মশাই। সূর্য্যি উঠতে দেরি কতো? হর্ষবর্ধন একজনকে শুধালেন।
সূর্য্যি উঠতে? ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে ওঁর কথায় জবাব দিলেন।
বেশি দেরি নেই আর। আমি বললাম–আকাশ বেশ পরিষ্কার। দিগ্বিদিক উদ্ভাসিত….উঠলো বলে মনে হয়।
কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। হর্ষবর্ধন বাধ্য হয়ে আরেকজনকে শুধান সূয্যি উঠচে না কোন মশাই?
এখন সূর্য উঠবে কি? সোকে অবাক হয়ে তাকান তার দিকে।
মানে, বলছিলাম কি সূর্য তো ওঠা উচিত ছিলো এতক্ষণ। পূবের আকাশ বেশ পরিষ্কার। সূর্যের আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে অথচ সূর্যের পাত্তা নেই।
সূর্য কি উঠবে না নাকি আজ? আমার অনুযোগ।
ঐ মেঘটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য, তাই দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি জানালেন মেঘটা নরে গেলেই
বলতে বলতে মেঘ সরে গেলো প্রকাশ পেলেন সূর্যদেব!
ও বাবা! অনেকখানি উঠে পড়েছেন দেখছি! বেলা হয়ে গেছে বেশ। আপসোস করলেন হর্ষবর্ধন সূর্যোদয়টা হাতছাড়া হয়ে গেলো দেখছি আজ।
ওমা! একি! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি নেমে যাচ্ছে যেন! নামছে কেন সূয্যিটা? নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে যে! এ-কি ব্যাপার?
এরকমটা তো কখনো হয় না! আমিও বিস্মিত হইয়া সূর্যের এমন বেচাল ব্যাপার তো দেখা যায় না কখনো।
হ্যাঁ মশাই, এরকমটা হয় নাকি এখানে মাঝে মাঝে? একটু না উঠেই নামতে থাকেন আবার পথ ভুল হয় সূর্যদেবের?
তার মানে?
তার মানে, আমরা সূর্যোদয় দেখতে এসেছি কিনা। উদীয়মান সূর্য দেখতে না পাই, উদিত সূর্য দেখেও তেমন বিশেষ দুঃখিত হইনি-কিন্তু একি! উঠতে না উঠতে নামতে লাগলো যে!
আপনার জন্যে কি পশ্চিম দিকে উঠবে নাকি সূর্য অস্ত যাবার সময় সূর্যোদয় দেখতে এসেছেন! আঁঝালো গলা শোনা যায় ভদ্রলোকের–
কোথাকার পাগল সব! আরেক জন উতোর গেয়ে ওঠেন তাঁর কথার।
হাতাহাতির পর
একবার হাতি পোষার বাতিক হয়েছিল আমার কাকার। সেই হাতির সঙ্গেই একদিন তাঁর হাতাহাতি বেধে গেল। সে কথাও শুনেছিস। হাতির গুঁড় এবং কাকার কান খুব বেশি দূর ছিল না– সুতরাং তার আসন্ন ফল কি দাঁড়াবে তা আমি এবং হাতি দুজনেই অনুমান করতে পেরেছিলাম। কাকাও পারেনি তা নয়, কিন্তু দুঘর্টনা আর বলে কাকে! সেই কর্ণবধ–পর্বের পর থেকে এই পালার শুরু!
কান গেলে মানুষের যত দুঃখ হয় অনেক সময় প্রাণ গেলেও ততটা হয় না বোধ হয়। কান হারিয়ে কাকা ভারি মুশড়ে পড়েছিলেন দিনকতক।
কর্ণের বিপদ পদে পদে, এই কথাটাই কাকাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। মহাভারত পড়েও যায়, তা ছাড়া, পাঠশালায় পড়বার সময় ছেলেরাও হাড়ে হাড়ে টের পায়। হাড়ে হাড়ে না বলে কানে কানে বললেই সঠিক হবে, কেন না কানের মধ্যে বোধহয় হাড় নেই, থাকলে ওটা আদৌ অত সুখকর মূলতব্য ব্যাপার হত না।
কাকাকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করি। কিন্তু কাকা বোঝেন কিনা তিনিই জানেন। তত্ত্বকথা বোঝ সহজ কথা নয়। আর তাছাড়া তাঁকে বোঝাই মনে মনে, মুখ ফুটে কিছু বলবার আমার সাহস হয় না। কাকা যা বদরাগী, ক্ষেপে যেতে কতক্ষণ!
কাকাকে দেখলে আজকাল আমার ভয় হয়। কর্ণফ্লুত কাকা পদচ্যুত চেয়ারের চেয়েও ভয়াবহ। তার উপরে নির্ভর করা যায় না–করেছ কি কুপোকাৎ! আর আজকাল যে রকম কটমট করে তিনি তাকান আমার দিকে। মুখের পানে বড় একটা না, আমার কানের দিকে কেবল। ঐ দিকেই তার যত চোখ, যত ঝোঁক আর যত রোখ। আমি বেশ বুঝতে পারি আমার কর্ণসম্পদে তিনি বেশ ঈর্ষান্বিত। হাতির হাত থেকে বাঁচিয়েছি, এখন কাকার কবল থেকে কি করে কান সামলাই তাই হয়েছে আমার সমস্যা। কাকা একবার ক্ষেপে গেলে আমাকে তার নিজের দশায় আনতে কতক্ষণ?
তাই আমিও যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করি। নিতান্তই কাকার কাছাকাছি থাকতে হলে মর্মাহত হয়ে থাকি। এবং মনে মনেই তাকে সান্ত্বনা দিই।
অবশেষে একদিন সকালে কাকা অকস্মাৎ চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। শিবু-শিবু–ডাক পড়ে আমার।
কাকার কাছে দৌড়োই কান হাতে করে। এত যখন হাঁকডাক, কি সর্বনাশ হবে কে জানে? প্রাণে মরতে ভয় খাই না, মারা গেলে আবার জন্মাবো, কিন্তু কানে মারা যাবার আমার বড় ভয়।
কোথায় ছিলিস এতক্ষণ? হয়েছে, সব ঠিক হয়েছে। আর কোন ভাবনা নেই! উৎসাহের
আতিশয্যে উথলে ওঠেন কাকা। আমি চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকি!
বুঝেছিস কিছু? কাকার প্রশ্ন হয়।
উঁহু–আমি দুকান নাড়ি। ঘাড় নাড়লেই কানরা নড়ে যায়, কেন যে তা জানি না, তবে বরাবর দেখে আসছি আমি।
রামপুরহাট যাব। টিকিট কিনে আনগে। একটা ফুল, একটা হাফ। তুই যাবি আমার সঙ্গে।
রামপুরহাট? হঠাৎ আমি বলে ফেলি।
হঠাৎ আবার কি? সেইখানেই তো যেতে হবে। আমার সবিস্ময়ে প্রশ্নে কাকা যেন হতভম্ব হয়ে যান।–বামাক্ষেপার জীবনী পড়িসনি? আর পড়বিই বা কি করে? বুড়ো হাতি হতে চললি কিন্তু ধর্মশিক্ষা হলো না তোর। যত বলি সাধু মহাত্মা যোগী-ঋষিদের জীবনী টিবনী পড়-–তা না, কেবল ডাণ্ডাগুলি, লুটু আর লাটাই। যদি তা পড়তিস তাহলে আর একথা জিজ্ঞেস করতিস না।
আমি আর জিজ্ঞাসা করি না। মৌনতা দ্বারা কেবল সম্মতি নয়, পাণ্ডিত্যের লক্ষণও প্রকাশ পায়, এই শিক্ষাটা আমার হয়ে যায়। না বলে কয়ে যদি সময়দার হওয়া যায় তাহলে আর কথা বলে কোন মুখ? কাকা স্বতঃপ্রবৃত্ত আমাকে সবিশেষ জ্ঞান দিতে উদ্যত হন। রামপুরহাটের কাছেই এক ঘোর মহাশ্মশান আছে, জানিস? এই দশ-বিশ মাইলের মধ্যেই। সেই শ্মশানে বসে কেউ যদি একটা না তিন লক্ষ বার কোনো দেবতার নাম জপ করতে পারে তাহলেই সিদ্ধি! নির্ঘাৎ! স্বয়ং বশিষ্টমুনি এই বর দিয়ে গেছেন। আমার ঠাকুর্দার কাছে শোনা। সেইখানেই আমি যাব।