আমি লিখলাম–যেতে লিখেছ যাব না–হয়। কিন্তু কাপড় নিয়ে যেতে হবে কেন বুঝতে পারলাম না। আমার সুটকেসে তো দুখানার বেশি ধরবে না, এবং বাড়তি বোঝা বইতে আমি নারাজ! আর তা ছাড়া এই সেদিনই তো তুমি কলকাতা থেকে বার জোড়া কাপড় নিয়ে গেছ! এত কাপড় সেখানে কি করো? বৌদি নিশ্চয়ই ধুতি পরা ধরেননি। তোমার কাপড়েই আমার চলে যাবে–আমি তো একলা মানুষ বাপু!
দাদা সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন–আর কিছু না, বাঘের জন্যে।
আমার সবিস্মিত পালটা জবাব গেল–সে কি! বাঘে ছাগল গরুই চুরি করে শুনেছি, আজকাল কাপড়-চোপড়ও সরাচ্ছে নাকি? কাপড়-চোপড়ের ব্যবহার যখন শিখেছে, তখন তারা রীতিমত সভ্য হয়েছে বলতে হবে!
দাদা উত্তর দিলেন–চিঠিতে অত বকতে পারি না। আমার এখানে এসে তোমার কাপড়ের অভাব হবে না, এ কথা নিশ্চয়ই–কিন্তু যে কাপড় তোমাকে আনতে বলেছি, তার দরকার পথেই। চিড়িয়াখানার বাঘই দেখেছ, আসল বাঘ তো কোনদিন দেখনি, আসল বাঘের হুঙ্কারও শোননি। চিড়িয়াখানার ওগুলোকে বেড়াল বলতে পার। সুন্দরবন দিয়ে স্টিমারে আসতে দুপাশের জঙ্গলে বাঘের হুঙ্কার শোনা যায়, শোনামাত্রই কাপড় বদলানোর প্রয়োজন অনুভব করবে। প্রায় সকলেই সেটা করে থাকে। যত ঘন ঘন ডাকবে, (ডাকাটা অব্যশ্য তাদের খেয়ালের ওপর নির্ভর করে) তত ঘন ঘনই কাপড়ের প্রয়োজন। তবে তুমি যদি খাকি প্যান্ট পরে আস, তাহলে দরকার হবে না।
অতঃপর চব্বিশ জোড়া কাপড় কিনে নিয়ে আমি সুন্দরবন গমন করলাম।
আমার মাসতুতো দাদাও একজন বড় শিকারী। এ তথ্যটা আগে জানতাম না; এবার গিয়ে জানলাম। শুধু হাতেই অনেক দুদ্ধর্ষ বাঘকে তিনি পটকে ফেলেছেন। বন্দুক নিয়েও শিকারের অভ্যাস তার আছে, কিন্তু সে রকম সুযোগে তিনি বন্দুককে লাঠির মত ব্যবহার করতেই ভালবাসেন। তাঁর মতে কেঁদো বাঘকে কাঁদাতে হলে বন্দুকের কুঁদোই প্রশস্ত-গুলি করা কোন কাজের কথাই নয়। কিছু দিন আগে এক বাগের সঙ্গে তাঁর বড় হাতাহাতি হয়ে গেছল, তাঁর নিজের মুখেই আমার শোনা। বাঘটার অত্যাচার বেজায় বেড়ে গেছল, সমস্ত গ্রামটার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাত ব্যাটা, এমন কি তাদের স্বপ্নের মধ্যে এসে হানা দিত পর্যন্ত!
দাদার নিজের ভাষাতেই বলিঃ তারপর তো ভাই বেরোলাম বন্দুক নিয়ে। কি করি, সমস্ত গ্রামের অনুরোধ। ফেলা তো যায় না–একাই গেলাম। সঙ্গে লোকজন নিয়ে শিকারে যাওয়া আমি পছন্দ করি না। একবার অনেক লোক সঙ্গে নিয়ে গিয়ে যা বিপদে পড়েছিলাম, কি বলব! বাঘ করল তাড়া তারা এসে পড়ল আমার ঘাড়ে; মানুষের তাড়ায় প্রাণে মারা যাই আর কি! গেলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি সামনে বাঘ, বন্দুক ছুঁড়তে গিয়ে জানলাম টোটা আনা হয়নি। আর সে বন্দুকটা এমন ভারী যে, তাকে লাঠির মতও খেলানো যায় না। কী করি, বন্দুক ফেলে দিয়ে শুধু হাতেই বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। জোর ধস্তাধস্তি, কখনো বাঘ ওপরে আমি নীচে, কখনো আমি নীচে বাঘ ওপরে–বাঘটাকে প্রায় কাবু করে এনেছি এমন সময়ে–
আমি রুদ্ধ-নিশ্বাসে অপেক্ষা করছি, বৌদি বাধা দিয়ে বললেন–এমন সময়ে তোমার দাদা গেলেন তক্তাপোষ থেকে পড়ে। জলের ছাঁট দিয়ে, হাওয়া করে, অনেক কষ্টে ওঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনি। মাথাটা গেল কেটে, তিন দিন জলপটি দিতে হয়েছিল।
এর পর দাদা বারো দিন আর বৌদির সঙ্গে বাক্যলাপ করলেন না এবং মাছের মুড়ো সব আমার পাতেই পড়তে লাগল।
দাদা একদিন চুপিচুপি আমায় বললেন–তোমার বৌদির কীর্তি জানো না তো! খুকিকে নিয়ে পাশের জঙ্গলে জাম কুড়োত গিয়ে, পড়েছিলেন এক ভালুকের পাল্লায়। খুকিতে পালিয়ে এল, উনি ভয়ে জবুথুবু হয়ে, একটা উইয়ের টিপির উপর বসে পড়ে এমন চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন যে, ভালুকটা ওঁর ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল।
আমি বললাম–ওঁর ভাষা না বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেছল, এমনও তো হতে পারে?
দাদা বিরক্তি প্রকাশ করলেন—হ্যাঁ! ভারি ত ভাষা! প্রত্যেক চিঠিতে দুশো করে বানান ভুল!
বৌদির পক্ষ সমর্থন করতে আমাকে, অন্ততঃ মাছের মুড়োর কৃতজ্ঞতাসূত্রের, বলতে হলো–ভালুকরা শুনেছি সাইলেন্ট ওয়ার্কার, বক্তৃতা ওরা বড় পছন্দ করে না। কাজেই বৌদি ভালুক তাড়াবার ব্রহ্মস্ত্রই প্রয়োগ করেছিলেন, বুঝলে দাদা?
দাদা কোন জবাব দিলেন না, আপন মনে গজরাতে লাগলেন। বৌদির তরফে আমার ওকালতি শুনে তিনি মুষড়ে পড়লেন, কি ক্ষেপে গেলেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সেদিন বিকেলেই তাঁর মনোভাব টের পাওয়া গলে। দাদা আমাকে হুকুম করলেন পাশের জঙ্গল থেকে এক ঝুড়ি জাম কুড়িয়ে আনতে–সেই জঙ্গল, যেখানে বৌদির সঙ্গে ভালুকের প্রথম দর্শন হয়েছিল।
দাদার গরহজম হয়েছিল, তাই জাম খাওয়া দরকার, কিন্তু আমি দাদার ডিপ্লোম্যাসি বুঝতে পারলাম। আমাকে ভালুকের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আমাকে সুদ্ধ বিনা আয়াসে হজম করবার মতলব। বুঝলাম বৌদির পক্ষে যাওয়া আমার ভাল হয়নি। আমতা-আমতা করছি দেখে দাদা বললেন–আমার বন্দুকটা না হয় নিয়ে যা, কিন্তু দেখিস, ভুলে ফেলে আসিস না যেন।
ওঃ, কি কূটচক্রী আমার মাসতুতো বড়দা! ভালুকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করা বরং আমার পক্ষে সম্ভব হতে পারে, কিন্তু বন্দুক ছোঁড়া–? একলা থাকলে হয়ত দৌড়ে পালিয়ে আসতে পারব, কিন্তু ঐ ভারী বন্দুকের হ্যাঁন্ডিক্যাপ নিয়ে দৌড়তে হলে সেই রেসে ভালুকই যে প্রথম হবে, এ বিষয়ে আমার যেমন সন্দেহ ছিল না, দেখলাম দাদাও তেমনি স্থির–নিশ্চয়।