দাদা জামের ঝুড়ি আর বন্দুকটা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললেন–চট করে যা, দেরি করিসনি। তোর ভয় কচ্ছে নাকি?
অগত্যা আমায় বেরুতে হলো। বেশ দেখতে পেলুম, আমার মাসতুতো বড়দা আড়ালে একটু মুচকি হেসে নিলেন। মাছের-মুড়োর বিরহ তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। নাঃ, এই বিদেশে বিভুয়ে মাসতুতো ভাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে ভাল করিনি। খতিয়ে দেখলাম, ওই চব্বিশ জোড়া কাপড়ই বড়দার নেট লাভ।
বেরিয়ে পড়লাম। এক হাতে ঝুড়ি, আরেক বন্দুক। নিশ্চয়ই আমাকে খুব বীরের মত দেখাচ্ছিল। যদিও একটু বিশ্রী রকমের ভারী, তবু বন্দুকে আমায় বেশ মানায়। ক্রমশ মনে সাহস এলো–আসুক না। ব্যাটা ভালুক, তাকে দেখিয়ে দিচ্ছি এবং বড়দাকেও! মাসতুতো ভাই কেবল চোরে-চোরেই হয় না, শিকারীতে-শিকারীতেও হতে পারে! উনিই একজন বড় শিকারী, আর আমি বুঝি কিছু না?
বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলাম। আসুক না ব্যাটা ভালুক এইবার! ঝুড়িটা হাতে নেওয়ায় যতটা মনুষ্যত্বের মর্যাদা লাঘব হয়েছিল, বন্দুকে তার ঢের বেশি পুষিয়ে গেছে। আমাকে দেখাচ্ছে ঠিক বীরের মত। অথচ দুঃখের বিষয়, এই জঙ্গল পথে একজনও দেখবার লোক নেই। এ সময়ে একটা ভালুককে দর্শকের মধ্যে পেলেও আমি পুলকিত হতাম।
বন্দুক কখনো যে ছুঁড়িনি তা নয়। আমার এক বন্ধুর একটা ভাল বন্ধুক ছিল, হরিণ-শিকারের উচ্চাভিলাষ বশে তিনি ওটা কিনেছিলেন। বহুদিনের চেষ্টায় ও পরিশ্রমে তিনি গাছ-শিকার করতে পারতেন। তিনি বলতেন–গাছ শিকারের অনেক সুবিধে, প্রথমত–গাছেরা হরিণের মত অত দৌড়ায় না, এমন কি ছুটে পালাবার বদভ্যাসই নেই ওদের, দ্বিতীয়ত–ইত্যাদি, সে বিস্তর কথা। তা, তিনি সত্যিই গাছ শিকার করতে পারতেন–অনন্ত বাতাস একটু জোর না বইলে, উপযুক্ত আবহাওয়ায় এবং গাছটাও হাতের কাছে হলে, তিনি অনায়াসে লক্ষ্য ভেদ করতে পারতেন–প্রায় প্রত্যেক বারই।
আমি তার সঙ্গে গাছ-শিকার করেছি, তবে যে-কোন গাছ আমি পারতাম না। আকারে-প্রকারে কিছু বড় হলেই আমার পক্ষে সুবিধে হতো, খুঁড়ির দিকটাতেই আমার স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। বৃক্ষ শিকারে যখন এতদিন হাত পাকিয়েছি, তখন ভালুক-শিকারে যে একেবারে বেহাত হব না, এ ভরসা আমার ছিল।
জঙ্গলে গিয়ে দেখি পাকা পাকা জামে গাছ ভর্তি! জাম দেখে জাম্ববানের কথা আমি ভুলেই গেলাম। এমন বড় বড় পাকা পাকা খাসা জাম! জিভ লালায়িত হয়ে উঠল। বন্দুকটা একটা গাছ ঠেসিয়ে, দুহাত ঝুড়ি ভরতে লাগলাম। কতক্ষণ কেটেছে জানি না, একটা খস খস শব্দে আমার চমক ভাঙল। চেয়ে দেখি-ভালুক!
ভালুকটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমি যা করছি সেও তাতেই ব্যাপৃত! একহাত দিয়ে জামের একটা নীচু ডালকে সে বাগিয়ে ধরেছে, অন্য হাতে নির্বিচারে মুখে পুরছে– কাঁচা ডাঁসা সমস্ত। আমি বিস্মিত হলাম বললে বেশি বলা হয় না! বোধ হয়, আমি ঈষৎ ভীতই হয়েছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, ভালুক দর্শনের বাঞ্ছা একটু আগেই করেছি বটে, কিন্তু দেখা না পেলেই যেন আমি বেশি আশ্বস্ত হতাম। ঠিক সেই মারাত্মক মুহূর্তেই আমাদের চারি চক্ষুর মিলন!
আমাকে দেখেই ভালুকটা জাম খাওয়া স্থগিত রাখল এবং বেশ একটু পুলকিত-বিস্ময়ের সঙ্গে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আমি মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। গাছে উঠতে পারলে বাঘের হাত থেকে নিস্তার আছে, কিন্তু ভালুকের হাতে কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ভালুকরা গাছে উঠতেও ওস্তাদ।
অগত্য শ্রেষ্ঠ উপায়–পালিয়ে বাঁচা। বন্দুক ফেলে যেতে যেতে দাদার নিষেধ; বন্দুকটা বগল দাবাই করে চোচা দৌড় দেবার মতলব করছি, দেখলাম সেও আস্তে আস্তে আমার দিকে এগুচ্ছে। আমি দৌড়লেই যে সে আমার পিছু নিতে দ্বিধা বোধ করবে না, আমি তা বেশ বুঝতে পারলাম। ভালুকজাতির ব্যবহার আমার মোটেই ভাল লাগল না।
আমিও দৌড়চ্ছি, ভালুকও দৌড়চ্ছে। বন্দুকের বোঝা নিয়ে ভালুক দৌড়ে আমি সুবিধে করতে পারব না বুঝতে পারলাম। যদি এখনও বন্দুকটা না ফেলে দিই, তাহলে নিজেকেই এখানে ফেলে যেতে হবে। অগত্যা অনেক বিবেচনা করে বন্দুককেই বিসর্জন দিলাম।
কিছুদূর দৌড়ে ভালুকের পদশব্দ না পেয়ে ফিরে তাকালাম। দেখলাম সে আমার বন্দুকটা নিয়ে পড়েছে। ওটাকে নতুন রকমের কোন খাদ্য মনে করেছে কিনা ওই জানে। আমিও স্তব্ধ হয়ে ওর কার্য্যকলাপ নিরীক্ষণ করছিলাম।
ভালকুটা বেশ বুদ্ধিমান। অল্পক্ষণেই সে বুঝতে পারল ওটা খাদ্য নয়, হাতে নিয়ে দৌড়াবার জিনিস। এবার বন্দুকটা হস্তগত করে সে আমাকে তাড়া করল। বিপদের ওপর বিপদ-এবার আমার বিপক্ষে ভালুক এবং বন্দুক। ভালুকটা কি রকম শিকারী আমার জানা ছিল না। বন্দুক ওর হাত অন্তর আমার চেয়ে খারাপ নয় বলেই আমার আন্দাজ।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। কয়েক লাফ না যেতেই পেছনে বন্দুকের আওয়াজ। আমি চোখ কান বুজে সটান শুয়ে পড়লাম—যাতে গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়–যুদ্ধের তাই রীতি কিনা! তারপর আবার দুড়ুম! অবার সেই বন্দুক গর্জ্জন। আমি দুরু দুরু বক্ষে শুয়ে দুর্গনাম করতে লাগলাম। ভালুক-শিকার করতে এসে ভালুকের হাতে না শিকৃত হয়ে যাই।
আমি চোখ বুজেও যেন স্পষ্ট দেখছিলাম, ভালুকটা আস্তেআস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার গুলিতে আমি হতাহত–অন্তত একটা কিছু যে হয়েছি,সে বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। গুলির আঘাতে না যাই, ভালুকের আঘাতে এবার গেলাম। মৃত্যুর পূর্ব্বক্ষণে জীবনের সমস্ত ঘটনা বায়স্কোপের ফিলমের মত মনশ্চক্ষের ওপর দিয়ে চলে যায় বলে একটা গুজব শোনা ছিল। সত্যিই তাই–একেবারে হুবহু। ছোটবেলার পাঠশালা পালানো, আম্রশিকার থেকে শুরু করে আজকের ভালুক শিকার পর্যন্ত প্রায় চারশো পাতার একটা মোটা সচিত্র জীবন-স্মৃতি আমার মনে মনে ভাবা, লেখা, ছাপাপো, প্রফ কারেক্ট করা– এমন কি তার পাঁচ হাজার কপি বিক্রি অবধি শেষ হয়ে গেল।