খাবার পর শোবার আয়োজন করছি বড়মামা বলেন–আমাদের ক্ষেতখামার দেখবে চলো।
ছোটমামা বলেন–দিবানিদ্রা খারাপ। ভার খারাপ! ওতে শরীর ভেঙে পড়ে।
আমি বলি–আজ আর না, কাল দেখব।
তবে চল, দেহাতে দিয়ে আখের রস খাওয়া যাক, আখের খেত দেখেছ কখনও?
আখের রসের লালসা ছিল, জিজ্ঞাসা করলুম–খুব বেশি দূরে নয় তো?
আরে, দূর কীসের? কাছেই তো–দু-কদম মোটে।
কদবে কদম হয় জানি নে, পাক্কা চোদ্দ মাইল হাঁটা হোলো, চোখে ফুল দেখছি! তবু শুনি–এই কাছেই। এসে পড়লাম বলে।
প্রাণের আশা ছেড়েই দিয়েছি, মামার পাল্লায় পড়লে প্রাণ প্রায়ই থাকে না-রামায়ণ-মহাভারতে তার প্রমাণ আছে।
আরো দু-মাইল পরে দেহাত। আখের রস খেয়ে দেহ কাত করলাম। আমার অবস্থা দেখে মামাদের করুণা হোলো বোধ হয়, দেহাতি রাস্তা ধরে এক্কা যাচ্ছিল একটা, সেটাকে ভাড়া করে ফেললেন।
এক্কায় কখনও চড়িনি; কিন্তু চাপবার পর মনে হলো, এর চেয়ে হেঁটে ফেরাই ছিল ভালো। এক্কার এমনি দাপট যে, মুহূর্তের আমি আকাশে উদ্ধৃত হতে লাগলাম এ যাত্রার এতক্ষণে টিকে থাকলেও এ-ধাক্কার এবার গেলাম নির্ঘাত, সজ্ঞানে এক্কা-প্রাপ্তি অর দেরি নেই–টের পেলাম বেশ।
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেল–এক্কায় যতক্ষণ এসেছি, তার দুই তৃতীয়াংশ সময় আকাশে আকাশেই ছিলাম, একথা বলতে পারি; কিন্তু সেই আকাশের ধাক্কাতেই সাসা গায়ে দারুণ ব্যাথা! হাড়পাজরা যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে ঝরঝরে হয়ে গেয়ে বোধ হতে লাগল। তেত্রিশটা চাপাটির মধ্যে সওয়া তিনখানা আত্মসাৎ করে শুয়ে পড়লাম। কোথায় রামলীলা হচ্ছিল, মামারা দেখতে গেলেন। আমায় সঙ্গে যেতে সাধলেন, বার বার অভয় দিলেন যে এক কদমের বেশি হবে না, আমি কিন্তু ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলাম। ডালটনী ভাষায় এক কদম মানে যে একুশ মাইল, তা আমি ভাল রকমই বুঝেছি।
আলাদা বিছানা ছিলনা, একটিমাত্র বড় বিছানা পাতা,তাতেই ছেলেদের সঙ্গে শুতে হোলো। খানিকক্ষণেই বুঝতে পারলাম যে হ্যাঁ, সৌরজগতেই বাস করছি বটে– আমার আশেপাশে তিনটি ছেলে যেন তিন টি গ্রহ! তাদের কক্ষ পরিবর্তনের কামাই নেই। এই যেখানে একজনের মাথা দেখি, একটু পরেই দেখি, সেখানে তার পা; কানিক বাদে মাথা বা পার কোনটাই দেখতে পাই না। তার পরেই অকস্মাৎ তার কোনো একটার সঙ্গে আমার দারুণ সংঘর্ষ লাগে। চটকা ভেঙে যায়, আহত স্থানের শুশ্রূষা করতে থাকি কিন্তু ওদের–কারুর নিদ্রার বিন্দুমাত্রও ব্যত্যয় ঘটে না। ঘুমের ঘোরে যেন বোঁ বোঁ করে ঘুরছে ওরা–আমিও যদি ওদের সঙ্গে ঘুরতে পারতাম, তাহোলে বেধ হয় তাল বজায় থাকত, ঠোকাঠুকি বাধার সম্ভাবনাও কমতো কিছুটা। কিন্তু মুশকিল এই ঘুরতে গেলে আমার ঘুমনো হয় না, আর ঘুমিয়ে পড়লে ঘোরার কথা একদম ভুলে যাই।
ছেলেগুলোর দেখছি পা দিয়েও বক্সিং করার বেশ অভ্যেস আছে এবং সব সময়ে নট-টু-হিট বিলো-দি-বেল্ট-এর নিয়ম মেনে চলে বলেও মনে হয় না। নাক এবং দাঁত খুব সতর্কভাবে রক্ষা করছি–ওদের ধাক্কায় কখন যে দেহচ্যুত হয়, কেবলি এই ভয়। ঘুমানোর দফা তো রফা!
ভাবছি, আর চৌকিদারিতে কাজ নেই, মাটির নেমে সটান জমিদার হয়ে পড়ি। প্রাণ হাতে নিয়ে এমন করে ঘুমনো যায় না। পোয় না আমার। এদিকে দুটো তত বাজে। নিচে নেমে শোবার উদ্যোগে আছি, এমন সময়ে নেপথ্যে মামাদের শোরগোল শোনা গেল রামলীলা দেখে আড়াইটা বাজিয়ে ফিরছেন এখন। অগত্যা মাটি থেকে পুনরায় প্রমোশন নিতে হেলো বিছানায়।
মামারা আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন, অর্থাৎ তাদের ধারণা যে, জাগালেন। তারপর ঝাড়া দু ঘণ্টা রামলীলার গল্প চলল। হনুমানের লম্পঝম্প তিন মামাকেই ভারী খুশি করেছে সে সমস্তই আমাকে শুনতে হোলো। ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে আসছিল কেবল হুঁ হাঁ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এক মামা প্রশ্ন করে বসলেন–হনুমানের বাবা কে জানো তো শিব্রাম?
ঘুমের ঝোঁকে ইতিহাসটা ঠিক মনে আসছিল না। হনুমান পুরাল হলে মামাদের নাম করে দিতাম, সিঙ্গুলার অবস্থায় কার নাম করি? সঙ্কোচের সহিত বললাম–জাম্বুমান নয়তো?
বড়মামা বললেন–পাগল!
মেজমামা বললেন–যা আমরা নিঃশ্বাস টানছি, তাই।
ও! এতক্ষণে বুঝেছি!–হঠাৎ আমার বুদ্ধি খুলে যায়, বলে ফেলি চট করে–ও! যতো সব রোগের জীবাণু!
বড়মামা আবার বলেন–পাগলা!
উহুঁহুঁ!–মেজমামাও আমায় দমিয়ে দেন, বলেন–না ও সব নয়। জীবাণুটিবাণু না।
জীবাণুটিবাণুও না? তা হোলে কি তবে? আমার তো ধরণা এই সব প্রাণীরাই আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসে যাতায়াত করে।–আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলি।
ছোটমামা বলেন–পবনদেব।
সাক্ষাৎ পবনদেবকে নিঃশ্বাসে টানছি এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়েছি, কিংবা হয়তো ঘুমাইনি। বড়মামা আমাকে টেনে তুললেন–ওঠো, ওঠো; চারটে বেজে গেছে, ভোর হয়ে এল। মুখ হাত ধুয়ে নাও, চলো বেরিয়ে পড়ি। আমরা সকলেই প্রাতঃভ্রমণ করি রোজ। তুমিও বেড়াবে আমাদের সঙ্গে।
মেজমামা বললেন–বিশেষ করে চেঞ্জে এসেছে যখন! হাওয়া বদলাতেই এসেছো তো?
ছোটমামাও সায় দেয়–ডালটনগঞ্জের হাওয়াই হোলো আসল! হাওয়া খেতে এসে হাওয়াই যদি না খেলে, তবে আর খেলে কি?
চোখে-মুখে জলের ছিটে দিয়ে মামাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। সাড়ে সাত মাইল হাঁটবার পর বড়মামা দুধারে যতদুর যাক, বাহু বিস্তার করলেন–এই সব-সবই আমাদের জমি।