মামারা আমাকে দেখে খুশী হয়ে ওঠেন।বেশ বেশ, এসেছে যখন, তখন থাকো কিছুদিন। বড়মামা বলেন।
থাকবই তো পায়ের ধুলো নিতে নিতে বলি–চেঞ্জের জন্যই তো এলাম।
মেজমামা বলেন–এসেছ ভালই করেছ, এতদিনে পটলের একটা ব্যবস্থা হোলো।
ছোটমামা সায় দেন–হ্যাঁ, একটা দুর্ভাবনাই ছিল যাক, তা ভালোই হয়েছে।
তিন মামাই যুগপৎ ঘাড় নাড়তে থাকেন।
বুঝলাম, মামাতো ভাইদের কারো গুরুভার আমায় বহন করতে হবে। হয়তো তাদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। তা বেশ তো, ছেলেপড়ানো এমন কিছু শক্ত কাজ নয় যে, হার্টফেল হয়ে যাবে। গুরুতর পরিশ্রম কিছু না করলেই হোলো; টিউশনির যেগুলো শ্রমসাধ্য অংশ–পড়া নেওয়া, ভুল করলে শোধরাবার চেষ্টা করা, কিছুতেই ভুল শোধরালে শেষে পাখাপেটা করা এবং মাস ফুরোলে প্রাণপণে বেতন বাগানন, এখন থেকেই এগুলো বাদ দিতে সর্তক থাকলাম। হা, সাবধানেই থাকবো, রীতিমতই, যাতে কান মোলর কষ্ট স্বীকারটুকুও না করতে হয়, বরঞ্চ প্রশ্রয়ই দেব পটলকে–যদি পড়াশুনায় ফাঁকি দিতে থাকে, কিংবা কাঠফাটা রোদ–জেগে উঠলেই ওর যদি ডাণ্ডাগুলিখেলার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, ভেগে পড়তে চায়, আমার উৎসাহই থাকবে ওর তরফে। ভ্রাতৃপ্রীতি আমার যতই থাক, প্রাণের চেয়ে পটল কিছু আমার আপনার নয়, তা মামাতো পটলই কি, আর মাসতুতো পটলই কি!
মামাতো ভাইদের সঙ্গে মোলাকাত হতে দেরী হোলো না। তিনটে ডানপিটে বাচ্চা-মাথা পিছু একটি করে গুণে দেখালাম।–এর মধ্যে কোনটি পটল, বাজিয়ে দেখতে হয়। আলাপ শুরু করা গেল–তোমার নাম কি খোকা?
রা, ঠনাঠন।
অ্যাঁ। সে আবার কি? পরিচয়ের সূত্রপাতেই পিলে চমকে যায় আমার। দ্বিতীয় জনের। অযাচিত জবাব আসে–হামার নাম ভটরিদাস হো!
আমার তো দম আটকাবার যোগাড়! বাঙ্গালীর ছেলের এ সব আবার কি নাম! এমন বিধঘুঁটে এরকম বদ নাম কেন বাঙ্গারীর?
বড়মামা পরিষ্কার করে দেন–যে দেশে থাকতে হবে, সেই দেশের দস্তর মানতে হবে না? তা নইলে বড় হয়ে এরা এখানকার দশজনের সাথে মিলে মিশে খাবে কিসে, মানিয়ে চলবেই বা কি করে?
মেজমামা বলেন–এ সব বাবা, ডালটনী নাম। সে দেশের যা দস্তুর!
ছোটমামা বলেন–এখানকার সবাই বাঙালীকে বড় ভয় করে। আমরা ব্যবসা করতে এসেছি যুদ্ধ করতে আসিনি তো! তাই এদের পক্ষে ভয়ঙ্কর বাঙ্গালী নাম সব বাদ দিয়ে এদেশী সাদাসিদে নাম রাখা।
তৃতীয়টিকে প্রশ্ন করতে আমার ভয় করে–তুমিই তবে পটল?
ছেলেটির দিক থেকে একটা ঝটকা আসে–আঃ! হামার নাম গিধৌড় বা!
হার্টফেলের একটা ভয়ানক ধাক্কা ভয়ানকভাবে কেটে যায়। পকেট থেকে বের করে চটকরে এক, দাগ ভিজিটালিস খেয়ে নিই–পটল তবে কার নাম?
তিনজনেই ঘাড় নাড়ে–জানহি না তো!
তুমহারা নাম কেয়া জী? জিগ্যেস করে ওদের একজন।
আমার নাম? আমার নাম? আমতা আমতা করে বলি–আমার নাম শিব্রাম ঠনাটন!
যস্মিন দেশে যদাচারঃ। ডালটনগঞ্জের ডালভাঙ্গা কায়দায় আমার নামটার একটা হিন্দি সংস্করণ বার করতে হয়।
ভটরিদাস এগিয়ে এসে আমার হাতের শিশিটা হস্তগত করে–সিরপ হ্যায় কেয়া?
তিনটি বোতল ওদের তিনজনের হাতে দিই মেজমামা একটি লেবেলের উপর দৃক পাত করে বলেন–সিরপ নেহি! ভিজটলিস্ হ্যায়। খাও মৎ-তাৰু উপর রাখ দেও।
ভটরিদাস রাম ঠনঠনকে বুঝিয়ে দেয়–সমঝা কুছ? ইসসে হি ডিজ লনঠন বনতি। এহি দুবাই সে।
বড়মামা বলেন–শিবু সেই কাল বিকেলে গাড়িতে উঠেছে, ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়? কিছু খেয়েদেয়ে নাও আগে।
এ্যাম্বক ওঝার ডাক পড়ল। ছোটমামা আমার বিস্মিত দৃষ্টির জবাব দেন–তোমার দাদামশায়ের সঙ্গে মামীরা সব তীর্থে গেছেন কিনা, তাই দিনকত-র জন্য এই মহারাজ!কে কাজ চালানোর মত রাখা হয়েছে।
তেইশটা চাপাটি আর কুছ তরকারি নিয়ে মহারাজের আবির্ভাব হয়। তিনটি পাচাটি বা চপেটাঘাত সহ্য করতেই প্রাণ যায় যায়, তারপর কিছুতেই আর টানতে পারি না। মামারা হাসতে থাকেন। অগত্যা লজ্জায় পড়ে আর আড়াইটা কোনো রকমে গলাধঃকরণ করি। টানে টুনে পাঠাইল গলায় তলায়, ঠেলে ঠুলে।
মামা ভয়ানক হাসেন–তোমার যে দেখি পাখির খোরাক হে!
আমি বলি–খেতে পারতাম। কিন্তু পরিশ্রম করা আমার ডাক্তারের নিষেধ কিনা।
আঁচিয়ে এসে লক্ষ্য করি, আমার ভুক্তাবশেষ সেই সাড়ে সাতটা চাপাটি ফ্রম রাম ঠনঠন টু গিধৌর চক্ষের পলকে নিঃশেষ করে এনেছে। এই দৃশ্য দেখাও কম শ্রমসাধ্য নয়, তৎক্ষণাৎ চার দাগ ভিজিটালিস খেতে হয়।
বড়মামা বলেন–চলো একটু বেড়িয়ে আসা যাক। নতুন দেশে এসেছ জায়গাটা দেখবে না? বলে আমাকে টেনে নিয়ে চলতে থাকেন।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরুতে হয়। ডাক্তারের মতে বিশ্রাম দরকার–একেবারে কমপ্লিট রেসট। কিন্তু মামারা রেসট কাকে বলে জানেন না, আলস্য ওঁদের দুচক্ষের বিষ। নিজেরা অলস তো থাকবেনই না, অন্য কাউকে থাকতেও দেবেন না।
সারা ডালটনগঞ্জটা ঘুরলাম, অনেক দ্রষ্টব্য জায়গা দেখা গেল, যা দেখবার কোনো প্রয়োজনই আমার ছিল না কোনদিন। পুরো সাড়ে তিন ঘণ্টায় পাক্কা এগারো মাইল ঘোরা হোলো। প্রতি পদক্ষেপেই মনে হয়, এই বুঝি হার্টফেল করল। কিন্তু কোন রকমে আত্মসংবরণ করে ফেলি। কি করে যে করি, আমি নিজেই বুঝতে পারি না।
বাড়ি ফিরে এবার বিয়াল্লিশটা চাপাটির সম্মুখীন হতে হয়। পাখির খোরাক বলে আমাকেই সব থেকে কম দেওয়া হয়েছে। পরে খাব জানিয়ে এক ফাঁকে ওগুলো ছাদে ফেলে দিয়ে আসি, একটু পরে গিয়ে দেখি,তার চিহ্নমাত্রও নেই। পাখির খোরাক তাহলে সত্যিই!