বলেন কি মশাই অ্যাঁ? এবার কল্কেকাশি সত্যিসত্যিই হতবাক হন।
বলে, দাদার ঐ বোনাস পেয়ে পেয়ে আমাদের কারিগররা বোনাই পেয়ে গেল সবাই। গোবর্ধন জানায়।
বোনাই পেয়ে গেলো? সে আবার কি? কল্কেকাশি কথাটার কোনো মানে খুঁজে পান বা–বোনাস থেকে বোনাই!
পাবে না? ব্যাসিলাস-এর বেলা যেমন ব্যাসিলাই। ইংরিজি কি জানিনে নাকি একদম? বোনাস এর বহুবচনে কী হয়? জিনিয়াসের পুরালে যেমন জিনিয়াই, তেমনি বোনাস-এর পুরালে বোনাই-ই তো হবে। হবে?
গোবর্ধন আমার দিকে তাকায়।
ব্যাকরণ মতে তাই হওয়াই তো উচিত। বলি আমি।
বোনাস-এর ওপর বোনাস পেতে ওদের আইবুড়ো বোনদের বিয়ে হয়ে গেলো সব। আপনিই বর-রা এসে জুটে গেলো যতো না! বিনাপণেই বলতে কি! বউয়ের হাত দিয়ে সেই বোনাস-এর ভাগ বসাতেই বোনাইরা জুটে গেলো সব আপনার থেকেই।
এই কথা! কথাটা পরিষ্কার হওয়ায় কল্কেকাশি হাঁফ ছাড়লেন? তাহলেও বাড়ি টাকার অনেকখানিই মজুদ থেকে যায় সে সব টাকা রাখেন? ব্যাঙ্কে না বাড়তি?…তিল তিল করে জমলেও তো তাতাল হয়ে ওঠে একদিন আপনাদের সেই বিপুল ঐশ্বর্য…।
অরণ্যেই ওঁদের ঐশ্বর্য! কথাটা আমি ঘুরিয়ে দিতে চাই : ঐশ্বর্য কি আর ওঁদের বাড়িতে আছে? না,বাড়িতে থাকে? জমিয়ে রাখবার দরকারটাই বা কী? গোটা অরণ্যভূমিই তো ঐশ্বর্য ওঁদের। বনস্পতিরূপে জমানো। কাটা গাছই টাকার গাছ। বলে উদাহরণ দিয়ে কথাটা আরো পরিষ্কার করি–যেমন মড়া মড়া জপতে জপতেই রাম হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি কাটা উলটোলেই টাকা হয়ে যায় মশাই! মানে, কাটা গাছই উলটে টাকা দেয় কিনা! টাকার গাছ তখন।
বুঝেছি। বলে ঘাড় নেড়ে কল্কেকাশি চাড় দেখান-আবার আপনাদের বাড়ি সেই গৌহাটি না কোথায় যেন বললেন না? আসাম থেকেই তো আসা আপনাদের এখানে–তাই নয়? তা আসামের বেশির ভাগই তো অরুণ্য। তাই নয় কি? তাহলে বোধহয় সেই অরণ্যের কাছাকাছি কোথাও…মানে, আপনাদের বাড়ির কাছেই হয়তো কোনো গভীর জঙ্গলেই জমানো আছে, তাই না।
কল্কেকাশির কথায় হর্যবর্ধনের কোনো সাড়া পাওয়া যায় না আর। তিনি শুধু বলেন–হুম। বলেই কেমনধারা গুম হয়ে যান। কল্কেকাশির উদ্যম সত্বেও তার গম্ভীর্যের বাঁধ ভেঙে কথার স্রোত আর গড়াতে পারে না।
আচ্ছা, নমস্কার, আজ আমি আসি তাহলে। বলে উঠে পড়ে আপনার নাম শুনেছিলাম, আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুব আনন্দ হলো। নমস্কার।
লোকটার কথাবার্তা কেমনধারা যেন। কল্কেকাশি গেলে পর মুখ খুললেন হর্ষবর্ধন–আমাদের টাকাকড়ির খোঁজ খবর পেতে চায় লোকটা!
হ্যাঁ দাদা, কেমন যেন রহস্যময়। গোবরা বলে।
তখন আমি ভদ্রলোকের রহস্য ফাঁস করে দিই। জানাই যে, ঐ কল্কেকাশি কোনো কেউকেটা লোক নন, ধুরন্ধর এক গোয়েন্দা। সরকার এখন কালোবাজার এর টাকার সন্ধানে আছে কি না, কোথায় কে কতো কালো টাকা, কালো সেনা জমিয়ে রেখেছে….।
কালো সোনা তো আফিঙকেই বলে মশাই! সোনার দাম এখন আফিঙের সমান। দাদার টীকা আমার কথার ওপর। আমার কি আফিঙের চাষ নাকি?
আবার কেষ্টঠাকুরকেও কালোসোনা বলে থাকে কেউ কেউ! তস্য ভ্রাতার টিপপনি দাদার ওপরে। কালোমানিকও বলে আবার।
এখনকার দিনে কালো টাকা তো কেউ আর বার করে না বাজারে, সোনার বার বানিয়ে লুকিয়ে কোনো খানে মজুদ করে রাখে, বুঝেছেন? আমি বিশদ ব্যাখ্য করি তখন আপনারা কালো বাজারে, মানে, কাঠের কালো বাজার করে প্রচুর টাকা জমিয়েছেন, সরকার বাহাদুরের সন্দেহ। তাই তার আঁচ পাবার জন্যেই এই গোয়েন্দা প্রভুটিকে লাগিয়েছেন আপনার পেছনে।
তাহলে তো বেশ গনগনে আঁচ মশাই মানুষটার। গোবর্ধন বলে, না আঁচলে তো বিশ্বাস নেই…বাচন নেই আমাদের।
সর্বনাশ করেছেন দাদা। হর্ষবর্ধনের প্রায় কাঁদার উপক্রম, আপনি ওই লোকটাকে আসামের অরণ্য দেখিয়ে দিয়েছেন আবার।
এমন সময় টেবিলের ফোন ক্রিং ক্রিং করে উঠলো ওঁর। ফোন ধরলেন হর্ষবর্ধন হ্যালো। কে?…কে একজন ডাকছেন আপনাকে। রিসিভারটা উনি এগিয়ে দিলেন আমায়।
আমাকে? আমাকে কে ডাকতে যাবে এখানে? অবাক হয়ে আমি কর্ণপাত করলাম হ্যালো, আমি শিব্রাম….আপনি কে?
আমি কল্কেরাশি। কাছাকাছি এক ডাক্তারখানা থেকে ফোন করছি আপনাকে। ওখানে বসে থাকতে দেখেই আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি। আপনি বোধহয় চিনতে পারেননি আমার…শুনুন, অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে। অনেকদিন পরে দেখা পেলুম আপনার। আজ রাত্রের ট্রেনে গৌহাটি যাচ্ছি, আসুন না আমার সঙ্গে। প্রকৃতির লীলাভূমি আসাম, আপনি লেখক মানুষ বেশ ভালো লাগবে আপনার। দু-পাঁচ দিন অরণ্যবিহার করে আসবেন এখন। চেঞ্জের কাজও হবে। কেমন, আসছেন তো?
অরণ্যবিহার? আমার সাড়া দিই :–আজ্ঞে না। আমাদের বাড়ি ঘাটশিলায়, তার চারধারেই জঙ্গল পাহাড়। প্রায়ই সেখানে যাই আমি সঠিক বললে, বিহারের বেশির ভাগই অরণ্য। খোদ বিহার-অরণ্যে বাস করি। আমাকে আবার গৌহাটি গিয়ে অরণ্য-বিহার করতে হবে কেন? অরণ্য দেখে দেখে অরুচি ধরে গেছে আমার। আর সত্যি বলতে, এক আধটু লিখিটিখি বটে, তবে কোনো প্রকৃতিরসিক আমি আদপেই নই।
ফোন রেখে দিয়ে হর্ষবর্ধনকে বললাম–ঐ ভদ্রলোক, মনে কল্কেকাশিই ফোন করেছিলেন এখন। আর রাত্রের ট্রেনেই উনি গৌহাটি যাচ্ছেন কিনা…
অ্যাঁ? গৌহাটি যাচ্ছেন। কী বললেন? অ্যাঁ? আতঙ্কিত হন হর্ষবর্ধন, সেরেছে তাহলে। এবার আমাদের সর্বনাশ রে গোবরা।