কিন্তু পরমুহূর্তেই ওঁর উৎসাহ নিভে আসে। গত সন্ধ্যার দুর্ঘটনা স্মরণ করে উনি দমে যান। আমি কাকাকে অভয় দিই–সমস্ত রাত মশার কামড় খেয়ে শায়েস্তা হয়ে এসেছে ব্যাটা। দাঁড়াবার ওর খ্যামতা নেই বসে পড়েছে দেখছ না!
তাই বটে! কাকা ঈষৎ চাঙ্গা হল, তাহলে ঠুকঠুক করে বেশ নিয়ে যেতে পারবে। কি বলিস তুই!
নিশ্চয়। আর আমার তো সাইকেলই আছে–আমি জানাই।
কাছে গিয়ে ওকে উঠতে বলি–ব্যাটার কোনো গ্রাহ্যই নেই। কাকা কান মলে দেন। নিজের নয়, ঘোড়ার: তবুও সে নট নড়ন–চড়ন। গালে ওর আমি থাবড়া মারি, তথাপি নিৰ্দ্ধক্ষেপ! অগত্যা আমি আর কাকা দুজনে মিলে ল্যাজ ধরে ওকে টেনে তুলতে যাই। আমাদের প্রাণন্ত চেষ্টায় অবশেষে ও খাড়া হয়।
সারারাত চুপচাপ ছিল ঘোড়াটা! এত কাছেই ছিল অথচ! এর কারণ কিরে শিবু? কাকা জিজ্ঞাসা করেন, এতো লক্ষণ ভালো নয়।
জপ করছিলো বোধ হয়। আমি ব্যক্ত করি, সমাধি হয়ে গেছে দেখছ না।
তাই হবে। স্থানমাহাত্ম যাবে কোথায়? কাকা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে,-এ তো সিদ্ধিলাভের জায়গা, তবে, হ্যাঁ–যদি না তুলে দেয়–
সিদ্ধিলাভের কথায় কাকার কানের দিকে তাকাই। কানটা যথাস্থানেই নেই। কাকার সিদ্ধিলাভ আর হল না এ-যাত্রা! আমার দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে!
কাকা ঘোড়ার পিঠে চাপেন। ঘোড়ার চলবার উদ্যোগই নেই, সেই পুরনো বদঅভ্যাস। আমাদের ছিপটি মারার সাহস হয় না। কালকের অত ঘোরা-ঘুরির পর–আবার? অনেক করে ওকে বোঝাই। বাপু বাছা বলে ঘাড়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিই ওর।
ও কেবল জবাব দেয়, চিঁ হিঁ হিঁ।
এই ভাবে বহুক্ষণ আমাদের কথোপকথনের পর ও রাজী হয়। হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু এ আবার কি বদখেয়াল? পেছন দিকে হাঁটতে থাকে! হ্যাঁ, সটান পেছনেই।
গতিক দেখে তো প্রায় কেঁদে ফেলেন।–কান তো গেছেই, এবার কি ঘোড়ার পাল্লায় পড়ে প্রাণটাও বেঘোরে যাবে নাকিরে শিবু?
আমিও ভাবিত হইয়া কিন্তু ঘাবড়াতে দিই না কাকাকে। বলি–ভয় খেয়ো না কাকা। বুঝতে পেরেছি কি হয়েছে। আর কিছু না, ঘোড়াটা সিদ্ধিলাভ করেছে। একে স্থানমাহাত্ম, তার ওপরে কাল সারা রাত ঘোরতর তপস্যা–যাবে কোথায়? তার ফলেই ঘোড়ার এই কাণ্ড।
সিদ্ধিলাভ করেছে কি করে বুঝলি? কাকার কণ্ঠ করুণতর হয়।
এ আর বুঝছ না কাকা? যারা সিদ্ধিলাভ করে তারা কি আমাদের মতো হবে? তাহলে সিদ্ধপুরুষে আর আমাদের মতো কাঁচাপুরুষে তফাত কি? আমরা সামনে দিয়ে হাঁটি, সিদ্ধপুরুষ হাঁটবেন পেছনের দিকে। সিদ্ধিলাভ করলে পেছনে হাঁটতেই হবে। সিদ্ধপুরুষদের চালচলনই আলাদা। সিদ্ধঘোড়ারও।
আমার ব্যাখ্যা শুনে কাকার চোখ বড় হয়। তিনি তখন জাঁকিয়ে বসেন বাহনের পিঠে–যাক বাঁচা গেছে, সিদ্ধিলাভের ফাঁড়াটা ঘোড়া দিয়েই গেছে। আমার হলে কি রক্ষা ছিল? এই বাপু নিয়ে এতো বয়সে পেছন হাঁটাতে হলেই তো গেছলাম! অমন সিদ্ধি আমার পোষাত না বাপু!
আমি আন্দাজী রামপুরহাটের দিকে নির্ণয় করে নিয়ে সেই মুখো ঘোড়াটার পেছন ফেরাই। কাকা ঘুরে বসেন। বলেন দে, লেজটা তুলে দে আমার হাতে। ওর ল্যাজকেই লাগাম করব আজ। সিদ্ধপুরুষের আবার ল্যাজ কেন?
ল্যাজহস্তগত করে অনুরোধ করেন কাকা–এবার হাঁটা প্রভু! অনেকটা গানের সুরে মতো করে। ভজন গানের মতন।
আশ্চর্য, বলা মাত্রই ঘোড়াটা চলতে শুরু করে। বেশ ধীর চতুষ্পদক্ষেপে। রাগ হিংসা-ক্ষোভ-দুঃখ চালাকি-চতুরতা, কোন কিছুর বালাই নেই ওর ব্যবহারে। শুধু সিদ্ধ নয়, এ সমস্তই সুসিদ্ধ হওয়ার লক্ষণ।
ঘোড়া চলতে থাকে। পেছন ফিরিয়ে সামনের দিকে, কিংবা মুখ ফিরিয়ে পেছনের দিকে। যেটাই বলো।
আমিও সাইকেল চালিয়ে যাই। ওর পেছন-পেছন কিংবা মুখোমুখি।
হাতির সঙ্গে হাতাহাতি
সংগ্রহ করার বাতিক কোনো কালেই ছিল না কাকার! কেবল টাকা ছাড়া। কিন্তু, টাকা এমন জিনিস যে যথেষ্ট পরিমাণে সংগৃহীত হলে আপনিই অনেক গ্রহ এসে জোটে এবং তখন থেকেই সংগ্রহ শুরু।
একদিন ওদেরই একজন কাকাকে বললে, দেখুন, সব বড়লোকেরই একটা না একটা কিছু সংগ্রহ করার ঝোঁক থাকে। তা না হলে বড়লোক আর বড়লোকের তফাত কোথায়? টাকায় তো নেই। ওইখানেই তফাত ওখানেই বিশেষ বড়লোকের বৈশিষ্ট্য। আর ধরুন, বৈশিষ্ট্যই যদি না থাকল তবে আর বড়লোক কিসের? আমাদের সম্রাট পঞ্চম জর্জেরও কালেকশনের—হবি ছিল।
কাকা বিস্মিত হয়ে গ্রহের দিকে তাকান–পঞ্চম জর্জেরও?
নিশ্চয়! কেন, তিনি কি বড়লোক ছিলেন না? কেবল সম্রাটই নন, দারুণ বড়লোকও যে! অনেকগুলো জমিদারকেই একসঙ্গে কিনতে পারতেন।
ও! তাই বুঝি জমিদার সংগ্রহ করার বাতিক ছিল তার? কাকা আরও বিস্মিয়ান্বিত।
উঁহুহ। জমিদার নিয়ে তিনি করবেন কি? রাখবেন কোথায়? ও চীজ তো চিড়িয়াখানায় রাখা যায় না। তিনি কেবল স্ট্যামপো কলেক্ট করতেন–
ইস্ট্যাম্পো? ওই যা পোস্টাপিসে পাওয়া যায় না?, দলিলের?
দলিলের নয়। নানা দেশের নানা রাজ্যের ডাকটিকিট, একশো বছর আগের, তারো আগের–তারো পরের–এমনি নানা কালের নানান আকারের, রঙ-বেড়ঙের মত ডাকটিকিট।
বাঃ, বেশত! কাকা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন–আমারও তা করতে ক্ষতি কি?
কিছু না। তবে একটা পুরনো টিকিটের দাম আছে বেশ। দু পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ দশ বিশ হাজার দুলাখ চারলাখ পর্যন্ত!
অ্যাঁ, এমন?–কাকা কিন্তু ভড়কে যান; তা হোক, তবুও করতেই হবে আমার। টাকার ক্ষতি কি একটা ক্ষতি নাকি?