হিস্টিরিয়ার কবল থেকে বেঁচেছি। এখন ভুগছি খালি নিউমোনিয়ায়। অমন ৫৫ জল চিকিৎসার পরিণাম তো একটা আছেই!
অঙ্ক আর সাহিত্যের যোগাযোগে যে আবিষ্কারটা আমি করেছিলাম সেটা আর চালু করা গেল না এ-বাজারে। আঙ্কিক সাহিত্যিকের ৯৯ দশায় অর্থাৎ অন্তিম অবস্থায় তার সাহিত্য-অঙ্কের যবনিকা পতন হল।
সাহিত্যে প্লাস অঙ্ক, তার সঙ্গে যদি সামান্য একটা ছেলেকে যোগ দেওয়া যায় তার ফল দাঁড়ায় প্রাণবিয়োগ। অর্থাৎ একেবারে শূন্য। ক্ষুদ্র, বৃহৎ, ১-ই কি আর ১০০ই কি, সব ব্যাপারেই ছেলেদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া নিরাপদ। চাইল্ড ইজ দি ফাদার অফ ম্যান, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন; এই কথাগুলোর মানে আমি বুঝতে পারলাম এতদিনে আমার হাড়ে হাড়ে। এর যথার্থ দামও এতদিনে আত্মসাৎ করতে পারলাম। অর্থাৎ, ছেলেরা হচ্ছে মানুষের বাবা! আর, বাবার সঙ্গে লাগতে গেলে কাবার হতে কতক্ষণ?
আবিষ্কারকের ক্রমপরিণতি খুব সুবিধের হল না, সেজন্য দুঃখ নেই। কোন দেশে কোন কালেই হয় না, ইতিহাস পড়ে জানা আছে। যাই হোক, এই সুযোগে সেই ভদ্রলোক, সেই মহেন্দ্রবাবু, মাহেন্দ্রক্ষণে যিনি অযাচিত এসে বন্ধুকৃত্য করেছিলেন তাকে ধন্যবাদ দিয়ে রাখি। হিস্টিরিয়ার টাল সামলেছি, নিউমোনিয়ার ধাক্কা সামলাব কিনা কে জানে! আগে থেকে দিয়ে রাখাই ভাল।
৬৭ জলকষ্টের কথা আর মনে নেই, এখন ৭৬ মন্বন্তর আমার সম্মুখে, সাবু বালিই খালি পথ্য আমার এখন।
অশ্বত্থামা হতঃ ইতি
পাশের বাড়ি বেরিবেরি হওয়ার পর থেকেই মন খারাপ যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক যে ছিল, তা নয়, সম্পর্ক হবার আশঙ্কাও ছিল না, কিন্তু বেরিবেরির সঙ্গে সম্পর্ক হতে কতক্ষণ? যে বেপরোয়ো ব্যরাম কোনদেশ থেকে এসে এতদূর পর্যন্ত এগুতে পেরেছে, তার পক্ষে আর একটু কষ্ট স্বীকার করা এমন কি কঠিন!
কদিন থেকে শরীরটাও খারাপ বোধ করতে লাগলাম। মনের মধ্যে স্বগতোক্তি শুরু হয়ে গেল–ভাল করছ না হে, অশ্বিনী! সময় থাকতে ডাক্তার-টাক্তার দেখাও।
মনের পরামর্শ মানতে হোলো। ডাক্তারের কাছেই গেলাম। বিখ্যাত গজেন ডাক্তারের কাছে। আমাদের পাড়ায় ডাক্তার এবং টাক্তার বলতে একমাত্র তাঁকেই বোঝায়।
তিনি নানারকমের পরীক্ষা করলেন, পালসের বীট গুণলেন, ব্লাডপেসার নিলেন, স্টেথিসকোপ বসালেন, অবশেষে নিছক আঙুলের সাহায্যে বুকের নানাস্থান বাজাতে শুরু করে দিলেন। বাজনা শেষ হলে বললেন–আর কিছু না, আপনার হার্ট ডায়ালেট করেছে।
বলেন কি গজেনবাবু?–আমার পিলে পর্যন্ত চমকে যায়।
তিনি দারুন গম্ভীর হয়ে গেলেন–কখনো বেরিবেরি হয়েছিল কি?
হুঁ হয়েছিল। পাশের বাড়িতে। ভয়ে ভয়ে বলতে হোলো। ডাক্তারের কাছে ব্যারাম লুকিয়ে লাভ নেই!
ঠিকই ধরেছি। বেরিবেরির আফটার–এফক্ট-ই এই।
তা হলে কি হবে? আমি অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লাম–তা হলে কি আমি আর বাঁচবো না?
একটু শক্ত বটে। সঙ্গীন কেস। এরকম অবস্থায় যে-কোন মুহূর্তে হার্টফেল করা সম্ভব।
অ্যাঁ! বলেন কি গজেনবাবু! না, আপনার কোনো কথা শুনব না। আমাকে বাঁচাতেই হবে আপনাকে।–করুণ কণ্ঠে বলি–তা যে করেই পারেন আমি না বেঁচে থাকলে আমাকে দেখবে কে? আমাকে দেখবার আর কেউ থাকবে না যে। কেউ আমার নেই।
পাঁচটাকা ভিজিট দিয়ে ফেললাম।–আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখা যাক–গজেন ডাক্তার বললেন–একটা ভিজিটালিসের মিক্সচার দিচ্ছি, আপনাকে। নিয়মিত খাবেন, সারলে ওতেই সারবে।
আমি আর পাঁচটাকা ওঁর হাতে গুঁজে দিলাম–তবে তাই কয়েক বোতল বানিয়ে দিন আমায়, আমি হরদম খাবো।
না, হরদম নয়। দিনে তিনবার। আর, কোথাও চেঞ্জে যান। চলে যান–পশ্চিম টশ্চিম। গেলে ভালো হয়। সেখানে গিয়ে আর কিছু নয়, একদম কমপ্লিট রেস্ট।
প্রাণের জন্য মরীয়া হতে বেশী দেরী লাগে না মানুষের। বললাম–আচ্ছা, তাই যাচ্ছি না হয়। ডালটনগঞ্জে আমার বাড়ি, সেখানেই যাবো।
কমপ্লিট রেস্ট, বুঝেছেন তো? হাঁটা-চলা, কি ঘোরাফেরা, কি দৌড়ঝাঁপ, কি কোনো পরিশ্রমের কাজ একদম না! করেছেন কি মরেছেন–যাকে বলে হার্টফেল–দেখতে শুনতে দেবে না–সঙ্গে সঙ্গে খমত। বুঝেছেন তো অশ্বিনীবাবু?
অশ্বিনীবাবু হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, ডাক্তার দেখাবার আগে বুঝেছেন এবং পরে বুঝেছেন–যেদিনই পাশের বাড়িতে বেরিবেরির সূত্রপাত হয়েছে, সেদিনই তিনি জেনেছেন তার জীবন সংশয়। তবু গজনবাবুকে আশ্বান্ত করি–নিশ্চয়! পরিশ্রম না করার জন্যই পরিশ্রম, তাই করব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এখন থেকে অলস হবার জন্যই আমার নিরলস চেষ্টা থাকবে। এই বলে আমি, ওরফে অশ্বিনীবাবু, বিদায় নিলাম।
মামারা থাকেন ডালটনগঞ্জে। সেখানে তাঁদের ক্ষেত-খামার। মোটা বেতনের সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে জমিটমি কিনে চাষবাস নিয়ে পড়েছেন। বেকার-সমস্যা সমাধানের মতলব ছোটবেলা থেকেই মামাদের মনে ছিল, কিন্তু চাকরির জন্য তা করতে পারছিলেন না। চাকরি করলে আর মানুষ বেকার থাকে, কি করে? সমস্যাই নেই তো সমাধান করবেন কিসের? অনেকদিন মনোকষ্টে থেকে অবশেষে তারা চাকরিই ছাড়লেন।
তারপরেই এই চাষাবাস। কলকাতার বাজারে তাদের তরকারি চালান আসে। সরকারী-গর্বে অনেককে গর্বিত দেখেছি, কিন্তু তরকারির গর্ব কেবল আমার মামাদের! একচেটে ব্যবসা, অনেকদিন থেকেই শোনা ছিল, দেখার বাসনাও ছিল; এবার এই রোগের অপূর্ব্ব সুযোগ ডালটনগঞ্জে গেলাম, মামার বাড়ির যাওয়া হোলো, চেঞ্জেও যাওয়া হোলো এবং চাই কি, তাঁদের সাম্রাজ্য চোখেও দেখতে পারি, চোখেও দেখতে পারি হয়তো বা।