বলা বাহুল্য, আমাকে রাজি করতে ভদ্রলোককে মোটেই বেগ পেতে হল না, সহজেই আমি সম্মত হলাম। এ যেন আমার হাতে স্বর্গ পাওয়া গাছে না উঠতেই এক কাঁদি! সম্পাদক শিকার করতে এসে সম্পাদকতা স্বীকার– তোমাদের মধ্যে খুব কম অজাতশ লেখকেরই এরকম সৌভাগ্য হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
সম্পাদনা-কাজের গোড়াতেই এক জোড়া চশমা কিনে ফেললাম; ফাউন্টেন পেন তো ছিলই। অতঃপর সমস্ত জিনিসটাই পরিপাটিরকম নিখুঁত হলো। কলম বাগিয়ে -কৃষিতত্ত্বের- সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করলাম। যদিও সম্পাদকীয় লেখার জন্য ঘুণাক্ষরেও কোন অনুরোধ ছিল না সম্পাদকের, কিন্তু ওটা বাদ দিলে সম্পাদকতা করার কোন মানেই হয় না, আমার মতো। এতএব লিখলাম।
আমাদের দেশে ভদ্রলোকের মধ্যে কৃষি সম্বন্ধে দারুণ অজ্ঞতা দেখা যায়। এমন কি, অনেকের এরকম ধারণা আছে যে এই সব তক্তা আমরা দেখি, দরজা, জানালা কড়ি, বরগা, পেনসিল তক্তপোষে যেসব কাঠ সাধারণতঃ দেখতে পাওয়া যায় সে সমস্ত ধান গাছের। এটা অতীব শোচনীয়। তারা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে ওগুলো ধান তো নয়ই, বরঞ্চ পাট বলা যেতে পারে। অবশ্য পাট গাছ ছাড়াও কাঠ জন্মায়; আম, জাম, কাঁঠাল, কদবেল ইত্যাদি বৃক্ষেরাও তক্তাদান করে থাকে। কিন্তু নৌকার পাটাতনে যে কাঠ ব্যবহৃত হয় তা কেবলমাত্র পাটের।…
ইত্যাদি—এইভাবে একটানা প্রায় আড়াই পাতা কৃষি তত্ত্ব। কাগজ বেরুতে না বেরুতে আমার সম্পাদকতার ফল প্রত্যক্ষ করা গেল। মোটে পাঁচশ করে আমাদের ছাপা হত, কিন্তু পাঁচশ কাগজ বাজারে পড়তেই পেল না। সকাল থেকে প্রেস চালিয়ে, সাতগুণ গেছেও অনেক হকারকে শেষে ক্ষুণ্ণমনে আর শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিতে হল।
সন্ধ্যায় পরে যখন আপিস থেকে বেরুলাম, দেখলাম একদল লোক আর বালক সামনের রাস্তায় জড়ো হয়েছে; আমাকে দেখেই তারা তৎক্ষণাৎ ফাঁকা হয়ে আমার পথ করে দিল। দুএকজনকে যেন বলতেও শুনলাম–ইনি, ইনিই। স্বভাবতঃই খুব খুশি হয়ে গেলাম। না হব কেন?
পরদিনও আপিসের সামনে সেই রকম লোকের ভীড়; দল পাকিয়ে দুচারজন করে এখানে ওখানে ছড়িয়ে, রাস্তার এধারে ওধারে, দূরে সুদূরে (কিন্তু অনতি নিকটে) প্রায় সমস্ত জায়গাটা জুড়েই ব্যক্তিবর্গ। সবাই বেশ আগ্রহের সঙ্গে আমাকে লক্ষ্য করছে। তাদের কৌতূহলের পাত্র আমি বুঝতে পারলাম বেশ; এবং পেরে আত্মপ্রসাদ হতে লাগল।
আমি কাছাকাছি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা বিচলিত হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল, আমি দ্বিধাবোধ করার আগেই মন্ডলীর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে আমার পথ পরিষ্কার করে দিচ্ছিল। একজন বলে উঠল ওর চোখের দিকে তাকাও, কি রকম চোখ দেখেছ! আমিই যে ওদের লক্ষ্য এটা যেন লক্ষ্য করছি না এই রকম ভাব দেখাচ্ছিলাম, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, মনে মনে বেশ পুলক সঞ্চার হচ্ছিল আমার। ভাবলাম, এ সম্বন্ধে লম্বা-চওড়া বর্ণনা দিয়ে আজই বড়দাকে একখানা চিঠি ছেড়ে দেব।
দরজা ঠেলে আপিস-ঘরে ঢুকতেই দেখলাম দুজন গ্রাম্যগোছের লোক আমার চেয়ার এবং টেবিল ভাগাভাগি করে বসে আছে–বসার কায়দা দেখলে মনে হয় লাঙ্গল ঠেলাই ওদের পেশা। আমাকে দেখেই তারা তটস্থ হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্য যেন তাদের লজ্জায় ম্রিয়মাণ বলে আমার বোধ হলো কিন্তু পরমুহূর্তেই তাদের আর দেখতে পেলাম না–ওধারের জানলা টপকে ততক্ষণে তারা সটকেছে। অপিস-ঘরে যাতায়াতের অমন দরজা থাকতেও তা না ব্যবহার করে অপ্রশস্ত জানলাই বা তারা কেন পছন্দ করল, এই অদ্ভুত কান্ডের মাথামুন্ড নির্ণয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। এমন সময়ে একজন ভোঢ় ভদ্রলোক সযত্নলাললিত ছড়ি হস্তে আমার সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। তাঁর দাড়ির চাকচিক্যা দৃষ্টি আকর্ষ করার মতো। চেয়ারে ছড়ির ঠেসান দিয়ে দাড়িকে হস্তগত করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি কি নতুন সম্পাদক?
আমি জানালাম, তাঁর অনুমান যথার্থ।
আপনি কি এর আগে কোন কৃষি কাগজের সম্পাদনা করেছেন?
আজ্ঞে না, আমি বললাম, এই আমার প্রথম চেষ্টা।
তাই সম্ভব। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, হাতে-কলমে কৃষি-কাজের কোন অভিজ্ঞতা আছে। আপনার?
একদম না। স্বীকার করলাম আমি।
আমারও তাই মনে হয়েছে। ভদ্রলোক পকেট থেকে ভাজ করা এই সপ্তাহের একখানা কৃষি তত্ত্ব বার করলেন–এই সম্পাদকীয় আপনার লেখা নয় কি?
আমি ঘাড় নাড়লাম–এটাও আপনি ঠিক ধরেছেন।
আমার আন্দাজ ঠিক। বলে তিনি পড়তে শুরু করলেন?
মূলো জিনিসটা পড়বার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কখনই টেনে ছেঁড়া উচিত নয়, ওকে মূলোর ক্ষতি হয়। তার চেয়ে বরং একটা ছেলেকে গাছের ওপরে পাঠিয়ে দিয়ে ডালপালা নাড়তে দিলে ভাল হয়। খুব কসে নাড়া দরকার। ঝাঁকি পেলেই টপাটপ মূলোবৃষ্টি হবে, তখন কুড়িয়ে নিয়ো ঝাঁকা ভরো।…..
এর মানে কি আমি জানতে চাই। ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বরে যেন উন্মার আভাস ছিল।
কেন? এর মানে তো স্পষ্ট। বৃদ্ধ ব্যক্তির বোধশক্তি-হীনতা দেখে আমি হতবাক হলাম, আপনি কি জানেন, কত হাজার হাজার, কত লাখ লাখ মূলো অর্ধপক্ক অবস্থায় টেনে ছিঁড়ে নষ্ট করা হয় আমাদের দেশে? মূলো নষ্ট হলে কার যায় আসে? কেবল যে মূলোরাই তাতে অপকার করা হয় তা নয়, আমাদের আমাদেরও ক্ষতি তাতে। দেশেরই তাতে সর্বনাশ, তার হিসেব রাখেন? তার চেয়ে যদি মূলোকে গাছেই পাকতে দেওয়া হত এবং তারপরে একটা ছেলেকে গাছের ওপরে