তারপর তার আর কোন উৎসাহ দেখা গেল না।
ছুঁচো গেলার চেয়েও খারাপ দশা হয়েছে সাপটার বুঝলে দাদা? সাপের পেটে ব্যাঙ, আর ব্যাঙের পেটে যতো পাথর কুঁচি। আগে ব্যাঙ পাথরকুঁচিগুলো হজম করবে, তারপর সে হজম করবে গিয়ে ব্যাঙটাকে। সে বোধহয় আর ওদের এজন্মে নয়।
ওদের কে কাকে হজম করে দেখা যাক। আমি তখন বলি, ততক্ষণে আমাদেরও কিছু হজম হয়ে যাক। আমরাও খেতে বসি এধারে।
চৌকিদারের আনা মাখন-রুটি ইত্যাদি খবর-কাগজ পেতে খেতে বসে গেলাম আমরা। সাপটার অদূরেই বসা গেল। সাপটা মার্বেলের গুলির মতনে তালগোল পাকিয়ে পড়ে রইল। আমাদের পাশেই।
এমন সময়ে জঙ্গলের ওধারে একটা খসখসানি আওয়াজ পাওয়া গেল। বাঘ এসে গেছে বাবু। চৌকিদার বলে উঠল, শুনেই না আমরা তাকিয়ে দেখি সত্যিই ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বাঘটা আমাদের দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে।
রুটি মাখন-টাখন শেষ পর্যন্ত বাঘের পেটেই গেল দেখছি। দেখে আমি দুঃখ করলাম।
কি করে যাবে? আমরা চেটেপুটে খেয়ে ফেলেছি না সব, ওর জন্যে রেখেছি নাকি? বলল গোবরা-পাউরুটির শেষ চিলতেটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে।
যেমন করে পাথর কুচিগুলো সাপের পেটে গেছে ঠিক সেই ভাবে। আমি বিশদ করি।
এক গুলিতে সাবাড় করে দিচ্ছি না ব্যাটাকে। দাঁড়ান না। বলে হর্ষবর্ধন হাতে কী একটা তুললেন–ওমা। এটা যে সাপটা। বলেই কিন্তু আঁতকে উঠলেন বন্দুকটা গেল কোথায়?
বন্দুক আমার হাতে বাবু। বলল চৌকিদার ও আপনি তো আমার হাত থেকে নেননি বন্দুক। তখন থেকেই আমার হাতে আছে।
তুমি বন্দুক ছুঁড়তে জান?
না বাবু, তবে তার দরকার হবে না। বাঘটা এগিয়ে এলে এই বন্দুকের কুঁদার ঘায় ওর জান খতম করে দেব। আপনারা ঘাবড়াবেন না।
হর্ষবর্ধন ততক্ষণে হাতের সাপটাকেই তিনি পাক ছুঁড়ে দিয়েছেন বাঘটার দিকে। সাপটা সবেগে পড়েছে গিয়ে তার উপর।
কিন্তু তার আগেই না, কয়েক চক্করের পাক খেয়ে, সাপের পেটের থেকে ছিটকে ব্যাঙটা আর ব্যাঙের গর্ভ থেকে যাতে পাথর কুচি তীর বেগে বেরিয়ে ছররার মতই বেরিয়ে লেগেছে গিয়ে বাঘটার তার চোখে মুখে নাকে।
হঠাৎ এই বেমক্কা মার খেয়ে বাঘটা ভিরমি খেয়েই যেন অজ্ঞান হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ আর। তার নড়া চড়া নেই।
সর্পাঘাতে মারা গেল নাকি বাঘটা? আমার পায়ে হতজ্ঞান। বাঘটার দিকে এগুলাম।
চৌকিদার আর দেরি না করে বন্দুকের কুঁদায় বাঘটার মাথা থেঁতলে দিল। দিয়ে বললোআপনার সাপের মারেই মারা পড়েছে বাঘটা। তাহলেও সাবধানের মার নেই বাবু, তাই বন্দুকটাও মারলাম তার ওপর।
এবার কি করা যাবে? আমি শুধাই ও কোনো ফোটে তোলার লোক পাওয়া গেলে বাঘটার পিঠে বন্দুক রেখে দাঁড়িয়ে বেশ পোজ করে ফোটো তোলা যেত একখানা।
এখানে ফোটো ওলা কোথায় বাবু এই জঙ্গলে? বাঘটা নিয়ে গিয়ে আমি ভেট দেব দারোগাবাবুকে। তাহলে আমার ইনামও মিলবে–আবার চৌকিদার থেকে একচোটে দফাদার হয়ে যাব আমি এই বাঘ মারার দরুন। বুঝলেন?
দাদা করল বাঘের দফারফা আর তুমি হলে গিয়ে দফাদার। গোবরা বলল– বারে।
সাপ ব্যাঙ দিয়েই বাঘ শিকার করলেন আপনি দেখছি। আমি বাহবা দিলাম ওর দাদাকে।
হর্ষবর্ধনের সূর্য-দর্শন
সূর্যদর্শন না বলে সূর্যগ্ৰাস বললেই ঠিক হয় বোধ হয়।
রাহুর পরে এক মহাবীরই যা সূর্যদেবকে বগলদাবাই করেছিলে, কিন্তু যতো বড় বীরবাহুই হন না, হর্ষবর্ধনকে হনুমানের পর্যায়ে কখনো ভাবাই যায় না।
তাই তিনি যখন এসে পড়লেন, সূয্যি মামাকে দেখে নেবো এইবার, তখন বলতে কি, আমি হা হয়ে গেছলাম।
আমার হা কারের কোনো জবাব না দিয়েই তিনি হেঁয়ালি পাড়লেন, সুন্দরবনের বাঘ শিকার তো হয়েছে, চলুন এবার পাহাড়ে বাঘটাকে দেখে আসা যাক।
যদ্দুর আমার জানা, না বলে আমি পারলাম না, বাঘরা পাহাড়ে বড়ো একটা থাকে না। বনে জঙ্গলেই তাদের দেখা মেলে। হাতিরাই থাকে পাহাড়ে। পাহাড়দের হাতিমার্কা চেহারা দেখেছেন তো?
কে বলছে আপনাকে? তিনি প্রতিবাদ করলেন আমার কথার, টাইগার হিল তাহলে বলেছে কেন? নাম শোনেনি টাইগার হিলের?
শুনবো না কেন? তবে সে হিলে, যদ্দুর জানি, কোনো টাইগার থাকে না। বাবুরা বেড়াতে যান।
সূর্যিঠাকুর সেই পাহাড়ে ওঠেন রোজ সকালে সে নাকি অপূর্ব্ব দৃশ্য!
তাই দেখতেই তো যায় মানুষ।
আমরা যাবো। আমি, আপনি আর গোবরা। এই তিনজন।
বিকেলের দিকে পৌঁছালাম দার্জিলিঙে। টাইগার পাহাড়ের কাছাকাছি এক হোটেলে ওঠা গেল।
খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত করে হোটেলের মালিককে অনুরোধ করলাম দয়া করে আমাদের কাল খুব ভোরের আগে জাগিয়ে দেবেন….
কেন বলুন তো?
আমরা এক-একটি ঘুমের ওস্তাদ কিনা, তাই বলছিলাম।
ঘুম পাহাড়ও বলতে পারেন আমাদের। বললেন হর্ষবর্ধন যে ঘুম পাহাড় খানিক আগেই পেরিয়ে এসেছি আমরা! তাই আমাদের এই পাহাড়ে ঘুম সহজে ভাঙবার নয় মশাই।
নিজগুণে আমরা ঘুম থেকে উঠতে পারবো না, গোবরাও যোগ দিলো আমাদের কথায় তাই আপনাকে এই অনুরোধ করছি…।
কারণটা জানতে পারি?
কারণ? আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, অদূরে এসেছি কেবল দূর্যোদয় দেখবার জন্য।
সূর্যোদয় দেখবার জন্য? কেন, কলকাতায় কি তা দেখা যায় না? সেখানে কি সূর্য ওঠে না নাকি?
উঠবে না কেন, কিন্তু দর্শন মেলে না। চারধারেই এমন উঁচু.উঁচু সব বাড়িঘর যে, সূয্যি ঠাকুরের ওটা নামার খবর টের পাবার জো নেই।