নিকুচি করেছে গাছের! মূলো গাছেই জন্মায় না।
কি! গাছে জন্মায় না। অসম্ভব–এ এখনও হতে পারে? মানুষ ছাড়া সবকিছুই গাছে জন্মায়, এমন কি বাঁদর পর্যন্ত।
ভদ্রলোকের মুখবিকৃতি দেখে বুঝলাম বিরক্তির তিনি চরম সীমায়। রেগে কৃষি-তত্ত্বখানা ছিঁড়ে কুচি কুচি করে ফুঁ দিয়ে, ঘরময় উড়িয়ে দিলেন। তারপরে নিজের ছড়িতে হস্তক্ষেপ করলেন। আমি শঙ্কিত হলাম–লোকটা মারবে নাকি? কিন্তু না আমাকে ছাড়া টেবিল, চেয়ার দেরাজ, আলমারি, ঘরের সবকিছু ছড়িপেটা করে, অনেক কিছু ভেঙেচুরে, অনেকটা শান্ত হয়ে, অবশেষে, সশব্দে ঘরের দরজায় ধাক্কা মেরে তিনি সবেগে বেরিয়ে গেলেন। লোকটা কোনো ইস্কুলের মাস্টার নয় তো?
আমি অবাক হলাম, ভদ্রলোক ভারী চটে চলে গেলেন তা তো স্পষ্টই, কিন্তু কেন যে কি সম্বন্ধে তার এত অসন্তোষ তা কিছু বুঝতে পারলাম না।
এই দুর্ঘটনার একটু পরেই আগামী সপ্তাহের সম্পাদকীয় লেখবার জন্য সুবিধে মতো আঁকিয়ে বসছি এমন সময়ে দরজা ফাঁক করে কে যেন উঁকি মারল। যারা জানলা-পথে পালিয়েছিল সেই ‘চষ্য’-রাজাদের একজন নাকি? কিন্তু না, নিরীক্ষণ করে দেখলাম বিশী বেহারার জনৈক বদখৎ লোক। লোকটা ঘরে ঢুকেই যেন কাঠের পুতুল হয়ে গেল, ঠোঁটে আঙুল চেপে, ঘাড় বেঁকিয়ে কুঁজো হয়ে কি যেন শোনবার চেষ্টা করল। কোথাও শব্দমাত্র ছিল না। তথাপি সে শুনতে লাগল। তবু কোনো শব্দ নেই। তারপরে অতি সন্তপর্ণে দরজা ভেজিয়ে পা টিপে টিপে আমার কাছাকাছি এগিয়ে এসে সুতীব্র ঔৎসুক্যে আমাকে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ একেবারে নিষ্পলক, তারপরেই কোটের বোতাম খুলে হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে একখণ্ড কৃষি-তত্ত্ব বার করল।
এই যে, তুমি! তুমিই লিখেছ তো? পড়-পড়–এইখানটা তাড়াতাড়ি। ভারী কষ্ট হচ্ছে আমার।
আমি পড়তে শুরু করলামঃ
মুলোর বেলা যেরকম আলুর বেলা সেরকম করা চলবে না। গাছ ঝাঁকি দিয়ে পাড়লে আলুরা চোট খায়, এই কারণেই আলু পচে আর তাতে পোকা ধরে। আলুকে গাছে বাড়তে দিতে হবে যতদূর খুশি সে বাড়ুক। এরকম সুযোগ দিলে এক-একটা আলুকে তরমুজের মতো বড় হতে দেখা গেছে। অবশ্য বিলাতেই; এদেশে আমরা আলু খেতেই শিখেছি, আলুর যত্ন নিতে শিখিনি। আলু যথেষ্ট বেড়ে উঠলে এক-একটা করে আলাদা আলাদা ফজলি আমের মতন তাকে ঠুসি পাড়া করতে হবে।
তবে পেঁয়াজ অমরা আঁকশি দিয়ে পাড়তে পারি, তাতে বিশেষ কোন ক্ষতি হবে না। অনেকের ধারণা পেঁয়াজ গাছেল ফল, বাস্তবিক কিন্ত তা নয়। বরং ওকে ফুল বলা যেতে পারে–ওর কোনো গন্ধ নেই, যা আছে কেবল দুর্গন্ধ। ওর খোসা ছাড়ানো মানেই ওর কোরক ছাড়ানো। এনতার কোরক ওর। পেঁয়াজেরই অপর নাম শতদল।
অতি প্রাচীনকালেও এদেশে ফুলকপি ছিল তার পরিচয় পাওয়া যায়, তবে তাকে আহার্যের মধ্যে তখন গণ্য করা হত না। শাস্ত্রে বলেছে অলাবুভক্ষণ নিষেধ, সেটা ফুলকপি সম্বন্ধেই। আর্যেরা কপি খেতেন না, ওটা আনর্য হাতিদের খাদ্য ছিল। গজভুক্ত কপিখ এই প্রবাদে তার প্রমাণ করেছে
বাতাবিলেবুর গাছে কমলালেবু ফলানোর সহজ উপায় হচ্ছে এই–
ব্যস, ব্যস–এতেই, হবে। আমার উৎসাহী পাঠক উত্তেজিত হয়ে আমার পিঠ চাপড়াবার জন্য হাত বাড়াল। আমি জানি আমার মাথা ঠিকই আছে, কেননা তুমি যা পড়লে আমিও ঠিক তাই পড়েছি, ওই কথাগুলোই। অন্তত আজ সকালে, তোমার কাগজ পড়ার আগে পর্যন্ত ওই ধারণাই আমার ছিল। যদিও আমার আত্মীয়স্বজন আমাকে সব সময়ে নজরে নজরে রাখে তবু এই ধারণা আমার প্রবল ছিল যে মাথা আমার ঠিকই আছে–
তার সংশয় দূর করার জন্য আমি সায় দিলাম–নিশ্চয়ঃ নিশ্চয়! বরং অনেকের চেয়ে বেশি ঠিক একথাই আমি বলব। এইমাত্র একজন বুড়ো লোক কিন্তু যাক সে কথা।
লোকটাও সায় দিল–হ্যাঁ, যাক। তবে আজ সকালে তোমার কাগজ পড়ে সে ধারণা আমার টলেছে। এখন আমি বিশ্বাস করি যে সত্যি সত্যিই আমার মাথা খারাপ। এই বিশ্বাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এক দারুণ চিৎকার ছেড়েছি নিশ্চয়ই তুমি এখানে বসে তা শুনতে পেয়েছে?
আমি ঘাড় নাড়লাম, কিন্তু আমার অস্বীকারোক্তিতে সে আমল দিল না–নিশ্চয় পেয়েছ। দু মাইল দূর থেকে তা শোনা যাবে। সেই চিৎকার ছেড়েই এই লাঠি নিয়ে আমি বেরিয়েছি, কাউকে খুন না করা পর্যন্ত স্বস্তি হচ্ছে না। তুমি বুঝতেই পারছ আমার মাথার যা অবস্থা তাতে একদিন কাউকে খুন আমায় করতেই হবে–তবে আজই তা শুরু করা যাক না কেন?
কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না, একটা অজানা আশঙ্কায় বুক দূর দূর করতে লাগল।
বেরুবার আগে আর একবার তোমার প্যারাগুলো পড়লাম, সত্যিই আমি পাগল কিনা নিশ্চিত হবার জন্যে। তার পরক্ষণেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়েছি। রাস্তায় যাকে পেয়েছি তাকেই ধরে ঠেঙিয়েছি। অনেকে খোঁড়া হয়েছে, অনেকের মাথা ভেঙেছে; সবসুদ্ধ কতজন হতাহত বলতে পারব না। তবে একজনকে জানি, সে গাছের উপর উঠে বসে আছে। গোলাদীঘির ধারে। আমি ইচ্ছা করলেই তাকে পেড়ে আনতে পারব। এই পথ দিয়ে যেতে মনে হল তোমার সঙ্গে একবার মোলাকাৎ করে যাই–
হৃৎকম্পের কারণ এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম–কিন্তু বোঝার সঙ্গে সঙ্গে হৃৎকম্প একেবারেই বন্ধ হবার যোগাড় হল যেন!
কিন্তু তোমায় আমি সত্যি বলছি, যে লোকটা গাছে চেপে আছে তার কপাল ভাল। এতক্ষণ তবু বেঁচে রয়েছে বেচারা। ওকে খুন করে আসাই উচিত ছিল আমার। যাক, ফেরার পথে ওর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া হবে। এখন আসি তাহলে–নমস্কার!