লোকটা চলে গেলে ঘাম দিয়ে আমার জ্বর ছাড়ল। কিন্তু এতগুলো লোক যে আমার লেখার জন্যই খুন-জখম হয়েছে হাত-পা হারিয়েছে এবং একজন গোলদীঘির ধারে এখনও গাছে চেপে বসে আছে এই সব ভেবে মন ভারী খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু অচিরেই এই সব দুশ্চিন্তা দূরীভূত হলো, কেননা—’কৃষি-তত্ত্বের’ আটপৌরে সম্পাদক অপ্রত্যাশিতরূপে প্রবেশ করলেন।
সম্পাদকের মুখ গম্ভীর, বিষণ্ণ, বিলম্বিত। চেঞ্জ গিয়ে অবিলম্বে ফিরে আসার জন্যেই বোধ হয়। আমার দুজনে চুপচাপ। অনেকক্ষণ পরে একটি মাত্র কথা তিনি বললেন–তুমি আমার কাগজের সর্বনাশ করেছ।
আমি বললাম, কেন, কাটতি তো অনেক বেড়েছে।
হ্যাঁ, কাগজ বহুত কেটেছ, আমি জানি। কিন্তু আমার মাথাও কাটা গেছে সেই সঙ্গে। তারপরে দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কীর্তিকলাপ তাঁর দৃষ্টিগোচর হল, চারিদিকে ভাঙাচোরা দেখে তিনি নিজেও যেন ভেঙে পড়লেন–সত্যি বড় দুঃখের বিষয়। ‘কৃষি-তত্ত্বের’ সুনামের যে হানি হলো, যে বদনাম হলো তা বোধহয় আর ঘুচবে না। অবিশ্যি কাগজের এত বেশি বিক্রী এর আগে কোনোদিন হয়নি বা এমন নামডাকও চারদারে ছড়িয়ে পড়েনি–কিন্তু পাগলামির জন্য বিখ্যাত হয়ে কি লাভ? একবার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখ দেখি চারধারে কি রকম ভীড় কি সোরগোল! তারা সব দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে দেখবার জন্যে। তাদের ধারণা তুমি বদ্ধ পাগল। তাদের দোষ কি? যে তোমার সম্পাদকীয় পড়বে তারই ওই ধারণা বদ্ধমূল হবে। তুমি যে চাষবাসের বিন্দুবিসর্গও জানো তা তো মনে হয় না। কপি আর কফিখ যে এক জিনিস একথা কে তোমাকে বলল? গোল আলুর সম্বন্ধে তুমি যে গবেষণা করেছ, মূলো চাষের যে আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছ সে সম্বন্ধে তোমার কোনই অভিজ্ঞতা নেই। তুমি লিখেছ শামুক অতি উৎকৃষ্ট সার, কিন্তু তাদের ধরা অতি শক্ত। মোটেই তা নয়, শামুক মোটেই সারবান নয়, এবং তাদের দ্রুতগতির কথা এই প্রথম জানা গেল। কচ্ছপেরা সঙ্গীতপ্রিয়, রাগ-রাগিণীর সম্মুখে তারা মৌনী হয়ে থাকে, সেটা তাদের মৌনসম্মতির লক্ষণ, তোমার এ মন্তব্য একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কচ্ছপদের সুরবোধের কোনই পরিচয় এ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এমনিই ওরা চুপচাপ থাকে, মৌনী হয়ে থাকাই ওদের স্বভাব-সঙ্গীতের কোন ধারই ধারে না তারা। কচ্ছপদের দ্বারা জমি চষানো অসম্ভব একেবারেই অসম্ভব। আপত্তি না করলেও জমি তারা চষবে না–তারা তো বলদ নয়! তুমি যে লিখেছ, ঘোড়ামুগ ঘোড়ার খাদ্য আর কলার বীচি থেকে কলাই হয়, তার ধাক্কা সামলাতে আমার কাগজ উঠে না গেলে বাঁচি! গাছের ডাল আর ছোলার ডালের মধ্যে যে প্রভেদ আছে দেড় পাতা খরচ করে তা বোঝাবার তোমার কোনই দরকার ছিল না। কেবল তুমি ছাড়া আর সবাই জানে। যাক, যা হবার হয়েছে, এখন তুমি বিদায় নাও। তোমাকে আর সম্পাদকতা করতে হবে না। আমার আর বায়ু পরিবর্তনের কাজ নেই– ঘাটশিলায় গিয়েই আমাকে দৌড়ে আসতে হয়েছে তোমার পাঠানো কাগজের কপি পেয়ে অবধি আমার দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। পরের সপ্তাহে আবার তুমি কি গবেষণা করে বসবে সেই ভয়েই আমার বুক কেঁপেছে। বিড়ম্বনা আর কাকে বলে! যখনই তোমার ঘোষণার কথা ভেবেছি জাম জামরুল আর গোলাপ জাম কি করে একই গাছে ফলানো যায়, পরের সংখ্যাতেই তুমি তার উপায় বলে দেবে, তখন থেকেই নাওয়া-খাওয়া আমার মাথায় উঠেছে- বেরিবেরিতে প্রাণ যায় সেও ভাল–তখনই আমি কলকাতার টিকিট কিনে গাড়িতে চেপেছি।
এতখানি বক্তৃতার পর ভদ্রলোক এক দারুণ দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। ওরই কাগজের কাটতি আর খ্যাতি বাড়িয়ে দিলাম, আরও বেড়ে গেল কত অথচ উনিই আমাকে গাল-মন্দ করলেন! ভদ্রলোকের নেমকহারামি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে আমাকে গাল-মন্দ করছেন! ভদ্রলোকের নেমকহারামি দেখে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। অতএব, শেষবিদায় নেওয়ার আগে অমিই বা ক্ষান্ত হইয়া কেন? আমার বক্তব্য আমিও বলে যাব। এত খাতির কিসের?
বেশ আমার কথাটাও শুনুন তবে। আপনার কোন কাণ্ডজ্ঞানেই নেই, আপনি একটি আস্ত বাঁধাকপি। এরকম অনুদার মন্তব্য যা এতক্ষণ আমাকে শুনব বলে কোনদিন আমি কল্পনাও করিনি। কাগজের সম্পাদক হতে হলে কোনো কিছু জানতে হয় তাও আমি এই প্রথম জানলাম। এতদিন তো দেখে আসছি যারা বই লিখতে পারে না তারই ফুটবল খেলা দেখতে যায়। আপনি নিতান্তই শালগম, তাই একথা বুঝতে আপনার বেগ পেতে হচ্ছে। যদি নেহাৎ ভুনিকুমাণ্ড না হতেন তাহলে অবশ্য বুঝতেন যে কৃষি-তত্ত্বের কি উন্নতি আর আপনার কতখানি উপকার আমি করেছি! আমার গায়ে জোর থাকলে আপনার মত গাজরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যেতাম! কি আর বলব আপনাকে, পালং শাক, পানিফল, তালশীল, যা খুশি বলা যায়। আপনাকে পাতিলেবু বললে পাতিলেবুর অপমান করা হয়–
দম নেবার জন্য আমাকে থামতে হল। গায়ের ঝাল মিটিয়ে গালাগালের শোধ তুললাম, কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে নির্বাক। আবার আরম্ভ করলাম আমি–
হ্যাঁ, একথা সত্যি, সম্পাদক হবার জন্য জন্মভূমি যারা সৃষ্টি করে আমি তাদেরই একজন, আমি হচ্ছি লেখক। উঁইফোড় কাগজের সম্পাদক হয় কারা? আপনার মতো লোক নিতান্তই যারা টম্যাটো। সাধারণত যারা কবিতা লিখতে পারে না, আট-আনা সংকরণের নভেলও যাদের আসে না, পিলে চমকানো থিয়েটারী নাটক লিখতেও অক্ষম, প্রথম শ্রেণীর মাসিক পত্রেও অপারগ তারাই অবশেষে হাত-চুলকানো থেকে আত্মরক্ষার জন্য আপনার মতো কাগজ বের করে বসে। আমি আমার সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করেছেন তাতে আর মুহূর্তও এখানে থাকতে আমার রুচি নেই! এই দণ্ডেই সম্পাদক-গিরিতে আমি ইস্তফা দিচ্ছি! চাষাড়ে কাগজের সম্পাদকের কাছে ভদ্রতা আশা করাই বাতুলতা! ঘড়ির দুর্দশা দেখেই আমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল। যাব তো আমি নিশ্চয়, কিন্তু জানবেন, আমার কর্তব্য আমি করে গেছি, যা গেছি, যা চুক্তি ছিল তা অক্ষরে পালন করেছি আমি। বলেছিলাম আপনার কাগজ সর্বশ্রেণীর পাঠ্য করে তুলব–তা আমি করেছিও। বলেছিলাম আপনার কাগজের কুড়ি হাজার গ্রাহক করে দেব–যদি আর দু-সপ্তাহ সময় পেতাম তাও আমি করতে পারতাম। এখন-এখনই আপনার পাঠক কারা? কোন চাষের কাগজের বরাতে যা কোনদিন জোটেনি সেইসব লোক আপনার কাগজের পাঠক–যত উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার, মোক্তার, হাইকোর্টের জজ, কলেজের প্রফেসার, যত সব সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। একজনও চাষা নেই ওর ভেতর-যত চাষা গ্রাহক ছিল তারা সব চিঠি লিখে কাগজ ছেড়ে দিয়েছে-ঐ দেখুন টেবিলের ওপর চিঠির গাদা! কিন্তু আপনি এমনই চাল-কুমড়ো যে পাঁচশ মুখ্যু চাষার জন্যে বিশ হাজার উচ্চশিক্ষিত গ্রাহক হারালেন! এতে আপনারই ক্ষতি হলো, আমার কি আর! আমি চললাম।
ঋণং কৃত্বা
কারো ধার ধারি না, এমন কথা আর যেই বলুক আমি কখনই বলতে পারি না। আমার ধারণা, এক কাবুলিওয়ালা ছাড়া এ জগতে এ-কথা কেউই বলতে পারে না। অমৃতের পথ ক্ষুরস্য ধারা নিশ্চিতা; অকালে মৃত না হতে বলে ধার করতেই হবে।