যতদুর চোখ যায়, জমি! কেবল জমিই চোখে পড়ে। মেজমামা বলেন–এবার যা আলু ফলেছিল তা যদি দেখতে! পটলও খুব হবে এবার।
ছোটমামা ঘাড় নাড়েন–আমার সব নিজেরাই করি তো! জন-মজুরের সাহায্য নিই না। স্বাবলম্বনের মত আর কী আছে? গতবারে আমরা তিন ভায়ে তুলে কুলিয়ে উঠতে পরলাম না, প্রায় আড়াই কী লক্ষ পটল এঁচোড়েই পেকে গেল। বিলকুল বরবাদ। পাকা পটল তো চালান যায় না, কে কিনবে?
বড়মামা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন–তবুও তো প্রত্যেকে দশলাখ করে তুলেছিলাম।
মেজমামা আশ্বাস দেন–যাক, এবার আর নষ্ট যাবার ভয় নেই, ভাগনেটা এসে পড়েছে, বাড়তির ভাগটা ওই তুলতে পারবে।
ছোটমামা বলেন–কিন্তু এবার পটল ফলেছেও দেড়া।
তা ও পারবে। জোয়ান ছেলে– উঠে পড়ে লাগলে ও আমাদের ডবল তুলতে পারে। পারবে? বড়মামা আমার পিঠ চাপড়ান।
পৃষ্ঠপোষকতার ধাক্কা সামলে ক্ষীণস্বরে বলি–পটলের সিজনটা কবে?
আর কি, দিন সাতেক পরেই পটল তোলার পালা শুরু হবে। ছোটমামার কাছে ভরসা পাই।
চোদ্দ মাইল হেঁটে টলতে টলতে বাড়ি ফিরি। ফিরেই ভিজিটালিসের অন্বেষণে গিয়ে দেখি, তিন বোতলই ফাঁক। গিধৌড়কে জিজ্ঞাসা করি–ক্যা হুয়া।
গিধৌয় জবাব দেয়–উ দোনো খা ডালা।
ভটরি দাস প্রতিবাদে করে–নেহি জি, উ ভি খায়া! আপকো ভিজটালিস উভি খাইস।
কেবল খাইস নয়, আমাকেও খেয়েছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি এই দারুণ পরিশ্রমের পর এখন কি করে হার্টফেলের হাত থেকে বাঁচি। আত্মরক্ষা করি আপনার?
গজেন ডাক্তারকে চিঠি লিখতে বসলাম কাল এসে অবধি আদ্যোপান্ত সব হতিহাস সবিশেষ অবশেষে জানাই–
ভিজিটালিস নেই, ভালই হয়েছে, আমার আর বাঁচাবার সাধও নেই। বাঁচতে গেলে আমায় পটল তুলতে হবে। এক-আধটা নয়, সাড়ে তিনলাখ পটল তার বেশিও হতে পারে। তুলতে হবে আমাকে। পত্রপাঠ এমন একটা ওষুধ চট করে, পাঠাবেন, যাতে এই পটল-তোলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাই এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার হার্টফেল করে। এ পর্যন্ত যা দারুণ খাটুনি গেছে, তাতেও যখন এই ডায়ালেটেড হার্ট আমার ফেল করেনি, তখন ওর ভরসা আমি ছেড়েই দিয়েছি। ওর ওপর নির্ভর করে বসে থাকা যায় না। সাড়ে তিনলক্ষ পটল তোলা আমার সাধ্য নয়, তার চেয়ে আমি একবার একটিমাত্র পটল তুলতে চাই-পটলের জিন আসার ঢের আগেই। যখন মরবারও আশা নেই, বাঁচাবারও ভরসা নাস্তি–তখন এ জীবন রেখে লাভ? ইতি মরণাপন্ন (কিংবা জীবনাপন্ন) বিনীত–ইত্যাদি।
এক সপ্তাহ গেল, দুসপ্তাহ কেটে গেল, তবু ডাক্তারের কোনো জবাব নেই, ওষুধ পাঠাবার নাম নেই। কাল সকাল থেকে পটল-পর্ব শুরু হবে ভেবে এখন থেকেই আমার স্বকম্প আরম্ভ হয়েছে। এঁটে রেখেছি মামারা রাত্রে রামলীলা দেখতে গেলেই সেই সুযোগে কলকাতার গাড়িতে সটকান দেব।
কলকাতায় ফিরেই গজেন ডাক্তারের কাছে ছুটি। গিয়ে দেখি কম্পাউন্ডার দুজন গালে হাত দিয়ে বসে আছে, রোগীপত্তর কিছু নেই। জিজ্ঞাসা করলাম–গজেনবাবু আসেননি আজ? কোথায় তিনি?
দু-তিনবার প্রশ্নের পর অঙ্গুলি নির্দেশ জবাব পাই।
ও! এই বাড়ির তেতলায় গেছেন! রোগী দেখতে বুঝি?
উত্তর আসে–না, রোগী দেখতে নয়, আরো উপরে।
আলো উপরে? আরে উপরে রকম? বাড়ির ছাদে নাকি? আমি অবাক হয়ে যাই।–ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন বুঝি?
আজ্ঞে না, তারও উপরে।
ছাদের ও উপরে? তবে কি এরোপ্লেনের সাহায্যে তিনি আকাশেই উড়ছেন এখন? ডাক্তার মানুষের এ আবার কি ব্যারাম! বিস্ময়ের আতিশয্যে প্রায় ব্যাকুল হয়ে উঠি; এমন সময়ে হোট কম্পাউন্ডারটি গুরুগম্ভীরভাবে, অথচ সংক্ষেপে জানান–তিনি মারা গেছেন।
মারা গেছেন! সেকি রকম!!!–দশদিনের মধ্যে তৃতীয়বার আমার পিলে চমকায়। হার্টফেল ফেল হয়।
বুড়ো কম্পাউন্ডারটি বলেন–কি আর বলবো মশায়! এক চিঠি–এক সর্বনাশে চিঠি–ডালটনগঞ্জ থেকে–অশ্বিনীর না ভরণীর কার এলো যেন–তাই পড়তে পড়তে ডাক্তারবাবুর চোখ উল্টে গেল। বার তিনেক শুধু বললে–কী সর্বনাশ! কী সর্বনাশ!!…তার পরে আর কিছুই বললেন না, তার হার্টফেল হোলো।
নিজের পাড়ায় যতটা অপরিচিত থাকা যায়! এই জন্যেই গজেন ডাক্তারের কাছে আমি অশ্বিনীরূপ ধারণ করেছিলাম। আজ সেই ছদ্মনামের মুখোস আর খুললাম না, নিজের কোনো পরিচয় না দিয়েই বাড়ি ফিরলাম। একবার ভাবলাম, বলি যে, সেই সঙ্কট মুহূর্তে ডাক্তারবাবুকে এক ডোজ ভিজিটালিস দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এখন আর বলে কি লাভ!
আমার বাঘ শিকার
মুখের দ্বারা বাঘ মারা কঠিন নয়। অনেকে বড় বড় কেঁদো বাঘকে কাঁদো কাঁদো মুখে আধমরা করে ঐ দ্বারপথে এনে ফেলেন। কিন্তু মুখের দ্বারা ছাড়াও বাঘ মারা যায়। আমিই মেরেছি।
মহারাজ বললেন, বাঘ-শিকারে যাচ্ছি। যাবে আমাদের সঙ্গে?
না বলতে পারলাম না। এতদিন ধরে তাঁর অতিথি হয়ে নানাবিধ চর্বচোষ্য খেয়ে অবশেষে বাঘের খাদ্য হবার সময়ে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলে না। কেমন যেন চক্ষুলজ্জায় বাধে।
হয়তো বাগে পেয়ে বাঘই আমায় শিকার করে বসবে। তবু মহারাজ!র আমন্ত্রণ কি করে অস্বীকার করি? বুক কেঁপে উঠলেও হাসি হাসি মুখ করে বললাম, চলুন যাওয়া যাক। ক্ষতি কি?
মহারাজ!র রাজ্য জঙ্গলের জন্যে এবং জঙ্গল বাঘের জন্যে বিখ্যাত। এর পরে তিনি কোথাকার মহারাজ, তা বোধ হয় না বললেও চলে। বলতে অবশ্য কোন বাধা ছিল না, আমার পক্ষে তো নয়ই, কেন না রাজামহারাজ!র সঙ্গেও আমার দহরম-মহরম আছে–সেটা বেফাঁস হয়ে গেলে আমার বাজারদর হয়ত একটু বাড়তোই। কিন্তু মুশকিল এই, টের পেলে মহারাজ হয়তো আমার বিরুদ্ধে মানহানির দাবি আনতে পারেন–এবং টের পাওয়া হয়তো অসম্ভব ছিল ন। মহারাজ না পড়ন, মহারাজকুমারেরা যে আমার লেখা পড়েন না, এমন কথা হলফ করে বলা কঠিন। তাছাড়া আমি যে পাড়ায় থাকি, যে গুড়াপাড়ায়, কোন মহারাজ!র সঙ্গে আমার খাতির আছে ধরা পড়লে তারা সবাই মিলে আমাকে একঘরে করে দেবে। অতএব সব দিক ভেবে স্থান, কাল, পাত্র চেপে যাওয়াই ভাল।