আমায়! আর, তোমার হাতির পা-ই তো ছিল হে! তাই কি কম হাতিয়ার? বাঘগুলোকে সামনে পাবামাত্রই, বন্দুক নেই টক নেই করি কি, হাতির কাঠের পা-খানাই খুলে নিলাম। খুলে নিয়ে দু-হাতে তাই দিয়েই এলোপাথাড়ি বসাতে লাগলাম। ঘা কতক দিতেই সব ঠাণ্ডা! হাতির পদাঘাত–সে কি কম নাকি? অবশ্য তোমাদের হাতিকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। বলবামাত্র পেছনের পা দান করতে সে পেছ পা হয়নি। আমিও আবার কাজ সেরে তেমনি করেই তার ইস্ট্রাপ লাগিয়ে দিয়েছি। ভাগ্যিস, তুমি হাতিটার কেঠো পায়ের কথা বলেছিলে আমায়।
অম্লান বদনে এত কথা হাতির দিকে চোখ তুলে তাকাতে আমার লজ্জা করছিল। হাতিরা ভারি সত্যবাদী হয়ে থাকে। এবং নিরামিষাশী তো বটেই তাদের মতো সাধুপুরুষ দেখা যায় না প্রায়। ওর পদচ্যুতি ঘটিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি এই মিথ্যা কথায় কেবল বিরক্তি নয়, ও যেন রীতিমত অপমান বোধ রকছিল। এমন বিষ-নজরে তাকাচ্ছিল আমার দিকে যে-কি বলব! বলা বাহুল্য, তারপর আমি আর ওর ত্রিসীমানায় যাইনি।
হাতিরা সহজে ভোলে না।
আমার ব্যাঘ্রপ্রাপ্তি
একবার আমাকে বাঘে পেয়েছিলো। বাগে পেয়েছিলো একেবারে—
আমার আত্মকাহিনী আরম্ভ হয়।
এতক্ষণে আমাদের চার-ইয়ারি আড্ডায় আর সকলের শিকার-কাহিনী চলছিলো। জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে যে যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করছিলেন। আমার পালা এলো অবশেষে।
অবিশ্য সবার আগে শুরু করেছিলেন এক ভালুক-মার। তার গল্পটা সত্যই ভারী রোমাঞ্চকর। ভালুকটা তার বাঁ হাতখানা গালে পুরে চিবোচ্ছিল কিন্তু তিনি তাতে একটুও না বিচলিত হয়ে এক ছুরির ঘায়ে ভালুকটাকে সাবাড় করলেন। ডান হাত দিয়ে–তাকে হাতিয়ে।
আমি আড় চোখে তার বাঁ হাতের দিকে তাকালাম। সেটা যে কখনো কোন ভালুক মন দিয়ে মুখস্থ করেছিল তার কোন চিহ্ন সেখানে নেই।