ভয় ছিল না কিন্তু ভরসাও যেন ক্রমশ কমে আসছিল! যেটা জুয়েলের মধ্যে সবচেয়ে স্থূলকায় সেটাকে এবার তিনি দাঁতের মধ্যে চাপলেন, দাঁত বসে কিনা দেখবার জন্যই হয়ত বা। কিন্তু দন্তস্ফুট করতে না পেরে সেটাকে ছেড়ে মাথার দিকের দম দেবার গোলাকার চাবিটাকে মুখের মধ্যে পুরলেন তারপর। একটু পরেই কটাস করে উঠল; ওটার মেরামৎ সমাধি হয়েছে বুঝতে পারলাম।
তারপর সমস্ত টুকরো-টাকরা এক করে ঘড়ির অন্তঃপুরে রেখে তলাকার ডালাটা চেপে বন্ধ করতে গেলেন; কিন্তু ডালা তাতে বসবে কেন? সে উঁচু হয়ে রইল। ওপরের ডালাটা আগেই ভেঙেছিল, এবার সেটাকে হাতে নিয়ে আমাকে বললেন, আঠার পাত্রটা আগিয়ে দিন তো দেখি। এটাকে।
অত্যন্ত নিরুৎসাহে গাম–পটটা বাড়ির দিলাম। তিনি আঠার সহায়তায় যথেষ্ট সগ্রাম করলেন কিন্তু তাঁর যৎপরোনাস্তি চেষ্টা সমস্ত ব্যর্থ হলো। আঠায় কখনও ও জিনিস আঁটানো যায়? তখন সবগুলোয় মুঠোর করে নিয়ে আমার দিকে প্রসারিত করলেন এই নিন আপনার ঘড়ি।
আমি অবাক হয়ে এতক্ষণ দেখছিলাম, বললাম–এ কি হল মশাই?
তিনি শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন–কেন, মেরামৎ করে দিয়েছি তো।
বাবার কাছ থেকে বাগানো দামী ঘড়িটার এই দফারফা দেখে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল–এই বুঝি মেরামৎ করা? আপনি ঘড়ির যদি কিছু জানেন। না তবে হাত দিতে গেলেন কেন?
কেন, কি ক্ষতি হয়েছে? একথা বলে তিনি অনায়াসে হাসতে পারলেন–তাছাড়া, আমারও এই প্রথম চেষ্টা।
আমি অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম, তারপ বললাম, ওঃ। আমার প্রথম লেখা বলেই এটা অপনার পছন্দ হয়নি? তা-ই বললেই পারতেন ঘড়ি ভেঙে একথ বলা কেন? আমার চোখ ফেটে জল বেরুবার মতো হলো, কিন্তু অবাঞ্ছিত অঞ কোনমতে সম্বরণ করে, এমনকি অনেকটা আপ্যায়িতের মতো হেসেই অবশেষে বললাম কাল না হয় আর একটা নতুন গল্প লিখে আনব, সেটা আপনার পছন্দ হবে। চেষ্টা করলেই আমি লিখতে পারি।
বেশ আসবেন। এ বিষয়ে সম্পাদকের বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল, কিন্তু ঐ সঙ্গে আর একটা নতুন ঘড়িও আনবেন মনে করে। আমাদের দুজনেরই শিক্ষা হবে তাতে। আপনারও লেখার হাত পাকবে, আমিও ঘড়ি সম্বন্ধে পরিপক্কতা লাভ করব।
পরের দিন মরীয়া হয়েই গেলাম এবং ঘড়িয়া না হয়েই। এবার আর গল্প না, তিনটে ছোট ছোট কবিতা–সিম, বেগুন, বরবটির উপরে।
আমাকে দেখেই সম্পাদক অভ্যর্থনা করলেন–এই যে এসেছেন, বেশ। ঘড়ি আছে তো সঙ্গে?
আমি বললাম না–দেখুন এবারে একেবারে অন্য ধরনের লিখেছি। লেখাগুলো সময়গাপযোগী, এমন কি সব সময়ের উপযোগী। এবং যদি অনুমতি করেন তাহলে অনুগ্রহ–
আরও খানিকটা মুখস্থ করে আনা ছিল। কিন্তু ভদ্রলোক আমার আবৃত্তিতে বাধা দিলেন–ধৈর্য, উৎসাহ, তিতিক্ষা এসব আপনার আছে দেখছি। পারবেন আপনি। কিন্তু আমাদের মুশকিল কি জানেন, বড় লেখকেরই বড় লেখা কেবল আমরা ছাপতে পারি। প্রবন্ধের শেষে বা তলায় দিকে দেওয়া চলে এমন ছোট-খাট খুচরা-খাচরা যদি আপনার কিছু থাকে তাহলে বরং–। এই ধরুন, চার লাইনের কবিতা কিংবা কৌতুক–কণা–
আমি তার মুখের কথা কেড়ে নিলাম–হ্যাঁ, কবিতা। কবিতাই এনেছি এবার। পড়ে দেখুন আপনি, রবীন্দ্রনাথের পরে ওমন কবিতা কেউ লিখেছে কিনা সন্দেহ।
তিনি কবিতা তিন পিস হাতে নিলেন এবং পড়তে শুরু করে দিলেন—
সিম।
সিমের মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
ধামার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।
সঙ্গে সঙ্গে তার সপ্রশংস অভিব্যক্তি দেখা গেল–বাঃ, বেশ হয়েছে। আপনি বুঝি সিমের ভক্ত? সিম খেয়ে থাকেন খুব? অত্যন্ত ভাল জিনিস, যথেষ্ট ভিটামিন।
সিম আমি খাইনে। বরং অখাদ্যই মনে করি। তবে এই কবিতাটা লিখতে হিমসিম খেয়েছি।
হ্যাঁ এগুলো চলবে। খাসা কবিতা লেখেন আপনি; বরবটির সঙ্গে চটপটির মিলটা মন্দ না। তুলনাটাও ভাল–তা, এক কাজ করলে তো হয়।–অকস্মাৎ তিনি যেন গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হলেন।দেখুন, ভিটামিনের কাগজ বটে কিন্তু ভিটামিন আমরা খুব কমই খাই। কলা বাদ দিয়ে কলার খোসা কিংবা শাঁস বাদ দিয়ে আলুর পোসার সারাংশ প্রায়ই খাওয়া হয়ে ওঠে না–এইজন্যে মাস কয়েক থেকে বেরিবেরিতে ভুগতে হচ্ছে; তা আপনি যদি–তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ, পারব। খুব পারব। ঝুড়ি ঝুড়ি কলার খোসা আপনাকে যোগাড় করে দেব। কিন্তু শুধু খোসা তো কিনতে পাওয়া যায় না, কলার দামটা আপনিই দেবেন। তার সমর্থনের অপেক্ষায় একটু থামলাম, কলাগুলো আমিই না হয় খুব কষ্টে-সৃষ্টে-যদিও অনুপকারী, তবু বেরিবেরি না হওয়া পর্যন্ত খেতে তো কোন বাধা নেই?
না সে কথা নয়। আমি বলছি কি, আমি তিন মাসের ছুটি নিয়ে ঘাটশিলায় হাওয়া বদলাতে যেতাম, আপনি যদি সেই সময়ে আমার কাগজটা চালাতেন।
আমি? এবার আমি আকাশ থেকে পড়লাম যেন।
তা, লিখতে না জানলেও কাগজ চালানো যায়। লেখক হওয়ার চেয়ে সম্পাদক হওয়া সোজা। আপনার সঙ্গে আমার এই চুক্তি থাকবেঃ আপনাকে নামজাদা লেখকদের তালিকা দিয়ে যার, তাঁদের লেখা আপনি চোখ বুজে চালিয়ে দেবেন কেবল কপি মিলিয়ে প্রুফ দেখে দিলেই হল। সেই সব লেখার শেষ পাতায় তলায় যা এক-আধুট জায়গা পড়ে থাকবে সেখানে আপনার এই ধরনের ছোট ছোট কবিতা আপনি ছাপতে পারবেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। এই রকম কৃষি কবিতা–ওলকপি, গোলআলু, শকরকন্দ–যার সম্বন্ধে খুশি লিখতে পারেন।