চমৎকার! খাসা! কী গল্পই না পড়লে সেদিন! যেমন লেখায় তেমনি পড়ায়-লেখাপড়ায় যে তুমি এমন ওস্তাদ তার পরিচয় তো ইস্কুলে কোনোদিন দাওনি হে! সব্যসাচি যদি কাউকে বলতে হয় তো সে তোমায়! আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছ, মাইরি!
আমি কম অবাক হইনি। প্রতিবাদ করতে যাব, কিন্তু হাঁ করবার আগেই আরেকজন হাঁ হাঁ করে এসে পড়েছে :
তোমার গল্প অনেক পড়েছি! ঠিক পড়িনি বটে, তবে শুনতে হয়েছে। বাড়ির ছেলেমেয়েরাই গাড়ে পড়ে শুনিয়ে দিয়েছে। শোনাতে তারা ছাড়ে না–তা সে শোনাও পড়াই মতই! কিন্তু যা পড়া সেদিন তুমি পড়লে তার কাছে সে সব কিছু লাগে না। আমার ছেলেমেয়েদের পড়াও না। হ্যাঁ, সে পড়া বটে একখান! আহা, এখনো এই কানে–এইখানে লেগে রয়েছে হে!
তাঁর মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন আরেকজন! গল্প শুনে তো হেসে আর বাঁচিনে ভায়! আশ্চর্য গল্পই পড়লে বটে! বাড়ি সুদ্ধ সবাই আমার দুধের ছেলেটা পর্যন্ত উত্তর্ণ হয়েছিল, কখন তুমি গল্প পড়বে! আর যখন তুমি আরম্ভ করলে সেই শুকুরবার না কোনবারে–বিকেরের দিকেই না?–আমরা তো শুনবামাত্র ধরতে পেরেছি–এমন টক-মিষ্ট-ঝাল-ঝাল-নোনতা গলা আর কার হবে? আমার কোলের মেয়েটা পর্যন্ত ধরতে পেরেছে যে আমাদের রামদার গলা!
রামদা-টা গলা থেকে তুলতে না তুলতেই অপর এক ব্যক্তির কাছে শুনতে হলো : বাহাদুর, বাহাদুর! তুমি বাহাদুর! রেডিয়োর গল্প পড়ার চানস পাওয়া সহজ নয়, কোন ফিকিরে কি করে জোগাড় করলে তুমিই জানো! তারপরে সেই গল্প মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে রগরানো–সে কি চাটটিখানি? আমার তো ভাবতেই পা কাঁপে, মাথা ঘুরতে থাকে! কি করে পারলে বলো তো? আর পারে বলে পারা–অমন নিখুঁত ভাবে পারা–যা একমাত্র কেবল হাঁসেরাই পারে। আবার বলি, তুমি বাহাদুর!! তারাই আমায় তাক লাগিয়ে দিল। রেডিয়োর স্বর্গে যাবার পথে উপসর্গে আটকে অ্যাম্বুলেন্স চেপে আধুনিক পাতালে যাওয়ার অমন গালভরা খবরটা ফাঁস করার আর ফাঁক পেলাম না।
একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা
বিশ্বেশ্বরবাবু সবেমাত্র সকালের কাগজ খুলে বিশ্বের ব্যাপারে মনযোগ দেবার চেষ্টা পাচ্ছেন, এমন সময়ে বিশ্বেশ্বর–গৃহিণী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। ওগো সর্বনাশ হয়েছে–!
বিশ্বজগৎ থেকে তার বিনীত দৃষ্টিকে অপসারিত করেন বিশ্বেশ্বরবাবু। চোখ তুলে তাকান গৃহিণীর দিকে।
ওগো আমার কি সর্বনাশ হলো গো। আমি কি করবো গো!
বিশ্বেশ্বরবাবুকে বিচলিত হতে হয়। কি–হয়েছে কি?
চুরি গেছে। আমার সমস্ত গয়না। একখানাও রাখেনি গো–
বিশ্বেশ্বরবাবুর বিশ্বাস হয় না প্রথমে। ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করেন তিনি। অবশেষে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন–ও! গয়না চুরি! তাই বলো! আমি ভেবেছি না জানি কি! বিশ্বেশ্বরবাবু যোগ করেন। তার য়্যানাটমিতে ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না।
আমার অত গয়না! একখানাও রাখেনি গো!
একখানাও রাখেনি নাকি? বিশ্বেশ্বরবাবু বাঁকা ঠোঁটে ঈষৎ হাসির আভাস যেন উঁকি মারে।– তা হলে ভাবনার কথা তো।
বিশ্বেশ্বরবাবুর ভাবভঙ্গি গৃহিণীকে অবাক করে, কিন্তু অবাক হয়ে থাকলে শোক প্রকাশের এমন সুযোগ হারাতে হয়। এহেন মাহেন্দ্র যোগ জীবনে কটা আসে?
ভাবনার কথা কি গো! আমার যে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কে আমাদের এমন সর্বনাশ করে গেল গো–তারস্বর ছাড়তে উদ্যত হন তিনি।
যাক, যেতে দাও। যা গেছে তার জন্য আর দুঃখ করে কি হবে?–হাসি মুখেই বলেন বিশ্বেশ্বরবাবু–গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য্য।
এহেন বিপর্যয়ের মধ্যেও হাসতে পারছেন বিশ্বেশ্বরবাবু? সর্বস্তান্ত হয়ে দুঃখের ধাক্কায় তার মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? না, গিন্নীকে সান্ত্বনা দিতেই তার এই হাসিখুশির ভান? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না, না পেরে আরো তিনি বিগড়ে যান–তুমি বলছ কি গো! হায় হায় আমার কি সর্বনাশ হল গো! বাজখাই গলা বার করেন গৃহিণী।
আরে থামো থামো, করছ কি। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু সত্যিই বিচলিত হন–চেপে যাও, পাড়াব লোক জানতে পারবে যে!
বয়েই গেল আমার!–গিন্নী খাপ্পা হয়ে ওঠেন–আমার এত টাকার গয়না গেল আর পাড়ার লোক জানতে পারবে না। কোনদিন গা সাজিয়ে পরতে পেলুম না, দেখাতেও পেলুম না হিংসুটেদের। জানুক না মুখপোড়ারা–মুখপুড়িরা।
উঁহুহু, তুমি বুঝছ না গিন্নী! বিশ্বেশ্বরবাবু মুখখানা প্যাচার মতো করে আনেন–চুরির খবর পেলে পুলিস এসে পড়বে যে!
পুলিস? পুলিসের কথায় গিন্নীর ভয় হয়।
আর পুলিস এলই বাড়িঘর সব খানাতল্লাসী হবে! আষাঢ়ের ঘন মেঘে বিশ্বেশ্বরবাবুর হাঁড়িপানা-মুখে ভারী হয়ে আসে। সে এক হাঙ্গামা।
এবার ভড়কে যান গিনী।–কেন, চুরি গেলেই পুলিস খবর দেয় এই তো জানি। চোরেই তো পুলিসের কিনারা করে। পরমুহূর্তেই ভুল শুধরে নেন–উঁহু! পুলিসেই তো চুরির কিনারা করে, চোরকেও পাকড়ায়!
সে হাতেনাতে ধরতে পারলেই পাকড়ায়–বিশ্বেশ্বর গোঁফে মোচড় দেয়, তা না হলে আর পাকড়াতে হয় না।
হ্যাঁ হয় না;–গিন্নী মাতা নাড়েন, তুমি বললেই আর কি?
তা তেমন পীড়াপীড়ি করলে নিয়ে যায় পাকড়ে। একটাকে নিয়ে গেলেই হলো! এখানে চোরকে হাতে না পেয়ে আমাকেই ধরে কিনা কে জানে!
তোমাকে কেন ধরতে যাবে? গিন্নীর বিস্ময় হয়।