এইভাবে হপ্তাতিনেক কাটার পর হঠাৎ একদিন বৃষ্টি নামল। মুড়ি পাপরভাজা দিয়ে অকাল বর্ষণটা উপভোগ করছি আমরা। এমন সময়ে মাহুত ওরফে সহিস এসে খবর দিল, বাদলার সঙ্গে সঙ্গে হাতিটার ভয়ানক ছটফটানি আর হাঁকডাক শুরু হয়েছে। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটলাম আমরা সবাই।
কি ব্যাপার? সত্যিই ভারী ছটফট করছে তো হাতিটা। মনে হয় যেন লাফাতে চাইছে চার পায়ে।
কাকা মাথা ঘামালেন খানিকক্ষণ। বুঝতে পারা গেছে। মেঘ ডাকছে কিনা। মেঘ ডাকলে ময়ূর নাচে। হাতিও নাচতে চাইবে আর আশ্চর্য কি? ময়ূর আর হাতি বোধহয় একজাতীয়? কার্তিক ঠাকুরের পাছার তলায় ময়ূর আর গণেশ ঠাকুরের মাথায় ওই হাতি, আত্মীয়তা থাকাই স্বাভাবিক। যাই হোক, ওর তিন পায়ের শেকল খুলে দাও, কেবল এক পায়ের থাক, নাচুক একটুখানি!
তিন পায়ের শেকল খুলে দিতেই ও যা শুরু করল, হাতির ভাষায় তাকে নাচই বলা যায় হয়তো। কিন্তু সেই নাচের উপক্রমেই, আরেক শেকল ভাঙতে দেরি হয় না। মুক্তি পাবামাত্র হাতিটা ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে পড়ে, সহিস বাধা দেবার সামান্য প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু এক শুড়ের ঝাঁপটায় তাকে ভূমিসাৎ করে দিয়ে চলে যায়।
তারপর দারুণ আর্তনাদ করতে মুক্তকচ্ছ ড় তুলে ছুটতে থাকে সদর রাস্তায়। আমরাও দস্তুরমত ব্যবধান রেখে, পেছনে পেছনে ছুটি। কিন্তু হাতির সঙ্গে ঘোড়াদৌড়ে পারব কেন? আমাদের মানুষদের দুটি করে পা মাত্র সম্বল। হাতির তুলনায় তাও খুব সরু সরু। দেখতে দেখতে হাতিকে আর দেখা যায় না। কেবল তার ডাক শোনা যায়। অতি দূর দুরান্ত থেকে।
তিনঘণ্টা পরে খবর আসে, মাইল পাঁচেক দূরে এক পুকুরে গিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আত্মহত্যা করবে না তো হাতিটা? শ্বেতহস্তীর কাণ্ড, কিছুই বোঝা যায় না। কাকিমা কাঁদতে শুরু করেন, পূজো আচ্চা করা হয়নি ঠিকমতন, হস্তীদেব তাই হয়ত এমন ক্ষেপে গেছেন, এখন কি সর্বনাশ হয় কে জানে? বংশলোপই হবে গিয়ে হয়তো।
বংশ বলতে তো সর্বসাকুল্যে আমি, যদিও পরস্মৈপদী। কাকিমার কান্নায় আমারই ভয় করতে থাকে।
কাকা এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে ছোটেন শ্বেতহস্তীকে প্রসন্ন করতে, আমরা সকলেই চলি কাকার সঙ্গে। কিন্তু হাতির যেরকম নাচ আমি দেখেছি তাতে সহজে ওকে হাতানো যাবে বলে আমার ভরসা হয় না।
পথের ধারে মাঝে মাঝে ভাঙা আটচালা চোখে পড়ে, সেগুলো ঝড়ে উড়েছে কি হাতিতে উড়িয়েছে বোঝা যায় না সঠিক। আশেআশে জনপ্রাণীও নেই যে জিজ্ঞাসা করে জানা যাবে। যতদুর সম্ভব হস্তীরেরই কীর্তি সব! শ্বেত শুণ্ডের আবির্ভাব দেখেই বসিন্দারা মলুক ছেড়ে সটকেছে এই রকমই সন্দেহ হয় আমাদের।
কিছুদূর গিয়ে হস্তীলীলার আরো ইতিহাস জানা যায়। একদল গঙ্গাযাত্রী একটি আধমড়াকে নিয়ে যাচ্ছিল গঙ্গাযাত্রায়, এমন সময়ে মহাপ্রভু এসে পড়েন। অমন ঘটা করে ঢাল ঢোল পিটিয়ে রাস্তা জুড়ে যাওয়াটা ওঁর মনঃপুত হয় না। উনি ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। শোনা গেল, এক একজনকে অনেক দূর অবধি তাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। কেবল বাদ দিয়েছেন, কেন জানা যায়নি, সেই গঙ্গাযাত্রীকে। সেই বেচারা অনেকক্ষণ অবহেলায় পড়ে থেকে অগত্যা উঠে বসে দেহররক্ষা কাজটা এ যাত্রা স্থগিত রেখে একলা হেঁটে বাড়ি ফিরে গেছে।
অবশেষে সেই পুকুরের ধারে এসে পড়া গেল। কাকা বহু সাধ্য-সাধনা, অনেক স্তব স্তুতি করেন। হাতিটা গঁড় খাড়া করে শোনে সব, কিন্তু নড়ে চড়ে না। রসগোল্লার হাঁড়ি ওকে দেখানো হয়, ঘাড় বাঁকিয়ে দ্যাখে, কিন্তু বিশেষ উৎসাহ দয়াখায় না।
পুকুরটা তেমন বড় নয়। কাকা একেবারে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ান–কাছাকাছি গিয়ে কথা কইলে ফল হয় যদি। কিছু ফল হয়, কেন না হাতিটা কাকা বরাবর তার শুঁড় বাড়িয়ে দ্যায়।
আমি বলি পালিয়ে এসো কাকা। ধরে ফেলবে।
দূর। আমি কি ভয় খাবার ছেলে? তোর মতন অত ভীতু নই আমি। কাকার সাহস দেখা যায়, কেন, ভয় কিসের? তোমাকে কিছু বলব না আমি ওর মনিব-মনিব-উঁ-হুঁ-হুঁ-শ্রীবিষ্ণু! সেবক–
বলতে বলতে কাকা ভিজ কাটলেন। কান মললেন নিজের!–উঁহু, মনিব হব কেন, অপরাধ নিয়ো না প্রভু শেতহস্তী! আমি তোমার ভক্ত-শ্রীচরণের দাসানুদাস। কি বলতে চাও বলল, আমি কান বাড়িয়ে দিচ্ছি । তোমার ভক্তকে তুমি কিছু বলবে না, আমি জানি। হাতির মতো কৃতজ্ঞ জীব দুই নেই, আর তুমি তো সামান্য হাতি নও, তুমি হচ্ছ একজন হস্তী-সম্রাট।
কাকা কান বাড়িয়ে দ্যান, হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দ্যায়–আমরা রুদ্ধশ্বাসে উভয়ের উৎকর্ণ আলাপের অপেক্ষা করি।
হাতিটা কাকার সর্বাঙ্গে তার শুঁড় বোলায়, কিন্তু সত্যিই কিছু বলে না। কাকার সাহস আরো বেড়ে যায়, কাকা আরো এগিয়ে যান। আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ করেন, দেখছিস, কেমন আদর করছে আমায়, দেখছিস?
কিন্তু হাতিটা অকস্মাৎ শুঁড় দিয়ে কাকার কান পাকড়ে ধরে। কানে হস্তক্ষেপ করায় কাকা বিচলিত হন। কেন বাবা হাতি! কি অপরাধ করেছি বাবা তোমার শ্রীচরণে যে এমন করে তুমি আমার কান মলছ?
কিন্তু হস্তীরাজ কর্ণপাত করে না। কাকার অবস্থা ক্রমশই করুণ হয়ে আসে। তিনি আমার উদ্দেশ্যে (চেষ্টা করেও আমার দিকে তখন তিনি তাকাতে পারে না।) বলেন–বাবা শিবু কান গেল, বোধ হয় প্রাণও গেল। তোর কাকিমাকে বলিস–বলিস যে সজ্ঞানে আমার হস্তীপ্রাপ্তি ঘটে গেছে!