আরেকবার বাঘটা একটা গ্রামোফোনের দোকান ফাঁক করলো। রেডিয়োসেট, লাউডস্পীকার, গানের রেকর্ড যা ছিলো, এমন কি পিনগুলি পর্যন্ত সব হজম, সে সবের আর কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না।
আমি যেদিন পৌঁছালাম সেদিন সে এক খাবারের দোকান সাবাড় করেছিল। সন্দেশ-রসগোল্লার ছিটেফোঁটাও রাখে নি, সব কাবার! এমন কি, অবশেষে সন্দেশওয়ালার পর্যন্ত ট্রেস পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তক্ষুনি বাঘটার আশ্চর্য খাদ্যরুচির খবরটা তারযোগে কলকাতায় কাগজে পাচার করে দিলাম।
আর, এই খবরটা রটনার পরেই দুর্ঘটানটা ঘটলো। চিড়িয়াখানার কর্তা লিখলেন আমাকে আমি বা গৌহাটির কেউ যদি অদ্ভুত বাঘটাকে হাতে হাতে ধরতে পারি–একটুও হতাহত না করে– আর আস্ত বাঘটাকে পাকড়াও করে প্যাক করে পাঠাতে পারি তা হলে তারা প্রচুর মূল্য আর পুরস্কার দিয়ে নিতে প্রস্তুত আছেন।
আর হ্যাঁ, পুরক্ষারের অঙ্কটা সত্যিই লোভজনক–বাঘটা যতই আতঙ্কজনক হোক না! যদিও হাতহত না করে এবং না হয়ে খালি হাতাহাতি করেই বাঘটাকে হাতেনো যাবে কি না সেই সমস্যা।
খবরটা ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। গৌহাটি বড় বড় বাঘ শিকারী উঠে পড়ে লাগলেন বাঘটাকে পাকড়াতে।
এখানে বাঘাবার কায়দাটা একটু বলা যাক। বাঘরা সাধারণত জঙ্গলে থাকে, জানেন, নিশ্চয়? কোন কিছু বাগাতে হলেই তারা লোকালয়ে আসে। শিকারীরা করে কি, আগে গিয়ে জঙ্গলে মাচা বেঁধে রাখে। আর সেই মাচার কাছাকাছি একটা একটা গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তের ওপর জাল পেতে রাখা হয়। জালের ওপরে জ্বালা! আবার শুকনো লতাপাতা, খড়কুটো বিছিয়ে আরো জালিয়াতি করা হয় তার ওপর, যাতে বাঘটা ঐ পথে ভ্রমণ করতে এলে পথ ভ্রমে ঐ ছলনার মধ্যে পা দেয়–ফাঁদের মধ্যে পড়ে, নিজেকে জলাঞ্জলি দিতে একটুও দ্বিধা না করে।
অবশ্যি, বাঘ নিজগুণে ধরা না পড়লে, নিজের দোষে ঐ প্যাঁচে পা না দিলে অক্ষত তাকে ধরা একটু মুশকিলই বইকি! তখন সেই জঙ্গল ঘেরাও করে দলকে দল দারুণ হৈ চৈ বাধায়। জঙ্গলের চারধার থেকে হট্টগোল করে, তারা বাঘটাকে তাড়া দেয়, তাড়িয়ে তাকে সেই অধঃপতনের মুখে ঠেলে নিয়ে আসে। সেই সময়ে মাচায় বসা শিকারী বাঘটাকে গুলি করে মারে। নিতান্তই যদি বাঘটা নিজেই গর্তে পড়ে, হাত-পা ভেঙে না মারা পড়ে তা হলেই অবশ্যি।
তবে বাঘ এক এক সময়ে গোল করে বসে তাও ঠিক। ভুলে গর্তের মধ্যে না পড়ে ঘাড়ের ওপরে এসে পড়ে–শিকারীর ঘাড়ের ওপর। তখন আর গুলি করে মারার সময় থাকে না, বন্দুক দিয়েই মারতে হয়। বন্দুক, গুলি, কিল, চড়, ঘুষি–যা পাওয়া যায় হাতের কাছে তখন। তবে কিনা, কাছিয়ে এসে বাঘ এ সব মারামারির তোয়াক্কাই করে না। বিরক্ত হয়ে বন্দুকধারীকেই মেরে বসে এক থাবড়াতেই সাবাড়ে দেয়। কিন্তু পারতপক্ষে বাঘকে সেরকমের সুযোগ দেওয়া হয় না–দূরে থাকতেই তার বদ-মতলব গুলিয়ে দেওয়া হয়।
এই হলো বাঘাবার সাবেক কায়দা। বাঘ মারো বা ধরো যাই করো–তার সেকেলে সার্বজনীন উৎসব হলো এই। গৌহাটির শিকারীরা সবাই এই ভাবেই বাঘটাকে বাগাবার তোড়জোড়ে লাগলেন।
আমি সেখানে একা। আমার লোকবল, অর্থবল, কিছুই নেই। সদলবলে তোড়জোড় করতে হলে টাকার জোর চাই। টাকার তোড়া নেই আমার। তবে হ্যাঁ, আমার মাথার জোড়াও ছিল না। বুদ্ধি-বলে বাঘটাকে বাগানো যায় কিনা আমি ভাবলাম।
চলে গেলাম এক ওষুধওয়ালার দোকানে–বললাম–দিন তো মশাই, আমায় কিছু ঘুমের ওষুধ।
কার জন্যে?
ধরুন, আমার জন্যেই। যাতে অন্ততঃ চব্বিশ ঘন্টা অকাতরে ঘুমানো যায় এমন ওষুধ চাই আমার।
বাঘের জন্যে চাই চেটা আর আমি বেফাঁস করতে চাইলাম না। কি জানি, যদি লোক-জানাজানি হয়ে সমস্ত প্ল্যানটাই আমার ভেস্তে যায়। তারপর গুজব যদি একবার রটে যায় হয়তো সেটা বাঘের কানেও উঠতে পারে, বাঘটা টের পেয়ে হুসিয়ার হয়ে যায় যদি?
তা ছাড়া, আমাকে কাজ সারতে হবে সবার আগে, সবচেয়ে চটপট, আর সকলের অজান্তে। দেরি করলে পাছে আর কেউ শিকার করে ফেলে বা বাঘটা কোন কারণে কিংবা মনের দুঃখে নিজেই আত্মহত্যা করে বসে তা হলে দাওটা ফসকে যাবে সেই ভয়টাও ছিল।
ওষুধ হাতে পেয়ে তারপর আমি শুধালাম–একজন মানুষকে বেমালুম হজম করতে একটা বাঘের কতক্ষণ লাগে বলতে পারেন?
ঘন্টা খানেক। হ্যাঁ, ঘন্টাখানেক তো লাগবেই।
আর বিশ জন মানুষ?
বিশ জন? তা দশ-বিশটা মানুষ হজম করতে অন্তত ঘন্টা তিনেক লাগা উচিত–অবশ্যি, যদি তার পেটে আঁটে তবেই। জানালেন ডাক্তারবাবু। তবে কিনা, এত খেলে হয়তো তার একটু বদ হজম হতে পারে। চোয়া ঢেকুর উঠতে পারে এক-আধটা।
তাহলে বিশ ইনটু তিন, ইনটু আট–মনে মনে আমি হিসেব করি–হলো চারশ আশি। একটা বাঘের হজম শক্তি ইজ ইকোয়াল টু চারশ আশিটা মানুষ। তার মানে চারশ আশি জনার হজম-শক্তি। আর হজমশক্তি ইজ ইকোয়াল টু ঘুমোবার ক্ষমতা।
মনে মনে অনেক কষাকষি করে, আমি বলি–আমাকে এই রকম চারশ আশিটা পুরিয়া দিন তো। এই নিন শষুধের টাকা। পুরিয়ার বদলে আপনি একটা বড় প্যাকেটও পুরে দিতে পারেন।
ডাক্তারবাবু ওষুধটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এর সবটা খেতে চান খান, আমার আপত্তি নেই। তবে আপনাকে বলে দেওয়া উচিত যে এ খেলে যে প্রগাঢ় ঘুম আপনার হবে তা ভাঙবার ওষুধ আমাদের দাবাই খানায় নেই। আপনার কোনো উইল-টুইল করবার থাকলে করে খাবার আগেই তা সেরে রাখবেন এই অনুরোধ।