তাঁর একমাত্র কানকে কাকা একমাত্ৰা মলে দেন। কিন্তু উদ্ধারের কোন ভরসাই মেলে না। ততক্ষণে চাঁদ ডুবে অন্ধকার ঘোরালো হয়ে আসে। দুহাত দূরেও দৃষ্টি অচল হয়। আমি কাকার কাছ ঘেঁষে বসি, আমায় গা ছমছম করতে থাকে।
অবশেষে কাকা বলেন–তাই করা যাক অগত্যা। তোর কথাই শুনি। আজ রাত্রে এখান থেকে বেরুবার যখন উপায় নেই, তখন কি আর করা? কাল সকালে একেবারে সিদ্ধি পকেটে করে হারাধানের বাড়ি ফিরলেই হবে। এই নে আমার কোট, এই নে পিরাণকাকা একে একে আমার হাতে তুলে দিতে থাকেন। জিজ্ঞাসা করি–তুমি কি খালি গা হচ্ছ কাকা–
বাঃ, হব না? সাধু সন্ন্যাসী কি কাপড়জামা পরে চাদর দিয়ে তপস্যা করে নাকি? তাহলে কি হয় রে মুখ? এই নে চাদর এই নে আমার গেঞ্জি–এই নে আমার–
আমি সচকিত হয়ে উঠি। অতঃপর পরবর্তী বস্তুটি কী তা বুঝতে আমার বিলম্ব হয় না।–উঁহু, কাপড়টা থাক কাকা। কাপড় পরাতে তত ক্ষতি হবে না–
তুই তো জানিস। কাকা রাগান্বিত হন, হা কাপড়টা থাক। তাহলেই আমার সিদ্ধিলাভ হয়েছে! তবে এত কাণ্ড করে দরজি ডাকিয়ে গেরুয়া রঙের কৌপীনই বা তৈরি করলাম কেন, আর অমন কষ্ট করে সেটা এঁটে পরতেই বা গেলাম কেন তবে?,
কাপড়ও আমার হাতে চলে আসে। সেই ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে কৌপীনসম্বল কাকা কর্ণলাভের প্রত্যাশায় ঘোর তপস্যা লাগিয়ে দেন।
আমি আর কী করব? কাকার কাপড়টাকে মাটিতে পাতি, কোটকে করি বালিশ, গেঞ্জিটাকে পাশ বালিশ। তারপর আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে সটান হই। আমি দেখেছি, জেগে থাকলেই আমার যত ভয়, ঘুমিয়ে পড়লে আর আমার কোনো ভয় করে না!
অনেকক্ষণ অমনি কাটে। ঘুমেরও কোন সাড়া নেই, কাকারও না। সহসা একটা আওয়াজ–চটাস।
আমি চমকে উঠি! কাঁপা গলায় ডাকি–কাকা!
কাকার কোন সাড়া নেই। আরো বেশি করে আমি চাদর মুড়ি দিই।
আবার খানিক বাদে চটাস। এবার আওয়াজটা আরো যেন জোরালো।
আবার আমার আর্তনাদ–কাকা!
অন্ধকার ভেদ করে উত্তর আসে–উঁহুঁহুঁ!
কাকার চাপা হুঙ্কারে আমি নিরস্ত হই। আর উচ্চবাচ্য করি না। কাকার যোগভঙ্গ করে কি নিজের কানের বিঘ্ন ঘটাবে? অন্ধকারের মধ্যেই ওঁর হাত বাড়াতে কতক্ষণ?
অনেকক্ষণ কেটে যায়, আমার একটু তন্দ্রার মতো আসে। অকস্মাৎ ফের চটকা ভাঙে; উঠে বসি, শুনতে থাকিচটাচট চড় চটাচট-চট। অন্ধকার ফের চৌচির করে কেবল ঐ শব্দ, আর কিছু না এবং বেশ জোর জোর।
তবে কি–তবে কি…? ভয়ে আমার হাত পা গুটিয়ে আসে। তাহলে কি তাল-বেতালেই কাকাকে ধরে পিটাতে শুরু করে দিয়েছে নাকি? কিংবা ভূতপ্রেতরাই কাকাকে বেওয়ারিশ পেয়ে মজা করে হাতের সুখ করে নিচ্ছে? যাই হোক, কোনটাই ভাল কথা নয়।
আমি মরীয়া হয়ে ডাকতে শুরু করি–কাকা কাকা কাকা–!
বসতে দিচ্ছে নারে–
আওয়াজ পেয়ে আশ্বাস পাই। তবু যা হোক, আমার কাকান্ত ঘটেনি। ও-ও-ও কি-কি-কিসের শব্দ? আমার গলা কাঁপে।
আর বলিস না। করুণ কণ্ঠের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে দারুণ দীর্ঘনিঃশ্বাস। একদম, বসতে দিচ্ছে না।
কিসে বসতে দিচ্ছে না? ভূতে?
উহুঁ!
ডাকিনী–যোগিনী?
উ হুঁহু।
তবে কি তাল-বেতাল?
নাঃ। মশায়। মশার ভারি উৎপাত রে!
ওঃ, তাই বল। মশার কথা শুনে ভরসা পাই। তাহলে অন্য মারাত্মক কিছু নয়! তোমার চাদর মুড়ি দিয়েছিলাম বলে বুঝতে পারিনি এতক্ষণ! তাইতো! কী রকম মশার ডাক শুনছে কাকা,–পন পনপিন– কী ডাকবে বাবা! এরাই তোমার সেই ডাকিনী নয়তো?
কে জানে! কাকার বিরক্তির তীক্ষ্মতায় অন্ধকার বিদীর্ণ হয়, কিন্তু ডাকিনী না হলেও যোগিনী যে, তা আমি বিলক্ষণ টের পাই, আমার গায়ের সঙ্গে যোগ হওয়া মাত্রই।
আবার চটাপট শুরু হয়। মনের সুখে গালে মুখে হাতে পায়ে সর্বাঙ্গে চড়াতে থাকেন কাকা।
চপেটাঘাত ছাড়া মশকবধের আর কী উপায় আছে? অতঃপর কেবল এই চড়-চাপড়ই চলতে থাকে! এবং বেশ সশব্দেই। তপস্যা ও মাথায় উঠে যায়।
কিন্তু মশার সঙ্গে মারামারিতে পারবেন কেন কাকা? প্রাণী হিসেবে ওরা খেচর, কাকা নিতান্তই স্থলচর। ওদের হল আকাশ পথে লড়াই আর কাকার ভূমিষ্ট হয়ে। তাছাড়া কাকার একাধারে দুপক্ষকে আক্রমণ–মশাকে এবং কাকাকে। কাজেই, কিছুক্ষণ যুদ্ধ করেই কাবু হয়ে পড়েন কাকাবাবু। রণে ক্ষান্ত তাকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। এই ঘোরর সগ্রামে, মশাদের মধ্যে নিহতদের আমি দিতে পারব না–তবে আহতদের মধ্যে একজনের নাম আমি বলতে পারি–খোদ আমার খুড়োমশাই।
তার বৈরাগ্য এসে যায় তপস্যায়। এমন অবস্থায় কার বা না আসে? তিনি বলেন–দে আমার কাপড়জামা। গ্যায়ের চাদরটাও দে। সিদ্ধিলাভ মাথায় থাক। কানে আমার কাজ নেই আর, ঘুমিয়ে বাঁচি।
বিছানা, বালিশ, মশারি সবই ফিরিয়ে দিতে হয়। অবিলম্বেই লম্বা হন কাকা! মাটিতে শুয়ে পরনের কাপড়কেই লেপে পরিণত করি, কি আর করব? তারই তলায় গা ঢাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয় আমায়। লেপের প্রলেপে যতটুকু বাঁচোয়া!
অমন ভয়ঙ্কর রাতও প্রভাত হয়। আবার সূর্যের মুখ দেখি আমরা। ইতস্তত তাকাতেই চোখে পড়ে–সেই ঘোড়া! একটু দূরে উবু হয়ে বসে আছে। অদ্ভুত দৃশ্য! ঘোড়াকে এভাবে বসে থাকতে জীবনে কখনো দেখিনি। সারা রাত তপস্যা করছিল নাতো?
কাকা উৎসাহিত হয়ে ওঠেন–যাক বাঁচিয়েছো। এতখানি পথ আর হেঁটে ফিরতে হবে না। বর হোক, অশ্ববর তো পাওয়া গেল আপাতত!