আবার খানিকবাদে আবার আরেক! পঞ্চম গলা চড়িয়ে ফিরছে ঐ–পথেই।
তার স্বরাঘাতের হাত থেকেই রেহাই পেতে, অর্ধচন্দ্র দেওয়ার মতো একটা আধুলি দিয়ে তাকে বিদায় করা হলো।
তারপর আরো আরো মেষপালকের গাইয়ে বালকের দল আসতে লাগল পরম্পরায়…ঐ পথে, আর আমিও তাদের বিদায় দিতে লেগেছি। তিনটাকে আধুলি, চারটেকে পঁচিশ পয়সা করে, বাকীগুলোকে পুঁজি হালকা হওয়ার হেতু বাধ্য হয়েই দশ পয়সা, পচ পয়সা করে দিয়ে তাদের গন্তব্য পথে পাচার করে দিতে হলো।
সেই একটা ছেলেই ঘুরে ঘুরে আসছে নাতো দাদা, গোবরা সন্দেহ করে শেষটার পয়সা নেবার ফিকিরে?
সেই একটা ছেলেই নাকি মশাই? দাদা শুধান আমায়।
কি করে বলব? একটা ভুটিয়ার থেকে আরেকটা ভুটিয়াকে আলাদা করে চেনা যার পক্ষে শক্ত। এক ভেড়ার পালকে আরেক পালের থেকে পৃথক করা কঠিন। আমার কাছে, সব ভেড়াই একরকম। এক চেহারা।
বলেন কি? হর্ষবর্ধন তাজ্জব হন।
হ্যাঁ সব এক ভ্যারাইটি। যেমন এক চেহারা তেমনি এক রকমের স্বরলরী–কি ভেড়ার আর কি ভুটিয়ার!
আসুন তো, পাশের টিলাটার ওপরে উঠে দেখা যাক ছেলেটা যায় কোথায়! ছেলেটা
যেতেই আমরা টিলাটার ওপরে উঠলাম,
ঠিক তাই; ছেলেটা এই টিলাটার বেড় মেরেই ফের আসছে বটে ঘুরে.. গলা ছেড়ে দিয়ে সুরের সপ্তমে।
কিন্তু এবার আর সে আমাদের দেখা পেল না।
পেয়ে, টিলাটাকে আর চক্কর না মেরে তার নিজের পথ ধরল সে। আর চক্ৰত্তের থেকে মুক্তি পেলাম আমরাও।
কিন্তু ছেলেটা আমাকে কপর্দকশূন্য করে দিয়ে গেলো। আরেকটু হলে তার গানের দাপটে আমার কানের সবকটা পর্দাই সে ফাটিয়ে দিয়ে যেত। তাহলেও কানের পাতলা পর্দার বেশ কয়েকটাই সে ঘায়েল করে গেছে, শেষ পর্দাটাই বেঁচে, গেছে কোন রকমে। আমার মত আমার কানকেও কপর্দকশূন্য করে গেছে।
তাহলেও কোনো গতিকে কানে কানে বেঁচে গেলাম এ-যাত্রায়।
প্রাকৃতিক মাধুরীর প্রচুর ভুরিভোজের পর বহুৎ হন্টন করে হোটেলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেলো।
তখন ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলুঢুলু, পা টলছে। কোনো রকমে কিছু নাকে মুখে গুঁজেই আমাদের ঘরের ঢালাও বিছানায় গিয়ে আমরা গড়িয়ে পড়লাম।
গোবরাভায়া, দরজা জানলা খড়খড়ি ভালো করে এঁটে দাও সব। নইলে কোনো ফাঁক পেলে কখন এসে বৃষ্টি নামবে, তার কোনো ঠিক নেই। বললাম আমি গোর্বধনকে।
এটা তো বর্ষাকাল নয় মশাই।
দার্জিলিঙের মেজাজ তুমি জানো না ভাই। এখানে আর কোনো ঋতু নেই, গ্রীষ্ম নেই, বসন্ত নেই, শরৎ নেই, খালি দুটো ঋতুই আছে কেবল। শীতটা লাগাতার আর বর্ষণ যখন তখন।
তার মানে?
চার ধারেই হালকা মেঘ ঘুরছে নজরে না ঠাওর হলেও। মেঘলোকের উচ্চতাতেই দার্জিলিং তো। জানলা খড়খড়ির ফাঁক পেলেই ঘরের ভেতরে সেই মেঘ এসে বৃষ্টি নামিয়ে সব ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবে।
বলেন কি?
তাই বলছি। আমি বললাম কিন্তু আর বলতে পারছি না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম…
ঘুমোচ্ছন তো! কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে ঘুমোবেন। হাঁকলেন হর্ষবর্ধন।
তেমন করে কি ঘুমানো যায় নাকি? আমি না বলে পারি না চোখ তো বুজতে হবে অন্তত।
কিন্তু কান খাড়া রাখুন। কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে ঘুমোন। একটু সোরগোল কানে এলেই বুঝবেন ভোর হয়েছে। জাগিয়ে দেবেন আমাদের।
দেখা যাবে। বলে আমি পাশ ফিরে শুই। কান দিয়ে কদুর কতটা দেখতে পারবো তেমন কোনো ভরসা না করেই।
এক ঘুমের পর কেমন একটা আওয়াজ আমার কান খাড়া হয়। আমি উঠে বসি বিছানায়। পাশে ঠেলা দিই গোবরাকে–গোবরা ভায়া, একটা আওয়াজ পাচ্ছো না?
কিসের আওয়াজ?
পাখখায়াজ বাজছে যেন। কেউ যেন ভৈরো রাগিণী সাধছে মনে হচ্ছে। ভৈরো হললাগে ভোরবেলার রাগিণী। ভোরবেলায় গায়।
পাথোয়াজ বাজছে? গোবরাও কান তুলে শোনবার চেষ্টা করে।
হর্ষবর্ধনও সাড়া দেন ঘুম থেকে উঠে কি হয়েছে? ভোর হয়েছে নাকি?
খানিক আগে কি রকম যেন একটা সোরগোল শুনছিলাম–আমি বললাম।
ভোর হয়েছে বুছি?
ভাবছিলুম তাই। কিন্তু আর সেই হাঁকডাকটা শোনা যাচ্ছে না।
শুনবেন কি করে? বলল গোবরা–দাদা জেগে উঠলেন যে! দাদাই তো নাক ডাকাচ্ছিলেন এতক্ষণ।
কখনো না। বললেই হলো! কখনো আমার নাক ডাকে না, ডাকলে আমি শুনতে পেতুম না নাকি? ঘুম ভেঙে যেতো না আমার?
তুমি যে বদ্ধকালা। শুনবে কি করে? নইলে কানের অত কাছাকাছি নাক! আর ওই ডাকাত পড়া হাঁক তোমার কানে যেতে না?
তুমি একটা বদ্ধ পাগল! তোর সঙ্গে কথা কয়ে আমি বাজে সময় নষ্ট করতে চাই নে।বলে দাদা পাশ ফিরলেন আবার তাঁর হাঁকডাক শুরু হলো।
এরপর, অনেকক্ষণ পরেই বোধহয়, হর্ষবর্ধনই জাগালেন আমাদের কোনো সোরগোল শুনছেন?
কই না তো। আমি বলি–বিলকুল চুপচাপ।
এতক্ষণেও ভোর হয়নি? বলেন কি! জানলা খুলে দেখা যাক তো…তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে জানলাটা খুললেন–ওমা! এই যে বেশ ফর্সা হয়ে এসেছে, উঠুন! উঠুন! উঠে পড়ন। চটপট।
আমরা ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।
জামা কাপড় পরে না! সাজগোজ করার সময় নেই তাছাড়া দেখতেই যাচ্ছেন, কাউকে দেখাতে যাচ্ছেন না। নিন, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। দেরি করলে সূর্যোদয়টা ফসকে যাবে।
তিনজনেই শশব্যস্ত হয়ে আপাদমস্তক কম্বল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টাইগার হিলের উঁচু টিলার কাছেই। হন্তদন্ত হয়ে তিনজনায় গিয়ে খাড়া হলাম তার ওপর। বিস্তর লোক গিজগিজ করছে সেখানে। নিঃসন্দেহে, সূর্যোদয় দেখতে এসেছে সবাই।