তাছাড়া তালগাছও তো নেইকো কলকাতায়, থাকলে না-হয় তার মাথায় উঠে দেখা যেতো.. গোবরা এই তালে একটা কথা বললো বটে তালেবরের মতন!
তাল গাছ না থাক, তেতলা বাড়ি আছে তো? তার ছাদে উঠে কি দেখা যেতো না? বলতে চান ম্যানেজার।
থাকবে না কেন তেতলা বাড়ি। তেতাল, চৌতাল, ঝাঁপতাল সবরকমের বাড়িই আছে। বলে হর্ষবর্ধন তার উল্লিখিত শেষের বাড়ির বিশদ বর্ণনা দেন, ঝাঁপতাল বাড়ি নামে যে-সব সাত-দশ তল বাড়ির থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরবার তালে ওঠে মানুষ, তেমন বাড়িও আছে বইকি! কিন্তু থাকলে কি হবে, তাদের ছাদে উঠেও বোধ হয় দেখা যাবে না সূর্যোদয়! দূরের উঁচু উঁচু বাড়ির আড়ালেই ঢাকা থাকবে পূর্ব্ব আকাশ।
এক হয়, যদি মনুমেন্টের মাথায় উঠে দেখা যায়…আমি জানাই।
তা সেই মনুমেন্টের মাথায় উঠতে হলে পুরো দিন লাগবে মশাই আমার এই দেহ নিয়ে…দেহটা দেখেছেন?
হর্ষবর্ধনের সকাতর আবেদনে হোটেলের মালিক তার দেহটি অবলোকন করেন। তারপরে সায় দেন–তা বটে।
তবে দেখুন এ জন্মে আমার সূর্যোদয়ই দেখা হচ্ছে না তাহলে এই মানবদেহ ধারণ বৃথাই হলো…।
তাই আমাদের একান্ত অনুরোধ….
এখানে নাকি অবাধে সূর্যোদয় দেখা যায়, আর তা নাকি একটা দেখাবার জিনিস সত্যিই…
সেই কারণেই আপনাকে বলছিলাম…
আমাদের যুগপৎ প্রতিবেদন-দয়া করে আমাদের ভোর হবার আগেই ঘুম থেকে তুলে দেবেন। এমনকি, দরকার হলে জোর করেও।
কোনো দরকার হবে না। তিনি জানান, রোজ ভোর হবার আগে এমন সোরগোল বাধে এখানে যে তার চোটে আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে যাবে আপনাদের।
সোরগোলটা বাধে কেন?
কেন আবার? ঐ সূর্যোদয় দেখবার জন্যেই। যে কারণে যেই আসুক না, হাওয়া খেতে কি বেড়াতে কি কোনো ব্যবসার খাতিরে, ঐ সূর্যোদয়টি সবারই দেখা চাই। হাজার বার দেখেও আশ মেটে না কারো। একটা বাতিকের মতই বলতে পারেন।
আমরাও. এখানে চেঞ্জে আসিনি, বেড়াতে কি হাওয়া খেতেও নয়– এসেছি ঠিক কি কারণেই…।
তাই রোজ রোজ হবার আগেই হোটেলের বোর্ডাররা সব গোল পাকায়, এমন হাঁকডাক ছাড়ে যে, আমরা, মাসে এই হোটেলের কর্মচারীরা, যারা অনেক রাতে কাজকর্ম সেরে ঘুমতে যায় আর অত ভোরে উঠতে চায় না, সূর্য ভাঙিয়ে আমাদের ব্যবসা হলেও সূর্য দেখার একটুও গরজ নেই, যাদের, একদম সেজন্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদেরও বাধ্য হয়ে উঠতে হয় ঐ হাঁকডাকের দাপটে। কাজেই আপনাদের কোনো ভাবনা নেই কিছু করতে হবে না আমাদের। কোন বোর্ডারকে আমরা ডিস্টার্ব করতে চাইনে কারও বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো আমাদের নিয়ম নয়…তার দরকার হবে না, সাত সকালেই সেই গোলমালে আপনাদের ঘুম যতই নিটোল হোক না কেন, না ভাঙলেই আনু অবাক হবো।
অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে হোটেলের ঘরে আমাদের মালপত্র রেখে বিকেলের জলযোগ পর্ব চা-টা সেরে বেড়াতে বেরুলাম আমরা।
তখন অবশ্য সূর্যোদয় দেখার সময় ছিল না, কিন্তু তা ছাড়াও দেখবার মতো আরো নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মজুদ ছিল তো। সেই সব অপূর্ব্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতেই আমরা বেরুলাম।
সন্ধে হয় হয়। এ-ধারের পাহাড়ের পথঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকাই এখন। একটা ভুটিয়ার ছেলে একপাল ভেড়া চরিয়ে বাড়ি ফিরছে গান গাইতে গাইতে।
শুনে হর্ষবর্ধন আহা-উঁহু করতে লাগলেন।
আহা আহা! কী মিষ্টি! কী মধুর…
কেমন মূছনা! যোগ দিল গোবরা। শুনে প্রায় মূছনা হয় আর কী!
একেই বলে ভাটিয়ালি গান, বুঝেছিস গোবরা? কান ভরে শুনে নে, প্রাণ ভরে শোন।
ভাটিয়ালি গান বোধ হয় এ নয়, মৃদু প্রতিবাদ আমার–সে গান গায় পূর্ব্ব-বাংলার মাঝিরা, নদীর বুকে নৌকার ওপর বৈঠা নিয়ে বসে। ভাটির টানে গাওয়া হয় বলেই বলা হয় ভাটিয়ালি।
তাহলে এটা কাওয়ালি হবে। সমঝদারের মতন কন হর্ষবর্ধন।
তাই-বা কি করে হয়? গোরু-চরাতে চরাতে গাইলে তাই হতো বটে, কিন্তু cow তো নয়, ও তো চারাচ্ছে ভেড়া।
কাওয়ালিও নয়? হর্ষবর্ধন যেন ক্ষুণ্ণ হন।
রাখালী গান বলতে পারো দাদা। ভাই বাতলায়, ভেড়া চরালেও রাখালই তো বলা যায় ছোঁড়াটাকে।
লোকসঙ্গীতের বাচ্চা বলতে পারেন। আমিও সঙ্গীতের গবেষণায় কারো চাইতে কম যাই না, এই বেড়ালই যেমন বনে গেড়ে বনবেড়াল হয়। তেমনি এই বানকই বড়ো হয়ে একদিন কে বিষ্ণু লোক হবে। অন্তত যখন ওর গোঁফ বেরুবে গানকে অক্লেশে লোকসঙ্গীত বলা যাবে। এখন নেহাৎ বালকসঙ্গীত।
ভেড়ার পাল নিয়ে ছেলেটা কাছিয়ে এলে হর্ষবর্ধন নিজের পকেট হাতড়াতে লাগলেন–ওকে কিছু বকশিস দেওয়া যাক। ওমা! আমার মানিব্যাগটা তো হোটেলের ঘরে ফেলে এসেছি দেখছি। আপনার কাছে কিছু আছে? নাকি, আপনিও ফেলে এসেছেন হোটেলে?
পাগল! আমি প্রাণ হাত ছাড়া করতে পারি, কিন্তু পয়সা নয়। আমার যৎসামান্য যা কিছু আমার সঙ্গে থাকে আমার পকেটে আমার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে কিনা।
বলতে গিয়েও বাধে আমার। চক্রবর্তীরা যে কঞ্জুস হয়, সে-কথা মুখ ফুটে বলি কি করে? নিজ গুণ কি গণনা করবার?
তাহলে ওকে কিছু দিন মশাই! একটা টাকা অন্তত।
দিলাম।
টাকাই পেয়ে তো ছেলেটা দস্তুরমত হতবাক। পয়সার জন্য নয়, প্রাণের তাগাদার অকারণ পুলকেই গাইছিল সে। তাহলেও খুশি হয়ে, আমাদের সেলাম বাজিয়ে নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে সে চলে গেলো।
খানিকবাদে সেই পথে আবার এক রাখাল বালকের আবির্ভাব! সেই ভেড়ার পাল নিয়ে সেইরকম সুর ভাজতে ভাজতে….তাকেও এক টাকা দিতে হয়।