জীবন-স্মৃতি রচনার পর আত্মীয়-স্বজনের কথা আমার স্মরণে এল। পরিবার আমার খুব সামান্য–একমাত্র মা এবং একমাত্র ভাই সুতরাং সে দুশ্চিন্তার সমাধা করা ও খুব কঠিন হলো না। এক সেকেন্ডে–দু সেকেন্ড-তিন-চার-পাঁচ সেকেন্ড-এর মধ্যে এত কান্ড হয়ে গেল, কিন্তু ভালুক ব্যাটা এখনো এসে পৌঁছল না তো। কি হলো তার? এতটা দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কি?
ঘাড়টা ফিরিয়ে দেখি, ওমা, সেও যে সটান চিৎপাত। সাহস পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম–এ ভালুকটা তো ভারি অনুকরণ প্রিয় দেখছি! কিন্তু নড়ে না চড়ে না যে। কাছে গিয়ে দেখলাম, নিজের বন্দুকের গুলিতে নিজেই মারা গেছে বেচারা। বুঝলাম অত্যন্ত মনক্ষোভেই এই অন্যায়টা সে করেছে। প্রথম দিন বৌদির ব্যবহারে সে লজ্জা পেয়েছিল, আজ আমার কাপুরুষতার পরিচয়ে সে এতটা মর্মাহত হয়েছে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া তার উপায় ছিল না।
বন্দুক হাতে সগর্বে বাড়ি ফিরলাম। আমার জাম-হীনতা লক্ষ্য করে দাদার অসন্তোষ প্রকাশের পূর্বেই ঘোষণা করে দিলাম–বৌদির প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ভালুকটাকে আজ নিপাত করে এসেছি। কেবল দুটো শট–ব্যস খতম।
দাদা, বৌদি এমন কি খুকি পর্যন্ত দেখতে ছুটল। আমিও চললাম–এবার আর বন্দুকটাকে সঙ্গে নিলাম না–পাঁচজনে যাত্রা নিষেধ, পাঁজিতে লেখে। দাদা বহু পরিশ্রমে ও বৌদির সাহায্যে, ভালুকের ল্যাজটাকে দেহচ্যুত করে, এই বৃহৎ শিকারের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ সযত্নে আহরণ করে নিয়ে এলেন। এই সহযোগিতার ফলে দাদা ও বৌদির আবার ভাব হয়ে গেল। আপনি আত্মদান করে ভালুকটা দাদা ও বৌদির মধ্যে মিলনগ্রন্থি রচনা করে গেল–তার এই অসাধারণ মহত্ত্বে সে নতুন মহিমা নিয়ে আমার কাছে প্রতিভাত হলো। আমার রচনায় তাকে অমর করে রাখলাম, অন্তত আমার চেয়ে সে বেশিদিন টিকবে আশা করি।
বাড়ি ফিরেই দাদা বললেন–অমৃতবাজার পত্রিকায় খবরটা পাঠিয়ে দিই কি বসিল?–A big wild bear was heroically killed by my young brother aged-aged-কত রে?
আমার age তুমি তা জানোই!–আমি উত্তর দিলাম।
উঁহু, কমিয়ে লিখতে হবে কিনা। নইলে বাহাদুরি কিসের! দশ বারো বছর কমিয়ে দিই, কি বলিস?
কিন্তু দশ-বারো বছর কমিয়েও আমার বয়স দশ-বারো বছরের কাছাকাছি আনা গেল না–(সাতে দাঁড় করানো তো দুঃসাধ্য ব্যাপার।) তখন বাধ্য হয়ে Young এই বিশেষণের ওপর নির্ভর করে আমার বয়সাল্পতাটা লোকের অনুমানের ওপর ছেড়ে দেওয়া গেল।
সেদিন আমার পাতে দু-দুটো মুড়ো পড়ল, খুকি মাকে বলে রেখেছে তার কাকামণিকে দিতে। আমি আপত্তি করলাম না, ভালুকের আত্মবিসর্জনে যখন করিনি, খুকির মুড়ো–বিসর্জনেই বা করব কেন? সবচেয়ে আশ্চর্য এই আমার ঝোলের বাটির অস্বাভাবিক উচ্চতা দেখেও দাদা আজ ভ্রূক্ষেপ করলেন না!
আমার সম্পাদক শিকার
হাম কিংবা টাইফয়েড়, সর্পাঘাত কিংবা মোটরচাপা, জলে ডোবা কিংবা গাছ থেকে পড়ে যাওয়া, এগজামিনে ফেল করা, কিংবা কাঁকড়া-বিছে কামড়ানো–জন্মাবার পর এক কোনো না কোনটা কারু-না-কারু বরাতে কখনো কখনো একবার ঘটেই। অবশ্য যে মোটর চাপা পড়ে তার সপার্ঘাত হওয়া খুব শক্ত ব্যাপার, সেরকম আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই হয়, এবং যার সর্পাঘাত হয় তাকে আর গাছ থেকে পড়তে হয় না। যে ব্যক্তি জলে ডুবে যায় মোটরচাপা পড়ার সুযোগ তার যৎসামান্যই এবং উঁচু দেখে গাছ থেকে ভাল করে পড়তে পারলে তার আর জলে ডোবার ভয় থাকে না। তবে কাঁকড়া-বিছের কামড়ের পরেও এগজামিনে ফেল করা সম্ভব, এবং অনেকক্ষেত্রে হামের ধাক্কা সামলাবার পরেও টাইফয়েড হতে দেখা গেছে। হামেশাই দেখা যায়।
কিন্তু বলছিই, এসব কাজ কারু না কারু অদৃষ্টে ঘটে কখনো বা কদাচ। কিন্তু একটা দুর্ঘটনা প্রায় সবারই জীবনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে অনিবার্যরূপে প্রকট হয়, তার ব্যকিক্রম খুব বড় একটা দেখা যায় না। আমি গোঁফ ওঠার কথা বলছিলেন–তার চেয়ে শক্ত ব্যারাম–গোঁফ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লেখক হবার প্রেরণা মানুষকে পেয়ে বসে।
আমরাও তাই হয়েছিল। প্রথম গল্প লেখার সূত্রপাতেই আমার ধারণা হয়ে গেল আমি দোলগোবিন্দবাবুর মতো লিখছে পেরেছি। দোলগোবিন্দকে আমি রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ মনে করতাম–কেননা একই কাগজে দুজনের নাম একই টাইপে ছাপার অক্ষরে দেখেছিলাম আমি। এমন কি অনেক সময়ে দোলগোবিন্দকে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বড় লেখক আমার বিবেচনা হয়েছে– তার লেখা কেমন জলের মতো বোঝা যায়, অথচ বোঝার মতন মাথায় চাপে না! কেন যে তিনি নোবেল। প্রাইজের জন্য চেষ্টা করেন না, সেই গোঁফ ওঠার প্রাক্কালে অনেকবার আমি আন্দোলন করেছি–অবশ্যি মনে মনে। একন বুঝতে পারছি পণ্ডিচেরী, কিংবা পাশাপাশি, রাঁচীতে তার পরামর্শ দেবার কেউ ছিল না বলেই। আরও দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের লেখা এখনও চোখে পড়ে থাকে কিন্তু কোনো কাগজ কোনো কাগজ-পত্রেই দোলগোবিন্দ বাবুর আর দেখা পাই না।
যাই হোক, গল্পটা লিখেই বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাসিকপত্রে, দোলগোবিন্দ বা বরীন্দ্রনাথের রচনার ঠিক পাশেই সেটা প্রকাশ করার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। নিশ্চিন্তে বসে আছি যে নিশ্চয়ই ছাপা হবে এবং ছাপার অক্ষরে লেখাটা দেখে কেবল আমি কেন, রবীন্দ্রনাথ, এমন কি স্বয়ং দোলগোবিন্দ পর্যন্ত পুলকিত হয়ে উঠবেন–ও হরি! পর পর তিন মাস হবার পরে একদিন দেখি বুকপোস্টের ছদ্মবেশে লেখাটা আমার কাছেই আবার ফিরে এসেছে। ভারী মর্মাহত হলাম। বলাই বাহুল্য! শোচনীয়তা আরও বেশি এইজন্য যে তিন মাসে তিনখানা কাগজ কিনেছিলাম–খতিয়ে দেখলাম সেই দেড়টা টাকাই ব্যাটাদের লাভ!