হাতির ডাক ভাষায় বর্ণনা করা দুষ্কর। ডাক শুনেই আমরা দুচার-দশ হাত ছিটকে পড়ি। কাকাও পা গজ পিছিয়ে আসেন।
বাবা! যেন মেঘ ডাকল কড়াক্কড়। কাকা বলেন, সিংহের ডাক কখনো শুনিনি, তবে বাঘ কোথায় লাগে। হ্যাঁ, এমন না হলে একখানা ডাক।
এটাতে হাতির সিংহনাদ হয়ত বলা যায়? না কাকা? আমি বলি।
উপগ্রহটি, যিনি হাতির সমভিব্যাহারে এসেছিলেন, এতক্ষণে একটি কথা বলার সুযোগ পান–প্রায়ই ডাকবে এরকম। শুনতে পাবেন যখন তখন।
প্রায়ই ডাকবে? রাত্রেও? তাহলে তো ঘুমনোর দফা–কাকা যেন একটু দুর্ভাবিতই হন।
উঁহুরাতে ডাকে না। হাতিও ঘুমোয় কিনা। রাত্রে কেবল ওর গুঁড় ডাকে।
তা ডাকে ডাকুক। কিন্তু এর কিরকম রঙ বলত। আবার আমার প্রতি কাকার দৃকপাত-ফর্সা ধবধব করছে। আর সব হাতি কি আর হাতি? এর কাছে তারা সব জানোয়ার। আসল বিলাতী সাহেবের কাছে সাঁওতাল। এই ফর্সা রঙটি বজায় রাখতে হলে সাবান মাখিয়ে একে চান করাতে হবে দুবেলা–ভাল বিলিতি সাবান, হুঁ হুঁ পয়সার জন্য পরোয়া করলে চলবে না। নইলে আমার এমন সোনার হাতি কালো হয়ে যেতে কতক্ষণ?
অমন কাজটিও করবেন না। উপগ্রহটি সবিনয়ে প্রতিবাদ করে।ঐটিই বারণ। স্নানটান একেবারে বন্ধ এর। শ্বেত হস্তীর গায়ে জল ছোঁয়ানই নিষেধ, তাহলেই গলগণ্ড হয়ে, মারা পড়বে!
ঐ গলায় আবার গলগণ্ড? আমি শুধাই। তাহলে তো ভারী গণ্ডগোল!
অ্যাঁ, বলে কি? কাকা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে, তাহলে?
সাধারণ হাতির মতো নয়তো যে রাত দিন পুকুরের জলে পড়ে থাকবে। শ্যামরাজ্যে রীতিমত মন্দিরে সোনার সিংহাসনের ওপরে বসানো থাকে। সেখানে হরদম ধূপধুনো পূজা আরতি চলে। কেবল চামৃত তৈরির সময়েই যা এক আধ ফোঁটা জল ওর পায়ে ঠেকানো হয়। এখানে তো সেরকমটি হবে না।
কাকা তার কথা শেষ করতে দ্যান না–এখানে হবে কি করে? রাতারাতি মন্দিরই বা বানাচ্ছে কে, সোনার সিংহাসনই বা পাচ্ছি কোথায়? তবে পূজারী যোগাড় করা হয়তো কঠিন হবে না, পুরুৎ বামুনের তো আর অভাব নেই পাড়ায়, কিন্তু হাতি পূজোর মন্তর কি তারা জানে?
কাকার প্রশ্নটা আমার প্রতিই হয়। আমি জবাব দিই–হাতির চন্নামেত্য আমি কিন্তু খেতে পারবো না কাকা!
গোড়াতেই বলে কয়ে রাখা ভালো। সেফটি ফার্সট! বলেই দিয়েছে কথায়।
পারবি না? কেন খেতে পারবি না? এ কি তোর গুজরাটি হাতি? কালো আর ভুত? এ হোলো গিয়ে ঐরাবতের বংশধর, স্বর্গের দেবতাদের একজন। খেতেই হবে তোকে–তা না হলে পরীক্ষায় তুই পাশ করতেই পারবিনে।
পরীক্ষার পাশের ব্যাপারে, মেড-ইজির কাজ করবে ভেবে আমি একটু নরম হই। কম্প্রমাইজের প্রস্তাব পাড়তে যাচ্ছি, এমন সময়ে উপগ্রহটি বলে ওঠে–না না, পূজা করবার আবশ্যক নেই। হস্তী পূজোর ব্যবস্থা তো নেই এদেশে। নিত্যকর্ম পদ্ধতিতেও তার বিধি খুঁজে পাওয়া যাবে না। পূজো করার দরকার নেই এমনি আস্তাবলে ওকে বেঁধে রাখলেই হবে। গায়ে জলের ছোঁড়াচটিও না লাগে, সহিস কেবল এই দিকে কড়া নজর রাখে যেন।
সহিস? হাতির আবার সহিস কি? মাহুতের কথা বলছ বুঝি? কাকা জিজ্ঞেস করেন।
সহিস মানে, যে ওর সেবা করবে, সইবে ওকে। সহিস কাঁধে বসলেই মাহুত হয়ে যায়। কিন্তু ওর কাঁধে বসা যাবে না তো। ভয়ানক অপরাধ তাতে। উপগ্রহটি ব্যাখ্যা করে দ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে হাতির উদ্দেশ্যেই হাত তুলে নমস্কার জানায় কিম্বা মাথা চুলকায় কে জানে!
ওর স্নানের ব্যবস্থা তো হোলো, স্নানটান নাস্তি। আচ্ছা, এবার ওর আহারের ব্যবস্থা শুনি– কাকা উগ্রীব হন, সাধারণ হাতি তো নয় সে সাধারণ খাবার খাবে?–তারপর কি যেন একটু ভাবেন খায় টায় তো? না তাও বন্ধ?
তাঁর অদ্ভুত প্রশ্নে আমরা সবাই অবাক হই। বলে ফেলি, খাবে না কি বলছেন? না খেলে অত বড় দেহ টেকে কখনো তাহলে? হাতির খোরাক বলে থাকে কথায়।
আমি ভাবছিলাম, চানটানের পাট যখন নেই তখন খাওয়া টাওয়ার হাঙ্গামা আছে কিনা কে জানে। কাকা ব্যক্ত করেন, তা কি খায় ও বলতো?
উপগ্রহটি বলে, সব কিছুই খায়, সে বিষয়ে ওর রুচি খুব উদার। মানুষ পেলে মানুষ খাবে, মহাভারত পেলে মহাভারত। মানে, মানুষ আর মহাভারতের মাঝামাঝি ভুভারতে যা কিছু আছে সবই খেতে পারে।
আমি টিপ্পনী কাটি, তা হলে হজম শক্তিও বেশ ওর।
ভালো, খুবই ভালো। কাকা সন্তোষ প্রকাশ করেন, যদি মানুষ পায়, কতগুলো খাবে? টাটকা মানুষ অবশ্যি।
যতগুলো ওর কাছাকাছি আসবে টাটকা-বাসি নিয়ে বড় বিশেষ মাথা ঘামাবে না। বলেছি তো খুব উদার রুচি।
তুই ওর কাছে যাসনে যেন, খবরদার! কাকা আমাকে সাবধান করেন, তবে তোকে ও মানুষের মধ্যে ধরবে কিনা কে জানে!
হ্যাঁ, তা ধরবে কেন? আমি মনে মনে রাগি তা যদি ও ধরতে পারে, তাহলে ওকেই বা কে মানুষের মধ্যে ধরতে যাচ্ছে? ওর রুচি যেমনই হোক, ওর বুদ্ধিশুদ্ধির প্রশংসা তো আমি করতে পারব না। কাকার মধ্যেই বরং ওকে গণ্য করব আজ থেকে।
তবে একেবারেই নিশ্চিন্ত হতে চান কাকা, খাদ্য হিসাবে কি ধরনের মানুষের ওপর ওর বেশি ঝোঁক?
একবার কটাক্ষে আমার দিকে তাকিয়ে নেন আমার জন্যেই ওঁর যত ভাবনা যেন।
চেনা লোকেরই পক্ষপাতী, চেনাদেরই পছন্দ করবে বেশি। তবে অচেনার ওপরেও বিশেষ আক্রোশ নেই। পেলে তাদেরো ধরে খাবে।
ভালো ভালো। আর কতগুলো মহাভারত? প্রত্যেক ক্ষেপে?