সেখানে কেন কাকা? আমি একটু বিস্মিতিই হই। সিদ্ধির জন্য অত কষ্ট করে অতদূর যাবার কি দরকার? রামপুরহাট না গিয়ে, রামশরণ দুবেকে বললে এখনি তো এক লোটা বানিয়ে দেয়? কোনও হাঙ্গামা নেই? হা, সবটাতেই কাকার যেন বাড়াবাড়ি।
আমার সিদ্ধি মেডইজির ভূমিকা পড়ার মুখেই কাকা উসকে ওঠেন–উ হুঁ হু সে সিদ্ধি নয়। ও তো খেতে হয়, খেলে আবার মাথা ঘোরে। এ সিদ্ধি পেতে হয়। বামাক্ষেপা, বারদির ব্রহ্মচারী, আরও যেন কারা সব ঐ শ্মশানে বসে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন! জানিস না? আমি দুর্গা দুর্গা দুর্গা এইরকম জপ করে যাব, যেমনি না তিন লক্ষ বার পুরবে আমনি মা দুর্গা হাসতে হাসতে দশ হাত নেড়ে এসে হাজির হবেন। বাবা গণেশও শুঁড় নাড়তে নাড়তে আসতে পারেন। তারা এসে বলবেন–বৎস বর নাও–
তখন আমি যা বর চাইব, বুঝেছিস কিনা, সঙ্গে সঙ্গে ফলবে। তাকেই বলে সিদ্ধিলাভ। আমি যদি চাই, আমার আরো দুটো হাত গজাক,তক্ষুনি গজাতে পারে। হুঁ! তৎক্ষণাৎ!
শুনে আমার রোমাঞ্চ হয়। চতুর্ভুজ কাকার চেহারা কল্পনা করার আমি প্রয়াস পাই।
কিন্তু কাকাবাবু! চার হাত হলে তুমি পাশ ফিরে শোবে কি করে?
কিন্তু আমি তো হাত চাইব না। হাত আমার আছেই। দুটো হাতই আমার পক্ষে যথেষ্ট। এই নিয়েই পেরে উঠি না। পায়েরও আমার আর দরকার নেই। দুটো পা–আমার মোর দ্যান এনাফ। আমি কেবল চাইব আর একটা কান। কান না হলে আমাকে মানায় না, আয়নার দিকে তাকানোই যায় না। তাই বুঝেছিস কিনা অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম–রামপুরহাট! মন্ত্র বলে চারটে হাত কি চারটে পা যদি আমার গজাতে পারে তাহলে একটা মাত্র কান গজানো আর এমন কি?
কাকা তার কথায় পুনশ্চ যোগ করেন আবার–ইচ্ছে করলেই যদি আমি চতুস্পদ হতে পারি তাহলে এমন বিকর্ণ হয়ে থাকব কেন? কিসের তরে?
আমারও–দারুণ বিশ্বাস হয়ে যায়। মন্ত্রবলে কতো কি হয় শুনেছি, কান হওয়া আর কি কঠিন? কানেই যখন মন্ত্র দেয়, তখন মন্ত্রেও কান দিতে পারে। আশ্চর্য কিছু নয়। তিল লাখ বার কেবল দুর্গা কি কালী কি জগদ্ধাত্রী এর যে কোনো একটা নাম–উঁহু জগদ্ধাত্রী বাদ–চার অক্ষরের মন্ত্র তার মধ্যে আবার দস্তুরমত দ্বিতীয় ভাগ! জগদ্ধাত্রীর তিন লক্ষ মানে কালীর ছলক্ষের ধাক্কা। শক্তির আরাধনাতেই নাহক শক্তির বরবাদ নেহাত সময়ের অপচয়! পয়সা না লাগুক, কিন্তু দেবতার নামের বাজে খরচ করতেও আমি নারাজ।
কাকা, আমিও তাহলেও বর চেয়ে নেব যাতে না পড়ে শুনে ম্যাট্রিকটা পাশ করতে পারি। আমি একটু ভেবে নিই, কেবল পাশ করাই বা কেন, স্কলারশিপটা নিতেই বা ক্ষতি কি? যে বরে পাশ হয়, স্কলারশিপও তাতে হতে পারে, কি বল কাকা? মা দুর্গার পক্ষে কি খুব শক্ত হবে এমন?
আর ম্যাট্রিকই বা কেন? না পড়ে একে বারে এম্-এ? এম টা আমি আরো বড়ো করি।
বারে! আমি মরব জপ করে আর তুমি পাশ করবে না পড়ে? বাঃ-রে!–-কাকা খাপ্পা হয়ে ওঠেন।
তা হলে আমার গিয়ে আর কি হবে! আমি ক্ষুণ্ণ হই। তোমার সঙ্গে নাই গেলাম তবে, আমার তো আর কানের তেমন অভাব নেই।
পাগল! তা কি করে হয়? তোকে যেতেই হবে সঙ্গে। সিদ্ধিলাভ করা কি অতই সোজা নাকি, জপ করতে বসলেই তুলে দেয় যে,–
কে? পুলিসে?
উঁহু। পুলিশ সেখানে কোথা? শুনছিস মহাশ্মশান! বারো কোশের ভেতরে কোনো জনমানব নেই!
ও বুঝেছি! শেয়াল! বেশ তোমার বন্দুকটা নিয়ে যাব না হয়–কাছে এলেই দুম-দুড়ুম।
শেয়াল নয় রে পাগলা, শেয়াল নয়। ডাকিনী যোগিনী, ভুত পেরেত, ভালবেতাল–এরা সব এসে তুলে দেয়। সিদ্ধিলাভ করতে দেয় না।
ভুত-প্রেত শুনেই আমি হয়ে গেছি! তাল-বেতালের তাল আমাকেই সামলাতে হবে ভাবতেই আমার হৃৎকম্প শুরু হয়। কাকা-কাকা! কম্পিত কণ্ঠে থেকে আমার কেবল কা কা ধ্বনি বেরোয়, তার বেশি বেরোয় না।
আরে, ভয় কিসের তোর। আমি তো কাছেই থাকব। গতিক সুবিধের নয় দেখলে দুর্গা পালটে রাম-নাম করতে যাব না হয়। রাম-নামে ভুত পালায়। তবে রাম হচ্ছে খোট্টাদের দেবতা–তা হোক গে, রামও বর দিতে পারে। সীতা উদ্ধার করেছিলেন আর একটা কান উদ্ধার করতে পারবেন না? তবে কিনা দুর্গা-দুর্গাই হল গিয়ে মোক্ষম! রামকেও দুর্গার কাছে বর নিতে হয়েছিল।
তথাপি আমি ইতস্তত করতে থাকি।
আচ্ছা, এক কাজ করা যাক! তুই নাহয় রাম রাম জপিস-তাহলে তো আর ভয় নেই তোর? রামকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পাশের ফিকিরও করে নিতে পারিস! আমার কোন আপত্তি নেই। ভোলানো খুব শক্ত হবে না হয়ত রামটা ভ্যাবা গঙ্গারাম। তা না হলে বাঁদরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এত মানুষ থাকতে? এতখানি বলে কাকাকে দম নিতে হয়–তা ছাড়া তোর দাঁত ব্যথা, পেট-কামড়ানো, সর্দিকাশি, লঙ্কা খেলে হেঁচকি ওঠা স্কুলের টাসক না হলে ডায়েরিয়া হওয়া–যত রাজ্যির ব্যারাম তো তোর লেগেই আছে, এসবও তোর সেরে যাবে শ্রীরামন্দ্রের মহিমায়।
পাশের কথায় আমার উৎসাহ সঞ্চার হয়। নতুন প্রস্তাবে কাকার সঙ্গে রফা করে ফেলতে দেরি হয় না একটুও। সেই দিনই আমরা রওনা দিই। সন্ধ্যার মুখে রামপুরহাটে পৌঁছানো; কাকার বন্ধু এক ডাক্তারের বাড়িতে আমাদের আবির্ভাব।
ডাক্তার ভদ্রলোক সে সময়ে একটা ঘোড়ার দর করছিলেন। একজন গেঁয়ো লোক ঘোড়া বেচতে এসেছিল, দিব্যি খাসা ঘোড়াটি–আকারপ্রকারে তেজী বলেই সন্দেহ হয়; প্রাথমিক কুশলপ্রশ্ন আদানপ্রদানের পরেই কাকা জিজ্ঞাসা করেন, ঘোড়া কেন হে হারাধন?