গভীর বনের ভেতরে পা বাড়াতে প্রথমেই যে এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা করল সে কোন বাঘ নয়, বাঘের বাচ্চাও না–আস্ত একটা কোলা ব্যাঙ।
ব্যাঙ দেখে হর্ষবর্ধন ভারী খুশি হলেন, বললেন, এটা শুভ লক্ষণ। ব্যাঙ ভারী পয়া, জানিস গোবরা?
মা লক্ষ্মীর বাহন বুঝি?
সে তা প্যাচা। দাদা জানান–কে না জানে।
যা বলেছেন। আমি ওঁর কথায় সায় দিই যতো পঁাচাল লোকই হচ্ছে মা লক্ষ্মীর বাহন। প্যাঁচ কষে টাকা উপায় করতে হয়, জান না ভাই?
তাহলে ব্যাঙ বুঝি সিদ্ধিদাতা গণেশের…, না…না বলে গোবরা নিজেই শুধরে নেয়–সে তো হলো গে ইঁদুর।
আমি পয়া বলেছি কারো বাহন টাহন বলে নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতায়। আমরা প্রথম যখন কলকাতায় আসি, তোর মনে নেই গোবরা? ধরমতলায় একটা মানিব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিলাম?
মনে আছে। পেয়েই তুমি সেটা পকেটে লুকিয়ে ফেলেছিলে, পাছে কারো নজরে পড়ে। তারপর বাড়ি এসে খুলে দেখতে গিয়ে দেখলে
দেখলাম যে চারটে ঠ্যাং। মনিব্যাগের আবার ঠ্যাং কেন রে? তার পরে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখি কি, ওমা, ট্রামগাড়ির চাকার তলায় পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ব্যাঙ একটা।
আর কিছুতেই খোলা গেল না ব্যাগটা।
গেল না বটে, কিন্তু তার পর থেকেই আমাদের বরাত খুলে গেল। কাঠের কারবারে কেঁপে উঠলাম আমরা। আমরা এখানে টাকা উড়িয়ে দিতে এসেছিলাম, কিন্তু টাকা কুড়িয়ে থই পাই না তারপর।
ব্যাঙ তাহলে বিশ্বকর্মার বাহন হবে নির্ঘাত। গোবরা ধারণা করে; যত কারবার আর কারখানার কর্তা ঐ ঠাকুরটি তো। কী বলেন মশাই আপনি? ব্যাঙ বিশ্বকর্মার বাহনই তো বটে?
ব্যাঙ না হলেও ব্যাঙ্ক তো বটেই। বিশ্বের কর্মীদের সহায়ই হচ্ছে ঐ ব্যাঙ্ক। আর বিশ্বকর্মাদের বাহন বোধহয় ওই ওয়ার্ড ব্যাঙ্ক।
ব্যাঙ থেকেই ব্যাঙ্ক। একই কথা। হর্ষবর্ধন উচ্ছ্বসিত হন।ব্যাঙ থেকেও আমার আমদানি, আবার ব্যাঙ্ক থেকেও।
ব্যাঙটাকে দেখে একটা গল্পের কথা মনে পড়ল। আমি বলি–জামপিং ফ্রগের গল্প। মার্ক টোয়েনের লেখা। ছোটবেলায় পড়েছিলাম গল্পটা।
মার্ক টোয়েন মানে? হর্ষবর্ধন জিজ্ঞেস করেন।
এক লেখকের নাম। মার্কিন মুলুকের লেখক।
আর জামপিং ফ্রগ? গোবরার জিজ্ঞাস্য।
জামপিং মানে লাফান, আর ফ্রগ মানে হচ্ছে ব্যাঙ। মানে যে ব্যাঙ কিনা লাফায়।
লাফিং ফ্রগ বলুন তাহলে মশাই।
তাও বল যায়। গল্পটা পড়ে আমার হাসি পেয়েছিল তখন। তবে ব্যাঙের পক্ষে ব্যাপারটা তেমন হাসির হয়েছিল কিনা আমি জানি না। গল্পটা শুনুন এবার। মার্ক টোয়েনের সময়ে সেখানে, ঘোড়দৌড়ের মতন বাজি ধরে ব্যাঙের দৌড় হোত। লাফিয়ে লাফিয়ে যে ব্যাঙ যার ব্যাঙ আর সব ব্যাঙকে টেক্কা দিতে পারত সেই মারত বাজি। সেইজন্যে করত কি, অরন্য সব ব্যাঙকে হারাবার মতলবে যাতে তারা তেমন লাফাতে না পারে লাফিয়ে লাফিরে এগিয়ে যেতে হবে তো–সেইজন্য সবার আড়ালে এক একটাকে ধরে পাথর কুঁচি খাইয়ে বেশ ভারি করে দিত কেউ কেউ।
খেত ব্যাঙ সেই পাথর কুঁচি?
অবোধ বালক তো। যাহা পায় তাহাই খায়।
আমার বিশ্বাস হয় না। হর্ষবর্ধন ঘাড় নাড়েন।
পরীক্ষা করে দেখলেই হয়। গোবরা বলে:–এই তো পাওয়া গেছে একটা ব্যাঙ-এখন বাজিয়ে দেখা যাক না খায় কি না।
গোবরা কতকগুলো পাথর কুঁচি যোগাড় করে এনে গেলাতে বসল ব্যাঙটাকে। হাঁ করিয়ে ওর মুখের কাছে কুঁচি ধরে দিতেই, কি আশ্চর্য, তক্ষুনি সে গোপালের ন্যায় সুবোধ বালক হয়ে গেল। একটার পর একটা গিলতে লাগল টুপটাপ করে। অনেকগুলো গিলে ঢাউস হয়ে উঠল ওর পেট। তারপর মাথা হেঁট করে চুপচাপ বসে রইল ব্যাঙটা। ভারিক্কি দেহ নিয়ে লাফান দূরে থাক, নড়া চড়ার কোন শক্তি রইল না তার আর।
খেলতো বটে, খাওয়ালিও তো দেখলাম, ব্যাটা এখন হজম করতে পারলে হয়।দাদা বললেন।
খুব হজম হবে। ওর বয়সে কত পাথর হজম করেছি দাদা। গোবরা বলে?
ভাতের সঙ্গে এতদিনে যতো কাঁকর গিলেছি, ছোটখাট একটা পাহাড়ই চলে গেছে আমাদের গর্ভে। হয়নি হজম?
আলবৎ হয়েছে। আমি বলি : হজম না হলে তো যম এসে জমত।
ওই দ্যাখ দাদা। আঁতকে চেঁচিয়ে ওটে গোবরা।
আমরা দেখি। প্রকান্ড একটা সাপ, গোখরোই হবে হয়ত, এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।
চৌকিদার বলে-একটুও নড়বেন না বাবুরা। নড়লেই সাপ এসে ছোবলাবে। আপনাদের দিকে নয়, ব্যাঙটাকে নিতে আসছে ও।
আমরা নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে দেখলাম, তাই বটে। আমাদের প্রতি ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে সে ব্যাঙটাকে এসে আত্মসাৎ করল।
সাপটা এগিয়ে এসে ধরল ব্যাঙটাকে, তারপর এক ঝটকায় লহমার মধ্যে মুখের ভেতর পুরে ফেলল। তারপর গিলতে লাগলো আস্তে আস্তে।
আমরা দাঁড়িয়ে ওর গলাধঃকরণ লীলা দেখতে লাগলাম। গলা দিয়ে পুরুষ্ট ব্যাঙটা তার তলার দিকে চলতে লাগল, খানিকটা গিয়ে থেকে গেল এক জায়গায়, সেইখানেই আটকে রইল, তারপর সাপটা যতই চেষ্টা করুন না, সেটাকে আর নামাতে পারল না। পেটের ভেতর ঢুকে ব্যাঙটা তার পিঠের উপর কুঁজের নত উঁচু হয়ে রইল।
উটকো ব্যাঙটাকে গিলে সাপটা উট হয়ে গেল শেষটায়। তার মুখখানা যেন কেমনতর হয়ে গেল। খুব তীব্র বৈরাগ্য হলেই যেমনটা হয়ে দেখা যায়। ভ্যাবাচাকা মার্কা মুখে সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জবুথবু হয়ে নট-নড়নচড়ন সে পড়ে রইল সেইখানেই।