এবার আসল গল্পে আসা যাক।
শিকার যাত্রা তত বেরোল। হাতির উপরে হাওদা চড়ানো, তার উপরে বন্দুক হাতে শিকারীরা ডজনখানেক চড়াও হাতি চার পায়ে মশ মশ করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে। সব আগের হাতিতে চলেছেন রাজ্যের সেনাপতি। তারপর পাত্র-মিত্র-মন্ত্রীদের হাতি; মাঝখানে প্রকাণ্ড এক দাতালো হাতিতে মশগুল হয়ে স্বয়ং মহারাজ!; তার পরের হাতিটাতেই একমাত্র আমি এবং আমার পরেও ডানহাতি, বাঁহাতি আরো গোটা কয়েক হাতি; তাতে অপাত্ৰ অমিত্ররা! হাতিতে হাতিতে যাকে বলে ধূল পরিমাণ! এত ধূলো উড়ল যে দৃষ্টি অন্ধ, পথঘাট অন্ধকার–তার পরিমাণ করা যায় না।
জঙ্গল ভেঙ্গে চলেছি। বাধা রাস্তা পেরিয়ে এসেছি অনেকক্ষণ–এখন আর মশ মশ নয়, মড় মড় করে চলেছি। এই ‘মর্মর-ধ্বনি কেন জাগিল রে।’ ভেবে না পেয়ে হতচকিত শেয়াল, খরগোশ, কাঠবেড়ালির দল এধারে ওধারে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিয়েছে, শাখায় শাখায় পাখিদের কিচির-মিচির আর কারো পরোয়া না করে চলেছি। হাতিরা কারো খাতির করে না।
চলেছি তো কতক্ষণ ধরে। কিন্তু কোন বাঘের ধড় দূরে থাক, একটা ল্যাজও চোখে পড়ে না। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর কিসের শোরগোল শোনা গেল। কোত্থেকে একদল বুনো জংলী লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। তারা বনের মধ্যে ঢুকে কি করছিল কে জানে! মহারাজ! হয়তো বাঘের বিরুদ্ধে তাদের গুপ্তচর লাগিয়ে থাকবেন। তারা বাঘের খবর নিয়ে এসেছে মনে হতেই আমার গায়ে ঘাম দেখা দিল।
কিন্তু তারা বাঘের কোন উচ্চবাচ্য করে হাত-তী-হাত-তী বলে চেঁচাতে লাগল।
হাত-তী তো কি? হাতি যে তা তো দেখতেই পাচ্ছ–হাতি কি কখনো দেখনি না কি? ও নিয়ে অমন হৈ চৈ করবার কি আছে? হাতির কানের কাছে ওই চেঁচামিচি আর চোখের সামনে ওরকম লম্ফঝম্ফ আমার ভাল লাগে না। হাতিরা বন্য ব্যবহারে চটে গিয়ে ক্ষেপে যায় যদি? হাতি বলে কি মানুষ নয়? হাতিরও তো মানমর্যাদা আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে!
মহারাজকে কথাটা আমি বললাম। তিনি জানালেন যে, আমাদের হাতির বিষয়ে উল্লেখ করছেন, একপাল বুনো হাতি একদিকেই তাড়া করে আসছে, সেই কথাই ওরা তারস্বরে জানাচ্ছে। এবং কথাটা খুব ভয়ের কথা। তারা এসে পড়লে আর রক্ষে থাকবে না। হাতি এবং হাওদা সমেত সবাইকে আমাদের দলে পিষে মাড়িয়ে একেবারে ময়দা বানিয়ে দেবে।
তৎক্ষণাৎ হাতিদের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া হল। কথায় বলে হস্তিযূথ, কিন্তু তাদের ঘোরানো ফেরানোর এত বেজুত যে বলা যায় না। যাই হোক কোন রকমে তো হাতির পাল ঘুরল, তারপরে এলো পালাবার পালা।
আমার পাশ দিয়ে হাতি চালিয়ে যাবার সময় মহারাজ! বলে গেলেন, খবরদার! হাতি থেকে একচুল যেন নড় না। যত বড় বিপদই আসুক, হাতির পিঠে লেপটে থাকবে। দরকার হলে দাঁতে কামড়ে, বুঝেছ?
বুঝতে বিলম্ব হয় না। দূরাগত বুনোদে বজ্রনাদী বৃংহণধ্বনি শোনা যাচ্ছিল-সেই ধ্বনি হন হন করতে এগিয়ে আসছে। আরো-আরো কাছে, আরো আরো কাছিয়ে। ডালে ডালে বাঁদররা কিচমিচিয়ে উঠেছে। আমার সারা দেহ কাটা দিয়ে উঠতে লাগল। ঘেমে নেয়ে গেলাম।
এদিক আমাদের দলের আর আর হাতিরা বেশ এগিয়ে গেছে। আমার হাতিটা কিন্তু চলতে পারে না। পদে পদে তার যেন কিসের বাধা! মহারাজের হাতি এত দূর এগিয়ে গেছে যে, তার লেজ পর্যন্ত দেখা যায় না। আর সব হাতিরাও যেন ছুটতে লেগেছে। কিন্তু আমার হাতিটার হল কি। সে যেন নিজের বিপুল বপুকে টেনে নিয়ে কোনরকমে চলেছে।
আমাদের দলের অগ্রণী হাতিরা অদৃশ্য হয়ে গেল। আর এধারে বুনো হাতির পাল পেল্লায় ডাক ছাড়তে এগিয়ে আসছে ক্রমশই তার আওয়াজ জোরাল হতে থাকে। আমার মাহুতটাও হয়েছে বাচছা। কিন্তু বাচ্ছা হলেও সেই তখন আমাদের একমাত্র ভরসা।
জিজ্ঞাসা করলাম–কি হে। তোমার হাতি চলছে না কেন? জোরসে চালাও। দেখছ কি?
জোরে আর কি চালাব হুজুর? তিনি পায়ে হাতি আর কত জোরে চলবে বলুন? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে বললে।
তিন পা। তিন পা কেন? হাতিদের তো চার পা থাকে বলেই জানি। অবশ্য, এখন পিঠে বসে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু চার পা দেখেই উঠেছিলাম বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য, ভাল করে ঠিক খেয়াল করিনি।
এর একটা পা কাঠের যে। পেছনের পাটা। খানায় পড়ে পা ভেঙে গেছল। রাজাসাহেব হাতিটাকে মারতে রাজি হলেন না, সাহেব ডাক্তার এসে পা কেটে বাদ দিয়ে কাঠের পা জুড়ে দিয়ে গেল। এমন রঙ বার্নিশ যে ধরবার কিছু জো নেই। ইট্রাপ দিয়ে বাঁধা কি না।
শুনে মুগ্ধ হলাম। ডাক্তার সাহেব কেবল হাতির পা-ই নয়, আমার গলাও সেইসঙ্গে কেটে রেখে গেছেন। আবার মহারাজেরও এমন মহিমা, কেবল বেছে বেছে খোঁড়া হাতিই নয়, দুগ্ধপোষ্য একটা খুদে মাহুতের হাতে অসহায় আমায় সমর্পণ করে সরে পড়লেন।
কাঠের হাতি নিয়ে বাচ্চা ছেলে তুমি কি করে চালাবে?–আমি অবাক হয়ে যাই।
বার্লি আমার নাম–সে সগর্বে জানাল–আর আমি হাতি চালাতে জানব না?
বার্লি? ভারি অদ্ভুত নাম তো।–আমার বিস্ময় লাগে।
আমি সাবুর ভাই। সাবু আমেরিকায় গেছে ছবি তুলতে।
তোমার বার্লিনে যাওয়া উচিত ছিল।–না বলে আমি পারলাম না।–গেলে ভাল করতে।
শোনা মাত্রই নিজের ভুল শোধরাতেই কি না কে জানে, তৎক্ষণাৎ সে হাতির ঘাড় থেকে নেমে পড়ল। নেমেই বার্লিনের উদ্দেশ্যেই কি না কে বলবে দে ছুট। দেখতে দেখতে আর তার দেখা নেই। জঙ্গলের আড়ালে হাওয়া।