কিন্তু আপনি এটাকে দাদার অবিমিশকারিতা বলছেন কেন বলুন তো? তস্য ভ্রাতা গোবর্ধন বসে ছিল পাশেই, খট করে বলে বসলো।
ও-কথা তো বলিনি! বলেছি অবিমৃষ্যকারিতা। আমি ওকে শুধরে দিতে চাই।
একই কথা। কিন্তু ওর মানেটা কি, তাই আমি জানতে চাইছি।
মানেটা যে কি, তা আমিও ঠিক জানিনে ভাই! অভিধানে আছে। তবে মনে হচ্ছে তোমার কথাটাতেও ওর মানে পাওয়া যায়। কি মেশাতে গিয়ে কি মেশানো-এ কথার সঙ্গে সে-কথা মিশিয়ে গুলিয়ে গিয়ে কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলা আর কি!
গোয়েন্দা যে লোকটা তা আপনি জানলেন কি করে? জিজ্ঞেস করলেন হর্ষবর্ধন।
চিনি যে ওকে। কল্কেকাশি ওঁর নাম, নামজাদা গোয়েন্দা উনি। অনেকদিন আগে ওঁল সঙ্গে একবার আলাপ হয়েছিল আমার কোন এক সূত্রে। উনি আমাকে চিনতে পারেননি। আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি।
ডিটেকটিভ কল্কেকাশি? গোবরা জিজ্ঞেস করে। হুঁকোকাশি তো জানি, মনোরঞ্জন ভট্টচার্যের ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছিলাম! ডিটেকটিভ হুঁকোকাশি।
তস্য ভ্রাতা হবেন হয়তো বা! জানিনে ঠিক। হুঁকোকাশির ভাই কল্কেকাশি হওয়া বিচিত্র নয়। আমি জানাই।
আমাদের কাছে ওঁকে কন্ধে পেতে হবে না। বললেন হর্ষবর্ধন।
আমাদের ল্যাজে পা দিতে এলে ওঁর কাশী-প্রীপ্তি ঘটিয়ে দেবো আমরা! এখানে আর কল্কে পেতে হবে না।
গোবর্ধন সায় দেয় দাদার কথায়।
হয়েছিল কি, ডিটেকটিভ কল্কেকাশি নিরীহ ভদ্রলোকের মতই এসেছিলেন হর্ষবর্ধনের কাছে এমনি আলাপ করতে। কথায় কথায় তিনি বললেন–আপনাদের ব্যবসায় আর এমন কি লাভ হয় মশাই! সামান্য কাঠের কারবার তো আপনার।
হর্ষবর্ধনের পেটের খবর টেনে বের করার জন্যেই যে কথাটা পাড়া ওঁর, পাড়তেই আমি তা টের পাই।
সামান্য! কথাটায় ওঁর অহমিকায় লাগল। গর্বে তিনি ফেটে পড়লেন তক্ষুনি, বড়াই করে বললেন–বলেন কি মশাই! আমাদের কারবারে পারসেন্ট মুনাফা, আঁচ করতে পারেন তার? চার টাকার কাঠের থেকে আমরা চারশো টাকা লাভ করি তা জানেন? হিসেব করে বলুন তো কত পারসেন্ট লাভ দাঁড়ায় তাহলে?
শুনে তো আমি থ হয়ে যাই, মানসাঙ্ক করেও ওর পারসেন্টেজের কোনো থই পাইনে।
কিরকম, কিরকম? নির্দোষ কৌতূহল দেখা যায় কষ্কেকাশির। হর্ষবর্ধনের হাঁড়ির খবর জানার মতলব তাঁর, আমি বুঝতে পারি বেশ।
কিন্তু আমি ওঁকে সামলাবার আগেই উনি নিজের হাঁড়ি নিজেই হাটে ভেঙে বসেছেন!
কি রকম শুনবেন? শুনুন তাহলে। ছোটনাগপুরের জঙ্গল আমরা ইজারা নিই। জঙ্গলকে জঙ্গল। ওইসব জঙ্গল বরাবর চলে গেছে মধ্যপ্রদেশের সেই দণ্ডকারণ্য অব্দি। অফুরন্ত জঙ্গল সীমা পরিসীমা নেই। এনতার গাছ। সেই সব গাছ কেটে তার ডালপালা হেঁটে কলকাতায় আমদানি করি আমরা। এখানে আমাদের কারখানায় সেইসব ইলাহি কাঠ করাত দিয়ে চিরে তক্তা বানানো হয়–সেই তক্তা আমরা বেচি। বেচি লাভ হয় আমাদের।
কেমনধারা লাভ? কল্কেকাশির ঔৎসুক্য।
তার কি ইয়ত্তা আছে নাকি? জঙ্গলকে জঙ্গল ইজারা নিই, বলো না? নীলাম ডেকে ইজারা নেয়া হয়। গাছ প্রতি আমাদের পরতা পড়ে চার টাকা মতন, সেই চার টাকার গাছের তক্তা বেচে পাই
অন্তত চার শো টাকা। তারপর… বলে তিনি একটু থামেন, দম নিতেই বোধ করি।
তারপর? কল্কেকাশি উসকে দেন ওঁকে নতুন উদ্যম দেবার জন্যেই বোধ হয়।
দম পেয়ে তিনি শুরু করেন আবার–তারপর ঐ সব তক্তার থেকে যদি আমরা আলনা, আলমারি, দেরাজ, ডেসক, টেবিল, চেয়ার, খাট, পালঙ্ক ইত্যাদি নানান আসবাব পত্তর বানিয়ে বেচি, তাহলে গোড়াকার সেই চার টাকার মুনাফাই হয়ে দাঁড়াবে চার হাজার টাকা। বুঝলেন এবার?
না না, এর মধ্যে শ্রমের প্রশ্নও রয়েছে যে! লেবারটাও ধরতে হবে। এই সব বানাতে কারিগরদের মজুরি দিতে হয় না? তাদের চারজও তো চারগুণ এখন। মুনাফার সবটাই আপনার সেবায় নয় মশাই! দেবার দিকটাও রয়েছে আবার। ওঁর কথায় বিপক্ষে বলে ওঁর পক্ষ সমর্থনের প্রয়াস আমার।
তা আছে। মেনে নেন হর্ষবর্ধন ও তা আছে বইকি। সেটাও ধর্তব্য ঐ সঙ্গে। তবে তা ধরেও..।
বিস্তর মুনাফা হয়, তাই না? কল্কেকাশি ওঁকে দম দেন আবার।
তা তো হয়ই। না হয়ে কি আর যায় মশাই? যাবার যো কী!
অ্যাতো টাকা আপনি রাখেন কোথায়! আনাড়ির মতই জিজ্ঞাসা কষ্কেকাশির। একটু যেন বিস্ময়ের সুরেই।
টাকা কি আবার রাখা যায় নাকি? রাখতে পারে কখনো কেউ? আপনার থেকেই তো উড়ে যায় টাকা। টাকার যা দস্তুর।
কেমন করে যায় কে জানে! গোবরার সায় দেওয়া। আসতে না আসতে চলে যায়।
কি করেন অ্যাতো টাকা দিয়ে? তবুও শুধান উনি-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওঁর সেই এক কথাই।
বিলিয়ে দিই। কি আবার করবো? হর্ষবর্ধনের সরল জবাব–টাকা নিয়ে কি করে মানুষ?
বিলিয়ে দেন! অবাক হন কল্কেকাশি। তার বিশ্বাস হয় না বলাই বাহুল্য।
বিল মেটাতেই চলে যায় টাকা। বেতনের বিল, বোনাসের বিল। বলেন হর্ষবর্ধন ও আমার কারখানার মজুর-করিগরকে মাইনে দিতেই কী কম টাকাটা যায় মশাই? বেতন মিটিয়ে, বোনাস দিয়ে কী আর থাকে বলুন।
কতো আর দেন বোনাস! বড়জোর তিনমাসের?
তাতে দিই-ই সব কোম্পানিই তা দেয়। তবে তারা দেয় বছরে তিনমাসের, আর আমি দিই প্রতি মাসে।
তার মানে?
মানে, মাস মাস তিন মাসের বেতন বাড়তি দিয়ে যাই। না দিলে চলবে কেন ওদের? জিনিসপত্রের দাম কি তিনগুণ করে বেড়ে যায়নি বলুন।