এমন কথা কেন বলছেন? গোবর্ধন আমার ভণিতা ঠিক করতে পারে না।
টাকটার আমার দরকার পড়েছে আবার। ওই পাঁচশো টাকাই–সেই জন্যেই তোমার কাছে এলাম ভাই। এই বধুবারই তোমায় আবার ফিরিয়ে দেবো টাকাটা। নির্ঘাত।
এইভাবে হর্ষবর্ধন আর গোবর্ধন, গোবর্ধন আর হর্ষবর্ধন শনিবার আর বুধবারের দু-ধারের টানা পোড়েনে আমার ধারিওয়াল কম্বল বুনে চলেছি এমন সময়ে পথে একদিন দু-জনের সঙ্গে দেখা।
দুই ভাই পাশাপাশি আসছিল। আমাকে দেখে দাঁড়াল। দু-জনের চোখেই কেমন যেন একটা সপ্রশ্ন দৃষ্টি।
হয়তো দৃষ্টিটা কুশল জিজ্ঞাসার হতে পারে, কোথায় যাচ্ছি, কেমন আছি–এই ধরনের সাধারণ কোন কৌতূহলই হয়তো বা, কিন্তু আমার তো পাপ মনে, মনে হলো দু-জনের চোখেই যেন এক তাগাদা!
হর্ষবর্ধনবাবু, ভাই গোবর্ধন, একটা আমি বলবো, কিছু মনে করো না–বলে আমি শুরু করি: ভাই গোবর্ধন, তুমি প্রত্যেক বুধবার হর্ষবর্ধনবাবুকে পাঁচশো টাকা দেবে। আর হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি প্রত্যেক শনিবার পাঁচশো টাকা আপনার ভাই গোবর্ধনকে দেবেন। হর্ষবর্ধনবাবু, আপনি বুধবার, আর গোবর্ধন, তুমি শনিবার মনে থাকবে তো?
ব্যাপার কি! হর্ষবর্ধন তো হতভম্ব: কিছুই বুঝতে পারছি না।
ব্যাপার এই যে, ব্যাপারটা আমি একেবারে মিটিয়ে ফেলতে চাই। আপনাদের দুজনের মধ্যে আমি আর থাকতে চাই না।
একটি বেতার ঘটিত দুর্ঘটনা
অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার মত বরাত বুঝি আর হয় না। মোটর চাপাপড়া গেল অথচ অ্যামবুলেন্স আসার জন্য তর সইতে হলো না–যাতে চাপা পড়লাম তাতেই চেপে হাসপাতালে চলে গেলাম। এর চেয়ে মজা কি আছে?
ভাগ্যের যোগযোগ বুঝি একেই বলে। অবিশ্যি, ক্কচিৎ এরূপ ঘটে থাকে-সকলের বরাত তো আর সমান হয় না। অবিশ্যি এর চেয়েও–অ্যামবুলেন্স চাপা পড়ার চেয়েও, আরো বড়ো সৌভাগ্য জীবনে আছে। তা হচ্ছে রেডিয়োয় গল্প পড়তে পাওয়া।
দুর্ভাগ্যের মত সৌভাগ্যরাও কখনো একলা আসে না। রেডিয়োর গল্প আর অ্যামবুলেন্স চাপ–এই দুটো পড়াই একযোগে আমার জীবনে এসেছিল। সেই কাহিনীই বলছি।
কোন পূণ্যবলে রেডিয়োয় গল্পপাঠের ভাগ্যলাভ হয় আমি জানিনে, পারতপক্ষে তেমন কোনো পুণ্য আমি করিনি। অন্তত আমার সজ্ঞানে তো নয়, হঠাৎ রেডিও অফিসের এক আমন্ত্রণ পেয়ে চমকাতে হলো। আমন্ত্রণ এবং চুক্তিপত্র একসঙ্গে গাঁথা দক্ষিণা পর্যন্ত বাঁধা–শুধু আমার সই করে স্বীকার করে নেওয়ার অপেক্ষা কেবল। এমন কি রেডিয়োর কর্তারা আমার পঠীতব্য গল্পের নামটা পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছেন। সর্বমন্ততাম! এই নাম দিয়ে, এই শিরোনামার সঙ্গে খাপ খাইয়ে গল্পটা আমায় লিখতে হবে।
তা, আমার মত একজন লিখিয়ের পক্ষে এ আর এমন শক্ত কি? আগে গল্প লিখে পরে নাম বসাই, এ না হয়, আগেই নাম ফেঁদে তারপরে গল্পটা লিখলাম। ছেলে আগে না ছেলের নাম আগে, ঘোড়া আগে না ঘোড়ার লাগাম আগে, কারো কাছে সেটা সমস্যারূপে দেখা দিলেও একজন লেখকের কাছে সেটা কোনো প্রশ্নই নয়। লাগামটাই যদি আগে পাওয়া গেল, তার সঙ্গে ধরে বেঁধে একটা ঘোড়াকে বাগিয়ে আনতে আর কতক্ষণ?
প্রথমেই মনে হলো, সব আগে সৌভাগ্যের কথাটা শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাইকে জানিয়ে ঈর্ষান্বিত করাটা দরকার। বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বন্ধু বান্ধব, চেনা আধচেনা, চিনি-চিনি সন্দেহজনক যাকেই পথে পেলাম, পাকড়ে দাঁড় করিয়ে এটা-সেটা একথা সেকথার পর এই রোমাঞ্চকর কথাটা জানিয়ে দিতে দ্বিধা করলাম না। অবশেষে পই পই করে বলে দিলাম–শুনো কিন্তু! এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার–সাড়ে পাঁচটায়–শুনে বলবে আমায় কেমন হলো!
শুনব বইকি! তুমি গল্প বলবে আমরা শুনবো না, তাও কি হয়? রেডিও কেনা তবে আর কেন? তবে কিনা, রেডিয়োটা কদিন থেকে আমাদের বিকল হয়ে রয়েছে–কে বিগড়ে দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। গিন্নির সন্দেহ অবশ্যি আমাকেই-যাক, এর মধ্যে ওটা সারিয়ে ফেলব ’খন! তুমি গল্প পড়ছ, সেটা শুনতে হবে তো। একজনের আপ্যায়িত করা জবাব পেলাম।
আরো কজন তো আমরা কথা বিশ্বাস করতে পারেন নাঃ বলো কি? আরে, শেষটায় তুমিও! তোমাকেও ওরা গল্প পড়তে দিলে? দিনকে দিন কি হচ্ছে কোম্পানীর! আর কিছু বোধহয় পাচ্ছে না ওরা নইলে শেষে তোমাকেও–ছিঃ ছিঃ ছিঃ! অধঃপাতের আর বাকি কি রইলো হে? নাঃ, এইবার দেখবে অল ইন্ডিয়া রেডিও উঠে যাবে, আর বিলম্ব নেই!
বন্ধুবরের মন্তব্য শুনে বেশ দমে গেলাম, তথাপি আমতা আমতা করে বললাম–রেড়িয়োর আর দোষ কি দাদা? খোদার দান। খোদা যখন দ্যান ছাপ্পর ছুঁড়ে দিয়ে থাকেন, জানো তো? এটাও তেমনি আকাশ ছুঁড়ে পাওয়া–হঠাৎ এই আকাশবাণীলাভ।
আচ্ছা শুনবখন। তুমি যখন এত করে বলছ। অ্যাসপিরিন, স্মেলিং সলট–এসব হাতের কাছে রেখেই শুনতে হবে। তোমার গল্প পড়লে তো সত্যি বলছি, কিছু মনে কোরো না আমার মাথা ধরে যায়–শুনলে কি ফল হবে কে জানে! মুখ বিকৃত করে বন্ধুটি জানিয়ে গেলেন।
তবু আমি নাছোড়বান্দা। পথেঘাটে যাদের পাওয়া গেল না তাদের বাড়ি ধাওয়া করে সুখবরটা দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য উক্ত শুক্রবারে সেই মুহূর্তে সকলেই শশব্যস্ত! কারো ছেলের বিয়ে, কারো মেয়ের পাকা দেখা, কারো আবার কিসের যেন এনগেজমেন্ট, কাউকে খুব জরুরি দরকারে কলকাতার বাইরে যেতে হচ্ছে! এমনি কত কি কাণ্ডে সেই দয়াখো দেখি। আমি গল্প বলব কেউ শুনবে না। আমার জানাশোনারা শুনতে পাবে না এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? আমার গল্প পড়ার দিনটিতেই যে সবার এত গোলমাল আর জরুরি কাজ এসে জুটবে তা কে জানত।