দেখুন বিশ্বেশ্বরবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাবেন না। আপনার ও চারটি কম নয়। আমরা তখন থেকেই জানি। যে চাকর টেরি কাটে, সে চোর ছাড়া আর কি হবে? আমরা সবাই জানতে পেরেছি, আপনার গিন্নীর থেকে আমাদের গিন্নী, আমাদের গিন্নীদের থেকে আমরা।
হ্যাঁ, কিছুই জানতে বাকি নেই। জনতার ভেতর থেকে একজন বেশি উৎসাহ দেখায় এখন কোথায় গেল সেই হতভাগা! পিটিয়ে লাশ করব তাকে। সেই জন্যই আমরা এসেছি।
দেখুন, সমস্তই যখন জেনেছেন তখন আর লুকোতে চাই না।–বিশ্বেশ্বরবাবু বলেন–কিন্তু একটা কথা। মেরে কি লাভ হবে? মারলে অন্য অনেক কিছু বেরুতে পারে, কিন্তু গয়না কি বেরুবে?
আলবৎ বেরুবে।–তাদের মধ্যে দারুণ মতের ঐক্য দেখা যায়, বার করে তবে ছাড়বো। বেরুতেই হবে।
বিশ্বেশ্বরবাবু দেখেন, এরা সব বাল্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত এ যাবকাল বাবার কাছে, মাস্টারের কাছে, স্কুলে আর পাঠশালায়, খেলার মাঠে আর সিনেমা দেখতে গিয়ে সার্জেন্টের আর গুণ্ডার হাতে যেসব ঠেঙান, ঠোক্কর আর তো খেয়ে এসেছে আজ সুদে আসলে নিতান্তই ধরা পড়ে যাওয়া কার্তিককেই তার সমস্ত শোধ দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। বেওয়ারিশ মাথায় চাদা করে চাটাবার এমন অধোদয়যোগে সহজে এরা হাতছাড়া করবে না। তবু তিনি একবার শেষ চেষ্টা করেন একটা কথা ভাবার আছে। শাস্ত্রে বলে ক্ষমা হি পরমো ধর্মঃ। মার্জনা করে দেওয়াই কি ভাল নয় ওকে?
আপনার চুরি গেছে আপনি ক্ষমা করতে পারেন। আপনার চাকর আপনি তো মার্জনা করবেনই। কিন্তু আমরা পাড়ার পাঁচজন তা করতে পারি না।
কি মুশকিল, কি মুশকিল! তাহলে এক কাজ করুণ আপনারা। অর্ধেক লোক যান হাওড়ায়, অর্ধের শেয়ালদায়। এই দুটো পথের একট পথেই সে উধা হয়েছে এতক্ষণ।
পাড়ার লোকেরা হতাশ হয়ে চলে যায়। পলায়মান চোরের পশ্চাদ্ধাবনের উৎসাহ প্রায় কারোরই হয় না। বিশেশ্বরবাবুর আবার কাগজের মধ্যে ফিরে আসেন। এমনই সময়ে টেরি সমন্বিত কার্তিকের আবির্ভাব।
কি রে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? বিশ্বেশ্বরবাবু খবরের কাগজ থেকে চোখ তোলেন। সকাল থেকে তো দেখতে পাইছি। ওঁর কণ্ঠে সহানুভূতির সুর।
আত্মীয়র বাড়ি গেছলাম–আমতা আমতা করে কার্তিক। কিন্তু একটু পরেই ফোঁস করে ওঠে–গেছলাম এক স্যাকরার দোকানে।
বিশ্বেশ্বরবাবু যেন ঘাবড়ে যান–আহা, কোথায় গেছলি আমি জানতে চেয়েছি কি! যাবি বই কি, একটু বেড়াতে টেড়াতে না গেলে হয়। বয়স হয়েছে আর পেরে উঠি না তাই, নইলে আমিও এককালে প্রাতঃভ্রমণ করতাম! রেগুলারলি।
গিন্নীমা আমার নামে যা–নয়–তাই বদনাম দিয়েছেন। পাড়ায় কান পাতা যাচ্ছে না–চাপা রাগে ফেটে পড়তে চায় কার্তিক।
বাধা দেন বিশ্বশ্বরবাবু–ওর কথা আবার ধরে নাকি! মাথার ঠিক নেই ওর। তুই কিছু মনে করিসনে বাপু।
আমি কিনা–আমি কিনা–কার্তিক ফুলে ফুলে ওঠে। অকথ্য উচ্চারণ ওর মুখ দিয়ে বেরুতে চায় না।
আহা কে বলছে! বিশ্বেশ্বরবাবু সান্ত্বনা দেন, আমি কি বলেছি সে কথা? বলিনি তো? তা হলেই হল।
পাড়ার পাঁচজনের নাকি আমায় পুলিশে দেবে। দিক না–দিয়েই দেখুক না মজাটা
হ্যাঁ, পুলিশে দেবে! দিলেই হল!–বিশ্বেশ্বরবাবু সাহস দেন–হ্যাঁ, দিলেই হল পুলিশে। কেন মিছে ভয় খাস বলতো। ওরা পুলিশে দেবার কে? আমি আছি কি জন্যে?
ভয় যার খাবার সেই খাবে। আমি কেন ভয় খেতে যাবো? কোনো দোষে দুষী নই আ আমারই যত বদনাম। আসুক না একবার পুলিশ। আমি নিজেই না হয় যাচ্ছি থানায়।
বিশ্বেশ্বরবাবু বেজায় দমে যান এবার–আরে, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কোথায় পুলিশ, কে কাকে দিচ্ছে তার ঠিক নেই, হাওয়ার সঙ্গে লড়াই। একটু থেকে ট্যাক থেকে একটা টাকা বের করেন–বদনাম দিয়েছে তার হয়েছে কি! গায়ে কি লেগে রয়েছে? এই নে, বকশিস নে–কিছু খা গিয়ে।
ঝনাৎ হতেই তৎক্ষণাৎ তুলে নেয় কার্তিক। একটু ঠাণ্ডা হয় এতক্ষণে।
কিন্তু একটা কথা বলি বাপু। যদি কিছু নিয়েই থাকিস, এখান থেকে সরিয়ে ফেল। একখানাও রাখিস নি যেন এখানে। পাড়ার লোক যখন খবর দেয়, পুলিশ যদি এসেই পড়ে, খানাতল্লাসী হতে কতক্ষণ? সদুপদেশ দিতে যান বিশ্বেশ্বরবাবু!
কী নিয়েছি, নিয়েছি কি? কার্তিক ক্ষেপে ওঠে।
আমি কি বলেছি কিছু নিয়েছিস? কিছু নিসনি। তবু যদি কিছু নিয়ে থাকিস বলে তোর সন্দেহ হয়।…আচ্ছা, এক কাজ কর না কেন কার্তিক? আমি তোকে গাড়ি ভাড়া এবং আরো কিছু টাকা দিচ্ছি, এখান থেকে পালিয়ে যা না কেন?
কেন পালাবো? আমি কি চুরি করেছি? তবে পালাব কেন? কার্তিক দপদপ করে জ্বলতে থাকে।
আহা, আমি কি পালাতে বলেছি? বলছি, দিনকতক কোথাও বেড়াতে যা না? এই হাওয়া খেতে, কি চেঞ্জে কোথাও শিলঙ কি দার্জিলিং, পুরী কিম্বা ওয়ালটোয়ারে? লোকে কি যায় না? চুরি না করলে কি যেতে নেই? দেশেও তো যাসনি অনেকদিন! আমি বলি কি–
কিন্তু তাঁর বলাবলির মধ্যে বাধা পড়ে। বিশ্বেশ্বরবাবু বাড়ি আছেন? বলতে বলতে কতকগুলি ভারী পায়ের শব্দ ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে, সটান তাঁর ঘরের মধ্যে এসে থামে। জনকতক পাহারাওলা নিয়ে স্বয়ং দারোগাবাবুকে দেখা যায়।
আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ। আপনি নাকি বাড়িতে চোর পুষেছেন?
বিশ্বেশ্বরবাবু আকাশ থেকে পড়েন, এসব মিথ্যে কথা কে লাগাচ্ছে বলুন তো? কার খেয়েদেয়ে কাজ নেই? ঘর-বাড়ি কি চোর পুষবার জন্যে হয়েছে? কেউ শুনেছে কখনো এমন কথা?