নিশ্চয় নয়! আর তা না হলে বড়ালোক কিসের? এই বলে গ্রহটি উপসংহার করে। এবং, আমার কাকাকেও প্রায় সংহার করে আনে।
কাকা স্ট্যাম্প সংগ্রহ করছেন–এ খবর রটতে বাকী থাকে না। পঞ্চাশখানা য়্যালবাম যখন প্রায় ভরিয়ে এনেছেন তখন একদিন সকালে উঠে দেখেন বাড়ির সামনে পাঁচশো ছেলে দাঁড়িয়ে। কি ব্যাপার? জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় ওরা সবাই এসেছে কাকার কাছে, কেউ স্ট্যাম্প বিক্রি করতে, কেউ বা কিনতে। সবারই হাতে স্ট্যাপের য়্যালবাম।
কাকা তখন গ্রহকে ডাকিয়ে পাঠান, একি কাণ্ড? এরাও সব ইস্টাম্পো সংগ্রহ করছে যে? করছে বলে করছে, অনেকদিন ধরে করছে–আমার ঢের আগের থেকেই–একি কাণ্ড?
কি হয়েছে তাতে? গ্রহটি ভয়ে ভয়ে বলে, কাকার ভাবভঙ্গী তাকে ভীত করে তুলেছে তখন, কেন ওদের কি ও কাজ করতে নেই?
সবাই যা করছে, পাড়ার পুঁচকে ছোঁড়াটা পর্যন্ত–কাকা এবার একেবারে ফেটে পড়েন, তুমি আমাকে লাগিয়েছ সেই কাজে? ছ্যা! কেন, এরাও কি সব বড়লোক নাকি?
বড় বালকও তো নয়। আমি কাকাকে উসকে দিই তার ওপর–নেহাৎ কাছাবাচ্ছা যতো।
কাকা আবার আফসোস করতে থাকেন, ইস্টাম্পে আমার দশ-দশ হাজার টাকা তুমি জলে দিলে হ্যাঁ! ছ্যা!
গ্রহ আর কি জবাব দেবে? সে তখন বিগ্রহে পরিণত হয়েছে। পাথরের প্রতিমূর্তির মতই তার মুখে কোনো ভাবান্তর নেই আর। তিত-বিরক্ত হয়ে কাকা নিজের যত য়্যালবাম খুলে ছিঁড়ে চ্যাঙড়াদের ভেতর পাম্পের লুট লাগিয়ে দ্যান সেই দণ্ডেই।
কিন্তু স্ট্যাম্প ছাড়লেও বাতিক তাঁকে ছাড়ল না! বাতিক জিনিসটা প্রায় বাতের মতই, একবার ধরলে ছাড়ানো দায়! তিনি বললেন–ইস্টাম্পো নয়–এমন জিনিস সংগ্রহ করতে হবে যা কেউ করে না, করতে পারে ও না। সেই রকম কিছু থাকে তো তোমরা আমায় বাতলাও!
তখন নবগ্রহ মিলে মাথা ঘামাতে শুরু করল। তাদের প্রেরণায়, তাদেরই, আরো নব্বই জন উপগ্রহের মাথা ঘামতে লাগল। নতুন হবি বের করতে হবে এবার রীতিমতন বুদ্ধি খাঁটিয়ে।
নানা রকমের প্রস্তাব হয়! খেচরের ভেতর থেকে প্রজাপতি, পাখির পালক জলচরের ভেতর থেকে রঙিন মাছ, কচ্ছপের খোলা ইত্যাদি, ভূচরের ভেতর থেকে পুরানো আসবাবপত্র, সেকেলে ঢাল তলোয়ার, চীনে বাসন, গরুর গলার ঘণ্টা, রঙ-বেরঙের নুড়ি, যত রাজ্যের খেলনা–
কাকা সমস্তই বাতিল করে দ্যান। সবাই পারে সংগ্রহ করতে এসব। কেউ না কেউ করেছেই।
তখন পকেটচরদের উল্লেখ হয়। নানা দেশের একালের সেকালের মোহর, টাকা, পয়সা, সিকি, দুয়ানি ইত্যাদি। ফাউন্টেন পেন, দেশলায়ের বাক্সকেও পকেটচরদের মধ্যে ধরা হয়েছিল।
কিন্তু কাকাকে রাজি করানো যায় না। কেউ না কেউ করছেই, এসব, এতদিন ধরে ফেলে রাখেনি নিশ্চয়।
কেউ কেউ মরীয়া হয়ে বলে–কেরোসিনের ক্যানেস্তারা?
নস্যির ডিবে?
জগঝম্প? কিম্বা গাঁজার কলকে?
অর্থাৎ চরাচরের কিছুই তখন বাকি থাকে না। কাকা তথাপি ঘাড় নাড়েন।
নানা রকমের খাবার-দাবার? চপ, কাটলেট, সন্দেশ, শনপাপড়ি, বিস্কুট, টফি, চকোলেট, লেবেনচুস? মানে, খাদ্য অখাদ্য যত রকমের আর যত রঙের হতে পারে-আমিই বাতলাই তখন। তবুও কাকার উৎসাহ হয় না।
অবশেষে চটেমটে একজনের মুখ থেকে বেফাঁস বেরিয়ে যায়–তবে আর কি করবেন? শ্বেতহস্তীই সংগ্রহ করুন।
কিন্তু পরিহাস বলে একে গ্রহণ করতে পারেন না কাকা। তিনি বারম্বার ঘাড় নাড়তে থাকেন–শ্বেতহস্তী! শ্বেতহস্তী! সেনার পাথর বাটির মতো ও কথাটাও আমার কানে এসেছে বটে। ব্রহ্মদেশে না শ্যামরাজ্যে কোথায় যেন ওর পূজোও হয়ে থাকে শুনেছি। হ্যাঁ, যদি সংগ্রহ করতে হয় তবে ওই জিনিস! বড়লোকের অস্তাবল দূরে থাক, বিলেতের চিড়িয়াখানাতেও এক আধটা আছে কিনা সন্দেহ। হ্যাঁ, ওই শ্বেতহস্তীই চাই আমার!
কাকা সর্বশেষ ঘোষণা করেন, তাঁকে শ্বেতহস্তীই দিতে হবে এনে, শ্যমরাজ্য কি রামরাজ্য থেকেই হোক, হাতিপোতা কি হস্তিনা থেকেই হোক, করাচী কিম্বা রাচি থেকেই হোক, উনি সেসব কিছু জানেন না কিন্তু শ্বেতহস্তী ওঁর চাই। চাই-ই। যেখানে থেকে হোক, যে করেই হোক যোগাড় করে দিতেই হবে, তা যত টাকা লাগে লাগুক। এক আধখানা হলে হবে না, অন্তত ডজন খানেক চাই তার, না হলে কালেকশন আবার কাকে বলে?
এই ঘোষণাপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তিনি ইঞ্জিনীয়ার কন্ট্রাকটার ডাকিয়ে আসন্ন শ্বেতহস্তীদের জন্য বড় করে আস্তাবল বানাবার হুকুম দিয়ে দিলেন।
আশ্চর্য! দু সপ্তাহের ভেতর জনৈক শ্বেতহস্তীও এসে হাজির। নগ্রহের একজন উপগ্রহ কোথা থেকে সংগ্রহ করেন আনে যেন।
কাকা তো উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন–বটে বটে? এই শ্বেতহস্তী! এই সেই, বাঃ! দিব্যি ফরসা রঙ তো! বাঃ বাঃ!
অনেকক্ষণ তার মুখ থেকে বাহবা ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। হাতিটাও সাদা গুঁড় নেড়ে তাঁর কথায় সমর্থন জানায়!
আমার দিকে তাকিয়ে বলেন–জানিস, বার্মায়–না না, শ্যামরাজ্যে এরকম একটা হাতি পেলে রাজারা মাথায় করে রাখে। রাজার চেয়ে বেশি খাতির এই হাতির; রীতিমতো পূজো হয়—হুহু! শাখ ঘন্ট বাজিয়ে রাজা নিজের পূজো করেন। যার নাম রাজপূজা। তা জানিস?
এমন সময় হাতিটা একটা ডাক ছাড়ে। যেন কাকার গবেষণায় তার সায় দিতে চায়।
হাতির ডাক? কিরকম সে ডাক? ঘোড়ার চিঁ-হি-হ্ কি গোরুর হাম্বার মতো নয়, ঘোড়ার ডাকের বিশ ডবল, গোরুর অন্তত পঞ্চাশ গুণ একটা হাতির আওয়াজ। বেড়ালের কি শেয়ালের ধ্বনি নয় যে একমুখে তা ব্যক্ত করা যাবে। সহজে প্রকাশ করা যায় না সে-ডাক।