ওষুধ নিয়ে চলে গেলাম আমি মাংসের দোকানে। সেখানে একটা আস্ত পাঠা কিনে তার পেটের মধ্যে ঘুমের ওষুধের সবটা দিলাম সেঁধিয়ে,–তার পরে পাঁঠাটিকে নিয়ে জঙ্গল আর শহরতলীর সঙ্গমস্থলে গেলাম। নদীর ধারে জল খাবার জায়গায় রেখে দিয়ে এলাম পাঁঠাটাকে। জল খেতে এসে জলখাবার পেলে বাঘটা কি আবার না খাবে?
ভোর না হতেই সঙ্গমস্থলে গেছি– বাঘাটার জলযোগের জায়গায়। গিয়ে দেখি অপূর্ব্ব দৃশ্য। ছাগলটার খালি হাড় কখানাই পড়ে আছে, আর তার পাশে লম্বা হয়ে শুয়ে রয়েছেন আমাদের বাঘা মলে। গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।
ঈস, কি ঘুম। রাস্তায় কোনো পাহারাওয়ালা কি পরীক্ষার্থী কোনো ছাত্রকেও এমন ঘুম ঘুমুতে দেখি নি!
বাঘটার আমি গায়ে হাত দিলাম, ল্যাজ ধরে টানলাম একবার। একেবারে নিঃসাড়। খাবার নখগুলো, গুণলাম, কোনো সাড়া নেই। তার গোঁফ চুমরে দিলাম, পিঠে হাত বুলোলাম-পেটে খোঁচা মারলাম–তবুও উচ্চবাচ্য নেই কোনো!
অবশেষে সাহাস করে তার গলা টিপলাম। আদর করলাম একটু। কিন্তু তার গালে আমার টিপসই দিতেও বাঘটা নড়লো না একটুও।
আরো একটু আদর দেখাবো কিনা ভাবছি। আদরের আরো একটু এগুবো মনে করছি, এমন সময়ে বাঘটা একটা হাই তুললো।
তার পরে চোখ খুললো আস্তে আস্তে।
হাই তুলতেই আমি একটা হাই জাম্প দিয়েছিলাম পাঁচ হাত পিছনে। চোখ খুলতেই আমি ভোঁ দৌড়। অনেক দূর গিয়ে দেখি উঠে আলস্যি ছাড়ছে– আড়মোড়া ভাঙছে; গা-হাত-পা খেলিয়ে নিচ্ছে একটু। ডন-বৈঠক হয়েতো সেটা, ওই রকমের কিছু একটা হতে পারে। কী যে-তা শুধু ব্যায়ামবীরেরাই বলতে পারেন।
তারপর ডন-বৈঠক ভেঁজে বাঘটা চারধারে তাকালো। তখন আমি বহুৎ দূরে গিয়ে পড়েছি, কিন্তু গেলে কি হবে, বাঘটা আমরা তাক পেলো ঠিক। আর আমিও তাকিয়ে দেখলাম তার চাউনি। অত দূর থেকেও দেখতে পেলাম। আকাশের বিদ্যুঝলক যেমন দেখা যায়। অনেক দূর থেকেও সেই দৃষ্টি–সে কটাক্ষ ভুলবার নয়।
বাঘটা গুঁড়ি এগুতে লাগলে আমার দিকে। আমারো দৌড় বেড়ে গেল আরো–আরোও।
গুড়ি গুঁড়ির থেকে ক্রমে তুড়ি লাফ বাঘটার।
আর আমি? প্রতি মুহূর্তের তখন হাতুড়ির ঘা টের পাচ্ছি আমার বুকে।
বাঘটাও আসছে–আমিও ছুটছি বাঁচবার আশায়। ছুটছি প্রাণপণ… বলতে বলতে আমি থামলাম দম নিতেই থামলাম একটু।
তারপর? তারপর? তারপর?…. আড্ডার চারজনার হসপ্রশ্ন। বাঘের সম্মুখে পড়ে বিকল অবস্থায় আমি যাই যাই, কিন্তু তাদের মার্জনা নেই। তারা দম দিতে ছাড়ছেন না।
ছুটতে ছুটতে আমি এসে পড়েছি এক খাদের সামনে। অতল গভীর খাদ। তার মধ্যে পড়লে আর রক্ষে নেই সাততলার ছাদ থেকে পড়লে যা হয় তাই একদম ছাতু। পিছনে বাঘ, সামনে খাদ–কোথায় পালাই? কোনদিকে যাই?
দারুণ সমস্যা। এধারে খাদ, ওধারে বাঘ–ওধারে আমি খাদ্য আর এধারে আমি বরবাদ!
কি করি? কী করি? কী যে করি?
ভাবতে ভাবতে বাঘটা আমার ঘাড়ের ওপর এসে পড়লো।
অ্যাঁ?
হ্যাঁ। বলে আমি হাঁফ ছাড়লাম। এতখানি ছুটোছুটির পর কাহিল হয়ে পড়েছিলাম।
তারপর? তারপর কী হলো?
কি আবার হবে? যা হবার তাই হলো। আমি বললাম : এ রকম অবস্থায় যা হয়ে থাকে। আমার গপপো শেষ হলো সেইখানেই।
কি করলো বাঘটা? তবু তারা নাছোড়বান্দা।
বাঘটা? আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম : কী আর করবে? বাঘটা আমায় গিলে ফেললো গল্প করে।
আমার ভালুক শিকার
তোমরা আমাকে গল্প-লেখক বলেই জানো। কিন্তু আমি যে একজন ভাল শিকারী এ খবর নিশ্চয়ই তোমাদের জানা নেই। আমি নিজেই এ কথা জানতাম না, শিকার করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।
আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, কোথায় নাকি দশ-বারো বছরের ছেলেরা, দশ-বারো হাত বাঘ শিকার করে ফেলেছে। আজকের ৭ই জুলাইয়ের খবরের কাগজেই তোমরা দেখবে একটা সাত বছরের ছেলে ন ফিট বাঘ সাবাড় করে দিয়েছে। বাঘটার উপদ্রবে গ্রামসুদ্ধ লোক ভীত, সস্ত্রস্ত। কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। ভগ্যিস সেখানকার তালুকদারের একটা ছেলে ছেলে ছিল এবং আরো সৌভাগ্যের কথা যে বয়স ছিল মোটে বছর সাত, তাই গ্রামবীসাদের বাঘের কবল থেকে এত সহজে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হলো।
তোমরা হয়ত বলবে যে, ছেলেটার ওজনের চেয়ে বন্দুকের ওজনই যে ভারী। তা হতে পরে, তবু এ কথা আমি অবিশ্বাস করি না, বিশেষ করে যখন খবরের কাগজে ছাপার অক্ষরে নিজের চোখে দেখেছি। আমার ভালুক শিকারের খবরটাও কাগজে দেখেছিলাম তারপর থেকেই তা ঘটনাটায় আমার দারুণ বিশ্বাস হয়ে গেছে। প্রথমে আমি ধারণা করতেই পারিনি যে আমিই ভালুকটাকে মেরেছি, এবং ভালুকটারও মনে যেন সেই সন্দেহ বরাবর ছিল মনে হয়, মরার আগে পর্যন্ত। কিন্তু যখন খবরের কাগজে আমার শিকার কাহিনী নিজে পড়লাম, তখন নিজের কৃতিত্ব সম্বন্ধে অমূলক ধারণা আমার দূর হলো। ভালুকটার সন্দেহ বোধকরি শেষ অবধি থেকেই গেছল, কেন না খবরের কাগজটা চোখে দেখার পর্যন্ত তার সুযোগ হয়নি–কিন্তু না হোক, সে নিজেই দূর হয়ে গেছে।
সেই রোমাঞ্চকর ঘটনাটা এবার তোমাদের বলিঃ আমার মাসতুতো বড়দা সুন্দরবনের দিকে জমি-টমি নিয়ে চাষ-বাস শুরু করেছেন। সেদিন তাঁর চিঠি গেলাম–এবার গ্রীষ্মটা এ ধারেই কাটিয়ে যাও না, নতুন জীবনের আস্বাদ পাবে অভিজ্ঞতাও বেড়ে যাবে অনেক।
সঙ্গে করে কিছুই আনতে হবে না, কয়েক জোড়া কাপড় এনো!