আপনার কি গয়নার বাকস চুরি যায়নি আজ? দারোগা জিজ্ঞাসা করেন।
বিশ্বেশ্বরবাবু ভারি মুশড়ে যান। চুপ করে থাকেন। কি আর বলবেন তিনি?
চুরির খবর থানায় রিপোর্ট করেন নি কেন তবে?- দারোগাবাবু হুমকি দেন।
গিন্নী বলছিলেন বটে চুরি গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। কার্তিকের দিকে ফেরেন এবার–এই, তুই এখানে কি করছিস? দাঁড়িয়ে কেন? বাড়ির ভেতরে যা। কাজ কর্ম নেই?
এই বুঝি আপনার সেই চাকর? কিরে ব্যাটা, তুই কিছু জানিস চুরির?
জানি বইকি হুজুর, সবই জানি। চুরি গেছে তাও জানি কি চুরি গেছে তাও জানি–কার্তিক বলতে থাকে।
বিশ্বেশ্বরবাবু বাধা দেন–দারোগাবাবু, অ্যাকে ছেলেমানুষ তার ওপর ওর মাথা খারাপ। চারক হয়ে টেড়ি কাটে, দেখছেন না? কি বলতে কি বলে ফেলবে, ওর কথায় কান দেবেন না। বহুদিন থেকে আছে, ভারী বিশ্বাসী, ওর ওপর সন্দেহ হয় না আমার।
বহুদিনের বিশ্বস্ততা একদিনেই উবে যায, লোভ এমনই জিনিস মশাই!–দারোগাবাবু, বলেন, আকচারই দেখছি এরকম। কার্তিকের প্রতি জেরা চলে–এ চুরি-কার কাজ বলে তোর মনে হয়?
আর কারো কাজ নয় হুজুর, আমারি কাজ।
কেন করতে গেলি এ কাজ?
ঐ তো আপনিই বলে দিয়েছেন হুজুর। লোভের বশে! কার্তিক প্রকাশ করে, তা শিক্ষাও আমার হয়েছে তেমনি। সবই বলব আমি, কিছুই লুকবো না হুজুরের কাছে।
যা যাঃ! আর তোকে সব বলতে হবে না! বিশ্বেশ্বরবাবু দুজনের মাঝে পড়েন, ভারি বক্তা হয়েছেন আমার! অমন করলে খালাস করাই শক্ত হবে তোকে। দারোগাবাবু, ওর কথায় কান দেবেন না আপনি।
দারোগাবাবু বিশ্বেশ্বরের কথায় কান দেন না–কোথায় সে সব গয়না? কার্তিককেই জিজ্ঞাসা করেন।
কোথায় আবার? আমারই বিছানার তলায়! বিরক্তির সঙ্গে বিস্তারিত করে কার্তিক।
ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে নাড়াচাড়া শুরু করতেই কার্তিকের লাখটাকার স্বপ্ন বেরিয়ে পড়ে। নেকলেস, ব্রেসলেট, টায়রা, হার, বালা, তাগা, চুড়ি, অনন্ত–সব কিছুরই অন্ত মেলে। দড়ি দিয়ে বাধা হয় কার্তিককে। সে কিন্তু বেপরোয়া। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু নিজেই ওকালতি শুরু করেন ওর তরফে–-দেখুন দারোগাবাবু! নেহাত ছেলেমানুষ, লোভের বশে একটা অন্যায় করেই ফেলেছে। ছেলেবেলা থেকে আছে, প্রায় ছেলের মতই, আমার কোন রাগ হয় না ওর ওপর। এই ওর প্রথম অপরাধ, প্রথম যৌবনে এবারটা ওকে রেহাই দিন আপনি। সুযোগ পেলে শুধরে যাবে, সকলেই অমন শুধরে যায়। যে অভিজ্ঞতা আজ ওর লাভ হলো তাই ওর পক্ষে যথেষ্ট। অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ বড় হয় জীবনে। এই থেকে ও কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, কলকাতার মেয়রও হতে পারে একদিন–হবে না যে তা কে বলবে? আর যদি নিতান্তই রেহাই না দেবেন, তবে দিন ওকে গুরুতর শাস্তি। আমি তাই চাই আপনার কাছে। চুরির চেয়েও গুরুতর। ও কি চোর? ও চোরের অধম। ও একটা গুণ্ডা! দেখছেন না কি রকম টেরি? ওকে আপনাদের গুণ্ডায়্যাক্টে একসটার্ন করে দিন–ঘাড় ধরে বার করে দিন এ দেশ থেকে। যাবজ্জীবন নির্বাসন। আমি ওকে এক বছরের বেতন আর গাড়িভাড়া আগাম গুণে দিচ্ছি, ও এক্ষুণি কেটে পড়ক, ছাপরা কি আরা জিলায়–যেখানে খুশি চলে যাক। গয়না তো সব পাওয়া গেছে, কেবল সাধু হবার, নতুন করে জীবন আরম্ভ করবার একটা সুযোগ দিন ওকে আপনি।
বিশ্বেশ্বরবাবুর বক্তৃতায় দারোগার মন টলে! কেবল বক্তৃতাই নয়, সেইসঙ্গে বক্তার দুই নয়নের দর বিগলিত ধারায় দারোগাবাবু বিমুগ্ধ, ব্যথিত, ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি শিকার ফেলে চিত্তবিকার নিয়ে চলে যান।
পুলিশের কবল থেকে অব্যাহতি পেয়েও একটুও কাহিল হয় না কার্তিক। তার সঙ্গে যেন ভয়ানক অদ্ৰতা করা হয়েছে, ভয়ানক রকম ঠকানো হয়েছে তাকে, এহেন ধারণার বশে একটা জিঘাংসার ভাব তার প্রত্যেকটি আচরণ- বিচরণ থেকে প্রকাশ পেতে থাকে।
অবশেষে চিরবিদায়ের আগের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। কর্তা অনেক আদর আপ্যায়নে, অযথা বাক্য বিস্তারে, অযাচিত বখশিসের প্রাচুর্য দিয়ে ওর যাবজ্জীবন নির্বাসনের দুঃখ ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু ও কি ভোলে? ওর ব্যথা কি ভোলবার? ওই জানে!
তোমার আদরেই তো সর্বনাশ হয়েছে ওর! মানুষ এমন নেমকহারাম হয়! গিন্নী নিজের অসন্তোষ চাপতে পারেন না–যথেষ্ট মাথা খেয়েছে, আর কেন? বরং, দড়ি-কলসী কিনে ডুবে মরতে বলল ওকে!
নিতে যাবার আগে শেষবারের মতন উসকে ওঠে কার্তিক। দড়ির ভাবনা নেই, কর্তার পুজোয় দেওয়া ছেঁড়া সিল্কের জামাটা পাকিয়েই দড়ি বানিয়ে নেব, কিন্তু কলসী আর হলো কোথায়? বড় দেখেই কলসী গড়াতেই চেয়েছিলাম মাঠাকরুণ, কিন্তু গড়তে আর দিলেন কই? হ্যাঁ, বেশ ভাল একটা পেতলের কলসী হত– বলে একটু থেকে সে উপসংহার করে আপনার গয়নাগুলি গালিয়েই!
কল্কেকাশির অবাক কাণ্ড
আপনার একটু অবিমৃষ্যকারিতা হয়েছে, বললাম অমি হর্ষবর্ধনকে : মানে ঐভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। ঐ লোকটা আসলে এক ডিটেকভিট। আপনার টাকাকড়ির খোঁজ খবর নিতেই এসেছিলো।
তাতে ওর লাভ? ওকে কি আমার টাকাকড়ির ভাগ দিতে হবে নাকি?
গভর্নমেন্ট থেকে ওকে লাগিয়ে থাকবে হয়তো। ইনকমট্যাকস-এর তরফ থেকেও হতে পারে! মুনাফাবাজদের পাকড়াবার চেষ্টা হচ্ছে না আজকাল? আপনি আবার ফলাও করে নিজের মুনাফার কথা জাহির করলেন ওর কাছে, এক কথায়, Moon offer করলেন, চাঁদ তুলে দিলেন ওর হাতে।