তারপর, এক একে আর যে-কটা নামজাদা মাসিক ছিল সবাইকে যাচাই করা হল–কিন্তু ফল একই। আট আনার পেট-মোটাদের ছেড়ে ছ-আনার কাগজদের ধরলাম–অবশেষে চার আনা দামের নব্যপন্থীদেরও বাজিয়ে দেখা গেল। নাঃ, সব শেয়ালের একই রা! হ্যাঁ, গল্পটা ভালই, তবে ছাপতে তারা অক্ষম! আরে বাপ, এত অক্ষমতা যে কেন তাতো আমি বুঝতে পারি নে, যখন এত লেখাই অনায়াসে ছাপতে পারছ তোমরা! মাসিক থেকে পাক্ষিক–পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিক নামলাম; অগত্যা লেখাটার দারুণ অমর্যাদা ঘটছে জেনেও দৈনিক সংবাদপত্রেই প্রকাশের জন্য পাঠালাম। কিন্তু সেখান থেকেও ফেরত এল। দৈনিকে নাকি অত বড় সংবাদ ধরবার জায়গাই নেই। আশ্চর্য! এত আজেবাজে বিজ্ঞাপন যা কেউ পড়ে না তার জন্য জায়গা আছে, আমার বেলাই যত স্থানাভাব? বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে ছাপলেই তো হয়। কিন্তু অদ্ভুত এঁদের একগুয়েমি–সব সংবাদপত্র থেকেই বারম্বার সেই একই দুঃসংবাদ পাওয়া গেল।
তখন বিরক্ত হয়ে, শহর ছেড়ে মফঃস্বলের দিকে লক্ষ্য দিতে হল । অর্থাৎ লেখাটা দিগ্বিদিকে পাঠাতে শুরু করলাম। মেদিনীপুর-মন্থন, চুঁচুড়া-চন্দ্রিকা, বাঁকুড়া–হরকরা, ফরিদপুর- সমাচার, গৌহাটি-গবাক্ষ, মালদহের গৌড়বান্ধব–কারুকেই বাদ রাখলাম না। কিন্তু শহরে পেট-মোটাদের কাছ থেকে যে দুর্ব্যবহার পাওয়া গেছে, পাড়াগেঁয়ে ছিটে ফোঁটাদের কাছে তার রকমফের হল না। আমার বিরুদ্ধে দেশব্যাগী এক দারুণ ষড়যন্ত্র আমার সন্দেহ হতে লাগল।
এইভাবে সেই প্রথম ও পুরোবর্তী লেখার ওপরে ট্রাই এন্ড ট্রাই এগেন পলিসির কার্য্যকারিতা পরীক্ষা করতেই বাংলা মুলুকের তাবৎ কাগজ আর সাড়ে তিন বছর গড়িয়ে গেল বাকি রইল কেবল একখানি কাগজ কৃষি সম্বন্ধীয় সাপ্তাহিক। চাষাড়ে কাগজ বলেই কি ওর দিকে এতাবৎ আমি মনোযোগ দিইনি, তারা কি আমার এই সাহিত্য রচনার মূল্য বুঝবে? ফেরত তো দেবেই, হয়তো সঙ্গে সঙ্গে বলে পাঠাবে, মশাই আপনার আষাড়ে গল্প আমাদের কাগজে অচল; তার চেয়ে ফুলকপির চাষ সম্বন্ধে যদি আপনার কোনো বক্তব্য থাকে তা লিখে পাঠালে বরং আমরা বেয়ে চেয়ে দেখতে পারি।
এই ভয়েই এতদিন ওধারে তাকাইনি কিন্তু এখন আর আমার ভয় কি? (ডুবন্ত লোক কি কুটো ধরতে ভয় করে?) কিন্তু না; ওদের কাছে আর ডাকে পাঠানো নয়, অনেক ডাকখরচা গেছে অ্যাদ্দিন, এবার লেখা সমভিব্যাহারে আমি নিজেই যাব।
দেখুন আপনি–আপনিই সম্পাদক, না? আমি–আমি একটা একটা লেখা এনেছিলাম আমি–? উক্ত সম্পাদকের সামনে হাজির হয়ে হাঁক পাড়লাম।
গভীর ভদ্রলোক চশমার ফাঁকে কটাক্ষ করলেন–কই দেখি!
একটা গল্প। একেবারে নতুন ধরনের–আপনি পড়লেই বুঝতে পারবেন। লেখাটা বাড়ির দিলাম আনকোরা প্লটে আনকোরা স্টাইলে একেবারে–
ভদ্রলোক গল্পে মনোযোগ দিয়েছেন দেখ আমি দেখে আমি বাক্যযোগ স্থগিত রাখলাম। একটু পড়তেই সম্পাদকের কপাল কুঞ্চিত হল, তারপর ঠোঁট বেঁকে গেল, নাক সিটকাল, দাড়িতে হাত পড়ল,যতই তিনি এগুতে লাগলেন, ততই তা চোখ-মুখের চেহারা বদলাতে লাগল, অবশেষে পড়া শেষ করে যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন তখন বদলাতে লাগল, অবশেষে পড়া শেষ করে যখন তিনি আমার দিকে তাকালেন তখন মনে হল তিনি যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। হতেই হবে। কিরকম লেখা একখান!
হ্যাঁ, পড়ে দেখলাম-নিতান্ত মন্দ হয়নি। তবে এটা যে একটা গল্প তা জানা গেল আপনি গল্পের নামের পাশে ব্র্যাকেটের মধ্যে কথাটা লিখে দিয়েছেন বলে –নতুবা বোঝার আর কোনো উপায় ছিল না।
তা বটে। আপনারা সম্পাদকরা যদি ছাপেন তবেই নতুন লেখক আমরা উৎসাহ পাই। বলতে বলতে আমি গলে গেলাম, এ গল্পটা আপনার ভাল লেগেছে তাহলে?
লেগেছে এক রকম। তা এটা কি–
হ্যাঁ অনায়াসে! আপনার কাগজের জন্যেই তো এনেছি।
আমার কাগজের জন্য? ভদ্রলোক বসেই ছিলেন কিন্তু মনে হল যেন আরো একটু বসে গেলেন, তা আপনি কি এর আগে আর কখনও লিখেছেন?
ঈষৎ গর্বের সঙ্গেই আমি জবাব দিলাম–নাঃ, এই আমার প্রথম চেষ্টা।
প্রথম চেষ্টা? বটে? ভদ্রলোক ঢোঁক গিললেন, আপনার ঘড়িতে কটা এখন?
ঘড়িটা পকেট থেকে বার করে অপ্রস্তুত হলাম, মনে পড়ল কদিন থেকেই এটা বন্ধ যাচ্ছে, অথচ ঘড়ির দোকানে দেওয়ার অবকাশ ঘটেনি। সত্য কথা বলতে কি, সম্পাদকের কাছে ঘড়ি না হোক অন্ততঃ ঘড়ি চিহ্নমাত্র না নিয়ে যাওয়াটা বে-স্টাইলি হবে ভেবেই আজ পর্যন্ত ওটা সারাতে দিইনি। এখান থেকে বেরিয়েই বরাবর ঘড়ির দোকানে যাব এই মতলব ছিল।
ঘড়িটাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললাম–নাঃ বন্ধ হয়ে গেছে দেখছি। কদিন থেকেই মাঝে মাঝে বন্ধ যাচ্ছে।
তাই নাকি? দেখি তো একবার? তিনি হাত বাড়ালেন।
ঘড়ি মেরামতও জানেন নাকি আপনি? আমি সমভরে উচ্চারণ করলাম।
জানি বলেই তো মনে হয়। কই দেখি, চালানো যায় কিনা।
আমি আগ্রহভরে ঘড়িটা ওঁর হাতে দিলাম–যদি নিখরচায় লেখা আর ঘড়ি একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া যায়, মন্দ কি!
ভদ্রলোক পকেট থেকে পেনসিল-কাটা ছুরি বার করলেন; তার একটা চাড় দিতেই পেছেনের ~ ডালার সবটা সটান উঠে এল। আমি চমকে উঠতেই তিনি সান্ত্বনা দিলেন, ভয় কি? জুড়ে দেব আবার।
সেই ভোতা ছুরি এবং সময়ে সময়ে একটা চোখা কলমের সাহায্যে তিনি একটার পর একটা ঘড়ির সমস্ত অল্প-প্রত্যঙ্গ খুলে ফেলতে লাগলেন। মিনিট এবং সেকেন্ডের কাঁটাও বাদ গেল না। খুঁটিনাটি যত যন্ত্রপাতি টেবিলের উপর পাকার হলো তিনি এক একটাকে চশমার কাছে এনে গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সূক্ষ্ম তারের ঘোরানো কি একটা জালের মতো বোধহয় হেয়ার স্প্রিংই হবে দুহাতে ধরে সেটাকে লম্বা করার চেষ্টা করলেন। দেখতে দেখতে সেটা দুখান হয়ে গেল, মৃদু হাস্য করে আমার দিকে তাকালেন; তার মানে, ভয় কি, আবার জুড়ে দেব।