আর তা ছাড়া, রেডিয়োর সময়টাতেই তারা কেন যে এত ভেজাল জোটায় আমি তো ভেবে পাই না। পূর্ব্বজন্মের তপস্যার পুণ্যফলে রেডিয়োকে যদি ঘরে আনতে পেরেছিস–তাই নিয়েই দিনরাত মশগুল থাক–তা না। অন্তত প্রোগ্রামের ঘণ্টায় যে কখনো কক্ষচ্যুত হতে নেই একথাও কি তোদের বলে দিতে হবে? আর সব তালে ঠিক আছিস কেবল রেডিয়োর ব্যাপারেই তোরা আনরেডি–সব তোদের উল্টোপাল্টা!
সত্যি, আমার ভারী রাগ হতে লাগল। অবিশ্যি, ওদের কেউই আমাকে আশ্বাস দিতে কসুর করল না যে যত ঝামেলাই থাক যেমন করে হোক, আমার গল্পটার সময়ে অন্তত ওরা কান খাড়া রাখবে–যত কাজই থাক না, এটাও তো একটা কাজের মধ্যে। বন্ধুর প্রতি কর্তব্য তো। এমন কি কলকাতার বর্হিগামী সেই বান্ধবটিও ভরসা দিয়ে গেলেন যে ট্রেন ফেল করার আগের মিনিট পর্যন্ত কোনো চুল-ছাঁটা সেলুনের সামনে দাঁড়িয়ে যতটা পারা যায় আমার গল্পটা শুনে তবেই তিনি রওনা দেবেন।
সবাইকে ফলাও করে জানিয়ে ফিরে এসে গল্পটা ফলাতে লাগা গেল! সর্বমত্যন্তম-এর সঙ্গে যুতমত, মজবুতমতো একটা কাহিনীকে জুড়ে দেয়াই এখন কাজ।
কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল কাজটা মোটেই সহজ নয়। গল্প তো কতই লিখেছি, কিন্তু এ ধরনের গল্প কখনো লিখিনি। ছোট্ট একটুখানি বীজ থেকে বড় বড় মহীরূহ গজিয়ে ওঠে। লোকে বলে থাকে, আমি নিজের চোখে কখনো দেখিনি বটে, তবে লোকের কথায় অবিশ্বাস করতে চাইনে। তবুও, একথা আমি বলব যে গাছের বেলা তা হয়ত সত্যি হলেও, একটুখানি বীজের থেকে একটা গল্পকে টেনে বার করে আনা দারুণ দুঃসাধ্য ব্যাপার!
বলব কি ভাই, যতই প্লট ফাদি আর যত গল্পই বাঁধি, আর যত রকম করেই ছকতে যাই, কিছুতেই ওই সর্বমত্যন্তম-এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানো যায় না। একটা গল্প লিখতে গিয়ে ভাবতে ভাবতে একশটা গল্প এসে গেল, মনের গল্পের একশা, আর মনের মত তার প্রত্যেকটাই কিন্তু নামের মত একটাও না।
ভাবতে ভাবতে সাত রাত্রি ঘুম নেই; এমন কি, দিনেও দু চোখে ঘুম আসে না। চোখের কোণে কালি পড়ে গেল আর মাথার চুল সাদা হতে শুরু করল। অর্ধেক চুল টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম–আর কামড়ে কামড়ে ফাউন্টেনের আধখানা পেটে চলে গেল। কত গল্পই এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে এল আর গেল কিন্তু কোনটাই এই নামের সঙ্গে খাটল না। •
তখন আমি নিজেই খাটলাম–আমাকেই খাঁটিয়ে নিতে হলো শেষটায়।
শুয়ে শুয়ে আমার খাতার শুভ্র অঙ্কে–আমার অনাগত গল্পে আষ্টেপৃষ্ঠে–ললাটে কত কি যে আঁকলাম! কাকের সঙ্গে বক জুড়ে দিয়ে, বাঘের সাথে কুমীরের কোলাকুলি বাধিয়ে, হনুমানের সঙ্গে জাম্বুবানকে জর্জরিত করে, সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার!
সব জড়িয়ে এক ইলাহী কাণ্ড! কি যে ওই সব ছবি, তার কিছু বুঝবার যো নেই, অথচ বুঝতে গেলে অনেক কিছুই বোঝা যায়। গুহা মানুষেরা একদা যে সব ছবি আঁকতো, এবং মানুষের মনের গুহায়, মনশ্চক্ষুর অগোচরে এখনো যে সব ছবি অনুক্ষণ অঙ্কিত হচ্ছে, সেই সব অন্তরের অন্তরালের ব্যাপার! মানুষ পাগল হয়ে গেলে যে সব ছবি আঁকে অথবা আঁকবার পরেই পাগল হয়ে যায়। সর্বমত্যন্তম—ড্যাশ–উইদিন ইনভার্টেড কমার শিরোনামার ঠিক নিচে থেকে সরু করে, গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় আমার নাম স্বাক্ষরের ওপর অবধি কেবল ওইসব ছবি–ওই পাগলকরা ছবি সব! পাতার দুধারে মার্জিনেও তার বাদ নেই–মার্জনা নেই কোনোখানে।
তোমরা হাসছো? তা হাসতে পারো! কিন্তু ছবিগুলো মোটেই হাসবার নয়– দেখলেই টের পেতে। ওই সব ছবির গর্ভে যে নিদারুণ আর্ট নিহিত রইলো আমার আশা, সমদারের সাহায্যে (রাচির বাইরেও তারা থাকবেন নিশ্চয়!) একদিন তার তত্ত্ব উদঘাটিত হবে হবেই চিরদিন কিছু তা ছলনা করে, নিগূঢ় হয়ে থাকবে না। আমার গল্পের জন্য, এমন কি, আমার কোনো লেখার জন্য কখনো কোনো প্রশংসা না পেলেও, ওই সব ছবির খ্যাতি আমার আছেই– ওদের জন্য একদিন না একদিন বাহবা আমি পাবই। ওরাই। ওরাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে–আজকে না হলে আগামীকালে মানুষের দুঃস্বপ্নের মধ্যে অন্ততঃ–এ বিশ্বাস আমার অটল।
অবশেষে সর্বমত্যন্তম-এর পরে ড্যাশের জায়গায় শুধু গর্হিতম কথাটি বসিয়ে রচনা মেষ করে, আমার গল্পের সেই চিত্ররূপ নিয়ে নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রেডিয়ো স্টেশনের দিকে দৌড়ালাম।
ভেবে দেখলে সমস্ত ব্যাপারটাই গর্হিত ছাড়া কি? আগাগোড়া ভাল করে ভেবে দেখা যায় যদি, আমার পক্ষে রেডিয়োর গল্প পড়তে পাওয়া, এবং যে দক্ষিণায় গল্প বেচে থাকি, সেই গল্প পড়তে গিয়ে তার তিনগুণ দাক্ষিণ্যলাভের সুযোগ পাওয়া দস্তুরমত গহিত বলেই মনে হতে থাকে! এবং যে গল্প আমি চিত্রাকারে, মিকি মাউসের সৃষ্টি কর্তাকে লজ্জা দিয়ে, পৃষ্ঠায় পর পৃষ্ঠা ধরে কেঁদেছি তার দিকে তাকালে–না, না এর সমস্তটাই অত্যন্তম–অতিশয় অত্যন্তম–এবং কেবল অত্যন্তম–এবং কেবল অত্যন্তম নয়, অত্যন্তম গর্হিতম!
তারপর? তারপর সেই গল্প নিয়ে হন্যে হয়ে যাবার মুখে আমার দু-নম্বর বরাত এসে দেখা দিল। অ্যামবুলেন্সে চাপা পড়লাম।
হাসপাতালে গিয়েও, হাত পা ব্যয় না করে, নিজে বাজে খরচ না হয়ে, অটুট অবস্থায় বেরিয়ে আসাটা তিন নম্বর বরাত বলতে হয়। কিন্তু সশরীরে সর্বাঙ্গীণরূপে লোকালয়ে ফিরে এসে ভাগ্যের ত্র্যহস্পর্শেয়র কথাটা যে ঘটা করে যাকে তাকে বলবো, বলে একটু আরাম পাবো তার যো কি! যার দেখা পাই, যাকেই বলতে যাই কথাটা, আমারি সুত্রপাতের আগের সে মুক্তকন্ট হয়ে ওঠে।