আর বল কেন বন্ধু! হারাধন ডাক্তার দুঃখ প্রকাশ করেন, দূর দূর যতো গ্রাম থেকে ডাক আসে, সেখানে তো মোটর চলে না, গরুর গাড়ির রাস্তাও নেই অনেক জায়গায়, সে স্থলে ঘোড়াই একমাত্র বাহন; অদূরস্থিত সাইকেলের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে–ওকে চেপে আর পোয় না ভাই! তাই দেখে শুনে একটা ঘোড়াই কিনছি এবার।
বেশ করেছ, বেশ করেছ। কাকার সর্বন্তকরণ সমর্থন–আমাদের স্বদেশী ঘোড়া থাকতে বিদেশী সাইকেল কেন হে! ঠিকই বুঝেছো এতদিনে। তা, তোমার ঘোড়াটিকে তো বেশ শান্তশিষ্ট বলেই বোধ হচ্ছে। কাছে গিয়ে কাকা ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে সার্টিফিকেট দেন।
তোমার তো ছোটবেলায় ঘোড়ায় চড়ার বাতিক ছিল হে! ঘোড়া দেখলেই চেপে বসতে, ডাক্তার বলেন, কি রকম জানোয়ার কিনলাম, চড়ে একবার পরীক্ষা করে দেখবে না? আমার তো ঘোড়ায় চড়া প্র্যাকটিস করতেই কিছুদিন যাবে এখন!
তৎক্ষণাৎ অশ্ব-পরীক্ষায় সম্মত হন কাকা; হাতি-ঘোড়র ব্যাপারে বেশি বেগ পেতে হয় না রাজি করাতে কাকাকে। চতুম্পদের দিকে কাকার স্বভাবতই যেন টান। সে তুলনায় আমার দিকেই একটু কম বরং, পদগৌরব করার মত কিছু আমার ছিল না বলেই বোধ হয়।
ঘোড়ায় চাপবার বয়েস কি আছে আর? কাকা সন্দিগ্ধ সুরেই বলেন–দেখি তবু চেষ্টা করে। তারপর ডাক্তারবাবু, আমি এবং অশ্ববিক্রেতা-সর্বোপরি স্বয়ং অশ্বের ব্যক্তিগত সহযোগিতায় কষ্টেসৃষ্টে, কোনো রকম তো চেপে বসেন শেষটা।
কাকার দেহখানি তো নয়, ভারাক্রান্ত হয়ে ঘোড়াটা কেমন যেন ভড়কে যায় নড়বার নামটিও করে না। কাকা যতই হেট হেট করেন ততই সে লজ্জায় ঘাড় হেঁট করে থাকে।
অশ্ব বিক্রয়ের আশা ক্রমশই সুদূর রহিত হচ্ছে দেখে অশ্ববিক্রেতা বিচলিত হয়ে ওঠে; এবং তার হাতের ছিপটিও। কিন্তু যেই না ঘোড়ার পিঠে ছপাৎ করে একঘা বসিয়ে দেওয়া, অমনি ঘোড়াটা ঘুরপাক খেতে শুরু করে দেয়। এ আবার কি কাণ্ড! কাকা তো মরীয়া হয়ে ঘোড়ায় গলা জড়িয়ে ধরেন।
একদিকে ঘোড়ার ঘূর্ণবর্তের মধ্যে পড়ে ডাক্তারবাবুর শখের বাগানের দফা রফা, নানাপ্রকার গোলাপ গাছের চারা লাগিয়েছিলেন, ঘোড়া কেনবার কাছাকাছিই লাগিয়েছিলেন ঘোড়র পায়ে তাদের অপঘাতের আশঙ্কা তো করেননি কোনোদিন! অতঃপর অশ্ববর মুহুর্মুহ এগোতে আর পেছোতে থাকে, যে পথে এগোেয় সে পথে প্রায়ই পেছোয় না এবং বিদ্যুদ্বেগে অগ্রপশ্চাৎ গতির ধাক্কায় আর এক ধারের শাকসজির দফা সারে অশঙ্কুরে মুড়িয়ে যায় সব। এ-সমস্ত কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার! আশ্চর্য ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পরপর দুটি মহাদেশ এইভাবে বিধ্বস্ত করে অশ্বরত্ন নিদারুণ এক লাফ মারেন সেই এক লাফেই কাকা-পৃষ্ঠে, বাগানের বেড়া টপকে সামনের একটা নালা ডিঙিয়ে, তাকে অন্তর্হিত হতে দেখা যায়। আমিও দেরি করি না,তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের সাইকেলটায় চেপে পশ্চাদ্ধাবন করি। ঘোড়ার এবং কাকার। ধাবমান অশ্বকে সশরীরে খুব সামান্যই দেখা যায়, অল্পক্ষণ পরেই তিনি কেবল শ্রুতিগোচরহতে থাকে। দূর থেকে কেবল খটাখট কানে আসে; কিছুক্ষণ পরে পদধ্বনিও না–শুধুই চিহি চিহি। চিহিরই অনুসরণ করি।
অনেকক্ষণ অনেক ঘোরাঘুরির পর এক ধু-ধু প্রান্তরে এসে পড়ি। সন্ধ্যা কখন পেরিয়ে গেছে। আধখানা চাঁদের ম্রিয়মাণ আলোয় কোনরকমে সাইকেল চালিয়ে যাই কিন্তু সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় কোথাও চিহ্নমাত্র নেই–না ঘোড়ার না সওয়ারের।
ইতস্তত সাইকেল চালাতে থাকি, কী করব আর? ফাঁকা মাঠ আর পরের সাইকেল পেলে কে ছাড়ে? কাকাহারা হয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে কাকীর কাছে কী কৈফিয়ৎ দেব? মুখ দেখাব কি করে? সে ভাবনাও যে নেই তা নয়।
কে-রে? শিবু নাকিরে? শিবুই তো!
চমকে গিয়ে সাইকেল থামাই। দেখি কাকা এক উঁচু ঢিবির পাশে পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন।
আঃ, এসেছিস তুই? বাঁচলুম।
তোমার ঘোড়া কোথায় কাকা?
আমায় ফেলে পালিয়েছে। কোথায় পালিয়েছে জানি না। কাকার দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ে–আঃ হতভাগার পিঠ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বেঁচেছি! কিন্তু এ কোথায় এনে ফেলেছেরে? এও কি রামপুরহাট?
উঁহু, মনে তো হয় না। রামপুরহাট কত মাইল দূরে তা বলতে পারব না, তবে বেশ কয়েকঘন্টা দূরে।
তাহলে এ কোন জায়গা? তুই কি বলছিস তবে লক্ষ্মণপুরহাট?
লক্ষ্মণপুর হতে পারে, ভরতপুর হতে পারে, হনুমানপুর হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু হাটের চিহ্নমাত্র নেই কাকা। চারধারেই তো ধুধু মাঠ! সাইকেল করে চারদিকে ঘুরলাম, জনমানবের পাত্তাই নেই কোথাও।
তবে…তবে এই কি সেই মহাশ্মশান? কাকা নিজেই নিজের জবাব দেন, দুর্লক্ষণ দেখে তাই তো মনে হয়। দমকা হাওয়ায় মড়া-পোড়ানোর গন্ধও পেয়েছি খানিক আগে। আর, দু-একটা শেয়ালকেও যেতে দেখলাম যেন। তাহলে–তাহলে কি হবে? কাকার কণ্ঠে অসহায়তার সুর।
কাকার বিচলিত হওয়ার কারণ অমি বুঝি না।–কেন? এখানে আসবার জন্যেই তো আমাদের আসা? তাই নয় কি? তাহলে সিদ্ধিলাভের ব্যাপারটা শুরু করে দিলেই তো হয়।
আজই? আর রাত্রেই? আজ যে সিদ্ধিলাভের জন্য মোটেই আমি প্রস্তুত নইরে। আজ কি করে হয়?
যখন হয়ে পড়েছে তখন আর কি করা? আমি কাকার পাশে বসে পড়ি। –তেমন ঝোঁপ-ঝাড় নেই, বেশ ফাঁকাই আছে কাকা! ভূতপ্রেত এলে টের পাওয়া যাবে তক্ষুনি।
সমস্ত দিন ট্রেনে-খাওয়া-দাওয়া হয়নি। খিদেয় নাড়ী চিঁ চিঁ করছে, এই কি সিদ্ধিলাভের সময়? তোর কি কোন আক্কেল নেই রে শিবু? এ রকম বিপদ হবে জানলে কে আসতে চাইত–এই আমি নিজের কান মলছি, যদি আজ উদ্ধার পাই–?