ভূমিকাটা, দু-একটা উদাহরণের পরে এইভাবে শেষ। পরিশেষে পৌঁছে হর্ষবর্ধন মুখ বাঁকান : জানি, জানি। এ সবই আমার জানা। তুমি আর নতুন কথা আমাকে কি শেখাবে বাপু! তোমার চেয়ে ঢের ভাল ভূমিকা আমি লিখে দিতে পারি। আরে বাপু কে না জানে শ্রীবৎস লিখলেই বীভৎস দিয়ে মেলাতে হয়। কার খোকা আনলেই অমনি ছারপোকাকে আমদানি করতে হবে। গাড়ি ভাড়া করলে ভারি তাড়া না হয়ে আর যায় না! সবাই জানে, তুমি আর বেশি কি বলবে! কিন্তু একপাল ছাগল আর তাদের কান ফাটানো চ্যাঁ–ভ্যাঁর সঙ্গে যদি মেলাতে পারতে তাহলে জানতুম যে হ্যাঁ–তুমি একজন আস্ত জাত কবি। এমন কি তোমাকে আমি কবি অমর মুড়ি-কাঁঠাল বলে মানতেও রাজি ছিলাম।
গোবরা এসে এতক্ষণ পরে উঁকি মারে–কি দাদা? কদুর? বেরুল তোমার কবিতা?
হয়েছে, খানিকটা হয়েছে। দু-ছত্তর তোর বইয়ের ওপর গজিয়েছে, আর দু-ছত্তর আমার মাথায় গজগজ করছে, এখনো খাতায় ছাড়িনি!
দেখি তোমার কবিতা? গোবরা দাদার কাব্য–গঞ্জনা শুনতে উৎসুক হয়।
কিন্তু খাতার দু-লাইন–মুখখানা থ্যবড়া, নাম তার গোবরা দেখেই নিজের মুখের সঙ্গে সে মিলিয়ে দেখে কি না বলা যায় না–গোবরার মুখ কবিতার আরেকটা মিল হয়ে ওঠে–একেবারে গোমড়া হয়ে ওঠে।
আরে এখনি অবাক হচ্ছিস! আরো দু-লাইন আছে–বলছি শোন! হর্ষবর্ধন বাকি পংক্তি গুলোকেও নিজের দন্তপংক্তির সঙ্গে প্রকাশ করে দেন–বাকিটাও শোন তবে–শুনলে খুশিই হবি–
তলায় এক পাল ছাগল!
আর ওপরে এক পাগলা।
এই চার লাইনেই আমার অমরত্বলাভ। আজকের মতো এই যথেষ্ট। কেমন হয়েছে কবিতাটা? এমন কৈআমের সমকক্ষ হয়তো হইনি, কিন্তু ওমর মুড়কিজাম কি বলা যায় না আমায়?
হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার
হর্ষবর্ধনকে আর রোখা গেল না তারপর কিছুতেই! বাঘ মারবার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠলেন।
আরেকটু হলেই তো মেরেছিল আমায়। তিনি বললেন, ওই হতভাগা বাঘকে আমি সহজে ছাড়ছি না।
কি করবে দাদা তুমি বাঘ নিয়ে? পুষবে নাকি?
মারবো ওকে। আমাকে মেরেছে আর ওকে আমি রেহাই দেব তুই ভেবেছিস?
তোমাকে আর মারল কোথায়? মারতে পারল কই?
একটুর জন্যেই বেঁচে গেছি না? মারলে তারা বাঁচাতে পারতিস আমায়?
গোবর্ধন চুপ করে থাকল, সে-কথার কোন জবাব দিতে পারল না।
এই গোঁফটাই আমায় বাটিয়ে দিয়েছে বলতে কি! বলে নিজের গোঁফ দুটো তিনি একটু চুমরে, নিলেন এই গোঁফের জন্যই বেঁচে গেছি আজ! নইলে ওই লোকটার মতই হাল হতো আমার…
মৃতদেহটির দিকে তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করেন–গোঁফ বাদ দিয়ে, বেগোঁফের বকলমে ও তো খোদ আমিই। আমার মতই হুবহু। ও না হয়ে আমিও হতে পারতাম। কি হতো তাহলে বল তো?
এই চৌকিদার! হঠাৎ তিনি হঙ্কার দিয়ে উঠলেন–একটা বন্দুক যোগাড় করে দিতে পার আমায়? যতো টাকা লাগে দেব।
বন্দুক নিয়ে কি করবে বাবু?
বাঘ শিকার করব আবার কি? বন্দুক নিয়ে কী করে মানুষ? বলে আমার প্রতি ফিরলেনঃ আমার এই বীরত্ব-কাহিনীটাও লিখতে হবে আপনাকে। যত সব আজেবাজে গল্প লিখেছেন আমাকে নিয়ে। লোক পড়ে হাসে কেবল। সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে আমি শুনেছি।
তার কি হয়েছে? লিখে দেব আপনার শিকার-কাহিনী। এই বাঘ মারার গল্পটাই লিখে দেব আপনার। কিন্তু তার জন্যে বন্দুক ঘাড়ে এত কষ্ট করে প্রাণপণে বাঘ মারতে হবে কেন? বনে-বাদাড়েই বা যেতে হবে কেন? বাঘ মারতে এত হ্যাঁঙ্গামের কী মানে আছে? বন্দুকের কোন দরকার নেই! সাপ-ব্যাঙ একটা হলেই হলো। কলমের কেরামতিতে সাপ ব্যাঙ দিয়েই বাঘ মারা যায়।
মুখেন মারিতং বাঘং? গোবরা টিপপনি কাটে।
আপনি টাকার কথা বলছেন বাবু! চৌকিদার এতক্ষণ ধরে কী যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিল, মুখ খুলল এবার তা, টাকা দিলে এনে দিতে পারি একটা বন্দুক দু-দিনের জন্য। আমাদের দারোগা সাহেবের বন্দুকটাই চেয়ে আনতে পারি। বাঘের ভারী উদ্রব হয়েছে এধারে মারতে হবে বাঘটাকে– এই বললেই তিনি ওটা ধার দেবেন আমায়। ব্যাভারের পর আবার ফেরত দিয়ে আসব।
শুধু বন্দুক নিয়ে কি করব শুনি? ওর সঙ্গে গুলি-কার্তুজ-টোটা ইত্যাদি এ-সবও তিনি দেবেন তো? নইলে বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে কি বাঘ মারা যায় নাকি? তেমনটা করতে গেলে তার আগেই বাঘ আমায় সাবড়ে দেবে?
তা কি হয় কখনো? বন্দুকের সঙ্গে কার্তুজ-টার্তুজ দেবেন বইকি বাবু।
তাহলে যাও, নিয়ে এসো গে চটপটা। বেশি দেরি কোর না। বাঘ না– মেরে নড়ছি না আমি এখান থেকে। জলগ্রহণ করব না আজ।
না না, বন্দুকের সঙ্গে কিছু খাবার টাবার নিয়ে এসো ভাই।
আমি বাতলাইঃ খালি পেটে কি বাঘ মারা যায়? আর কিছু না হোক, একটু গাঁজা খেতে হবে অন্তত।
আনব নাকি গাঁজা? সে শুধায়।
গাঁজা হলে তো বন্দুকের দরকার হয় না। বনে-বাদাড়েও ঘুরে মরতে হয় না। বন্দুকের বোঝা বইবারও কোন প্রায়াজন করে না। বসেই বাঘ মারা যায় বেশ। আমি জানাই।
না না গাঁজা-ফাঁজা চাই না। বাবু ইয়ার্কি করছে তোমার সঙ্গে। তুমি কিছু রুটি মাখন বিস্কটু চকোলেট এইসব এনো, পাও যদি। গোবরা বলে দেয়।
বন্দুক এলে হর্ষবর্ধন শুধাল–কি করে বাঘ মারতে হয় আপনি জানেন?
বাগে পেলেই মামা যায়। কিন্তু বাগেই পাওয়া যায় না ওদের। বাগে পাবার চেষ্টা করতে গেলে উলটে নাকি বাঘেই পায়।
বনের ভিতরে সেঁধুতে হবে বাবু। চৌকিদার জানায়।