সব পারে ওরা। হাঁস আর পুলিস, ওদের পারতে কতক্ষণ? বিশ্বেশ্বরবাবু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন, তবে তফাত এই, হাঁস পাড়ে হাঁসের ডিম। আর ওরা পাড়ে ঘোড়ার ডিম। ঘোড়ার ডিমের আবার মাললেটও হয় না, একেবারে অখাদ্য। তাঁর মুখ বিকৃত হয়।
তোমাকে কক্ষনো ধরবে না।–গিন্নী সজোরে বলেন।
না ধরবে না আবার। আমাকেই তো ধরবে। বিশ্বেশ্বরবাবুর দৃঢ় বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয় । আর ধরলেই আমি স্বীকার করে ফেলব। তা বলে রাখছি কিন্তু। করাবেই ওরা আমাকে স্বীকার। স্বীকার করানোই হলো কাজ, তাহলেই ওদের চুরির কিনারা হয়ে গেল কিনা।
চুরি না করেও তুমি স্বীকার করবে চুরি করেছ?
করবই তো! পড়ে পড়ে মার খেতে যাব নাকি? সকলেই স্বীকার করে। করাটাই দস্তুর। আর নাও যদি মারে, হাজত বলে এমন একটা বিশ্রী জায়গায় আটকে রাখে শুনেছি সেখানে ভারী আরশোলা, আর নেংটি ইঁদর। আরশোলা আমার দুচক্ষের বিষ, আর নেংটি ইঁদুর? বাবাঃ, সে বাঘের চেয়েও ভয়ানক! অমন অবস্থায় পড়লে সকলকেই স্বীকার করতে হয়।
যদি তেমন তেমন দেখ না হয় স্বীকার করেই ফেল। তাহলেই ছেড়ে দেবে তো?
হ্যাঁ, দেবে। একেবারে জেলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে।
তবে কাজ নেই তোমার স্বীকার করে।–গিন্নী এবার শান্ত হন, গয়না আমি চাই না।
হ্যাঁ, সেই কথাই বল! আমি বেঁচে থাকতে তোমার ভাবনা কি? আবার গয়না গড়িয়ে দেব না হয়।
হ্যাঁ, দিয়েছ! সেবার বালিগঞ্জের জমিটা বিক্রী করেই তো হলো!
এবার না হয় টালিগঞ্জের বাড়িটাই বেচে ফেলব।
এতক্ষণে গিন্নীর মুখে হাসি দেখা দেয়–জমিটা বেচে পাঁচ হাজার টাকার গয়না হয়েছিল। পুরানো বাড়ির আর কত দাম হবে?
যতই কম হোক, বিশ হাজারের কম তো না। আমি ব্যঙ্কে টাকা জমানোর চেয়ে গয়না গড়িয়ে রাখতেই বেশি ভালবাসি। তুমি তো জানো! মাটিতে পুঁতে রাখার চেয়েও ভাল।–একটু দম নেন–হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জলে ফেলে দেওয়ার চেয়েও।
কিন্তু এত টাকার গয়না! পুলিসে খবর না দাও, নিজে থেকেও একটু খোঁজ করলে হতো না! হয়তো পাওয়া যেত একটু চেষ্টা করলে।
হ্যাঁ, ও আবার পাওয়া যায়। তা আর ফেরে না। ও আমি অনেকবার দেখেছি। কেবল খোঁজাখুঁজিই সার হবে! বিশ্বেশরবাবু বুড়ো আঙুল নাড়েন।
তবু–গিন্নীর তথাপি খুঁত-থুতুনি যায় না।
খুঁজব কি, কে নিতে পারে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না। বিশ্বেশ্বরবাবু কপাল কোচকান, কার যে এই কাজ?
কার আবার! কার্তিকের! তা বুঝতেও তোমার এত দেরি হচ্ছে। যে চাকর টেরি কাটে, সে চোর হয়ে যায় না।
কার্তিক? এতদিন থেকে আছে, অমন বিশ্বাসী? সে চুরি করবে তা কি হয় কখন?
সে করবে না তো কি আমি করেছি? গিন্নী এবার ক্ষেপে যান।
তুমি?–বিশ্বেশরবাবু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকান–তোমার নিজের জিনিস নিজে চুরি করবে? আমার বিশ্বাস হয় না।–
তাহলে কি তুমি করেছ?
আমি? অসম্ভব। বিশ্বেশ্বরবাবু প্রবলভাবে ঘাড় নাড়েন।
তুমি করোনি, আমিও করিনি, কার্তিকও করেনি–তাহলে কে করতে গেল? বাড়িতে তো এই তিনটি প্রাণী! গৃহিণী অন্তরের বিরক্তি প্রকাশ করেই ফেলেন।
তাই তো ভাবনায় বিষয়। বিশ্বেশ্বরবাবু মাথা ঘামাবার প্রয়াস পান,এইখানেই গুরুতর রহস্য! গোয়েন্দার মতো গোলমেলে হয়ে ওঠে তার মুখ।
তোমার রহস্য নিয়ে তুমি থাকো, আমি চললুম। গয়না গেছে বলে পেট তো মানবে না, চলে যেতে যেতে বলে যান গিন্নী, তুমি টালিগঞ্জের বাড়িটার বিহিত কর এদিকে, তাছাড়া আর কি হবে তোমাকে দিয়ে! গয়নার কি গতি করতে পারি, আমি নিজেই দেখছি।
কার্তিককে কিছু বোল না যেন। প্রমান নেই, বৃথা সন্দেহ করলে বেচারা আঘাত পাবে মনে।–কর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
কি করতে হয় না হয় সে আমি বুঝব।
আর পাড়ায় কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। বিশ্বেশ্বরবাবু ঈষৎ ব্যস্তই হন–চুরি যাওয়া একটা কেলেঙ্কারীই তো?
অত টাকার গয়না, একদিন গা সাজিয়ে পরতেও পেলুম না। তোমার জন্যেই তো। কেবলই বলেছ, গয়না কি পরবার জন্যে। ও-সব বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! এখন হল তো, সব নিয়ে গেল চোরে? গিন্নীর কেবল কাঁদতে বাকী থাকে।
সে তো তোমার ভালই জন্যেই বলেছি। পাড়ার লোকের চোখ টাটাবে। তোমার হিংসে করবে–সেটা কি ভাল?
বেশ, তবে এবার ওদের কান টাটাক। আমি গলা ফাটিয়ে ডাক ছেড়ে বলব যে, আমায় অ্যাতো টাকার গয়না ছিল। বলবই তো!
উঁহুহু। তাহলেই পুলিসে জানবে। চুরির কিনারা হবে, ভারী হাঙ্গামা। ও নিয়ে উচ্চবাচ্যও কোরো না। আমি আজ বিকেলেই বরং টালিগঞ্জে যাচ্ছি।
গিন্নী চলে গেলে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়েন বিশ্বেশ্বরবাবু। নিজের গৃহের সমস্যা থেকে একেবারে স্পেনের গৃহ সমস্যায়। বিশ্ব ব্যাপারে ওতঃপ্রোত হয়ে কতক্ষণ কাটে বলা যায় না, হটাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়া ওঁকে সচকিত করে। নিচে নেমে যেতেই পাড়ার সবাই ওঁকে হেঁকে ধরে।
কোথায় গেল সেই বদমাইশটা? তাকেই জিজ্ঞাসা করে সবাই।
কে গেল কোথায়? বিশ্বেশ্ববাবু বিচলিতই হন।
সেই গুণধর আপনার চাকর? কার্তিক? চুরি করে পালিয়েছে বুঝি?
পালিয়েছে? কই তা জানি না! কার চুরি করল আবার?
আপনাকেই তো পথে বসিয়ে গেছে আর অপনিই জানেন না? আশ্চর্য!
আমাকে? পথে বসিয়ে? বিশ্বেশ্বরবাবু আরো আশ্চর্য হন, আমি তো এতক্ষণ ওপরেই বসেছিলাম।